alt

উপ-সম্পাদকীয়

স্কুল খোলার পর শিক্ষার্থীদের আচরণগত প্রতিক্রিয়া ও প্রতিকার

মাহমুদুল হাছান

: শুক্রবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১

লকডাউন শেষে দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার ঘোষণা নিসন্দেহে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের জন্য একটি আনন্দের সংবাদ। ছাত্রছাত্রীরা শ্রেণীতে আসবে, শিক্ষকরা তাদের পড়াবেন এবং টিফিন টাইমে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে তারা খেলা করবে-এ যেন এক বাঁধভাঙা আনন্দের জোয়ার।

দীর্ঘদিন শিক্ষার্থীরা শ্রেণীকক্ষের বাইরে থাকার ফলে তাদের আচার-আচরণ, আবেগ-অনুভূতি, প্রকাশভঙ্গি, জানার আগ্রহ, পড়ার প্রতি মনোনিবেশ ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হতে পারে। তাই এসব ব্যাপারে একজন শিক্ষককে বেশি কৌশলী ভূমিকা রাখতে হবে। এ ব্যাপারে আমার নিম্নের আলোচনা শিক্ষককে সচেতনতার সঙ্গে শ্রেণী কার্যক্রম চালাতে সাহায্য করবে।

একই শ্রেণীর বিভিন্ন ছাত্রছাত্রীদের প্রত্যেকের করোনা অতিমারির ব্যাপারে বিচিত্র অভিজ্ঞতা থাকতে পারে। তাদের সেই অভিজ্ঞতাগুলোর সঙ্গে তারা কীভাবে নিজেদের অভ্যস্ত করেছে কিংবা করোনাকে তারা কীভাবে মোকাবিলা করেছে, এ সব বিষয়ে একজন শিক্ষককে সম্যক ধারণা রেখে তাদের সঙ্গে আচরণ করতে হবে।

একজন শিক্ষক হিসেবে তার সামনে কিছু সমস্যা অপ্রতিরোধ্য মনে হতে পারে, যা তার প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য শিক্ষকসহ দেশের সব শিক্ষকই এ সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। শিক্ষক কি শিখাচ্ছেন এবং শিক্ষার্থীরা কি শিখছে, তাদের মনোনিবেশ কোনদিকে বা তারা শিক্ষককে বুঝতে পারছে কিনা ইত্যাদি নানা বিষয়ে শিক্ষক বিব্রত হতে পারেন। এ ব্যাপারে আপনাকে আপনার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে শেয়ার করে তাদের সঙ্গে আচরণ করতে হবে।

করোনাকালে শিক্ষার্থীরা হয়তো অনেক ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, ফলে একজন শিক্ষক বিভিন্ন ধরনের সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়া দেখতে পারেন এবং তাদের মধ্যে ব্যতিক্রম মানসিক প্রতিক্রিয়াও দেখা দিতে পারে। যেমন; দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়া, অস্বীকার করার প্রবণতা, রাগ রাগ ভাব, অপরাধবোধ কাজ করা, বিষণ্নতা ইত্যাদি ছাড়াও তাদের মধ্যে শিক্ষকরা বিভিন্ন শারীরিক প্রতিক্রিয়াও বোধ করতে পারে।

সাইকোথেরাপিস্ট জেন ক্যারো শিক্ষার্থীদের মানসিক প্রতিক্রিয়ার কয়েকটি লক্ষণ তুলে ধরেছেন, যা জানা থাকলে একজন শিক্ষক তাদের শ্রেণীকক্ষে সহায়তা করতে পারবেন:

১। শিক্ষার্থীদের মেজাজে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন, যা কয়েক দিনের চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। লক্ষণগুলোর মধ্যে স্বল্প শক্তি থাকা, বন্ধুদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ থেকে সরে আসা, পাঠগুলোতে মনোনিবেশ না করা, অশ্রুসিক্ত হওয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

২। শারীরিক ওজনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসতে পারে- সেটি ওজন বৃদ্ধি হতে পারে বা হ্রাসও হতে পারে- কারণ প্যান্ডেমিকে প্রায়শই মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকাতে তারা ক্ষুধা আক্রান্ত হযতে পারে।

৩। ক্লান্তিভাব বেশ কয়েক দিনের জন্য স্থায়ী হতে পারে। ক্লাসে ঘুম ঘুম ভাব, অলসতা প্রদর্শন, উদাসীনতা প্রভৃতি পরিলক্ষিত হতে পারে; যা মানসিক স্বাস্থ্যের উদ্বেগের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

