alt

সাময়িকী

সাহিত্যের দর্শনানুসন্ধান

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

: বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

কবিতাই প্রথমে এসেছে, তারপরে দর্শন। কিন্তু কবিতা দর্শনকে খুঁজেছে, যদিও দু’য়ের মধ্যে ব্যবধান বিস্তরÑ জন্মসময়গত যতটা তার চেয়ে অনেক বেশি চরিত্রগত। কবিতার তথা সাহিত্যের উপজীব্য হচ্ছে বিশেষ, দর্শনের নির্বিশেষ; তাদের অবলম্বন ভিন্ন ভিন্ন; সাহিত্য বিশ্বাস করে সংশ্লেষণে, দর্শন বিশ্লেষণে। তবু সাহিত্যের এই দর্শনানুসন্ধান অপরিহার্য। কেননা মানুষের বিশেষ অনুভূতিগুলোর প্রবণতা থাকে নির্বিশেষ সরলীকরণের দিকে; সব সময়ই তাই দেখা যায় তারা কোনো জ্ঞানের অভিমুখে যেতে চাইছে। অন্যদিকে আবার দর্শন যদিও বিশ্লেষণধর্মী ও চিন্তানির্ভর, তথাপি দর্শন বিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞানের মতো খ- খ- করে অবলোকন করে না সে জীবন ও জগৎকে সংলগ্ন ও ঐক্যবদ্ধ করতে চায়, অনেক সময় আকাক্সক্ষা রাখে সমগ্রকে ব্যাখ্যা করবে একক কোনো মানদ-ে। তবে সত্য থাকে এটা যে, দর্শনের তবু সাহিত্যকে বাদ দিলে চলে, কিন্তু সাহিত্যের কখনোই চলতে পারে না দর্শনকে বাদ দিয়ে।

https://sangbad.net.bd/images/2024/September/19Sep24/news/lit-1.jpg

তাই দেখি ইন্দ্রিয়সংবেদী যে-কবি কিটস, চরমভাবে আস্থা রেখেছিলেন ঝবহংধঃরড়হং-এ, তিনিও বারংবার বলেছেন দর্শনের কথা, ভয় পাচ্ছেন চিন্তাবিহীন অনুভবকে, দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছেন মননশীলতার দিকে, এবং গভীরতম অনুভব শক্তির প্রকাশে সমৃদ্ধ কবিতাসমূহেও অনুপ্রাণিত দার্শনিক উক্তি করেছেন। সেটা একটা দিক। অপরদিকে এও অনিবার্য সত্য যে, কোনো মানুষই তার সমসায়িক দার্শনিক আবহাওয়ার বাইরে নয়, কোনো লেখক তো ননই। যেমন করে ভৌগোলিক জলবায়ু প্রবাহিত করে মানুষের দৈহিক স্বাস্থ্যকে ঠিক তেমনিভাবে দার্শনিক আবহাওয়া প্রভাব রাখে মানসিক স্বাস্থ্যে। এই প্রভাব একজন লেখক অন্য মানুষের তুলনায় অধিক পরিমাণে গ্রহণ করে, কেননা লেখক সাধারণ-মানুষের তুলনায় অধিক সংবেদনশীল, গ্রহণক্ষম। টেনিসনের ওহ গবসড়ৎরধস কবিতায় বিবর্তনবাদী চিন্তার উপস্থিতি কোনো গোপন ব্যাপার নয়; কিন্তু এই কবিতা লেখা হয়েছিল ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের বই প্রকাশের নয় বছর আগে। ডারউইনের বই প্রকাশের পূর্বেই বিবর্তনবাদী চিন্তা অগ্রসর হয়ে এসে পৌঁছেছিল মানুষের মনে, এবং সেই অগ্রসর চিন্তা থেকে দূরে ছিলেন না কবি টেনিসন, যিনি সৌন্দর্যপিপাসু মূলত, যার বিশেষ দক্ষতা দার্শনিক ভাবনায় চঞ্চল অনুসরণে নয়, অনুভবের অচঞ্চল চিত্রায়নে।

জীবনানন্দ দাশ ও জসীম উদ্দীন সমসাময়িক কবি। দু’জনেই পূর্ববঙ্গের মানুষ, শ্যামল ও সিক্ত প্রকৃতির প্রতি দু’জনেরই গভীর ভালোবাসা। কিন্তু তাঁদের কবিতায় যে পারস্পরিক দূরতিক্রমণীয় ব্যবধান তার কারণটা মূলত দার্শনিক। সময়কে জয় করবার প্রয়োজনে বিপন্ন জীবনানন্দ যে একটি ইতিহাসচেতনা নীরবে গড়ে তুলেছিলেন নিজের মতো করে, জসীম উদ্দীনের লেখায় তেমন কোনো দার্শনানুসন্ধান আমরা পাবো না। এখানে জীবনানন্দ অনেক বড় জসীম উদ্দীনের তুলনায়, একই সঙ্গে তিনি বৈচিত্র্যপূর্ণ ও গভীর। অথবা ধরা যাক কাজী নজরুল ইসলামের কথা। বড় মাপের কবি তিনি। কিন্তু মনে হবে বড়ই অগোছালো, অনেক সময় স্ববিরোধী। তবু নজরুল ইসলামের ভেতর ন্যায়-অন্যায়ের জন্য প্রখর বোধ আছে, রয়েছে সুন্দর জীবনের জন্য আকাক্সক্ষা, আর তার বিপরীতে অসুন্দরের জন্য প্রবলতর ঘৃণা, দেখা যাবে প্রবহমান ও নির্যাতিতের ব্যাপারে তিনি আগ্রহী। সব মিলিয়ে একটি দার্শনিকতা রয়েছে, যেমনটা আমরা পাই ইংরেজি রোমান্টিক কবিদের লেখায়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে একজন কালজয়ী সাহিত্যিক সে কেবল হৃদয়গ্রাহী ও কৌতূহলোদ্দীপক গল্প বলার দরুন নয়, আরো বড় কারণ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, যাতে রয়েছে মানুষের জন্য গভীর মমতা, এবং যে-দৃষ্টিটি উল্লেখযোগ্য এই বৈশিষ্ট্যের কারণেও বটে যে এতে একই সঙ্গে রয়েছে সামন্তবাদের প্রতি ঘৃণা ও ভালোবাসা।

রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে সৃজনীকল্পনা ও দার্শনিকতা হাত ধরাধরি করে আছে। একাধারে তিনি ইহজাগতিক ও আধ্যাত্মিক। তাঁর রচনাতে রক্ত-মাংসের মানুষেরা রয়েছে, তাদের নিজস্ব দাবি নিয়ে। বহু বিষয়ে তাঁর বৈজ্ঞানিক কৌতূহল। সমসাময়িক জগৎ ও ঘটনা সম্পর্কে তিনি সজাগ, যেমন সচেতন অতীত ইতিহাস বিষয়ে। গতির প্রতি তাঁর স্বাভাবিক পক্ষপাত। অন্যদিকে আবার রয়েছে তাঁর ধর্মচেতনা। তিনি উপনিষদের উত্তরাধিকারী, কিন্তু তাই বলে ধর্মের ব্যাপারে তাঁর নিজস্বতা অনুপস্থিত নয়। ধর্ম তাঁকে সাম্প্রদায়িক করেনি, বরঞ্চ বাংলা সাহিত্যকে তিনি যে-পরিমাণে অসাম্প্রদায়িক করে গেছেন তাঁর আগে তেমনটি করতে আর কেউ পারেনি। এবং এও মোটেই তাৎপর্যহীন নয় যে তাঁর গান যেমন ভারতের তেমনি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বহুমুখিতা ও বৈচিত্র্যকে ধারণ করে রয়েছে একটি দার্শনিকতা, যেটি ছাড়া তাঁর সাহিত্যকে ভাবা যায় না। রবীন্দ্র সাহিত্য অবশ্যই আদর্শ-নিরপেক্ষ নয়, রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত গভীরভাবে আদর্শবাদী।

