শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ
অজানাকে জানা, বিনোদন, গবেষণা ইত্যাদি বিভিন্ন উদ্দেশ্যে যুগে যুগে মানুষ দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছে। আজও বেড়ায়। অতীতে এ জন্য মানুষ পায়ে হেঁটে, পাথার-পাহাড় মাড়িয়ে, সাগরের উথাল-পাতাল ঢেউয়ের ঝুঁটি ডিঙ্গিয়ে এবং লুটেরা ও বন্য জীবজন্তুর চোখ এড়িয়ে ঘুরেছে। কখনো সরাইখানায়, কখনও কারোর বাড়ির দাওয়ায় খেয়ে না খেয়ে পথ চলেছে। বিখ্যাত সেসব পর্যটকের মধ্যে চৈনিক উয়ান চুয়াঙ (হিউয়েন সাঙ), মুরিশ ইবনে বতুতা প্রমুখ সবচেয়ে বিখ্যাত। কারণ, তারা তাদের ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখেছেন। সেসব বৃত্তান্তে প্রচুর ঐতিহাসিক তথ্য লুকিয়ে আছে। কিন্তু তাদের যুগে ভ্রমণ বিষয়টি শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছেনি। এখন এটি শিল্পের মর্যাদা ভোগ করছে। এটিকে এখন বলা হয় পর্যটন শিল্প।
২৭ সেপ্টেম্বর। বিশ্ব পর্যটন দিবস। জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার (ইউএনডব্লিউটিও) উদ্যোগে ১৯৮০ সাল থেকে প্রতি বছর ২৭ সেপ্টেম্বর দিবসটি বিশ্বে পালিত হয়ে আসছে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচির মাধ্যমে পালিত হয় দিবসটি।
বিশ্বের যে কোন দেশের জন্য সম্ভাবনাময় খাত পর্যটন শিল্প। বিশ্বের যে কয়েকটি দেশ পর্যটন খাতে ভালো প্রবৃদ্ধি করছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। এছাড়া আগামী এক দশকে পর্যটন খাতে যে ১২টি দেশ দীর্ঘ মেয়াদে প্রবৃদ্ধি করবে, সেখানেও আছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ১০০ কোটি। ২০২০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা দাঁড়াবে ১৬০ কোটি। এই বিপুলসংখ্যক পর্যটকের মূল গন্তব্য এশিয়ার দেশগুলো। বাংলাদেশ যদি বিশাল এই বাজার ধরতে পারে, তাহলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে দেশের অর্থনীতি। কিন্তু পর্যটন শিল্পের এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না যথাযথ উদ্যোগের অভাবে।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের হিসেব মতে, দেশের ভেতরে এখন বছরে ৮০ লাখ লোক ভ্রমণে বের হচ্ছেন। গত ৪-৫ বছরে এই সংখ্যা বছরে ৮ থেকে ১০ লাখ হারে বেড়েছে। পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অনেক পরিবার এখন সঞ্চয়ের একটা অংশ আলাদা করে রাখে ভ্রমণের জন্য। ভ্রমণপিপাসুদের কল্যাণে দেশে বিকশিত হচ্ছে পর্যটন অবকাঠামো। হোটেল, মোটেল ও রেস্টুরেন্টের পাশাপাশি পর্যটন ব্যবস্থাপনার জন্য গড়ে উঠছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এর পেছনে এখন এক বিরাট অর্থনীতি।
প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকেও অসংখ্য পর্যটক বিশ্বের নানা দেশে বেড়াতে যাচ্ছেন। ট্যুর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) তথ্য অনুযায়ী, শুধু মালয়েশিয়াতেই বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় দেড় লাখ পর্যটক যাচ্ছে। এছাড়া থাইল্যান্ডে ৮৫ হাজার, ভারতে ৫ থেকে ৬ লাখ, সিঙ্গাপুরে ৩০-৪০ হাজার পর্যটক যাচ্ছে। এছাড়া নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কায় ভিসা লাগে না বলে সেখানেও যাচ্ছে বিপুল পর্যটক। তারপরও দেশের ভেতরে পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। এই বিদেশমুখী পর্যটকদের দেশের ভেতরে ধরে রাখা গেলে পর্যটনের অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হবে।