৪। পাঠদানকালে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অল্পতে রেগে যাওয়ার মানসিকতা পরিলক্ষিত হতে পারে, যা পাঠদান প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে।

৫। শিক্ষকের চোখ ফাঁকি দিয়ে আড়ালে এমনভাবে অঙ্গভঙ্গি করা, যা শিক্ষকের শিক্ষাদান পদ্ধতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। যেমন, অযথা দেহ চুলকানো, নিজের শরীরে আঘাতের চিহ্ন তৈরি করা ইত্যাদি।

মোটকথা, শিক্ষার্থীরা আগের মতো একই গতিতে শিখতে সক্ষম বোধ করতে নাও পারে এবং বিব্রতকর আচরণ দেখাতে পারে। শ্রেণীতে পাঠদানকালে শিক্ষার্থীদের পাঠে মনোযোগী করতে না পারা বড় ধরনের একটি চ্যালেঞ্জ।

এছাড়াও শ্রেণীতে এসে শিক্ষার্থীরা হোম সিকনেস বা গৃহপীড়ায় আক্রান্ত হতে পারে। দীর্ঘদিন বাসা-বাড়িতে থাকার কারণে তারা বাবা-মা, দাদা-দাদি বা ভাইবোন থেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও আলাদা হওয়াতে তাদের মনের মধ্যে এক ধরনের বিরহ ব্যথা অনুভব হতে পারে। ফলে শিক্ষকরা তাদের পাঠদানে সংকট বোধ করতে পারেন, যা শিক্ষার সঠিক ফলাবর্তন নির্ণয়ে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।

করোনাকালে এমনও অনেক শিক্ষার্থী থাকতে পারে যাদের কেউ হয়ত মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে মারাও গিয়েছেন, যা তাদের মধ্যে একধরনের ট্রমা তৈরি করতে পারে। এ সব শিক্ষার্থীদের শ্রেণীভিত্তিক পড়ালেখায় আত্মনিমগ্ন করা শিক্ষকের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিতে পারে। এমতাবস্থায় তাদের প্রতি মানসিক যত্ন নেয়ার জন্য শিক্ষক ও স্কুল কর্তৃপক্ষের বিশেষ পরিবেশ তৈরি করা আবশ্যক হবে। ট্রমা-অবহিত যত্ন হলো স্কুল এবং সংস্থাগুলোর মধ্যে এমন একটি পরিবেশ তৈরির লক্ষ্য, যা ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করে এবং ট্রমাজনিত ব্যক্তিদের নিরাময়ের বিষয়টি নিশ্চিত করে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর সমস্যা ও সংকট যাই হোক না কেন শিক্ষকদের এমন কিছু উপায় অবলম্বন করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা মানসিক দিক থেকে সুস্থ থেকে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারে। এমন কিছু উপায় সম্পর্কে ধারণা প্রদান করা হলো :

১। করোনাকালে আমাদের সবার জীবন কীভাবে কেটেছে বা কার কি সমস্যা হয়েছে- এ সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলতে হবে। করোনা একটি ভাইরাসজনিত রোগ মাত্র, যা স্বাস্থ্য সচেতন থেকে মোকাবিলা করতে হবে। জীবন থাকলে ঝুঁকি থাকবে-এ বিষয়টি পরিষ্কার করে তাদের বোঝাতে হবে।

২। শিক্ষার্থীদের ভাইরাস সম্পর্কে প্রচুর কৌতূহল এবং প্রশ্ন থাকতে পারে, বর্তমানে করোনার আপডেট কি, ভবিষ্যতে এর প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে এবং এটি কীভাবে তাদের শিক্ষাকে প্রভাবিত করবে ইত্যাদি নানা বিষয়ে জানার আগ্রহ থাকতে পারে। শিক্ষক তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করা উচিত হবে। সৃজনশীল এবং বৃত্তিমূলক বিষয়গুলোর সঙ্গে একাডেমিক পাঠগুলোর ভারসাম্য বজায় রেখে শিক্ষার্থীদের সহায়ক জায়গায় এই চিন্তাভাবনা এবং প্রশ্নগুলো অন্বেষণ করার অনুমতি দেয়া শিক্ষকের শিক্ষাদানের আরেকটি কৌশল হতে পারে।