সাহিত্যিক-শ্রেষ্ঠ শেক্সপিয়র প্রচারক ছিলেন না আদৌ, কোনো বিশেষ দার্শনিক মতবাদের স্থিরপ্রতিজ্ঞ উপস্থাপকও নন তিনি, জীবনের জটিলতাকেই নাট্যায়িত করেছেন এই লেখকÑ নিরাসক্ত পক্ষপাতবিহীন অবস্থানে দাঁড়িয়ে। তিনি দার্শনিক নন, দান্তে নন, গ্যেটে নন, নন টলস্টয়Ñ কিন্তু তাই বলে কি তাঁর রচনাতে জীবনের কোনো ব্যাখ্যা নেই, চিন্তা নেই গভীরতম? অবশ্যই আছে। বস্তুত শেক্সপিয়রের রচনায় অনুভূতি ও চিন্তাশক্তিÑ এই দুই শত্রুর মধ্যে জীবনমরণ, সামনা-সামনি সমান-সমান মল্লযুদ্ধের যে চিত্র কোলরিজ দিয়েছেন তা অসত্য নয় কোনো দিক দিয়েই। সাদায়-কালোয় জীবন আঁকেননি তিনি, শুভ ও অশুভ সর্বক্ষণ আছে তাঁর লেখায়, আছে তাদের ক্ষান্তিহীন রক্তাক্ত দ্বন্দ্ব। রেনেসাঁ ও রিফরমেশনের যে দার্শনিক আবহাওয়ার মধ্যে শেক্সপিয়রের অবস্থান তা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর সাহিত্যে শুধু প্রতিফলিত নয়, সেই আবহাওয়া গভীরতর ও সমৃদ্ধতর হয়ে উঠেছে তাঁর রচনার মধ্য দিয়ে। ঈশ্বর নয়, মানুষই থাকবে বিবেচনা ও মূল্যবোধের কেন্দ্রভূমিতেÑ এই দর্শন রেনেসাঁ শিখিয়েছে তাঁকে। মানুষের চরিত্র যে অপার বিস্ময়ের এক রহস্যলোক এই বোধও রেনেসাঁরই। রিফরমেশন দৃঢ়তর করেছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের এই চেতনাকে, ধর্মের ক্ষেত্রে বিবেকের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে নিয়ে। সেই সঙ্গে ধর্মনিহিত মূল্যবোধকেও গ্রহণ করেছেন শেক্সপিয়র, এলিজাবেথীয় জগৎ-দৃষ্টিকেও। স্পেনীয়দের পরাজিত করে এবং নাবিকদের সাহায্যে নতুন নতুন দেশ আবিষ্কার করায় যে বহির্মুখী উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছিল সেকালে তার প্রভাবও পড়েছে শেক্সপিয়রে। এক কথায় বলতে গেলে, ইহলৌকিকতার এবং জীবনকে নিরুদ্বেগে নির্দ্বিধায় গ্রহণের ফলে যে একটি মানববাদী শক্তি তৈরি হয়েছিল, সেই শক্তিই আপন সৃজনক্ষমতা অবারিত করেছে শেক্সপিয়রের অসামান্য রচনাবলির মধ্যে দিয়ে। শেক্সপিয়রের ব্যক্তি-মনীষাকে খাটো করার আবশ্যকতা নেই, কিন্তু তাঁর মনীষা অবশ্যই একটি বিশেষ সামাজিক ও দার্শনিক পরিবেশের আনুকূল্যে বিকশিত হয়েছিল; সেই পরিবেশটি মোটেই উপেক্ষণীয় নয়। গ্রিক নাট্যকাররাও তেমনি, একটি বিশেষ আবহাওয়ার মানুষ তারা এবং তিনজন শ্রেষ্ঠ গ্রিক নাট্যকার যখন একই বিষয়ের ওপর তিনটি সম্পূর্ণ ভিন্ন নাটক রচনা করেন তখন একটি বড় ও সাধারণ দার্শনিক পরিমগুলের ভিতরে থেকেও তাঁদের নিজস্ব দার্শনিক অবস্থানের স্বাতন্ত্র্য উদ্ভাসিত করেন তাঁরা। কিটসের মধ্যে শেক্সপিয়রের গুণ ছিল। কিন্তু কিটসের তুলনায় শেক্সপিয়র যে বড় লেখক তার একমাত্র কারণ এটা নয় যে, শেক্সপিয়র দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিনে কিটসের তুলনায়, কারণ এটাও যে শেক্সপিয়রের দর্শনিকতা গভীরতর ছিল কিটসের অপেক্ষা। ট্র্যাজেডি গীতিকবিতার চাইতে উচ্চতর রূপকল্প-দার্শনিক গভীরতার কারণে। মূল কথা দাঁড়ায় তাহলে এই রকম। কোনো লেখকই দার্শনিক বলয়ের বাইরে নন, তখন তো ননই যখন তিনি সেই বলয়কে মান্য করেন, যেমন শেক্সপিয়র করেছেন; তখনো নন যখন তিনি তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন, যেমন মাইকেল মধুসূদন করেছিলেন। মাইকেল প্রসঙ্গ এলে স্মরণ করা যায় যে, তাঁর ওপর হোমার-মিল্টনের সাহিত্যিক ও দার্শনিক প্রভাব সক্রিয় ছিল। সেই তুলনায় তাঁর লেখায় শেক্সপিয়রের প্রভাব অল্প। অন্য বাঙালি লেখকদের ক্ষেত্রে ঐ নাট্যকারের প্রভাব নেই বললেই চলে। প্রভাব পরের কথা, শেক্সপিয়রের মৃত্যুর এতো বছর পরেও বাংলায় তাঁর একই সঙ্গে যথার্থ অনুবাদ পর্যন্ত হয়নি। বিশেষ করে তাঁর ট্র্যাজেডির। এর কারণ ভাষাতাত্ত্বিক তো বটেই, তার চেয়েও অধিক পরিমাণে দার্শনিক।

