মঙ্গলবার ৯ ডিসেম্বও, নারী জাগরনের অগ্রদূত মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া দিবস। তার জন্মস্থান রংপুরের পায়রাবন্দে প্রতিবছরই এক মাস আগে থেকেই দিনটি পালন করা নিয়ে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্তাদের শুরু হয় দৌড়ঝাপ।
বেগম রোকেয়ার জন্যই নারী জাতি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, অথচ তার বাস্তুভিটা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে
দৃষ্টিনন্দন স্মৃতি কেন্দ্রটি ৭ বছর পর আবারও চালুর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলা একাডেমি
বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান রংপুরের পায়রাবন্দে স্মৃতি কেন্দ্র সহ ধ্বংসপ্রাপ্ত বাস্তুভিটায় চলে ধোয়া-মোছা, রং করা ও পরিষ্কার করার কাজ।
তবে দীর্ঘদিন পর বাংলা একাডেমি ও রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে যৌথভাবে আলোচনা অনুষ্ঠান হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর অনেকদিন পর স্মৃতি কেন্দ্রে দুস্থ নারীদের জন্য সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, শিশু-কিশোর-কিশোরীদের জন্য আর্ট ও সংগীত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সোমবার, (০৮ ডিসেম্বর ২০২৫) তা উদ্বোধন করার ঘোষণা দিয়েছে বাংলা একাডেমি।
এবারও ৭ দিন ব্যাপী গ্রহণ করা হয়েছে নানা কর্মসূচি। কিন্তু রোকেয়ার স্মৃতিকে জাগরুক করে রাখা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হওয়া বাস্তুভিটা আর স্মৃতি কেন্দ্র সংস্কারের জন্য দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
সরেজমিনে নারী জাগরনের অগ্রদূত মহীয়সী বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে ঘুরে এলাকাবাসি ও শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, রোকেয়ার স্মৃতিকে ধরে রাখা, সুবিধাবঞ্চিত নারীদের পুনর্বাসন এবং রোকেয়ার জীবন ও রচিত গ্রন্থ নিয়ে গবেষণা করার জন্য ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে পায়রাবন্দে নির্মাণ করা হয় দৃষ্টিনন্দন বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর স্মৃতি কেন্দ্রটি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতা বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৮ সালে মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন ক্ষমতায় আসলে স্মৃতি কেন্দ্রটি পুনরায় চালু করার উদ্যোগ নেয়া হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এরপর স্মৃতি কেন্দ্র কার অধীনে থাকবে এ নিয়ে মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমির মধ্যে টাগ অব ওয়ার শুরু হয়। এ ব্যাপারে স্মৃতি কেন্দ্রের তিন কর্মকর্তা-কর্মচারী হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করে। শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট স্মৃতি কেন্দ্রটির দায়িত্ব বাংলা একাডেমির কাছে ন্যস্ত করে এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বকেয়া বেতনসহ তাদের রাজস্ব খাতে গ্রহণ করার নির্দেশ দান করে।
এ ব্যাপারে বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক ও রোকেয়া গবেষক রফিকুল ইসলাম দুলাল জানান, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর ২০১৮ সালে আবারও বাংলা একাডেমি স্মৃতি কেন্দ্র সহ বেগম রোকেয়া বাস্তুভিটা সহ পুরো কমপ্লেক্স এর দায়িত্ব গ্রহণ করে কিন্তু ৭ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও বাংলা একাডেমি স্মৃতি কেন্দ্রটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, এবার বেগম রোকেয়া দিবস উদযাপনের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কোনো অর্থ বরাদ্দ করে নাই যা দুঃখজনক। তিনি বলেন, আমরা পায়রাবন্দবাসি সহ রংপুরের সর্বস্তরের মানুষের দাবি বেগম রোকেয়ার কবর ভারতের কলকাতা থেকে পায়রাবন্দে নিয়ে আসা। এজন্য সংস্কৃতি ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনেকবার বলার পরও তারা কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
এদিকে দীর্ঘ ৭ বছর পর আবারও চালু করা হচ্ছে স্মৃতি কেন্দ্রটি। কিন্তু একজন কর্মকর্তা একজন সহকারী লাইব্রেরিয়ান নিয়োগ দেয়া ছাড়া আর কিছুই হয়নি। এখনও সেখানে লাইব্রেরি আছে কিন্তু বই নেই। বেগম রোকেয়াকে নিয়ে গবেষণা করার কোনো উদ্যোগ ও ব্যবস্থা নেই।
এদিকে ১৫ বছর আগে নির্মিত স্মৃতি কেন্দ্রটি সংস্কারের অভাবে ভবনের পলেষ্টারা উঠে যাচ্ছে। দৃষ্টিনন্দন অডিটোরিয়ামটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভবনের বিভিন্ন স্থানে ফাটল ধরেছে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মূল্যবান জিনিসপত্র। ভবনটি সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেই। যার ফলে কার্যত ৭ বছর ধরে স্মৃতি কেন্দ্রটি পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। স্মৃতি কেন্দ্রের মূল ভবন, অডিটোরিয়াম, গেষ্ট হাউসসহ স্থাপনাগুলো জরুরিভিত্তিতে সংস্কার করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
একই অবস্থা বেগম রোকেয়ার বাস্তুভিটায় দীর্ঘদিনেও কোনো স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়নি। অযতে্ন অবহেলায় বাস্তুভিটা এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বেগম রোকেয়ার ধ্বংস হয়ে যাওয়া বসতভিটা এবং বন্ধ স্মৃতি কেন্দ্র দেখে তীব্র ক্ষোভ আর হতাশা প্রকাশ করেন। আগে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা আসলেও দু’বছর ধরে দর্শনার্থীদের আনাগোনাও একেবারে কমে গেছে বলে এখানে কর্মরত এক কর্মচারী জানায়।
এ ব্যাপারে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গবেষক ড. তুহিন ওয়াদুদ এবং রোকেয়া গবেষক ড. শ্বাশত ভট্টাচার্য বলেন, নারী জাগরণের অগ্রদূত মহীয়সী বেগম রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেছিলেন রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে। ক্ষণজন্মা রোকেয়া নারী জাতির জন্য যে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন তার কারণেই নারীরা এখন শিক্ষা-দীক্ষা রাজনীতি ব্যবসাসহ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়েছে। পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিযোগিতা করে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করছে। তারপরও আরও অনেক দূর যেতে হবে। দু’জনই বেগম রোকেয়ার স্মৃতিকে জাগরুক করার কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, শুধু ৯ ডিসেম্বর আসলেই মাতামাতি করলে চলবে না, তার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য চাই বাস্তব উদ্যোগ।
সার্বিক ব্যাপারে জানতে স্মৃতি কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবিদ করিম মুন্নার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এবার স্মৃতি কেন্দ্রে দুস্থঃ নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আর্ট শিক্ষা ও সংগীত শিক্ষার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ৯ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার) আনুষ্ঠানিকভাবে ৭ দিন ব্যাপী অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করা হবে।