ফারুক ওয়াহিদ
জহরত আরা
দেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী জহরত আরা আর নেই। ১৯ জুলাই ২০২১ লন্ডনের একটি কেয়ার হোমে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
জহরত আরা ৫৩ নং লেকসার্কাস-কলাবাগানের (ডলফিন গলি) স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন। বিশ্বাবিদ্যালয় ভবন’ খ্যাত এই বাড়িটি ছিল তার পৈতৃক বাড়ি। ‘বিশ্বাবিদ্যালয় ভবন’ নামে বাড়িটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেস্ট হাউস ছিল অনেক বছর।
লেকসার্কাসের বাসায় জহরত আরা উন্নত জাতের গাভী পালতেন এবং নিজের হাতে যতœ করতেন, তাছাড়া নিজেই টেক্সাস স্টাইলের কাউবয় ড্রেস পরিধান করে বর্তমান পান্থপথ এলাকায় যতœ করে গরু চড়াতেন। তখন সে এলাকা ছিল বিল ও খোলা মাঠ। জাহরত আরার বাড়িটি ছিল লেকসার্কাস-কলাবাগানের প্রথম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নান্দনিক ডুপ্লেক্স বাড়ি।
ঢাকায় লেকসার্কাস-কলাবাগানে জহরত আরার পরিবার ও আমাদের পরিবার পাশাপাশি থাকতাম। তারা আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন। আমাদের বাড়ি বারান্দা থেকে জহরত আরাদের বাড়িটা পুরো পুরি দেখা যেত। দুই পরিবারের মধ্যে একে অপরের বাসায় যাতায়াত ছিল। একই এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় দুই পরিবারের মধ্যে অনেক স্মৃতি জেগে আছে।
জহরত আরার বাবা ইমামউদ্দিন পাটোয়ারি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তা। জহরত আরার পৈতৃক নিবাস ইলিশের দেশ চাঁদপুর। বাবা-মায়ের স্মৃতির উদ্দেশে জহরত প্রতিষ্ঠা করেন ইমামউদ্দিন ও বেগম আসমাতুন্নেসা ফাউন্ডেশন। এ ফাউন্ডেশনের অধীনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বৃত্তিও দেয়া হতো।
আবদুল জব্বার খান পরিচালিত ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তি পায় ১৯৫৬ সালের ৩ অগাস্ট। এর আগে এই ভূখ-ে বাংলা ভাষায় আর কোন পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র হয়নি। ‘মুখ ও মুখোশ’-এর অভিনেত্রী জহরত আরা ঢাকার ইডেন কলেজের ছাত্রী অবস্থায় ‘মুখ ও মুখোশ’এ অভিনয় করেন। ‘মুখ ও মুখোশ’ চলচ্চিত্রে অভিনেতা মনসুর আলীর স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেন জহরত আরা।
আব্দুল জব্বার খান ‘মুখ ও মুখোশ’-এর জন্য অভিনেত্রী খুঁজতে চিত্রালী ম্যাগাজিনে বিজ্ঞাপন দেন। চিত্রালী ম্যাগাজিনে সেই বিজ্ঞাপন দেখেই ছবিতে অভিনয় করার আগ্রহ প্রকাশ করেন ইডেন কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী জহরত আরা। পরিবারকে অনেক বুঝিয়ে জহরত আরা ছায়াছবিতে অভিনয় করার অনুমতি পান। তবে এর আগে পরিচালক আব্দুল জব্বার খান জহরত আরা’র পরিবারকে অনেক অনুনয়-বিনয় করে রাজি করিয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত।
ঢাকার কালীগঞ্জ, সিদ্ধেশ্বরী, কমলাপুর-বাসাবো বৌদ্ধ বিহারের পুকুরপাড়, মিরপুর ও তেজগাঁও, রাজারবাগ ও লালমাটিয়া-ধানমন্ডির ধানক্ষেত এবং টঙ্গীতে ‘মুখ ও মুখোশ’ সিনেমার শুটিং হয়।
সিনেমার চিত্রনাট্য ছিল এরকম: গ্রামের এক জোতদারের দুই ছেলে। তাদের একজন ঘটনা-পরম্পায় ডাকাতদলের খপ্পরে পড়ে। তাদের সঙ্গেই বেড়ে ওঠে সে। আরেক ছেলে পড়ালেখা করে, পুলিশ হয়।
কিন্তু ডাকাতদলের সঙ্গে অসৎ পুলিশের যোগাযোগ ছিল। পরিচয় না জানলেও ডাকাত-পুলিশ যোগাযোগের সূত্রে ভাই-ভাই যোগাযোগ তৈরি হয়। একপর্যায়ে ডাকাত ভাই তার সর্দারকে খুন করে। অসৎ পুলিশ ভাই গ্রেপ্তার হয়। কাহিনী শেষ হয় জোতদার বাবার দুই ছেলেকে ফিরে পাওয়ার মধ্য দিয়ে।
