alt

সাময়িকী

সুবিমল মিশ্রের বিদায় অথবা

একটি দুর্বিনীত নাশকতার অন্তিম চিৎকার

গৌতম গুহ রায়

: বৃহস্পতিবার, ০২ মার্চ ২০২৩

“লেখকেরা গল্প জানে না জীবন জানে আর

জীবন গল্পের থেকেও অশ্লীল”

-সুবিমল

৮ ফেব্রুয়ারি, সকাল বেলা এই সংবাদ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লো- ‘প্রথাবিরোধী সাহিত্যিক সুবিমল মিশ্র চলে গেলেন!’ এই খবরটা আসলে তৈরিই ছিলো। অসুস্থতা আক্রান্ত সুবিমল মৃত্যুর কাছে এদিন আত্মসমর্পণ করলেন বলা যায়। অধিকাংশ দৃঢ়চেতা ও আদর্শবাদী আপসহীন মানুষের শেষ সময় যেমন হয়, ক্ষমতার থেকে দূরে এক একক জীবন, কোনক্রমে চিকিৎসার আয়োজন, এক হতাশামগ্ন পরিণতি। সুবিমল মিশ্র, ‘আনপ্যারালাল’ এই লেখকেরও শেষ সময় খুব একটা ‘সুখের’ ছিল বলা যায় না। তাঁর লেখা নিয়ে বাণিজ্য করা মনুষদের অনেকেই না-জানার ভান করে শেষ সময়েও ‘নিরাপদ দূরত্ব’ বজায় রেখেছেন, গুটি কয়েক অনুগত সঙ্গী তাঁর অন্তিম দিনগুলোয় সাথে ছিলেন। এটা আমাদের যন্ত্রণার উপকরণ দিতে পারে মাত্র , উপশম দেবে না।

কে এই ‘দুর্বিনীবেরিয়ে পড়ছেন পরবর্তী বেরিয়ে পড়ছেন পরবর্তী ত’ সুবিমল, যাকে অনেকেই চেতনে এড়িয়ে যায়?

১৯৭১-এ পাঠকের হাতে পৌঁছল ‘হারান মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া অথবা সোনার গান্ধিমূর্তি’। একটা বড়সড় কম্পন। আরাম পিপাসু সাহিত্য পাঠকেরা হঠাৎ এই ধাক্কা সামলে উঠতে পারলেন না, নিরাপদ বলয় ভেঙ্গেচুরে খানখান হওয়ার আশঙ্কায় রব উঠলো, ‘না’ ‘না’-এ সাহিত্যই নয়। ঢিঢি রব উঠলো সাহিত্য নগরের নাগরদের কণ্ঠে। পাঠক, সময়টা লক্ষ্য করুন একবার- সাতের দশক। সমাজকে আঘাতের মধ্য দিয়ে মুক্তির দশকে পরিণত করার সংকল্প নিয়ে বাংলার তারুণ্য তখন জীবন বাজি রেখে পথে নেমেছে। শাসক সভ্যতার যাবতীয় শর্ত ভেঙ্গে হত্যার যজ্ঞ শুরু করেছে। সীমান্তে ওপারে তখন আর এক যুদ্ধ, মুক্তির সংগ্রামে বাংলার রক্ততেজ বন্দুক তুলে নিয়েছে। সেই সময়টাকেই যেন বেছে নিয়ে সাহিত্যের ‘তুলতুলে’ চর্বিস্ফিত শরীরটাকে আঘাত করার জন্য কলম তুলে নিলেন সুবিমল। প্রথম ধাক্কাতেই সাহিত্য বাণিজ্য কেঁপে উঠলো। কাপবেই না কেন? তাঁর টেক্সট আজও সেই কাঁপন শক্তি ধারণ করে আছে:

হারান মাঝির বিধবা বৌ বলত : শালার বামুন বুড়ো চাট্টিখানি খাইতে দ্যায় আর সময় নাই অসময় নাই খালি ঠাপানোর ধান্দা। পরজন্মে শালারা নরকের কুত্তা হবে।... সকলে সমবেত চমকালেন নাকে রুমাল দিলেন এবং বুঝতে পারলেন হারান মাঝির বোউ-এর মড়া না সরালে সোনার গান্ধীমূর্তি নাগাল পাওয়া যাবে না।

অথবা- ‘মনে হচ্ছে এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলেই রাণীর মৃতদেহ আবার জেগে উঠে বসবে এবং তার খোয়া যাওয়া অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো ফেরত চাইবে। (পরীজাতক)

আমাদের এই বাংলা ভাষা তার ঔপনিবেশিক সময়ে বেরে ওঠা গড়ন নিয়ে বিকশিত হয়েছে, সেই বিন্যাসকে ঘিরে আমাদের সাহিত্যের টেক্সট গড়ে উঠেছে, সেই টেক্সটের প্রতি সুবিমল সচেতনভাবে, আক্রমণাত্মক হয়ে পালটা যুদ্ধব্যবস্থা গড়ে তুলে ঐ গড়নটাকে ছিঁড়েফেড়ে ফেলে দেওয়ার নাশকতা চালিয়ে গেছেন চিরকাল। কিন্তু এই নাশকতার ভাষা ছিলো প্রত্যক্ষ: ‘বেশ্যার দালাল অথবা সুতারকিন বাগবাজারের সম্পাদক কাম সাহিত্যের আড়তদার যেই হোক না কেন, তাদের স্বরূপ নিয়ে বলতে যাও, শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষর্থে পুলিশ আসবেই। সবার আগে মধ্যবিত্ত কেরিয়ারিজমের বারোটা বাজানো দরকার ...

