alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

ঐতিহাসিক সত্য উন্মোচনে ট্রুথ কমিশন

শঙ্কর প্রসাদ দে

: বৃহস্পতিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

পরবর্তী প্রজন্ম আজি হতে শত শত বর্ষ পরে কল্পনাও করতে পারবে না বিভীষিকাময় দিনগুলো। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। বিজয় এলো। তাজউদ্দীন সাহেব ২২ ডিসেম্বর এসেই পাকিস্তানি প্রশাসন এবং সামরিক আমলাতন্ত্র পুনর্বহাল করলেন। ১২ জানুয়ারি ১৯৭২, বঙ্গবন্ধু ও পুরনো সিভিল ও সামরিক কাঠামো নিয়ে এগোলেন। সর্বনাশের শুরু এখান থেকে।

সামরিক কর্তারা ভাবলেন তারাই দেশ স্বাধীন করেছেন আর রাজনৈতিক নেতারা প্রবাসী সরকারের নামে অনেকটা ঝুঁকিহীন অবস্থানে ছিলেন। আমরা কেউই সেনাকর্তাদের এ মনোভাবকে পাত্তা দেইনি। বঙ্গবন্ধু এদের নিজের সন্তান জ্ঞান করতেন। তিনি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেননি। পাকিস্তান সৃষ্টির দ্বিতীয় ব্যক্তি ও প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে সামরিক বাহিনীই হত্যা করেছে। সেনাপ্রধান আইয়ুব খান নির্বাচিত সরকারকে বন্দুকের গুঁতা দিয়ে বের করে দিলেন। নিজেকে ঘোষণা করলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা না হলে জিয়া সেনাপ্রধান হতেন না। ২৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার মাত্র ৯ দিনের ব্যবধানে সেনাপ্রধান হয়েই জিয়া ক্ষমতার প্রকৃত মালিক হলেন। পরবর্তীতে বিচারপতি সায়েমকে বন্দুকের গুঁতায় বঙ্গভবন থেকে বের করে দিয়ে নিজেকে ঘোষণা করলেন প্রেসিডেন্ট। হুবহু পাকিস্তানি মডেলে আইয়ুবের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জিয়ার বঙ্গভবন দখল রূপকথাকেও হার মানায়। লিয়াকত আলী খান হত্যার বিচার হয়নি। কারণ গত ৭০ বছরে পাকিস্তান রাষ্ট্রে সময়, ক্ষমতা ও সমাজের নিয়ন্ত্রণ ছিল সামরিক বাহিনীর হাতে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতা নেয়ার মুহূর্তে সময়, ক্ষমতা ও সমাজ বিচারের পক্ষে ছিল না। রূঢ় হলেও এটি সত্য। পঁচাত্তরের পর যে শিশু জন্ম নিয়েছিল তারা জানত না, বঙ্গবন্ধু নামে কেউ এদেশে জন্মেছিল বা জাতির পিতা ছিল। এই রাষ্ট্রের অন্যতম শক্তিকেন্দ্র সামরিক বাহিনী। তখন উঁচুস্তরে যারা ছিলেন তাদের অনেকেই রক্তাক্ত পঁচাত্তর না হলে এত উপরে উঠতে পারতেন না। ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোকে উত্ত্যক্ত করে বিচার দূরের কথা ক্ষমতায় টিকে থাকাও ছিল কষ্টসাধ্য। মনে রাখতে হবে ১৯৯৬ সালের ৭ম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ১৪৬ আসন। আ স ম রবের মতো এরশাদী মোসাহেবসহ ৫টি ভোট ধার করে সরকার গঠন করতে হয়েছিল। একাত্তরের পরাজিতরা, খুনিরা, ষড়যন্ত্রকারীরা, মৌলবাদ সমাজে ছড়িয়ে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে রাশি রাশি ঘৃণা। শেখ হাসিনার সময়, ক্ষমতা ও সমাজের এ প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা, হিমালয় অতিক্রম করাকেও হার মানায়। গোটা দেশে কানাঘুষা চলছিল মামলা করলে কী হবে, এ বিচার কোন দিন শেষ হবে না। ফারুককে যেদিন গ্রেফতার করা হয় সেদিন অনেকেই অবাক হয়ে বলেছিল শেখ হাসিনা বড় দুঃসাহসী হয়ে উঠেছেন। এসব অশুভ ইঙ্গিত ছিল। ২১ আগস্ট ২০০৪ শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা হামলার এটাই ছিল প্রকৃত কারণ। বেগম জিয়া বিচার প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দিয়েছিলেন হাইকোর্টে। পাকিস্তানি আদর্শ, মৌলবাদ ও মুক্তিযুদ্ধকে চিরতরে পরাস্ত করতে হলে শেখ হাসিনাকে চিরতরে বিদায় করার দরকার ছিল।

