image
হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পরার পর গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলো, ডেইলি স্টার ও ছায়ানটে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করা হয় -সংবাদ

প্রথম আলো, ডেইলি স্টার ও ছায়ানটে হামলা-ভাঙচুর-আগুন

শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫
সংবাদ অনলাইন রিপোর্ট

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদির মৃত্যুর খবরে বিক্ষুব্ধ জনতা হামলা করেছে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার ভবনে। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর প্রায় ১০ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন পুরোপুরি নেভাতে সক্ষম হয়েছে। তবে এখনও ডেইলি স্টার ভবনে ধোঁয়া উঠছে। শুক্রবার,(১৯ ডিসেম্বর ২০২৫) সকালে প্রথম আলোর প্রধান ফটকের সামনে ‘ক্রাইম সিন’ লেখা ফিতা টানিয়ে দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এই ফিতায় লেখা ‘ডু নট ক্রস’। পাশাপাশি সিএ ভবনের পাশেও ক্রাইম সিন ঘোষণা করে জনসাধারণের প্রবেশ সীমিত করা হয়েছে।

শুক্রবার সকালে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, দমকল কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষয়ক্ষতির পর্যালোচনার কাজ করছেন। ভবনের সামনে উৎসুক জনতার ভিড় জমেছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে পুলিশ সদস্যদেরও অবস্থান করতে দেখা গেছে। সরেজমিনে দেখা যায়, ডেইলি স্টার ভবনের ১ থেকে ৩ তলা পর্যন্ত আগুনে পুড়ে গেছে। আগুনে এসব তলার অফিস কক্ষ, আসবাব ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে ৪ থেকে ৭ তলা পর্যন্ত অফিসের প্রায় সব সামগ্রী লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয়েছে। কাগজপত্র, কম্পিউটার, আসবাবসহ বিভিন্ন উপকরণ তছনছ করে ফেলা হয়েছে। এক কথায় পুরো ভবনই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এছাড়া হামলায় প্রথম আলো ভবন পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপ। ভবনের চারটি তলার যাবতীয় সবকিছু আগুনে পুড়ে গেছে। আগুনে ঝলসে যাওয়া ভবনের সামনে সকাল থেকেই ছিল উৎসুক মানুষের ভিড়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ভবন দু’টির প্রধান ফটকে দায়িত্বরত অবস্থায় দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের।

‘পরিকল্পিতভাবে একটি মহল এ হামলা চালিয়েছে’: প্রথম আলো

পরিকল্পিতভাবে একটি স্বার্থান্বেষী মহল প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা চালিয়েছে বলে মনে করছেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ। শুক্রবার প্রথম আলোর কর্মীদের মানববন্ধন কর্মসূচিতে তিনি এমন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদে এ কর্মসূচি ডাকা হয়। ঢাকার কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে বিকেল ৪টায় এই মানববন্ধন শুরু হয়। তবে হট্টগোলের কারণে কয়েক মিনিটের মাথায় কর্মসূচি শেষ হয়ে যায়।

ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরীফ ওসমান বিন হাদির মৃত্যুর খবর আসার পর গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা হয়। আগের রাতের সেই হামলার কথা তুলে ধরে মানববন্ধনে প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, ‘পরিকল্পিতভাবে একটি স্বার্থান্বেষী মহল এই সংগঠিত আক্রমণটি চালিয়েছে। আমাদের সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকিতে ছিলেন, প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ছিলেন। তারা বাধ্য হয়ে পত্রিকা প্রকাশ না করে সাংবাদিকতার কাজ অসমাপ্ত রেখে চলে যান’।

‘প্রতিষ্ঠার পর গত ২৭ বছরে এই প্রথম শুক্রবার প্রথম আলো প্রকাশ হয়নি। আমাদের অনলাইনও বন্ধ আছে শুক্রবার রাত থেকে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে যে, আগামী নির্বাচনকে পথভ্রষ্ট করার জন্য, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও সরকারের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে’। বাংলাদেশের আইনের আওতায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক বলেন, ‘আমরা এ ঘটনার প্রতিবাদ জানাই এবং দাবি জানাই যে, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হোক। যারা দোষী, তাদের খুঁজে বের করা হোক’।

