alt

উপ-সম্পাদকীয়

ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসবে কিভাবে

রেজাউল করিম খোকন

: বুধবার, ৩১ মে ২০২৩

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের হারে শীর্ষে রয়েছে শ্রীলঙ্কা। দেশটির খেলাপি ঋণ প্রায় ১১ শতাংশ। এরপরই অবস্থান বাংলাদেশের, খেলাপি ঋণ প্রায় ৯ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম খেলাপি ঋণের দেশ নেপাল। দেশটির খেলাপি ঋণ ২ শতাংশের কম। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের খেলাপি ঋণ বাড়ছে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের আঞ্চলিক অর্থনৈতিক আপডেটে এসব কথা বলা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- উচ্চ আমদানি ব্যয়, ঋণগ্রহীতাদের নিয়মিত ঋণ পরিশোধ না করা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বল তদারকি ব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ বাড়ছে।

কিছু বেসরকারি ব্যাংকের এক-দু’জন পরিচালক একাই ব্যাংক চালাচ্ছেন। এসব ব্যাংকে কোনো সুশাসন নেই। এর প্রভাবে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, আরও বাড়বে। কোনো খেলাপি ঋণ গোপন করলে তা আরও বড় সংকট হয়ে দেখা দেবে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তদারকি ও পরিদর্শন ব্যবস্থা কঠোর করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকই পারে বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় সুশাসন ফেরাতে। সরকারি ব্যাংক ও খেলাপি ঋণ এক সময় একসূত্রে গাঁথা ছিল। এ প্রবণতা এখন ছড়িয়ে পড়েছে বেসরকারি ব্যাংকে। বিশেষ করে যেসব বেসরকারি ব্যাংক এক পরিবারের নিয়ন্ত্রণে, সেই ব্যাংকগুলোয় বেশি অনিয়ম হচ্ছে। এসব ঋণ ধীরে ধীরে খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। অন্যদিকে ঋণ আদায় না হওয়ায় বেসরকারি খাতের অনেক ব্যাংক তারল্য সংকটে ঋণগছে। অন্য ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে ও বেশি সুদে আমানত নিয়ে দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। নতুন ব্যাংকগুলোতেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে রাষ্ট্র খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা। অথচ এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংককে চলতি বছরের জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণ ১২ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত এক দশকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। গত এক দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, খেলাপি ঋণ কমানোর কার্যকর কোনো উদ্যোগ আসলে ছিল না। বরং সরকার বিভিন্ন সময় ঋণখেলাপিদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে।

সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পাশ কাটিয়ে এ ধরনের নীতি নিলেও তা কার্যকর করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর তা বাস্তবায়ন করেছে সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংক। এ অবস্থায় খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যাংকারদের দৃঢ়তা ও সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন।

ঋণখেলাপিদের ধরার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংকগুলোর হাতে পুরো ক্ষমতা থাকা উচিত। কোনো গ্রাহকের মুখ দেখে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। তাহলে প্রভাবশালীরা ছাড় পাবে না। পাশাপাশি অর্থঋণ আদালতে বিচারক, বেঞ্চ বাড়ানোসহ আইনি কাঠামো জোরদার করতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। তাহলে খেলাপিদের মধ্যে কিছুটা হলেও ভয় কাজ করবে। খেলাপি ঋণ কমাতে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

অনেকে ব্যাংক খাতের জন্য কমিশন গঠনের কথা বলছেন, এটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। সামনে ব্যাংকের জন্য যে পরিমাণ মূলধন প্রয়োজন হবে এবং অর্থ পাচার প্রতিরোধ সংক্রান্ত আইনকানুন পরিপালনের শর্ত আসছে, তাতে কতগুলো ব্যাংক টিকতে পারবে, তা সময়ই বলে দেবে। ব্যাংকগুলোর দৈনন্দিন কাজে মালিকদের হস্তক্ষেপ রয়েছে- এমন অভিযোগ অনেক দিনের। বাংলাদেশে ব্যাংকগুলোর মালিকানা কাঠামো ভারতের মতো নয়। অনেক দেশে বাংলাদেশের মতো ব্যবসায়ী ও করপোরেট গ্রুপ ব্যাংকের মালিক হতে পারেন না। বাংলাদেশে এমন কাঠামো ৩০ থেকে ৪০ বছর ধরে চলে আসছে। এটা রাতারাতি ঠিক হবে না।

দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ- এই দুই দেশ বাদে সবাই খেলাপি ঋণ ক্রমান্বয়ে কমাচ্ছে। বাকি দেশগুলো মূলত আইনের কঠোর বাস্তবায়ন, নজরদারি বৃদ্ধি, শাস্তি প্রদান, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা না দেয়া, প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিতে খেলাপি ঋণ আদায় এবং দুর্বল ব্যাংক বন্ধ বা অন্যের সঙ্গে একীভূত করেই খেলাপি ঋণ কমিয়ে এনেছে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি বিষয়টি ভারত ও পাকিস্তান ছাড়া বিশ্বের আর কোনো দেশের আইনে নেই। নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধ না করলে সবাই ঋণখেলাপি। তবে কী কারণে ঋণ পরিশোধ করা যায়নি, তা নির্ধারণ করেন আদালত।

উন্নত দেশগুলোতে খেলাপি ঋণসংক্রান্ত আইনকানুন অত্যন্ত কঠোর। খেলাপি হলে আদালতে যেতে হয়, সেখানে মামলা ঝুলেও থাকে না। আদালতের রায়ে একবার খেলাপি সাব্যস্ত হলে স্বাভাবিক জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়ে। নানা ধরনের বিধিনিষেধ আসে। সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়া অনুযায়ী ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো সম্মাননা পাবেন না, কোনো সংগঠনের পদে থাকতে পারবেন না, নিষেধাজ্ঞা থাকবে বিদেশ ভ্রমণ, গাড়ি-বাড়ি নিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্স এবং কোম্পানি নিবন্ধনে। যারা খেলাপি হচ্ছে, তাদের কোনো শাস্তি এ দেশে হচ্ছে না, যেসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেশি, সেই ব্যাংকও কোনো শাস্তির আওতায় আসছে না।

ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত পূরণের জন্যই। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য এর কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তারা মনে করেন, রাজনৈতিক অঙ্গীকার না থাকলে শেষ পর্যন্ত প্রভাবশালী খেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া যাবে না। যারা খেলাপি হচ্ছে, তাদের কোনো শাস্তি এ দেশে হচ্ছে না। যেসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেশি, সেই ব্যাংকও কোনো শাস্তির আওতায় আসছে না। আবার ঋণ পুনর্গঠন, পুনঃতফসিল, স্থগিতাদেশের নামে অনেক ঋণের প্রকৃত তথ্য গোপন করা হচ্ছে। ফলে দেশে খেলাপি ঋণ আসলে কত, তা অজানা রয়ে যাচ্ছে না। খেলাপি ঋণ কমাতে হলে আগে প্রকৃত খেলাপিদের চিহ্নিত করতে হবে। এরপর আইনি ব্যবস্থা জোরদার করে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। কিছুদিন পরপর খেলাপিদের ছাড় দিতে যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়, তা বন্ধ করে দিতে হবে।

ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) আয়োজিত সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, দেশের ব্যাংক খাতের অস্বস্তির বিষয় খেলাপি ঋণ। এটা কমাতে ব্যাংকের শীর্ষ ব্যবস্থাপনায় যারা আছেন, তাদের বিশেষ করে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে দায়িত্ব নিতে হবে। শীর্ষ কর্তারা শক্তভাবে পদক্ষেপ নিলে দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের সমস্যা কমে আসবে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ‘দূরদর্শী নীতিমালা’ প্রণয়নের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আরও বলেন, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমানো ও করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করতে ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। এটা করতে হলে আলাদা করে পরিকল্পনা করতে হবে এবং কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