আসলে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যাদের মৃত্যুদন্ড বহাল ও কার্যকর হয়েছে তার বাইরে রয়ে গেছে একঝাঁক ষড়যন্ত্রকারী, পটভূমি রচনাকারী, বিদেশের সাথে সংযোগকারী আন্তর্জাতিক চক্র। যেমন ধরুন লিবিয়ার নৈতিক সমর্থন না থাকলে লিবিয়া খুনিদের নিরাপদ আস্তানা হতো না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে আমেরিকার নৈতিক সমর্থন ছিল বলেই আজও খুনি রাশেদ দিব্যি ঘুরে বেড়াতে পারছে। বিশাল এক ক্যানভাসে মঞ্চস্থ হয়েছে পৃথিবীর নৃশংসতম এক হত্যালীলা। ফ্রাঙ্কফুট ওডার থেকে বার্লিন ফেরার পথে এক বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক আলাপচারিতায় বলেছিলেন- তিনি বাংলাদেশিদের ঘৃণা করেন, কারণ শেখ মুজিবের মতো এক অসাধারণ মানুষকে তারা হত্যা করেছে। তিনি বার্লিন বিশ^বিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর। লজ্জায় মাথা নিচু করা ছাড়া আমার উপায় ছিল না।

মহাভারতের হত্যাযজ্ঞ থেকে শুরু করে আলেন্দে হত্যাকান্ড পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা তুলনা করে দেখলাম, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সাথে তুলনীয় কোন জঘন্য ঘটনা মানব ইতিহাসে ঘটেনি। সেসব ষড়যন্ত্রকারী, পটভূমি, রচনাকারী ও বিদেশি শত্রুরা কি ইতিহাসের বিচার এড়িয়ে যাবে দোর্দন্ড প্রতাপে? বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড উদ্ঘাটনে কমিশন বাঙালি জাতিসত্তা, সভ্যতা ও প্রগতির স্বার্থে অপরিহার্য অনিবার্য। মহাত্মা গান্ধীকে হত্যাকারী শিবসেনা সমর্থক আইনজীবী নাথুরাম গডসেকে ফাঁসি দেয়া হলেও তার আদর্শকে মোকাবেলা করা হয়নি। সেদিন নাথুরামের রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিভূমি, ষড়যন্ত্র, পটভূমি চিহ্নিত করা গেলে ভারতবর্ষে শিবসেনা, রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ ও বিজেপি দিল্লি দখল করতে পারতো না। তেমনি ১৫ আগস্ট হত্যাকারীদের রাজনৈতিক আদর্শ, পটভূমি রচনাকারীদের আদর্শ ও মৌলবাদকে চিহ্নিত করা না গেলে ভবিষ্যৎ কখনই ঝুঁকিমুক্ত হবে না। কমিশন গঠনের এটাই সর্বোত্তম সময়। সময় ও স্রোত কাহারো জন্য অপেক্ষা করে না। এরপর কথা উঠবে কমিশনের শেষ পরিণতি কী? কী উদঘাটন করতে চায় কমিশন? রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য কমিশন ব্যবহৃত হবে না তো? প্রশ্নগুলোর যৌক্তিকতা আছে। আবার এসব প্রশ্ন উত্থাপন করে কমিশন গঠনকে ঠেকানোর অপচেষ্টা নেয়া হবে না তো? এসব প্রশ্ন যত বেশি উত্থাপিত হবে, ততই যৌক্তিক পরিণতির দিকে ধাবিত হবে রক্তাক্ত পঁচাত্তরের রহস্য উন্মোচন।

