আমাদের সমাজে শারীরিক সুস্থতার গুরুত্ব যতটা দৃশ্যমান, মানসিক স্বাস্থ্য সে তুলনায় এখনো অবহেলিত। এই উপেক্ষা দেশের তরুণ প্রজন্মকে নীরবে এক গভীর সংকটে ঠেলে দিচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্যকে ব্যক্তিগত দুর্বলতা হিসেবে দেখার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে এটিকে জাতীয় উন্নয়ন, সামাজিক স্থিতি ও মানবিক নিরাপত্তার প্রশ্ন হিসেবে দেখা জরুরি।
শিক্ষার্থীদের জীবনে চাপ নতুন নয়, কিন্তু তা এখন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে তাদের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত করছে। একাডেমিক প্রতিযোগিতা, ফলাফলকেন্দ্রিক প্রত্যাশা, জিপিএ-৫–এর অবাস্তব মানদণ্ড তরুণদের মনে চরম উদ্বেগ তৈরি করছে। শেখার আনন্দের জায়গায় নম্বর–নির্ভর আতঙ্ক দখল করে নিচ্ছে। উচ্চশিক্ষিত তরুণদের বেকারত্ব তাদের হতাশ করে তুলছে, আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘নিখুঁত জীবন’-এর প্রদর্শন তাদের আত্মসম্মান ক্ষয় করছে। অনলাইন হয়রানি, তুলনা-বিষণ্ণতা, করোনা–পরবর্তী শিখন–ঘাটতি-সব মিলিয়ে অনেক শিক্ষার্থী নিঃসঙ্গতা ও দুশ্চিন্তায় আটকে যাচ্ছে।
সমস্যার সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ দেখা যায় আত্মহত্যার প্রবণতায়। এটি কেবল ব্যক্তিগত বিপর্যয় নয়, বরং একটি ব্যর্থ সামাজিক পরিবেশের প্রতিচ্ছবি। বিষণ্ণতা ও উদ্বেগে আক্রান্ত তরুণের মনোযোগ হারানো, সমাজ থেকে গুটিয়ে নেওয়া এবং ধ্বংসাত্মক আচরণের দিকে ঝুঁকে পড়া সমাজব্যবস্থার জন্যও বড় হুমকি। মানসিক চাপ শুধু মনকে নয়, দেহকেও অসুস্থ করে তোলে-ঘুমের ব্যাঘাত, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ নানা শারীরিক সমস্যা এর পরিণতি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব বলে,বিষণ্ণতা ও উদ্বেগজনিত অসুস্থতায় বিশ্বে বছরে বিপুল উৎপাদনশীলতা নষ্ট হয়। সুস্থ মন কর্মদক্ষতা, সৃজনশীলতা ও সহমর্মিতা বাড়ায়; সুস্থ সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করে; অপরাধ কমায়; উদ্ভাবনী শক্তিকে জাগ্রত করে। একটি দেশের অগ্রগতি তার তরুণদের মানসিক স্থিতি ও প্রাণশক্তির ওপরই নির্ভর করে।
এই সংকট থেকে উত্তরণে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষিত কাউন্সেলর নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা জরুরি। শিক্ষক ও অভিভাবকদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সংবেদনশীল হতে হবে-ভালো ফলের চেয়ে সন্তানের সুস্থ মনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পাঠ্যসূচিতে আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। শহর–গ্রামভেদে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে মানসিক সেবার সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। মানসিক অসুস্থতাকে লুকনোর বিষয় নয়-এটি শারীরিক অসুস্থতার মতোই স্বাভাবিক-এই ধারণা সমাজে প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য আজ আর ব্যক্তিগত বিষয় নয়; এটি জাতির ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা। এখনই পরিবার, শিক্ষাব্যবস্থা ও রাষ্ট্রকে একসঙ্গে এগিয়ে এসে একটি নিরাপদ মানসিক সুরক্ষা পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সুস্থ মনই সুস্থ সমাজের ভিত্তি।
আলী আহমেদ মজুমদার শ্রাবণ