কয়লা সঙ্কটে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। বকেয়া বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ অর্ধেক করে দিয়েছে ভারতের আদানি। এদিকে এস আলমের বাঁশখালী (এস এস পাওয়ার) এবং রামপাল থেকেও আসছে সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ।
কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে শুধু পায়রা পূর্ণ সক্ষমতা উৎপাদনে রয়েছে। পটুয়াখালীর এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে একটানা পূর্ণ সক্ষমতায় (কমবেশি ১২৪৪ মেগাওয়াট) বিদ্যুৎ নিচ্ছে পিডিবি।
এরপরও, চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ কমে যাওয়া লোডশেডিং মোকাবিলায় তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে।
লোডশেডিং তুলনামূলক কমেছে
শনিবার (২ নভেম্বর) দেশে দিনে-রাতে বিভিন্ন সময় সোয়া ১১ হাজার থেকে প্রায় ১২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদা ছিল। এ সময় দুইশ’ থেকে প্রায় সাতশ’ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হয়েছে। যা আগের কয়েক দিনের তুলানায় কম ছিল। ১ নভেম্বর শুক্রবার রাত একটায় দেশে সর্বোচ্চ ১৬৮৫ মেগাওয়াট, এর আগের দিন বৃহস্পতিবার রাতে সর্বোচ্চ ১৫৭৬ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। এছাড়া দিনে-রাতে বিভিন্ন সময় কমবেশি লোডশেডিং ছিল।
পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এক সপ্তাহ আগেও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সোয়া কোটি ইউনিট (কিলোওয়াট/ঘণ্টা) থেকে দেড় কোটি ইউনিটের মধ্যে ছিল।
বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বাড়ছে
গত ২৫ অক্টোবর, দেশে চাহিদার যোগান দিতে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে ১৩ দশমিক ৭ মিলিয়ন কিলোওয়াট/ঘণ্টা বা প্রায় ১ কোটি ৩৭ লাখ ইউনিট। জ্বালানি ব্যয় হয়েছে প্রায় ২৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। পরদিন ২৬ অক্টোবর তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৩ কোটি ১২ লাখ ইউনিট। জ্বালানি ব্যয় হয় ৫৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। একদিনের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে উৎপাদনে খরচ বেড়ে যায় ৩১ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।
২৭ অক্টোবর তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় ৩ কোটি ৮৩ লাখ ইউনিট, ২৮ অক্টোবর উৎপাদন করা হয় ৪ কোটি ১৫ লাখ ইউনিট, ২৯ অক্টোবর ৪ কোটি ৫ লাখ ইউনিট, ৩০ অক্টোবর তেলভিত্তিক উৎপাদন ছিল ৪ কোটি ৯ লাখ ইউনিট।
এ সময় গ্যাস, কয়লা, তেলা, সোলার, হাইড্রো (আমদানিসহ) অর্থাৎ সব ধরণের জ্বালানি মিলিয়ে মোট উৎপাদন ছিল ২৫৭ মিলিয়ন ইউনিট থেকে ২৮৫ মিলিয়ন ইউনিট।
কয়লার বড় ৪ বিদ্যুৎ কেন্দ্র
দেশে কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে পটুয়াখালীর পায়রা, বাগেরহাটের রামপাল ও চট্টগ্রামে এস আলমের বাঁশখালী এসএস পাওয়ারের স্থাপিত সক্ষমতা ১৩২০ মেগাওয়াট। এরমধ্যে পায়রা গ্রিডে দিতে পারে ১২৪৪ মেগাওয়াট, রামপাল ১২৩৪ মেগাওয়াট এবং এস আলম দিতে পারে ১২২৪ মেগাওয়াট।
মাতারবাড়ির স্থাপিত ক্ষমতা ১২০০ মেগাওয়াট, গ্রিডে দিতে পারে ১১৫০ মেগাওয়াট।
একটি পূর্ণ সক্ষমতায়
চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে একমাত্র পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদনে রয়েছে। এনএলডিসির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে একটানা ১২০০-১২৪৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নিচ্ছে পিডিবি।
বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ উদ্যোগে গঠিত বাংলাদেশ-চীন পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল) পটুয়াখালীর পায়রায় এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করে। মালিকানায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) ও চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনের (সিএমসি) সমান (৫০:৫০) অংশীদারিত্ব রয়েছে। পায়রার প্রথম ইউনিটটি ২০২০ সালের ১৫ মে এবং দ্বিতীয় ইউনিটটি একই বছর ৮ ডিসেম্বর বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে।
এভাবে, একটানা পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন অব্যাহত রাখা হলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিদ্যুৎকেন্দ্র সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে পিডিবির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রর দুটি ইউনিট ২০২০ সালে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। মেইনটেন্সে পিরিয়ড ছাড়া পুরো সময় এই কেন্দ্র থেকে টানা বিদ্যুৎ নেয়া হচ্ছে। সমস্যাতো হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে কেন্দ্র নির্মাতাদের (সিএমসি) সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা (চীনা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান) বলেছে, কেন্দ্রটি সাসটেইনেবল, প্রবলেম হবে না।’
