alt

উপ-সম্পাদকীয়

শিশুর মাতৃভাষার ভিত শক্ত করা জরুরি

সন্ধ্যা রানী সাহা

: সোমবার, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

মাতৃভাষায় দক্ষ না হলে অন্যান্য পাঠ্যবিষয়গুলো যথাযথভাবে আয়ত্ত করা শিশুদের পক্ষে কঠিন। ফলে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। দুঃখের বিষয় হলো, সরকারের চেষ্টা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক ও সামাজিক সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদের শিশুদের উল্লেখযোগ্য অংশ মাতৃভাষায় ভালো মতো লিখতে এবং পড়তে পারে না। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ধাপ কায়ক্লেশে উৎরে গেলেও উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে অনেকেই ঝরে পড়ে। গ্রামে বসবাসরত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ প্রবণতা বেশি দেখা যায়। ভাষা শিক্ষার জন্য চারটি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন জরুরি। সেগুলো হলো- শোনা, বলা, পড়া এবং লেখা। সাধারণত শোনা এবং বলার দক্ষতা নিয়েই একজন শিশু বিদ্যালয়ে পা রাখে। এবং এ দুটো দক্ষতার ওপর নির্ভর করেই বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাকে পড়া এবং লেখার দক্ষতা অর্জনে সাহায্য করতে শুরু করে। তবে পরিবারের কেউ শিক্ষিত থাকলে শিশু বাড়ি থেকেই কিছু না কিছু লেখা এবং পড়া শিখে বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। শহর অঞ্চলে কিছু কিছু বিদ্যালয় ও পিটিআইয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষণ বিদ্যালয়গুলোতে এই শিশুরাই ভর্তির সুযোগ পায়। কারণ তথাকথিত ভালো বিদ্যালয়গুলো ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে লিখতে এবং পড়তে পারা শিশুদেরই নির্বাচিত করে থাকে। অন্যদিকে যে সব শিশুর পরিবারে অভিভাকরা অক্ষর-জ্ঞানহীন, তাদের জন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। এবং সে সুযোগটি শুধু বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলেই পাওয়া যায়। আমার অভিজ্ঞতা বলছে, অক্ষর-জ্ঞানহীন শিশুদের জন্য অনেক শিক্ষকই কমবেশি সময় দিয়ে থাকেন।

বর্তমান করোনা-সংকটে তাবদ শিক্ষাব্যবস্থা স্থবির প্রায়। সরকার চলমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন বিকল্প পদ্ধতির সঙ্গে ওয়ার্কসিট ও অ্যাকটিভিটি-সিট (করোনার ক্ষতিপূরণে ২০২১ সালের ৩০ এপ্রিল ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি কর্তৃক ন্যাশনাল অফ প্রাইমারি এডুকেশন প্রণীত) বিতরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এগুলো নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখছি শিশুদের অনেকেই তার নিজ-নিজ শ্রেণীর বাংলা বইটি ভালোভাবে পড়তে পারছে না বা সেখান থেকে কিছু লিখতে দিলে ঠিকমতো লিখতে পারছে না। অন্যকে দিয়ে লিখিয়ে বিদ্যালয়ে জমা দিচ্ছে। এমনটি হলে যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ওয়ার্কসিট ও অ্যাকটিভিটি-সিট এর কার্যক্রম শুরু তা সফল হবে হবে কিনা সন্দেহ। অতিমারী থেকে সুরক্ষার প্রয়োজনে এ অবস্থা কতদিন চলতে থাকে কে জানে! সরকার ঠিকই সংশ্লিষ্ট সবার বেতনভাতাদি দিয়ে চলেছে। আমরাও মোটামুটি আছি। কিন্তু শিশুরা যেহেতু মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তাই আত্মতৃপ্তির কোন সুযোগ নেই