নাগরিক সমাজকে প্রথম আলোর সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শুধু প্রথম আলো নয়, ডেইলি স্টারের ওপরও আক্রমণ হয়েছে। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, এটি একটি কালো দিন সংবাদমাধ্যমের জন্য, বাকস্বাধীনতার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য। ‘আমরা বলতে চাই, এটি বাংলাদেশের বাকস্বাধীনতা, ভিন্নমতের প্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর কঠিন আক্রমণ করা হয়েছে।’ মানবন্ধনে সম্পাদক মতিউর রহমান ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হকসহ প্রথম আলোর শতাধিক কর্মী অংশগ্রহণ করেন।

ডেইলি স্টারের ছাদে একদল সংবাদকর্মীর রুদ্ধশ্বাস ৩ ঘণ্টা

ওসমান হাদির মৃত্যুর খবরে ফার্মগেটে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের কার্যালয়ে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের পর ছাদে আটকা পড়া একজন সাংবাদিক তার রুদ্ধশ্বাস অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তিনি জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১টার দিকে কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে হামলা অগ্নিসংযোগের পর উন্মত্ত জনতার একাংশ যখন ডেইলি স্টার ভবনের দিকে অগ্রসর হয়, তখন বাইরে থেকে একজন ফোনে তাদের সেই খবর দেন। খবর পেয়ে ডেইলি স্টারের বার্তা কক্ষে থাকা কর্মীরা নেমে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু ততক্ষণে ভবনের নিচে ‘মব’ এসে ভাঙচুর শুরু করে এবং একপর্যায়ে আগুন দেয়।

ওই অবস্থায় ধোঁয়ার মধ্যে নিচে নামার চেষ্টা বাদ দিয়ে সংবাদকর্মীদের একটি অংশ উঠে যান ১০ তলার ছাদে। ওই সাংবাদিক বলেন, সবমিলিয়ে তারা মোট ২৮ জন ছিলেন। ভীষণ উৎকণ্ঠা আর আতঙ্কের মধ্যে ছিলেন সবাই। কিছুক্ষণ পর ভবনের ক্যান্টিন বয় সাহস করে ছাদ থেকে ভবনের বাইরের ফায়ার এক্সিটের মই বেয়ে নেমে যান। কিন্তু নামার পর তিনি মবের কবলে পড়েন এবং মারধরের শিকার হন। ওই ঘটনা দেখে অন্যরা আর কেউ মই বেয়ে নামার সাহস করেননি।

একপর্যায়ে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা এসে নিচতলার আগুন নেভায় এবং ৪ জন ফায়ারম্যান ছাদে উঠে আসেন আটকা পড়া কর্মীদের নামিয়ে নেয়ার জন্য। কিন্তু নিচে উন্মত্ত জনতার ভাঙচুর চলতে থাকায় কেউ নামার সাহস পাচ্ছিলেন না। তারা ছাদের দরজা বন্ধ করে দেন। ফায়ার সর্ভিসের কর্মীরা সাহস দিয়ে বলছিলেন, নিচে সেনাবাহিনী আছে ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু কিছুক্ষণ পর হামলাকারীদের কয়েকজন ছাদে উঠে এসে দরজায় ধাক্কা দেয়া শুরু করলে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তখন ছাদে থাকা ফায়ার সার্ভিসের ৪ কর্মীও ভড়কে যান। আটকা পড়া সংবাদকর্মীরা ছাদে থাকা টব জড়ো করে দরজা আটকে রাখার চেষ্টা করেন। তাদের সময় কাটতে থাকে আতঙ্কের মধ্যে।