পিডিবির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ২৪ অক্টোবর মাতারবাড়ি থেকে গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল ছিল। ওইদিন কেন্দ্রটি থেকে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়েছে ১৫৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। কয়লা মজুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় পরদিন কেন্দ্রটির উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
কয়লার অভাবে বন্ধ রয়েছে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর প্রথম ও দ্বিতীয় ইউনিট বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে যথাক্রমে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এবং ২০২৪ সালের জুলাইয়ে। জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) অর্থায়ন এবং রাষ্ট্রীয় কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিপিজিসিবিএল) অধীনে এই কেন্দ্রটি নির্মিত হয়।
কয়লার অভাবে উৎপাদন অর্ধেক কমেছে রামপাল ও বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রে। এ সময়, এস আলমের বাঁশখালীর একটি ইউনিট রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে। রামপাল নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (প্রাইভেট) লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল)। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে সম-অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে এই কোম্পানি গঠিত হয়েছে। এস এস পাওয়ার নির্মিত হয়েছে দেশীয় শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ এবং চীনা কোম্পানি সেপকো থ্রি ও এইচটিজির যৌথ উদ্যোগে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে এস আলমের অধীনস্থ ৬টি প্রতিষ্ঠানের অংশীদারিত্ব ৭০ শতাংশ। অবশিষ্ট ৩০ শতাংশ চীনের দুই কোম্পানির।
**আদানির সরবরাহ অর্ধেকে**
কয়লাভিত্তিক তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রে সংকটকালে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে ভারতের আদানি পাওয়ার ঝাড়খ- লিমিটেড (এপিজেএল)। সময়মতো বকেয়া বিল না পেয়ে তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। ন্যাশনাল লোড ডেসপ্যাচ সেন্টারের (এনএলডিসি) তথ্যে দেখা গেছে, গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে আদানি প্ল্যান্ট অর্ধেক বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।
স্থাপিত সক্ষমতা ১৬০০ মেগাওয়াটের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির একটি ইউনিট থেকে বর্তমানে প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশে সরবরাহ করছে। একই সক্ষমতার অন্য ইউনিটর উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে। আদানির দাবি, পিডিবির কাছে তাদের ৮৮৬ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ১০ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা) বকেয়া রয়েছে।
পিডিবির সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আদানি কয়লার দাম বেশি ধরে সেই টাকা পরিশোধ করতে বলছে। তবে কয়লার চড়া দাম দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।
**কয়লার দাম বেশি**
পিবির সূত্র বলছে, পটুয়াখালীর পায়রায় নির্মিত ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পিডিবির কাছ থেকে প্রতি টন কয়লার দাম নিচ্ছে ৭৫ মার্কিন ডলার। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের এস এস পাওয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি টন কয়লার দাম ধরছে কমবেশি ৮০ ডলার। আদানি গ্রুপ প্রতি টন কয়লার দাম চাইছে ৯৬ ডলার।
বাড়তি দাম নিয়ে বিরোধ ও বকেয়া পরিশোধের তাগিদের মধ্যে সর্বশেষ গত ২৮ অক্টোবর পিডিবিকে চিঠি দেয় আদানি। এতে বলা হয়, পিডিবি যাতে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৩০ অক্টোবরের মধ্যে বকেয়া পরিশোধের ব্যবস্থা নেয়, নইলে আদানি ক্রয়চুক্তি অনুযায়ী ৩১ অক্টোবর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখতে বাধ্য হবে। কারণ, আদানি চলতি মূলধনের সংকটে রয়েছে।
পিডিবি সূত্র বলছে, বিদ্যুৎ আমদানিতে আদানির নামে ঋণপত্র (এলসি) খোলার কথা ছিল ৩০ অক্টোবরের মধ্যে। এই ঋণপত্র খোলার কথা ছিল কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে; কিন্তু সেটা হয়নি। পিডিবি আরও সময় চেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার থেকে একটি ইউনিট বন্ধ করে দিয়েছে আদানি।