যে সব শিক্ষকরা অক্ষরজ্ঞানহীন অভিভাবকদের সন্তানদের নিয়ে কাজ করছেন তাদের বলছি। শিশুদের মাতৃভাষায় দক্ষ হতে সাহায্য করুন। এজন্য যা করা দরকার তা হলো: শুরুতে কয়েকদিন কষ্ট করে বর্ণগুলো ভালোভাবে চিনিয়ে দিন। অতঃপর কার-বিহীন ছোট ছোট শব্দ শিখান। যেমন বই, দই, মই, বক ইত্যাদি। পরে ছোটবাক্য যেমন- বই পড়, দই কই, বড় ঘর, কত জল, জল ভর, এত পথ, ওই বক ইত্যাদি। অতপর একটু বড় ধরনের শব্দ যেমন কলম ধর, বরণ কর, কলস ভর, গরম জল ইত্যাদি ছোট ছোট বাক্যগুলো দিয়ে চেষ্টা করুন। এগুলো শিখানোর সময় অন্য কোনো বই-পুস্তক পড়ানোর চেষ্টা করা ঠিক নয়। শিশু যেন বুঝে- পড়ালেখা বলতে এগুলোই বোঝায়। তাহলে তার মনে হবে পড়া তেমন কঠিন কিছু নয় এবং বেশ মজার। এভাবে তার মধ্যে আত্মবিশ^াস তৈরি হবে। ঠিক তখনই সে কঠিন বই-পুস্তক, বিদ্যালয়, শিক্ষক, খেলার মাঠ, সহপাঠী এ সবের অংশীজন হয়ে উঠবে। এরপর কিছু বিরতি দিয়ে তাকে আ-কার, তারপর এ-কার এবং ও-কার অর্থাৎ “কার” চিহ্নগুলো আস্তে আস্তে ধরিয়ে দিতে হবে। পেডাগজিতে যাই থাকুক না কেন ওদিকে নজর দেয়া এ মুহূর্তে তেমন জরুরি নয়। আমাদের সবারই জানা যে Teacher is the best method। আপনি শিক্ষক! আপনার প্রথম কাজ হলো শিক্ষার্থীর ভেতরে পাঠ বিষয়ে আত্মবিশ্বাস তৈরি করে দেয়া। পেডাগজি মোতাবেক বাক্য-ক্রমিক পদ্ধতিতে (প্রথমে বাক্য, তারপর শব্দ ও পরে বর্ণ শিখানো) পড়া শিখাতে গিয়ে প্রথমে রিডিং-পড়া না বুঝে মুখস্থ করার অভ্যাস হয়ে যায়। এ অভ্যাস গড়ে তুলা যাবে না। এভাবে মাতৃভাষা বাংলা শিখাতে, লিখতে ও পড়াতে পারলে অপরাপর বিষয়গুলো খুব সহজেই শিখাতে পারবেন।

প্রধান শিক্ষকদের নিয়মিত স্টাফমিটিং করে সহকারী শিক্ষকদের উৎসাহিত করতে হবে। কারও প্রতি যেন পক্ষপাতিত্ব না হয়। কোনোক্রমেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যথাযথ নির্দেশনাকে যেন উপেক্ষা করা না হয়। পাশাপাশি সহকারী শিক্ষকগণ তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন কিনা বা করতে পারছেন কিনা, কোন বিষয় বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে কিনা এসব বিষয়ে খোঁজ নিতে হবে। প্রয়োজনে তাদের সহযোগিতা করতে হবে। তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে হবে। সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারবৃন্দকে শিক্ষকদের শিক্ষা-কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে হবে এবং উপজেলা শিক্ষা অফিসারের নিকট নিয়মিতভাবে রিপোর্ট দিতে হবে। উপজেলা শিক্ষা অফিসারবৃন্দ বিদ্যালয়সমূহ পরিদর্শন, সহকারী উপজেলা অফিসারদের সঙ্গে আলোচনা, জেলা প্রাথমিক অফিসার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা চেয়ারম্যান, সর্বোপরি জাতীয় সংসদ সদস্য মহোদয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে শিশুর মানসম্মত প্রাথমিকশিক্ষ-প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।