একপর্যায়ে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও নিউ এইজ সম্পাদক নূরুল কবীর এবং আলোকচিত্রী শহিদুল আলম ডেইলি স্টার ভবনের নিচে এসে হামলাকারীদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেখানে নূরুল কবীর উল্টো হেনস্তার শিকার হন। পরে ভবনের নিচে থাকা সেনা সদস্যরা কৌশল করে একপাশের সিঁড়ি ছেড়ে দেন। হামলাকারীরা তখন ওইপাশ দিয়ে ওপরে উঠে ভাঙচুর-লুটপাট শুরু করে। এই ফাঁকে ছাদে এবং ভবনে আটকা পড়া ডেইলি স্টার কর্মীদের ফায়ার এক্সিটের সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে এনে পেছন দিক দিয়ে বের করে দেয়া হয়। ততক্ষণে ভোর পৌনে ৪টা বেজে গেছে। ডেইলি স্টারের ওই সাংবাদিক বলেন, ‘কপাল ভালো, বড় বিপদ থেকে বেঁচে গেছি। জানি না দেশ কোন দিকে যাচ্ছে।’

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার সম্পাদককে প্রধান উপদেষ্টার ফোন

প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর হামলার শামিল বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বর্বরোচিত ওই হামলার ঘটনায় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে বর্বরোচিত হামলার ঘটনায় পত্রিকা দুটির সম্পাদকদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। প্রথম আলো সম্পাদক ও ডেইলি স্টার সম্পাদকের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনাদের প্রতিষ্ঠান ও সংবাদকর্মীদের ওপর এই অনাকাক্সিক্ষত ও ন্যক্কারজনক হামলা আমাকে গভীরভাবে ব্যথিত করেছে। আপনাদের এই দুঃসময়ে সরকার পাশে আছে।’ প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, দেশের শীর্ষস্থানীয় দুটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ওপর এই হামলা স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর হামলার শামিল। এ ঘটনা দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে বিরাট এক বাধা সৃষ্টি করেছে। টেলিফোনে আলাপকালে সম্পাদকদের ও সংবাদমাধ্যমগুলোর পূর্ণ নিরাপত্তা এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য সহযোগিতার আশ্বাস দেন প্রধান উপদেষ্টা। খুব শিগগিরই এই দুই সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে বলেও জানান প্রধান উপদেষ্টা।

ডেইলি স্টারের সামনে নিউ এইজ সম্পাদক নূরুল কবীর নাজেহাল

দৈনিক ডেইলি স্টার ভবনের সামনে একদল ব্যক্তির হাতে নাজেহাল হয়েছেন নিউ এইজ সম্পাদক নূরুল কবীর। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে একদল বিক্ষোভকারী ডেইলি স্টারে ভাঙচুর ও আগুন দিলে সেখানে যান সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভাপতি নূরুল কবীর। সেখানে হামলাকারীদের থামাতে গিয়ে তোপের মুখে পড়েন তিনি। এ ঘটনার বেশ কয়েকটি ভিডিও ছড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেগুলোতে দেখা যায়, তাকে ভিড়ের মধ্যে ধাক্কা দিচ্ছেন এক যুবক। ‘আওয়ামী লীগের দালাল’ বলে গালিও দেয়া হয়। তাকে ধাক্কা দেয়ার সময় একজনকে তার চুল টানতেও দেখা যায়।

কারওয়ান বাজারসহ রাজধানীর বিভিন্ন অংশে বিজিবি মোতায়েন

হাদির মরদেহ দেশে আসার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিজিবি মোতায়ন করা হয়েছে। শুক্রবার বিকেলে সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীটির এক বার্তায় এ তথ্য দেয়া হয়। এতে বলা হয়, বিমানবন্দর এলাকা, কারওয়ানবাজার ও হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এলাকাসহ নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিজিবি মোতায়ন করা হয়েছে।

ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো ভবন পরিদর্শনে আইজিপি

হাদির মৃত্যুর খবরে কারওয়ান বাজারে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার ও দৈনিক প্রথম আলোর কার্যালয়ে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের পর সেখানে পরিদর্শনে যান পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে এই দুই ভবন পরিদর্শন করেন তিনি। তেজগাঁও বিভাগের (শিল্পাঞ্চল) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আব্দুল্লাহ আল ইমরান বলেন, ‘আইজিপি মহোদয় সকালে প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার ভবন পরিদর্শন করেন’। এ সময় তিনি বাহারুল আলম সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেন এবং পরিস্থিতি জানতে চান।

