জিয়াউদ্দীন আহমেদ
যুক্তরাষ্ট্রের কাবুল ত্যাগের এক সপ্তাহের মাথায় সরকার গঠন করল তালেবান। নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দ; তিনি তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি দুজন- মোল্লা আব্দুল গণি বারাদার এবং আব্দুল সালাম হানাফি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রধান সিরাজুদ্দিন হাক্কানি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোল্লা ইয়াকুব। মোল্লা ইয়াকুব তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের জ্যেষ্ঠ সন্তান। কোন মহিলাকে তাদের মন্ত্রিপরিষদে এখনও নেয়া হয়নি; এমন কি মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ও বাদ দেয়া হয়েছে। মহিলা মন্ত্রী না নেয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তালেবানদের স্পষ্ট উত্তর ছিল, নারীদের কাজ সন্তান জন্ম দেয়া, মন্ত্রী হওয়া নয়। সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখে তালেবান সরকারের শপথ নেয়ার তারিখ নির্ধারিত ছিল, এই তারিখে আল কায়েদার বিমান হামলায় আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়েছিল। নতুন সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যে ছয়টি দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল সেই দেশগুলো হচ্ছে পাকিস্তান, চীন, রাশিয়া, ইরান, কাতার ও তুরস্ক।
প্রধানমন্ত্রী মোল্লা হাসান আখুন্দ একজন কট্টরপন্থি লোক। ২০০১ সনে তার তত্ত্বাবধানেই আফগানিস্তানের বামিয়ান প্রদেশের বিখ্যাত বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করা হয়; সেজন্য জাতিসংঘ এখনও তাকে সন্ত্রাসী তালিকায় রেখেছে। প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি আব্দুল সালাম হানাফিও জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় রয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিরাজুদ্দিন হাক্কানি যুক্তরাষ্ট্রের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী এবং তার মাথার মূল্য ঘোষণা করা হয়েছিল ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘের কালো তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের মন্ত্রিপরিষদে অন্তর্ভুক্ত করে তালেবানেরা জাতিসংঘ ও আমেরিকার প্রতি কঠোর মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছে। তবে জাতিসংঘ ও আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে এই সব তালিকা কোন বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে হয় না। ভিয়েতনামেও আমেরিকা প্রায় ২০ বছর ধরে বোমা ফেলেছে, কিন্তু এখন ভিয়েতনামের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক অনেক গভীর।
আমেরিকা ও ইউরোপ তালেবানদের শত্রু মনে করে না, তাদের নিয়ে তাদের ভয়ও নেই; কারণ তাদের কার্যক্রম শুধু আফগানিস্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ওসামা বিন লাদেনকে আমেরিকার কথামত তাদের হাতে তুলে দিলে আমেরিকা আফগানিস্তান আক্রমণ করত না, কারণ তালেবানদের তারাই ক্ষমতায় বসিয়েছিল। তারা ভয় করছে আইএস এবং আল কায়েদা গোষ্ঠীকে। আমেরিকা এবং পশ্চিমা বিশ্বের আশঙ্কা, তালেবানদের প্রত্যাবর্তনের পর আইএস, আল কায়েদাসহ অন্য জিহাদী গ্রুপ আফগানিস্তানে আশ্রয় প্রশ্রয় পাবে, এই গ্রুপগুলোর বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক রয়েছে, এই গ্রুপগুলো আমেরিকা এবং ইউরোপে আত্মঘাতী হামলা চালায়। এই