অতীতে প্রাথমিক শিক্ষায় এত প্রশিক্ষণ ছিল না। শুধু শিক্ষার প্রাথমিক স্তর (মাইনর বিদ্যালয়) উত্তীর্ণ কেউ ইচ্ছে করলেই একই স্তরের শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতেন। অবশ্য GT (Guru Training) বলে একটা সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ সেকালেও ছিল। তবে তা আজকের মতো এত বিস্তারিত ছিল না। সে তুলনায় আজকালকার শিক্ষকবৃন্দের অধিকাংশই মাস্টার্স ডিগ্রিধারী। সঙ্গে বিভিন্নমুখী একাধিক প্রশিক্ষণ তো আছেই। তা সত্ত্বেও যদি শিশু ভালোভাবে পড়তে না পারে বা লিখতে না পারে তাহলে আরকি! কালে এসব শিশু-শিক্ষার্থীরাই যথাযথ শিক্ষার অভাবে বা তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে বুঝতে পেরে অন্যদের সন্তানদের প্রতি বৈরী আচরণ করতে পারে। করতে পারে না করছেই বলতে হয়। ফলে সমাজের মাঝে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। আজকের কিশোর-অপরাধগুলোর অনেকগুলোই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাই শিক্ষক এবং সংশ্লিষ্টদেও কাছে অনুরোধ, প্রতিদিন পত্রিকা পড়ুন, বই পড়ুন, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদগুলো জেনে নিজের জ্ঞনকে সমৃদ্ধ করুন। সঙ্গে সঙ্গে কোমলমতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে তা ছড়িয়ে দিন।

বিশ^ব্যাংকের সাম্প্র্রতিকতম এক সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৬৫% শিক্ষার্থী বাংলা পড়তে পারে না। এবং এর চেয়েও বেশিসংখ্যক ছাত্রছাত্রী গণিত এবং ইংরেজিতে দুর্বল। কাজেই সনদ লাভের কৌশল না শিখে শিক্ষার্থীরা যেন মাতৃভাষা বাংলা থেকে শুরু করে সব বিষয় পড়তে পারে বুঝতে পারে এবং সমস্যার সমাধান করতে পাওে সেভাবে শিক্ষাদান করতে হবে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যে সব শিশুদের মাতৃভাষা বাংলা নয়; সে সব শিশুরা যেন তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় দক্ষ হতে পারে সে ব্যবস্থাও থাকতে হবে। তাহলে সবাই মাতৃভাষার মাধ্যমে উপযুক্ত শিক্ষা পাবে এবং প্রাথমিক শিক্ষার জন্য নির্দিষ্ট ২৯টি প্রান্তিক যোগ্যতা সহজেই অর্জন করতে সক্ষম হবে।

বিশ্বব্যাংকের সাম্প্র্রতিকতম এক সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৬৫% শিক্ষার্থী বাংলা পড়তে পারে না

করোনা ভাইরাসের কারণে বিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশ কিন্তু বন্ধ নেই। প্রাকৃতিক নিয়মে সে বড় হচ্ছে। এই বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান, দক্ষতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনে শিক্ষকের সহযোগিতা প্রয়োজন। তা যে প্রকারেই হোক। প্রাথমিক শিক্ষার কাজে নিয়োজিত সবাইকেই দায়িত্ব নিতে হবে। সহকারী শিক্ষকবৃন্দ এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন এবং আরও করবেন। তাদের করোনাকাল চলছে বলে স্বাস্থ্যবিধি এবং সামাজিকবিধি মেনে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে পাঠবিষয়ক সহায়তা দান করতে হবে, ধাপে ধাপে মাতৃভাষায় দক্ষ করে তুলতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে হেসেখেলে, নেচেগেয়ে, অভিনয় করে, প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখিয়ে, উপকরণ নাড়াচাড়া করতে দিয়ে ইত্যাদি ভাবে শিখাতে হবে। পাশাপাশি অনলাইন কার্যক্রমেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। এ জন্য ধৈর্য সহকারে সময় দেয়া জরুরি। মনে রাখতে হবে ওরা মানুষ না হলে নিজেদের শিশুরাও এ সমাজে নিরাপদ জীবনযাপন করতে পারবে না।

[লেখক : উপজেলা শিক্ষা অফিসার,

কামারখন্দ, সিরাজগঞ্জ]

লোকসান কমাতে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো কতটা যৌক্তিক?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও আগামী বাজেট

স্মার্ট দেশ গড়তে চাই স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয়

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসন ও সন্ত্রাস সৃষ্টির দায় কার

ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের কাছে দোষ স্বীকারে সাক্ষ্যগত মূল্য ও বাস্তবতা

সমস্যায় জর্জরিত সড়ক, প্রতিকার কী

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস

শিক্ষক নিয়োগ : পর্বতসম দুর্নীতির সামান্য প্রকাশ

সব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে হবে

ছবি

চৌবাচ্চার ফুটো এবং আমাদের উন্নয়ন

কিশোর গ্যাং : নষ্ট রাজনীতির বিনষ্ট সংস্কৃতি

মন্ত্রণালয় ভাগ করে লাভবান হলো কারা?

