গৌতম রায়
আমার পাশের শহরের একদা বামপন্থি যুবনেতা, যাকে ঘিরে বামপন্থি পত্রিকায় পাশের শহরটিতে কোন বাম কর্মসূচি হলে, ‘গণ-আন্দোলনের নেতা’ এই বিশেষণ-ই তার নামের আগে বসে, সেই ব্যক্তি চাকরি করতেন স্থানীয় পৌরসভায়। অবসর নেয়ার পরে সেই ‘গণ-আন্দোলনের নেতা’ টিকেই তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত পৌরসভা পুনর্নিয়োগ দিয়েছে। সেই মহান বঙ্গকুলোদ্ভবটি গত লকডাউনের সময় বামপন্থি যুবকর্মীদের দ্বারা পরিচালিত কমিউনিটি কিচেনে গিয়েছিলেন পৌরসভার-ই গাড়ি করে। আর সেই গাড়ির পেছনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের প্রচার কর্মসূচি, ‘দিদিকে বলো’র স্টিকার সাঁটা ছিল। যে স্টিকারে মমতার হাস্যোজ্জ্বল মুখ রয়েছে।
ভূমিস্তরে লড়াইয়ের প্রশ্নে আন্তরিকতা, সততা ঘিরে একটা ভয়ঙ্কর ঘূর্ণাবর্তের ভেতরে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থি আন্দোলনের মূল স্র্রোতের কর্মপদ্ধতি এখন আবর্তিত হচ্ছে। দিশা নির্ধারণের ক্ষেত্রে কি বামপন্থিরা একটা দহের ভেতরে ক্রমশ-ই আবর্তিত হচ্ছেন? একদিকে ভূমিস্তরের একটা বড় অংশ বামপন্থি লেবাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়ালেও জানকবুল লড়াইয়ের প্রশ্নে শাসক তৃণমূলকে ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, তাদের সঙ্গে কি গোপন গভীর সম্পর্ক রেখে শ্যাম আর কুল, দুই-ই বাঁচাতে চাইছে?
বাম আমলে বিরোধীদের যে পরিসর বামেরা দিতেন, সেই পরিসর এখন অনেক সংকুচিত। কিন্তু সেই সংকুচিত পরিসরকে প্রসারিত করবার প্রশ্নে বামপন্থিরা কি কোন রকম বিভ্রান্তির শিকার হয়ে পড়েছেন? কংগ্রেসের সঙ্গে, আইএসএফের সঙ্গে শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্তে’র টগর বোস্টমীর মতো আচরণের রাজনৈতিক সার্থকতা কোথায়? আজ বিধানসভা ভোটের পর, দুই নম্ফর পার্টি চিঠি প্রকাশ করে সিপিআই (এম) আইএসএফের রাজনৈতিক চরিত্র ঘিরে কিছু প্রশ্ন তুলেছে। এই প্রশ্ন তোলবার পেছনে কি বামপন্থি নেতৃত্বের ভেতরের একাংশের মুসলমান বিদ্বেষী মানসিকতা সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে? আইএসএফ যদি সংযুক্ত মোর্চাকে বেশ কিছু আসন দিতে পারত বিধান সভাতে, তাহলে কি ফেজ টুপি আর নূর দাড়ি নিয়ে প্রশ্ন তোলা থেকে বিরত থাকতেন ওই একাংশের বামপন্থিরা?
আর বামপন্থিদের ভেতরে একটা অংশ তাদের ঘিরে নাক সিঁটকোনোটা কে বামপন্থিদের সরকারি অবস্থান বলে দাঁড় করাতে সক্ষম হওয়ার পর কি স্থিতধী, প্রজ্ঞাসম্পন্ন রাজনীতির আবর্ত থেকে একটু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আইএসএফ? সেই এলোমেলোপনার সুযোগ নিয়ে বামপন্থিদের ভেতরে যে ছুপারুস্তম সাম্প্রদায়িকরা আছে, মুসলমান বিদ্বেষীরা আছে, তারা বেশি সক্রিয় হয়ে উঠছে?
কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতার ক্ষেত্রে ভোট রাজনীতিতে ব্যর্থতা ঘিরে বামপন্থিদের ভেতরে যারা এই সমঝোতার খুব পক্ষপাতী ছিলেন, তাদের কি আত্মসমালোচনা করতে শোনা যাচ্ছে? অথচ, দুই নম্বর পার্টি চিঠিতে আইএসএফ সম্পর্কে সংশয়ী হওয়ার পরে ও রক্তদানের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানে প্রথম সারির প্রবীণ বাম নেতা বিমান বসু আরআইএসএফের বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকীকে যে একমঞ্চে দেখা গিয়েছে, তা সাধারণ বামকর্মী, সমর্থকদের ভেতরে কি নতুন করে কোন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে?
বামপন্থিদের নেতৃত্বের একটা বড় অংশ-ই কিন্তু বিগত ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের অভিজ্ঞতার নিরিখে কংগ্রেসের সঙ্গে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে আসন সমঝোতার থেকে বৃহত্তর বাম ঐক্যের পক্ষপাতী ছিলেন। ভূমিস্তরের বামপন্থিদের ও একটা বড় অংশের ও তেমনটাই ছিল অভিমত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বৃহত্তর বাম ঐক্যের পরিবর্তে কংগ্রেসের সঙ্গে বামপন্থিরা অনেক কাঠখড় পুড়িয়েই আসন সমঝোতা করেন।
২০১৬-র সময়কালে বামপন্থিদের সঙ্গে কংগ্রেসের যে রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, সেই রাজনৈতিক সম্পর্কের ধারাবাহিকতা কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরে ছিল না। বিগত ২০১৯ এর লোকসভা ভোটে কংগ্রেস বামেদের সঙ্গে একটা না ঘরকা, না ঘাটকা গোছের সম্পর্ক তৈরি করে। কার্যত কংগ্রেসের সেই মনোভাবের দরুণ রায়গঞ্জের মতো বেশ কিছু আসন অল্পের জন্যে হাতছাড়া হয় বামেদের। দীপা দাশমুন্সী কার্যত রায়গঞ্জ কেন্দ্রে সিপিআই (এম)-এর তৎকালীন সাংসদ মহ. সেলিমকে হারাতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, পরিণতিতে সেখানে জয়লাভ করে বিজেপি।
গত বিধানসভা ভোটের সময়কালে সাম্প্রদায়িক বিজেপিকে রোখার প্রশ্নে সিপিআইএম (লিবারেশন) যে ভূমিকা নিয়েছিল, তা নিয়ে শীর্ষস্তরের কোন বামফ্রন্ট নেতা প্রকাশ্যে কিছু না বললেও, সামাজিক গণমাধ্যমে একদল উগ্র বামফ্রন্ট সমর্থক লিবারেশন নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্যকে ব্যক্তিগতভাবে অসম্মান করতে ছাড়েনি। এই অতি উৎসাহীদের দীপঙ্কর বাবুকে ব্যক্তি আক্রমণ থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট নেতাদের কারও কোন প্রকাশ্য ভূমিকা কিন্তু তখন দেখতে পাওয়া যায়নি।