নেলসন ম্যান্ডেলা ক্ষমতা নিয়েই ইতিহাসের সত্য উন্মোচনে গঠন করেছিলেন ট্রুথ কমিশন। হাজার হাজার হৃদয়বিদারক ঘটনা উঠে এলো অবলীলায়। বেশির ভাগ অপরাধ সংঘটিত করেছিল শ্বেতাঙ্গরা

পৃথিবীব্যাপী একটি জনপ্রিয় ধারণার নাম ট্রুথ কমিশন। নেলসন ম্যান্ডেলা ক্ষমতা নিয়েই ইতিহাসের সত্য উন্মোচনে গঠন করেছিলেন ট্রুথ কমিশন। হাজার হাজার হৃদয়বিদারক ঘটনা উঠে এলো অবলীলায়। বেশির ভাগ অপরাধ সংঘটিত করেছিল শ্বেতাঙ্গরা। সত্য স্বীকার করায় অপরাধীরা ক্ষমা পেয়েছিল রাষ্ট্রের কাছে। তবে ক্ষমা পায়নি ভুক্তভোগী আর ইতিহাসের কাছে- এটাই সভ্যতার লাভ।

কমিশন বা ট্রুথ কমিশন যেটাই হোক, রক্তাক্ত পঁচাত্তরের সত্য ঘটনা আসুক দিনের আলোয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্র অনেককে ক্ষমা করার সুযোগ পাবে। প্রদর্শিত ক্ষমায় বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের বিদেহী আত্মাও শান্তি পাবে। লাভবান হবে বাঙালি জাতিসত্তা, সভ্যতা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ। আমার বিশ্বাস মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে পরিপূর্ণভাবে বুঝতে হলে আমাদের আরো বহুপথ অতিক্রম করতে হবে।

[লেখক : আইনজীবী, হাইকোর্ট]

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

প্রকৃতার্থে ফকির কারা

এনসিপি চায় অবিনাশী জুলাই সনদ

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

আলুর প্রাচুর্যে কৃষকের সংকট

তাহলে কী ‘কোটা’ই জয়যুক্ত হবে!

ব্যাংকিং খাতে বিষফোঁড়া: বাংলাদেশের অর্থনীতির ধমনী বিষাক্ত হয়ে উঠছে

ছবি

ঢাকার নদী ও খালের দখল-দূষণ: পুনরুদ্ধার কোন পথে

জমি কী মূলে রেকর্ড হয়েছে, দলিল মূলে না উত্তরাধিকার মূলে?

কার্বন-নিরপেক্ষ শিশুর অনুপ্রেরণায় দেশ

এবার আমরা সভ্য হলাম!

সোনার প্রাসাদের দেয়ালে ঘামের দাগ

নিরাপদ সড়ক চাই কিন্তু কার্যকর উদ্যোগ কোথায়?

অবহেলিত শিক্ষার দুর্দশা বাড়ছে

টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত নিরাপদ সড়ক

বাংলার সংস্কৃতি কি মূলধারা হারিয়ে ফেলবে?