রম্যগদ্য : মর্জিনার কলঙ্কিত দাগ

সোমালিয়ার গরিব জেলেরা কীভাবে জলদস্যু হলো

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

tab

উপ-সম্পাদকীয়

শিশুর মাতৃভাষার ভিত শক্ত করা জরুরি

সন্ধ্যা রানী সাহা

সোমবার, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

মাতৃভাষায় দক্ষ না হলে অন্যান্য পাঠ্যবিষয়গুলো যথাযথভাবে আয়ত্ত করা শিশুদের পক্ষে কঠিন। ফলে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। দুঃখের বিষয় হলো, সরকারের চেষ্টা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক ও সামাজিক সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদের শিশুদের উল্লেখযোগ্য অংশ মাতৃভাষায় ভালো মতো লিখতে এবং পড়তে পারে না। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ধাপ কায়ক্লেশে উৎরে গেলেও উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে অনেকেই ঝরে পড়ে। গ্রামে বসবাসরত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ প্রবণতা বেশি দেখা যায়। ভাষা শিক্ষার জন্য চারটি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন জরুরি। সেগুলো হলো- শোনা, বলা, পড়া এবং লেখা। সাধারণত শোনা এবং বলার দক্ষতা নিয়েই একজন শিশু বিদ্যালয়ে পা রাখে। এবং এ দুটো দক্ষতার ওপর নির্ভর করেই বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাকে পড়া এবং লেখার দক্ষতা অর্জনে সাহায্য করতে শুরু করে। তবে পরিবারের কেউ শিক্ষিত থাকলে শিশু বাড়ি থেকেই কিছু না কিছু লেখা এবং পড়া শিখে বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। শহর অঞ্চলে কিছু কিছু বিদ্যালয় ও পিটিআইয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষণ বিদ্যালয়গুলোতে এই শিশুরাই ভর্তির সুযোগ পায়। কারণ তথাকথিত ভালো বিদ্যালয়গুলো ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে লিখতে এবং পড়তে পারা শিশুদেরই নির্বাচিত করে থাকে। অন্যদিকে যে সব শিশুর পরিবারে অভিভাকরা অক্ষর-জ্ঞানহীন, তাদের জন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। এবং সে সুযোগটি শুধু বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলেই পাওয়া যায়। আমার অভিজ্ঞতা বলছে, অক্ষর-জ্ঞানহীন শিশুদের জন্য অনেক শিক্ষকই কমবেশি সময় দিয়ে থাকেন।

বর্তমান করোনা-সংকটে তাবদ শিক্ষাব্যবস্থা স্থবির প্রায়। সরকার চলমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন বিকল্প পদ্ধতির সঙ্গে ওয়ার্কসিট ও অ্যাকটিভিটি-সিট (করোনার ক্ষতিপূরণে ২০২১ সালের ৩০ এপ্রিল ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি কর্তৃক ন্যাশনাল অফ প্রাইমারি এডুকেশন প্রণীত) বিতরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এগুলো নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখছি শিশুদের অনেকেই তার নিজ-নিজ শ্রেণীর বাংলা বইটি ভালোভাবে পড়তে পারছে না বা সেখান থেকে কিছু লিখতে দিলে ঠিকমতো লিখতে পারছে না। অন্যকে দিয়ে লিখিয়ে বিদ্যালয়ে জমা দিচ্ছে। এমনটি হলে যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ওয়ার্কসিট ও অ্যাকটিভিটি-সিট এর কার্যক্রম শুরু তা সফল হবে হবে কিনা সন্দেহ। অতিমারী থেকে সুরক্ষার প্রয়োজনে এ অবস্থা কতদিন চলতে থাকে কে জানে! সরকার ঠিকই সংশ্লিষ্ট সবার বেতনভাতাদি দিয়ে চলেছে। আমরাও মোটামুটি আছি। কিন্তু শিশুরা যেহেতু মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তাই আত্মতৃপ্তির কোন সুযোগ নেই

