alt

উপ-সম্পাদকীয়

রক্তাক্ত মাতৃভাষা, বঙ্গবন্ধু ও বাংলা ভাষা

মোস্তাফা জব্বার

: সোমবার, ০৫ এপ্রিল ২০২১

পাঁচ

দুঃখজনক হলেও সত্য যে পাকিস্তান গণপরিষদে মুসলিম লীগ দলের কোন বাঙালি সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে সমর্থন করে কথা বলেননি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই যে খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্ববাংলার গণমানুষের ভাষার স্বপক্ষে কথা বলেননি বরং খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দুর পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে বলেন, সংসদ নেতা এটি স্পষ্ট করেছেন যে বাংলাকে প্রাদেশিক ভাষা রাখা হবে এবং আমি বিশ্বাস করি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে। বাংলাকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা করার কোন যৌক্তিক কারণ নাই তবে বাংলা প্রদেশের জন্য এটি হতে পারে। ফলে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আনীত বাংলা ভাষা প্রস্তাব ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ পাকিস্তান সরকারের একগুঁয়েমি এবং মুসলিম লীগ নেতাদের অদূরদর্শিতার কারণে বাতিল হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের আচরণকে ব্যাখ্যা করে বলেন, “... করাচিতে গণপরিষদে এই মর্মে প্রস্তাব পাস করা হলো যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, তখন থেকেই বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত। তখন কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একমাত্র এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু বলেন আমি অবাক হয়ে যাই ওই সময় আমাদের বাঙালি মুসলিম নেতৃবৃন্দ কি করেছিল?..”

কাগজে কলমে, ঘরোয়া বৈঠকে আলাপচারিতায় ও পাকিস্তান গণপরিষদে ভাষা প্রশ্ন আলোচিত হবার পর বাংলা ভাষা আন্দোলন নেমে আসে রাজপথে। গণপরিষদে বাংলা ভাষাবিরোধী সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে ঢাকায় ছাত্র সমাজ বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট পালন করে। বাঙালির জাতিসত্তা গড়ে তোলার জন্য বাংলা ভাষাই যে শ্রেষ্ঠতম একক সেটি নিয়ে আর যা ধারণাই থাকুক না কেন বঙ্গবন্ধু দৃঢ়তার সঙ্গে সেই অনন্য একককেই ধারণ করেছিলেন। সেজন্য পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রথম ধর্মঘট সংগঠিত করার জন্য তিনি সর্বশক্তি নেয়োগ করেন।

১০ মার্চ রাতে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের একটি সভা বসলো। সভায় আপোষকারীদের ষড়যন্ত্র শুরু হলো। রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহ্বায়কসহ অনেকেই তখন দোদুল্যমানতায় ভুগছে, আপোষ করতে চাইছে সরকারের সঙ্গে। একটা বজ্রকণ্ঠ সচকিত হয়ে উঠলো তখন’ সরকার কি আপস প্রস্তাব দিয়েছে? নাজিমুদ্দিন সরকার কি বাংলা ভাষার দাবি মেনে নিয়েছে? যদি তা না হয়ে থাকে তবে আগামীকাল ধর্মঘট হবে, সেক্রেটারিয়েটের সামনে পিকেটিং হবে। এই বজ্রকণ্ঠ ছিল বঙ্গবন্ধুর। ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন দিলেন অলি আহাদ, মোগলটুলির শওকত সাহেব, শামসুল হক সাহেব। আপোষকামীদের ষড়যন্ত্র ভেসে গেল।