ময়দানে দাঁতের মাজনওয়ালারা এবার ভালো ভালো সব ম্যাজিক দেখাচ্ছে। ইয়া মোটা মোটা লোহার বালা গায়ের জোরে দুমড়ে দেওয়ার ম্যাজিক, কাটামু-র কথা বলার ম্যাজিক। দেখতে লোক জমে যাচ্ছে। বাংলা উপন্যাসের নায়িকারা ক্রমশ প্রোগ্রেসিভ হয়ে উঠছে। লেকের ধারে সন্ধ্যেবেলায় ছেলে বন্ধুর সঙ্গে কী করেছে নিঃসঙ্কোচে মাকে এসে বলছে নায়িকা। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা পাকা হয়েছে। ফসল কাটার মরশুমে চাষিরা নিজেদের শ্রমের ফসল জোতদারের ঘরে তুলতে অস্বীকার করলে শো শো ধুলো উড়িয়ে চলে আসছে পুলিশের জিপÑ শান্তিশৃঙ্খলা বড় আজব চিজ। রাধু ম-ল হাত কামড়াচ্ছে এই রাস্তা তারা কাজের বদলে খাদ্য নাকি এই রকম কী এক রাজকীয় উদ্যোগে বানিয়েছিল। রাধানাথের দুঃখ তার ম্যাট্রিক পাস করা ছেলে কাজ না পেয়ে লরি ড্রাইভারের সাগরেদ হয়েছে, বিনা মাইনের ক্লিনার। দিনরাত গ্যারেজে পড়ে থেকে, নেশা ভাঙ করতে শিখেছে এই ১৪ বছর বয়সেই, বাড়ি আসতে চায় না। অথচ কী যে ভালো ছিল ছেলেটা।... রাধানাথ এখন সপরিবারে বিড়ি শ্রমিক। শুধু সে বা তার বৌ নয়, স্বাধীনতার এই ৩০/৩২ বছর পরও তার ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরও পর্যন্ত ইসকুল যাওয়ার বদলে বাড়িতে বসে বিড়ি বাঁধতে হয়, পড়ার খরচ জোগানোর জন্য নয়, সংসারের সাশ্রয়ের জন্য। হাড়ভাঙ্গা খাটুনি, দিনরাত বসে কাজ, তামাকের ধূলোÑ মালিকের টাকার পাহাড় তুলতে গিয়ে ৮/১০ বছরের বাচ্চাদের ফুসফুসগুলো এই বয়সেই ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে। রাধানাথের এই বিড়ি বাঁধতে থাকা ছেলেরা কখনো শিশুবর্ষের নাম শোনার সুযোগ পাবে না। কথা হচ্ছে শিগগিরই এখানে একটা চেস্ট ক্লিনিক খোলা হবে। জায়গা নেওয়া হয়েছে ইস্টিশানে। ডোনেশন উঠেছে সাকল্যে হাজার আড়াইয়ের মতো। সেই টাকায় নাম খোদাই করা পাথরখানাই পোঁতা হয়েছে শুধু, আর একদিন শ্রমমন্ত্রী এসে ঘটা করে সেই পাথরের উদ্বোধন করে গেছে, কোল্ড ড্রিঙ্ক খেয়েছে। ব্যাস খেল খতম। (সজনে ফুলের ভাল চচ্চরি হয়, ১৯৭৯)

পূর্বে উল্লিখিত ‘হারান মাঝির বিধবা...’ আখ্যানে দেখা যায় এই বয়ানের তীব্র ঝলকানিতে থমকে যাওয়া পাঠক। “বৌটার আর কোন উপায় ছিল না, গলায় দড়ি দিয়ে মরল। বাইশ বছরী আঁটো মড়া এখন তরতর করে খালের ঘোলা জলে ভেসে যাচ্ছে। ... দেড় বছরের কালো রোগা পেটের পিলে বিশ্রীভাবে উঁচু হয়ে থাকা ছেলেটা কঁকিয়ে কঁকিয়ে এখন হাফিয়ে উঠেছে, ধুঁকছে।... মড়াটা ভেসে ভেসে কালিঘাটের দিকে চলে যাচ্ছে। কাকেরা পিছু নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল।... কালিঘাটে এসে লোকে এই জলে চান করে পাপ ধুয়ে ফ্যালে। হারান মাঝির বিধবা বৌয়ের শব কত দূরে কে জানে, কালিঘাটের দিকে ভেসে আসছে। হারান মাঝি বৌটাকে অনাথ করে গিয়েছিল, বৌটা মরে বাচ্চাটাকে অনাথ করে গেল। শিশুর শরীরে পাপ নাই, শিশু ঈশ্বরের তুল্যি, তুলে নিয়ে যাও পুণ্যি হবেÑ কারা যেন কথাগুলো বলে ওঠে।

হারান মাঝি মরে যাওয়ার পর সে মুড়ি বেঁচে পেট চালাতো। বামুনপাড়ায় অনেক শিক্ষিত লোকের বাস। তারা বাড়ির সামনে রজনীগন্ধার বাগান বানায়, পুজোর সময় নতুন কাপড়-জামা পরে, বানরের খেলা দেখে বাজিকরের দিকে টাকাটা-সিকিটা ছুড়ে দেয়, হারান-বৌয়ের আঁটো শরীর দেখে তাঁকে ধানভানারি রাখতে চায়। এহেন হারান-বৌয়ের বাইশবছরী আঁটো মড়া এখন তরতর করে খালের ঘোলা জলে ভেসে যাচ্ছে।...

...আমেরিকা থেকে সোনার গান্ধীমূর্তি খুব শিগগির এ দেশে আসছে খবরের কাগজে খুব বড় বড় হরফে ছাপা হয়ে বেরুল।... বামুনপাড়ার জমিদারবুড়ো সন্ধ্যেবেলা পুকুর ঘাটে হাত পা ধুয়ে খড়ম পায়ে বাড়িতে ঢুকতে যাচ্ছে এমন সময় তার পায়ের কাছে নরম মতো কি ঠেকে। লম্ফ নিয়ে এসে দ্যাখে হারান মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া। রাম রাম! এর কাছে ওর কাছে শুয়ে মাগিটা পেট করেছিল শেষ কালে কিনা বামুনের বাড়ির বারান্দায়। শহরের মেয়র বাথরুমে যাওয়ার উঠেছেন, রাত তখন দুটো, ঢুকতে গিয়ে দরজার কাছে বিশ্রী একটা পঁচা গন্ধ পেলেন, আলো জ্বালিয়ে দেখেন হারান মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া সেখানে পড়ে আছে। একজন বিখ্যাত জননেতা সারাদিন যিনি নানা ধরনের সমাজসেবায় ব্যস্ত থাকেন দুপুরের খাবার টেবিলে বসতে গিয়েই দুর্গন্ধ; টেবিলের ওপর হারান মাঝির বৌয়ের মড়া পরে আছে। ভোর রাতে ট্রাম চালাতে চালাতে ট্রাম-কনডাক্টার হঠাৎ নাকে রুমাল চেপে ধরে বিস্ফারিত চোখে দ্যাখে চলার পথ বন্ধ, রাস্তার উপর হারান মাঝির বৌয়ের মড়া শুয়ে আছে। সারা শহরময় খবর ছড়িয়ে পড়ল। সবাই ভীত, মরা মাছের চোখ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, গণ্যমান্যদের ঘরের চৌকির নিচে, আলমারির পেছনে, খাবার ঘরের মেঝেতে, কলতলায় অন্ধকারে হারান মাঝির বৌয়ের মড়া পাওয়া যাচ্ছে। দেড় বছরের সর্বহারা বাচ্চাটা কোন এক অপরিচিত মেয়ের বুকে সমানে কেঁদে চলেছে। খবরে বলল আমেরিকা থেকে সোনার গান্ধীমূর্তি দমদমের দিকে রওনা দিয়েছে। আকাশে অসংখ্য কাক-শকুনকে ঘুরে বেরাতে দেখা যাচ্ছে। নাগরিকেরা মুখে রুমাল চেপে সব সময় চলাফেরা করছেন। সারা শহর দুর্গন্ধে ভরে গেছে। সবাই ভীতসন্ত্রস্ত। কখনও না জানি কাকে হারান মাঝির বৌয়ের মড়ার পাল্লায় পড়তে হয়।... আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রধান তাঁর দস্তানাপরা হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন গান্ধীজীর সোনার মূর্তি স্পর্শ করার জন্য। সৈন্যবাহিনী রাজকীয় মর্যাদায় দাঁড়িয়ে আছে। রাষ্ট্রীয় পতাকা, সিল্কের তৈরি পৎ পৎ উড়ছে। ড্রাম বাজছে তালে তালে। অনেক ফালতু লোক ব্যাপারটা কি দেখার জন্য দূর থেকে উঁকি ঝুঁকি মারছে, তাদের ঘেষতে দেওয়া হচ্ছে না। একসময় বাক্সটার ডালা খোলা হলো, এবং সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত উপস্থিত জনবর্গ সবিস্ময়ে দেখলেন বাক্সটার উপরে হারান মাঝির বৌয়ের গলিত মড়াটি শোয়ানো রয়েছে। সকলে সমবেত চমকালেন, নাকে রুমাল দিলেন এবং বুঝতে পারলেন হারান মাঝির বৌয়ের মড়া না সরালে সোনার গান্ধীমূর্তির নাগাল পাওয়া যাবে না।”