মুখ ও মুখোশের নায়িকা কুলসুমের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন চট্টগ্রামের মেয়ে কলকাতার অভিনেত্রী পূর্ণিমা সেনগুপ্ত। নায়ক আফজালের চরিত্রে পরিচালক আব্দুল জব্বার খান নিজেই অভিনয় করেন। পিয়ারী অভিনয় করেন নায়ক আফজালের বোন রাশিদার চরিত্রে। অসৎ পুলিশ কর্মকর্তার চরিত্রে ছিলেন অভিনেতা আলী মনসুর। আর তার স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেন জহরত আরা। ডাকাত সর্দারের ভূমিকায় ছিলেন ইনাম আহমেদ।
১৯৫৪ সালে ৬ আগস্ট শাহবাগ হোটেলে ‘মুখ ও মুখোশ’ সিনেমার মহরত হয়। মহরতে অনুষ্ঠানে জহরত আরা তার বাবা ইমামউদ্দিন পাটোয়ারিকে সঙ্গে নিয়ে যান।
পূর্ব পাকিস্তানের তখনকার গভর্নর শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ‘মুখ ও মুখোশ’ বাংলা সিনেমার উদ্বোধন করেছিলেন।
বেতারে নাটকের অভিজ্ঞতা আগে থেকেই ছিল জহরত আরার। একজন অ্যাথলেট হিসেবেও তিনি পরিচিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলনেও জহরত আরা অংশ নিয়েছিলেন।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী ও সুরকার মোসলেহ উদ্দিন ছিলেন জহরত আর’র আপন ভাই। মুসলেহ উদ্দিন ও নাহিদ নিয়াজির গাওয়া বিখ্যাত গান “ওগো সোনার মেয়ে তুমি যাও গো চলে মৃদু কাঁকনের রিমিঝিমি বাজিয়ে’ গানটি সে সময়ে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল এবং সবার মুখে মুখে ছিল গানটি। ‘আকাশের মিটি মিটি তারার সঙ্গে কইবো কথা নাই বা তুমি এলে’- গানটির শিল্পী নাহিদ নিয়াজি জহরত আরার আপন ভাবি।
জহরত আরা বিয়ে করেন আইসিএস সরকারি কর্মকর্তা ডেভিড খালেদ পাওয়ারকে। ডেভিড খালেদ পাওয়ার ছিলেন ওয়াবদার (ইপিওয়াবদা) চেয়ারম্যান। চার দশকেরও বেশি আগে জহরত আরা, ভাই মোসলেহউদ্দিন ও ভাবী কণ্ঠশিল্পী নাহিদ নিয়াজি বার্মিংহ্যাম শহরে চলে যান। সেখানেই কাটান জীবনের বাকি দিনগুলো।
ফারুক ওয়াহিদ
জহরত আরা
বুধবার, ২৮ জুলাই ২০২১
দেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী জহরত আরা আর নেই। ১৯ জুলাই ২০২১ লন্ডনের একটি কেয়ার হোমে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
জহরত আরা ৫৩ নং লেকসার্কাস-কলাবাগানের (ডলফিন গলি) স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন। বিশ্বাবিদ্যালয় ভবন’ খ্যাত এই বাড়িটি ছিল তার পৈতৃক বাড়ি। ‘বিশ্বাবিদ্যালয় ভবন’ নামে বাড়িটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেস্ট হাউস ছিল অনেক বছর।
লেকসার্কাসের বাসায় জহরত আরা উন্নত জাতের গাভী পালতেন এবং নিজের হাতে যতœ করতেন, তাছাড়া নিজেই টেক্সাস স্টাইলের কাউবয় ড্রেস পরিধান করে বর্তমান পান্থপথ এলাকায় যতœ করে গরু চড়াতেন। তখন সে এলাকা ছিল বিল ও খোলা মাঠ। জাহরত আরার বাড়িটি ছিল লেকসার্কাস-কলাবাগানের প্রথম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নান্দনিক ডুপ্লেক্স বাড়ি।
ঢাকায় লেকসার্কাস-কলাবাগানে জহরত আরার পরিবার ও আমাদের পরিবার পাশাপাশি থাকতাম। তারা আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন। আমাদের বাড়ি বারান্দা থেকে জহরত আরাদের বাড়িটা পুরো পুরি দেখা যেত। দুই পরিবারের মধ্যে একে অপরের বাসায় যাতায়াত ছিল। একই এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় দুই পরিবারের মধ্যে অনেক স্মৃতি জেগে আছে।
জহরত আরার বাবা ইমামউদ্দিন পাটোয়ারি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তা। জহরত আরার পৈতৃক নিবাস ইলিশের দেশ চাঁদপুর। বাবা-মায়ের স্মৃতির উদ্দেশে জহরত প্রতিষ্ঠা করেন ইমামউদ্দিন ও বেগম আসমাতুন্নেসা ফাউন্ডেশন। এ ফাউন্ডেশনের অধীনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বৃত্তিও দেয়া হতো।
