alt

স্মৃতিগদ্য : ১

দিনান্তবেলায়

অঞ্জনা সাহা

: বৃহস্পতিবার, ০১ জুলাই ২০২১

যেমন করে শিশু তার মায়ের আঁচল টেনে ধরে, তেমনি করেই পিছুটান বারবার আমাকে মনে করিয়ে দেয় শৈশব আর ফেলে আসা সব অতীতের কথা। আমি শুধুই ঘুরে মরি আমার অতীত-আঙিনায়। সেই শেকলে বাঁধা ডিঙিনৌকার খেয়াঘাট, ঘাট পেরিয়ে মহুয়াবাগান, আর কোঁচড়ভর্তি মহুয়া ফুল, আকন্দফুলের গাঁথা মালা, মধুমতি নদীর জলসাঁতার, ঢেউয়ে ঢেউয়ে শরীর ভাসিয়ে দোল খাওয়ার অপরূপ খেলা- সব যেন ছবির মতো ভেসে উঠছে চোখের সামনে।

গোপালগঞ্জে দুর্গাপুজোর সময় লক্ষ্মণ দাসের সার্কাস দলের তাঁবু পড়ত মেলার মাঠে। টিকিট কেটে দেখতে হতো। বসত বায়স্কোপের বাক্স। ঝুমঝুমি বাজিয়ে তাল ঠুকে ঠুকে সুর করে একজন লোক বলে যেতো, ‘তারপরেতে দেখা গেল/কী চমৎকার দেখা গেল।/ তাজমহলের ছবি এলো/কী চমৎকার দেখা গেল’... ইত্যাদি। আমরা অধীর আগ্রহে বায়স্কোপের বাক্সে চোখ লাগিয়ে একের পর এক ছবি দেখে যেতাম। দেখতে পেতাম, তার পাশেই কিং-সাইজের কড়াইয়ে আস্ত পাপড় ভাজা হচ্ছে। সেই গরম পাপড় ভাজার স্বাদ যেন অমৃত। দুই পয়সা তার দাম। এদিকে আবার টিনের বাক্স গলায় ঝুলিয়ে অদ্ভুত পোশাক পরে, চোঙাটুপি মাথায় দিয়ে জোকারের মতো সেজে মেলায় ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে এক লোক ঘটিগরম বিক্রি করত আর গাইত, “চানাচুর এনেছি, বড় মজাদার চানাচুর গরম, ঘটি গরররররররমমমমমমমমম।”

নবমীর দিন সকাল থেকেই মধুমতি নদীতে চলতো নৌকাবাইচ। দলে দলে নৌকা সাঁই সাঁই করে চলে যেতো। সে-এক অপূর্ব দৃশ্য। নদীর অদূরেই আমাদের কাঠের দোতলা। সেই দোতলার বারান্দা ছিল নদীর মুখোমুখি। চেয়ার পেতে বসে একটার পর একটা নৌকা ঢোল-ডগর বাজিয়ে তিরবেগে সামনের দিকে এগিয়ে যেতো।

সবার মুখে থাকতো অদ্ভুত ধ্বনি- “মারো জোয়ান হেইও, আরও জোরে হেইও।” বাইচ দেখতে দেখতে ভাইবোনেরা সবাই মিলে চেয়ারে বসে দুলতে দুলতে ‘হেইও হেইও’ করে যেন ছুট লাগাতাম বাইচের সঙ্গে। ঐদিন গরম জিলিপি খাওয়ার ধুম লাগতো। ইয়াব্বড় ঠোঙা ভরে বাবা আমিত্তি (অমৃতি) আর জিলিপি নিয়ে আসতেন। তখন আমাদের আনন্দ আর ধরে না!