এই আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়াই সুবিমলের সাহিত্যের নাশকতা। তার সাহিত্য সেই ‘এন্টি উপন্যাস’ Ñযা প্রচলিত পাঠের দিকে পাঠকুকে যেতে দেয় না, শুধু টেক্সোট নয়, সুবিমলের এই নাশকতার আখ্যানের প্রারম্ভ তার লেখার প্রচ্ছদ থেকেই শুরু হয়। তিনি সচেতনভাবে তার লেখার নামপত্র, প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে ভেতরেও নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালি রাখেন দুর্বিনীত সাহসের সঙ্গে। তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন যে খবরের কাগজ, চিঠি, লেখা, ইন্টারভ্যু-এর অংশ, রিপোর্টাজ এবং তুমুলভাবে ডাইরির অংশ ও তিনি নিজেও ব্যবহৃত হয়েছেন তার বইয়ে, এগুলো আমাদের কলোনিয়াল ভাষা নির্মিত উপন্যাস নয়, যথার্থই এন্টি উপন্যাস। খবরের কাগজের কাটিং কোটেশান বা কোটেশান বিকৃতি যাই হোক, তাঁর গোটা রচনা জুড়ে টের পাওয়া যায় এক অসাধারণ মুক্ত গদ্য। সুবিমল সেই গদ্যের ¯্রষ্ঠা যে গদ্য পাঠককে কোনো তৃপ্তি রেখায় পৌঁছে দিয়ে বলে না যে এই তোমার সীমান্ত, তাঁর টেক্সট প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় পাঠের পর পাঠকের পাঠ ধারণা পালটে যেতে পারে বা পাল্টাতে বাধ্য। সুবিমলের লেখা গল্পগুলো তাই বারংবার পড়ে দেখা যায়, স্তব্ধ হয়ে বসে নিজের অবস্থানকে অনুভব করা যায়, এখান থেকেই পাঠকের আর এক যাত্রা সূচিত হয়। প্রথাগত গল্প-উপন্যাসের ধারে কাছ দিয়ে যাতো না এই আখ্যান। প্রতিষ্ঠান যে সাহিত্যকে লাইলত করেছে, বানিজ্য করেছেÑ সুবিমলের সেই বাণিজ্যমুখি সাহিত্যর বিপ্রতীপে, প্রথা ও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা তার অভিমুখ। তিনি মনে করতেন প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা একটা টোটাল ব্যাপার। তাই আজীবন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাগজে তিনি লিখেননি। তিনি লিখেছেন, “প্রত্যেকের সফলতা খোঁজ করে, আমি খোঁজ করি অন্য কিছুর। আমার জীবনের প্রধাণ ব্যাপার হল হয়ে ওঠা, হয়ে ওঠার চেষ্টা, এই ‘চেষ্টা’ শব্দটির উপর আমি বিশেষভাবে জোর দিতে চাই, জীবনের শেষক্ষণটি পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে সক্রিয় থাকা, সম্পূর্ণভাবে দায়িত্ববান হওয়া।... নিজেকে ভাগুবান, ভাগ্য কিংবা এ ধরনের কারো হাতে ডুলে দেওয়া এক ধরনের কাপুরুষতা বলে আমি মনে করি। আর কাপুরুষতা আমি আদৌ পছন্দ করি না। সফলতা এলে আমি ভয় পাই। কারণ নতুন কিছু করলে সফলতা সঙ্গে সঙ্গে আসে না। আমি যদি সফলতা পাই তার মানে হলো আমি এমন কিছু করছিÑ যা তত নতুন নয়।” (বই সংগ্রহ-১)

সুবিমল মিশ্র তথাকথিত সাফল্যকে তোয়াক্কাই করতেন না। তিনি গল্প লেখার সময় তাই সামাজিক স্থিতিকে মাথায় রাখলেও সুখি সামজের প্রতিষ্ঠিত শর্তগুলোকে উপেক্ষ করেই এগোতেন। উদাহরণ হসাবে আমরা ‘পরীজাতক’ হাতে নিতে পারি। সুখময়, রজত, তমাল, দীপেনÑ এই চার বন্ধু ‘রানি’ নামের একটি মেয়েকে নিয়ে সমুদ্রের কাছে বেড়াতে গেছে। কিন্তু রাতে সমুদ্রস্নান সেরে তারা হোটেলে ফিরে দেখে রাণী মৃত। কিন্তু তাদের ভোগ্য হওয়ার আগেই এই ‘মৃত্যু’ তাদের কাছে রাণীকে হারামি বানিয়ে দেয়। “রানির স্বাস্থ্যের ওপর আমাদের লক্ষ ছিল। রানির পোশাকের ওপর আমাদের লক্ষ ছিল। কারণ আমরা জানতাম পড়ির মতো এই শড়ির খারাপ হয়ে গেলে রানি আমাদের কোনো কাজে লাগবে না। খারাপ দেখতে হয়ে গেলে রানিকে আমাদের দরকার থাকবে না। গরু বুড়ো ও অকর্মণ্য হয়ে গেলে যেমন কশাইয়ের কাছে বিক্রি করে দেয়, আমাদের সেই রকম অন্য জায়গায় রানিকে বেচে দিতে হবে...

... সমস্ত সভ্য জগতের দোহাই দিয়ে আমি বলতে পারি আমাদের কারোর মনে কোনো পাপ নেই। আমরা জানি কশাই তার বিক্রিত পশুর কোনো কিছুওই ফেলে না। তারা মাংস রক্ত তো বিক্রি করেই, এমনকী চামড়া। মাথার সিং, পেটের নাড়ি ভুঁড়িগুলো পর্যন্ত ফেলে না। আমরা মৃত রানির কাছ থেকে অল্প কিছু দাবি করতে পারি। তাতে মাদের ন্যায্য অধিকার...

...কথাটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই তিনিটে শরীর লাফিয়ে উঠল। এক ঝটকায় তারা মৃতদেহ থেকে খুলে ফেলল সাদা চামড়াটা। মোমবাতির আলোয় তাদের হাতে ছুরির ফলা ঝলসে উঠেছিল। তারা দ্রুত সেই শবদেহ থেকে বিশেষ বিশেষ স্থানের মাংস কেটে নিতে ব্যত হলো, মোমের আলোটা জ্বলছিল তখন সারা ঘরে।...’

এভাবেই এক মারাত্মক আখ্যন এগিয়ে চলে, যৌনতার ও বীভৎসতার। বিকৃত, বীভৎস প্রসঙ্গকে কেন্দ্রে রেখে বারবার বিন্যস্ত করতে থাকেন তাঁর এই আখ্যান।

বাংলা সাহিত্যে গল্প কিন্তু পাঠক লালিত গল্প নয় বা কাহিনী নির্মিত উপন্যাসের পালটা একটা ধরনের জন্ম হয়েছে, যাকে ‘এন্টি গল্প’ বা ‘এন্টি উপন্যাস’ বলে চিহ্নিত করা হয়। এমন ধারার চর্চা আলোচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাম সুবিমল মিশ্র। উদাহরণ হিসাবে আমরা দেখতে পারি উল্লিখিত ‘হারান মাঝির বিধবা...’, ‘বাগানের ঘোড়া নিমের গাছে দেখন চাচা থকতেন’ , ‘শিয়ালদা স্টেশান ও কপালকু-লা’, ’৭২-এর ডিসেম্বরের এক বিকেল’, ‘নাঙ্গা হাড় জেগে উঠেছে’, ‘টিয়াপাখিরগলায় নীল কণ্ঠি’, ‘আসুন ভারতবর্ষ দখে যান’ থেকে ‘পোদের গু তিন যায়গায় লাগে’। সুবিমল মিশ্র নিজের ও পাঠকের ভাষায় এই গদ্যকে ‘অন্টি-উপন্যাস’ বলা হয়। তাঁর প্রায় সমস্ত লেখাতেই রাজনৈতিক, সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতি দ্বিধাহীন বিশ্লেষণ ও মধ্যবিত্ত সমাজের যৌনতা নিয়েও যে ‘ছুঁয়োনা ছুঁয়োনা’ রয়েছে তার পালটা বিন্দু থেকে তিনি জেহাদ শুরু করেন। রাষ্ট্র ক্ষমতা, তার গোপন ও প্রকাশ্য নিপীড়ন, সুবিধাভোগী শ্রেণির প্রতি ব্যঙ্গ, অবক্ষয়, দ্বন্দ্ব ও নৈরাজ্য প্রভৃতি নিয়ে এক আপোসহীন আখ্যান রচনা করে গেছেন প্রতিষ্ঠান ও তাঁর প্রদত্ত যাবতীয় সুবিধাবাদী অবস্থানের বিপ্রতীপে থাকা সুবিমল মিশ্র। তাঁর প্রতিটি বয়ান এই অবস্থানের স্বাক্ষর বহন করে, ‘টাটা সেন্টারের দিকে তাকিয়ে শ্রেণিশত্রুকে চিনে নেওয়া সহজ কিন্তু গরিব চাষির ছেলে আমলা হয়ে পিতৃপরিচয় গোপন করলে যে সংস্কৃতি অকৃতজ্ঞ পুত্র বলে তাকে নিন্দা করতে ভালোবাসে এবং পরক্ষণেই চাষির ছেলে আই এ এস হয়েছে বলে মস্করা করতে ছাড়ে না, সেই সংস্কৃতিকে চিনে নেওয়া অতটা সহজ নয়...”

(ক্যালকাটা ডেটলাইন)

সুবিমল আমাদের ভাষার মুক্তির কারিগর, যে মুক্তির পথ বাতলে দিয়েছিলেন কমলকুমার মজুমদারÑ ‘ভাষাকে যে আক্রমণ করে সেই ভাষাকে বাঁচায়।’ সুবিমল মিশ্র এক স্পর্ধার নাম, যাকে দেখে শেখা যায়, কীভাবে নিজেকে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। সুবিমল বাংলা ভাষার একমাত্র লেখক, যিনি নিজের বিরুদ্ধে নিজেকে বাজি ধরেছিলেন। নিজের লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন আমৃত্যু। সুবিমলের মৃত্যু আসলে এক একলা লেখকের মৃত্যু। সুখি গৃহকোণের দুঃখ যন্ত্রণার ভাতঘুমের আখ্যান তিনি লিখতে বসেননি, তাঁর লেখা ছিলো বাজার চলতি বাস্তবতাগুলোকে অবিশ্বাস করতে শেখানোর কৌশল। তিনি বলতেনÑ সুবিমল, নিজেকে নিজে আক্রমণ করার জন্য তৈরি থাকো। আজীবন যিনি একা একা যুদ্ধে ছিলেন নিজেই নিজের সেনাবাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র যা কিছু তাঁর নিজেরই। সীমাহীন শক্তিধর গদ্য ছিলো তাঁর আয়ুধ। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তাই তিনি নিজেকে অবিরাম ভেঙেছেন আবার গড়েছেনÑ থমকে থাকেননি। কেটেছেন আবার জুড়েছেন, নিজের সচেতন পোস্টমর্টেমও করেছেন নিজেই। এই কারণে তাকে প্রতিণ্ঠানকে তোয়াক্কা করতে হয়নি।

ছবি

সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা ও আত্মবিনাশ

ছবি

সমসাময়িক মার্কিনি ‘সহস্রাব্দের কণ্ঠস্বর’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অন্য নিরিখে দেখা

ছবি

হেলাল হাফিজের চলে যাওয়া

ছবি

হেলাল হাফিজের কবিতা

ছবি

কেন এত পাঠকপ্রিয় হেলাল হাফিজ

ছবি

নারী শিক্ষাবিদ : বেগম রোকেয়া

ছবি

বাসার তাসাউফ

ছবি

‘জগদ্দল’-এর শক্তি ও সমরেশ বসু

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

রুবেন দারিও-র কবিতা

‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’

ছবি

কবিতা পড়া, কবিতা লেখা

ছবি

‘ধুলোয় সব মলিন’, পাঠকের কথা

ছবি

মহত্ত্বর কবি সিকদার আমিনুল হক

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

কয়েকটি অনুগল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

যেভাবে লেখা হলো ‘শিকিবু’

