alt

উপ-সম্পাদকীয়

অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন : সাদামাটা কিছু কথা

শুভ্রেন্দু ভট্টাচার্য

: বৃহস্পতিবার, ০৮ জুন ২০২৩

অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ বাস্তবায়ন আইন ২০০১ সালের ১১ এপ্রিল গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এই আইনের ১৬ নম্বর ধারা ২০১৩ সাল পর্যন্ত সংশোধিত মর্মে প্রকাশিত হয়েছে। অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত কতিপয় সম্পত্তি বাংলাদেশি মূল মালিক বা তার উত্তরাধিকারী অথবা মূল মালিক বা উত্তরাধিকারীর স্বার্থাধিকারীর (সাকসেসার ইন ইন্টারেস্ট) কাছে প্রত্যর্পণ এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে এই আইন প্রণীত হয়েছে। অর্পিত সম্পত্তি ক ও খ এই দুই তালিকায় ভাগ করা হয়েছে। এখানে ক তালিকার সম্পত্তিই প্রত্যর্পণের জন্য গেজেটভুক্ত হয়েছে যা ওপরে বর্ণিত দাবিদারদের কাছে আইনে নির্দেশিত শর্তপূরণ সাপেক্ষে প্রত্যর্পণ করার বিধান করা হয়েছে। আইনের বিধান অনুযায়ী উপযুক্ত দাবিদারদের নির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে দাবিকৃত সম্পত্তির অনুকূলে প্রামাণ্য দলিলপত্রাদিসহ মালিকানার দাবি নিষ্পত্তিকল্পে গঠিত ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়েরের জন্যে বলা হয়। অর্পিত সম্পত্তিসংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তির জন্যে সরকার বিভিন্ন জেলায় ট্রাইব্যুনাল ও আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। সে অনুযায়ী এতদসংক্রান্ত ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর ভুক্তভোগীরা তাদের দাবির অনুকূলে স্ব স্ব জেলায় অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ঘোষিত পিতৃ পুরুষের সম্পতি ফেরত পাওয়ার জন্যে আবেদন করেন। এতদসংক্রান্ত ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়ার পর দাবিদাররা জমি ফেরত পাওয়ার আশায় হন্যে হয়ে আদালত চত্বরে ভিড় করেন এবং মামলা দায়ের করেন। এতে করে কয়েক দিনের মধ্যেই বিভিন্ন ট্রাইব্যুনালে শত শত মামলার জট সৃষ্টি হয়। কারণ আদালতের সীমিত লোকবল দিয়ে যেক্ষেত্রে নির্ধারিত মামলাসমূহ নিষ্পত্তিতে সমস্যার সৃষ্টি হয় সে ক্ষেত্রে হঠাৎ করে এই বাড়তি সংবেদনশীল মামলা নিষ্পত্তি করা দুষ্কর হয়ে পড়ে। বর্ণিত প্রেক্ষাপটে জনৈক দাবীদার তার পিতৃপুরুষের গেজেটভূক্ত অর্পিত সম্পত্তি ফেরত পাওয়ার দাবি করে ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। মামলা রুজু করার পর কিছুদিনের মধ্যেই আদালতে মামলার জট সৃষ্টি হওয়ায় অত্র দাবিদার আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে জানতে পারেন বাদীপক্ষ দায়েরকৃত মামলাসমূহ প্রত্যাহার করে স্ব স্ব উপজেলার এসিল্যান্ডের অফিসে দাবির স্বপক্ষে কাগজপত্র দাখিল করে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ঘোষিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ও নামজারির জন্য দরখাস্ত করতে পারেন।