ছবি

সমদৃষ্টি, বহুত্ববাদী সমাজ এবং সহিষ্ণুতা

খাদ্য অপচয় : ক্ষুধার্ত পৃথিবীর এক নিঃশব্দ ট্র্যাজেডি

টেকসই বাংলাদেশ গঠনে পরিবেশ সংস্কার কেন অপরিহার্য

সে এক রূপকথারই দেশ

উপকূলের খাদ্যসংকট নিয়ে ভাবছেন কি নীতিনির্ধারকেরা?

মানসিক স্বাস্থ্য: মানবাধিকারের নতুন চ্যালেঞ্জ

ঢাকার যানজট ও বিকেন্দ্রীকরণ

নির্বাচনী মাঠে জামায়াতী হেকমত

শিক্ষা ব্যবস্থায় গভীর বৈষম্য ও জাতির অগ্রযাত্রাধ

উপমহাদেশে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন, বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

এইচএসসি ফল: সংখ্যার খেল না কি শিক্ষার বাস্তব চিত্র?

বিনা ভোট, নিশি ভোট, ডামি ভোটের পরে এবার নাকি গণভোট!

কমরেড ইলা মিত্রের শততম জন্মজয়ন্তী

কত মৃত্যু হলে জাগবে বিবেক?

বৈষম্যের বিবিধ মুখ

মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় জরুরি আইনি সহায়তা

গাজা : এখন শান্তি রক্ষা করবে কে?

দোসর, বাই ডিফল্ট!

জমি কেনা দাগে দাগে কিন্তু ভোগদখল একদাগে

রাষ্ট্র কি শুধু শিক্ষকদের বেলায় এসে দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে?

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

ঐতিহাসিক সত্য উন্মোচনে ট্রুথ কমিশন

শঙ্কর প্রসাদ দে

বৃহস্পতিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

পরবর্তী প্রজন্ম আজি হতে শত শত বর্ষ পরে কল্পনাও করতে পারবে না বিভীষিকাময় দিনগুলো। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। বিজয় এলো। তাজউদ্দীন সাহেব ২২ ডিসেম্বর এসেই পাকিস্তানি প্রশাসন এবং সামরিক আমলাতন্ত্র পুনর্বহাল করলেন। ১২ জানুয়ারি ১৯৭২, বঙ্গবন্ধু ও পুরনো সিভিল ও সামরিক কাঠামো নিয়ে এগোলেন। সর্বনাশের শুরু এখান থেকে।