ছবি

জাঁ জোসেফ রাবেয়ারিভেলোর কবিতা

ছবি

সিকদার আমিনুল হকের গদ্য

ছবি

সিকদার আমিনুল হককে লেখা অগ্রজ ও খ্যাতিমান লেখক-সম্পাদকের চিঠি

ছবি

ফিওদর দস্তয়েভস্কি: রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

একজন গফুর মল্লিক

ছবি

অগ্রবীজের ‘অনুবাদ সাহিত্য’ সংখ্যা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

গোপন কথা

ছবি

র’নবীর টোকাই-কথন

ছবি

শিল্পচর্চায় তরুণ প্রজন্ম অনেক বেশি ইনোভেটিভ

ছবি

শামসুর রাহমানের কবিতা বৈভব ও বহুমাত্রিকতা

ছবি

উইলিয়াম রাদিচের অধ্যয়নে অনন্য রবীন্দ্রনাথ

দিলারা হাফিজের কবিতা

ছবি

অবরুদ্ধ বর্ণমালার শৃঙ্খলমুক্তি

ছবি

আহমদুল কবির স্মরণে

ছবি

আহমদুল কবিরের সদাশয়তা

tab

সাময়িকী

সুবিমল মিশ্রের বিদায় অথবা

একটি দুর্বিনীত নাশকতার অন্তিম চিৎকার

গৌতম গুহ রায়

বৃহস্পতিবার, ০২ মার্চ ২০২৩

“লেখকেরা গল্প জানে না জীবন জানে আর

জীবন গল্পের থেকেও অশ্লীল”

-সুবিমল

৮ ফেব্রুয়ারি, সকাল বেলা এই সংবাদ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লো- ‘প্রথাবিরোধী সাহিত্যিক সুবিমল মিশ্র চলে গেলেন!’ এই খবরটা আসলে তৈরিই ছিলো। অসুস্থতা আক্রান্ত সুবিমল মৃত্যুর কাছে এদিন আত্মসমর্পণ করলেন বলা যায়। অধিকাংশ দৃঢ়চেতা ও আদর্শবাদী আপসহীন মানুষের শেষ সময় যেমন হয়, ক্ষমতার থেকে দূরে এক একক জীবন, কোনক্রমে চিকিৎসার আয়োজন, এক হতাশামগ্ন পরিণতি। সুবিমল মিশ্র, ‘আনপ্যারালাল’ এই লেখকেরও শেষ সময় খুব একটা ‘সুখের’ ছিল বলা যায় না। তাঁর লেখা নিয়ে বাণিজ্য করা মনুষদের অনেকেই না-জানার ভান করে শেষ সময়েও ‘নিরাপদ দূরত্ব’ বজায় রেখেছেন, গুটি কয়েক অনুগত সঙ্গী তাঁর অন্তিম দিনগুলোয় সাথে ছিলেন। এটা আমাদের যন্ত্রণার উপকরণ দিতে পারে মাত্র , উপশম দেবে না।

কে এই ‘দুর্বিনীবেরিয়ে পড়ছেন পরবর্তী বেরিয়ে পড়ছেন পরবর্তী ত’ সুবিমল, যাকে অনেকেই চেতনে এড়িয়ে যায়?

১৯৭১-এ পাঠকের হাতে পৌঁছল ‘হারান মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া অথবা সোনার গান্ধিমূর্তি’। একটা বড়সড় কম্পন। আরাম পিপাসু সাহিত্য পাঠকেরা হঠাৎ এই ধাক্কা সামলে উঠতে পারলেন না, নিরাপদ বলয় ভেঙ্গেচুরে খানখান হওয়ার আশঙ্কায় রব উঠলো, ‘না’ ‘না’-এ সাহিত্যই নয়। ঢিঢি রব উঠলো সাহিত্য নগরের নাগরদের কণ্ঠে। পাঠক, সময়টা লক্ষ্য করুন একবার- সাতের দশক। সমাজকে আঘাতের মধ্য দিয়ে মুক্তির দশকে পরিণত করার সংকল্প নিয়ে বাংলার তারুণ্য তখন জীবন বাজি রেখে পথে নেমেছে। শাসক সভ্যতার যাবতীয় শর্ত ভেঙ্গে হত্যার যজ্ঞ শুরু করেছে। সীমান্তে ওপারে তখন আর এক যুদ্ধ, মুক্তির সংগ্রামে বাংলার রক্ততেজ বন্দুক তুলে নিয়েছে। সেই সময়টাকেই যেন বেছে নিয়ে সাহিত্যের ‘তুলতুলে’ চর্বিস্ফিত শরীরটাকে আঘাত করার জন্য কলম তুলে নিলেন সুবিমল। প্রথম ধাক্কাতেই সাহিত্য বাণিজ্য কেঁপে উঠলো। কাপবেই না কেন? তাঁর টেক্সট আজও সেই কাঁপন শক্তি ধারণ করে আছে:

হারান মাঝির বিধবা বৌ বলত : শালার বামুন বুড়ো চাট্টিখানি খাইতে দ্যায় আর সময় নাই অসময় নাই খালি ঠাপানোর ধান্দা। পরজন্মে শালারা নরকের কুত্তা হবে।... সকলে সমবেত চমকালেন নাকে রুমাল দিলেন এবং বুঝতে পারলেন হারান মাঝির বোউ-এর মড়া না সরালে সোনার গান্ধীমূর্তি নাগাল পাওয়া যাবে না।

অথবা- ‘মনে হচ্ছে এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলেই রাণীর মৃতদেহ আবার জেগে উঠে বসবে এবং তার খোয়া যাওয়া অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো ফেরত চাইবে। (পরীজাতক)

আমাদের এই বাংলা ভাষা তার ঔপনিবেশিক সময়ে বেরে ওঠা গড়ন নিয়ে বিকশিত হয়েছে, সেই বিন্যাসকে ঘিরে আমাদের সাহিত্যের টেক্সট গড়ে উঠেছে, সেই টেক্সটের প্রতি সুবিমল সচেতনভাবে, আক্রমণাত্মক হয়ে পালটা যুদ্ধব্যবস্থা গড়ে তুলে ঐ গড়নটাকে ছিঁড়েফেড়ে ফেলে দেওয়ার নাশকতা চালিয়ে গেছেন চিরকাল। কিন্তু এই নাশকতার ভাষা ছিলো প্রত্যক্ষ: ‘বেশ্যার দালাল অথবা সুতারকিন বাগবাজারের সম্পাদক কাম সাহিত্যের আড়তদার যেই হোক না কেন, তাদের স্বরূপ নিয়ে বলতে যাও, শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষর্থে পুলিশ আসবেই। সবার আগে মধ্যবিত্ত কেরিয়ারিজমের বারোটা বাজানো দরকার ...