যে সব শিক্ষকরা অক্ষরজ্ঞানহীন অভিভাবকদের সন্তানদের নিয়ে কাজ করছেন তাদের বলছি। শিশুদের মাতৃভাষায় দক্ষ হতে সাহায্য করুন। এজন্য যা করা দরকার তা হলো: শুরুতে কয়েকদিন কষ্ট করে বর্ণগুলো ভালোভাবে চিনিয়ে দিন। অতঃপর কার-বিহীন ছোট ছোট শব্দ শিখান। যেমন বই, দই, মই, বক ইত্যাদি। পরে ছোটবাক্য যেমন- বই পড়, দই কই, বড় ঘর, কত জল, জল ভর, এত পথ, ওই বক ইত্যাদি। অতপর একটু বড় ধরনের শব্দ যেমন কলম ধর, বরণ কর, কলস ভর, গরম জল ইত্যাদি ছোট ছোট বাক্যগুলো দিয়ে চেষ্টা করুন। এগুলো শিখানোর সময় অন্য কোনো বই-পুস্তক পড়ানোর চেষ্টা করা ঠিক নয়। শিশু যেন বুঝে- পড়ালেখা বলতে এগুলোই বোঝায়। তাহলে তার মনে হবে পড়া তেমন কঠিন কিছু নয় এবং বেশ মজার। এভাবে তার মধ্যে আত্মবিশ^াস তৈরি হবে। ঠিক তখনই সে কঠিন বই-পুস্তক, বিদ্যালয়, শিক্ষক, খেলার মাঠ, সহপাঠী এ সবের অংশীজন হয়ে উঠবে। এরপর কিছু বিরতি দিয়ে তাকে আ-কার, তারপর এ-কার এবং ও-কার অর্থাৎ “কার” চিহ্নগুলো আস্তে আস্তে ধরিয়ে দিতে হবে। পেডাগজিতে যাই থাকুক না কেন ওদিকে নজর দেয়া এ মুহূর্তে তেমন জরুরি নয়। আমাদের সবারই জানা যে Teacher is the best method। আপনি শিক্ষক! আপনার প্রথম কাজ হলো শিক্ষার্থীর ভেতরে পাঠ বিষয়ে আত্মবিশ্বাস তৈরি করে দেয়া। পেডাগজি মোতাবেক বাক্য-ক্রমিক পদ্ধতিতে (প্রথমে বাক্য, তারপর শব্দ ও পরে বর্ণ শিখানো) পড়া শিখাতে গিয়ে প্রথমে রিডিং-পড়া না বুঝে মুখস্থ করার অভ্যাস হয়ে যায়। এ অভ্যাস গড়ে তুলা যাবে না। এভাবে মাতৃভাষা বাংলা শিখাতে, লিখতে ও পড়াতে পারলে অপরাপর বিষয়গুলো খুব সহজেই শিখাতে পারবেন।

প্রধান শিক্ষকদের নিয়মিত স্টাফমিটিং করে সহকারী শিক্ষকদের উৎসাহিত করতে হবে। কারও প্রতি যেন পক্ষপাতিত্ব না হয়। কোনোক্রমেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যথাযথ নির্দেশনাকে যেন উপেক্ষা করা না হয়। পাশাপাশি সহকারী শিক্ষকগণ তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন কিনা বা করতে পারছেন কিনা, কোন বিষয় বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে কিনা এসব বিষয়ে খোঁজ নিতে হবে। প্রয়োজনে তাদের সহযোগিতা করতে হবে। তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে হবে। সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারবৃন্দকে শিক্ষকদের শিক্ষা-কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে হবে এবং উপজেলা শিক্ষা অফিসারের নিকট নিয়মিতভাবে রিপোর্ট দিতে হবে। উপজেলা শিক্ষা অফিসারবৃন্দ বিদ্যালয়সমূহ পরিদর্শন, সহকারী উপজেলা অফিসারদের সঙ্গে আলোচনা, জেলা প্রাথমিক অফিসার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা চেয়ারম্যান, সর্বোপরি জাতীয় সংসদ সদস্য মহোদয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে শিশুর মানসম্মত প্রাথমিকশিক্ষ-প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।