এর আগে এবিবি এক সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিল, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা এককভাবে ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব নয়। এ কাজের জন্য সামাজিক প্রতিশ্রুতি দরকার। খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে আইনি ব্যবস্থা কঠোর করতে হবে এবং এ খাতে লোকবল বাড়াতে হবে। খেলাপি ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানামুখী পদক্ষেপ অব্যাহত আছে। ব্যাংকার, পরিচালনা পর্ষদ ও বাংলাদেশ ব্যাংক তিন পক্ষকেই খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে হবে। প্রকৃত খেলাপি ঋণ কত, তা প্রকাশ করতে হবে। খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা এককভাবে ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব নয়। ব্যাংকার, পরিচালনা পর্ষদ ও বাংলাদেশ ব্যাংক তিন পক্ষকেই খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে হবে। এখন প্রশ্ন উঠছে, কে করবে এ পরিকল্পনা, কে আনবে ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন?

সরকারি ব্যাংক ও খেলাপি ঋণ এক সময় একসূত্রে গাঁথা ছিল। এ প্রবণতা এখন ছড়িয়ে পড়েছে বেসরকারি ব্যাংকে। বিশেষ করে যেসব বেসরকারি ব্যাংক এক পরিবারের নিয়ন্ত্রণে, সেই ব্যাংকগুলোয় বেশি অনিয়ম হচ্ছে

গত জানুয়ারিতে আইএমএফ বাংলাদেশকে যে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে, তার অন্যতম শর্ত ছিল ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার কমাতে হবে। বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের দৌরাত্ম্য কমাতে সরকার আইন সংশোধনের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা অনেকটা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার শামিল। অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন আনা হলেও ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটেনি। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে এখনো রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি কাজ করে।

বহির্বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের তেমন করণীয় না থাকলেও তারা অন্তত আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কঠোর অবস্থান নিতে পারে। ঋণগ্রহীতারা যদি নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে ভাবেন কিংবা হাজার হাজার কোটি টাকার খেলাপি হয়েও পার পেয়ে যান, সরকারের কোনো আইন ও পদক্ষেপই কাজে আসবে না।

এটা ঠিক, রাজনৈতিক প্রভাবে ব্যাংকিং খাত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আর্থিক খাত হলো দেশের প্রাণ, এটাকে নষ্ট করা মানে নিজেদের দুর্ভোগ ডেকে আনা। জনগণের বাজেটের টাকা দিয়ে ব্যাংকের মূলধন জোগান দেয়া হচ্ছে কিন্তু ব্যাংকিং খাতকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা হচ্ছে না। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের চাপে কখনো কখনো এ খাতে কিছু সংস্কার দেখা গেলেও স্থায়ী কোনো সংস্কার এ পর্যন্ত চোখে পড়েনি। তবু আশায় আছি, সরকার কোনো না কোনো সময় ব্যাংকগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে সংসদে আইন পাস করার উদ্যোগ গ্রহণ করবে। প্রকৃত খেলাপি ঋণ কত, তা প্রকাশ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে সততা, বিচক্ষণতা ও সাহসের সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে ব্যাংক খাত তদারকি করতে হবে। দোষীদের শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। তাহলেই খেলাপি ঋণ কমবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ

ধর্মভিত্তিক জোট কোন পথে

ছবি

বিদায় অগ্নিকন্যা

রিমান্ড সংস্কৃতি : আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে একটি মানবাধিকার পরিপ্রেক্ষিত

ছবি

ডেঙ্গুজ্বর : সচেতনতার বিকল্প নেই

ছবি

উন্নয়ন ও পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য রাখা কেন জরুরি

ছবি

মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ম-ল

নদীর প্রাণ শুশুক, নিরাপদে বেঁচে থাকুক

ভবন নির্মাণ ও বিল্ডিং কোড

রম্যগদ্য : গণতন্ত্রের গলিতে গলিতে হিটলার

রাষ্ট্র সংস্কার ও আদিবাসী

রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুতে সংবিধান ও অতীত-ইতিহাস

শিক্ষাকে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করার উপায়

দিবস যায় দিবস আসে, নিরাপদ হয় না সড়ক

‘ক্ষুদ্রতার মন্দিরেতে বসায়ে আপনারে আপন পায়ে না দিই যেন অর্ঘ্য ভারে ভারে’

একাকিত্ব : নিজেকে আবিষ্কার ও সৃজনশীলতা বিকাশের পথ

লাগামহীন দ্রব্যমূল্য

বাঁশের বংশবৃদ্ধিতে অন্তরায় বাঁশকরুল সংগ্রহ

একতার অভাবে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে করণীয়

শিক্ষা খাতে দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব

কোন পথে জামায়াতের রাজনীতি?