যে-বিশেষ দার্শনিক পরিম-লে শেক্সপিয়রের অবস্থান বাঙালি মনন থেকে তার দূরবর্তিতা, নিতান্ত সামান্য নয়। শেক্সপিয়রের ‘দি টেমপেস্ট’ নাটক সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যটি তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি লিখেছেন, “নাটকের নামও যেমন তাহার ভিতরকার ব্যাপারও সেইরূপ। মানুষে প্রকৃতিতে বিরোধ এবং সেই বিরোধের মূলে ক্ষমতালাভের প্রয়াস। ইহার আগাগোড়া বিক্ষোভ।” এই বিক্ষোভ পছন্দ হয়নি রবীন্দ্রনাথের। না-হবার কারণটি নিছক ব্যক্তিগত নয়, ব্যক্তিগত হয়েও সমষ্টিগত ও আদর্শিক বটে। এই আদর্শগত কারণেই আমাদের পক্ষপাত গীতিকবিতার প্রতি। নাটক এসেছে ধীরে ধীরে। এবং সেখানেও কমেডি প্রাধান্য পেয়েছে ট্র্যাজেডির তুলনায়। ট্র্যাজেডি চূড়ান্তরূপে ইহজাগতিক, অন্যপক্ষে বাঙালি জীবনে সুপ্রতিষ্ঠাত ধর্মভিত্তিক ভাববাদ শিক্ষা দেয় জগৎ অনিত্য, নিত্য হচ্ছে মানুষের আত্মা ও তার পরকাল। ইহকালের দুর্ভোগ চূড়ান্ত নয়, বরঞ্চ দুর্ভোগের পুরস্কার পাওয়া যাবে পরলোকেÑ এই যে ধারণা, এ ধারণা ট্র্যাজেডির জন্ম-বিরোধী। শুধু ভাববাদের কারণে নয়, দারিদ্র্যের কারণেও ‘মরলে বাঁচি’র জীবনদর্শন গড়ে উঠেছে এই দেশে। এই দর্শন ট্র্যাজেডির শত্রু; ট্র্যাজেডি মরার পরে বাঁচার কথা বলে না, বাঁচার মধ্যে বাঁচাকেই চরম ও চূড়ান্ত জ্ঞান করে। তপোবনে দ্বন্দ্ব নেই, কেননা সেখানে অশুভ নেই প্রতাপান্বিত। পরলৌকিক স্বর্গেও ঐ একই ব্যাপার। আমাদের শুভ সংঘর্ষে যেতে চায় না অশুভের সঙ্গে, ফলে তার শক্তি কখনো যথার্থ বিকাশিত ও সম্পূর্ণরূপে পরীক্ষিত হতে পারে নি। শুভ-অশুভের দ্বন্দ্ব নিতান্তই যখন অনিবার্য হয়ে ওঠে সাহিত্যে নিরুপায় লেখক তখন পক্ষ নেন, বিপন্ন হয়ে অশুভ তাঁর ব্যক্তিগত শত্রুতে পরিণত হয়েছে মনে হয়। তিনি সমবেদনা প্রকাশ করেন শুভের জন্য এমনকি অশ্রুপাতও করতে বলেন পাঠককে, যেমন শরৎচন্দ্র বলেছেন, ‘দেবদাস’-এর অন্তিম লাইনগুলোতে।

এই ভাববাদী ও তপোবনপ্রিয় চেতনায় ট্র্যাজেডি অনাহূত স্বভাবতই। গিরিশ ঘোষ ‘ম্যাকবেথ’ অনুবাদ করেছিলেন। তিনি নিজেই বলেছেন ঐ নাটক দু-চারদিনের বেশি চলে নি, শূন্য হয়ে গেছে রঙ্গালয়, পরে যখন ‘আবু হোসেন’ এলো তখন, যেন ভোজবাজি, আবার ভরে উঠলো আসনসমূহ। পাঠক-দর্শক হাসি চায়, পরিহাস চায়; চায় উৎফুল্লতা, চায় না দুর্ভোগ, চায় না দ্বন্দ্ব। তার সাহস নেই, তার প্রয়েজনও নেই, আপন ঘরে দুর্ভোগ যার নিত্যসঙ্গী, কোন দুঃখে সে দুঃখ খুঁজবে রঙ্গমঞ্চে।

শেক্সপিয়র অনুবাদ-ব্যর্থতার ভাষাতাত্ত্বিক কারণটাও দর্শন-নিরক্ষেপ নয়। ভাষা ওপর থেকে আসে না, নিচের থেকেই গড়ে ওঠে; ওপর থেকে এলেও টেকে না, টেকে তা-ই যা গড়ে উঠেছে নিচের প্রয়োজনে। বাংলা বাঙালি মানসেরই ভাষা। এই ভাষার বিজ্ঞান-চর্চার ছাপ যেমন সামন্য তেমনি, সামান্য দর্শন চর্চার চাপ। কারণটা অন্য কিছু নয়। সেটি হচ্ছে এই যে, আমাদের চেতনায় কাব্যের শান্ত ও নিরীহ কিন্তু শক্ত ও অচঞ্চল আচ্ছাদনটি ভেদ করে মননশীলতার, বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলনের প্রবল ঐতিহ্য গড়ে ওঠেনি। আমাদের প্রধানতম গৌরবের গীতিকবিতা, প্রধানতম অগৌরব বিজ্ঞানের ও দর্শনের অভাব। সেই গৌরব ও অগৌরবের যুগ্ম পতাকা ভাষা তার পেলবতা ও কাব্যময়তার মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত আন্দোলিত করছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনাকালে একজন সমালোচক বলেছিলেন বাংলা ভাষা কেবলি এলাইয়া এলাইয়া পড়ে, ধরি ধরি করিয়া তাহাকে রাখা যায় না সে সত্য অপ্রমাণিত হয় নি অদ্যাবধি।

রবীন্দ্রনাথ ‘ম্যাকবেথে’র অনুবাদ করেছিলেন, তার গৃহ-শিক্ষকের শাসনের মুখে। সে-অনুবাদ হারিয়ে গেছে, রক্ষা করার মতো আগ্রহ কবির ছিল না নিশ্চয়ই। সেই অনুবাদের অনবলুপ্ত প্রথম দৃশ্যে এই ধরনের পংক্তি আছে, ‘পোড়ামুখী বোল্লে রেগে ডাইনী মাগী যা তুই ভেগে।’ ঐ যে শব্দ ‘মাগী’ তা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ঐ পরিবেশে। অনায়াসে বিদ্যাসাগর ব্যবহার করেছেন এ-শব্দ। পরে মধ্যবিত্ত মানসের বর্জনবিলাস এইসব শব্দ অশ্লীল জ্ঞানে জিভে কেটে পরিত্যাগ করেছে। বলাই বাহুল্য, এর কারণ ভাষাতাত্ত্বিক নয়, মনস্তাত্ত্বিক। এই প্রবণতা শেক্সপিয়রের নিজের কালে ছিল না এবং ছিল না বলেই তিনি তাঁর রচনাবলি সৃষ্টি করায় আনুকূল্য পেয়েছিলেন। আমরা শেক্সপিয়রের যথেষ্ট ও যথার্থ অনুবাদ করতে পারি নি, কেননা আমাদের মনস্তাত্ত্বিক পরিধিটা এখনো বিস্তৃতির ও গভীরতার অপেক্ষায় আছে।

রবীন্দ্রনাথ অন্য সবার চেয়ে বড়; কিন্তু ভক্তিবাদের অবস্থান তাঁর সাহিত্যেও উজ্জ্বল। তাঁর বিশ্বাস “স্থুলত্ব বর্জন করতে তপস্যার মধ্য দিয়ে মানুষই দেবতা হয়ে উঠবে।” এই বিশ্বাসে উঁচু আশাবাদ আছে, কিন্তু মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখবার বাস্তবিক ইচ্ছার কিছুটা অভাব রয়েছে। মানুষ মানুষই, এই সত্য এমনকি রবীন্দ্রনাথও গ্রহণ করছেন না, মানুষকে দেবতা করতে চাইছেন। তদুপরি মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশ যে তপস্যার দ্বারা হয় না, হয় সংগ্রাম ও দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে এই বৈজ্ঞানিক সত্যও অস্বীকৃত রয়ে যাচ্ছে। রক্ত-মাংসের মানুষ রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্যে উপস্থিত আছে। কিন্তু তিনি প্রধানত কবি-ই, ঠিক যে-অর্থে শেক্সপিয়র প্রধানত নাট্যকার, এবং তাঁর কবিতায় মানুষের চাইতে মানুষ্যত্ব সম্পর্কে তাঁর ধারণাটাই বড়, দ্বন্দ্বের চাইতে অধিক মূল্যবান, সমন্বয়। যেন তপোবনই চাইছেন তিনি তপস্যার জন্য।