আমরা যে বাড়িতে থাকতাম, সে-বাড়ির মালিক ছিলেন খ্রিস্টান। রোজ সন্ধ্যায় ওরা প্রার্থনা করত। শিশুমনের অদম্য কৌতূহল নিয়ে আমি বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ওদের প্রার্থনা দেখতাম এবং প্রার্থনার ভাষা বোঝার চেষ্টা করতাম। প্রার্থনার প্রথম অংশে ছিল বাইবেল পাঠ। প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যায় বেড়ার ফাঁক দিয়ে হানা দিতাম। ওদের বারান্দায় সেজদা ভঙ্গিতে মাথা ঠেকিয়ে সবাই একসঙ্গে “হলে লুইয়া হলে লুইয়া” বলে উঠতো। এই একটা শব্দই আমার মনে আছে। ওদের প্রতিদিনের প্রার্থনা দেখাটা ছিল আমার কাছে নেশার মতো। বাড়িওয়ালার বুড়ো মা খুব ফর্সা আর দেখতেও খুব সুন্দরী ছিলেন। তার পাশে বসে থাকত ধবধবে সাদা তুলতুলে এক বেড়াল। ওর নাম ছিল ‘মেন্টি’। ঐ বুড়ো দিদা বসে থাকতেন বারান্দার বেঞ্চিতে। পরনে ফিনফিনে সাদা শাড়ি। দেখতে আমার খুব ভালো লাগত। বাড়িওয়ালার বাড়িতে যা কিছু কাজকর্ম চলত, তার সবই দেখার জন্য সারাদিন ওদের বাড়ির আঙিনায় ঘুরঘুর করতাম। টেবিলে বসে খাওয়ার আগে ওরা প্রার্থনা করে খাবার খাওয়া শুরু করত। বারান্দার এক কোণে ডায়নিং টেবিল পাতা ছিল। ওদের উঠোনের একপাশ থেকে এই সব দেখতে আমার কোনও অসুবিধাই হতো না! এখন বুঝতে পারি, শিশুমনের অজস্র কৌতূহল কীভাবে আমাকে সারাদিন ছুটিয়ে বেড়াত। আমার জানার অদম্য ইচ্ছের কারণে একদিন বেশ বিপদে পড়তে হলো। লক্ষ্মণ দাসের সার্কাসের ভালুকটাকে নিয়ে এক লোক খেলা দেখাতে দেখাতে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে খেলা দেখার পর আর থাকতে না পেরে ঘর থেকে বেরিয়ে পথে নামলাম। মা তখন রান্নাঘরে রান্নার কাজে ব্যস্ত। বাবা অফিসের কাজে। এই ফাঁকে আমি চললাম ভালুক নাচের পেছনে। যেতে যেতে আমি কখন চৌরঙ্গী পেরিয়ে বাজারের ভেতর চলে এসেছি, তা বুঝতেই পারিনি। পেছন ফিরে তাকাতেই আমার ভালুক নাচের খেলা দেখার নেশা মাথায় উঠল। ভয়ে আমার ভেতরে একটা শিরশিরে অনুভবের কাঁপন শুরু হলো। আমি চারপাশে চেয়ে চেনার চেষ্টা করছি। ভয়ে চোখে অন্ধকার দেখছি। এমন সময় আশার আলো ঝিলিক দিয়ে উঠল। আমাদের বাড়িতে যে মুড়িমাসি মাঝে মাঝে মুড়ি দিয়ে যায়, তাকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে তার কাছে ছুটে যাই। তাকে বলি, “আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি। বাড়ি ফিরতে পারছি না। তুমি আমায় পৌঁছে দেবে গো?”

আমরা যে বাড়িতে থাকতাম, সে-বাড়ির মালিক ছিলেন খ্রিস্টান। রোজ সন্ধ্যায় ওরা প্রার্থনা করত। শিশুমনের অদম্য কৌতূহল নিয়ে আমি বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ওদের প্রার্থনা দেখতাম এবং প্রার্থনার ভাষা বোঝার চেষ্টা করতাম। প্রার্থনার প্রথম অংশে ছিল বাইবেল পাঠ