অতি সম্প্রতি সেই লিবারেশনের নেতাদের সঙ্গে বামফ্রন্ট নেতৃত্বের বৈঠক হয়েছে। ত্রিপুরাতে সিপিআই (এম)-এর ওপর বিজেপির বর্বরোচিত আক্রমণের প্রতিবাদে যৌথ কর্মসূচি সম্পর্কে ও ফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বিবৃতি দিয়েছেন। বৃহত্তর বাম প্রেক্ষিত প্রলম্বিত হওয়াটা পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী রাজনীতির ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বাম রাজনীতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত স্বাস্থ্যের লক্ষণ। তবু প্রশ্ন এটা-ই থেকে যায় যে, বামফ্রন্টভুক্ত বামেরা বন্ধু নির্বাচনের প্রশ্নে কেন দৃঢ় সংকল্প হতে পারছেন না? আজ মনে করছেন কংগ্রেস বন্ধু। তাদের নিয়ে ভোটে লড়ছেন। সেই বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে যখন বিগত লোকসভার ভোটের সময়ে কংগ্রেস এতটুকু দায়িত্ববোধের পরিচয় দেয়নি, সেই কংগ্রেসের-ই সঙ্গে আবার জোট করে লড়লেন বিধানসভাতে।
একই কথা বলতে হয় আইএসএফ সম্পর্কেও। কেনই-বা মাত্র কয়েকমাস আগে এত আবেগাপ্লুত হলেন বামফ্রন্টের বড় শরিক আইএসএফ ঘিরে, আর কেনই-বা ভোটে কেউই ভালো ফল করতে না পারার পরেই সবাই মিলে আসামির কাঠগড়ায় তুলছেন এখন আইএসএফকে? আর কেনই-বা হঠাৎ কয়েক মাসের ভেতরেই একটা বড় অংশের বামপন্থিরা যাকে ‘দালাল’ বলে অভিহিত করলেন, সেই দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের দল নতুন করে বন্ধু হয়ে উঠল? আইএসএফকে কোন যৌথ আন্দোলনে না ডেকে হঠাৎ করে কেন বামফ্রন্ট সিপিআইএমকে (লিবারেশন) নিয়েই বা যৌথ আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করল? কেন কয়েক মাস আগে যে আব্বাস সিদ্দিকী, নওশাদ সিদ্দিকীকে দিয়ে নিদেনপক্ষে একটা প্রচার সভা করাতে বামফ্রন্টের নেতাকর্মীরা অতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন, সেই আব্বাস বা নওশাদকে ভবানীপুরসহ বাকি উপনির্বাচনের প্রচারসহ ত্রিপুরায় গণতন্ত্রের ওপর আঘাতকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের প্রশ্নে ব্রাত্য করে রাখা হচ্ছে?
এই যে রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্ত চলেছে, তার জেরে আইএসএফ যদি মূলধারার রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভিন্নধারার রাজনীতির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে, তার দায় কে নেবে? বামফ্রন্ট বা ফ্রন্টভুক্ত দলগুলো তো বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের মতো ব্যক্তি বিশেষের ইচ্ছেতে কোন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেন না। কংগ্রেস বা আইএসএফের প্রশ্নে ও যৌথ সিদ্ধান্তের ভেতর দিয়েই তারা এসেছিলেন। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে যদি প্রগতিশীল রাজনীতির প্রেক্ষিত থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নেয় আইএসএফ, তাহলে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী রাজনীতির ক্ষেত্রে কি তা আদৌ ইতিবাচক হবে?
