জিয়াউদ্দীন আহমেদ
বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরী ম্যাগসেসে পুরস্কার পেয়েছেন; তিনি আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) একজন বিজ্ঞানী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টিকাবিষয়ক বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্যও ছিলেন তিনি। ড. কাদরী টিকা-সংক্রান্ত গবেষণা ও পরীক্ষার কাজে যুক্ত; তিনি মুখে খাওয়ার টিকার উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন। সাশ্রয়ী মূল্যে টিকা উদ্ভাবনে তার অবদান অসামান্য। কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের তার উদ্ভাবিত সাশ্রয়ী মূল্যের টিকা দিয়ে তিনি লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে কলেরার প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা করেছেন। টিকার উদ্ভাবন ও উন্নয়নের গবেষণায় তার অবদান স্বীকার করে ফিলিপিন্সের র্যামন ম্যাগসেসে কমিটি ফেরদৌসী কাদরীসহ বিভিন্ন দেশের আরও তিনজনকে এই পুরস্কার প্রদান করে। ফিলিপিন্সের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট র্যামোন ম্যাগসেসের স্মরণে ১৯৫৭ সনে প্রবর্তিত এই পুরস্কার দালাই লামা, সত্যজিৎ রয়, পন্ডিত রবিশংকর, মহেশ্বতা দেবী, আক্তার হামিদ খান, ফজলে হাসান আবেদ, জাফর উল্লাহ চৌধুরী, মোহাম্মদ ইউনুস প্রমুখ ব্যক্তিগণকে দেয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এনবিসি চ্যানেল সারা বিশ্বের ২২০ কোটি মেধাবী শিশুর নানাভাবে পরীক্ষা নিয়ে গত বছর যে ২০ শিশুকে সবচেয়ে মেধাবী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় তাদের মধ্যে একজন হচ্ছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সুবর্ণ আইজ্যাক বারী। ২০১২ সনে জন্ম নেয়া সুবর্ণকে ক্ষুদে আইনস্টাইনও বলা হয়। ২০১৮ সনে ৬ বছর বয়সে সুবর্ণকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘বিজ্ঞানী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। পিএইচডি পর্যায়ের গণিত, পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়ন-এর সমস্যাগুলো সে অনায়সে সমাধান করতে পারে। রুইয়া কলেজ অফ মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ভিজিটিং অধ্যাপক পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। ২০২০ সনে নেদারল্যান্ডসের হেগে আয়োজিত সম্মেলনে কিডস রাইটস ফাউন্ডেশন কর্তৃক আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশের নড়াইলের কিশোর সাদাত রহমান। সাইবার অপরাধ থেকে শিশুদের সুরক্ষার ‘সাইবার টিনস’ নামে যে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনটি সে তৈরি করে তা দিয়ে ভুক্তভোগীর সঙ্গে গোপনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যোগাযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়। বাংলাদেশের গ্রামবাংলার মানুষের আবহমানকালের খাবার পান্তা ভাত আর আলু ভর্তা পরিবেশন করে অস্ট্রেলিয়ায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কিশোয়ার চৌধুরী।
ওমানের মাস্কাট থেকে যাত্রীবাহী ফ্লাইট নিয়ে ফেরার পথে ভারতের আকাশে হার্ট অ্যাটাকের শিকার হয়ে বাংলাদেশ বিমানের পাইলট ক্যাপ্টেন নওশাদ আতাউল কাইউম মারা গেলেও শতাধিক যাত্রীসহ বিমানটি রক্ষা পেয়েছে। আরও অনেকগুলো স্বস্তিদায়ক খবর আছে- বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ কমছে এবং সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে মেট্রোরেলের পরীক্ষামূলক চলাচল শুরু হয়েছে। বিদ্যুৎচালিত এই মেট্রোরেল চালু হলে ঢাকার যানজট সমস্যার অনেকটা সমাধান হবে। মেট্রোরেলে ২৪টি ট্রেনপ্রতি ঘণ্টায় আপ ও ডাউন রুটে ৬০ হাজার যাত্রী আনা নেয়া করতে সক্ষম হবে। সবচেয়ে বড় সুখবর হচ্ছে, পদ্মা সেতুর সঙ্গে বিগত এক সপ্তাহে কোন ফেরির ধাক্কা লাগেনি।