ছায়ানট ভবনে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন

ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান বিন হাদির মৃত্যুর খবরে ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট ভবনে হামলা ও ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়েছে, দেয়া হয়েছে আগুন। গতকাল বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের পর একদল বিক্ষোভকারী ধানমন্ডির সাত তলা এ ভবনের বিভিন্ন তলায় গিয়ে প্রতিটি কক্ষে ব্যাপক ভাঙচুর করেছে।

তাদের ক্ষোভের বলি হয়েছে বিভিন্ন তলায় থাকা বাদ্যযন্ত্র ও শিল্প কর্ম। এর পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন কক্ষে থাকা কাগজপত্র ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের লাইভের ভিডিওতে। মুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখে ও হেলমেট পরে আসা হামলাকারীরা বিভিন্ন তলায় ভাঙচুর শেষে চলে যাবার সময় ভবনের সামনে আগুন দেয়। তবে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা আসার আগেই সেই আগুন নিভে যাওয়ায় বড় অগ্নিকাণ্ড থেকে রক্ষা পায় বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণের নেতৃত্ব দেয়া সংগঠনটি।

সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন হাদির মৃত্যুর খবর আসার পর শাহবাগসহ রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে হামলার খবরের মধ্যে একদল বিক্ষোভকারী রাত ১টার পর জড়ো হতে থাকেন ধানমন্ডির শংকরে ছায়ানটের সামনে। ঐতিহ্যবাহী এ ভবন ও সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটে হামলার বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যায়, বিক্ষোভকারীরা দলে দলে সেখানে ঢুকে পড়ে এবং ভাঙচুর চালাতে শুরু করে। তারা সংগঠনের নামফলক ভেঙে ফেলে। নিচতলায় গিয়ে সব আসবাবপত্র ও বাদ্যযন্ত্র ভেঙে ফেলে।

চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের লাইভ ভিডিওতে তিন তলা পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি কক্ষ ভেঙে চুরমার করার চিত্র দেখা যায়। মিলনায়তনে হামলাকারীর যা পেয়েছেন সেটিই ভাঙচুর করেছেন। পুরো মনিটরিং সিস্টেম, লাইট ও ফ্যান ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেখানে থাকা মাটির তৈরি চারুকর্ম ও শিল্পকর্ম ভেঙে ফেলা হয়েছে। ভবনটিতে ঢুকে পড়া ব্যক্তিদের ক্ষোভের বলি হয়েছে প্রতিটি তলায় থাকা সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট এবং সেখানে পরিচালিত বিদ্যালয়ের সবগুলো কক্ষ ও অফিস রুম। বেশিরভাগ আসবাব ভেঙে ফেলা হয়েছে। কাগজপত্র ও সরঞ্জাম তছনছ করা হয়েছে।

এ ঘটনার ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভিডিওতে ভাঙচুরের সময় হামলাকারীদের বলতে শোনা যায় ‘ভারতীয় সংস্কৃতি চর্চার’ কোনো জায়গা নেই বাংলাদেশে। ভিডিওতে দেখা যায়, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কক্ষও বাদ যায়নি। আলমারির গ্লাস ভেঙে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। চেয়ার-টেবিল সব ওলটপালট করা হয়েছে। ফ্যান ও জানালাও ভাঙচুর করা হয়েছে। ধানমন্ডি থানার দায়িত্বরত কর্মকর্তা মিথুন সিংহ বলেন, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে ভাঙচুর ও আগুন দেয়ার কিছুক্ষণ পরই ছায়ানটে হামলার ঘটনা ঘটে। পুলিশের ধারণা বিক্ষোভকারীদের একই অংশ এ দুই হামলা চালিয়েছে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ ও সেনাবাহিনী পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ হামলার পর ছায়ানট ভবনে পরিচালিত ‘ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তনের’ ক্লাসসহ সংগঠনের সব কার্যক্রম পরবর্তী ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত স্থগিত রাখার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