সামরিক কর্তারা ভাবলেন তারাই দেশ স্বাধীন করেছেন আর রাজনৈতিক নেতারা প্রবাসী সরকারের নামে অনেকটা ঝুঁকিহীন অবস্থানে ছিলেন। আমরা কেউই সেনাকর্তাদের এ মনোভাবকে পাত্তা দেইনি। বঙ্গবন্ধু এদের নিজের সন্তান জ্ঞান করতেন। তিনি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেননি। পাকিস্তান সৃষ্টির দ্বিতীয় ব্যক্তি ও প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে সামরিক বাহিনীই হত্যা করেছে। সেনাপ্রধান আইয়ুব খান নির্বাচিত সরকারকে বন্দুকের গুঁতা দিয়ে বের করে দিলেন। নিজেকে ঘোষণা করলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা না হলে জিয়া সেনাপ্রধান হতেন না। ২৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার মাত্র ৯ দিনের ব্যবধানে সেনাপ্রধান হয়েই জিয়া ক্ষমতার প্রকৃত মালিক হলেন। পরবর্তীতে বিচারপতি সায়েমকে বন্দুকের গুঁতায় বঙ্গভবন থেকে বের করে দিয়ে নিজেকে ঘোষণা করলেন প্রেসিডেন্ট। হুবহু পাকিস্তানি মডেলে আইয়ুবের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জিয়ার বঙ্গভবন দখল রূপকথাকেও হার মানায়। লিয়াকত আলী খান হত্যার বিচার হয়নি। কারণ গত ৭০ বছরে পাকিস্তান রাষ্ট্রে সময়, ক্ষমতা ও সমাজের নিয়ন্ত্রণ ছিল সামরিক বাহিনীর হাতে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতা নেয়ার মুহূর্তে সময়, ক্ষমতা ও সমাজ বিচারের পক্ষে ছিল না। রূঢ় হলেও এটি সত্য। পঁচাত্তরের পর যে শিশু জন্ম নিয়েছিল তারা জানত না, বঙ্গবন্ধু নামে কেউ এদেশে জন্মেছিল বা জাতির পিতা ছিল। এই রাষ্ট্রের অন্যতম শক্তিকেন্দ্র সামরিক বাহিনী। তখন উঁচুস্তরে যারা ছিলেন তাদের অনেকেই রক্তাক্ত পঁচাত্তর না হলে এত উপরে উঠতে পারতেন না। ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোকে উত্ত্যক্ত করে বিচার দূরের কথা ক্ষমতায় টিকে থাকাও ছিল কষ্টসাধ্য। মনে রাখতে হবে ১৯৯৬ সালের ৭ম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ১৪৬ আসন। আ স ম রবের মতো এরশাদী মোসাহেবসহ ৫টি ভোট ধার করে সরকার গঠন করতে হয়েছিল। একাত্তরের পরাজিতরা, খুনিরা, ষড়যন্ত্রকারীরা, মৌলবাদ সমাজে ছড়িয়ে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে রাশি রাশি ঘৃণা। শেখ হাসিনার সময়, ক্ষমতা ও সমাজের এ প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা, হিমালয় অতিক্রম করাকেও হার মানায়। গোটা দেশে কানাঘুষা চলছিল মামলা করলে কী হবে, এ বিচার কোন দিন শেষ হবে না। ফারুককে যেদিন গ্রেফতার করা হয় সেদিন অনেকেই অবাক হয়ে বলেছিল শেখ হাসিনা বড় দুঃসাহসী হয়ে উঠেছেন। এসব অশুভ ইঙ্গিত ছিল। ২১ আগস্ট ২০০৪ শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা হামলার এটাই ছিল প্রকৃত কারণ। বেগম জিয়া বিচার প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দিয়েছিলেন হাইকোর্টে। পাকিস্তানি আদর্শ, মৌলবাদ ও মুক্তিযুদ্ধকে চিরতরে পরাস্ত করতে হলে শেখ হাসিনাকে চিরতরে বিদায় করার দরকার ছিল।

আসলে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যাদের মৃত্যুদন্ড বহাল ও কার্যকর হয়েছে তার বাইরে রয়ে গেছে একঝাঁক ষড়যন্ত্রকারী, পটভূমি রচনাকারী, বিদেশের সাথে সংযোগকারী আন্তর্জাতিক চক্র। যেমন ধরুন লিবিয়ার নৈতিক সমর্থন না থাকলে লিবিয়া খুনিদের নিরাপদ আস্তানা হতো না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে আমেরিকার নৈতিক সমর্থন ছিল বলেই আজও খুনি রাশেদ দিব্যি ঘুরে বেড়াতে পারছে। বিশাল এক ক্যানভাসে মঞ্চস্থ হয়েছে পৃথিবীর নৃশংসতম এক হত্যালীলা। ফ্রাঙ্কফুট ওডার থেকে বার্লিন ফেরার পথে এক বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক আলাপচারিতায় বলেছিলেন- তিনি বাংলাদেশিদের ঘৃণা করেন, কারণ শেখ মুজিবের মতো এক অসাধারণ মানুষকে তারা হত্যা করেছে। তিনি বার্লিন বিশ^বিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর। লজ্জায় মাথা নিচু করা ছাড়া আমার উপায় ছিল না।