বঙ্গবন্ধুসহ ছাত্রনেতারা জেলায় জেলায় বেরিয়ে পড়লো। ফরিদপুর, যশোর হয়ে দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশালে ছাত্রসভা করে ওই তারিখের তিন দিন পূর্বে ঢাকায় ফিরে এলেন বঙ্গবন্ধু। মুসলিম লীগ সমর্থক ছাত্ররা সভা পন্ড করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করলেন। ঢাকায় ফিরে এসে কাজ ভাগ করলেন কে কোথায় থাকবে কে কোথায় পিকেটিং করবেন। সামান্য কিছু-সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাড়া শতকরা ৯০ ভাগ ছাত্র এই আন্দোলনে যোগদান করল। ১১ মার্চ ভোরবেলা শত শত ছাত্রকর্মী ইডেন বিল্ডিং, জেনারেল পোস্ট অফিস ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করল। সমস্ত ঢাকা শহর পোস্টারে ভরে ফেলা হলো। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হলো। হক সাহেবকে পূর্বেই জিপে তোলা হলো। বহু ছাত্র গ্রেপ্তার ও জখম হলো। অলি আহাদও গ্রেপ্তার হয়ে গেছে। প্রায় ৭০- ৭৫ জনকে বেঁধে নিয়ে জেলে পাঠিয়ে দিল সন্ধ্যার সময়। ফলে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠল। ঢাকার জনগণের সমর্থন পেলেন তারা। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই,’ ‘বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই,’ ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’- নানা ধরনের স্লোগান চলল। পাকিস্তান সৃষ্টির সাত মাস পূর্তির আগেই বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হলেন। স্বাধীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে এটিই তার প্রথম গ্রেপ্তার। বঙ্গবন্ধুসহ অন্য ছাত্র নেতাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ১৩ মার্চ ছাত্র ধর্মঘট এবং ১৪ মার্চ প্রদেশব্যাপী হরতাল পালিত হলো। আন্দোলন তীব্রতর হতে থাকলে নাজিম উদ্দিন সরকার ছাত্র নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়। উভয়পক্ষ মিলে একটি খসড়া চুক্তি প্রণয়ন করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুসহ বিশিষ্ট ছাত্রনেতারা ১১ মার্চ থেকে ছিলেন কারাগারে। ছাত্র নেতৃবৃন্দ তাদের অনুমোদন ব্যতীত কোন চুক্তি না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। চুক্তিপত্রটি ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধুসহ বন্দিগণ কর্তৃক অনুমোদনের জন্য কালান্তরালে বৈঠকে মিলিত হন তারা। শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান ও অলি আহাদ বন্দীগণের পক্ষ হইতে খসড়া চুক্তির শর্তাবলী পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর অনুমোদন করলেন। এই ঐতিহাসিক চুক্তির ফলে সর্বপ্রথম বাংলাভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল এবং চুক্তির মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল এবং চুক্তির শর্ত মোতাবেক বঙ্গবন্ধুসহ অন্য ভাষাসৈনিকরা কারামুক্ত হন। এই ঐতিহাসিক চুক্তির ফলে একটি প্রতিষ্ঠিত সরকার এ দেশবাসীর কাছে নতি স্বীকারে বাধ্য হয়েছিল। ১৫ মার্চ আন্দোলনের কয়েকজন নেতৃবৃন্দকে মুক্তিদানের ব্যাপারে সরকার গড়িমসি শুরু করেন। এতে বঙ্গবন্ধু ক্ষিপ্ত ও বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন এবং এর তীব্র প্রতিবাদ করেন।

যদিও চুক্তিতে নাজিমুদ্দিন সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন তবুও বাংলা ভাষা সম্পর্কে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়নি, চুক্তি পরবর্তী ঘটনাবলী থেকে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। খাজা নাজিমুদ্দিনের এই চুক্তি ছিল ভাঁওতাবাজি। জিন্নাহ সাহেবের ঢাকা আগমনকে নিষ্কণ্টক করাÑ যাতে ওই সময় কোন আন্দোলন না হয়। কিন্তু জিন্নাহ সাহেবকে বাংলা ভাষার ব্যাপারে তার ওই চুক্তির কথা খাজা নাজিমুদ্দিন হয় কিছু বলেননি, না হয় তাকে রাজি করাতে পারেননি। তবে চুক্তি মোতাবেক ১৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু এবং নেতৃবৃন্দ জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন।

ওই সময় অন্যান্য বন্দি রণেশ দাশগুপ্ত, ধরণী রায় প্রমুখের অন্য মামলার অজুহাতে মুক্তি দিতে সরকার অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের বন্দিরা বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু বিশেষভাবে চাপাচাপি করলে ১৫ মার্চ রণেশ দাশগুপ্ত ও ধরণী রায়কে বন্দিদের সঙ্গে ছেড়ে দেয়া হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যারা গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বে ছিলেন, যেমন- আব্দুস সামাদ আজাদ, জিল্লুর রহমান, কামরুজ্জামান, আব্দুল মমিন তারা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, বঙ্গবন্ধু জেলখানা থেকে এবং পরে হাসপাতালে থাকাকালীন আন্দোলন সম্পর্কে চিরকুটের মাধ্যমে নির্দেশ পাঠাতেন।

