alt

উপ-সম্পাদকীয়

খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি

আব্দুর রহমান

: বুধবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২১
image

করোনাকালে একটি প্রশ্ন বেশ জোরেসোরে উঠেছে আর তার উত্তরও মিলেছে। প্রশ্নটি হচ্ছে ‘জীবন আগে না জীবিকা’? মোটামুটি সবাই একমত হয়েছিলেন ‘জীবন’ আগে। ‘জীবন’ বাঁচলেই না আসবে জীবিকার প্রশ্ন। কিছুটা ক্ষীণ স্বরে বলার চেষ্টা হয়েছিল ‘জীবিকা’ ছাড়া ‘জীবন’ চলে কীভাবে? কিন্তু শেষাবধি সবাই মেনে নিয়েছেন আগে জীবন এরপর জীবিকা। আর এই তত্ত্বের কারণেই জীবন বাঁচাতে জীবিকার ব্যাপারে ছাড় দিয়েছে মানুষ। সরকার মাসের পর মাস, অফিস-আদালত, যানবাহন, দোকানপাট, শপিংমল সবকিছু বন্ধ রেখেছে। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর থেকে এসব প্রতিষ্ঠান কখনও বন্ধ ছিল কখনও খুলেছে কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এক নাগাড়ে বন্ধ ছিল এবং আছে। অবশেষে প্রায় দেড় বছর ধরে বন্ধ রাখা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এসেছে সরকারের পক্ষ থেকে।

করোনাকালে প্রায় সব সিদ্ধান্তই এসেছে প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ২ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে, এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান দেশের মেডিকেল কলেজগুলো খুলবে ১৩ সেপ্টেম্বর। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এ ঘোষণাটি মানুষ স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে, কেননা মেডিকেলে প্রাপ্ত বয়স্করাই পড়াশোনা করেন, আর অগ্রাধিকার তালিকার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সবাই এরই মধ্যে টিকাও পেয়ে গেছেন।

এরপর মানুষের মনে প্রশ্ন আসে, স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় কবে খুলবে? শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ১২ সেপ্টেম্বর থেকে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশরীরে ক্লাস শুরু হবে। প্রথম দিকে ২০২১ ও ২০২২ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন ক্লাস হবে। এর বাইরে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ক্লাস হবে সপ্তাহে এক দিন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে সরকারের এ সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে মতামত আসছে, তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছেন। এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা চোখে পড়েনি শুধু কিছুটা দ্বিমত এসেছে, যেমন কিছু শিক্ষার্থীকে সপ্তাহে এক দিন আর কিছু শিক্ষাথীর সপ্তাহে ৫/৬ দিন শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের বিষয়টি অসাম্যমূলক। করোনার ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে এমনটা করা হলো, কিন্তু কিছু শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের নিয়মিত সেই ঝুঁকির মধ্যে রাস্তায় আনার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় পঞ্চম শ্রেণীর পাঠদান হবে সপ্তাহে ৫-৬ দিন। নিচের ক্লাসের কথা না হয় বাদই দিলাম কিন্তু যেখানে ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম আর নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ক্লাস হবে সপ্তাহে এক দিন সেখানে পঞ্চম শ্রেণীর ক্লাস সপ্তাহে ৫/৬ দিন নেয়ার কারণ কী? পঞ্চম শ্রেণী কি কারণে এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো? এটা কি ‘পিইসি’ পরীক্ষার জন্য? পিইসি পরীক্ষার মতোই আরেকটি সমান গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বিতর্কিত পরীক্ষা হচ্ছে জেএসসি ও জেডিসি। পঞ্চম শ্রেণীর ক্লাস প্রতি কার্যদিবসে হওয়ার অর্থ অনেকে মনে করছেন হয়তো পিইসি পরীক্ষাটা এবার নেয়া হবে, (সবশেষ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন পিইসি পরীক্ষা হবে) আর অষ্টম শ্রেণী ও সমমানের ক্লাস এক দিন নেয়ায় ধরেই নেয়া হয়েছে হয়তো জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা হবে না। আমাদের ফলাফল নির্ভর শিক্ষা ও সমাজ ব্যবস্থায় হুট করে পিইসি পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত অভিভাবকমহলে নতুন আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ও দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে। একই কথা জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষার ক্ষেত্রেও খাটে। যদি জেএসসি পরীক্ষা নেয়া হয় তাহলে তাদের একদিন ক্লাস কতটা চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে? আবার হুট করে এই পরীক্ষার ঘোষণাটি যদি আসে তাও সবাইকে নতুন ভাবনায় ফেলবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর বন্ধ রাখা আসলেই অসম্ভব, এসব খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত অবশ্যই যুক্তিযুক্ত, তবে এটি খোলার আর কার্যক্রম পরিচালনার প্রক্রিয়া নিয়ে যেসব প্রশ্ন উঠেছে সেসব বিষয়ে ১২ সেপ্টেম্বরের আগেই সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বর্তমান পর্যায়ে কোন শ্রেণীর শ্রেণীকক্ষে সপ্তাহে ৫/৬ দিন পাঠদান করাটা অবশ্যই একটি ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত। কেউ কেউ বলেন, অভিভাবকরা এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন, প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ সীমিত। বিষয়টি ঐচ্ছিক ঘোষণারও সুযোগ নেই। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আর পাঠদানের ক্ষেত্রে অবশ্যই বিকল্প উপায় নিয়ে ভাবতে হবে।