মহাভারতের হত্যাযজ্ঞ থেকে শুরু করে আলেন্দে হত্যাকান্ড পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা তুলনা করে দেখলাম, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সাথে তুলনীয় কোন জঘন্য ঘটনা মানব ইতিহাসে ঘটেনি। সেসব ষড়যন্ত্রকারী, পটভূমি, রচনাকারী ও বিদেশি শত্রুরা কি ইতিহাসের বিচার এড়িয়ে যাবে দোর্দন্ড প্রতাপে? বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড উদ্ঘাটনে কমিশন বাঙালি জাতিসত্তা, সভ্যতা ও প্রগতির স্বার্থে অপরিহার্য অনিবার্য। মহাত্মা গান্ধীকে হত্যাকারী শিবসেনা সমর্থক আইনজীবী নাথুরাম গডসেকে ফাঁসি দেয়া হলেও তার আদর্শকে মোকাবেলা করা হয়নি। সেদিন নাথুরামের রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিভূমি, ষড়যন্ত্র, পটভূমি চিহ্নিত করা গেলে ভারতবর্ষে শিবসেনা, রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ ও বিজেপি দিল্লি দখল করতে পারতো না। তেমনি ১৫ আগস্ট হত্যাকারীদের রাজনৈতিক আদর্শ, পটভূমি রচনাকারীদের আদর্শ ও মৌলবাদকে চিহ্নিত করা না গেলে ভবিষ্যৎ কখনই ঝুঁকিমুক্ত হবে না। কমিশন গঠনের এটাই সর্বোত্তম সময়। সময় ও স্রোত কাহারো জন্য অপেক্ষা করে না। এরপর কথা উঠবে কমিশনের শেষ পরিণতি কী? কী উদঘাটন করতে চায় কমিশন? রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য কমিশন ব্যবহৃত হবে না তো? প্রশ্নগুলোর যৌক্তিকতা আছে। আবার এসব প্রশ্ন উত্থাপন করে কমিশন গঠনকে ঠেকানোর অপচেষ্টা নেয়া হবে না তো? এসব প্রশ্ন যত বেশি উত্থাপিত হবে, ততই যৌক্তিক পরিণতির দিকে ধাবিত হবে রক্তাক্ত পঁচাত্তরের রহস্য উন্মোচন।

নেলসন ম্যান্ডেলা ক্ষমতা নিয়েই ইতিহাসের সত্য উন্মোচনে গঠন করেছিলেন ট্রুথ কমিশন। হাজার হাজার হৃদয়বিদারক ঘটনা উঠে এলো অবলীলায়। বেশির ভাগ অপরাধ সংঘটিত করেছিল শ্বেতাঙ্গরা

পৃথিবীব্যাপী একটি জনপ্রিয় ধারণার নাম ট্রুথ কমিশন। নেলসন ম্যান্ডেলা ক্ষমতা নিয়েই ইতিহাসের সত্য উন্মোচনে গঠন করেছিলেন ট্রুথ কমিশন। হাজার হাজার হৃদয়বিদারক ঘটনা উঠে এলো অবলীলায়। বেশির ভাগ অপরাধ সংঘটিত করেছিল শ্বেতাঙ্গরা। সত্য স্বীকার করায় অপরাধীরা ক্ষমা পেয়েছিল রাষ্ট্রের কাছে। তবে ক্ষমা পায়নি ভুক্তভোগী আর ইতিহাসের কাছে- এটাই সভ্যতার লাভ।

কমিশন বা ট্রুথ কমিশন যেটাই হোক, রক্তাক্ত পঁচাত্তরের সত্য ঘটনা আসুক দিনের আলোয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্র অনেককে ক্ষমা করার সুযোগ পাবে। প্রদর্শিত ক্ষমায় বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের বিদেহী আত্মাও শান্তি পাবে। লাভবান হবে বাঙালি জাতিসত্তা, সভ্যতা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ। আমার বিশ্বাস মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে পরিপূর্ণভাবে বুঝতে হলে আমাদের আরো বহুপথ অতিক্রম করতে হবে।

[লেখক : আইনজীবী, হাইকোর্ট]

back to top