করোনা মহামারির আর্থিক চ্যালেঞ্জের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক।
উৎপাদন সম্প্রসারণে যে শক্তি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হচ্ছে বিদ্যুৎ; শেখ হাসিনার সরকার এই বিদ্যুৎ উৎপাদনে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। পাকিস্তান আমলে যে প্রকল্পের কথা আমরা স্কুলে পড়েছি সেই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বাস্তবায়নে শেখ হাসিনা অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। বিদ্যুতের অনেকগুলো মেগাপ্রকল্প এখন বাস্তবায়নাধীন। মাথাপিছু আয়, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ইত্যাদি অনেকগুলো ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। এর বাইরেও সাফল্য রয়েছে, সাম্প্রতিককালে ক্রিকেটে বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছে, নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধেও জিতেছে।
এসব ইতিবাচক খবরে আমরা অনুপ্রাণিত হই, হাজারো প্রতিকূলতা সামলে নিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে তাতে উজ্জীবিত হই। কিন্তু পরক্ষণেই যখন মানসপটে ভেসে উঠে, কাজের সন্ধানে নৌকায় করে সাগরপাড়ি দিতে গিয়ে হাজার হাজার বাঙালির ভূমধ্যসাগরে সলিল সমাধি হচ্ছে, তখন আর উন্নয়নের স্লোগানে উজ্জীবিত হতে পারি না। অসংখ্য লোকের কর্মসংস্থান করা দুঃস্বপ্ন; প্রতি বছর যে পরিমাণ কর্মসংস্থান হয় তারচেয়ে অনেক বেশি লোক বেকার হচ্ছে। রকেটের গতিতে উন্নয়ন হলেও বেকার সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হয় না। জনসংখ্যার চাপে সেনাবাহিনী আর পুলিশ দিয়েও লকডাউন কার্যকর করা যায়নি, খাবার দেয়া সম্ভব না হওয়ায় জীবনের চেয়ে জীবিকার ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হয়েছে। খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা টেকসই হচ্ছে না, প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলেই টনে টনে চাল আমদানি করতে হচ্ছে। তাই অনুন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসার তড়িঘড়ি প্রচেষ্টা যেন বুমেরাং না হয় তাও দেখতে হবে; এই অর্জনে মর্যাদা বাড়লেও প্রচুর সুযোগ-সুবিধা হারাতে হবে।
করোনা প্রকোপে সারা বিশ্বের মানুষের জীবন ও জীবিকার সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। টিকার ব্যাপক হারে প্রয়োগে উন্নত দেশগুলোতে করোনার প্রকোপ দ্রুত কমে যাচ্ছে, তাদের দেশে সবকিছু আগের মতো চালু হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে টিকার সংকট কাটাতে চীনের সিনোফার্মার সঙ্গে চুক্তি করে একটি ওষুধ কোম্পানি করোনার টিকা তৈরি করতে যাচ্ছে, বাংলাদেশ সরকারও এদের কাজ থেকে প্রচুর টিকা নিয়েছে এবং নেবে। এমন সুখবরের মধ্যেও নেতিবাচক ভাবনায় আক্রান্ত হচ্ছি। বিশ্ব রাজনীতির খেলায় সিনোফার্মার টিকা দিয়ে ৩/৪টি দেশের বাইরে অন্য কোন দেশে যাওয়া যাবে না। আমাদের দেশের লোকেরা সিনোফার্মের টিকা নিয়ে পড়ার জন্য, চাকরির জন্য, ব্যবসার জন্য বিদেশে যেতে গিয়ে সমস্যায় পড়বে। তাই এই টিকা বিদেশ গমনেচ্ছুদের দেয়া ঠিক হবে বলে মনে হয় না, এই টিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে অবশ্যই অপশন থাকা প্রয়োজন। করোনার জন্য বহু ছেলেমেয়ে বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে পারেনি, শিগগিরই তারা আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে বিদেশে যাবে, তাদের সিনোফার্মের টিকা দেয়া ঠিক হবে বলে মনে হয় না। উন্নত দেশগুলোর মতো পছন্দ অনুযায়ী টিকা নেয়ার ব্যবস্থা সীমিত পর্যায়ে হলেও চালু করা জরুরি।