‘গীতাঞ্জলি’র সেই অসাধারণ চরণগুলো স্মরণ করা যাক, যেখানে বলেছেন তিনি যে ঈশ্বর স্থপতিনির্মিত মন্দিরে নেই, তিনি আছেন “যেথায় মাটি ভেঙ্গে করছে চাষা চাষ/ পাথর ভেঙ্গে কাটছে সেথায় পথ খাটছে বারো মাস/ রৌদ্র জলে আছেন সবার সাথে/ ধূলা তাঁহার লেগেছে দুই হাতে।” কিন্তু কর্মের এই যে জগৎ সেও তো মন্দিরই, বৃহৎ মন্দির। অথবা তপোবন একটি। শ্রমিককে শ্রমিক হিসাবে স্বীকার করছেন না কবি, দেখছেন তাকে ঈশ্বরের প্রকাশ-ভূমি হিসাবে। শ্রমিক কিন্তু নিজেকে জানে মেহনতি মানুষ বলেই; ঈশ্বর তাকে সুখ দেয় নি, মেহনত দিয়েছে, দিয়েছে অনাহার ও দারিদ্র্য। এভাবে রবীন্দ্রনাথ বাস্তবকে কোথাও কোথাও অবাস্তব করে তুলেছেন তাঁর আলোকসামান্য প্রতিভার যাদুকরী ও গীতিময় স্পর্শে। ‘মানুষের ধর্মে’ তিনি জ্ঞান, অনুভূতি ও কর্মের মাধ্যমে জগৎকে জানার বিষয়ে বলেছেন, বলে নিয়ে নিজের স্বাভাবিক পক্ষপাত প্রদর্শন করেছেন অনুভূতির প্রতি। জ্ঞান ও কর্ম কম মূল্য পেয়েছে, তুলনায়।

জ্ঞান ও কর্মের এই অবমূল্যায়ন অধিকাংশ লেখকের বেলাতেই সত্য। কল্লোল যুগের লেখকেরা হুজুগ তুলেছিলেন বিদ্রোহের। বিদ্রোহ ছিল যৌনালোচনা সম্পর্কে সামাজিক নিষেধের এবং রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক নীতির বিরুদ্ধেই মূলত। কিন্তু সেই বিদ্রোহে বড় একটা স্থান ছিল না জ্ঞান ও কর্মের, উচ্ছ্বাস ছিল অনুভূতির। এই বিদ্রোহীদের জগৎটাও ভাববাদী। তফাৎ এই পরিমাণ যে, কর্মের স্থলে এঁরা স্থাপন করেছেন আবেগকে, আবেগের কাছ থেকে এঁরা সেই ধরনের তৃপ্তি কামনা করেছেন ধার্মিক যা পায় ধর্মানুশীলনের মধ্য দিয়ে। ‘বেদে’র লেখক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত যখন পরমহংসের জীবনী রচনায় নিয়োজিত হন তখন বিস্ময়ের সত্যি কোনো কারণ থাকে না। কেননা তিনি এবং তাঁরা সকলেই ভাববাদীই ছিলেন, শুরু থেকেই, একটা ভাব অন্য একটা ভাবের জন্য জায়গা করে দিয়েছে মাত্র, এর বেশি না। তবু মানতেই হবে যে, ‘বেদে’র জীবন থেকে পরমহংসের জীবনে আসা জীবন-সংকোচন এক প্রকারের। যেমন, রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’র জগৎ থেকে বুদ্ধদের বসুর উপন্যাসে আসা উন্মুক্ত প্রান্তর থেকে সরে এসে বন্দী হওয়া ড্রয়িং রুমে। ড্রয়িং তথা বদ্ধঘরের দিকেই গোপন ও সক্রিয় পক্ষপাত অধিকাংশ লেখকের। সেই জন্য পরবর্তীকালে দেখি সমরেশ বসু গঙ্গার তীর ভেঙ্গে আহ্লাদিত চিত্তে বিবরে প্রবেশ করছেন মধ্যবিত্ত কলকাতায়। সেই একই পলায়ন, জীবন থেকে। জীবনকে পুঁজি হিসেবে সঙ্গে নেননি, নিয়েছেন জীবন সম্পর্কে খ-িত কিছু ধারণাকে। পুঁজি নিঃশেষিত হয়ে গেছে দ্রুত, তখন তাঁরা, নানাবিধ উত্তেজনাকে মূলধন হিসাবে নিযুক্ত করবেন ভেবেছেন তাঁদের লেখায়। অনেক দিক দিয়ে শরৎচন্দ্র অত্যন্ত বস্তুবাদী। কিন্তু তিনি আবার ভাববাদীও, সংস্কারে বিশ্বাস রাখেন আস্থা রাখেন ভক্তিতে, পরিত্যাজ্যকে মোহনীয় করে তোলেন নানাভাবে। চেতনাগত পরিচয়ে তারাশস্কর হচ্ছেন সংশোধিত শরৎচন্দ্র।

গদ্যের যদি অবস্থা হয় এমন তবে কবিতার পরিস্থিতি অধিকতর শোচনীয় হতে বাধ্য। হয়েছেও তা-ই। সেখানে ব্যক্তির সমন্বয়বাদী ও গীতিধর্মী অনুভবই প্রধান সত্য এবং সেই অনুভব জীবনে যেমন সাহিত্যেও তেমনি ইন্দ্রিয়-সংবেদী ও প্রগতিবিরোধী। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বুদ্ধদেব বসুর মধ্যে মনে হবে দূরত্ব অধিক, কিন্তু দূরত্ব নেই প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁরা উভয়েই ভাববাদী। ব্যতিক্রম কি নেই? আছে। বিদ্রোহ হয়েছে। বিদ্যাসাগর করেছেন বিদ্রোহ, করেছেন মধুসূদন, নজরুল, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য। কিন্তু এদের সকলেরই পরিণতি বেশ করুণ, তাঁদের লেখা মূল ধারায় পরিণত হতে পারেনি। সমাজ, এমনকি প্রকৃতিও সহ্য করতে চায়নি তাঁদের দার্র্শনিক বিদ্রোহকে। এখনকার মধ্যবিত্ত সংস্কৃতি বশ্যতার বটে বিদ্রোহের নয়।

রবীন্দ্রনাথ যথার্থ বলেছেন বাংলা সাহিত্যে নারীর মর্যাদা পুরুষের তুলনায় অধিক। তাঁর মতে, পুরুষ এখানে ‘মহাদেবের ন্যায় নিশ্চলভাবে ধূলিয়ান এবং রমণী তাহার বক্ষের উপর জাগ্রত জীবন্তভাবে বিরাজমান।’ এর কারণ হিসাবে তিনি সরাসরি বলেছেন পুরুষ এদেশে অকর্মা। কিন্তু অকর্মন্যতা একমাত্র কারণ নয়, সাহিত্যে নারীর আধিপত্যের আরো একটি কারণ বোধ করি এই যে, এ সাহিত্য অত্যন্ত কোমল, ভাবালু ও তরলানুভূতিপ্রবণ এককথায় বেশ মেয়েলি। দার্শনিক চিন্তায় তা যথেষ্ট পুষ্ট বা সমৃদ্ধ নয়। অবশ্যই সেই অপুষ্টি ও অসমৃদ্ধি রবীন্দ্রনাথ-নিদের্শিত অকর্মন্যতা থেকে এসেছে বললে উগ্র কথা বলা হবে না। (বাকি অংশ আগামী সংখ্যায়)

ছবি

অর্ধেক জীবন

ছবি

ক্যান্ডি, শ্রীলঙ্কায় বেড়ানোর আদর্শ জায়গা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

‘দূরের কার্নিশ’