ময়দানে দাঁতের মাজনওয়ালারা এবার ভালো ভালো সব ম্যাজিক দেখাচ্ছে। ইয়া মোটা মোটা লোহার বালা গায়ের জোরে দুমড়ে দেওয়ার ম্যাজিক, কাটামু-র কথা বলার ম্যাজিক। দেখতে লোক জমে যাচ্ছে। বাংলা উপন্যাসের নায়িকারা ক্রমশ প্রোগ্রেসিভ হয়ে উঠছে। লেকের ধারে সন্ধ্যেবেলায় ছেলে বন্ধুর সঙ্গে কী করেছে নিঃসঙ্কোচে মাকে এসে বলছে নায়িকা। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা পাকা হয়েছে। ফসল কাটার মরশুমে চাষিরা নিজেদের শ্রমের ফসল জোতদারের ঘরে তুলতে অস্বীকার করলে শো শো ধুলো উড়িয়ে চলে আসছে পুলিশের জিপÑ শান্তিশৃঙ্খলা বড় আজব চিজ। রাধু ম-ল হাত কামড়াচ্ছে এই রাস্তা তারা কাজের বদলে খাদ্য নাকি এই রকম কী এক রাজকীয় উদ্যোগে বানিয়েছিল। রাধানাথের দুঃখ তার ম্যাট্রিক পাস করা ছেলে কাজ না পেয়ে লরি ড্রাইভারের সাগরেদ হয়েছে, বিনা মাইনের ক্লিনার। দিনরাত গ্যারেজে পড়ে থেকে, নেশা ভাঙ করতে শিখেছে এই ১৪ বছর বয়সেই, বাড়ি আসতে চায় না। অথচ কী যে ভালো ছিল ছেলেটা।... রাধানাথ এখন সপরিবারে বিড়ি শ্রমিক। শুধু সে বা তার বৌ নয়, স্বাধীনতার এই ৩০/৩২ বছর পরও তার ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরও পর্যন্ত ইসকুল যাওয়ার বদলে বাড়িতে বসে বিড়ি বাঁধতে হয়, পড়ার খরচ জোগানোর জন্য নয়, সংসারের সাশ্রয়ের জন্য। হাড়ভাঙ্গা খাটুনি, দিনরাত বসে কাজ, তামাকের ধূলোÑ মালিকের টাকার পাহাড় তুলতে গিয়ে ৮/১০ বছরের বাচ্চাদের ফুসফুসগুলো এই বয়সেই ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে। রাধানাথের এই বিড়ি বাঁধতে থাকা ছেলেরা কখনো শিশুবর্ষের নাম শোনার সুযোগ পাবে না। কথা হচ্ছে শিগগিরই এখানে একটা চেস্ট ক্লিনিক খোলা হবে। জায়গা নেওয়া হয়েছে ইস্টিশানে। ডোনেশন উঠেছে সাকল্যে হাজার আড়াইয়ের মতো। সেই টাকায় নাম খোদাই করা পাথরখানাই পোঁতা হয়েছে শুধু, আর একদিন শ্রমমন্ত্রী এসে ঘটা করে সেই পাথরের উদ্বোধন করে গেছে, কোল্ড ড্রিঙ্ক খেয়েছে। ব্যাস খেল খতম। (সজনে ফুলের ভাল চচ্চরি হয়, ১৯৭৯)

পূর্বে উল্লিখিত ‘হারান মাঝির বিধবা...’ আখ্যানে দেখা যায় এই বয়ানের তীব্র ঝলকানিতে থমকে যাওয়া পাঠক। “বৌটার আর কোন উপায় ছিল না, গলায় দড়ি দিয়ে মরল। বাইশ বছরী আঁটো মড়া এখন তরতর করে খালের ঘোলা জলে ভেসে যাচ্ছে। ... দেড় বছরের কালো রোগা পেটের পিলে বিশ্রীভাবে উঁচু হয়ে থাকা ছেলেটা কঁকিয়ে কঁকিয়ে এখন হাফিয়ে উঠেছে, ধুঁকছে।... মড়াটা ভেসে ভেসে কালিঘাটের দিকে চলে যাচ্ছে। কাকেরা পিছু নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল।... কালিঘাটে এসে লোকে এই জলে চান করে পাপ ধুয়ে ফ্যালে। হারান মাঝির বিধবা বৌয়ের শব কত দূরে কে জানে, কালিঘাটের দিকে ভেসে আসছে। হারান মাঝি বৌটাকে অনাথ করে গিয়েছিল, বৌটা মরে বাচ্চাটাকে অনাথ করে গেল। শিশুর শরীরে পাপ নাই, শিশু ঈশ্বরের তুল্যি, তুলে নিয়ে যাও পুণ্যি হবেÑ কারা যেন কথাগুলো বলে ওঠে।

হারান মাঝি মরে যাওয়ার পর সে মুড়ি বেঁচে পেট চালাতো। বামুনপাড়ায় অনেক শিক্ষিত লোকের বাস। তারা বাড়ির সামনে রজনীগন্ধার বাগান বানায়, পুজোর সময় নতুন কাপড়-জামা পরে, বানরের খেলা দেখে বাজিকরের দিকে টাকাটা-সিকিটা ছুড়ে দেয়, হারান-বৌয়ের আঁটো শরীর দেখে তাঁকে ধানভানারি রাখতে চায়। এহেন হারান-বৌয়ের বাইশবছরী আঁটো মড়া এখন তরতর করে খালের ঘোলা জলে ভেসে যাচ্ছে।...