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পালিত ধর্মঘটটি ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথম সফল ধর্মঘট। এই ধর্মঘটে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেপ্তার হন

বস্তুত এর মধ্য দিয়ে এটি আবারও প্রমাণিত হলো যে অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করা বঙ্গবন্ধুর অভিধানে ছিল না।

এটি এখন অনুভব করা যায় যে বঙ্গবন্ধুর হাতে ছাত্রলীগের গড়ে ওঠাটা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভাষা আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরের জাতিসত্তার লড়াইতে এই সংগঠনটির কোন তুলনা হতে পারে না।

এদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ১৬-৩-৪৮ -এ গোপালগঞ্জে সর্বাত্মক হরতাল ডাকা হয়। বিকেলে এসএন একাডেমি এবং এমএন ইনস্টিটিউটের ৪০০ ছাত্র শহরে বিক্ষাভ মিছিল বের করে, “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”, “নাজিমউদ্দিন নিপাত যাক”, “মুজিবকে মুক্তি দাও”, “অন্য গ্রেপ্তারকারীদের মুক্তি দাও” ইত্যাদি সেøাগান দেয়।’ উল্লেখ্য, ঢাকায় এর আগের দিন মুজিবসহ গ্রেপ্তারকৃত নেতাদের মুক্তি দেয়া হয়। সে খবর যথাসময়ে গোপালগঞ্জে না পৌঁছায় ছাত্র বিক্ষোভটি ওইদিন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পালিত ধর্মঘটটি ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথম সফল ধর্মঘট। এই ধর্মঘটে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেপ্তার হন। ১৫ মার্চ তিনি মুক্তিলাভ করলেও অচিরেই তার জীবনে শুরু হয় দীর্ঘ কারাবাস। ১৯৪৯ সালের ২৯ এপ্রিল তাকে ঊচচচঝঙ এর ১৮(২) ধারা মোতাবেক আইন অমান্য কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ এনে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে কত তারিখ পর্যন্ত তিনি এই যাত্রায় জেলে ছিলেন, কত তারিখে মুক্তি পেয়েছেন তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ১৯৪৯ সালের সরকারি কোন নথি না পাওয়ায় এ পর্যন্ত সঠিক তথ্য উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। ২৩ ও ২৪ জুন আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন। এতে কোন সন্দেহ নাই। তিনি সম্ভবত জুলাই মাসের কোন এক সময় মুক্তি লাভ করেছিলেন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর গোয়েন্দা শাখার (আইবি) গোপন নথি এবং পাকিস্তানি গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, একজন সাধারণ ছাত্রনেতা পাকিস্তানি হানাদারদের নজরে পড়েন সেদিন থেকেই যেদিন ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে সমকালীন রাজনীতিবিদসহ ১৪ জন ভাষাবীর সর্বপ্রথম ভাষা-আন্দোলনসহ অন্যান্য দাবি সংবলিত ২১ দফা দাবি নিয়ে একটি ইস্তেহার প্রণয়ন করেছিলেন। ওই ইস্তেহারে ২১ দফা দাবির মধ্যে দ্বিতীয় দাবিটি ছিল রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত। ঐতিহাসিক এই ইস্তেহারটি একটি ছোট পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছিল যার নাম ‘রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইস্তেহার- ঐতিহাসিক দলিল’। উক্ত পুস্তিকাটি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত। এই ইস্তেহার প্রণয়নে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ছিল অনস্বীকার্য এবং তিনি ছিলেন অন্যতম স্বাক্ষরদাতা। ১৫০ নং মোগলটুলীর ‘ওয়ার্কাস ক্যাম্প’ ছিল সে সময়ে প্রগতিশীল ছাত্র-যুবক ও রাজনৈতিক কর্মীদের মিলন কেন্দ্র। ওয়ার্কাস ক্যাম্পের কর্মীরা বাংলা ভাষাসহ পাকিস্তানের অন্যান্য বৈষম্যমূলক দিকগুলো জাতির সামনে তুলে ধরেন। ভাষা আন্দোলনের স্বপক্ষের কর্মীবাহিনী এখানে নিয়মিত জমায়াতে হত এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার নানা কর্ম পরিকল্পনা এখানেই নেয়া হতো। বঙ্গবন্ধু, শওকত আলী, কামরুদ্দিন আহমদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ছিলেন এই ক্যাম্পের প্রাণশক্তি। ‘সাতচল্লিশে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও ১৫০ মোগলটুলীবিরোধী রাজনীতির মূলকেন্দ্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। কলকাতা থেকে শেখ মুজিবুর রহমান, জহিরুদ্দিন, নঈমুদ্দিনের মতো নেতারা প্রথমে ১৫০ মোগলটুলীতেই জমায়েত হন।’ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ সংগঠনটির ভূমিকা খুবই স্মরণীয়। ছাত্রলীগের ১০ দফা দাবির মধ্যে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার ও সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের নিয়োগ এবং বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার দাবি ছিল অন্যতম দাবি।