৩। দীর্ঘদিন শিক্ষার্থীরা বাড়িতে থাকায় তাদের পরিবারে এমন কিছু ঘটনা ঘটতে পারে, যা সম্পর্কে শিক্ষক হয়ত জানেন না। হতে পারে সেটি প্যাথেটিক বা সিম্প্যাথেটিক-এ বিষয়ে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থী শিশু এবং যুবকরা কথা বলতে শুরু করতে পারে, শিক্ষক হিসেবে তাদের এ অভিজ্ঞতা শেয়ার করার সুযোগ দিতে হবে। তারা এ ধরনের বিষয়ে যত বলার সুযোগ পাবে তারা ততই নিজেদের হালকা করে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারবে।

৪। শ্রেণীকক্ষে ফিরে এলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের অনেক খোলামেলা হতে হবে। দীর্ঘকাল পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কারণে শিক্ষার্থীরা একে অন্যের সঙ্গে মেলামেশা করতে বা শিক্ষদের সঙ্গে কথা বলতে শিক্ষার্থীদের মাঝে ইতস্ততভাব বা জড়তা কাজ করতে পারে। খোলামেলা বা ফ্রি হলে তারা দ্রুত শ্রেণীকক্ষে সবার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে এবং পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে পারবে। এজন্য শিক্ষকরা মাঝে মাঝে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে স্বাধীনভাবে কথা বলার একটি আলাদা শিডিউলও করতে পারেন।

৫। শ্রেণীকক্ষে উন্মুক্ত প্রশোত্তর পর্ব রেখে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকরা মুক্ত আলোচনায় অংশ নিতে পারেন। করোনাকে নিয়ে বাড়িতে কে কীভাবে সময় কাটিয়েছে, এ বিষয়ে দলভিত্তিক কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজনও করা যেতে পারে। তাহলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের পাঠগ্রহণের প্রতি আগ্রহী করে তুলবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর লকডাউন বা কোভিডোত্তর শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের শ্রেণীতে পড়ালেখায় মনোযোগী করে তোলাই শিক্ষকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ

৬। ভাইরাসজনিত কারণে আমরা যে সব চ্যালেঞ্জ এবং ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছি, শিক্ষার্থীদের সামনে তা তুলে ধরতে হবে এবং জীবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখাতে হবে। ভবিষ্যতের ব্যাপারে কোন রকম হতাশা ব্যক্ত না করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গঠনে আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার অনুপ্রেরণা জাগাতে হবে।

৭। কোভিডোত্তর শ্রেণী কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের বেশি বেশি সৃজনশীল কাজে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বহুদিন হোমস্কুলে থাকার কারণে তারা ক্লান্ত-শ্রান্ত ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে উঠেছে, তাদের এ একঘেয়েমি ভাব কাটাতে শিক্ষকদেরকে শ্রেণীকক্ষে এমন কিছু ক্রিয়াকলাপ চর্চা করতে হবে যার ফলে তাদের মেধা বিকশিত হতে পারে এবং সৃষ্টিশীল মানসিকতা গড়ে উঠে। যেমন পাঠদানের পাশাপাশি শ্রেণীকক্ষের বাইরে এনে প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসার সুযোগ তৈরি করা, প্লাকার্ড-পোস্টার বানানো, সংগীত, ভিজুয়াল আর্ট বা ড্রয়িংয়ের কাজ দেয়া ইত্যাদি নানা ধরনের কাজ দিয়ে শিক্ষার্থীদের মানসিক প্রশান্তি দেয়া যেতে পারে।

মোটকথা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর লকডাউন বা কোভিডোত্তর শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের শ্রেণীতে পড়ালেখায় মনোযোগী করে তোলাই শিক্ষকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। প্রায় দেড় বছরব্যাপী স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোলাহল থেকে দূরে থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নানাবিধ মানসিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তাই শ্রেণীভিত্তিক শিক্ষাক্রমে ফিরে আসার পর শিক্ষকদের পুস্তকনির্ভর জ্ঞান প্রদানের পূর্বে তাদের মানসিক বিকাশ সাধনের জন্য বিভিন্ন ধরনের সহপাঠক্রমিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। পড়ার পাশাপাশি সৃজনশীলতার প্রতি আকৃষ্ট করে তাদের মেধা ও মনন চর্চার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলেই শুধু লকডাউন পরবর্তী শিক্ষকদের সব সমস্যার দ্রুত সমাধান করা সম্ভব হবে।

[লেখক : প্রিন্সিপাল,

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা]