আইএসএফের একমাত্র বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকী কিছুদিন আগে যৌথ কর্মসূচি তে বামফ্রন্ট না ডাকায় প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। সম্প্রতি উপনির্বাচনের প্রচার থেকে সরে থাকার কথা আইএসএফ বলেছে। বামেরা না ডাকলে তারা প্রচারে যাবেন না উপনির্বাচনে- এমনটাই আইএসএফের সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত এবং বামফ্রন্টের, বিশেষ করে তাদের বড়ো শরিক সিপিআই (এম)-এর এ সম্পর্কে নীরবতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় ফরোয়ার্ড ব্লকের মতো চরম কমিউনিস্ট বিরোধী দলের সঙ্গে ও মানিয়ে গুনিয়ে দীর্ঘকাল সরকার চালানোর ক্ষেত্রে প্রয়াত জ্যোতি বসুর অসামান্য কৃতিত্বের কথা। জ্যোতিবাবুর মতো সবার সঙ্গে মানিয়ে, সবাইকে সমান মর্যাদা দিয়ে সঙ্গে নিয়ে চলবার মতো মানসিকতা যদি পরবর্তীতে প্রবাহিত হতো, তাহলে হয়তো সার্বিক রাজনীতির ক্ষেত্রে আজকে এই দুরবস্থায় বামপন্থিদের পড়তে হতো না।
যে মানসিক দ্বন্দ্বের ভেতরে ঠিক এই মুহূর্তে আইএসএফ রয়েছে, সেখান থেকে যদি ওদের এখন-ই উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে বের করে আনতে না পারা যায় তাহলে যে ধর্ম বা জাতিসত্তাভিত্তিক অন্য ধারার কোন নেতিবাচক রাজনীতির ধারা প্রবাহের নতুন করে জন্ম হবে না- এই কথাটা কে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারে? বিগত বিধানসভা ভোটে আইএসএফ প্রার্থী মইদুল ইসলামের প্রতি পুলিশি হেনস্থার অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ এবং শুভেন্দু অধিকারীর যে অতি উৎসাহ, তা কি কোন সিঁদুরে মেঘের আভাস নয়? আইএসএফ নেতা মইদুল যেভাবে শুভেন্দু অধিকারীর তার প্রতি মনিটারিং ঘিরে গদগদ, তা কি কোন বিপদের আশঙ্কাকে উসকে দিচ্ছে না? ভুলে গেলে চলবে না যে, ’৪৭-এর দেশভাগের অব্যবহিত আগে জামায়াতে ইসলামের আমীর মওদুদী, ‘জামায়াতে ইসলাম কি দাওয়াত’ নামে একটি পুস্তিকা লিখে হিন্দু আর মুসলিম মৌলবাদের অভিন্ন শ্রেণীস্বার্থের কথা তার নিজের অজান্তেই কবুল করে ফেলেছিলেন। ভারতে হিন্দু এবং মুসলমান- উভয়ের ভেতরেই কিন্তু মওদুদী, সাভারকর, গোলওয়ালকরের ভুতেরা আজ ও সমানভাবে সক্রিয়।
ব্যক্তিটি খুব পাজি, কারণ; আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষা করে... এই প্রবাদবাক্যের অভিশ্রুতি যেন দেখতে পাচ্ছি আইএসএফকে ঘিরে। তাদের কান ভাঙানোর লোকের অভাব নেই। শুনতে পাচ্ছি, দায়বদ্ধতাহীন নানা বর্ণের বাম হিসেবে নিজেদের দাবি করা লোকজন তাদের পাশে ক্রমশ নাকি ভিড় জমাচ্ছেন। এদের লক্ষ্য বামফ্রন্টের সঙ্গে আইএসএফের একটা দূরত্ব তৈরি করা। এদের কারও কারও সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সংযোগের নানা রোমহর্ষক গল্পও শোনা যায়। সেসব গল্পের সত্য- অসত্য যাই থাকুক না কেন, একটা বিষয় পরিষ্কার যে, আইএএফের সঙ্গে বন্ধুর বেশে শত্রুর ভূমিকা পালনে এদের জুড়ি নেই। এদের মূল লক্ষ্য হলো, পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে বামপন্থিদের সবরকমভাবে শক্তি হ্রাস করানো। তাই বামফ্রন্টের ভেতরে তৈরি হওয়া সংশয়ের তিলকে তাল করে উপস্থাপিত করে আইএসএফকে একটা সত্তা রাজনীতির কৌনিক বিন্দুতে ঠেলে দেয়ার সব রকমের ষড়যন্ত্র চলছে। সেই ষড়যন্ত্রে যে সার্বিকভাবে বামপন্থিদের ভেতরে চোরাগোপ্তাভাবে থাকা মুসলমান বিদ্বেষীরা ভালোভাবেই আছেন-তা আলাদা করে বলে দেয়ার কোন আর প্রয়োজন নেই।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]