মুড়িমাসি বললো, “দাঁড়াও আমি বাজারটা সেরে নিই। তারপর তোমায় নিয়ে যাবো।” মুড়িমাসির আঁচল ধরে তার সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকি। সে বাজার থেকে পানসুপারি, তার ছেলের বৌয়ের জন্য নীলাম্বরি শাড়ি কিনলো। তার সংসারের টুকিটাকি কত্তো জিনিস কিনে তবে মুড়িমাসি আমার হাত ধরে নিয়ে চলল বাড়ির উদ্দেশে। হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে পথ যেন আর ফুরোয় না। এমন সময় দেখি কালীবাড়ির আঙিনা। এরপরেই আমার বীণাপাণি স্কুল। বাড়ি থেকে সোজা পথ ধরে রোজ এই স্কুলে আসি। মুড়িমাসিকে বললাম, “আমি এ-পথ চিনি।” একথা বলেই এক চিৎকার দিয়ে মুড়িমাসির হাত ছেড়ে একছুটে বাড়িতে এসে হাজির হলাম। মায়ের কাছে গিয়ে বললাম, “মা, আমি আজ হারিয়ে গিয়েছিলাম।” মা আদর করে বলল, “আর কখনও না বলে একা একা কোত্থাও যেও না।” আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, “না মা, আমি আর কখনও কোত্থাও যাবো না।” মা আমাকে আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরল। ক্রমশ...

ছবি

সত্যেন সেনের উপন্যাস: মিথ ও ইতিহাসলগ্ন মানুষ

ছবি

বিস্ময়ের সীমা নাই

ছবি

নগর বাউল ও ত্রিকালদর্শী সন্ত কবি শামসুর রাহমান

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ও বন্ধু আমার

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

শামসুর রাহমানের কবিতায় ‘মিথ’

ছবি

বহুমাত্রিক শামসুর রাহমান

ছবি

দূর-সময়ের সার্বভৌম কবি

ছবি

মাহফুজ আল-হোসেন-এর দশটি কবিতা

ছবি

মনোজগতের অন্বেষায়

সাময়িকী কবিতা

ছবি

এক ঘর রোদ

ছবি

দ্রোহের রম্য পঙ্ক্তিমালা

ছবি

সংবেদী রঙে ও রেখায় প্রাণের উন্মোচন

ছবি

অলস দিনের হাওয়া

ছবি

লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের মর্মস্পর্শী ও দূরদর্শী সাহিত্যকর্ম

ছবি

‘ভাষার আরোপিত কারুকাজে খেই হারিয়ে ফেলি’

ছবি

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের জিন্দা লাশ কি প্রকৃত লাশ

ছবি

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের শিক্ষা দর্শন ও অলস দিনের হাওয়া

ছবি

ধ্রুপদী বোধ ও ব্যাধির কবিতা

ছবি

সুকান্তর কবিতায় বিপ্লবী চেতনা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

মগ্নচৈতন্যে সৌন্দর্যধ্যান

ছবি

অধুনাবাদী নিরীক্ষার অগ্রসাধক

ছবি

‘বায়ান্নর আধুনিকতা ও প্রগতিশীল ধারাকে বহন করতে চেয়েছি’

ছবি

জাতীয় চেতনার অমলিন ধারক

ছবি

নক্ষত্রের অনন্ত যাত্রা

ছবি

আহমদ রফিক ও ভাষামুক্তি সাধনা

ছবি

কবি আসাদ চৌধুরী : ঘরে ফেরা হলো না তাঁর

ছবি

জীবনবোধের অনবদ্য চিত্ররূপ ‘স্বপ্নছোঁয়ার পদযাত্রা’

ছবি

অনালোকিত ইতিহাসের সন্ধানে

ছবি

কবিরের দোঁহা

ছবি

আকবর হোসেন ও ‘যৌবনটাই জীবন নয়’

ছবি

স্বোপার্জিত

ছবি

সংগ্রামের অগ্নিশিখা থেকে হেলাল হাফিজ

tab

স্মৃতিগদ্য : ১

দিনান্তবেলায়

অঞ্জনা সাহা

বৃহস্পতিবার, ০১ জুলাই ২০২১

যেমন করে শিশু তার মায়ের আঁচল টেনে ধরে, তেমনি করেই পিছুটান বারবার আমাকে মনে করিয়ে দেয় শৈশব আর ফেলে আসা সব অতীতের কথা। আমি শুধুই ঘুরে মরি আমার অতীত-আঙিনায়। সেই শেকলে বাঁধা ডিঙিনৌকার খেয়াঘাট, ঘাট পেরিয়ে মহুয়াবাগান, আর কোঁচড়ভর্তি মহুয়া ফুল, আকন্দফুলের গাঁথা মালা, মধুমতি নদীর জলসাঁতার, ঢেউয়ে ঢেউয়ে শরীর ভাসিয়ে দোল খাওয়ার অপরূপ খেলা- সব যেন ছবির মতো ভেসে উঠছে চোখের সামনে।