চলতি বছরে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নভেম্বরে ও ডিসেম্বরে হবে, তাই এই দুই ধরনের শিক্ষার্থীদের পাঠদানের বিষয়টি একটু বিশেষভাবেই গুরুত্ব দিতে হবে, সে ক্ষেত্রে তাদের প্রতি কার্যদিবসেই ক্লাস হতে পারে। অন্য ক্লাসগুলোর ব্যাপারে বিকল্প চিন্তার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করি। সে ক্ষেত্রে প্রথম ও তৃতীয় শ্রেণীর ক্লাসে পাঠদান সপ্তাহে দু’দিন করা যায়, দ্বিতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর ক্লাসও হতে পারে সপ্তাহে দুই দিন (এক দিনের পর দু’দিন বিরতি) পঞ্চম শ্রেণীর পাঠদান হতে পারে সপ্তাহে তিন/চার দিন।

মাধ্যমিক পর্যায়ে ষষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণীতে সপ্তাহে তিন দিন আর সপ্তম ও নবম শ্রেণীতে সপ্তাহে তিন দিন ক্লাস হতে পারে (এক দিন ক্লাস, এক দিন বন্ধ ভিত্তিতে)। ২০২২ সালে যারা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে তাদের সপ্তাহে তিন দিন ক্লাস হতে পারে, এবারের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ক্লাস সপ্তাহে ৫/৬ দিন যা হয় হতে পারে।

শ্রেণীকক্ষে সশরীরে পাঠদানের এমন রোস্টার পদ্ধতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিতির ঘনত্ব অনেক কমিয়ে দেবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা অনেকটা সম্ভব হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিন্তু যেখানে নবম শ্রেণীর ক্লাস হবে এক দিন সেখানে পঞ্চম শ্রেণীর ক্লাস সপ্তাহের প্রতি কার্যদিবসে নেয়ার পেছনে কারণ আর যুক্তি যাই থাকুক না কেন, অনেক অভিভাবকই বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগে পড়েছেন আর উৎকণ্ঠায় আছেন।

খুলে দেয়ার আগে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যত দূর সম্ভব স্বাস্থ্যসম্মত করতে হবে। গত দেড় বছরে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোন শ্রেণীকক্ষের তালাই খোলা হয়নি, গুমোট হওয়া সেসব শ্রেণীকক্ষের পরিবেশ শিক্ষক আর কর্তৃপক্ষের আশ্বাস আর আত্মবিশ্বাসে স্বাভাবিক হয়ে যাবে এমনটা ভাবার কারণ নেই। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার পর এখন থেকে প্রতিদিন অন্তত: এক ঘণ্টা ক্লাসরুমের ফ্যান ছেড়ে রাখতে হবে, দরজা-জানালা খোলা রাখতে হবে।

করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গুও একটা আতঙ্কের বিষয়ে পরিণত হয়েছে, তাই স্কুলের আশপাশের পরিচ্ছন্নতার বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। নামকরা দু’একটি স্কুল বা কলেজের পরিবেশ দেখে সারাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা করা যথাযথ হবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হাত ধোয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে, তরল সাবান রাখতে হবে। শিক্ষককে উপস্থিত থেকে শিক্ষার্থীদের হাত ধোয়ার (ক্লাসে ঢোকার আগে) নিশ্চিত করতে হবে। আর শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সবাই যাতে মাস্ক পরেন তাও নিশ্চিত করতে হবে, এ ক্ষেত্রে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি নিলে তার একটা ইতিবাচক প্রভাব সর্বক্ষেত্রেই পড়বে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওয়াশরুমগুলো কখনোই খুব বেশি যতেœর ছোঁয়া পায় না, নোংরা আবর্জনা তো আছেই। এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষ যদি সতর্ক ও কঠোর না হন তাহলে নানাভাবে নাজুক পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে।

আগেই বলা হয়েছে, করোনাকালে জীবন বাঁচানোটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, আবার সবকিছু স্বাভাবিকের দিকে নেয়ার যে চেষ্টা শুরু হয়েছে তা যাতে বুমেরাং না হয় সে জন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত আমাদের জীবনকে স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের উলম্ফন হবে, তাই এ বিষয়টি যাতে স্বাভাবিকরূপেই স্বাভাবিক হয় সে জন্য ধীরে চলো নীতিতে এগোতে হবে।

[লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক,

ল’ রিপোর্টার্স ফোরাম]

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি

আব্দুর রহমান

image

বুধবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২১

করোনাকালে একটি প্রশ্ন বেশ জোরেসোরে উঠেছে আর তার উত্তরও মিলেছে। প্রশ্নটি হচ্ছে ‘জীবন আগে না জীবিকা’? মোটামুটি সবাই একমত হয়েছিলেন ‘জীবন’ আগে। ‘জীবন’ বাঁচলেই না আসবে জীবিকার প্রশ্ন। কিছুটা ক্ষীণ স্বরে বলার চেষ্টা হয়েছিল ‘জীবিকা’ ছাড়া ‘জীবন’ চলে কীভাবে? কিন্তু শেষাবধি সবাই মেনে নিয়েছেন আগে জীবন এরপর জীবিকা। আর এই তত্ত্বের কারণেই জীবন বাঁচাতে জীবিকার ব্যাপারে ছাড় দিয়েছে মানুষ। সরকার মাসের পর মাস, অফিস-আদালত, যানবাহন, দোকানপাট, শপিংমল সবকিছু বন্ধ রেখেছে। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর থেকে এসব প্রতিষ্ঠান কখনও বন্ধ ছিল কখনও খুলেছে কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এক নাগাড়ে বন্ধ ছিল এবং আছে। অবশেষে প্রায় দেড় বছর ধরে বন্ধ রাখা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এসেছে সরকারের পক্ষ থেকে।

করোনাকালে প্রায় সব সিদ্ধান্তই এসেছে প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ২ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে, এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান দেশের মেডিকেল কলেজগুলো খুলবে ১৩ সেপ্টেম্বর। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এ ঘোষণাটি মানুষ স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে, কেননা মেডিকেলে প্রাপ্ত বয়স্করাই পড়াশোনা করেন, আর অগ্রাধিকার তালিকার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সবাই এরই মধ্যে টিকাও পেয়ে গেছেন।