ইতিবাচক ঘটনা নিয়ে লেখার আগ্রহে আবার ভাটা পড়েছে। টিকা নেয়ার জন্য লক্ষ লক্ষ লোক নিবন্ধন করেছেন, কিন্তু টিকার অভাবে আবারও দুর্নীতির সংবাদ পেলাম। ভ্যাকসিন চুরি সম্পর্কিত আমার কলামটি পড়ে আমার বন্ধুর বউ লিখেছেন, ‘ভাই, গত মার্চ মাসে টিকার জন্য রেজিস্ট্রেশন করেছিলাম। পাঁচ মাস ধরে প্রতিদিন মোবাইলে মেসেজ চেক করি, মেসেজ তো আর আসে না। জুলাই মাসের প্রথম দিকে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে (হাসপাতালের নাম আমি উল্লেখ করলাম না) খোঁজ নিতে গেলে ‘সময় হলে জানাবে’ বলে আমাকে বিদায় করে দিল। আরও এক মাস পর করোনার প্রকোপ বেড়ে গেলে আমি অস্থির হয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আমার ফুফাতো ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলে সে মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট চেক করে দেখে যে, আমাকে টিকা দেয়া সম্পন্ন হয়েছে এবং টিকার দেয়ার তারিখও উল্লেখ রয়েছে। আমার ডাক্তার পড়–য়া ছেলে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে যে, এমন ঘটনা আরও অনেকের ক্ষেত্রে ঘটেছে। ৩১ জুলাই সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে গিয়ে সব কাহিনী বলার পর কোন শব্দ উচ্চারণ না করে নীরবে আমাকে টিকা দিয়ে দিল’।
পরীমনির বাসায় মদের বোতল পাওয়া আর ব্যক্তিগত গোপনীয় বিষয় নিয়ে মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেভাবে মাতামাতি করেছে বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরী, সুবর্ণ বা সাদাতকে নিয়ে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। এক্ষেত্রে শুধু মিডিয়াকে একতরফা দোষ দেয়া সমীচীন হবে না, কারণ পাঠক এবং দর্শক নেতিবাচক খবরের প্রতি বেশি আগ্রহান্বিত। পাঠক এবং দর্শকের এমন আগ্রহের কারণেই ইতিবাচক খবরের প্রচারণা ২৪ ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হয় না, আমাকেও ইতিবাচক খবরের পর শেষ পর্যন্ত নেতিবাচক খবর দিয়েই লেখা শেষ করতে হলো।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]
ahmedzeauddin0@gmail.com
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
শনিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১
বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরী ম্যাগসেসে পুরস্কার পেয়েছেন; তিনি আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) একজন বিজ্ঞানী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টিকাবিষয়ক বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্যও ছিলেন তিনি। ড. কাদরী টিকা-সংক্রান্ত গবেষণা ও পরীক্ষার কাজে যুক্ত; তিনি মুখে খাওয়ার টিকার উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন। সাশ্রয়ী মূল্যে টিকা উদ্ভাবনে তার অবদান অসামান্য। কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের তার উদ্ভাবিত সাশ্রয়ী মূল্যের টিকা দিয়ে তিনি লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে কলেরার প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা করেছেন। টিকার উদ্ভাবন ও উন্নয়নের গবেষণায় তার অবদান স্বীকার করে ফিলিপিন্সের র্যামন ম্যাগসেসে কমিটি ফেরদৌসী কাদরীসহ বিভিন্ন দেশের আরও তিনজনকে এই পুরস্কার প্রদান করে। ফিলিপিন্সের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট র্যামোন ম্যাগসেসের স্মরণে ১৯৫৭ সনে প্রবর্তিত এই পুরস্কার দালাই লামা, সত্যজিৎ রয়, পন্ডিত রবিশংকর, মহেশ্বতা দেবী, আক্তার হামিদ খান, ফজলে হাসান আবেদ, জাফর উল্লাহ চৌধুরী, মোহাম্মদ ইউনুস প্রমুখ ব্যক্তিগণকে দেয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এনবিসি চ্যানেল সারা বিশ্বের ২২০ কোটি মেধাবী শিশুর নানাভাবে পরীক্ষা নিয়ে গত বছর যে ২০ শিশুকে সবচেয়ে মেধাবী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় তাদের মধ্যে একজন হচ্ছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সুবর্ণ আইজ্যাক বারী। ২০১২ সনে জন্ম নেয়া সুবর্ণকে ক্ষুদে আইনস্টাইনও বলা হয়। ২০১৮ সনে ৬ বছর বয়সে