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

আউশ ধান : পরিবেশ ও কৃষকবান্ধব ফসল

ছবি

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আতুড়ঘর

চেক ডিজঅনার মামলার অধিক্ষেত্র ও প্রাসঙ্গিকতা

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৃষি

ছবি

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

ছবি

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

স্কুল খোলার পর শিক্ষার্থীদের আচরণগত প্রতিক্রিয়া ও প্রতিকার

মাহমুদুল হাছান

শুক্রবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১

লকডাউন শেষে দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার ঘোষণা নিসন্দেহে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের জন্য একটি আনন্দের সংবাদ। ছাত্রছাত্রীরা শ্রেণীতে আসবে, শিক্ষকরা তাদের পড়াবেন এবং টিফিন টাইমে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে তারা খেলা করবে-এ যেন এক বাঁধভাঙা আনন্দের জোয়ার।

দীর্ঘদিন শিক্ষার্থীরা শ্রেণীকক্ষের বাইরে থাকার ফলে তাদের আচার-আচরণ, আবেগ-অনুভূতি, প্রকাশভঙ্গি, জানার আগ্রহ, পড়ার প্রতি মনোনিবেশ ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হতে পারে। তাই এসব ব্যাপারে একজন শিক্ষককে বেশি কৌশলী ভূমিকা রাখতে হবে। এ ব্যাপারে আমার নিম্নের আলোচনা শিক্ষককে সচেতনতার সঙ্গে শ্রেণী কার্যক্রম চালাতে সাহায্য করবে।

একই শ্রেণীর বিভিন্ন ছাত্রছাত্রীদের প্রত্যেকের করোনা অতিমারির ব্যাপারে বিচিত্র অভিজ্ঞতা থাকতে পারে। তাদের সেই অভিজ্ঞতাগুলোর সঙ্গে তারা কীভাবে নিজেদের অভ্যস্ত করেছে কিংবা করোনাকে তারা কীভাবে মোকাবিলা করেছে, এ সব বিষয়ে একজন শিক্ষককে সম্যক ধারণা রেখে তাদের সঙ্গে আচরণ করতে হবে।

একজন শিক্ষক হিসেবে তার সামনে কিছু সমস্যা অপ্রতিরোধ্য মনে হতে পারে, যা তার প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য শিক্ষকসহ দেশের সব শিক্ষকই এ সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। শিক্ষক কি শিখাচ্ছেন এবং শিক্ষার্থীরা কি শিখছে, তাদের মনোনিবেশ কোনদিকে বা তারা শিক্ষককে বুঝতে পারছে কিনা ইত্যাদি নানা বিষয়ে শিক্ষক বিব্রত হতে পারেন। এ ব্যাপারে আপনাকে আপনার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে শেয়ার করে তাদের সঙ্গে আচরণ করতে হবে।

করোনাকালে শিক্ষার্থীরা হয়তো অনেক ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, ফলে একজন শিক্ষক বিভিন্ন ধরনের সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়া দেখতে পারেন এবং তাদের মধ্যে ব্যতিক্রম মানসিক প্রতিক্রিয়াও দেখা দিতে পারে। যেমন; দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়া, অস্বীকার করার প্রবণতা, রাগ রাগ ভাব, অপরাধবোধ কাজ করা, বিষণ্নতা ইত্যাদি ছাড়াও তাদের মধ্যে শিক্ষকরা বিভিন্ন শারীরিক প্রতিক্রিয়াও বোধ করতে পারে।

সাইকোথেরাপিস্ট জেন ক্যারো শিক্ষার্থীদের মানসিক প্রতিক্রিয়ার কয়েকটি লক্ষণ তুলে ধরেছেন, যা জানা থাকলে একজন শিক্ষক তাদের শ্রেণীকক্ষে সহায়তা করতে পারবেন:

১। শিক্ষার্থীদের মেজাজে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন, যা কয়েক দিনের চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। লক্ষণগুলোর মধ্যে স্বল্প শক্তি থাকা, বন্ধুদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ থেকে সরে আসা, পাঠগুলোতে মনোনিবেশ না করা, অশ্রুসিক্ত হওয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

২। শারীরিক ওজনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসতে পারে- সেটি ওজন বৃদ্ধি হতে পারে বা হ্রাসও হতে পারে- কারণ প্যান্ডেমিকে প্রায়শই মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকাতে তারা ক্ষুধা আক্রান্ত হযতে পারে।

৩। ক্লান্তিভাব বেশ কয়েক দিনের জন্য স্থায়ী হতে পারে। ক্লাসে ঘুম ঘুম ভাব, অলসতা প্রদর্শন, উদাসীনতা প্রভৃতি পরিলক্ষিত হতে পারে; যা মানসিক স্বাস্থ্যের উদ্বেগের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