...আমেরিকা থেকে সোনার গান্ধীমূর্তি খুব শিগগির এ দেশে আসছে খবরের কাগজে খুব বড় বড় হরফে ছাপা হয়ে বেরুল।... বামুনপাড়ার জমিদারবুড়ো সন্ধ্যেবেলা পুকুর ঘাটে হাত পা ধুয়ে খড়ম পায়ে বাড়িতে ঢুকতে যাচ্ছে এমন সময় তার পায়ের কাছে নরম মতো কি ঠেকে। লম্ফ নিয়ে এসে দ্যাখে হারান মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া। রাম রাম! এর কাছে ওর কাছে শুয়ে মাগিটা পেট করেছিল শেষ কালে কিনা বামুনের বাড়ির বারান্দায়। শহরের মেয়র বাথরুমে যাওয়ার উঠেছেন, রাত তখন দুটো, ঢুকতে গিয়ে দরজার কাছে বিশ্রী একটা পঁচা গন্ধ পেলেন, আলো জ্বালিয়ে দেখেন হারান মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া সেখানে পড়ে আছে। একজন বিখ্যাত জননেতা সারাদিন যিনি নানা ধরনের সমাজসেবায় ব্যস্ত থাকেন দুপুরের খাবার টেবিলে বসতে গিয়েই দুর্গন্ধ; টেবিলের ওপর হারান মাঝির বৌয়ের মড়া পরে আছে। ভোর রাতে ট্রাম চালাতে চালাতে ট্রাম-কনডাক্টার হঠাৎ নাকে রুমাল চেপে ধরে বিস্ফারিত চোখে দ্যাখে চলার পথ বন্ধ, রাস্তার উপর হারান মাঝির বৌয়ের মড়া শুয়ে আছে। সারা শহরময় খবর ছড়িয়ে পড়ল। সবাই ভীত, মরা মাছের চোখ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, গণ্যমান্যদের ঘরের চৌকির নিচে, আলমারির পেছনে, খাবার ঘরের মেঝেতে, কলতলায় অন্ধকারে হারান মাঝির বৌয়ের মড়া পাওয়া যাচ্ছে। দেড় বছরের সর্বহারা বাচ্চাটা কোন এক অপরিচিত মেয়ের বুকে সমানে কেঁদে চলেছে। খবরে বলল আমেরিকা থেকে সোনার গান্ধীমূর্তি দমদমের দিকে রওনা দিয়েছে। আকাশে অসংখ্য কাক-শকুনকে ঘুরে বেরাতে দেখা যাচ্ছে। নাগরিকেরা মুখে রুমাল চেপে সব সময় চলাফেরা করছেন। সারা শহর দুর্গন্ধে ভরে গেছে। সবাই ভীতসন্ত্রস্ত। কখনও না জানি কাকে হারান মাঝির বৌয়ের মড়ার পাল্লায় পড়তে হয়।... আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রধান তাঁর দস্তানাপরা হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন গান্ধীজীর সোনার মূর্তি স্পর্শ করার জন্য। সৈন্যবাহিনী রাজকীয় মর্যাদায় দাঁড়িয়ে আছে। রাষ্ট্রীয় পতাকা, সিল্কের তৈরি পৎ পৎ উড়ছে। ড্রাম বাজছে তালে তালে। অনেক ফালতু লোক ব্যাপারটা কি দেখার জন্য দূর থেকে উঁকি ঝুঁকি মারছে, তাদের ঘেষতে দেওয়া হচ্ছে না। একসময় বাক্সটার ডালা খোলা হলো, এবং সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত উপস্থিত জনবর্গ সবিস্ময়ে দেখলেন বাক্সটার উপরে হারান মাঝির বৌয়ের গলিত মড়াটি শোয়ানো রয়েছে। সকলে সমবেত চমকালেন, নাকে রুমাল দিলেন এবং বুঝতে পারলেন হারান মাঝির বৌয়ের মড়া না সরালে সোনার গান্ধীমূর্তির নাগাল পাওয়া যাবে না।”

এই আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়াই সুবিমলের সাহিত্যের নাশকতা। তার সাহিত্য সেই ‘এন্টি উপন্যাস’ Ñযা প্রচলিত পাঠের দিকে পাঠকুকে যেতে দেয় না, শুধু টেক্সোট নয়, সুবিমলের এই নাশকতার আখ্যানের প্রারম্ভ তার লেখার প্রচ্ছদ থেকেই শুরু হয়। তিনি সচেতনভাবে তার লেখার নামপত্র, প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে ভেতরেও নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালি রাখেন দুর্বিনীত সাহসের সঙ্গে। তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন যে খবরের কাগজ, চিঠি, লেখা, ইন্টারভ্যু-এর অংশ, রিপোর্টাজ এবং তুমুলভাবে ডাইরির অংশ ও তিনি নিজেও ব্যবহৃত হয়েছেন তার বইয়ে, এগুলো আমাদের কলোনিয়াল ভাষা নির্মিত উপন্যাস নয়, যথার্থই এন্টি উপন্যাস। খবরের কাগজের কাটিং কোটেশান বা কোটেশান বিকৃতি যাই হোক, তাঁর গোটা রচনা জুড়ে টের পাওয়া যায় এক অসাধারণ মুক্ত গদ্য। সুবিমল সেই গদ্যের ¯্রষ্ঠা যে গদ্য পাঠককে কোনো তৃপ্তি রেখায় পৌঁছে দিয়ে বলে না যে এই তোমার সীমান্ত, তাঁর টেক্সট প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় পাঠের পর পাঠকের পাঠ ধারণা পালটে যেতে পারে বা পাল্টাতে বাধ্য। সুবিমলের লেখা গল্পগুলো তাই বারংবার পড়ে দেখা যায়, স্তব্ধ হয়ে বসে নিজের অবস্থানকে অনুভব করা যায়, এখান থেকেই পাঠকের আর এক যাত্রা সূচিত হয়। প্রথাগত গল্প-উপন্যাসের ধারে কাছ দিয়ে যাতো না এই আখ্যান। প্রতিষ্ঠান যে সাহিত্যকে লাইলত করেছে, বানিজ্য করেছেÑ সুবিমলের সেই বাণিজ্যমুখি সাহিত্যর বিপ্রতীপে, প্রথা ও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা তার অভিমুখ। তিনি মনে করতেন প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা একটা টোটাল ব্যাপার। তাই আজীবন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাগজে তিনি লিখেননি। তিনি লিখেছেন, “প্রত্যেকের সফলতা খোঁজ করে, আমি খোঁজ করি অন্য কিছুর। আমার জীবনের প্রধাণ ব্যাপার হল হয়ে ওঠা, হয়ে ওঠার চেষ্টা, এই ‘চেষ্টা’ শব্দটির উপর আমি বিশেষভাবে জোর দিতে চাই, জীবনের শেষক্ষণটি পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে সক্রিয় থাকা, সম্পূর্ণভাবে দায়িত্ববান হওয়া।... নিজেকে ভাগুবান, ভাগ্য কিংবা এ ধরনের কারো হাতে ডুলে দেওয়া এক ধরনের কাপুরুষতা বলে আমি মনে করি। আর কাপুরুষতা আমি আদৌ পছন্দ করি না। সফলতা এলে আমি ভয় পাই। কারণ নতুন কিছু করলে সফলতা সঙ্গে সঙ্গে আসে না। আমি যদি সফলতা পাই তার মানে হলো আমি এমন কিছু করছিÑ যা তত নতুন নয়।” (বই সংগ্রহ-১)

সুবিমল মিশ্র তথাকথিত সাফল্যকে তোয়াক্কাই করতেন না। তিনি গল্প লেখার সময় তাই সামাজিক স্থিতিকে মাথায় রাখলেও সুখি সামজের প্রতিষ্ঠিত শর্তগুলোকে উপেক্ষ করেই এগোতেন। উদাহরণ হসাবে আমরা ‘পরীজাতক’ হাতে নিতে পারি। সুখময়, রজত, তমাল, দীপেনÑ এই চার বন্ধু ‘রানি’ নামের একটি মেয়েকে নিয়ে সমুদ্রের কাছে বেড়াতে গেছে। কিন্তু রাতে সমুদ্রস্নান সেরে তারা হোটেলে ফিরে দেখে রাণী মৃত। কিন্তু তাদের ভোগ্য হওয়ার আগেই এই ‘মৃত্যু’ তাদের কাছে রাণীকে হারামি বানিয়ে দেয়। “রানির স্বাস্থ্যের ওপর আমাদের লক্ষ ছিল। রানির পোশাকের ওপর আমাদের লক্ষ ছিল। কারণ আমরা জানতাম পড়ির মতো এই শড়ির খারাপ হয়ে গেলে রানি আমাদের কোনো কাজে লাগবে না। খারাপ দেখতে হয়ে গেলে রানিকে আমাদের দরকার থাকবে না। গরু বুড়ো ও অকর্মণ্য হয়ে গেলে যেমন কশাইয়ের কাছে বিক্রি করে দেয়, আমাদের সেই রকম অন্য জায়গায় রানিকে বেচে দিতে হবে...