এ মতে আলোচ্য বাদী নিজ উপজেলা এসিল্যান্ড অফিসে দরখাস্ত করলে এসিল্যান্ড শুনানি অন্তে দাবিকৃত প্রায় ৫৪ বিঘা জমির মধ্যে প্রায় ০৭ বিঘা জমি প্রত্যর্পণপূর্বক বাদী পক্ষের অনুকূলে নামজারির আদেশ দেন এবং অবশিষ্ট প্রায় ৪৭ বিঘা জমি প্রত্যর্পণ ও নামজারির দাবি খারিজ করে দেন। দাবিকৃত জমিতে আবেদনকারী দখলে নাই এবং উক্ত সম্পত্তিসমূহ বিভিন্ন লোকের নামে বেচা-বিক্রি হয়ে গেছে এই যুক্তিতে এসিল্যান্ড বাকি ৪৭ বিঘা জমিতে বাদীর মালিকানার দাবি অগ্রাহ্য করেন। উক্ত খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে বাদী পক্ষের নামে বাকি ৪৭ বিঘা জমি নামজারি করার নিমিত্তে বাদীপক্ষ এডিসি রেভিনিউর কাছে আবেদন করেন। উক্ত পুনর্বিবেচনার আবেদন ২০১৬ সালে এডিসি রেভিনিউর কাছে দাখিল করা হয়। ২০১৬ সালে দাবি পেশ করা হলেও ২০২৩ সাল অবধি সাত বছর যাবত বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়নি। উল্লেখ্য, দরখাস্তকারী উত্তরাধিকার ও স্বার্থাধিকারের দাবিতে তালিকাভুক্ত অর্পিত সম্পত্তি ফেরত পাওয়ার জন্যে আবেদন করেন। দাবিকৃত সম্পত্তিতে আবেদনকারী দখলে নেই এবং তফসিলভুক্ত অনেক জমি বেচাবিক্রি হয়ে গেছে, এই যুক্তিতে এসিল্যান্ড আবেদনকারীর দাবি অগ্রাহ্য করেন। উক্ত খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে বাতিলকৃত দাবি পুনর্বিবেচনার জন্যে দরখাস্তকারী এডিসির কাছে আবেদন করেন। স্থানীয় তহসিলদারের তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর এসিল্যান্ড নিজে তদন্ত না করে শুধু স্বাক্ষর দিয়ে প্রতিবেদনটি এডিসি রেভিনিউ এর কাছে পাঠিয়ে দেন।

এখন অর্পিত সম্পত্তি আইনের ৮ নম্বর ধারায় বলা আছে, ‘এই আইনের অধীনে প্রত্যর্পণ সম্পন্ন হওয়ার আগে কোন ব্যক্তি অর্পিত সম্পত্তি বিক্রয়, দান বা অন্য কোনভাবে হস্তান্তর করিতে বা বন্ধক রাখিতে পারিবে না এবং উক্তরূপ বিক্রয়, বাতিল ও ফলবিহীন হইবে। ‘অথচ তালিকাভুক্ত দাবিকৃত অর্পিত সম্পত্তি বেচা-বিক্রি, বেদখল হয়েছে- এই যুক্তিতেই এসিল্যান্ড আবেদনকারীর দাবি অগ্রাহ্য করেন। কার্যত অর্পিত সম্পত্তি হস্তান্তরের আগে সরকার পক্ষে জিম্মাদার হিসেবে স্থানীয় কর্মচারীদের নজরে থাকার কথা থাকলেও কেমন করে তালিকাভুক্ত সম্পত্তি বিক্রি ও বেহাত হয়ে গেল এবং এই যুক্তিতে আবেদনকারীর দাবি অগ্রাহ্য করা হল তা স্ববিরোধী মনে হওয়ার অবকাশ থেকে যায়। পুনর্বিবেচনাধীন থাকা কালে অধস্তন কার্যালয় থেকে প্রতিবেদন না আসা, সরকার/আবেদনকারী পক্ষে শুনানিকালে অনুপস্থিতি, প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত থাকা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে আবেদন নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হয়। বারবার তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও ভূমি অফিস হতে রিপোর্ট প্রদানে দীর্ঘসূত্রিতা বা হাজিরা না দেয়াতে সাধারনভাবে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ বাস্তবায়নের কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে। পক্ষান্তরে সরকার পক্ষে দিনের পর দিন গড়হাজির থাকা অথবা রিপোর্ট প্রদানে অহেতুক বিলম্বের কারণে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আচরণে দাবিকৃত সম্পত্তিতে সরকারের স্বার্থ নেই বিবেচনায় বিষয়টি অপেক্ষমান না রেখে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর দাখিলকৃত দলিলপত্রাদি পরীক্ষা করে দাবিকৃত ইস্যুতে একতরফা সিদ্ধান্ত দেয়া যায় অথবা প্রামাণ্য কাগজপত্রে দাবি প্রতিষ্ঠিত না হলে বিষয়টি নথিজাত করা যায়। কিন্তু উদ্ভূত দাবি নিষ্পত্তিতে সার্বিক অনুকূল পরিস্থিতি থাকা সত্ত্বেও মোটাদাগে কেন যে বিষিয়টি অনিষ্পন্ন রেখে সংশ্লিষ্ট দাবিদারদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে তা বোধগম্য নয়। উল্লেখ্য, আলোচ্য দাবি অনিষ্পন্ন থাকা অবস্থায় কমপক্ষে ১০/১২জন এডিসি বদলি হয়েছেন। এতেও বিষয়টি নিষ্পত্তিতে বিঘ্ন ঘটেছে।

অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণের নিমিত্তে সরকার পরিষ্কার বিধিবিধান প্রণয়ন করেছে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যথাযথ তৎপরতা এবং জবাবদিহিতার অভাবে প্রত্যর্পণ আইন বাস্তবায়নে ধীরগতির সৃষ্টি হচ্ছে মর্মে ভুক্তভোগীদের কাছে মনে হচ্ছে। সূত্রমতে জানা যায়, বিরাজিত অবস্থার কারণে দেশব্যাপী অসংখ্য ভুক্তভোগী পিতৃপুরুষের সম্পত্তি ফেরত পাওয়ার আশায় বছরের পর বছর বিভিন্নভাবে ক্ষতি ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এতে করে সরকারের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণে বিলম্ব ঘটছে। আশায় আশায় বুক বেঁধে অনেকে ইতোমধ্যে জমি ফেরত না পেয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ভুক্তভোগীদের দুর্দশার নিরসনকল্পে অর্পিত সম্পত্তি আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়নের নিমিত্তে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। এ ব্যাপারে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাজ তদারকির আওতায় আনতে কঠোর বিধি বিধান প্রণয়ন করা জরুরি। মামলা নিষ্পত্তিতে সময়সীমা বেঁধে দেয়া এবং সরকারে স্বার্থ ও আইন বাস্তবায়নে ক্ষতিকারক কোনরুপ বিচ্যুতি প্রমাণ হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের/ পক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ করা যেতে পারে। দাবি নিষ্পত্তির অগ্রগতি সম্পর্কে পাক্ষিক প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়সহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানোর নির্দেশনা জারি করতে হবে। এছাড়া বিভাগীয় জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের নিয়মিত পরিদর্শন মামলা নিষ্পত্তিতে গতি সঞ্চার করতে পারে। মাঠ পর্যায়ে অর্পিত সম্পত্তির দাবিসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তির জন্যে ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক নয়টি বিভাগে টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে। অর্পিত সম্পত্তি যাতে বেহাত না হয় সে ব্যাপারে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মালিকানা প্রমাণিত না হলে দাবিকৃত সম্পত্তি সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত করা যেতে পারে। ভুক্তভোগীরা আশা করেন, সরকার অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণের বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে কর্মচারীদের অধিকতর আন্তরিক ও সক্রিয় করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করে আইনটি সফল বাস্তবায়নে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবে। এর ফলে দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠীর কয়েক যুগের লাঞ্চনা বঞ্চনার অবসান ঘটাবে। সর্বোপরি অর্পিত সম্পত্তি যত দ্রুততার সঙ্গে প্রত্যর্পণ করা যায় ততই সরকার ভারমুক্ত হতে পারে। এতে করে দীর্ঘদিনের একটা পূঞ্জিভূত সমস্যার সমাধান করে আর্থসামাজিক ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের অভূতপূর্ব সাফল্যের তালিকায় আরেকটি নতুন পালক যুক্ত হবে।

[লেখক : সাবেক পরিচালক

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট]

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

কুষ্ঠ ও বৈষম্য : মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি অবহেলিত অধ্যায়

ছবি

প্রান্তজনের বাংলাদেশ

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

সাইবার নিরাপত্তা : অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে আমাদের প্রস্তুতি

ছবি

বাহান্নর গর্ভে জন্ম নেয়া এক ঝড়ের পাখি

প্রবাসী শ্রমিক : অর্থের যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের সহযোদ্ধা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

ভোগবাদের বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিসের জলবায়ু বার্তা

রম্যগদ্য : হাসি নিষেধ...