গোপালগঞ্জে দুর্গাপুজোর সময় লক্ষ্মণ দাসের সার্কাস দলের তাঁবু পড়ত মেলার মাঠে। টিকিট কেটে দেখতে হতো। বসত বায়স্কোপের বাক্স। ঝুমঝুমি বাজিয়ে তাল ঠুকে ঠুকে সুর করে একজন লোক বলে যেতো, ‘তারপরেতে দেখা গেল/কী চমৎকার দেখা গেল।/ তাজমহলের ছবি এলো/কী চমৎকার দেখা গেল’... ইত্যাদি। আমরা অধীর আগ্রহে বায়স্কোপের বাক্সে চোখ লাগিয়ে একের পর এক ছবি দেখে যেতাম। দেখতে পেতাম, তার পাশেই কিং-সাইজের কড়াইয়ে আস্ত পাপড় ভাজা হচ্ছে। সেই গরম পাপড় ভাজার স্বাদ যেন অমৃত। দুই পয়সা তার দাম। এদিকে আবার টিনের বাক্স গলায় ঝুলিয়ে অদ্ভুত পোশাক পরে, চোঙাটুপি মাথায় দিয়ে জোকারের মতো সেজে মেলায় ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে এক লোক ঘটিগরম বিক্রি করত আর গাইত, “চানাচুর এনেছি, বড় মজাদার চানাচুর গরম, ঘটি গরররররররমমমমমমমমম।”

নবমীর দিন সকাল থেকেই মধুমতি নদীতে চলতো নৌকাবাইচ। দলে দলে নৌকা সাঁই সাঁই করে চলে যেতো। সে-এক অপূর্ব দৃশ্য। নদীর অদূরেই আমাদের কাঠের দোতলা। সেই দোতলার বারান্দা ছিল নদীর মুখোমুখি। চেয়ার পেতে বসে একটার পর একটা নৌকা ঢোল-ডগর বাজিয়ে তিরবেগে সামনের দিকে এগিয়ে যেতো।

সবার মুখে থাকতো অদ্ভুত ধ্বনি- “মারো জোয়ান হেইও, আরও জোরে হেইও।” বাইচ দেখতে দেখতে ভাইবোনেরা সবাই মিলে চেয়ারে বসে দুলতে দুলতে ‘হেইও হেইও’ করে যেন ছুট লাগাতাম বাইচের সঙ্গে। ঐদিন গরম জিলিপি খাওয়ার ধুম লাগতো। ইয়াব্বড় ঠোঙা ভরে বাবা আমিত্তি (অমৃতি) আর জিলিপি নিয়ে আসতেন। তখন আমাদের আনন্দ আর ধরে না!