২৬ ফেব্রুয়ারির ধর্মঘট চলাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তমদ্দুন মজলিস প্রধান অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে এক সমাবেশ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিযারিং কলেজ ও ইঞ্জিনিযারিং স্কুলের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে দলে দলে এ সমাবেশে যোগদান করেন। এই মিছিলের সমগ্র ব্যবস্থাপনায় ও পরিচালনায় শেখ মুজিব বলিষ্ঠ নেতৃত্বদান করেন। শেখ মুজিবসহ সব প্রগতিবাদী ছাত্রনেতাই বাংলা ভাষার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একটি সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে অনুভব করেন।’

ঢাকা, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। সর্বশেষ সম্পাদনা : ২৭ মার্চ, ২০২১।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]

mustafajabbar@gmail.com

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

আউশ ধান : পরিবেশ ও কৃষকবান্ধব ফসল

ছবি

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আতুড়ঘর

চেক ডিজঅনার মামলার অধিক্ষেত্র ও প্রাসঙ্গিকতা

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৃষি

ছবি

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

ছবি

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

রক্তাক্ত মাতৃভাষা, বঙ্গবন্ধু ও বাংলা ভাষা

মোস্তাফা জব্বার

সোমবার, ০৫ এপ্রিল ২০২১

পাঁচ

দুঃখজনক হলেও সত্য যে পাকিস্তান গণপরিষদে মুসলিম লীগ দলের কোন বাঙালি সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে সমর্থন করে কথা বলেননি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই যে খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্ববাংলার গণমানুষের ভাষার স্বপক্ষে কথা বলেননি বরং খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দুর পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে বলেন, সংসদ নেতা এটি স্পষ্ট করেছেন যে বাংলাকে প্রাদেশিক ভাষা রাখা হবে এবং আমি বিশ্বাস করি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে। বাংলাকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা করার কোন যৌক্তিক কারণ নাই তবে বাংলা প্রদেশের জন্য এটি হতে পারে। ফলে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আনীত বাংলা ভাষা প্রস্তাব ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ পাকিস্তান সরকারের একগুঁয়েমি এবং মুসলিম লীগ নেতাদের অদূরদর্শিতার কারণে বাতিল হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের আচরণকে ব্যাখ্যা করে বলেন, “... করাচিতে গণপরিষদে এই মর্মে প্রস্তাব পাস করা হলো যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, তখন থেকেই বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত। তখন কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একমাত্র এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু বলেন আমি অবাক হয়ে যাই ওই সময় আমাদের বাঙালি মুসলিম নেতৃবৃন্দ কি করেছিল?..”