৪। পাঠদানকালে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অল্পতে রেগে যাওয়ার মানসিকতা পরিলক্ষিত হতে পারে, যা পাঠদান প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে।

৫। শিক্ষকের চোখ ফাঁকি দিয়ে আড়ালে এমনভাবে অঙ্গভঙ্গি করা, যা শিক্ষকের শিক্ষাদান পদ্ধতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। যেমন, অযথা দেহ চুলকানো, নিজের শরীরে আঘাতের চিহ্ন তৈরি করা ইত্যাদি।

মোটকথা, শিক্ষার্থীরা আগের মতো একই গতিতে শিখতে সক্ষম বোধ করতে নাও পারে এবং বিব্রতকর আচরণ দেখাতে পারে। শ্রেণীতে পাঠদানকালে শিক্ষার্থীদের পাঠে মনোযোগী করতে না পারা বড় ধরনের একটি চ্যালেঞ্জ।

এছাড়াও শ্রেণীতে এসে শিক্ষার্থীরা হোম সিকনেস বা গৃহপীড়ায় আক্রান্ত হতে পারে। দীর্ঘদিন বাসা-বাড়িতে থাকার কারণে তারা বাবা-মা, দাদা-দাদি বা ভাইবোন থেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও আলাদা হওয়াতে তাদের মনের মধ্যে এক ধরনের বিরহ ব্যথা অনুভব হতে পারে। ফলে শিক্ষকরা তাদের পাঠদানে সংকট বোধ করতে পারেন, যা শিক্ষার সঠিক ফলাবর্তন নির্ণয়ে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।

করোনাকালে এমনও অনেক শিক্ষার্থী থাকতে পারে যাদের কেউ হয়ত মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে মারাও গিয়েছেন, যা তাদের মধ্যে একধরনের ট্রমা তৈরি করতে পারে। এ সব শিক্ষার্থীদের শ্রেণীভিত্তিক পড়ালেখায় আত্মনিমগ্ন করা শিক্ষকের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিতে পারে। এমতাবস্থায় তাদের প্রতি মানসিক যত্ন নেয়ার জন্য শিক্ষক ও স্কুল কর্তৃপক্ষের বিশেষ পরিবেশ তৈরি করা আবশ্যক হবে। ট্রমা-অবহিত যত্ন হলো স্কুল এবং সংস্থাগুলোর মধ্যে এমন একটি পরিবেশ তৈরির লক্ষ্য, যা ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করে এবং ট্রমাজনিত ব্যক্তিদের নিরাময়ের বিষয়টি নিশ্চিত করে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর সমস্যা ও সংকট যাই হোক না কেন শিক্ষকদের এমন কিছু উপায় অবলম্বন করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা মানসিক দিক থেকে সুস্থ থেকে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারে। এমন কিছু উপায় সম্পর্কে ধারণা প্রদান করা হলো :

১। করোনাকালে আমাদের সবার জীবন কীভাবে কেটেছে বা কার কি সমস্যা হয়েছে- এ সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলতে হবে। করোনা একটি ভাইরাসজনিত রোগ মাত্র, যা স্বাস্থ্য সচেতন থেকে মোকাবিলা করতে হবে। জীবন থাকলে ঝুঁকি থাকবে-এ বিষয়টি পরিষ্কার করে তাদের বোঝাতে হবে।

২। শিক্ষার্থীদের ভাইরাস সম্পর্কে প্রচুর কৌতূহল এবং প্রশ্ন থাকতে পারে, বর্তমানে করোনার আপডেট কি, ভবিষ্যতে এর প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে এবং এটি কীভাবে তাদের শিক্ষাকে প্রভাবিত করবে ইত্যাদি নানা বিষয়ে জানার আগ্রহ থাকতে পারে। শিক্ষক তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করা উচিত হবে। সৃজনশীল এবং বৃত্তিমূলক বিষয়গুলোর সঙ্গে একাডেমিক পাঠগুলোর ভারসাম্য বজায় রেখে শিক্ষার্থীদের সহায়ক জায়গায় এই চিন্তাভাবনা এবং প্রশ্নগুলো অন্বেষণ করার অনুমতি দেয়া শিক্ষকের শিক্ষাদানের আরেকটি কৌশল হতে পারে।