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্য মতে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটক আগমনের সংখ্যা ৬ লাখ ৪২ হাজার জন। তথ্যানুসারে ২০১৫ সালে ন্যাশনাল জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ৪০২.৬ বিলিয়ন টাকা অর্থাৎ জিডিপির প্রায় ২.৪ শতাংশ-যা ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়াবে ৫.২ শতাংশে। পর্যটন খাতে ২০১৫ সালে প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে ১১৩৮.৫০০টি-যা মোট কর্মসংস্থানের ২.০ শতাংশ, যা প্রতি বছর ০.৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৬ সাল নাগাদ ১.৮ শতাংশে (১২৫৭.০০টি) উন্নীত হবে।২০১৫ সালে পর্যটন খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৬১.৬ বিলিয়ন টাকা (মোট বিনিয়োগের ১.২ শতাংশ), যা ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়াবে ৬.৩ শতাংশে।
পর্যটন খাতের এসব সম্ভাবনা কাজে লাগছে না কেবল যথাযথ উদ্যোগের অভাবে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, অবকাঠামোগত সমস্যার পাশাপাশি নীতিনির্ধারকদের আন্তরিকতা, পেশাদারিত্ব, দক্ষতা ও আন্তর্জাতিক প্রচার নেই বলে সম্ভাবনাময় এই খাতটি পিছিয়ে আছে। এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পর্যটন যে বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনাময় খাত, সেটাই অনেকে বুঝতে চান না। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত-এই দেশগুলো পর্যটক আনার জন্য বিশ্বব্যাপী প্রচার চালিয়েছে, বিনিয়োগ করেছে। এখন তারা এর সুফল পাচ্ছে। অথচ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমুদ্রসৈকত বা ম্যানগ্রোভ বন থাকার পরও আমরা সেটি বিশ্ববাসীকে জানাতে পারছি না। তিনি দেশের সড়ক ও যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত করার এবং পর্যটনের সত্যিকার অবকাঠামো গড়ে তোলার পরামর্শ দেন।
পর্যটন শিল্পে বর্তমানে সবচেয়ে অগ্রসর দেশ যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ইতালি, গ্রিস, চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপাল ও ভারত। কিন্তু এতেই ওই সব দেশ সন্তুষ্ট হয়ে বসে থাকছে না। জাপান নারিতা বিমান বন্দরেই বিতরণ করছে বহু ভাষায় সংকলিত জাপানি পর্যটন স্পটের বিবরণ। বিশ্বে পর্যটক সংখ্যার বিবেচনায় চিনের অবস্থান পঞ্চম। তবুও তারা বসে নেই। পর্যটক সুবিধা এবং প্রচার এমনভাবে বাড়াচ্ছে যাতে এ খাতের রাজস্ব আয় আরও বৃদ্ধি পায়। আমাদের দেশেও সেই সুযোগ রয়েছে। তবে এখন প্রয়োজন নিরাপত্তা ও প্রচার।
বাংলাদেশের পর্যটনের উপযোগী প্রধান প্রধান স্পট কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত, কুয়াকাটা, পাহাড়পুর বিহার, ময়নামতি, মহাস্থান গড়, খলিফাতাবাদ (বাগেরহাট শহর), গৌড় লক্ষ্মণাবতী, সুন্দরবন, মাধবকুন্ড, সীতাকুন্ড পাহাড়, তিনটি পার্বত্য জেলা এবং বিভিন্ন জাদুঘর। জাদুঘরগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বরেন্দ্র জাদুঘর, দিনাজপুর জাদুঘর, চট্টগ্রাম জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর। এ ক্ষেত্রে অবশ্য যশোরের দত্তবাড়ি, নওগাঁয়ের পতিসর রবীন্দ্র কাছারি বাড়ি, শিলাইদহ রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি এবং শাহজাদপুর কাছারি বাড়ির ভূমিকাও একেবারে কম নয়। তাছাড়া রয়েছে চা-বাগান, হাওর, বিল ও চর।