সুবর্ণকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘বিজ্ঞানী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। পিএইচডি পর্যায়ের গণিত, পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়ন-এর সমস্যাগুলো সে অনায়সে সমাধান করতে পারে। রুইয়া কলেজ অফ মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ভিজিটিং অধ্যাপক পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। ২০২০ সনে নেদারল্যান্ডসের হেগে আয়োজিত সম্মেলনে কিডস রাইটস ফাউন্ডেশন কর্তৃক আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশের নড়াইলের কিশোর সাদাত রহমান। সাইবার অপরাধ থেকে শিশুদের সুরক্ষার ‘সাইবার টিনস’ নামে যে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনটি সে তৈরি করে তা দিয়ে ভুক্তভোগীর সঙ্গে গোপনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যোগাযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়। বাংলাদেশের গ্রামবাংলার মানুষের আবহমানকালের খাবার পান্তা ভাত আর আলু ভর্তা পরিবেশন করে অস্ট্রেলিয়ায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কিশোয়ার চৌধুরী।
ওমানের মাস্কাট থেকে যাত্রীবাহী ফ্লাইট নিয়ে ফেরার পথে ভারতের আকাশে হার্ট অ্যাটাকের শিকার হয়ে বাংলাদেশ বিমানের পাইলট ক্যাপ্টেন নওশাদ আতাউল কাইউম মারা গেলেও শতাধিক যাত্রীসহ বিমানটি রক্ষা পেয়েছে। আরও অনেকগুলো স্বস্তিদায়ক খবর আছে- বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ কমছে এবং সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে মেট্রোরেলের পরীক্ষামূলক চলাচল শুরু হয়েছে। বিদ্যুৎচালিত এই মেট্রোরেল চালু হলে ঢাকার যানজট সমস্যার অনেকটা সমাধান হবে। মেট্রোরেলে ২৪টি ট্রেনপ্রতি ঘণ্টায় আপ ও ডাউন রুটে ৬০ হাজার যাত্রী আনা নেয়া করতে সক্ষম হবে। সবচেয়ে বড় সুখবর হচ্ছে, পদ্মা সেতুর সঙ্গে বিগত এক সপ্তাহে কোন ফেরির ধাক্কা লাগেনি।
করোনা মহামারির আর্থিক চ্যালেঞ্জের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক।
উৎপাদন সম্প্রসারণে যে শক্তি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হচ্ছে বিদ্যুৎ; শেখ হাসিনার সরকার এই বিদ্যুৎ উৎপাদনে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। পাকিস্তান আমলে যে প্রকল্পের কথা আমরা স্কুলে পড়েছি সেই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বাস্তবায়নে শেখ হাসিনা অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। বিদ্যুতের অনেকগুলো মেগাপ্রকল্প এখন বাস্তবায়নাধীন। মাথাপিছু আয়, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ইত্যাদি অনেকগুলো ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। এর বাইরেও সাফল্য রয়েছে, সাম্প্রতিককালে ক্রিকেটে বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছে, নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধেও জিতেছে।
এসব ইতিবাচক খবরে আমরা অনুপ্রাণিত হই, হাজারো প্রতিকূলতা সামলে নিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে তাতে উজ্জীবিত হই। কিন্তু পরক্ষণেই যখন মানসপটে ভেসে উঠে, কাজের সন্ধানে নৌকায় করে সাগরপাড়ি দিতে গিয়ে হাজার হাজার বাঙালির ভূমধ্যসাগরে সলিল সমাধি হচ্ছে, তখন আর উন্নয়নের স্লোগানে উজ্জীবিত হতে পারি না। অসংখ্য লোকের কর্মসংস্থান করা দুঃস্বপ্ন; প্রতি বছর যে পরিমাণ কর্মসংস্থান হয় তারচেয়ে অনেক বেশি লোক বেকার হচ্ছে। রকেটের গতিতে উন্নয়ন হলেও বেকার সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হয় না। জনসংখ্যার চাপে সেনাবাহিনী আর পুলিশ দিয়েও লকডাউন কার্যকর করা যায়নি, খাবার দেয়া সম্ভব না হওয়ায় জীবনের চেয়ে জীবিকার ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হয়েছে। খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা টেকসই হচ্ছে না, প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলেই টনে টনে চাল আমদানি করতে হচ্ছে। তাই অনুন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসার তড়িঘড়ি প্রচেষ্টা যেন বুমেরাং না হয় তাও দেখতে হবে; এই অর্জনে মর্যাদা বাড়লেও প্রচুর সুযোগ-সুবিধা হারাতে হবে।