রোববার, ০৩ নভেম্বর ২০২৪
কয়লা সঙ্কটে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। বকেয়া বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ অর্ধেক করে দিয়েছে ভারতের আদানি। এদিকে এস আলমের বাঁশখালী (এস এস পাওয়ার) এবং রামপাল থেকেও আসছে সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ।
কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে শুধু পায়রা পূর্ণ সক্ষমতা উৎপাদনে রয়েছে। পটুয়াখালীর এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে একটানা পূর্ণ সক্ষমতায় (কমবেশি ১২৪৪ মেগাওয়াট) বিদ্যুৎ নিচ্ছে পিডিবি।
এরপরও, চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ কমে যাওয়া লোডশেডিং মোকাবিলায় তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে।
লোডশেডিং তুলনামূলক কমেছে
শনিবার (২ নভেম্বর) দেশে দিনে-রাতে বিভিন্ন সময় সোয়া ১১ হাজার থেকে প্রায় ১২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদা ছিল। এ সময় দুইশ’ থেকে প্রায় সাতশ’ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হয়েছে। যা আগের কয়েক দিনের তুলানায় কম ছিল। ১ নভেম্বর শুক্রবার রাত একটায় দেশে সর্বোচ্চ ১৬৮৫ মেগাওয়াট, এর আগের দিন বৃহস্পতিবার রাতে সর্বোচ্চ ১৫৭৬ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। এছাড়া দিনে-রাতে বিভিন্ন সময় কমবেশি লোডশেডিং ছিল।
পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এক সপ্তাহ আগেও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সোয়া কোটি ইউনিট (কিলোওয়াট/ঘণ্টা) থেকে দেড় কোটি ইউনিটের মধ্যে ছিল।
বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বাড়ছে
গত ২৫ অক্টোবর, দেশে চাহিদার যোগান দিতে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে ১৩ দশমিক ৭ মিলিয়ন কিলোওয়াট/ঘণ্টা বা প্রায় ১ কোটি ৩৭ লাখ ইউনিট। জ্বালানি ব্যয় হয়েছে প্রায় ২৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। পরদিন ২৬ অক্টোবর তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৩ কোটি ১২ লাখ ইউনিট। জ্বালানি ব্যয় হয় ৫৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। একদিনের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে উৎপাদনে খরচ বেড়ে যায় ৩১ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।
২৭ অক্টোবর তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় ৩ কোটি ৮৩ লাখ ইউনিট, ২৮ অক্টোবর উৎপাদন করা হয় ৪ কোটি ১৫ লাখ ইউনিট, ২৯ অক্টোবর ৪ কোটি ৫ লাখ ইউনিট, ৩০ অক্টোবর তেলভিত্তিক উৎপাদন ছিল ৪ কোটি ৯ লাখ ইউনিট।
এ সময় গ্যাস, কয়লা, তেলা, সোলার, হাইড্রো (আমদানিসহ) অর্থাৎ সব ধরণের জ্বালানি মিলিয়ে মোট উৎপাদন ছিল ২৫৭ মিলিয়ন ইউনিট থেকে ২৮৫ মিলিয়ন ইউনিট।
কয়লার বড় ৪ বিদ্যুৎ কেন্দ্র
দেশে কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে পটুয়াখালীর পায়রা, বাগেরহাটের রামপাল ও চট্টগ্রামে এস আলমের বাঁশখালী এসএস পাওয়ারের স্থাপিত সক্ষমতা ১৩২০ মেগাওয়াট। এরমধ্যে পায়রা গ্রিডে দিতে পারে ১২৪৪ মেগাওয়াট, রামপাল ১২৩৪ মেগাওয়াট এবং এস আলম দিতে পারে ১২২৪ মেগাওয়াট।
মাতারবাড়ির স্থাপিত ক্ষমতা ১২০০ মেগাওয়াট, গ্রিডে দিতে পারে ১১৫০ মেগাওয়াট।
একটি পূর্ণ সক্ষমতায়
চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে একমাত্র পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদনে রয়েছে। এনএলডিসির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে একটানা ১২০০-১২৪৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নিচ্ছে পিডিবি।
বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ উদ্যোগে গঠিত বাংলাদেশ-চীন পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল) পটুয়াখালীর পায়রায় এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করে। মালিকানায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) ও চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনের (সিএমসি) সমান (৫০:৫০) অংশীদারিত্ব রয়েছে। পায়রার প্রথম ইউনিটটি ২০২০ সালের ১৫ মে এবং দ্বিতীয় ইউনিটটি একই বছর ৮ ডিসেম্বর বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে।
এভাবে, একটানা পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন অব্যাহত রাখা হলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিদ্যুৎকেন্দ্র সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে পিডিবির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রর দুটি ইউনিট ২০২০ সালে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। মেইনটেন্সে পিরিয়ড ছাড়া পুরো সময় এই কেন্দ্র থেকে টানা বিদ্যুৎ নেয়া হচ্ছে। সমস্যাতো হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে কেন্দ্র নির্মাতাদের (সিএমসি) সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা (চীনা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান) বলেছে, কেন্দ্রটি সাসটেইনেবল, প্রবলেম হবে না।’