ছবি

কবিতায় উড়ন্ত সারস

ছবি

রবীন্দ্রসংগীত চর্চা, বাংলাদেশে-

শক্তিমান কবির কলমে গল্প

ছবি

শহীদুল হকের জীবন ও আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতা

ছবি

জলবন্দী স্বপ্ন

সাময়িকী কবিতা

ছবি

কমল চক্রবর্তী, আদি ও অকৃত্রিম রিংমাস্টার

ছবি

নূরুল হক : আধুনিক মরমি কবি

ছবি

ও. হেনরি : ছোটগল্পের কালজয়ী অগ্রদূত

ছবি

নজরুল : বিশ্বতোরণে বৈজয়ন্তী মানব-বিজয়-কেতন

ছবি

নিছক সাজুর গল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

কবিতায় বিশ্বস্ত স্বর

ছবি

স্মৃতির আয়নাজুড়ে শহীদ ভাই

ছবি

ব্যক্তিগত শহীদ

ছবি

দূরের তারাটিকে

ছবি

একটি দুর্বিনীত নাশকতার অন্তিম চিৎকার

ছবি

যেদিন সুবিমল মিশ্র চলে গেলেন

ছবি

ফিরবে না তা জানি

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

tab

সাময়িকী

সাহিত্যের দর্শনানুসন্ধান

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

কবিতাই প্রথমে এসেছে, তারপরে দর্শন। কিন্তু কবিতা দর্শনকে খুঁজেছে, যদিও দু’য়ের মধ্যে ব্যবধান বিস্তরÑ জন্মসময়গত যতটা তার চেয়ে অনেক বেশি চরিত্রগত। কবিতার তথা সাহিত্যের উপজীব্য হচ্ছে বিশেষ, দর্শনের নির্বিশেষ; তাদের অবলম্বন ভিন্ন ভিন্ন; সাহিত্য বিশ্বাস করে সংশ্লেষণে, দর্শন বিশ্লেষণে। তবু সাহিত্যের এই দর্শনানুসন্ধান অপরিহার্য। কেননা মানুষের বিশেষ অনুভূতিগুলোর প্রবণতা থাকে নির্বিশেষ সরলীকরণের দিকে; সব সময়ই তাই দেখা যায় তারা কোনো জ্ঞানের অভিমুখে যেতে চাইছে। অন্যদিকে আবার দর্শন যদিও বিশ্লেষণধর্মী ও চিন্তানির্ভর, তথাপি দর্শন বিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞানের মতো খ- খ- করে অবলোকন করে না সে জীবন ও জগৎকে সংলগ্ন ও ঐক্যবদ্ধ করতে চায়, অনেক সময় আকাক্সক্ষা রাখে সমগ্রকে ব্যাখ্যা করবে একক কোনো মানদ-ে। তবে সত্য থাকে এটা যে, দর্শনের তবু সাহিত্যকে বাদ দিলে চলে, কিন্তু সাহিত্যের কখনোই চলতে পারে না দর্শনকে বাদ দিয়ে।

https://sangbad.net.bd/images/2024/September/19Sep24/news/lit-1.jpg

তাই দেখি ইন্দ্রিয়সংবেদী যে-কবি কিটস, চরমভাবে আস্থা রেখেছিলেন ঝবহংধঃরড়হং-এ, তিনিও বারংবার বলেছেন দর্শনের কথা, ভয় পাচ্ছেন চিন্তাবিহীন অনুভবকে, দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছেন মননশীলতার দিকে, এবং গভীরতম অনুভব শক্তির প্রকাশে সমৃদ্ধ কবিতাসমূহেও অনুপ্রাণিত দার্শনিক উক্তি করেছেন। সেটা একটা দিক। অপরদিকে এও অনিবার্য সত্য যে, কোনো মানুষই তার সমসায়িক দার্শনিক আবহাওয়ার বাইরে নয়, কোনো লেখক তো ননই। যেমন করে ভৌগোলিক জলবায়ু প্রবাহিত করে মানুষের দৈহিক স্বাস্থ্যকে ঠিক তেমনিভাবে দার্শনিক আবহাওয়া প্রভাব রাখে মানসিক স্বাস্থ্যে। এই প্রভাব একজন লেখক অন্য মানুষের তুলনায় অধিক পরিমাণে গ্রহণ করে, কেননা লেখক সাধারণ-মানুষের তুলনায় অধিক সংবেদনশীল, গ্রহণক্ষম। টেনিসনের ওহ গবসড়ৎরধস কবিতায় বিবর্তনবাদী চিন্তার উপস্থিতি কোনো গোপন ব্যাপার নয়; কিন্তু এই কবিতা লেখা হয়েছিল ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের বই প্রকাশের নয় বছর আগে। ডারউইনের বই প্রকাশের পূর্বেই বিবর্তনবাদী চিন্তা অগ্রসর হয়ে এসে পৌঁছেছিল মানুষের মনে, এবং সেই অগ্রসর চিন্তা থেকে দূরে ছিলেন না কবি টেনিসন, যিনি সৌন্দর্যপিপাসু মূলত, যার বিশেষ দক্ষতা দার্শনিক ভাবনায় চঞ্চল অনুসরণে নয়, অনুভবের অচঞ্চল চিত্রায়নে।

জীবনানন্দ দাশ ও জসীম উদ্দীন সমসাময়িক কবি। দু’জনেই পূর্ববঙ্গের মানুষ, শ্যামল ও সিক্ত প্রকৃতির প্রতি দু’জনেরই গভীর ভালোবাসা। কিন্তু তাঁদের কবিতায় যে পারস্পরিক দূরতিক্রমণীয় ব্যবধান তার কারণটা মূলত দার্শনিক। সময়কে জয় করবার প্রয়োজনে বিপন্ন জীবনানন্দ যে একটি ইতিহাসচেতনা নীরবে গড়ে তুলেছিলেন নিজের মতো করে, জসীম উদ্দীনের লেখায় তেমন কোনো দার্শনানুসন্ধান আমরা পাবো না। এখানে জীবনানন্দ অনেক বড় জসীম উদ্দীনের তুলনায়, একই সঙ্গে তিনি বৈচিত্র্যপূর্ণ ও গভীর। অথবা ধরা যাক কাজী নজরুল ইসলামের কথা। বড় মাপের কবি তিনি। কিন্তু মনে হবে বড়ই অগোছালো, অনেক সময় স্ববিরোধী। তবু নজরুল ইসলামের ভেতর ন্যায়-অন্যায়ের জন্য প্রখর বোধ আছে, রয়েছে সুন্দর জীবনের জন্য আকাক্সক্ষা, আর তার বিপরীতে অসুন্দরের জন্য প্রবলতর ঘৃণা, দেখা যাবে প্রবহমান ও নির্যাতিতের ব্যাপারে তিনি আগ্রহী। সব মিলিয়ে একটি দার্শনিকতা রয়েছে, যেমনটা আমরা পাই ইংরেজি রোমান্টিক কবিদের লেখায়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে একজন কালজয়ী সাহিত্যিক সে কেবল হৃদয়গ্রাহী ও কৌতূহলোদ্দীপক গল্প বলার দরুন নয়, আরো বড় কারণ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, যাতে রয়েছে মানুষের জন্য গভীর মমতা, এবং যে-দৃষ্টিটি উল্লেখযোগ্য এই বৈশিষ্ট্যের কারণেও বটে যে এতে একই সঙ্গে রয়েছে সামন্তবাদের প্রতি ঘৃণা ও ভালোবাসা।

রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে সৃজনীকল্পনা ও দার্শনিকতা হাত ধরাধরি করে আছে। একাধারে তিনি ইহজাগতিক ও আধ্যাত্মিক। তাঁর রচনাতে রক্ত-মাংসের মানুষেরা রয়েছে, তাদের নিজস্ব দাবি নিয়ে। বহু বিষয়ে তাঁর বৈজ্ঞানিক কৌতূহল। সমসাময়িক জগৎ ও ঘটনা সম্পর্কে তিনি সজাগ, যেমন সচেতন অতীত ইতিহাস বিষয়ে। গতির প্রতি তাঁর স্বাভাবিক পক্ষপাত। অন্যদিকে আবার রয়েছে তাঁর ধর্মচেতনা। তিনি উপনিষদের উত্তরাধিকারী, কিন্তু তাই বলে ধর্মের ব্যাপারে তাঁর নিজস্বতা অনুপস্থিত নয়। ধর্ম তাঁকে সাম্প্রদায়িক করেনি, বরঞ্চ বাংলা সাহিত্যকে তিনি যে-পরিমাণে অসাম্প্রদায়িক করে গেছেন তাঁর আগে তেমনটি করতে আর কেউ পারেনি। এবং এও মোটেই তাৎপর্যহীন নয় যে তাঁর গান যেমন ভারতের তেমনি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বহুমুখিতা ও বৈচিত্র্যকে ধারণ করে রয়েছে একটি দার্শনিকতা, যেটি ছাড়া তাঁর সাহিত্যকে ভাবা যায় না। রবীন্দ্র সাহিত্য অবশ্যই আদর্শ-নিরপেক্ষ নয়, রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত গভীরভাবে আদর্শবাদী।

সাহিত্যিক-শ্রেষ্ঠ শেক্সপিয়র প্রচারক ছিলেন না আদৌ, কোনো বিশেষ দার্শনিক মতবাদের স্থিরপ্রতিজ্ঞ উপস্থাপকও নন তিনি, জীবনের জটিলতাকেই নাট্যায়িত করেছেন এই লেখকÑ নিরাসক্ত পক্ষপাতবিহীন অবস্থানে দাঁড়িয়ে। তিনি দার্শনিক নন, দান্তে নন, গ্যেটে নন, নন টলস্টয়Ñ কিন্তু তাই বলে কি তাঁর রচনাতে জীবনের কোনো ব্যাখ্যা নেই, চিন্তা নেই গভীরতম? অবশ্যই আছে। বস্তুত শেক্সপিয়রের রচনায় অনুভূতি ও চিন্তাশক্তিÑ এই দুই শত্রুর মধ্যে জীবনমরণ, সামনা-সামনি সমান-সমান মল্লযুদ্ধের যে চিত্র কোলরিজ দিয়েছেন তা অসত্য নয় কোনো দিক দিয়েই। সাদায়-কালোয় জীবন আঁকেননি তিনি, শুভ ও অশুভ সর্বক্ষণ আছে তাঁর লেখায়, আছে তাদের ক্ষান্তিহীন রক্তাক্ত দ্বন্দ্ব। রেনেসাঁ ও রিফরমেশনের যে দার্শনিক আবহাওয়ার মধ্যে শেক্সপিয়রের অবস্থান তা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর সাহিত্যে শুধু প্রতিফলিত নয়, সেই আবহাওয়া গভীরতর ও সমৃদ্ধতর হয়ে উঠেছে তাঁর রচনার মধ্য দিয়ে। ঈশ্বর নয়, মানুষই থাকবে বিবেচনা ও মূল্যবোধের কেন্দ্রভূমিতেÑ এই দর্শন রেনেসাঁ শিখিয়েছে তাঁকে। মানুষের চরিত্র যে অপার বিস্ময়ের এক রহস্যলোক এই বোধও রেনেসাঁরই। রিফরমেশন দৃঢ়তর করেছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের এই চেতনাকে, ধর্মের ক্ষেত্রে বিবেকের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে নিয়ে। সেই সঙ্গে ধর্মনিহিত মূল্যবোধকেও গ্রহণ করেছেন শেক্সপিয়র, এলিজাবেথীয় জগৎ-দৃষ্টিকেও। স্পেনীয়দের পরাজিত করে এবং নাবিকদের সাহায্যে নতুন নতুন দেশ আবিষ্কার করায় যে বহির্মুখী উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছিল সেকালে তার প্রভাবও পড়েছে শেক্সপিয়রে। এক কথায় বলতে গেলে, ইহলৌকিকতার এবং জীবনকে নিরুদ্বেগে নির্দ্বিধায় গ্রহণের ফলে যে একটি মানববাদী শক্তি তৈরি হয়েছিল, সেই শক্তিই আপন সৃজনক্ষমতা অবারিত করেছে শেক্সপিয়রের অসামান্য রচনাবলির মধ্যে দিয়ে। শেক্সপিয়রের ব্যক্তি-মনীষাকে খাটো করার আবশ্যকতা নেই, কিন্তু তাঁর মনীষা অবশ্যই একটি বিশেষ সামাজিক ও দার্শনিক পরিবেশের আনুকূল্যে বিকশিত হয়েছিল; সেই পরিবেশটি মোটেই উপেক্ষণীয় নয়। গ্রিক নাট্যকাররাও তেমনি, একটি বিশেষ আবহাওয়ার মানুষ তারা এবং তিনজন শ্রেষ্ঠ গ্রিক নাট্যকার যখন একই বিষয়ের ওপর তিনটি সম্পূর্ণ ভিন্ন নাটক রচনা করেন তখন একটি বড় ও সাধারণ দার্শনিক পরিমগুলের ভিতরে থেকেও তাঁদের নিজস্ব দার্শনিক অবস্থানের স্বাতন্ত্র্য উদ্ভাসিত করেন তাঁরা। কিটসের মধ্যে শেক্সপিয়রের গুণ ছিল। কিন্তু কিটসের তুলনায় শেক্সপিয়র যে বড় লেখক তার একমাত্র কারণ এটা নয় যে, শেক্সপিয়র দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিনে কিটসের তুলনায়, কারণ এটাও যে শেক্সপিয়রের দর্শনিকতা গভীরতর ছিল কিটসের অপেক্ষা। ট্র্যাজেডি গীতিকবিতার চাইতে উচ্চতর রূপকল্প-দার্শনিক গভীরতার কারণে। মূল কথা দাঁড়ায় তাহলে এই রকম। কোনো লেখকই দার্শনিক বলয়ের বাইরে নন, তখন তো ননই যখন তিনি সেই বলয়কে মান্য করেন, যেমন শেক্সপিয়র করেছেন; তখনো নন যখন তিনি তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন, যেমন মাইকেল মধুসূদন করেছিলেন। মাইকেল প্রসঙ্গ এলে স্মরণ করা যায় যে, তাঁর ওপর হোমার-মিল্টনের সাহিত্যিক ও দার্শনিক প্রভাব সক্রিয় ছিল। সেই তুলনায় তাঁর লেখায় শেক্সপিয়রের প্রভাব অল্প। অন্য বাঙালি লেখকদের ক্ষেত্রে ঐ নাট্যকারের প্রভাব নেই বললেই চলে। প্রভাব পরের কথা, শেক্সপিয়রের মৃত্যুর এতো বছর পরেও বাংলায় তাঁর একই সঙ্গে যথার্থ অনুবাদ পর্যন্ত হয়নি। বিশেষ করে তাঁর ট্র্যাজেডির। এর কারণ ভাষাতাত্ত্বিক তো বটেই, তার চেয়েও অধিক পরিমাণে দার্শনিক।

