জুলাইয়ের ১০ তারিখে প্রকাশিত হয় এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল। এর পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় একটি পোস্ট, যেখানে দাবি করা হয়Ñবাংলাদেশে এইচএসসি পাস একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞান ও দক্ষতা আন্তর্জাতিক মানদ- অনুসারে গড়ে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীর সমান। শিক্ষা ব্যবস্থার মানের ওপর এই মন্তব্য যেন এক ধিক্কার। তবে এই ব্যবধান এক দিনে তৈরি হয়নি; হাতেখড়ি থেকে শুরু করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষাÑসব পর্যায়েই ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়েছে আমাদের শিক্ষার্থীরা।
জাতির মেরুদ- হলো শিক্ষা। অথচ শিক্ষা ব্যবস্থায় লক্ষ্য করা যাচ্ছে এক গভীর অবহেলা। দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ১,১৪,৬৩০টি, যার মধ্যে ৬৫,৫৬৭টি সরকারি। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২০,৩১৬টি, এর মধ্যে মাত্র ৬৮৪টি সরকারি এবং বাকি ২০,২৭৬টি বেসরকারি। শিক্ষিত জাতি তৈরির ভিত্তি হলো এসব প্রতিষ্ঠান, বিশেষত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো, যেগুলোর ওপরই নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভাগ্য। কিন্তু এখানেই সমস্যার শেষ নেই।
প্রথমত, রয়েছে তীব্র শিক্ষক সংকট। দেশে ৫২ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদ শূন্য। সহকারী শিক্ষক পদের শূন্যতাও বছরের পর বছর পূরণ হচ্ছে না। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের অভাব আরও বড় সমস্যা। প্রাথমিক স্তরে ছয়টি বিষয় পড়ানো হয়Ñবাংলা, ইংরেজি, গণিত, প্রাথমিক বিজ্ঞান, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় এবং ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা। অথচ এসব বিষয়ের জন্য আলাদা শিক্ষক নেই। বাংলার শিক্ষক গণিত পড়াচ্ছেন, আবার গণিতের শিক্ষক ধর্ম শিক্ষা পড়াচ্ছেনÑএমন দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায়। একজন স্নাতক ডিগ্রিধারী শিক্ষক যেকোনো বিষয় পড়াতে সক্ষম হলেও বিষয়টির গভীর জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ ছাড়া শিক্ষার্থীর কাছে সেটি আকর্ষণীয় ও বোধগম্য করে তোলা সম্ভব নয়। জীবনের প্রাথমিক পর্যায়েই যদি কোনো শিশু ভুল উচ্চারণ বা ভ্রান্ত তথ্য শিখে নেয়, তবে পরবর্তীতে তা সংশোধন করা কঠিন হয়ে পড়ে।
বিশ্বে প্রাথমিক শিক্ষার রোল মডেল সিঙ্গাপুর। সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ডিগ্রির পাশাপাশি শিক্ষকতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ (যেমন ই.ঊফ, চএউঊ বা সমমানের ডিগ্রি) ও লাইসেন্স বাধ্যতামূলক। পাশাপাশি রয়েছে ভাষাগত দক্ষতা ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার জন্য অতিরিক্ত যোগ্যতার শর্ত। সেখানে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, পেশাগত উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ উল্লেখযোগ্য, কাজের পরিবেশ নিরাপদ, আর সামাজিক মর্যাদাও উচ্চ।
অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষকরা অনেক ক্ষেত্রে নিত্যপ্রয়োজন মেটাতেই হিমশিম খান। ফলে এই পেশা অবহেলিত হয়ে পড়েছে, অথচ তাদের হাতেই গড়ে ওঠে জাতির ভবিষ্যৎ। যেভাবে চিকিৎসা ক্ষেত্রে এমবিবিএস ডিগ্রি ছাড়া কাউকে চিকিৎসা দেওয়ার অনুমতি নেই, কিংবা ভবন নির্মাণের জন্য প্রকৌশলীর বিশেষজ্ঞ জ্ঞান প্রয়োজন হয়, সেভাবেই দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাতাদের হাতে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ থাকা জরুরি। কিন্তু এই মৌলিক চাহিদা অবহেলিত হচ্ছে বছরের পর বছর।
সরকারের উচিত এই বিষয়ে অবিলম্বে নজর দেওয়া। চক, বোর্ড বা শ্রেণিকক্ষের অভাব সত্ত্বেও পড়াশোনা হতে পারে, কিন্তু শিক্ষক সংকট কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। গাছের শক্তি যেমন শেকড়ে, তেমনি শিক্ষার ভিত্তি প্রাথমিক শিক্ষা। এই ভিত্তি দুর্বল হলে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বাড়িয়েও শিক্ষিত জাতি গড়া সম্ভব নয়।
আনিকা বুশরা সিফাত
