মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সময়কার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল যে অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন, সেই অভিযোগেও মৃত্যুদণ্ড চেয়ে আপিল করেছে প্রসিকিউশন।
সোমবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় এই আপিল দাখিল করা হয়। আপিলে সাজা বাড়ানোর পক্ষে আটটি আইনি যুক্তি (গ্রাউন্ড) তুলে ধরা হয়েছে।
আপিল দাখিলের পর প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম সাংবাদিকদের বলেন, আমৃত্যু কারাদণ্ডকে মৃত্যুদণ্ডে রূপান্তরের দাবিতে আপিল বিভাগে আবেদন করা হয়েছে। তিনি জানান, রায় ঘোষণার ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করার বিধান রয়েছে এবং নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেই আপিল করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী আপিল দায়েরের পর ৬০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির কথা থাকায় তিনি আশা প্রকাশ করেন, এই সময়ের মধ্যেই আপিলের শুনানি ও নিষ্পত্তি হবে।
প্রসিকিউটর গাজী তামিম বলেন, সংঘটিত অপরাধের নৃশংসতা ও ভয়াবহতার তুলনায় আমৃত্যু কারাদণ্ড যথেষ্ট নয়। তার মতে, এ ধরনের গুরুতর ও ভয়াবহ অপরাধের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডই একমাত্র উপযুক্ত শাস্তি হওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, সংশ্লিষ্ট আইনে শাস্তি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কারণ, আসামিদের নির্দেশ বা উসকানিতে এক হাজার ৪০০ জনের বেশি মানুষ শহীদ হয়েছেন এবং ২৫ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন।
উল্লেখ্য, গত ১৭ নভেম্বর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খাঁন কামালকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে।
রায়ে বলা হয়, আসামিদের বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে দ্বিতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অভিযোগে শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তবে এক নম্বর অভিযোগ—‘প্ররোচনা, হত্যার নির্দেশ এবং বলপ্রয়োগ বন্ধ করতে ব্যর্থতা’র দায়ে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
অন্যদিকে, আসাদুজ্জামান খাঁন কামালকে চানখাঁরপুল ও আশুলিয়ার দুটি ঘটনার জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আরেকটি অভিযোগে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
এ মামলায় রাজসাক্ষী হওয়া তৃতীয় আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
সাজা বাড়াতে প্রসিকিউশনের উপস্থাপিত আটটি আইনি যুক্তি
১. আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন-১৯৭৩-এ শাস্তির বর্ণনায় প্রথমেই মৃত্যুদণ্ডের কথা উল্লেখ রয়েছে। এরপর অপরাধের ভয়াবহতা (গ্রাভিটি অব দ্য অফেন্স) বিবেচনার বিষয়টি বলা হয়েছে। যেহেতু আইনে নির্দিষ্ট শাস্তি বিধান করা আছে, তাই সব অভিযোগেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার যোগ্যতা রয়েছে।
২. জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত অপরাধ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। সেখানে ‘নিষ্ঠুরতম’ অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, যার একমাত্র উপযুক্ত শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
৩. নিরস্ত্র ও নিরীহ মানুষের ওপর যে মাত্রায় ও পরিসরে হামলা হয়েছে, তা ছিল ভয়াবহ। এ ধরনের আক্রমণের জন্য মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য কোনো শাস্তি আইনসম্মত হতে পারে না।
৪. আইন অনুযায়ী এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডই একমাত্র শাস্তি হওয়া উচিত।
৫. কেবল আসামিদের অধিকার বিবেচনা করলেই চলবে না। ভুক্তভোগীদের অধিকার এবং সমাজের যৌক্তিক প্রত্যাশাও বিবেচনায় নিতে হবে। সমাজ এ ধরনের অপরাধের জন্য কী ধরনের শাস্তি প্রত্যাশা করে এবং ভবিষ্যতে এমন অপরাধ প্রতিরোধে কোন শাস্তি কার্যকর হবে—সেটিও আদালতের বিবেচ্য হওয়া উচিত ছিল। এ ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডই উপযুক্ত শাস্তি।
৬. আসামিরা জানতেন যে তাদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে মামলা চলছে এবং সাজা হচ্ছে। তারা এটাও জানতেন যে আপিলের সময়সীমা ৩০ দিন। এসব জেনেও তারা পলাতক থেকেছেন এবং বিভিন্ন ট্রায়ালে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিয়ে গেছেন। এ ধরনের আচরণের পর তাদের শাস্তি কমানোর কোনো সুযোগ নেই।
৭. আসামিদের সরাসরি আদেশ ও নির্দেশে যে হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে, তা ছিল পৈশাচিক। তাদের নির্দেশে সারাদেশে এক হাজার ৪০০-এর বেশি মানুষ শহীদ এবং ২৫ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন।
৮. এক নম্বর অভিযোগে উল্লেখিত আবু সাঈদ ছিলেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অগ্রদূত। তার হত্যাকাণ্ডেও আসামিদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এ কারণে ওই অভিযোগেও মৃত্যুদণ্ডই ন্যায়বিচার হতো।