শ্রমিকের উন্নয়ন ছাড়া গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব নয়

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির ভূমিকা

ডিমের জারিজুরি

যোগ্য নেতৃত্ব সমাজ-সংগঠনকে এগিয়ে নেয়

ব্যক্তি স্বাধীনতার সংকট

কিল মারার গোঁসাই

ছবি

শেকড়ের সন্ধানে সাঁইজির ধামে

বৈষম্যের অন্ধকারে নিমজ্জিত প্রকৌশল শিক্ষার আরেক জগৎ

প্রশাসনিক সংস্কারে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা কতটা প্রতিষ্ঠা পাবে?

বাংলার মৃৎশিল্প

প্রবারণা পূর্ণিমার আলোয় আলোকিত হোক মানবজাতি

খেলাপি ঋণের অপসংস্কৃতি

কথার কথা যত কথা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসবে কিভাবে

রেজাউল করিম খোকন

বুধবার, ৩১ মে ২০২৩

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের হারে শীর্ষে রয়েছে শ্রীলঙ্কা। দেশটির খেলাপি ঋণ প্রায় ১১ শতাংশ। এরপরই অবস্থান বাংলাদেশের, খেলাপি ঋণ প্রায় ৯ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম খেলাপি ঋণের দেশ নেপাল। দেশটির খেলাপি ঋণ ২ শতাংশের কম। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের খেলাপি ঋণ বাড়ছে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের আঞ্চলিক অর্থনৈতিক আপডেটে এসব কথা বলা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- উচ্চ আমদানি ব্যয়, ঋণগ্রহীতাদের নিয়মিত ঋণ পরিশোধ না করা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বল তদারকি ব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ বাড়ছে।

কিছু বেসরকারি ব্যাংকের এক-দু’জন পরিচালক একাই ব্যাংক চালাচ্ছেন। এসব ব্যাংকে কোনো সুশাসন নেই। এর প্রভাবে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, আরও বাড়বে। কোনো খেলাপি ঋণ গোপন করলে তা আরও বড় সংকট হয়ে দেখা দেবে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তদারকি ও পরিদর্শন ব্যবস্থা কঠোর করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকই পারে বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় সুশাসন ফেরাতে। সরকারি ব্যাংক ও খেলাপি ঋণ এক সময় একসূত্রে গাঁথা ছিল। এ প্রবণতা এখন ছড়িয়ে পড়েছে বেসরকারি ব্যাংকে। বিশেষ করে যেসব বেসরকারি ব্যাংক এক পরিবারের নিয়ন্ত্রণে, সেই ব্যাংকগুলোয় বেশি অনিয়ম হচ্ছে। এসব ঋণ ধীরে ধীরে খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। অন্যদিকে ঋণ আদায় না হওয়ায় বেসরকারি খাতের অনেক ব্যাংক তারল্য সংকটে ঋণগছে। অন্য ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে ও বেশি সুদে আমানত নিয়ে দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। নতুন ব্যাংকগুলোতেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে রাষ্ট্র খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা। অথচ এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংককে চলতি বছরের জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণ ১২ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত এক দশকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। গত এক দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, খেলাপি ঋণ কমানোর কার্যকর কোনো উদ্যোগ আসলে ছিল না। বরং সরকার বিভিন্ন সময় ঋণখেলাপিদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে।

সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পাশ কাটিয়ে এ ধরনের নীতি নিলেও তা কার্যকর করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর তা বাস্তবায়ন করেছে সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংক। এ অবস্থায় খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যাংকারদের দৃঢ়তা ও সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন।