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : দাবি ও সমাধানের পথ

সিরিয়ার পতন কিভাবে আমেরিকার স্বার্থকে হুমকিতে ফেলছে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধানে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন : সাদামাটা কিছু কথা

শুভ্রেন্দু ভট্টাচার্য

বৃহস্পতিবার, ০৮ জুন ২০২৩

অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ বাস্তবায়ন আইন ২০০১ সালের ১১ এপ্রিল গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এই আইনের ১৬ নম্বর ধারা ২০১৩ সাল পর্যন্ত সংশোধিত মর্মে প্রকাশিত হয়েছে। অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত কতিপয় সম্পত্তি বাংলাদেশি মূল মালিক বা তার উত্তরাধিকারী অথবা মূল মালিক বা উত্তরাধিকারীর স্বার্থাধিকারীর (সাকসেসার ইন ইন্টারেস্ট) কাছে প্রত্যর্পণ এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে এই আইন প্রণীত হয়েছে। অর্পিত সম্পত্তি ক ও খ এই দুই তালিকায় ভাগ করা হয়েছে। এখানে ক তালিকার সম্পত্তিই প্রত্যর্পণের জন্য গেজেটভুক্ত হয়েছে যা ওপরে বর্ণিত দাবিদারদের কাছে আইনে নির্দেশিত শর্তপূরণ সাপেক্ষে প্রত্যর্পণ করার বিধান করা হয়েছে। আইনের বিধান অনুযায়ী উপযুক্ত দাবিদারদের নির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে দাবিকৃত সম্পত্তির অনুকূলে প্রামাণ্য দলিলপত্রাদিসহ মালিকানার দাবি নিষ্পত্তিকল্পে গঠিত ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়েরের জন্যে বলা হয়। অর্পিত সম্পত্তিসংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তির জন্যে সরকার বিভিন্ন জেলায় ট্রাইব্যুনাল ও আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। সে অনুযায়ী এতদসংক্রান্ত ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর ভুক্তভোগীরা তাদের দাবির অনুকূলে স্ব স্ব জেলায় অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ঘোষিত পিতৃ পুরুষের সম্পতি ফেরত পাওয়ার জন্যে আবেদন করেন। এতদসংক্রান্ত ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়ার পর দাবিদাররা জমি ফেরত পাওয়ার আশায় হন্যে হয়ে আদালত চত্বরে ভিড় করেন এবং মামলা দায়ের করেন। এতে করে কয়েক দিনের মধ্যেই বিভিন্ন ট্রাইব্যুনালে শত শত মামলার জট সৃষ্টি হয়। কারণ আদালতের সীমিত লোকবল দিয়ে যেক্ষেত্রে নির্ধারিত মামলাসমূহ নিষ্পত্তিতে সমস্যার সৃষ্টি হয় সে ক্ষেত্রে হঠাৎ করে এই বাড়তি সংবেদনশীল মামলা নিষ্পত্তি করা দুষ্কর হয়ে পড়ে। বর্ণিত প্রেক্ষাপটে জনৈক দাবীদার তার পিতৃপুরুষের গেজেটভূক্ত অর্পিত সম্পত্তি ফেরত পাওয়ার দাবি করে ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। মামলা রুজু করার পর কিছুদিনের মধ্যেই আদালতে মামলার জট সৃষ্টি হওয়ায় অত্র দাবিদার আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে জানতে পারেন বাদীপক্ষ দায়েরকৃত মামলাসমূহ প্রত্যাহার করে স্ব স্ব উপজেলার এসিল্যান্ডের অফিসে দাবির স্বপক্ষে কাগজপত্র দাখিল করে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ঘোষিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ও নামজারির জন্য দরখাস্ত করতে পারেন।