অতীতে প্রাথমিক শিক্ষায় এত প্রশিক্ষণ ছিল না। শুধু শিক্ষার প্রাথমিক স্তর (মাইনর বিদ্যালয়) উত্তীর্ণ কেউ ইচ্ছে করলেই একই স্তরের শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতেন। অবশ্য GT (Guru Training) বলে একটা সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ সেকালেও ছিল। তবে তা আজকের মতো এত বিস্তারিত ছিল না। সে তুলনায় আজকালকার শিক্ষকবৃন্দের অধিকাংশই মাস্টার্স ডিগ্রিধারী। সঙ্গে বিভিন্নমুখী একাধিক প্রশিক্ষণ তো আছেই। তা সত্ত্বেও যদি শিশু ভালোভাবে পড়তে না পারে বা লিখতে না পারে তাহলে আরকি! কালে এসব শিশু-শিক্ষার্থীরাই যথাযথ শিক্ষার অভাবে বা তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে বুঝতে পেরে অন্যদের সন্তানদের প্রতি বৈরী আচরণ করতে পারে। করতে পারে না করছেই বলতে হয়। ফলে সমাজের মাঝে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। আজকের কিশোর-অপরাধগুলোর অনেকগুলোই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাই শিক্ষক এবং সংশ্লিষ্টদেও কাছে অনুরোধ, প্রতিদিন পত্রিকা পড়ুন, বই পড়ুন, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদগুলো জেনে নিজের জ্ঞনকে সমৃদ্ধ করুন। সঙ্গে সঙ্গে কোমলমতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে তা ছড়িয়ে দিন।

বিশ^ব্যাংকের সাম্প্র্রতিকতম এক সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৬৫% শিক্ষার্থী বাংলা পড়তে পারে না। এবং এর চেয়েও বেশিসংখ্যক ছাত্রছাত্রী গণিত এবং ইংরেজিতে দুর্বল। কাজেই সনদ লাভের কৌশল না শিখে শিক্ষার্থীরা যেন মাতৃভাষা বাংলা থেকে শুরু করে সব বিষয় পড়তে পারে বুঝতে পারে এবং সমস্যার সমাধান করতে পাওে সেভাবে শিক্ষাদান করতে হবে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যে সব শিশুদের মাতৃভাষা বাংলা নয়; সে সব শিশুরা যেন তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় দক্ষ হতে পারে সে ব্যবস্থাও থাকতে হবে। তাহলে সবাই মাতৃভাষার মাধ্যমে উপযুক্ত শিক্ষা পাবে এবং প্রাথমিক শিক্ষার জন্য নির্দিষ্ট ২৯টি প্রান্তিক যোগ্যতা সহজেই অর্জন করতে সক্ষম হবে।

বিশ্বব্যাংকের সাম্প্র্রতিকতম এক সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৬৫% শিক্ষার্থী বাংলা পড়তে পারে না

করোনা ভাইরাসের কারণে বিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশ কিন্তু বন্ধ নেই। প্রাকৃতিক নিয়মে সে বড় হচ্ছে। এই বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান, দক্ষতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনে শিক্ষকের সহযোগিতা প্রয়োজন। তা যে প্রকারেই হোক। প্রাথমিক শিক্ষার কাজে নিয়োজিত সবাইকেই দায়িত্ব নিতে হবে। সহকারী শিক্ষকবৃন্দ এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন এবং আরও করবেন। তাদের করোনাকাল চলছে বলে স্বাস্থ্যবিধি এবং সামাজিকবিধি মেনে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে পাঠবিষয়ক সহায়তা দান করতে হবে, ধাপে ধাপে মাতৃভাষায় দক্ষ করে তুলতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে হেসেখেলে, নেচেগেয়ে, অভিনয় করে, প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখিয়ে, উপকরণ নাড়াচাড়া করতে দিয়ে ইত্যাদি ভাবে শিখাতে হবে। পাশাপাশি অনলাইন কার্যক্রমেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। এ জন্য ধৈর্য সহকারে সময় দেয়া জরুরি। মনে রাখতে হবে ওরা মানুষ না হলে নিজেদের শিশুরাও এ সমাজে নিরাপদ জীবনযাপন করতে পারবে না।

[লেখক : উপজেলা শিক্ষা অফিসার,

কামারখন্দ, সিরাজগঞ্জ]

back to top