আমরা যে বাড়িতে থাকতাম, সে-বাড়ির মালিক ছিলেন খ্রিস্টান। রোজ সন্ধ্যায় ওরা প্রার্থনা করত। শিশুমনের অদম্য কৌতূহল নিয়ে আমি বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ওদের প্রার্থনা দেখতাম এবং প্রার্থনার ভাষা বোঝার চেষ্টা করতাম। প্রার্থনার প্রথম অংশে ছিল বাইবেল পাঠ। প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যায় বেড়ার ফাঁক দিয়ে হানা দিতাম। ওদের বারান্দায় সেজদা ভঙ্গিতে মাথা ঠেকিয়ে সবাই একসঙ্গে “হলে লুইয়া হলে লুইয়া” বলে উঠতো। এই একটা শব্দই আমার মনে আছে। ওদের প্রতিদিনের প্রার্থনা দেখাটা ছিল আমার কাছে নেশার মতো। বাড়িওয়ালার বুড়ো মা খুব ফর্সা আর দেখতেও খুব সুন্দরী ছিলেন। তার পাশে বসে থাকত ধবধবে সাদা তুলতুলে এক বেড়াল। ওর নাম ছিল ‘মেন্টি’। ঐ বুড়ো দিদা বসে থাকতেন বারান্দার বেঞ্চিতে। পরনে ফিনফিনে সাদা শাড়ি। দেখতে আমার খুব ভালো লাগত। বাড়িওয়ালার বাড়িতে যা কিছু কাজকর্ম চলত, তার সবই দেখার জন্য সারাদিন ওদের বাড়ির আঙিনায় ঘুরঘুর করতাম। টেবিলে বসে খাওয়ার আগে ওরা প্রার্থনা করে খাবার খাওয়া শুরু করত। বারান্দার এক কোণে ডায়নিং টেবিল পাতা ছিল। ওদের উঠোনের একপাশ থেকে এই সব দেখতে আমার কোনও অসুবিধাই হতো না! এখন বুঝতে পারি, শিশুমনের অজস্র কৌতূহল কীভাবে আমাকে সারাদিন ছুটিয়ে বেড়াত। আমার জানার অদম্য ইচ্ছের কারণে একদিন বেশ বিপদে পড়তে হলো। লক্ষ্মণ দাসের সার্কাসের ভালুকটাকে নিয়ে এক লোক খেলা দেখাতে দেখাতে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে খেলা দেখার পর আর থাকতে না পেরে ঘর থেকে বেরিয়ে পথে নামলাম। মা তখন রান্নাঘরে রান্নার কাজে ব্যস্ত। বাবা অফিসের কাজে। এই ফাঁকে আমি চললাম ভালুক নাচের পেছনে। যেতে যেতে আমি কখন চৌরঙ্গী পেরিয়ে বাজারের ভেতর চলে এসেছি, তা বুঝতেই পারিনি। পেছন ফিরে তাকাতেই আমার ভালুক নাচের খেলা দেখার নেশা মাথায় উঠল। ভয়ে আমার ভেতরে একটা শিরশিরে অনুভবের কাঁপন শুরু হলো। আমি চারপাশে চেয়ে চেনার চেষ্টা করছি। ভয়ে চোখে অন্ধকার দেখছি। এমন সময় আশার আলো ঝিলিক দিয়ে উঠল। আমাদের বাড়িতে যে মুড়িমাসি মাঝে মাঝে মুড়ি দিয়ে যায়, তাকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে তার কাছে ছুটে যাই। তাকে বলি, “আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি। বাড়ি ফিরতে পারছি না। তুমি আমায় পৌঁছে দেবে গো?”

আমরা যে বাড়িতে থাকতাম, সে-বাড়ির মালিক ছিলেন খ্রিস্টান। রোজ সন্ধ্যায় ওরা প্রার্থনা করত। শিশুমনের অদম্য কৌতূহল নিয়ে আমি বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ওদের প্রার্থনা দেখতাম এবং প্রার্থনার ভাষা বোঝার চেষ্টা করতাম। প্রার্থনার প্রথম অংশে ছিল বাইবেল পাঠ

মুড়িমাসি বললো, “দাঁড়াও আমি বাজারটা সেরে নিই। তারপর তোমায় নিয়ে যাবো।” মুড়িমাসির আঁচল ধরে তার সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকি। সে বাজার থেকে পানসুপারি, তার ছেলের বৌয়ের জন্য নীলাম্বরি শাড়ি কিনলো। তার সংসারের টুকিটাকি কত্তো জিনিস কিনে তবে মুড়িমাসি আমার হাত ধরে নিয়ে চলল বাড়ির উদ্দেশে। হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে পথ যেন আর ফুরোয় না। এমন সময় দেখি কালীবাড়ির আঙিনা। এরপরেই আমার বীণাপাণি স্কুল। বাড়ি থেকে সোজা পথ ধরে রোজ এই স্কুলে আসি। মুড়িমাসিকে বললাম, “আমি এ-পথ চিনি।” একথা বলেই এক চিৎকার দিয়ে মুড়িমাসির হাত ছেড়ে একছুটে বাড়িতে এসে হাজির হলাম। মায়ের কাছে গিয়ে বললাম, “মা, আমি আজ হারিয়ে গিয়েছিলাম।” মা আদর করে বলল, “আর কখনও না বলে একা একা কোত্থাও যেও না।” আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, “না মা, আমি আর কখনও কোত্থাও যাবো না।” মা আমাকে আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরল। ক্রমশ...

back to top