যে-বিশেষ দার্শনিক পরিম-লে শেক্সপিয়রের অবস্থান বাঙালি মনন থেকে তার দূরবর্তিতা, নিতান্ত সামান্য নয়। শেক্সপিয়রের ‘দি টেমপেস্ট’ নাটক সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যটি তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি লিখেছেন, “নাটকের নামও যেমন তাহার ভিতরকার ব্যাপারও সেইরূপ। মানুষে প্রকৃতিতে বিরোধ এবং সেই বিরোধের মূলে ক্ষমতালাভের প্রয়াস। ইহার আগাগোড়া বিক্ষোভ।” এই বিক্ষোভ পছন্দ হয়নি রবীন্দ্রনাথের। না-হবার কারণটি নিছক ব্যক্তিগত নয়, ব্যক্তিগত হয়েও সমষ্টিগত ও আদর্শিক বটে। এই আদর্শগত কারণেই আমাদের পক্ষপাত গীতিকবিতার প্রতি। নাটক এসেছে ধীরে ধীরে। এবং সেখানেও কমেডি প্রাধান্য পেয়েছে ট্র্যাজেডির তুলনায়। ট্র্যাজেডি চূড়ান্তরূপে ইহজাগতিক, অন্যপক্ষে বাঙালি জীবনে সুপ্রতিষ্ঠাত ধর্মভিত্তিক ভাববাদ শিক্ষা দেয় জগৎ অনিত্য, নিত্য হচ্ছে মানুষের আত্মা ও তার পরকাল। ইহকালের দুর্ভোগ চূড়ান্ত নয়, বরঞ্চ দুর্ভোগের পুরস্কার পাওয়া যাবে পরলোকেÑ এই যে ধারণা, এ ধারণা ট্র্যাজেডির জন্ম-বিরোধী। শুধু ভাববাদের কারণে নয়, দারিদ্র্যের কারণেও ‘মরলে বাঁচি’র জীবনদর্শন গড়ে উঠেছে এই দেশে। এই দর্শন ট্র্যাজেডির শত্রু; ট্র্যাজেডি মরার পরে বাঁচার কথা বলে না, বাঁচার মধ্যে বাঁচাকেই চরম ও চূড়ান্ত জ্ঞান করে। তপোবনে দ্বন্দ্ব নেই, কেননা সেখানে অশুভ নেই প্রতাপান্বিত। পরলৌকিক স্বর্গেও ঐ একই ব্যাপার। আমাদের শুভ সংঘর্ষে যেতে চায় না অশুভের সঙ্গে, ফলে তার শক্তি কখনো যথার্থ বিকাশিত ও সম্পূর্ণরূপে পরীক্ষিত হতে পারে নি। শুভ-অশুভের দ্বন্দ্ব নিতান্তই যখন অনিবার্য হয়ে ওঠে সাহিত্যে নিরুপায় লেখক তখন পক্ষ নেন, বিপন্ন হয়ে অশুভ তাঁর ব্যক্তিগত শত্রুতে পরিণত হয়েছে মনে হয়। তিনি সমবেদনা প্রকাশ করেন শুভের জন্য এমনকি অশ্রুপাতও করতে বলেন পাঠককে, যেমন শরৎচন্দ্র বলেছেন, ‘দেবদাস’-এর অন্তিম লাইনগুলোতে।

এই ভাববাদী ও তপোবনপ্রিয় চেতনায় ট্র্যাজেডি অনাহূত স্বভাবতই। গিরিশ ঘোষ ‘ম্যাকবেথ’ অনুবাদ করেছিলেন। তিনি নিজেই বলেছেন ঐ নাটক দু-চারদিনের বেশি চলে নি, শূন্য হয়ে গেছে রঙ্গালয়, পরে যখন ‘আবু হোসেন’ এলো তখন, যেন ভোজবাজি, আবার ভরে উঠলো আসনসমূহ। পাঠক-দর্শক হাসি চায়, পরিহাস চায়; চায় উৎফুল্লতা, চায় না দুর্ভোগ, চায় না দ্বন্দ্ব। তার সাহস নেই, তার প্রয়েজনও নেই, আপন ঘরে দুর্ভোগ যার নিত্যসঙ্গী, কোন দুঃখে সে দুঃখ খুঁজবে রঙ্গমঞ্চে।

শেক্সপিয়র অনুবাদ-ব্যর্থতার ভাষাতাত্ত্বিক কারণটাও দর্শন-নিরক্ষেপ নয়। ভাষা ওপর থেকে আসে না, নিচের থেকেই গড়ে ওঠে; ওপর থেকে এলেও টেকে না, টেকে তা-ই যা গড়ে উঠেছে নিচের প্রয়োজনে। বাংলা বাঙালি মানসেরই ভাষা। এই ভাষার বিজ্ঞান-চর্চার ছাপ যেমন সামন্য তেমনি, সামান্য দর্শন চর্চার চাপ। কারণটা অন্য কিছু নয়। সেটি হচ্ছে এই যে, আমাদের চেতনায় কাব্যের শান্ত ও নিরীহ কিন্তু শক্ত ও অচঞ্চল আচ্ছাদনটি ভেদ করে মননশীলতার, বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলনের প্রবল ঐতিহ্য গড়ে ওঠেনি। আমাদের প্রধানতম গৌরবের গীতিকবিতা, প্রধানতম অগৌরব বিজ্ঞানের ও দর্শনের অভাব। সেই গৌরব ও অগৌরবের যুগ্ম পতাকা ভাষা তার পেলবতা ও কাব্যময়তার মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত আন্দোলিত করছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনাকালে একজন সমালোচক বলেছিলেন বাংলা ভাষা কেবলি এলাইয়া এলাইয়া পড়ে, ধরি ধরি করিয়া তাহাকে রাখা যায় না সে সত্য অপ্রমাণিত হয় নি অদ্যাবধি।

রবীন্দ্রনাথ ‘ম্যাকবেথে’র অনুবাদ করেছিলেন, তার গৃহ-শিক্ষকের শাসনের মুখে। সে-অনুবাদ হারিয়ে গেছে, রক্ষা করার মতো আগ্রহ কবির ছিল না নিশ্চয়ই। সেই অনুবাদের অনবলুপ্ত প্রথম দৃশ্যে এই ধরনের পংক্তি আছে, ‘পোড়ামুখী বোল্লে রেগে ডাইনী মাগী যা তুই ভেগে।’ ঐ যে শব্দ ‘মাগী’ তা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ঐ পরিবেশে। অনায়াসে বিদ্যাসাগর ব্যবহার করেছেন এ-শব্দ। পরে মধ্যবিত্ত মানসের বর্জনবিলাস এইসব শব্দ অশ্লীল জ্ঞানে জিভে কেটে পরিত্যাগ করেছে। বলাই বাহুল্য, এর কারণ ভাষাতাত্ত্বিক নয়, মনস্তাত্ত্বিক। এই প্রবণতা শেক্সপিয়রের নিজের কালে ছিল না এবং ছিল না বলেই তিনি তাঁর রচনাবলি সৃষ্টি করায় আনুকূল্য পেয়েছিলেন। আমরা শেক্সপিয়রের যথেষ্ট ও যথার্থ অনুবাদ করতে পারি নি, কেননা আমাদের মনস্তাত্ত্বিক পরিধিটা এখনো বিস্তৃতির ও গভীরতার অপেক্ষায় আছে।

রবীন্দ্রনাথ অন্য সবার চেয়ে বড়; কিন্তু ভক্তিবাদের অবস্থান তাঁর সাহিত্যেও উজ্জ্বল। তাঁর বিশ্বাস “স্থুলত্ব বর্জন করতে তপস্যার মধ্য দিয়ে মানুষই দেবতা হয়ে উঠবে।” এই বিশ্বাসে উঁচু আশাবাদ আছে, কিন্তু মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখবার বাস্তবিক ইচ্ছার কিছুটা অভাব রয়েছে। মানুষ মানুষই, এই সত্য এমনকি রবীন্দ্রনাথও গ্রহণ করছেন না, মানুষকে দেবতা করতে চাইছেন। তদুপরি মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশ যে তপস্যার দ্বারা হয় না, হয় সংগ্রাম ও দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে এই বৈজ্ঞানিক সত্যও অস্বীকৃত রয়ে যাচ্ছে। রক্ত-মাংসের মানুষ রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্যে উপস্থিত আছে। কিন্তু তিনি প্রধানত কবি-ই, ঠিক যে-অর্থে শেক্সপিয়র প্রধানত নাট্যকার, এবং তাঁর কবিতায় মানুষের চাইতে মানুষ্যত্ব সম্পর্কে তাঁর ধারণাটাই বড়, দ্বন্দ্বের চাইতে অধিক মূল্যবান, সমন্বয়। যেন তপোবনই চাইছেন তিনি তপস্যার জন্য।