জাতীয় উগ্রপন্থিদের আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করতে দেয়া হবে না মর্মে তালেবানেরা চুক্তিবদ্ধ হলেও তার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে বলে আমেরিকাও বিশ্বাস করে না। কারণ পর্বত আর মরুভূমির দেশ আফগানিস্তানে অসংখ্য গোত্র, কেউ কাউকে মানে না, নিজেদের এলাকায় নিজেরাই অধিপতি। কোন এলাকার কোন অধিপতি আইএস গ্রুপকে আশ্রয় দিলে তালেবান সরকারের কিছুই করার থাকবে না। ইতোমধ্যে কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে আত্মঘাতী বোমা ফাটিয়ে আইএস তাদের শক্তিশালী অস্তিত্বের প্রমাণ করে দিয়েছে। তবে আইএস এবং আল কায়েদা তালেবানদের জয়ে নিন্দা জানিয়েছে, কারণ তালেবানদের এই জয় জিহাদের মাধ্যমে আসেনি, এসেছে আমেরিকার সঙ্গে চুক্তি ও সমঝাতার মাধ্যমে।
তালেবানেরা পাকিস্তানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে চীন ও পাকিস্তান যৌথভাবে কাজ করবে। তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণেও পাকিস্তান সরকারের ভূমিকা থাকবে বলে ভারত আশঙ্কা করছে। কাতারের দোহায় আমেরিকার সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনে পাকিস্তান তালেবানদের শলাপরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেছে। তালেবানেরা পাকিস্তানকে তাদের সেকেন্ড হোম মনে করে থাকে। পাকিস্তান বিশ্বাস করে, তালেবানেরা ক্ষমতায় আসায় পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আফগানিস্তানের সীমান্ত শহরগুলোর মাধ্যমে আর ভারতের সহায়তা পাবে না। পাকিস্তান আরও মনে করে, কাশ্মীরের মুসলিম সম্প্রদায় তালেবানদের সহায়তায় আরও উজ্জীবিত হবে, কারণ অতীতেও আফগানিস্তান থেকে মুজাহিদীনরা এসে কাশ্মীরে তৎপর ছিল। ভারতও বিভিন্নভাবে তালেবানদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে, কারণ আফগানিস্তানে ভারতের প্রায় ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ রয়েছে। তবে ভারত যতই চেষ্টা করুক, তালেবান সরকারের ওপর পাকিস্তানের প্রভাব-প্রতিপত্তি শিগগিরই কমবে না।
ইসলামিক আমিরাত অফ আফগানিস্তানের তালেবান সরকার গোটা বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার ঘোষণা দিয়েছে; তবে তাদের প্রথম পছন্দের দেশ চীন। পাকিস্তানের মাধ্যমে বেশ কিছুদিন ধরেই চীন তালেবানের সঙ্গে তলে তলে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছে। ধর্মহীন নাস্তিক দেশ চীনের সঙ্গে ইসলামিক আমিরাত অফ আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরি করার ব্যাপারে আগ্রহের প্রধান কারণ, চীনের কাছে বিনিয়োগযোগ্য প্রচুর অলস অর্থ সঞ্চিত আছে। আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদের ওপর চীনেরও লোভ থাকা স্বাভাবিক, এর বাইরে রয়েছে পণ্য রপ্তানির একচেটিয়া সুযোগ। তবে এই মুহূর্তে ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিলের চেয়ে আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা চীনের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পাকিস্তান এবং ইরানে তারা শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে এবং আরও করতে যাচ্ছে, আফগানিস্তানেও করবে। আফগানিস্তান স্থিতিশীল না হলে পাকিস্তান ও ইরানে চীনের বিনিয়োগে ঝুঁকি বাড়বে। আফগানিস্তান থেকে ভারতকে উচ্ছেদ করার সুযোগও চীন নষ্ট করবে না। তবে চীনও পশ্চিমা বিশ্বের মতো তালেবানদের আমলে সন্ত্রাসী আক্রমণের ভয় করছে; কারণ আফগানিস্তানের সঙ্গে চীনের যে ৯০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে তার ঠিক ওপাশেই রয়েছে উইঘুর মুসলিম অধ্যুষিত চীনা প্রদেশ শিনজিয়াং। তবে উইঘুর মুসলমানদের প্রশ্রয় দেয়া হবে না মর্মে ইত্যবসরে তালেবানেরা চীনকে আশ্বস্ত করেছে।