রাত সাড়ে ৩টার দিকে ছায়ানটের ফেইসবুকে পেইজে এ ঘোষণা দেয়া হয়। বাঙালিকে আপন সংস্কৃতি ও দেশীয় বৈশিষ্ট্যে স্বাধীনসত্তায় বিকশিত হতে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত ছায়ানট এর আগে প্রাণঘাতী হামলার মুখেও পড়েছে। পাকিস্তানি শাসকদের বাধা উপেক্ষা করে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন এবং তার সূত্র ধরে পরে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের জন্ম। প্রতিবছর বাংলা নববর্ষে রমনা বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান করে এটি পরিচিতি পেয়েছে।

সেই ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানটি ২০০১ সালে বর্ষবরণেই ভয়াবহ এক বোমা হামলার শিকার হয়। এতে প্রাণ যায় ১০ জনের এবং আহত হন বেশ কয়েকজন। এরপরও দমে যায়নি ছায়ানট, সাংস্কৃতিক অঙ্গন ও সংগীতের দুই পুরোধা ওয়াহিদুল হক ও সন্‌জীদা খাতুনের নেতৃত্বে এগিয়ে যায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতের হামলার পর সংগঠনটির সদস্য, ছাত্র ও শুভাকাঙ্খীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হয়ে বলেছেন, এ আঘাতেও তাদের কর্মকাণ্ড বন্ধ হবে না।

‘ফৌজদারি অপরাধ’, গণঅভ্যুত্থানের চেতনারও পরিপন্থী: ফারুকী

হাদির মৃত্যুর খবরে ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে ধানমন্ডিতে ছায়ানট ভবনে হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ‘ফৌজদারি অপরাধ’ এবং তা ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনার পরিপন্থী’ বলে মন্তব্য করেছেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তিনি বলেছেন, এই হামলায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনে অবিলম্বে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করার বিষয়ে সরকার ‘কাজ করছে’।

শুক্রবার এক বিবৃতিতে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক শরীফ ওসমান হাদির শহীদী মৃত্যুতে জাতি শোকার্ত। এই জাতীয় শোকের মুহূর্তে এক শ্রেণীর হঠকারী দেশকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ছায়ানট’-এ হামলা চালিয়ে ক্ষয়-ক্ষতি সাধন করেছে। ‘মৃত্যুঞ্জয়ী হাদীর মৃত্যুতে কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠনে হামলা কেবল একটি ফৌজদারি অপরাধই নয়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনারও পরিপন্থী।’ ‘গণতান্ত্রিক রূপান্তরের এই সময়ে সব হঠকারিতার বিরুদ্ধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ’ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন উপদেষ্টা। তিনি বলেছেন, ছায়ানট ভবনে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে এ বিষয়ে যা যা করণীয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ছায়ানট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে তা করবে।

জাতীয় সংগীত গেয়ে প্রতিবাদ

সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটে হামলার ঘটনায় গান গেয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন নালন্দা ও ছায়ানট বিদ্যায়তনের বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সংস্কৃতিকর্মীরা। শুক্রবার বিকেল ৪টায় ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবনের সামনে সম্মিলিত কণ্ঠে জাতীয় সংগীতসহ কয়েকটি গান পরিবেশন করা হয়। প্রতিবাদী এই আয়োজনে অংশ নিয়ে সংস্কৃতিকর্মী আরিফ নূর বলেন, রাতে ছায়ানটে যে ন্যাক্কারজনক হামলা হয়েছে, তার প্রতিবাদে এটি আমাদের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ।’

ছায়ানটে হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে কেউ কেউ প্ল্যাকার্ড হাতেও দাঁড়িয়েছিলেন। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর (একাংশ) সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন এই প্রতিবাদী আয়োজনে অংশ নিয়ে বলেন, ‘ছায়ানটে হামলার পর থেকেই অনেকে উৎকণ্ঠা নিয়ে সকাল থেকে ছায়ানটে এসেছেন, আমরাও এসেছি। তাৎক্ষণিকভাবে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সংস্কৃতিকর্মীরা গান গেয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছি। ‘আমরা দাবি জানাই, দ্রুত হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।’

ছায়ানটে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে: সংস্কৃতি উপদেষ্টা