করোনা প্রকোপে সারা বিশ্বের মানুষের জীবন ও জীবিকার সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। টিকার ব্যাপক হারে প্রয়োগে উন্নত দেশগুলোতে করোনার প্রকোপ দ্রুত কমে যাচ্ছে, তাদের দেশে সবকিছু আগের মতো চালু হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে টিকার সংকট কাটাতে চীনের সিনোফার্মার সঙ্গে চুক্তি করে একটি ওষুধ কোম্পানি করোনার টিকা তৈরি করতে যাচ্ছে, বাংলাদেশ সরকারও এদের কাজ থেকে প্রচুর টিকা নিয়েছে এবং নেবে। এমন সুখবরের মধ্যেও নেতিবাচক ভাবনায় আক্রান্ত হচ্ছি। বিশ্ব রাজনীতির খেলায় সিনোফার্মার টিকা দিয়ে ৩/৪টি দেশের বাইরে অন্য কোন দেশে যাওয়া যাবে না। আমাদের দেশের লোকেরা সিনোফার্মের টিকা নিয়ে পড়ার জন্য, চাকরির জন্য, ব্যবসার জন্য বিদেশে যেতে গিয়ে সমস্যায় পড়বে। তাই এই টিকা বিদেশ গমনেচ্ছুদের দেয়া ঠিক হবে বলে মনে হয় না, এই টিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে অবশ্যই অপশন থাকা প্রয়োজন। করোনার জন্য বহু ছেলেমেয়ে বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে পারেনি, শিগগিরই তারা আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে বিদেশে যাবে, তাদের সিনোফার্মের টিকা দেয়া ঠিক হবে বলে মনে হয় না। উন্নত দেশগুলোর মতো পছন্দ অনুযায়ী টিকা নেয়ার ব্যবস্থা সীমিত পর্যায়ে হলেও চালু করা জরুরি।
ইতিবাচক ঘটনা নিয়ে লেখার আগ্রহে আবার ভাটা পড়েছে। টিকা নেয়ার জন্য লক্ষ লক্ষ লোক নিবন্ধন করেছেন, কিন্তু টিকার অভাবে আবারও দুর্নীতির সংবাদ পেলাম। ভ্যাকসিন চুরি সম্পর্কিত আমার কলামটি পড়ে আমার বন্ধুর বউ লিখেছেন, ‘ভাই, গত মার্চ মাসে টিকার জন্য রেজিস্ট্রেশন করেছিলাম। পাঁচ মাস ধরে প্রতিদিন মোবাইলে মেসেজ চেক করি, মেসেজ তো আর আসে না। জুলাই মাসের প্রথম দিকে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে (হাসপাতালের নাম আমি উল্লেখ করলাম না) খোঁজ নিতে গেলে ‘সময় হলে জানাবে’ বলে আমাকে বিদায় করে দিল। আরও এক মাস পর করোনার প্রকোপ বেড়ে গেলে আমি অস্থির হয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আমার ফুফাতো ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলে সে মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট চেক করে দেখে যে, আমাকে টিকা দেয়া সম্পন্ন হয়েছে এবং টিকার দেয়ার তারিখও উল্লেখ রয়েছে। আমার ডাক্তার পড়–য়া ছেলে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে যে, এমন ঘটনা আরও অনেকের ক্ষেত্রে ঘটেছে। ৩১ জুলাই সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে গিয়ে সব কাহিনী বলার পর কোন শব্দ উচ্চারণ না করে নীরবে আমাকে টিকা দিয়ে দিল’।
পরীমনির বাসায় মদের বোতল পাওয়া আর ব্যক্তিগত গোপনীয় বিষয় নিয়ে মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেভাবে মাতামাতি করেছে বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরী, সুবর্ণ বা সাদাতকে নিয়ে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। এক্ষেত্রে শুধু মিডিয়াকে একতরফা দোষ দেয়া সমীচীন হবে না, কারণ পাঠক এবং দর্শক নেতিবাচক খবরের প্রতি বেশি আগ্রহান্বিত। পাঠক এবং দর্শকের এমন আগ্রহের কারণেই ইতিবাচক খবরের প্রচারণা ২৪ ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হয় না, আমাকেও ইতিবাচক খবরের পর শেষ পর্যন্ত নেতিবাচক খবর দিয়েই লেখা শেষ করতে হলো।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]
ahmedzeauddin0@gmail.com