এ মতে আলোচ্য বাদী নিজ উপজেলা এসিল্যান্ড অফিসে দরখাস্ত করলে এসিল্যান্ড শুনানি অন্তে দাবিকৃত প্রায় ৫৪ বিঘা জমির মধ্যে প্রায় ০৭ বিঘা জমি প্রত্যর্পণপূর্বক বাদী পক্ষের অনুকূলে নামজারির আদেশ দেন এবং অবশিষ্ট প্রায় ৪৭ বিঘা জমি প্রত্যর্পণ ও নামজারির দাবি খারিজ করে দেন। দাবিকৃত জমিতে আবেদনকারী দখলে নাই এবং উক্ত সম্পত্তিসমূহ বিভিন্ন লোকের নামে বেচা-বিক্রি হয়ে গেছে এই যুক্তিতে এসিল্যান্ড বাকি ৪৭ বিঘা জমিতে বাদীর মালিকানার দাবি অগ্রাহ্য করেন। উক্ত খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে বাদী পক্ষের নামে বাকি ৪৭ বিঘা জমি নামজারি করার নিমিত্তে বাদীপক্ষ এডিসি রেভিনিউর কাছে আবেদন করেন। উক্ত পুনর্বিবেচনার আবেদন ২০১৬ সালে এডিসি রেভিনিউর কাছে দাখিল করা হয়। ২০১৬ সালে দাবি পেশ করা হলেও ২০২৩ সাল অবধি সাত বছর যাবত বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়নি। উল্লেখ্য, দরখাস্তকারী উত্তরাধিকার ও স্বার্থাধিকারের দাবিতে তালিকাভুক্ত অর্পিত সম্পত্তি ফেরত পাওয়ার জন্যে আবেদন করেন। দাবিকৃত সম্পত্তিতে আবেদনকারী দখলে নেই এবং তফসিলভুক্ত অনেক জমি বেচাবিক্রি হয়ে গেছে, এই যুক্তিতে এসিল্যান্ড আবেদনকারীর দাবি অগ্রাহ্য করেন। উক্ত খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে বাতিলকৃত দাবি পুনর্বিবেচনার জন্যে দরখাস্তকারী এডিসির কাছে আবেদন করেন। স্থানীয় তহসিলদারের তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর এসিল্যান্ড নিজে তদন্ত না করে শুধু স্বাক্ষর দিয়ে প্রতিবেদনটি এডিসি রেভিনিউ এর কাছে পাঠিয়ে দেন।

এখন অর্পিত সম্পত্তি আইনের ৮ নম্বর ধারায় বলা আছে, ‘এই আইনের অধীনে প্রত্যর্পণ সম্পন্ন হওয়ার আগে কোন ব্যক্তি অর্পিত সম্পত্তি বিক্রয়, দান বা অন্য কোনভাবে হস্তান্তর করিতে বা বন্ধক রাখিতে পারিবে না এবং উক্তরূপ বিক্রয়, বাতিল ও ফলবিহীন হইবে। ‘অথচ তালিকাভুক্ত দাবিকৃত অর্পিত সম্পত্তি বেচা-বিক্রি, বেদখল হয়েছে- এই যুক্তিতেই এসিল্যান্ড আবেদনকারীর দাবি অগ্রাহ্য করেন। কার্যত অর্পিত সম্পত্তি হস্তান্তরের আগে সরকার পক্ষে জিম্মাদার হিসেবে স্থানীয় কর্মচারীদের নজরে থাকার কথা থাকলেও কেমন করে তালিকাভুক্ত সম্পত্তি বিক্রি ও বেহাত হয়ে গেল এবং এই যুক্তিতে আবেদনকারীর দাবি অগ্রাহ্য করা হল তা স্ববিরোধী মনে হওয়ার অবকাশ থেকে যায়। পুনর্বিবেচনাধীন থাকা কালে অধস্তন কার্যালয় থেকে প্রতিবেদন না আসা, সরকার/আবেদনকারী পক্ষে শুনানিকালে অনুপস্থিতি, প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত থাকা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে আবেদন নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হয়। বারবার তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও ভূমি অফিস হতে রিপোর্ট প্রদানে দীর্ঘসূত্রিতা বা হাজিরা না দেয়াতে সাধারনভাবে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ বাস্তবায়নের কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে। পক্ষান্তরে সরকার পক্ষে দিনের পর দিন গড়হাজির থাকা অথবা রিপোর্ট প্রদানে অহেতুক বিলম্বের কারণে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আচরণে দাবিকৃত সম্পত্তিতে সরকারের স্বার্থ নেই বিবেচনায় বিষয়টি অপেক্ষমান না রেখে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর দাখিলকৃত দলিলপত্রাদি পরীক্ষা করে দাবিকৃত ইস্যুতে একতরফা সিদ্ধান্ত দেয়া যায় অথবা প্রামাণ্য কাগজপত্রে দাবি প্রতিষ্ঠিত না হলে বিষয়টি নথিজাত করা যায়। কিন্তু উদ্ভূত দাবি নিষ্পত্তিতে সার্বিক অনুকূল পরিস্থিতি থাকা সত্ত্বেও মোটাদাগে কেন যে বিষিয়টি অনিষ্পন্ন রেখে সংশ্লিষ্ট দাবিদারদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে তা বোধগম্য নয়। উল্লেখ্য, আলোচ্য দাবি অনিষ্পন্ন থাকা অবস্থায় কমপক্ষে ১০/১২জন এডিসি বদলি হয়েছেন। এতেও বিষয়টি নিষ্পত্তিতে বিঘ্ন ঘটেছে।

অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণের নিমিত্তে সরকার পরিষ্কার বিধিবিধান প্রণয়ন করেছে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যথাযথ তৎপরতা এবং জবাবদিহিতার অভাবে প্রত্যর্পণ আইন বাস্তবায়নে ধীরগতির সৃষ্টি হচ্ছে মর্মে ভুক্তভোগীদের কাছে মনে হচ্ছে। সূত্রমতে জানা যায়, বিরাজিত অবস্থার কারণে দেশব্যাপী অসংখ্য ভুক্তভোগী পিতৃপুরুষের সম্পত্তি ফেরত পাওয়ার আশায় বছরের পর বছর বিভিন্নভাবে ক্ষতি ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এতে করে সরকারের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণে বিলম্ব ঘটছে। আশায় আশায় বুক বেঁধে অনেকে ইতোমধ্যে জমি ফেরত না পেয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ভুক্তভোগীদের দুর্দশার নিরসনকল্পে অর্পিত সম্পত্তি আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়নের নিমিত্তে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। এ ব্যাপারে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাজ তদারকির আওতায় আনতে কঠোর বিধি বিধান প্রণয়ন করা জরুরি। মামলা নিষ্পত্তিতে সময়সীমা বেঁধে দেয়া এবং সরকারে স্বার্থ ও আইন বাস্তবায়নে ক্ষতিকারক কোনরুপ বিচ্যুতি প্রমাণ হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের/ পক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ করা যেতে পারে। দাবি নিষ্পত্তির অগ্রগতি সম্পর্কে পাক্ষিক প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়সহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানোর নির্দেশনা জারি করতে হবে। এছাড়া বিভাগীয় জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের নিয়মিত পরিদর্শন মামলা নিষ্পত্তিতে গতি সঞ্চার করতে পারে। মাঠ পর্যায়ে অর্পিত সম্পত্তির দাবিসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তির জন্যে ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক নয়টি বিভাগে টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে। অর্পিত সম্পত্তি যাতে বেহাত না হয় সে ব্যাপারে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মালিকানা প্রমাণিত না হলে দাবিকৃত সম্পত্তি সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত করা যেতে পারে। ভুক্তভোগীরা আশা করেন, সরকার অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণের বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে কর্মচারীদের অধিকতর আন্তরিক ও সক্রিয় করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করে আইনটি সফল বাস্তবায়নে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবে। এর ফলে দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠীর কয়েক যুগের লাঞ্চনা বঞ্চনার অবসান ঘটাবে। সর্বোপরি অর্পিত সম্পত্তি যত দ্রুততার সঙ্গে প্রত্যর্পণ করা যায় ততই সরকার ভারমুক্ত হতে পারে। এতে করে দীর্ঘদিনের একটা পূঞ্জিভূত সমস্যার সমাধান করে আর্থসামাজিক ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের অভূতপূর্ব সাফল্যের তালিকায় আরেকটি নতুন পালক যুক্ত হবে।

[লেখক : সাবেক পরিচালক

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট]

back to top