ঋণখেলাপিদের ধরার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংকগুলোর হাতে পুরো ক্ষমতা থাকা উচিত। কোনো গ্রাহকের মুখ দেখে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। তাহলে প্রভাবশালীরা ছাড় পাবে না। পাশাপাশি অর্থঋণ আদালতে বিচারক, বেঞ্চ বাড়ানোসহ আইনি কাঠামো জোরদার করতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। তাহলে খেলাপিদের মধ্যে কিছুটা হলেও ভয় কাজ করবে। খেলাপি ঋণ কমাতে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

অনেকে ব্যাংক খাতের জন্য কমিশন গঠনের কথা বলছেন, এটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। সামনে ব্যাংকের জন্য যে পরিমাণ মূলধন প্রয়োজন হবে এবং অর্থ পাচার প্রতিরোধ সংক্রান্ত আইনকানুন পরিপালনের শর্ত আসছে, তাতে কতগুলো ব্যাংক টিকতে পারবে, তা সময়ই বলে দেবে। ব্যাংকগুলোর দৈনন্দিন কাজে মালিকদের হস্তক্ষেপ রয়েছে- এমন অভিযোগ অনেক দিনের। বাংলাদেশে ব্যাংকগুলোর মালিকানা কাঠামো ভারতের মতো নয়। অনেক দেশে বাংলাদেশের মতো ব্যবসায়ী ও করপোরেট গ্রুপ ব্যাংকের মালিক হতে পারেন না। বাংলাদেশে এমন কাঠামো ৩০ থেকে ৪০ বছর ধরে চলে আসছে। এটা রাতারাতি ঠিক হবে না।

দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ- এই দুই দেশ বাদে সবাই খেলাপি ঋণ ক্রমান্বয়ে কমাচ্ছে। বাকি দেশগুলো মূলত আইনের কঠোর বাস্তবায়ন, নজরদারি বৃদ্ধি, শাস্তি প্রদান, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা না দেয়া, প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিতে খেলাপি ঋণ আদায় এবং দুর্বল ব্যাংক বন্ধ বা অন্যের সঙ্গে একীভূত করেই খেলাপি ঋণ কমিয়ে এনেছে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি বিষয়টি ভারত ও পাকিস্তান ছাড়া বিশ্বের আর কোনো দেশের আইনে নেই। নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধ না করলে সবাই ঋণখেলাপি। তবে কী কারণে ঋণ পরিশোধ করা যায়নি, তা নির্ধারণ করেন আদালত।

উন্নত দেশগুলোতে খেলাপি ঋণসংক্রান্ত আইনকানুন অত্যন্ত কঠোর। খেলাপি হলে আদালতে যেতে হয়, সেখানে মামলা ঝুলেও থাকে না। আদালতের রায়ে একবার খেলাপি সাব্যস্ত হলে স্বাভাবিক জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়ে। নানা ধরনের বিধিনিষেধ আসে। সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়া অনুযায়ী ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো সম্মাননা পাবেন না, কোনো সংগঠনের পদে থাকতে পারবেন না, নিষেধাজ্ঞা থাকবে বিদেশ ভ্রমণ, গাড়ি-বাড়ি নিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্স এবং কোম্পানি নিবন্ধনে। যারা খেলাপি হচ্ছে, তাদের কোনো শাস্তি এ দেশে হচ্ছে না, যেসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেশি, সেই ব্যাংকও কোনো শাস্তির আওতায় আসছে না।

ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত পূরণের জন্যই। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য এর কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তারা মনে করেন, রাজনৈতিক অঙ্গীকার না থাকলে শেষ পর্যন্ত প্রভাবশালী খেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া যাবে না। যারা খেলাপি হচ্ছে, তাদের কোনো শাস্তি এ দেশে হচ্ছে না। যেসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেশি, সেই ব্যাংকও কোনো শাস্তির আওতায় আসছে না। আবার ঋণ পুনর্গঠন, পুনঃতফসিল, স্থগিতাদেশের নামে অনেক ঋণের প্রকৃত তথ্য গোপন করা হচ্ছে। ফলে দেশে খেলাপি ঋণ আসলে কত, তা অজানা রয়ে যাচ্ছে না। খেলাপি ঋণ কমাতে হলে আগে প্রকৃত খেলাপিদের চিহ্নিত করতে হবে। এরপর আইনি ব্যবস্থা জোরদার করে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। কিছুদিন পরপর খেলাপিদের ছাড় দিতে যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়, তা বন্ধ করে দিতে হবে।

ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) আয়োজিত সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, দেশের ব্যাংক খাতের অস্বস্তির বিষয় খেলাপি ঋণ। এটা কমাতে ব্যাংকের শীর্ষ ব্যবস্থাপনায় যারা আছেন, তাদের বিশেষ করে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে দায়িত্ব নিতে হবে। শীর্ষ কর্তারা শক্তভাবে পদক্ষেপ নিলে দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের সমস্যা কমে আসবে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ‘দূরদর্শী নীতিমালা’ প্রণয়নের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আরও বলেন, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমানো ও করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করতে ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। এটা করতে হলে আলাদা করে পরিকল্পনা করতে হবে এবং কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

এর আগে এবিবি এক সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিল, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা এককভাবে ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব নয়। এ কাজের জন্য সামাজিক প্রতিশ্রুতি দরকার। খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে আইনি ব্যবস্থা কঠোর করতে হবে এবং এ খাতে লোকবল বাড়াতে হবে। খেলাপি ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানামুখী পদক্ষেপ অব্যাহত আছে। ব্যাংকার, পরিচালনা পর্ষদ ও বাংলাদেশ ব্যাংক তিন পক্ষকেই খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে হবে। প্রকৃত খেলাপি ঋণ কত, তা প্রকাশ করতে হবে। খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা এককভাবে ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব নয়। ব্যাংকার, পরিচালনা পর্ষদ ও বাংলাদেশ ব্যাংক তিন পক্ষকেই খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে হবে। এখন প্রশ্ন উঠছে, কে করবে এ পরিকল্পনা, কে আনবে ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন?

সরকারি ব্যাংক ও খেলাপি ঋণ এক সময় একসূত্রে গাঁথা ছিল। এ প্রবণতা এখন ছড়িয়ে পড়েছে বেসরকারি ব্যাংকে। বিশেষ করে যেসব বেসরকারি ব্যাংক এক পরিবারের নিয়ন্ত্রণে, সেই ব্যাংকগুলোয় বেশি অনিয়ম হচ্ছে

গত জানুয়ারিতে আইএমএফ বাংলাদেশকে যে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে, তার অন্যতম শর্ত ছিল ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার কমাতে হবে। বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের দৌরাত্ম্য কমাতে সরকার আইন সংশোধনের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা অনেকটা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার শামিল। অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন আনা হলেও ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটেনি। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে এখনো রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি কাজ করে।

বহির্বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের তেমন করণীয় না থাকলেও তারা অন্তত আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কঠোর অবস্থান নিতে পারে। ঋণগ্রহীতারা যদি নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে ভাবেন কিংবা হাজার হাজার কোটি টাকার খেলাপি হয়েও পার পেয়ে যান, সরকারের কোনো আইন ও পদক্ষেপই কাজে আসবে না।

এটা ঠিক, রাজনৈতিক প্রভাবে ব্যাংকিং খাত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আর্থিক খাত হলো দেশের প্রাণ, এটাকে নষ্ট করা মানে নিজেদের দুর্ভোগ ডেকে আনা। জনগণের বাজেটের টাকা দিয়ে ব্যাংকের মূলধন জোগান দেয়া হচ্ছে কিন্তু ব্যাংকিং খাতকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা হচ্ছে না। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের চাপে কখনো কখনো এ খাতে কিছু সংস্কার দেখা গেলেও স্থায়ী কোনো সংস্কার এ পর্যন্ত চোখে পড়েনি। তবু আশায় আছি, সরকার কোনো না কোনো সময় ব্যাংকগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে সংসদে আইন পাস করার উদ্যোগ গ্রহণ করবে। প্রকৃত খেলাপি ঋণ কত, তা প্রকাশ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে সততা, বিচক্ষণতা ও সাহসের সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে ব্যাংক খাত তদারকি করতে হবে। দোষীদের শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। তাহলেই খেলাপি ঋণ কমবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

back to top