বুধবার, ১৩ আগস্ট ২০২৫
জুলাইয়ের ১০ তারিখে প্রকাশিত হয় এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল। এর পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় একটি পোস্ট, যেখানে দাবি করা হয়Ñবাংলাদেশে এইচএসসি পাস একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞান ও দক্ষতা আন্তর্জাতিক মানদ- অনুসারে গড়ে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীর সমান। শিক্ষা ব্যবস্থার মানের ওপর এই মন্তব্য যেন এক ধিক্কার। তবে এই ব্যবধান এক দিনে তৈরি হয়নি; হাতেখড়ি থেকে শুরু করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষাÑসব পর্যায়েই ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়েছে আমাদের শিক্ষার্থীরা।
জাতির মেরুদ- হলো শিক্ষা। অথচ শিক্ষা ব্যবস্থায় লক্ষ্য করা যাচ্ছে এক গভীর অবহেলা। দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ১,১৪,৬৩০টি, যার মধ্যে ৬৫,৫৬৭টি সরকারি। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২০,৩১৬টি, এর মধ্যে মাত্র ৬৮৪টি সরকারি এবং বাকি ২০,২৭৬টি বেসরকারি। শিক্ষিত জাতি তৈরির ভিত্তি হলো এসব প্রতিষ্ঠান, বিশেষত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো, যেগুলোর ওপরই নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভাগ্য। কিন্তু এখানেই সমস্যার শেষ নেই।
প্রথমত, রয়েছে তীব্র শিক্ষক সংকট। দেশে ৫২ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদ শূন্য। সহকারী শিক্ষক পদের শূন্যতাও বছরের পর বছর পূরণ হচ্ছে না। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের অভাব আরও বড় সমস্যা। প্রাথমিক স্তরে ছয়টি বিষয় পড়ানো হয়Ñবাংলা, ইংরেজি, গণিত, প্রাথমিক বিজ্ঞান, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় এবং ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা। অথচ এসব বিষয়ের জন্য আলাদা শিক্ষক নেই। বাংলার শিক্ষক গণিত পড়াচ্ছেন, আবার গণিতের শিক্ষক ধর্ম শিক্ষা পড়াচ্ছেনÑএমন দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায়। একজন স্নাতক ডিগ্রিধারী শিক্ষক যেকোনো বিষয় পড়াতে সক্ষম হলেও বিষয়টির গভীর জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ ছাড়া শিক্ষার্থীর কাছে সেটি আকর্ষণীয় ও বোধগম্য করে তোলা সম্ভব নয়। জীবনের প্রাথমিক পর্যায়েই যদি কোনো শিশু ভুল উচ্চারণ বা ভ্রান্ত তথ্য শিখে নেয়, তবে পরবর্তীতে তা সংশোধন করা কঠিন হয়ে পড়ে।
বিশ্বে প্রাথমিক শিক্ষার রোল মডেল সিঙ্গাপুর। সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ডিগ্রির পাশাপাশি শিক্ষকতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ (যেমন ই.ঊফ, চএউঊ বা সমমানের ডিগ্রি) ও লাইসেন্স বাধ্যতামূলক। পাশাপাশি রয়েছে ভাষাগত দক্ষতা ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার জন্য অতিরিক্ত যোগ্যতার শর্ত। সেখানে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, পেশাগত উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ উল্লেখযোগ্য, কাজের পরিবেশ নিরাপদ, আর সামাজিক মর্যাদাও উচ্চ।
অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষকরা অনেক ক্ষেত্রে নিত্যপ্রয়োজন মেটাতেই হিমশিম খান। ফলে এই পেশা অবহেলিত হয়ে পড়েছে, অথচ তাদের হাতেই গড়ে ওঠে জাতির ভবিষ্যৎ। যেভাবে চিকিৎসা ক্ষেত্রে এমবিবিএস ডিগ্রি ছাড়া কাউকে চিকিৎসা দেওয়ার অনুমতি নেই, কিংবা ভবন নির্মাণের জন্য প্রকৌশলীর বিশেষজ্ঞ জ্ঞান প্রয়োজন হয়, সেভাবেই দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাতাদের হাতে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ থাকা জরুরি। কিন্তু এই মৌলিক চাহিদা অবহেলিত হচ্ছে বছরের পর বছর।
সরকারের উচিত এই বিষয়ে অবিলম্বে নজর দেওয়া। চক, বোর্ড বা শ্রেণিকক্ষের অভাব সত্ত্বেও পড়াশোনা হতে পারে, কিন্তু শিক্ষক সংকট কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। গাছের শক্তি যেমন শেকড়ে, তেমনি শিক্ষার ভিত্তি প্রাথমিক শিক্ষা। এই ভিত্তি দুর্বল হলে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বাড়িয়েও শিক্ষিত জাতি গড়া সম্ভব নয়।
আনিকা বুশরা সিফাত