৩। দীর্ঘদিন শিক্ষার্থীরা বাড়িতে থাকায় তাদের পরিবারে এমন কিছু ঘটনা ঘটতে পারে, যা সম্পর্কে শিক্ষক হয়ত জানেন না। হতে পারে সেটি প্যাথেটিক বা সিম্প্যাথেটিক-এ বিষয়ে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থী শিশু এবং যুবকরা কথা বলতে শুরু করতে পারে, শিক্ষক হিসেবে তাদের এ অভিজ্ঞতা শেয়ার করার সুযোগ দিতে হবে। তারা এ ধরনের বিষয়ে যত বলার সুযোগ পাবে তারা ততই নিজেদের হালকা করে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারবে।

৪। শ্রেণীকক্ষে ফিরে এলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের অনেক খোলামেলা হতে হবে। দীর্ঘকাল পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কারণে শিক্ষার্থীরা একে অন্যের সঙ্গে মেলামেশা করতে বা শিক্ষদের সঙ্গে কথা বলতে শিক্ষার্থীদের মাঝে ইতস্ততভাব বা জড়তা কাজ করতে পারে। খোলামেলা বা ফ্রি হলে তারা দ্রুত শ্রেণীকক্ষে সবার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে এবং পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে পারবে। এজন্য শিক্ষকরা মাঝে মাঝে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে স্বাধীনভাবে কথা বলার একটি আলাদা শিডিউলও করতে পারেন।

৫। শ্রেণীকক্ষে উন্মুক্ত প্রশোত্তর পর্ব রেখে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকরা মুক্ত আলোচনায় অংশ নিতে পারেন। করোনাকে নিয়ে বাড়িতে কে কীভাবে সময় কাটিয়েছে, এ বিষয়ে দলভিত্তিক কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজনও করা যেতে পারে। তাহলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের পাঠগ্রহণের প্রতি আগ্রহী করে তুলবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর লকডাউন বা কোভিডোত্তর শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের শ্রেণীতে পড়ালেখায় মনোযোগী করে তোলাই শিক্ষকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ

৬। ভাইরাসজনিত কারণে আমরা যে সব চ্যালেঞ্জ এবং ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছি, শিক্ষার্থীদের সামনে তা তুলে ধরতে হবে এবং জীবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখাতে হবে। ভবিষ্যতের ব্যাপারে কোন রকম হতাশা ব্যক্ত না করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গঠনে আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার অনুপ্রেরণা জাগাতে হবে।

৭। কোভিডোত্তর শ্রেণী কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের বেশি বেশি সৃজনশীল কাজে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বহুদিন হোমস্কুলে থাকার কারণে তারা ক্লান্ত-শ্রান্ত ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে উঠেছে, তাদের এ একঘেয়েমি ভাব কাটাতে শিক্ষকদেরকে শ্রেণীকক্ষে এমন কিছু ক্রিয়াকলাপ চর্চা করতে হবে যার ফলে তাদের মেধা বিকশিত হতে পারে এবং সৃষ্টিশীল মানসিকতা গড়ে উঠে। যেমন পাঠদানের পাশাপাশি শ্রেণীকক্ষের বাইরে এনে প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসার সুযোগ তৈরি করা, প্লাকার্ড-পোস্টার বানানো, সংগীত, ভিজুয়াল আর্ট বা ড্রয়িংয়ের কাজ দেয়া ইত্যাদি নানা ধরনের কাজ দিয়ে শিক্ষার্থীদের মানসিক প্রশান্তি দেয়া যেতে পারে।

মোটকথা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর লকডাউন বা কোভিডোত্তর শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের শ্রেণীতে পড়ালেখায় মনোযোগী করে তোলাই শিক্ষকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। প্রায় দেড় বছরব্যাপী স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোলাহল থেকে দূরে থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নানাবিধ মানসিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তাই শ্রেণীভিত্তিক শিক্ষাক্রমে ফিরে আসার পর শিক্ষকদের পুস্তকনির্ভর জ্ঞান প্রদানের পূর্বে তাদের মানসিক বিকাশ সাধনের জন্য বিভিন্ন ধরনের সহপাঠক্রমিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। পড়ার পাশাপাশি সৃজনশীলতার প্রতি আকৃষ্ট করে তাদের মেধা ও মনন চর্চার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলেই শুধু লকডাউন পরবর্তী শিক্ষকদের সব সমস্যার দ্রুত সমাধান করা সম্ভব হবে।

[লেখক : প্রিন্সিপাল,

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা]

back to top