পিডিবির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ২৪ অক্টোবর মাতারবাড়ি থেকে গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল ছিল। ওইদিন কেন্দ্রটি থেকে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়েছে ১৫৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। কয়লা মজুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় পরদিন কেন্দ্রটির উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
কয়লার অভাবে বন্ধ রয়েছে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর প্রথম ও দ্বিতীয় ইউনিট বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে যথাক্রমে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এবং ২০২৪ সালের জুলাইয়ে। জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) অর্থায়ন এবং রাষ্ট্রীয় কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিপিজিসিবিএল) অধীনে এই কেন্দ্রটি নির্মিত হয়।
কয়লার অভাবে উৎপাদন অর্ধেক কমেছে রামপাল ও বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রে। এ সময়, এস আলমের বাঁশখালীর একটি ইউনিট রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে। রামপাল নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (প্রাইভেট) লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল)। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে সম-অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে এই কোম্পানি গঠিত হয়েছে। এস এস পাওয়ার নির্মিত হয়েছে দেশীয় শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ এবং চীনা কোম্পানি সেপকো থ্রি ও এইচটিজির যৌথ উদ্যোগে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে এস আলমের অধীনস্থ ৬টি প্রতিষ্ঠানের অংশীদারিত্ব ৭০ শতাংশ। অবশিষ্ট ৩০ শতাংশ চীনের দুই কোম্পানির।
**আদানির সরবরাহ অর্ধেকে**
কয়লাভিত্তিক তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রে সংকটকালে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে ভারতের আদানি পাওয়ার ঝাড়খ- লিমিটেড (এপিজেএল)। সময়মতো বকেয়া বিল না পেয়ে তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। ন্যাশনাল লোড ডেসপ্যাচ সেন্টারের (এনএলডিসি) তথ্যে দেখা গেছে, গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে আদানি প্ল্যান্ট অর্ধেক বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।
স্থাপিত সক্ষমতা ১৬০০ মেগাওয়াটের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির একটি ইউনিট থেকে বর্তমানে প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশে সরবরাহ করছে। একই সক্ষমতার অন্য ইউনিটর উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে। আদানির দাবি, পিডিবির কাছে তাদের ৮৮৬ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ১০ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা) বকেয়া রয়েছে।
পিডিবির সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আদানি কয়লার দাম বেশি ধরে সেই টাকা পরিশোধ করতে বলছে। তবে কয়লার চড়া দাম দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।
**কয়লার দাম বেশি**
পিবির সূত্র বলছে, পটুয়াখালীর পায়রায় নির্মিত ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পিডিবির কাছ থেকে প্রতি টন কয়লার দাম নিচ্ছে ৭৫ মার্কিন ডলার। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের এস এস পাওয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি টন কয়লার দাম ধরছে কমবেশি ৮০ ডলার। আদানি গ্রুপ প্রতি টন কয়লার দাম চাইছে ৯৬ ডলার।
বাড়তি দাম নিয়ে বিরোধ ও বকেয়া পরিশোধের তাগিদের মধ্যে সর্বশেষ গত ২৮ অক্টোবর পিডিবিকে চিঠি দেয় আদানি। এতে বলা হয়, পিডিবি যাতে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৩০ অক্টোবরের মধ্যে বকেয়া পরিশোধের ব্যবস্থা নেয়, নইলে আদানি ক্রয়চুক্তি অনুযায়ী ৩১ অক্টোবর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখতে বাধ্য হবে। কারণ, আদানি চলতি মূলধনের সংকটে রয়েছে।
পিডিবি সূত্র বলছে, বিদ্যুৎ আমদানিতে আদানির নামে ঋণপত্র (এলসি) খোলার কথা ছিল ৩০ অক্টোবরের মধ্যে। এই ঋণপত্র খোলার কথা ছিল কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে; কিন্তু সেটা হয়নি। পিডিবি আরও সময় চেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার থেকে একটি ইউনিট বন্ধ করে দিয়েছে আদানি।