তালেবানেরা ইতোমধ্যে মস্কোর সমর্থন আদায় করে নিয়েছে। আমেরিকার বিদায়ে রাশিয়া স্বস্তিবোধ করছে। তবে তালেবানের আগমনে রাশিয়াও জেহাদ রপ্তানির ভয়ে আছে। আফগানিস্তান ও রাশিয়া উভয়ের প্রতিবেশী দেশ তাজাকিনিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কেমেনিস্তান প্রভৃতি দেশ মুসলিম অধ্যুষিত, এই সব দেশের জেহাদিরা তালেবানদের আশ্রয়-প্রশ্রয় পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই জেহাদ ঠেকাতে রাশিয়া তালেবান সরকারের সঙ্গে একটা গাঢ় সম্পর্ক রাখতে চাইবে। শুধু নাস্তিক দেশ চীন আর রাশিয়া নয়, কট্টর সুন্নী ওয়াহাবিপন্থি তালেবান নেতারা শিয়া ইরানের সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তোলার পদক্ষেপ নিয়েছে। অবশ্য আমেরিকাকে শায়েস্তা করতে বহু পূর্ব থেকেই ইরান তালেবানদের সহায়তা করে আসছিল, তালেবানেরাও প্রতিদান হিসেবে সংখ্যালঘু শিয়া হাজেরাদের ওপর আগের মতো আর নির্যাতন করেনি। তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য হিসেবে এতদিন তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তবুও তালেবান সরকার শপথ অনুষ্ঠানে তুরস্ককে দাওয়াত দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে রাশিয়া, চীন, ইরান একমত পোষণ করছে, তুরস্কও মাঝে মাঝে তাদের সঙ্গে সুর মেলাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তালেবানেরা অনেকদূর এগিয়ে গেছে।
রাশিয়া, চীন, ইরান, পাকিস্তান, তুরস্ক প্রভৃতি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের পর তালেবান সরকার পশ্চিমাদের রোষানলে পড়তে পারে। আন্তর্জাতিক কূটনীতি সরলরেখায় চলে না, বিভিন্ন জটিল সম্পর্কের সহজ সমাধান নেই। কিউবায় চটের বস্তা বিক্রি করার কারণে আমেরিকা সমুদ্রের মাঝপথ থেকে বাংলাদেশের জন্য প্রেরিত গমের জাহাজ ফেরত নিয়ে যায়, চুয়াত্তরে দুর্ভিক্ষ হয়। আমেরিকা ইতোমধ্যে আফগানিস্তানের সাড়ে ৯ হাজার কোটি ডলার আটক করেছে; নগদ টাকার অভাবে তালেবান সরকার জরুরি পণ্যও আমদানি করতে পারছে না। তালেবানদের আমেরিকার প্রতি নমনীয় করাই এর মূল উদ্দেশ্য হতে পারে। আমেরিকা নিজের স্বার্থ রক্ষায় পানামার শাসনকর্তা ম্যানুয়েল নরিয়েগাকে ধরে নিয়ে জেলখানায় পুরেছিল। অন্যদিকে গুজরাটে দাঙ্গার পর আমেরিকার কোর্ট থেকে সমন জারী করা ছাড়াও নরেন্দ্র মোদিকে ভিসা দেয়নি ৯ বছর; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মোদি হয়ে যান আমেরিকার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু। আমেরিকা এবং ইউরোপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ালে তালেবানদের বিরুদ্ধে আইএসও আত্মঘাতী বোমা ফাটতে পারে; কারণ তালেবান সরকার, আইএস এবং আল কায়েদার কঠোর নজরদারির বাইরে নয়। ইতোমধ্যে গঠিত সরকারের মন্ত্রী, নেতাদের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়ে গিয়েছে। দেশটিতে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তালেবানদের আগের মতো উগ্র হলে চলবে না, কূটনীতির খেলায় কৌশলী হতে হবে।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]
ahmedzeauddin0@gmail.com
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
শনিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১
যুক্তরাষ্ট্রের কাবুল ত্যাগের এক সপ্তাহের মাথায় সরকার গঠন করল তালেবান। নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দ; তিনি তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি দুজন- মোল্লা আব্দুল গণি বারাদার এবং আব্দুল সালাম হানাফি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রধান সিরাজুদ্দিন হাক্কানি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোল্লা ইয়াকুব। মোল্লা ইয়াকুব তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের জ্যেষ্ঠ সন্তান। কোন মহিলাকে তাদের মন্ত্রিপরিষদে এখনও নেয়া হয়নি; এমন কি মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ও বাদ দেয়া হয়েছে। মহিলা মন্ত্রী না নেয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তালেবানদের স্পষ্ট উত্তর ছিল, নারীদের কাজ সন্তান জন্ম দেয়া, মন্ত্রী হওয়া নয়। সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখে তালেবান সরকারের শপথ নেয়ার তারিখ নির্ধারিত ছিল, এই তারিখে আল কায়েদার বিমান হামলায় আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়েছিল। নতুন সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যে ছয়টি দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল সেই দেশগুলো হচ্ছে পাকিস্তান, চীন, রাশিয়া, ইরান, কাতার ও তুরস্ক।
প্রধানমন্ত্রী মোল্লা হাসান আখুন্দ একজন কট্টরপন্থি লোক। ২০০১ সনে তার তত্ত্বাবধানেই আফগানিস্তানের বামিয়ান প্রদেশের বিখ্যাত বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করা হয়; সেজন্য জাতিসংঘ এখনও তাকে সন্ত্রাসী তালিকায় রেখেছে। প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি আব্দুল সালাম হানাফিও জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় রয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিরাজুদ্দিন হাক্কানি যুক্তরাষ্ট্রের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী এবং তার মাথার মূল্য ঘোষণা করা হয়েছিল ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘের কালো তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের মন্ত্রিপরিষদে অন্তর্ভুক্ত করে তালেবানেরা জাতিসংঘ ও আমেরিকার প্রতি কঠোর মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছে। তবে জাতিসংঘ ও আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে এই সব তালিকা কোন বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে হয় না। ভিয়েতনামেও আমেরিকা প্রায় ২০ বছর ধরে বোমা ফেলেছে, কিন্তু এখন ভিয়েতনামের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক অনেক গভীর।
আমেরিকা ও ইউরোপ তালেবানদের শত্রু মনে করে না, তাদের নিয়ে তাদের ভয়ও নেই; কারণ তাদের কার্যক্রম শুধু আফগানিস্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ওসামা বিন লাদেনকে আমেরিকার কথামত তাদের হাতে তুলে দিলে আমেরিকা আফগানিস্তান আক্রমণ করত না, কারণ তালেবানদের তারাই ক্ষমতায় বসিয়েছিল। তারা ভয় করছে আইএস এবং আল কায়েদা গোষ্ঠীকে। আমেরিকা এবং পশ্চিমা বিশ্বের আশঙ্কা, তালেবানদের প্রত্যাবর্তনের পর আইএস, আল কায়েদাসহ অন্য জিহাদী গ্রুপ আফগানিস্তানে আশ্রয় প্রশ্রয় পাবে, এই গ্রুপগুলোর বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক রয়েছে, এই গ্রুপগুলো