বাংলাদেশে বিদেশিদের আকর্ষণের মতো বহু লোক-ঐতিহ্যও রয়েছে; যেমন-বেদে জীবন, ষাঁড়ের লড়াই, লাঠিখেলা, গান (ঘাটু, বাউল, ধামাইল, গম্ভীরা, মালজোড়া, মুর্শিদী, ভাটিয়ালি, দেহতত্ত্ব, জারি, সারি, পুঁথিপাঠ, বাহাস প্রভৃতি)। বাহাস হলো গানের মাধ্যমে বিতর্ক। খাটু হলো বর্ষার মৌসুমে বড় বড় নৌকায় চড়ে দলবেঁধে ঘাটে ঘাটে পরিবেশিত গান। যাত্রা, পুতুল নাচ প্রভৃতির বৈচিত্র্যও কম নয়। ঘরে ঘরে তৈরি হয় নানা নকশা ও স্বাদের পিঠাপুলি।
কুটির শিল্পের মধ্যে শীতল পাটি, পাটের থলে, নকশিকাঁথা, পিতল-কাঁসার তেজসপত্র, মৃৎশিল্পজাত শোপিস, ঢাকার আমলিগোলার শিং দিয়ে তৈরি শৌখিন দ্রব্যাদি, শঙ্খের তৈরি উপহার সামগ্রী প্রভৃতির আবেদনও কম নয়।
নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের অপার সম্ভার থাকলেও আমাদের পর্যটন শিল্প পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে। পিছিয়ে আছে কেন? এই প্রশ্নটি বারবার আমাদের ভাবিয়ে তোলে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আইনশৃঙ্খলার অবনতির জন্য এই খাতটির গতি বাড়ছে না। এই বিষয়ে একজন বিদেশি বিশেষজ্ঞ সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন। তার মন্তব্য ছিল এই যে, বাংলাদেশ এ যাবৎ তার পর্যটন সম্পদগুলো সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী জোরালো আবেদন তুলে ধরতে পারেনি।
সম্প্রতি আরও একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে। সেটি হলো পর্যটন মৌসুম এলেই বড় বড় পর্যটন স্পটের আবাসিক হোটেল মালিকেরা নানান অজুহাতে ভাড়ার টাকার অঙ্ক বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া যানবাহনের চালক ও খাবার বিক্রেতারাও একই অপকৌশল অবলম্বন করে। অনেক অনেক স্পটে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গাইডেরও অভাব রয়েছে। সুতরাং অচিরেই এসব সমস্যার সমাধান প্রয়োজন। আরও যা যা করা প্রয়োজন সেগুলোর মধ্যে ভিসা ব্যবস্থায় শিথিলতা আনয়ন, বিমান সংস্থাগুলোর সঙ্গে সুযোগ বৃদ্ধিমূলক চুক্তি সম্পাদন, বিভিন্ন ভাষায় প্রচারমূলক তৎপরতা গ্রহণ। এছাড়াও পরিস্থিতি বিবেচনায় আরও কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। টোকেনধর্মী প্রতিকৃতি বিক্রয়সহ বিদেশিদের জন্য বিশেষ সেবামূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে।
পর্যটন শিল্পের জন্য একটি দেশ যেমন বিশ্ব দরবারে পরিচিতি লাভ করতে পারে তেমনি অনেক অর্থ আয়ও করতে পারে। অনেক দেশ আজ পরিচিত শুধু তাদের পর্যটন শিল্পের জন্য। এমনকি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও পর্যটন শিল্প গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। দেশে পর্যটন শিল্পের পরিধি বাড়াতে হলে আরও বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন। সেই সঙ্গে আরও ভালো পর্যটনবান্ধব পরিবেশেও গড়ে তোলা দরকার। এজন্য সরকার ও পর্যটন শিল্পের সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিকতার সঙ্গে সুপরিকল্পিত মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসা জরুরি।
[লেখক : সাংবাদিক]
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ
রোববার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১
অজানাকে জানা, বিনোদন, গবেষণা ইত্যাদি বিভিন্ন উদ্দেশ্যে যুগে যুগে মানুষ দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছে। আজও বেড়ায়। অতীতে এ জন্য মানুষ পায়ে হেঁটে, পাথার-পাহাড় মাড়িয়ে, সাগরের উথাল-পাতাল ঢেউয়ের ঝুঁটি ডিঙ্গিয়ে এবং লুটেরা ও বন্য জীবজন্তুর চোখ এড়িয়ে ঘুরেছে। কখনো সরাইখানায়, কখনও কারোর বাড়ির দাওয়ায় খেয়ে না খেয়ে পথ চলেছে। বিখ্যাত সেসব পর্যটকের মধ্যে চৈনিক উয়ান চুয়াঙ (হিউয়েন সাঙ), মুরিশ ইবনে বতুতা প্রমুখ সবচেয়ে বিখ্যাত। কারণ, তারা তাদের ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখেছেন। সেসব বৃত্তান্তে প্রচুর ঐতিহাসিক তথ্য লুকিয়ে আছে। কিন্তু তাদের যুগে ভ্রমণ বিষয়টি শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছেনি। এখন এটি শিল্পের মর্যাদা ভোগ করছে। এটিকে এখন বলা হয় পর্যটন শিল্প।
২৭ সেপ্টেম্বর। বিশ্ব পর্যটন দিবস। জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার (ইউএনডব্লিউটিও) উদ্যোগে ১৯৮০ সাল থেকে প্রতি বছর ২৭ সেপ্টেম্বর দিবসটি বিশ্বে পালিত হয়ে আসছে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচির মাধ্যমে পালিত হয় দিবসটি।
বিশ্বের যে কোন দেশের জন্য সম্ভাবনাময় খাত পর্যটন শিল্প। বিশ্বের যে কয়েকটি দেশ পর্যটন খাতে ভালো প্রবৃদ্ধি করছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। এছাড়া আগামী এক দশকে পর্যটন খাতে যে ১২টি দেশ দীর্ঘ মেয়াদে প্রবৃদ্ধি করবে, সেখানেও আছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ১০০ কোটি। ২০২০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা দাঁড়াবে ১৬০ কোটি। এই বিপুলসংখ্যক পর্যটকের মূল গন্তব্য এশিয়ার দেশগুলো। বাংলাদেশ যদি বিশাল এই বাজার ধরতে পারে, তাহলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে দেশের অর্থনীতি। কিন্তু পর্যটন শিল্পের এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না যথাযথ উদ্যোগের অভাবে।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের হিসেব মতে, দেশের ভেতরে এখন বছরে ৮০ লাখ লোক ভ্রমণে বের হচ্ছেন। গত ৪-৫ বছরে এই সংখ্যা বছরে ৮ থেকে ১০ লাখ হারে বেড়েছে। পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অনেক পরিবার এখন সঞ্চয়ের একটা অংশ আলাদা করে রাখে ভ্রমণের জন্য। ভ্রমণপিপাসুদের কল্যাণে দেশে বিকশিত হচ্ছে পর্যটন অবকাঠামো। হোটেল, মোটেল ও রেস্টুরেন্টের পাশাপাশি পর্যটন ব্যবস্থাপনার জন্য গড়ে উঠছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এর পেছনে এখন এক বিরাট অর্থনীতি।
প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকেও অসংখ্য পর্যটক বিশ্বের নানা দেশে বেড়াতে যাচ্ছেন। ট্যুর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) তথ্য অনুযায়ী, শুধু মালয়েশিয়াতেই বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় দেড় লাখ পর্যটক যাচ্ছে। এছাড়া থাইল্যান্ডে ৮৫ হাজার, ভারতে ৫ থেকে ৬ লাখ, সিঙ্গাপুরে ৩০-৪০ হাজার পর্যটক যাচ্ছে। এছাড়া নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কায় ভিসা লাগে না বলে সেখানেও যাচ্ছে বিপুল পর্যটক। তারপরও দেশের ভেতরে পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। এই বিদেশমুখী পর্যটকদের দেশের ভেতরে ধরে রাখা গেলে পর্যটনের অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হবে।