কাগজে কলমে, ঘরোয়া বৈঠকে আলাপচারিতায় ও পাকিস্তান গণপরিষদে ভাষা প্রশ্ন আলোচিত হবার পর বাংলা ভাষা আন্দোলন নেমে আসে রাজপথে। গণপরিষদে বাংলা ভাষাবিরোধী সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে ঢাকায় ছাত্র সমাজ বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট পালন করে। বাঙালির জাতিসত্তা গড়ে তোলার জন্য বাংলা ভাষাই যে শ্রেষ্ঠতম একক সেটি নিয়ে আর যা ধারণাই থাকুক না কেন বঙ্গবন্ধু দৃঢ়তার সঙ্গে সেই অনন্য একককেই ধারণ করেছিলেন। সেজন্য পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রথম ধর্মঘট সংগঠিত করার জন্য তিনি সর্বশক্তি নেয়োগ করেন।

১০ মার্চ রাতে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের একটি সভা বসলো। সভায় আপোষকারীদের ষড়যন্ত্র শুরু হলো। রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহ্বায়কসহ অনেকেই তখন দোদুল্যমানতায় ভুগছে, আপোষ করতে চাইছে সরকারের সঙ্গে। একটা বজ্রকণ্ঠ সচকিত হয়ে উঠলো তখন’ সরকার কি আপস প্রস্তাব দিয়েছে? নাজিমুদ্দিন সরকার কি বাংলা ভাষার দাবি মেনে নিয়েছে? যদি তা না হয়ে থাকে তবে আগামীকাল ধর্মঘট হবে, সেক্রেটারিয়েটের সামনে পিকেটিং হবে। এই বজ্রকণ্ঠ ছিল বঙ্গবন্ধুর। ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন দিলেন অলি আহাদ, মোগলটুলির শওকত সাহেব, শামসুল হক সাহেব। আপোষকামীদের ষড়যন্ত্র ভেসে গেল।

বঙ্গবন্ধুসহ ছাত্রনেতারা জেলায় জেলায় বেরিয়ে পড়লো। ফরিদপুর, যশোর হয়ে দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশালে ছাত্রসভা করে ওই তারিখের তিন দিন পূর্বে ঢাকায় ফিরে এলেন বঙ্গবন্ধু। মুসলিম লীগ সমর্থক ছাত্ররা সভা পন্ড করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করলেন। ঢাকায় ফিরে এসে কাজ ভাগ করলেন কে কোথায় থাকবে কে কোথায় পিকেটিং করবেন। সামান্য কিছু-সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাড়া শতকরা ৯০ ভাগ ছাত্র এই আন্দোলনে যোগদান করল। ১১ মার্চ ভোরবেলা শত শত ছাত্রকর্মী ইডেন বিল্ডিং, জেনারেল পোস্ট অফিস ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করল। সমস্ত ঢাকা শহর পোস্টারে ভরে ফেলা হলো। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হলো। হক সাহেবকে পূর্বেই জিপে তোলা হলো। বহু ছাত্র গ্রেপ্তার ও জখম হলো। অলি আহাদও গ্রেপ্তার হয়ে গেছে। প্রায় ৭০- ৭৫ জনকে বেঁধে নিয়ে জেলে পাঠিয়ে দিল সন্ধ্যার সময়। ফলে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠল। ঢাকার জনগণের সমর্থন পেলেন তারা। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই,’ ‘বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই,’ ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’- নানা ধরনের স্লোগান চলল। পাকিস্তান সৃষ্টির সাত মাস পূর্তির আগেই বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হলেন। স্বাধীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে এটিই তার প্রথম গ্রেপ্তার। বঙ্গবন্ধুসহ অন্য ছাত্র নেতাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ১৩ মার্চ ছাত্র ধর্মঘট এবং ১৪ মার্চ প্রদেশব্যাপী হরতাল পালিত হলো। আন্দোলন তীব্রতর হতে থাকলে নাজিম উদ্দিন সরকার ছাত্র নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়। উভয়পক্ষ মিলে একটি খসড়া চুক্তি প্রণয়ন করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুসহ বিশিষ্ট ছাত্রনেতারা ১১ মার্চ থেকে ছিলেন কারাগারে। ছাত্র নেতৃবৃন্দ তাদের অনুমোদন ব্যতীত কোন চুক্তি না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। চুক্তিপত্রটি ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধুসহ বন্দিগণ কর্তৃক অনুমোদনের জন্য কালান্তরালে বৈঠকে মিলিত হন তারা। শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান ও অলি আহাদ বন্দীগণের পক্ষ হইতে খসড়া চুক্তির শর্তাবলী পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর অনুমোদন করলেন। এই ঐতিহাসিক চুক্তির ফলে সর্বপ্রথম বাংলাভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল এবং চুক্তির মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল এবং চুক্তির শর্ত মোতাবেক বঙ্গবন্ধুসহ অন্য ভাষাসৈনিকরা কারামুক্ত হন। এই ঐতিহাসিক চুক্তির ফলে একটি প্রতিষ্ঠিত সরকার এ দেশবাসীর কাছে নতি স্বীকারে বাধ্য হয়েছিল। ১৫ মার্চ আন্দোলনের কয়েকজন নেতৃবৃন্দকে মুক্তিদানের ব্যাপারে সরকার গড়িমসি শুরু করেন। এতে বঙ্গবন্ধু ক্ষিপ্ত ও বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন এবং এর তীব্র প্রতিবাদ করেন।