আমেরিকা এবং ইউরোপে আত্মঘাতী হামলা চালায়। এই জাতীয় উগ্রপন্থিদের আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করতে দেয়া হবে না মর্মে তালেবানেরা চুক্তিবদ্ধ হলেও তার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে বলে আমেরিকাও বিশ্বাস করে না। কারণ পর্বত আর মরুভূমির দেশ আফগানিস্তানে অসংখ্য গোত্র, কেউ কাউকে মানে না, নিজেদের এলাকায় নিজেরাই অধিপতি। কোন এলাকার কোন অধিপতি আইএস গ্রুপকে আশ্রয় দিলে তালেবান সরকারের কিছুই করার থাকবে না। ইতোমধ্যে কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে আত্মঘাতী বোমা ফাটিয়ে আইএস তাদের শক্তিশালী অস্তিত্বের প্রমাণ করে দিয়েছে। তবে আইএস এবং আল কায়েদা তালেবানদের জয়ে নিন্দা জানিয়েছে, কারণ তালেবানদের এই জয় জিহাদের মাধ্যমে আসেনি, এসেছে আমেরিকার সঙ্গে চুক্তি ও সমঝাতার মাধ্যমে।
তালেবানেরা পাকিস্তানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে চীন ও পাকিস্তান যৌথভাবে কাজ করবে। তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণেও পাকিস্তান সরকারের ভূমিকা থাকবে বলে ভারত আশঙ্কা করছে। কাতারের দোহায় আমেরিকার সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনে পাকিস্তান তালেবানদের শলাপরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেছে। তালেবানেরা পাকিস্তানকে তাদের সেকেন্ড হোম মনে করে থাকে। পাকিস্তান বিশ্বাস করে, তালেবানেরা ক্ষমতায় আসায় পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আফগানিস্তানের সীমান্ত শহরগুলোর মাধ্যমে আর ভারতের সহায়তা পাবে না। পাকিস্তান আরও মনে করে, কাশ্মীরের মুসলিম সম্প্রদায় তালেবানদের সহায়তায় আরও উজ্জীবিত হবে, কারণ অতীতেও আফগানিস্তান থেকে মুজাহিদীনরা এসে কাশ্মীরে তৎপর ছিল। ভারতও বিভিন্নভাবে তালেবানদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে, কারণ আফগানিস্তানে ভারতের প্রায় ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ রয়েছে। তবে ভারত যতই চেষ্টা করুক, তালেবান সরকারের ওপর পাকিস্তানের প্রভাব-প্রতিপত্তি শিগগিরই কমবে না।
ইসলামিক আমিরাত অফ আফগানিস্তানের তালেবান সরকার গোটা বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার ঘোষণা দিয়েছে; তবে তাদের প্রথম পছন্দের দেশ চীন। পাকিস্তানের মাধ্যমে বেশ কিছুদিন ধরেই চীন তালেবানের সঙ্গে তলে তলে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছে। ধর্মহীন নাস্তিক দেশ চীনের সঙ্গে ইসলামিক আমিরাত অফ আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরি করার ব্যাপারে আগ্রহের প্রধান কারণ, চীনের কাছে বিনিয়োগযোগ্য প্রচুর অলস অর্থ সঞ্চিত আছে। আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদের ওপর চীনেরও লোভ থাকা স্বাভাবিক, এর বাইরে রয়েছে পণ্য রপ্তানির একচেটিয়া সুযোগ। তবে এই মুহূর্তে ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিলের চেয়ে আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা চীনের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পাকিস্তান এবং ইরানে তারা শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে এবং আরও করতে যাচ্ছে, আফগানিস্তানেও করবে। আফগানিস্তান স্থিতিশীল না হলে পাকিস্তান ও ইরানে চীনের বিনিয়োগে ঝুঁকি বাড়বে। আফগানিস্তান থেকে ভারতকে উচ্ছেদ করার সুযোগও চীন নষ্ট করবে না। তবে চীনও পশ্চিমা বিশ্বের মতো তালেবানদের আমলে সন্ত্রাসী আক্রমণের ভয় করছে; কারণ আফগানিস্তানের সঙ্গে চীনের যে ৯০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে তার ঠিক ওপাশেই রয়েছে উইঘুর মুসলিম অধ্যুষিত চীনা প্রদেশ শিনজিয়াং। তবে উইঘুর মুসলমানদের প্রশ্রয় দেয়া হবে না মর্মে ইত্যবসরে তালেবানেরা চীনকে আশ্বস্ত করেছে।