গৌতম রায়
শুক্রবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১
আমার পাশের শহরের একদা বামপন্থি যুবনেতা, যাকে ঘিরে বামপন্থি পত্রিকায় পাশের শহরটিতে কোন বাম কর্মসূচি হলে, ‘গণ-আন্দোলনের নেতা’ এই বিশেষণ-ই তার নামের আগে বসে, সেই ব্যক্তি চাকরি করতেন স্থানীয় পৌরসভায়। অবসর নেয়ার পরে সেই ‘গণ-আন্দোলনের নেতা’ টিকেই তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত পৌরসভা পুনর্নিয়োগ দিয়েছে। সেই মহান বঙ্গকুলোদ্ভবটি গত লকডাউনের সময় বামপন্থি যুবকর্মীদের দ্বারা পরিচালিত কমিউনিটি কিচেনে গিয়েছিলেন পৌরসভার-ই গাড়ি করে। আর সেই গাড়ির পেছনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের প্রচার কর্মসূচি, ‘দিদিকে বলো’র স্টিকার সাঁটা ছিল। যে স্টিকারে মমতার হাস্যোজ্জ্বল মুখ রয়েছে।
ভূমিস্তরে লড়াইয়ের প্রশ্নে আন্তরিকতা, সততা ঘিরে একটা ভয়ঙ্কর ঘূর্ণাবর্তের ভেতরে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থি আন্দোলনের মূল স্র্রোতের কর্মপদ্ধতি এখন আবর্তিত হচ্ছে। দিশা নির্ধারণের ক্ষেত্রে কি বামপন্থিরা একটা দহের ভেতরে ক্রমশ-ই আবর্তিত হচ্ছেন? একদিকে ভূমিস্তরের একটা বড় অংশ বামপন্থি লেবাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়ালেও জানকবুল লড়াইয়ের প্রশ্নে শাসক তৃণমূলকে ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, তাদের সঙ্গে কি গোপন গভীর সম্পর্ক রেখে শ্যাম আর কুল, দুই-ই বাঁচাতে চাইছে?
বাম আমলে বিরোধীদের যে পরিসর বামেরা দিতেন, সেই পরিসর এখন অনেক সংকুচিত। কিন্তু সেই সংকুচিত পরিসরকে প্রসারিত করবার প্রশ্নে বামপন্থিরা কি কোন রকম বিভ্রান্তির শিকার হয়ে পড়েছেন? কংগ্রেসের সঙ্গে, আইএসএফের সঙ্গে শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্তে’র টগর বোস্টমীর মতো আচরণের রাজনৈতিক সার্থকতা কোথায়? আজ বিধানসভা ভোটের পর, দুই নম্ফর পার্টি চিঠি প্রকাশ করে সিপিআই (এম) আইএসএফের রাজনৈতিক চরিত্র ঘিরে কিছু প্রশ্ন তুলেছে। এই প্রশ্ন তোলবার পেছনে কি বামপন্থি নেতৃত্বের ভেতরের একাংশের মুসলমান বিদ্বেষী মানসিকতা সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে? আইএসএফ যদি সংযুক্ত মোর্চাকে বেশ কিছু আসন দিতে পারত বিধান সভাতে, তাহলে কি ফেজ টুপি আর নূর দাড়ি নিয়ে প্রশ্ন তোলা থেকে বিরত থাকতেন ওই একাংশের বামপন্থিরা?
আর বামপন্থিদের ভেতরে একটা অংশ তাদের ঘিরে নাক সিঁটকোনোটা কে বামপন্থিদের সরকারি অবস্থান বলে দাঁড় করাতে সক্ষম হওয়ার পর কি স্থিতধী, প্রজ্ঞাসম্পন্ন রাজনীতির আবর্ত থেকে একটু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আইএসএফ? সেই এলোমেলোপনার সুযোগ নিয়ে বামপন্থিদের ভেতরে যে ছুপারুস্তম সাম্প্রদায়িকরা আছে, মুসলমান বিদ্বেষীরা আছে, তারা বেশি সক্রিয় হয়ে উঠছে?
কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতার ক্ষেত্রে ভোট রাজনীতিতে ব্যর্থতা ঘিরে বামপন্থিদের ভেতরে যারা এই সমঝোতার খুব পক্ষপাতী ছিলেন, তাদের কি আত্মসমালোচনা করতে শোনা যাচ্ছে? অথচ, দুই নম্বর পার্টি চিঠিতে আইএসএফ সম্পর্কে সংশয়ী হওয়ার পরে ও রক্তদানের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানে প্রথম সারির প্রবীণ বাম নেতা বিমান বসু আরআইএসএফের বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকীকে যে একমঞ্চে দেখা গিয়েছে, তা সাধারণ বামকর্মী, সমর্থকদের ভেতরে কি নতুন করে কোন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে?
বামপন্থিদের নেতৃত্বের একটা বড় অংশ-ই কিন্তু বিগত ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের অভিজ্ঞতার নিরিখে কংগ্রেসের সঙ্গে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে আসন সমঝোতার থেকে বৃহত্তর বাম ঐক্যের পক্ষপাতী ছিলেন। ভূমিস্তরের বামপন্থিদের ও একটা বড় অংশের ও তেমনটাই ছিল অভিমত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বৃহত্তর বাম ঐক্যের পরিবর্তে কংগ্রেসের সঙ্গে বামপন্থিরা অনেক কাঠখড় পুড়িয়েই আসন সমঝোতা করেন।
২০১৬-র সময়কালে বামপন্থিদের সঙ্গে কংগ্রেসের যে রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, সেই রাজনৈতিক সম্পর্কের ধারাবাহিকতা কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরে ছিল না। বিগত ২০১৯ এর লোকসভা ভোটে কংগ্রেস বামেদের সঙ্গে একটা না ঘরকা, না ঘাটকা গোছের সম্পর্ক তৈরি করে। কার্যত কংগ্রেসের সেই মনোভাবের দরুণ রায়গঞ্জের মতো বেশ কিছু আসন অল্পের জন্যে হাতছাড়া হয় বামেদের। দীপা দাশমুন্সী কার্যত রায়গঞ্জ কেন্দ্রে সিপিআই (এম)-এর তৎকালীন সাংসদ মহ. সেলিমকে হারাতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, পরিণতিতে সেখানে জয়লাভ করে বিজেপি।
গত বিধানসভা ভোটের সময়কালে সাম্প্রদায়িক বিজেপিকে রোখার প্রশ্নে সিপিআইএম (লিবারেশন) যে ভূমিকা নিয়েছিল, তা নিয়ে শীর্ষস্তরের কোন বামফ্রন্ট নেতা প্রকাশ্যে কিছু না বললেও, সামাজিক গণমাধ্যমে একদল উগ্র বামফ্রন্ট সমর্থক লিবারেশন নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্যকে ব্যক্তিগতভাবে অসম্মান করতে ছাড়েনি। এই অতি উৎসাহীদের দীপঙ্কর বাবুকে ব্যক্তি আক্রমণ থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট নেতাদের কারও কোন প্রকাশ্য ভূমিকা কিন্তু তখন দেখতে পাওয়া যায়নি।