... সমস্ত সভ্য জগতের দোহাই দিয়ে আমি বলতে পারি আমাদের কারোর মনে কোনো পাপ নেই। আমরা জানি কশাই তার বিক্রিত পশুর কোনো কিছুওই ফেলে না। তারা মাংস রক্ত তো বিক্রি করেই, এমনকী চামড়া। মাথার সিং, পেটের নাড়ি ভুঁড়িগুলো পর্যন্ত ফেলে না। আমরা মৃত রানির কাছ থেকে অল্প কিছু দাবি করতে পারি। তাতে মাদের ন্যায্য অধিকার...

...কথাটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই তিনিটে শরীর লাফিয়ে উঠল। এক ঝটকায় তারা মৃতদেহ থেকে খুলে ফেলল সাদা চামড়াটা। মোমবাতির আলোয় তাদের হাতে ছুরির ফলা ঝলসে উঠেছিল। তারা দ্রুত সেই শবদেহ থেকে বিশেষ বিশেষ স্থানের মাংস কেটে নিতে ব্যত হলো, মোমের আলোটা জ্বলছিল তখন সারা ঘরে।...’

এভাবেই এক মারাত্মক আখ্যন এগিয়ে চলে, যৌনতার ও বীভৎসতার। বিকৃত, বীভৎস প্রসঙ্গকে কেন্দ্রে রেখে বারবার বিন্যস্ত করতে থাকেন তাঁর এই আখ্যান।

বাংলা সাহিত্যে গল্প কিন্তু পাঠক লালিত গল্প নয় বা কাহিনী নির্মিত উপন্যাসের পালটা একটা ধরনের জন্ম হয়েছে, যাকে ‘এন্টি গল্প’ বা ‘এন্টি উপন্যাস’ বলে চিহ্নিত করা হয়। এমন ধারার চর্চা আলোচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাম সুবিমল মিশ্র। উদাহরণ হিসাবে আমরা দেখতে পারি উল্লিখিত ‘হারান মাঝির বিধবা...’, ‘বাগানের ঘোড়া নিমের গাছে দেখন চাচা থকতেন’ , ‘শিয়ালদা স্টেশান ও কপালকু-লা’, ’৭২-এর ডিসেম্বরের এক বিকেল’, ‘নাঙ্গা হাড় জেগে উঠেছে’, ‘টিয়াপাখিরগলায় নীল কণ্ঠি’, ‘আসুন ভারতবর্ষ দখে যান’ থেকে ‘পোদের গু তিন যায়গায় লাগে’। সুবিমল মিশ্র নিজের ও পাঠকের ভাষায় এই গদ্যকে ‘অন্টি-উপন্যাস’ বলা হয়। তাঁর প্রায় সমস্ত লেখাতেই রাজনৈতিক, সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতি দ্বিধাহীন বিশ্লেষণ ও মধ্যবিত্ত সমাজের যৌনতা নিয়েও যে ‘ছুঁয়োনা ছুঁয়োনা’ রয়েছে তার পালটা বিন্দু থেকে তিনি জেহাদ শুরু করেন। রাষ্ট্র ক্ষমতা, তার গোপন ও প্রকাশ্য নিপীড়ন, সুবিধাভোগী শ্রেণির প্রতি ব্যঙ্গ, অবক্ষয়, দ্বন্দ্ব ও নৈরাজ্য প্রভৃতি নিয়ে এক আপোসহীন আখ্যান রচনা করে গেছেন প্রতিষ্ঠান ও তাঁর প্রদত্ত যাবতীয় সুবিধাবাদী অবস্থানের বিপ্রতীপে থাকা সুবিমল মিশ্র। তাঁর প্রতিটি বয়ান এই অবস্থানের স্বাক্ষর বহন করে, ‘টাটা সেন্টারের দিকে তাকিয়ে শ্রেণিশত্রুকে চিনে নেওয়া সহজ কিন্তু গরিব চাষির ছেলে আমলা হয়ে পিতৃপরিচয় গোপন করলে যে সংস্কৃতি অকৃতজ্ঞ পুত্র বলে তাকে নিন্দা করতে ভালোবাসে এবং পরক্ষণেই চাষির ছেলে আই এ এস হয়েছে বলে মস্করা করতে ছাড়ে না, সেই সংস্কৃতিকে চিনে নেওয়া অতটা সহজ নয়...”

(ক্যালকাটা ডেটলাইন)

সুবিমল আমাদের ভাষার মুক্তির কারিগর, যে মুক্তির পথ বাতলে দিয়েছিলেন কমলকুমার মজুমদারÑ ‘ভাষাকে যে আক্রমণ করে সেই ভাষাকে বাঁচায়।’ সুবিমল মিশ্র এক স্পর্ধার নাম, যাকে দেখে শেখা যায়, কীভাবে নিজেকে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। সুবিমল বাংলা ভাষার একমাত্র লেখক, যিনি নিজের বিরুদ্ধে নিজেকে বাজি ধরেছিলেন। নিজের লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন আমৃত্যু। সুবিমলের মৃত্যু আসলে এক একলা লেখকের মৃত্যু। সুখি গৃহকোণের দুঃখ যন্ত্রণার ভাতঘুমের আখ্যান তিনি লিখতে বসেননি, তাঁর লেখা ছিলো বাজার চলতি বাস্তবতাগুলোকে অবিশ্বাস করতে শেখানোর কৌশল। তিনি বলতেনÑ সুবিমল, নিজেকে নিজে আক্রমণ করার জন্য তৈরি থাকো। আজীবন যিনি একা একা যুদ্ধে ছিলেন নিজেই নিজের সেনাবাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র যা কিছু তাঁর নিজেরই। সীমাহীন শক্তিধর গদ্য ছিলো তাঁর আয়ুধ। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তাই তিনি নিজেকে অবিরাম ভেঙেছেন আবার গড়েছেনÑ থমকে থাকেননি। কেটেছেন আবার জুড়েছেন, নিজের সচেতন পোস্টমর্টেমও করেছেন নিজেই। এই কারণে তাকে প্রতিণ্ঠানকে তোয়াক্কা করতে হয়নি।

back to top