এরপর মানুষের মনে প্রশ্ন আসে, স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় কবে খুলবে? শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ১২ সেপ্টেম্বর থেকে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশরীরে ক্লাস শুরু হবে। প্রথম দিকে ২০২১ ও ২০২২ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন ক্লাস হবে। এর বাইরে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ক্লাস হবে সপ্তাহে এক দিন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে সরকারের এ সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে মতামত আসছে, তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছেন। এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা চোখে পড়েনি শুধু কিছুটা দ্বিমত এসেছে, যেমন কিছু শিক্ষার্থীকে সপ্তাহে এক দিন আর কিছু শিক্ষাথীর সপ্তাহে ৫/৬ দিন শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের বিষয়টি অসাম্যমূলক। করোনার ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে এমনটা করা হলো, কিন্তু কিছু শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের নিয়মিত সেই ঝুঁকির মধ্যে রাস্তায় আনার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় পঞ্চম শ্রেণীর পাঠদান হবে সপ্তাহে ৫-৬ দিন। নিচের ক্লাসের কথা না হয় বাদই দিলাম কিন্তু যেখানে ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম আর নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ক্লাস হবে সপ্তাহে এক দিন সেখানে পঞ্চম শ্রেণীর ক্লাস সপ্তাহে ৫/৬ দিন নেয়ার কারণ কী? পঞ্চম শ্রেণী কি কারণে এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো? এটা কি ‘পিইসি’ পরীক্ষার জন্য? পিইসি পরীক্ষার মতোই আরেকটি সমান গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বিতর্কিত পরীক্ষা হচ্ছে জেএসসি ও জেডিসি। পঞ্চম শ্রেণীর ক্লাস প্রতি কার্যদিবসে হওয়ার অর্থ অনেকে মনে করছেন হয়তো পিইসি পরীক্ষাটা এবার নেয়া হবে, (সবশেষ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন পিইসি পরীক্ষা হবে) আর অষ্টম শ্রেণী ও সমমানের ক্লাস এক দিন নেয়ায় ধরেই নেয়া হয়েছে হয়তো জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা হবে না। আমাদের ফলাফল নির্ভর শিক্ষা ও সমাজ ব্যবস্থায় হুট করে পিইসি পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত অভিভাবকমহলে নতুন আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ও দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে। একই কথা জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষার ক্ষেত্রেও খাটে। যদি জেএসসি পরীক্ষা নেয়া হয় তাহলে তাদের একদিন ক্লাস কতটা চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে? আবার হুট করে এই পরীক্ষার ঘোষণাটি যদি আসে তাও সবাইকে নতুন ভাবনায় ফেলবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর বন্ধ রাখা আসলেই অসম্ভব, এসব খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত অবশ্যই যুক্তিযুক্ত, তবে এটি খোলার আর কার্যক্রম পরিচালনার প্রক্রিয়া নিয়ে যেসব প্রশ্ন উঠেছে সেসব বিষয়ে ১২ সেপ্টেম্বরের আগেই সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বর্তমান পর্যায়ে কোন শ্রেণীর শ্রেণীকক্ষে সপ্তাহে ৫/৬ দিন পাঠদান করাটা অবশ্যই একটি ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত। কেউ কেউ বলেন, অভিভাবকরা এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন, প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ সীমিত। বিষয়টি ঐচ্ছিক ঘোষণারও সুযোগ নেই। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আর পাঠদানের ক্ষেত্রে অবশ্যই বিকল্প উপায় নিয়ে ভাবতে হবে।

চলতি বছরে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নভেম্বরে ও ডিসেম্বরে হবে, তাই এই দুই ধরনের শিক্ষার্থীদের পাঠদানের বিষয়টি একটু বিশেষভাবেই গুরুত্ব দিতে হবে, সে ক্ষেত্রে তাদের প্রতি কার্যদিবসেই ক্লাস হতে পারে। অন্য ক্লাসগুলোর ব্যাপারে বিকল্প চিন্তার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করি। সে ক্ষেত্রে প্রথম ও তৃতীয় শ্রেণীর ক্লাসে পাঠদান সপ্তাহে দু’দিন করা যায়, দ্বিতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর ক্লাসও হতে পারে সপ্তাহে দুই দিন (এক দিনের পর দু’দিন বিরতি) পঞ্চম শ্রেণীর পাঠদান হতে পারে সপ্তাহে তিন/চার দিন।