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্য মতে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটক আগমনের সংখ্যা ৬ লাখ ৪২ হাজার জন। তথ্যানুসারে ২০১৫ সালে ন্যাশনাল জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ৪০২.৬ বিলিয়ন টাকা অর্থাৎ জিডিপির প্রায় ২.৪ শতাংশ-যা ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়াবে ৫.২ শতাংশে। পর্যটন খাতে ২০১৫ সালে প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে ১১৩৮.৫০০টি-যা মোট কর্মসংস্থানের ২.০ শতাংশ, যা প্রতি বছর ০.৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৬ সাল নাগাদ ১.৮ শতাংশে (১২৫৭.০০টি) উন্নীত হবে।২০১৫ সালে পর্যটন খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৬১.৬ বিলিয়ন টাকা (মোট বিনিয়োগের ১.২ শতাংশ), যা ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়াবে ৬.৩ শতাংশে।
পর্যটন খাতের এসব সম্ভাবনা কাজে লাগছে না কেবল যথাযথ উদ্যোগের অভাবে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, অবকাঠামোগত সমস্যার পাশাপাশি নীতিনির্ধারকদের আন্তরিকতা, পেশাদারিত্ব, দক্ষতা ও আন্তর্জাতিক প্রচার নেই বলে সম্ভাবনাময় এই খাতটি পিছিয়ে আছে। এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পর্যটন যে বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনাময় খাত, সেটাই অনেকে বুঝতে চান না। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত-এই দেশগুলো পর্যটক আনার জন্য বিশ্বব্যাপী প্রচার চালিয়েছে, বিনিয়োগ করেছে। এখন তারা এর সুফল পাচ্ছে। অথচ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমুদ্রসৈকত বা ম্যানগ্রোভ বন থাকার পরও আমরা সেটি বিশ্ববাসীকে জানাতে পারছি না। তিনি দেশের সড়ক ও যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত করার এবং পর্যটনের সত্যিকার অবকাঠামো গড়ে তোলার পরামর্শ দেন।
পর্যটন শিল্পে বর্তমানে সবচেয়ে অগ্রসর দেশ যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ইতালি, গ্রিস, চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপাল ও ভারত। কিন্তু এতেই ওই সব দেশ সন্তুষ্ট হয়ে বসে থাকছে না। জাপান নারিতা বিমান বন্দরেই বিতরণ করছে বহু ভাষায় সংকলিত জাপানি পর্যটন স্পটের বিবরণ। বিশ্বে পর্যটক সংখ্যার বিবেচনায় চিনের অবস্থান পঞ্চম। তবুও তারা বসে নেই। পর্যটক সুবিধা এবং প্রচার এমনভাবে বাড়াচ্ছে যাতে এ খাতের রাজস্ব আয় আরও বৃদ্ধি পায়। আমাদের দেশেও সেই সুযোগ রয়েছে। তবে এখন প্রয়োজন নিরাপত্তা ও প্রচার।
বাংলাদেশের পর্যটনের উপযোগী প্রধান প্রধান স্পট কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত, কুয়াকাটা, পাহাড়পুর বিহার, ময়নামতি, মহাস্থান গড়, খলিফাতাবাদ (বাগেরহাট শহর), গৌড় লক্ষ্মণাবতী, সুন্দরবন, মাধবকুন্ড, সীতাকুন্ড পাহাড়, তিনটি পার্বত্য জেলা এবং বিভিন্ন জাদুঘর। জাদুঘরগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বরেন্দ্র জাদুঘর, দিনাজপুর জাদুঘর, চট্টগ্রাম জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর। এ ক্ষেত্রে অবশ্য যশোরের দত্তবাড়ি, নওগাঁয়ের পতিসর রবীন্দ্র কাছারি বাড়ি, শিলাইদহ রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি এবং শাহজাদপুর কাছারি বাড়ির ভূমিকাও একেবারে কম নয়। তাছাড়া রয়েছে চা-বাগান, হাওর, বিল ও চর।