যদিও চুক্তিতে নাজিমুদ্দিন সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন তবুও বাংলা ভাষা সম্পর্কে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়নি, চুক্তি পরবর্তী ঘটনাবলী থেকে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। খাজা নাজিমুদ্দিনের এই চুক্তি ছিল ভাঁওতাবাজি। জিন্নাহ সাহেবের ঢাকা আগমনকে নিষ্কণ্টক করাÑ যাতে ওই সময় কোন আন্দোলন না হয়। কিন্তু জিন্নাহ সাহেবকে বাংলা ভাষার ব্যাপারে তার ওই চুক্তির কথা খাজা নাজিমুদ্দিন হয় কিছু বলেননি, না হয় তাকে রাজি করাতে পারেননি। তবে চুক্তি মোতাবেক ১৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু এবং নেতৃবৃন্দ জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন।

ওই সময় অন্যান্য বন্দি রণেশ দাশগুপ্ত, ধরণী রায় প্রমুখের অন্য মামলার অজুহাতে মুক্তি দিতে সরকার অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের বন্দিরা বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু বিশেষভাবে চাপাচাপি করলে ১৫ মার্চ রণেশ দাশগুপ্ত ও ধরণী রায়কে বন্দিদের সঙ্গে ছেড়ে দেয়া হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যারা গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বে ছিলেন, যেমন- আব্দুস সামাদ আজাদ, জিল্লুর রহমান, কামরুজ্জামান, আব্দুল মমিন তারা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, বঙ্গবন্ধু জেলখানা থেকে এবং পরে হাসপাতালে থাকাকালীন আন্দোলন সম্পর্কে চিরকুটের মাধ্যমে নির্দেশ পাঠাতেন।

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পালিত ধর্মঘটটি ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথম সফল ধর্মঘট। এই ধর্মঘটে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেপ্তার হন

বস্তুত এর মধ্য দিয়ে এটি আবারও প্রমাণিত হলো যে অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করা বঙ্গবন্ধুর অভিধানে ছিল না।

এটি এখন অনুভব করা যায় যে বঙ্গবন্ধুর হাতে ছাত্রলীগের গড়ে ওঠাটা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভাষা আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরের জাতিসত্তার লড়াইতে এই সংগঠনটির কোন তুলনা হতে পারে না।

এদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ১৬-৩-৪৮ -এ গোপালগঞ্জে সর্বাত্মক হরতাল ডাকা হয়। বিকেলে এসএন একাডেমি এবং এমএন ইনস্টিটিউটের ৪০০ ছাত্র শহরে বিক্ষাভ মিছিল বের করে, “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”, “নাজিমউদ্দিন নিপাত যাক”, “মুজিবকে মুক্তি দাও”, “অন্য গ্রেপ্তারকারীদের মুক্তি দাও” ইত্যাদি সেøাগান দেয়।’ উল্লেখ্য, ঢাকায় এর আগের দিন মুজিবসহ গ্রেপ্তারকৃত নেতাদের মুক্তি দেয়া হয়। সে খবর যথাসময়ে গোপালগঞ্জে না পৌঁছায় ছাত্র বিক্ষোভটি ওইদিন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পালিত ধর্মঘটটি ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথম সফল ধর্মঘট। এই ধর্মঘটে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেপ্তার হন। ১৫ মার্চ তিনি মুক্তিলাভ করলেও অচিরেই তার জীবনে শুরু হয় দীর্ঘ কারাবাস। ১৯৪৯ সালের ২৯ এপ্রিল তাকে ঊচচচঝঙ এর ১৮(২) ধারা মোতাবেক আইন অমান্য কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ এনে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে কত তারিখ পর্যন্ত তিনি এই যাত্রায় জেলে ছিলেন, কত তারিখে মুক্তি পেয়েছেন তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ১৯৪৯ সালের সরকারি কোন নথি না পাওয়ায় এ পর্যন্ত সঠিক তথ্য উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। ২৩ ও ২৪ জুন আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন। এতে কোন সন্দেহ নাই। তিনি সম্ভবত জুলাই মাসের কোন এক সময় মুক্তি লাভ করেছিলেন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর গোয়েন্দা শাখার (আইবি) গোপন নথি এবং পাকিস্তানি গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, একজন সাধারণ ছাত্রনেতা পাকিস্তানি হানাদারদের নজরে পড়েন সেদিন থেকেই যেদিন ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে সমকালীন রাজনীতিবিদসহ ১৪ জন ভাষাবীর সর্বপ্রথম ভাষা-আন্দোলনসহ অন্যান্য দাবি সংবলিত ২১ দফা দাবি নিয়ে একটি ইস্তেহার প্রণয়ন করেছিলেন। ওই ইস্তেহারে ২১ দফা দাবির মধ্যে দ্বিতীয় দাবিটি ছিল রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত। ঐতিহাসিক এই ইস্তেহারটি একটি ছোট পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছিল যার নাম ‘রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইস্তেহার- ঐতিহাসিক দলিল’। উক্ত পুস্তিকাটি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত। এই ইস্তেহার প্রণয়নে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ছিল অনস্বীকার্য এবং তিনি ছিলেন অন্যতম স্বাক্ষরদাতা। ১৫০ নং মোগলটুলীর ‘ওয়ার্কাস ক্যাম্প’ ছিল সে সময়ে প্রগতিশীল ছাত্র-যুবক ও রাজনৈতিক কর্মীদের মিলন কেন্দ্র। ওয়ার্কাস ক্যাম্পের কর্মীরা বাংলা ভাষাসহ পাকিস্তানের অন্যান্য বৈষম্যমূলক দিকগুলো জাতির সামনে তুলে ধরেন। ভাষা আন্দোলনের স্বপক্ষের কর্মীবাহিনী এখানে নিয়মিত জমায়াতে হত এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার নানা কর্ম পরিকল্পনা এখানেই নেয়া হতো। বঙ্গবন্ধু, শওকত আলী, কামরুদ্দিন আহমদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ছিলেন এই ক্যাম্পের প্রাণশক্তি। ‘সাতচল্লিশে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও ১৫০ মোগলটুলীবিরোধী রাজনীতির মূলকেন্দ্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। কলকাতা থেকে শেখ মুজিবুর রহমান, জহিরুদ্দিন, নঈমুদ্দিনের মতো নেতারা প্রথমে ১৫০ মোগলটুলীতেই জমায়েত হন।’ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ সংগঠনটির ভূমিকা খুবই স্মরণীয়। ছাত্রলীগের ১০ দফা দাবির মধ্যে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার ও সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের নিয়োগ এবং বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার দাবি ছিল অন্যতম দাবি।

২৬ ফেব্রুয়ারির ধর্মঘট চলাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তমদ্দুন মজলিস প্রধান অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে এক সমাবেশ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিযারিং কলেজ ও ইঞ্জিনিযারিং স্কুলের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে দলে দলে এ সমাবেশে যোগদান করেন। এই মিছিলের সমগ্র ব্যবস্থাপনায় ও পরিচালনায় শেখ মুজিব বলিষ্ঠ নেতৃত্বদান করেন। শেখ মুজিবসহ সব প্রগতিবাদী ছাত্রনেতাই বাংলা ভাষার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একটি সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে অনুভব করেন।’

ঢাকা, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। সর্বশেষ সম্পাদনা : ২৭ মার্চ, ২০২১।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]

mustafajabbar@gmail.com

back to top