অতি সম্প্রতি সেই লিবারেশনের নেতাদের সঙ্গে বামফ্রন্ট নেতৃত্বের বৈঠক হয়েছে। ত্রিপুরাতে সিপিআই (এম)-এর ওপর বিজেপির বর্বরোচিত আক্রমণের প্রতিবাদে যৌথ কর্মসূচি সম্পর্কে ও ফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বিবৃতি দিয়েছেন। বৃহত্তর বাম প্রেক্ষিত প্রলম্বিত হওয়াটা পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী রাজনীতির ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বাম রাজনীতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত স্বাস্থ্যের লক্ষণ। তবু প্রশ্ন এটা-ই থেকে যায় যে, বামফ্রন্টভুক্ত বামেরা বন্ধু নির্বাচনের প্রশ্নে কেন দৃঢ় সংকল্প হতে পারছেন না? আজ মনে করছেন কংগ্রেস বন্ধু। তাদের নিয়ে ভোটে লড়ছেন। সেই বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে যখন বিগত লোকসভার ভোটের সময়ে কংগ্রেস এতটুকু দায়িত্ববোধের পরিচয় দেয়নি, সেই কংগ্রেসের-ই সঙ্গে আবার জোট করে লড়লেন বিধানসভাতে।
একই কথা বলতে হয় আইএসএফ সম্পর্কেও। কেনই-বা মাত্র কয়েকমাস আগে এত আবেগাপ্লুত হলেন বামফ্রন্টের বড় শরিক আইএসএফ ঘিরে, আর কেনই-বা ভোটে কেউই ভালো ফল করতে না পারার পরেই সবাই মিলে আসামির কাঠগড়ায় তুলছেন এখন আইএসএফকে? আর কেনই-বা হঠাৎ কয়েক মাসের ভেতরেই একটা বড় অংশের বামপন্থিরা যাকে ‘দালাল’ বলে অভিহিত করলেন, সেই দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের দল নতুন করে বন্ধু হয়ে উঠল? আইএসএফকে কোন যৌথ আন্দোলনে না ডেকে হঠাৎ করে কেন বামফ্রন্ট সিপিআইএমকে (লিবারেশন) নিয়েই বা যৌথ আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করল? কেন কয়েক মাস আগে যে আব্বাস সিদ্দিকী, নওশাদ সিদ্দিকীকে দিয়ে নিদেনপক্ষে একটা প্রচার সভা করাতে বামফ্রন্টের নেতাকর্মীরা অতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন, সেই আব্বাস বা নওশাদকে ভবানীপুরসহ বাকি উপনির্বাচনের প্রচারসহ ত্রিপুরায় গণতন্ত্রের ওপর আঘাতকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের প্রশ্নে ব্রাত্য করে রাখা হচ্ছে?
এই যে রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্ত চলেছে, তার জেরে আইএসএফ যদি মূলধারার রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভিন্নধারার রাজনীতির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে, তার দায় কে নেবে? বামফ্রন্ট বা ফ্রন্টভুক্ত দলগুলো তো বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের মতো ব্যক্তি বিশেষের ইচ্ছেতে কোন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেন না। কংগ্রেস বা আইএসএফের প্রশ্নে ও যৌথ সিদ্ধান্তের ভেতর দিয়েই তারা এসেছিলেন। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে যদি প্রগতিশীল রাজনীতির প্রেক্ষিত থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নেয় আইএসএফ, তাহলে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী রাজনীতির ক্ষেত্রে কি তা আদৌ ইতিবাচক হবে?