দুপুর আড়াইটার দিকে ছায়ানট ভবন পরিদর্শনে আসেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তিনি বলেন, ‘ছায়ানট ভবনে হামলা ও লুটপাটের ঘটনায় জড়িত প্রত্যেককে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ‘আমি ছায়ানট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপন করে যাবতীয় সংস্কার কার্যক্রম শেষ করে প্রতিষ্ঠানটি যেন দ্রুত চালু করা যায়। এ ব্যাপারে আর্থিক সহায়তাসহ সরকার সব ধরনের সহায়তা দেবে।’ ছায়ানটের সংগঠক পার্থ তানভীর নভেদসহ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করেন উপদেষ্টা। ছায়ানটের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, ছায়ানটের বাইরে বিজিবি ও পুলিশ নিয়োজিত রয়েছে।’

‘ওরা আমার সন্তানের স্কুল পুড়িয়েছে’

হাদির মৃত্যুর ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে একটি চক্র বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট ভবনে আগুন দেবে, ভাঙচুর চালাবে তা যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না আফরোজা খাতুন নামে একজন অভিভাবক। তিনি বলেন, ‘আমরা রাতে ঘরে থেকেই বুঝতে পারছি ছায়ানটে হামলা হবে। অথচ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বুঝতে পারেননি বা ছায়ানটকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি। আমার সন্তান তো এখানে লেখাপড়া করে, এটা স্কুল। ওরা আমার সন্তানের স্কুলে আগুন দিয়েছে।’ শুক্রবার সকালেই ছায়ানট ভবনের সামনে ছুটে আসেন তিনি। আফরোজা বলেন, ‘রাতে যখন মোবাইল ফোনে ছায়ানটে হামলার ভিডিও দেখছিলাম, পাশে বসে আমার ছেলে বলছে, ‘মা চলো- আমাদের স্কুল ভেঙে ফেলতেছে’। তখন যে কতটা খারাপ লেগেছে। রাতে যখন শুনছিলাম ছায়ানটে হামলা হতে পারে, ধানমন্ডি থানার ওসিকে কয়েকবার আমি ফোনে চেষ্টা করেছি, তিনি ফোন ধরেননি।’

‘স্থির প্রত্যয় যাত্রায় অবিচল থাকার’ অঙ্গীকার ছায়ানটের

স্থির প্রত্যয় যাত্রায় অবিচল থাকার অঙ্গীকারের কথা জানিয়েছে বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট। সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে সমাজ গড়তে প্রয়াসী বলে জানিয়েছে এই সংগঠনটি। ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান বিন হাদির মর্মান্তিক মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত হওয়ার কথাও জানিয়েছে ছায়ানট। কিন্তু ওই সূত্র ধরে ছায়ানট-সংস্কৃতি ভবনে কেন হামলা সংঘটিত হলো তা মোটেই বোধগম্য নয় জানিয়ে ছায়ানট বলেছে, ‘হয়তো পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করেছে সংস্কৃতি চর্চার বিরোধী গোষ্ঠী।’

শুক্রবারসন্ধ্যায় ছায়ানটের সভাপতি সারওয়ার আলী ও সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসার দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়, ১৮ তারিখ (গত) রাত ১২টার পর ওসমান হাদির মর্মান্তিক মৃত্যুকে উপলক্ষ্য করে একজোট লোক ছায়ানট-সংস্কৃতি ভবনে জোরপূর্বক প্রবেশ করে ভাঙচুর ও লুটতরাজ চালায় এবং অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করে। তারা ছয়তলা ভবনের প্রতিটি সিসি ক্যামেরাসহ অধিকাংশ কক্ষ, প্রক্ষালণ কক্ষ এবং বহু বাদ্যযন্ত্র, মিলনায়তন, কম্পিউটার ও আসবাবপত্র ভাঙচুর করেছে। সার্ভারসহ ছায়ানটের কিছু বাদ্যযন্ত্র ও আসবাবপত্র পুড়িয়ে দিয়েছে। অন্তত ৭টি ল্যাপটপসহ চারটি ফোন ও কিছু হার্ডডিস্ক লুট করেছে। তাদের ভাঙচুরে বৈদ্যুতিক সংযোগ ও সরঞ্জামও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই হামলার ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছে ছায়ানট।

‘নগর-মহানগর’ : আরও খবর

সম্প্রতি