মাধ্যমিক পর্যায়ে ষষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণীতে সপ্তাহে তিন দিন আর সপ্তম ও নবম শ্রেণীতে সপ্তাহে তিন দিন ক্লাস হতে পারে (এক দিন ক্লাস, এক দিন বন্ধ ভিত্তিতে)। ২০২২ সালে যারা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে তাদের সপ্তাহে তিন দিন ক্লাস হতে পারে, এবারের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ক্লাস সপ্তাহে ৫/৬ দিন যা হয় হতে পারে।

শ্রেণীকক্ষে সশরীরে পাঠদানের এমন রোস্টার পদ্ধতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিতির ঘনত্ব অনেক কমিয়ে দেবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা অনেকটা সম্ভব হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিন্তু যেখানে নবম শ্রেণীর ক্লাস হবে এক দিন সেখানে পঞ্চম শ্রেণীর ক্লাস সপ্তাহের প্রতি কার্যদিবসে নেয়ার পেছনে কারণ আর যুক্তি যাই থাকুক না কেন, অনেক অভিভাবকই বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগে পড়েছেন আর উৎকণ্ঠায় আছেন।

খুলে দেয়ার আগে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যত দূর সম্ভব স্বাস্থ্যসম্মত করতে হবে। গত দেড় বছরে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোন শ্রেণীকক্ষের তালাই খোলা হয়নি, গুমোট হওয়া সেসব শ্রেণীকক্ষের পরিবেশ শিক্ষক আর কর্তৃপক্ষের আশ্বাস আর আত্মবিশ্বাসে স্বাভাবিক হয়ে যাবে এমনটা ভাবার কারণ নেই। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার পর এখন থেকে প্রতিদিন অন্তত: এক ঘণ্টা ক্লাসরুমের ফ্যান ছেড়ে রাখতে হবে, দরজা-জানালা খোলা রাখতে হবে।

করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গুও একটা আতঙ্কের বিষয়ে পরিণত হয়েছে, তাই স্কুলের আশপাশের পরিচ্ছন্নতার বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। নামকরা দু’একটি স্কুল বা কলেজের পরিবেশ দেখে সারাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা করা যথাযথ হবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হাত ধোয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে, তরল সাবান রাখতে হবে। শিক্ষককে উপস্থিত থেকে শিক্ষার্থীদের হাত ধোয়ার (ক্লাসে ঢোকার আগে) নিশ্চিত করতে হবে। আর শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সবাই যাতে মাস্ক পরেন তাও নিশ্চিত করতে হবে, এ ক্ষেত্রে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি নিলে তার একটা ইতিবাচক প্রভাব সর্বক্ষেত্রেই পড়বে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওয়াশরুমগুলো কখনোই খুব বেশি যতেœর ছোঁয়া পায় না, নোংরা আবর্জনা তো আছেই। এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষ যদি সতর্ক ও কঠোর না হন তাহলে নানাভাবে নাজুক পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে।

আগেই বলা হয়েছে, করোনাকালে জীবন বাঁচানোটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, আবার সবকিছু স্বাভাবিকের দিকে নেয়ার যে চেষ্টা শুরু হয়েছে তা যাতে বুমেরাং না হয় সে জন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত আমাদের জীবনকে স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের উলম্ফন হবে, তাই এ বিষয়টি যাতে স্বাভাবিকরূপেই স্বাভাবিক হয় সে জন্য ধীরে চলো নীতিতে এগোতে হবে।

[লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক,

ল’ রিপোর্টার্স ফোরাম]

back to top