আবদুল জব্বার খান পরিচালিত ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তি পায় ১৯৫৬ সালের ৩ অগাস্ট। এর আগে এই ভূখ-ে বাংলা ভাষায় আর কোন পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র হয়নি। ‘মুখ ও মুখোশ’-এর অভিনেত্রী জহরত আরা ঢাকার ইডেন কলেজের ছাত্রী অবস্থায় ‘মুখ ও মুখোশ’এ অভিনয় করেন। ‘মুখ ও মুখোশ’ চলচ্চিত্রে অভিনেতা মনসুর আলীর স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেন জহরত আরা।
আব্দুল জব্বার খান ‘মুখ ও মুখোশ’-এর জন্য অভিনেত্রী খুঁজতে চিত্রালী ম্যাগাজিনে বিজ্ঞাপন দেন। চিত্রালী ম্যাগাজিনে সেই বিজ্ঞাপন দেখেই ছবিতে অভিনয় করার আগ্রহ প্রকাশ করেন ইডেন কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী জহরত আরা। পরিবারকে অনেক বুঝিয়ে জহরত আরা ছায়াছবিতে অভিনয় করার অনুমতি পান। তবে এর আগে পরিচালক আব্দুল জব্বার খান জহরত আরা’র পরিবারকে অনেক অনুনয়-বিনয় করে রাজি করিয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত।
ঢাকার কালীগঞ্জ, সিদ্ধেশ্বরী, কমলাপুর-বাসাবো বৌদ্ধ বিহারের পুকুরপাড়, মিরপুর ও তেজগাঁও, রাজারবাগ ও লালমাটিয়া-ধানমন্ডির ধানক্ষেত এবং টঙ্গীতে ‘মুখ ও মুখোশ’ সিনেমার শুটিং হয়।
সিনেমার চিত্রনাট্য ছিল এরকম: গ্রামের এক জোতদারের দুই ছেলে। তাদের একজন ঘটনা-পরম্পায় ডাকাতদলের খপ্পরে পড়ে। তাদের সঙ্গেই বেড়ে ওঠে সে। আরেক ছেলে পড়ালেখা করে, পুলিশ হয়।
কিন্তু ডাকাতদলের সঙ্গে অসৎ পুলিশের যোগাযোগ ছিল। পরিচয় না জানলেও ডাকাত-পুলিশ যোগাযোগের সূত্রে ভাই-ভাই যোগাযোগ তৈরি হয়। একপর্যায়ে ডাকাত ভাই তার সর্দারকে খুন করে। অসৎ পুলিশ ভাই গ্রেপ্তার হয়। কাহিনী শেষ হয় জোতদার বাবার দুই ছেলেকে ফিরে পাওয়ার মধ্য দিয়ে।
মুখ ও মুখোশের নায়িকা কুলসুমের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন চট্টগ্রামের মেয়ে কলকাতার অভিনেত্রী পূর্ণিমা সেনগুপ্ত। নায়ক আফজালের চরিত্রে পরিচালক আব্দুল জব্বার খান নিজেই অভিনয় করেন। পিয়ারী অভিনয় করেন নায়ক আফজালের বোন রাশিদার চরিত্রে। অসৎ পুলিশ কর্মকর্তার চরিত্রে ছিলেন অভিনেতা আলী মনসুর। আর তার স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেন জহরত আরা। ডাকাত সর্দারের ভূমিকায় ছিলেন ইনাম আহমেদ।
১৯৫৪ সালে ৬ আগস্ট শাহবাগ হোটেলে ‘মুখ ও মুখোশ’ সিনেমার মহরত হয়। মহরতে অনুষ্ঠানে জহরত আরা তার বাবা ইমামউদ্দিন পাটোয়ারিকে সঙ্গে নিয়ে যান।
পূর্ব পাকিস্তানের তখনকার গভর্নর শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ‘মুখ ও মুখোশ’ বাংলা সিনেমার উদ্বোধন করেছিলেন।
বেতারে নাটকের অভিজ্ঞতা আগে থেকেই ছিল জহরত আরার। একজন অ্যাথলেট হিসেবেও তিনি পরিচিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলনেও জহরত আরা অংশ নিয়েছিলেন।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী ও সুরকার মোসলেহ উদ্দিন ছিলেন জহরত আর’র আপন ভাই। মুসলেহ উদ্দিন ও নাহিদ নিয়াজির গাওয়া বিখ্যাত গান “ওগো সোনার মেয়ে তুমি যাও গো চলে মৃদু কাঁকনের রিমিঝিমি বাজিয়ে’ গানটি সে সময়ে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল এবং সবার মুখে মুখে ছিল গানটি। ‘আকাশের মিটি মিটি তারার সঙ্গে কইবো কথা নাই বা তুমি এলে’- গানটির শিল্পী নাহিদ নিয়াজি জহরত আরার আপন ভাবি।
জহরত আরা বিয়ে করেন আইসিএস সরকারি কর্মকর্তা ডেভিড খালেদ পাওয়ারকে। ডেভিড খালেদ পাওয়ার ছিলেন ওয়াবদার (ইপিওয়াবদা) চেয়ারম্যান। চার দশকেরও বেশি আগে জহরত আরা, ভাই মোসলেহউদ্দিন ও ভাবী কণ্ঠশিল্পী নাহিদ নিয়াজি বার্মিংহ্যাম শহরে চলে যান। সেখানেই কাটান জীবনের বাকি দিনগুলো।