বাংলাদেশে বিদেশিদের আকর্ষণের মতো বহু লোক-ঐতিহ্যও রয়েছে; যেমন-বেদে জীবন, ষাঁড়ের লড়াই, লাঠিখেলা, গান (ঘাটু, বাউল, ধামাইল, গম্ভীরা, মালজোড়া, মুর্শিদী, ভাটিয়ালি, দেহতত্ত্ব, জারি, সারি, পুঁথিপাঠ, বাহাস প্রভৃতি)। বাহাস হলো গানের মাধ্যমে বিতর্ক। খাটু হলো বর্ষার মৌসুমে বড় বড় নৌকায় চড়ে দলবেঁধে ঘাটে ঘাটে পরিবেশিত গান। যাত্রা, পুতুল নাচ প্রভৃতির বৈচিত্র্যও কম নয়। ঘরে ঘরে তৈরি হয় নানা নকশা ও স্বাদের পিঠাপুলি।
কুটির শিল্পের মধ্যে শীতল পাটি, পাটের থলে, নকশিকাঁথা, পিতল-কাঁসার তেজসপত্র, মৃৎশিল্পজাত শোপিস, ঢাকার আমলিগোলার শিং দিয়ে তৈরি শৌখিন দ্রব্যাদি, শঙ্খের তৈরি উপহার সামগ্রী প্রভৃতির আবেদনও কম নয়।
নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের অপার সম্ভার থাকলেও আমাদের পর্যটন শিল্প পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে। পিছিয়ে আছে কেন? এই প্রশ্নটি বারবার আমাদের ভাবিয়ে তোলে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আইনশৃঙ্খলার অবনতির জন্য এই খাতটির গতি বাড়ছে না। এই বিষয়ে একজন বিদেশি বিশেষজ্ঞ সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন। তার মন্তব্য ছিল এই যে, বাংলাদেশ এ যাবৎ তার পর্যটন সম্পদগুলো সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী জোরালো আবেদন তুলে ধরতে পারেনি।
সম্প্রতি আরও একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে। সেটি হলো পর্যটন মৌসুম এলেই বড় বড় পর্যটন স্পটের আবাসিক হোটেল মালিকেরা নানান অজুহাতে ভাড়ার টাকার অঙ্ক বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া যানবাহনের চালক ও খাবার বিক্রেতারাও একই অপকৌশল অবলম্বন করে। অনেক অনেক স্পটে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গাইডেরও অভাব রয়েছে। সুতরাং অচিরেই এসব সমস্যার সমাধান প্রয়োজন। আরও যা যা করা প্রয়োজন সেগুলোর মধ্যে ভিসা ব্যবস্থায় শিথিলতা আনয়ন, বিমান সংস্থাগুলোর সঙ্গে সুযোগ বৃদ্ধিমূলক চুক্তি সম্পাদন, বিভিন্ন ভাষায় প্রচারমূলক তৎপরতা গ্রহণ। এছাড়াও পরিস্থিতি বিবেচনায় আরও কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। টোকেনধর্মী প্রতিকৃতি বিক্রয়সহ বিদেশিদের জন্য বিশেষ সেবামূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে।
পর্যটন শিল্পের জন্য একটি দেশ যেমন বিশ্ব দরবারে পরিচিতি লাভ করতে পারে তেমনি অনেক অর্থ আয়ও করতে পারে। অনেক দেশ আজ পরিচিত শুধু তাদের পর্যটন শিল্পের জন্য। এমনকি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও পর্যটন শিল্প গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। দেশে পর্যটন শিল্পের পরিধি বাড়াতে হলে আরও বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন। সেই সঙ্গে আরও ভালো পর্যটনবান্ধব পরিবেশেও গড়ে তোলা দরকার। এজন্য সরকার ও পর্যটন শিল্পের সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিকতার সঙ্গে সুপরিকল্পিত মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসা জরুরি।
[লেখক : সাংবাদিক]