তালেবানেরা ইতোমধ্যে মস্কোর সমর্থন আদায় করে নিয়েছে। আমেরিকার বিদায়ে রাশিয়া স্বস্তিবোধ করছে। তবে তালেবানের আগমনে রাশিয়াও জেহাদ রপ্তানির ভয়ে আছে। আফগানিস্তান ও রাশিয়া উভয়ের প্রতিবেশী দেশ তাজাকিনিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কেমেনিস্তান প্রভৃতি দেশ মুসলিম অধ্যুষিত, এই সব দেশের জেহাদিরা তালেবানদের আশ্রয়-প্রশ্রয় পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই জেহাদ ঠেকাতে রাশিয়া তালেবান সরকারের সঙ্গে একটা গাঢ় সম্পর্ক রাখতে চাইবে। শুধু নাস্তিক দেশ চীন আর রাশিয়া নয়, কট্টর সুন্নী ওয়াহাবিপন্থি তালেবান নেতারা শিয়া ইরানের সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তোলার পদক্ষেপ নিয়েছে। অবশ্য আমেরিকাকে শায়েস্তা করতে বহু পূর্ব থেকেই ইরান তালেবানদের সহায়তা করে আসছিল, তালেবানেরাও প্রতিদান হিসেবে সংখ্যালঘু শিয়া হাজেরাদের ওপর আগের মতো আর নির্যাতন করেনি। তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য হিসেবে এতদিন তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তবুও তালেবান সরকার শপথ অনুষ্ঠানে তুরস্ককে দাওয়াত দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে রাশিয়া, চীন, ইরান একমত পোষণ করছে, তুরস্কও মাঝে মাঝে তাদের সঙ্গে সুর মেলাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তালেবানেরা অনেকদূর এগিয়ে গেছে।
রাশিয়া, চীন, ইরান, পাকিস্তান, তুরস্ক প্রভৃতি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের পর তালেবান সরকার পশ্চিমাদের রোষানলে পড়তে পারে। আন্তর্জাতিক কূটনীতি সরলরেখায় চলে না, বিভিন্ন জটিল সম্পর্কের সহজ সমাধান নেই। কিউবায় চটের বস্তা বিক্রি করার কারণে আমেরিকা সমুদ্রের মাঝপথ থেকে বাংলাদেশের জন্য প্রেরিত গমের জাহাজ ফেরত নিয়ে যায়, চুয়াত্তরে দুর্ভিক্ষ হয়। আমেরিকা ইতোমধ্যে আফগানিস্তানের সাড়ে ৯ হাজার কোটি ডলার আটক করেছে; নগদ টাকার অভাবে তালেবান সরকার জরুরি পণ্যও আমদানি করতে পারছে না। তালেবানদের আমেরিকার প্রতি নমনীয় করাই এর মূল উদ্দেশ্য হতে পারে। আমেরিকা নিজের স্বার্থ রক্ষায় পানামার শাসনকর্তা ম্যানুয়েল নরিয়েগাকে ধরে নিয়ে জেলখানায় পুরেছিল। অন্যদিকে গুজরাটে দাঙ্গার পর আমেরিকার কোর্ট থেকে সমন জারী করা ছাড়াও নরেন্দ্র মোদিকে ভিসা দেয়নি ৯ বছর; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মোদি হয়ে যান আমেরিকার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু। আমেরিকা এবং ইউরোপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ালে তালেবানদের বিরুদ্ধে আইএসও আত্মঘাতী বোমা ফাটতে পারে; কারণ তালেবান সরকার, আইএস এবং আল কায়েদার কঠোর নজরদারির বাইরে নয়। ইতোমধ্যে গঠিত সরকারের মন্ত্রী, নেতাদের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়ে গিয়েছে। দেশটিতে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তালেবানদের আগের মতো উগ্র হলে চলবে না, কূটনীতির খেলায় কৌশলী হতে হবে।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]
ahmedzeauddin0@gmail.com