আইএসএফের একমাত্র বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকী কিছুদিন আগে যৌথ কর্মসূচি তে বামফ্রন্ট না ডাকায় প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। সম্প্রতি উপনির্বাচনের প্রচার থেকে সরে থাকার কথা আইএসএফ বলেছে। বামেরা না ডাকলে তারা প্রচারে যাবেন না উপনির্বাচনে- এমনটাই আইএসএফের সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত এবং বামফ্রন্টের, বিশেষ করে তাদের বড়ো শরিক সিপিআই (এম)-এর এ সম্পর্কে নীরবতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় ফরোয়ার্ড ব্লকের মতো চরম কমিউনিস্ট বিরোধী দলের সঙ্গে ও মানিয়ে গুনিয়ে দীর্ঘকাল সরকার চালানোর ক্ষেত্রে প্রয়াত জ্যোতি বসুর অসামান্য কৃতিত্বের কথা। জ্যোতিবাবুর মতো সবার সঙ্গে মানিয়ে, সবাইকে সমান মর্যাদা দিয়ে সঙ্গে নিয়ে চলবার মতো মানসিকতা যদি পরবর্তীতে প্রবাহিত হতো, তাহলে হয়তো সার্বিক রাজনীতির ক্ষেত্রে আজকে এই দুরবস্থায় বামপন্থিদের পড়তে হতো না।
যে মানসিক দ্বন্দ্বের ভেতরে ঠিক এই মুহূর্তে আইএসএফ রয়েছে, সেখান থেকে যদি ওদের এখন-ই উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে বের করে আনতে না পারা যায় তাহলে যে ধর্ম বা জাতিসত্তাভিত্তিক অন্য ধারার কোন নেতিবাচক রাজনীতির ধারা প্রবাহের নতুন করে জন্ম হবে না- এই কথাটা কে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারে? বিগত বিধানসভা ভোটে আইএসএফ প্রার্থী মইদুল ইসলামের প্রতি পুলিশি হেনস্থার অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ এবং শুভেন্দু অধিকারীর যে অতি উৎসাহ, তা কি কোন সিঁদুরে মেঘের আভাস নয়? আইএসএফ নেতা মইদুল যেভাবে শুভেন্দু অধিকারীর তার প্রতি মনিটারিং ঘিরে গদগদ, তা কি কোন বিপদের আশঙ্কাকে উসকে দিচ্ছে না? ভুলে গেলে চলবে না যে, ’৪৭-এর দেশভাগের অব্যবহিত আগে জামায়াতে ইসলামের আমীর মওদুদী, ‘জামায়াতে ইসলাম কি দাওয়াত’ নামে একটি পুস্তিকা লিখে হিন্দু আর মুসলিম মৌলবাদের অভিন্ন শ্রেণীস্বার্থের কথা তার নিজের অজান্তেই কবুল করে ফেলেছিলেন। ভারতে হিন্দু এবং মুসলমান- উভয়ের ভেতরেই কিন্তু মওদুদী, সাভারকর, গোলওয়ালকরের ভুতেরা আজ ও সমানভাবে সক্রিয়।
ব্যক্তিটি খুব পাজি, কারণ; আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষা করে... এই প্রবাদবাক্যের অভিশ্রুতি যেন দেখতে পাচ্ছি আইএসএফকে ঘিরে। তাদের কান ভাঙানোর লোকের অভাব নেই। শুনতে পাচ্ছি, দায়বদ্ধতাহীন নানা বর্ণের বাম হিসেবে নিজেদের দাবি করা লোকজন তাদের পাশে ক্রমশ নাকি ভিড় জমাচ্ছেন। এদের লক্ষ্য বামফ্রন্টের সঙ্গে আইএসএফের একটা দূরত্ব তৈরি করা। এদের কারও কারও সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সংযোগের নানা রোমহর্ষক গল্পও শোনা যায়। সেসব গল্পের সত্য- অসত্য যাই থাকুক না কেন, একটা বিষয় পরিষ্কার যে, আইএএফের সঙ্গে বন্ধুর বেশে শত্রুর ভূমিকা পালনে এদের জুড়ি নেই। এদের মূল লক্ষ্য হলো, পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে বামপন্থিদের সবরকমভাবে শক্তি হ্রাস করানো। তাই বামফ্রন্টের ভেতরে তৈরি হওয়া সংশয়ের তিলকে তাল করে উপস্থাপিত করে আইএসএফকে একটা সত্তা রাজনীতির কৌনিক বিন্দুতে ঠেলে দেয়ার সব রকমের ষড়যন্ত্র চলছে। সেই ষড়যন্ত্রে যে সার্বিকভাবে বামপন্থিদের ভেতরে চোরাগোপ্তাভাবে থাকা মুসলমান বিদ্বেষীরা ভালোভাবেই আছেন-তা আলাদা করে বলে দেয়ার কোন আর প্রয়োজন নেই।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]