‘গীতাঞ্জলি’র সেই অসাধারণ চরণগুলো স্মরণ করা যাক, যেখানে বলেছেন তিনি যে ঈশ্বর স্থপতিনির্মিত মন্দিরে নেই, তিনি আছেন “যেথায় মাটি ভেঙ্গে করছে চাষা চাষ/ পাথর ভেঙ্গে কাটছে সেথায় পথ খাটছে বারো মাস/ রৌদ্র জলে আছেন সবার সাথে/ ধূলা তাঁহার লেগেছে দুই হাতে।” কিন্তু কর্মের এই যে জগৎ সেও তো মন্দিরই, বৃহৎ মন্দির। অথবা তপোবন একটি। শ্রমিককে শ্রমিক হিসাবে স্বীকার করছেন না কবি, দেখছেন তাকে ঈশ্বরের প্রকাশ-ভূমি হিসাবে। শ্রমিক কিন্তু নিজেকে জানে মেহনতি মানুষ বলেই; ঈশ্বর তাকে সুখ দেয় নি, মেহনত দিয়েছে, দিয়েছে অনাহার ও দারিদ্র্য। এভাবে রবীন্দ্রনাথ বাস্তবকে কোথাও কোথাও অবাস্তব করে তুলেছেন তাঁর আলোকসামান্য প্রতিভার যাদুকরী ও গীতিময় স্পর্শে। ‘মানুষের ধর্মে’ তিনি জ্ঞান, অনুভূতি ও কর্মের মাধ্যমে জগৎকে জানার বিষয়ে বলেছেন, বলে নিয়ে নিজের স্বাভাবিক পক্ষপাত প্রদর্শন করেছেন অনুভূতির প্রতি। জ্ঞান ও কর্ম কম মূল্য পেয়েছে, তুলনায়।

জ্ঞান ও কর্মের এই অবমূল্যায়ন অধিকাংশ লেখকের বেলাতেই সত্য। কল্লোল যুগের লেখকেরা হুজুগ তুলেছিলেন বিদ্রোহের। বিদ্রোহ ছিল যৌনালোচনা সম্পর্কে সামাজিক নিষেধের এবং রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক নীতির বিরুদ্ধেই মূলত। কিন্তু সেই বিদ্রোহে বড় একটা স্থান ছিল না জ্ঞান ও কর্মের, উচ্ছ্বাস ছিল অনুভূতির। এই বিদ্রোহীদের জগৎটাও ভাববাদী। তফাৎ এই পরিমাণ যে, কর্মের স্থলে এঁরা স্থাপন করেছেন আবেগকে, আবেগের কাছ থেকে এঁরা সেই ধরনের তৃপ্তি কামনা করেছেন ধার্মিক যা পায় ধর্মানুশীলনের মধ্য দিয়ে। ‘বেদে’র লেখক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত যখন পরমহংসের জীবনী রচনায় নিয়োজিত হন তখন বিস্ময়ের সত্যি কোনো কারণ থাকে না। কেননা তিনি এবং তাঁরা সকলেই ভাববাদীই ছিলেন, শুরু থেকেই, একটা ভাব অন্য একটা ভাবের জন্য জায়গা করে দিয়েছে মাত্র, এর বেশি না। তবু মানতেই হবে যে, ‘বেদে’র জীবন থেকে পরমহংসের জীবনে আসা জীবন-সংকোচন এক প্রকারের। যেমন, রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’র জগৎ থেকে বুদ্ধদের বসুর উপন্যাসে আসা উন্মুক্ত প্রান্তর থেকে সরে এসে বন্দী হওয়া ড্রয়িং রুমে। ড্রয়িং তথা বদ্ধঘরের দিকেই গোপন ও সক্রিয় পক্ষপাত অধিকাংশ লেখকের। সেই জন্য পরবর্তীকালে দেখি সমরেশ বসু গঙ্গার তীর ভেঙ্গে আহ্লাদিত চিত্তে বিবরে প্রবেশ করছেন মধ্যবিত্ত কলকাতায়। সেই একই পলায়ন, জীবন থেকে। জীবনকে পুঁজি হিসেবে সঙ্গে নেননি, নিয়েছেন জীবন সম্পর্কে খ-িত কিছু ধারণাকে। পুঁজি নিঃশেষিত হয়ে গেছে দ্রুত, তখন তাঁরা, নানাবিধ উত্তেজনাকে মূলধন হিসাবে নিযুক্ত করবেন ভেবেছেন তাঁদের লেখায়। অনেক দিক দিয়ে শরৎচন্দ্র অত্যন্ত বস্তুবাদী। কিন্তু তিনি আবার ভাববাদীও, সংস্কারে বিশ্বাস রাখেন আস্থা রাখেন ভক্তিতে, পরিত্যাজ্যকে মোহনীয় করে তোলেন নানাভাবে। চেতনাগত পরিচয়ে তারাশস্কর হচ্ছেন সংশোধিত শরৎচন্দ্র।

গদ্যের যদি অবস্থা হয় এমন তবে কবিতার পরিস্থিতি অধিকতর শোচনীয় হতে বাধ্য। হয়েছেও তা-ই। সেখানে ব্যক্তির সমন্বয়বাদী ও গীতিধর্মী অনুভবই প্রধান সত্য এবং সেই অনুভব জীবনে যেমন সাহিত্যেও তেমনি ইন্দ্রিয়-সংবেদী ও প্রগতিবিরোধী। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বুদ্ধদেব বসুর মধ্যে মনে হবে দূরত্ব অধিক, কিন্তু দূরত্ব নেই প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁরা উভয়েই ভাববাদী। ব্যতিক্রম কি নেই? আছে। বিদ্রোহ হয়েছে। বিদ্যাসাগর করেছেন বিদ্রোহ, করেছেন মধুসূদন, নজরুল, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য। কিন্তু এদের সকলেরই পরিণতি বেশ করুণ, তাঁদের লেখা মূল ধারায় পরিণত হতে পারেনি। সমাজ, এমনকি প্রকৃতিও সহ্য করতে চায়নি তাঁদের দার্র্শনিক বিদ্রোহকে। এখনকার মধ্যবিত্ত সংস্কৃতি বশ্যতার বটে বিদ্রোহের নয়।

রবীন্দ্রনাথ যথার্থ বলেছেন বাংলা সাহিত্যে নারীর মর্যাদা পুরুষের তুলনায় অধিক। তাঁর মতে, পুরুষ এখানে ‘মহাদেবের ন্যায় নিশ্চলভাবে ধূলিয়ান এবং রমণী তাহার বক্ষের উপর জাগ্রত জীবন্তভাবে বিরাজমান।’ এর কারণ হিসাবে তিনি সরাসরি বলেছেন পুরুষ এদেশে অকর্মা। কিন্তু অকর্মন্যতা একমাত্র কারণ নয়, সাহিত্যে নারীর আধিপত্যের আরো একটি কারণ বোধ করি এই যে, এ সাহিত্য অত্যন্ত কোমল, ভাবালু ও তরলানুভূতিপ্রবণ এককথায় বেশ মেয়েলি। দার্শনিক চিন্তায় তা যথেষ্ট পুষ্ট বা সমৃদ্ধ নয়। অবশ্যই সেই অপুষ্টি ও অসমৃদ্ধি রবীন্দ্রনাথ-নিদের্শিত অকর্মন্যতা থেকে এসেছে বললে উগ্র কথা বলা হবে না। (বাকি অংশ আগামী সংখ্যায়)

back to top