alt

সাময়িকী

অস্থির পৃথিবীর মায়াবী কবি

পুলক হাসান

: বৃহস্পতিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৪

গান আর কবিতার মধ্যে যার পৃথিবীর বন্ধন, সে-বন্ধন ছিন্ন করা বড় কঠিন, দারিদ্র্যের শত নিষ্পেষণেও তা হয় না মলিন, সে এমনি এক সম্মোহন বরং দিনে দিনে গাঢ় থেকে গাঢ়তর, নিবিড় থেকে আরও নিবিড়তর হয়ে থাকে সেই জীবনতৃষা, সেই বিশুদ্ধতায় অবগাহন। কোলাহলমুখর বাস্তবতার মধ্যেও তাই সে একা, নির্জনলোকের বাসিন্দা এবং নিত্য অন্বেষণে এক ব্রতচারি। যে-কোনো কবির শিল্পিত জীবনের চেয়ে সদ্য প্রয়াত কবি ও সাংবাদিক শান্তিময় বিশ্বাসের বেলায় এই সারসত্য যেন আরও জীবন্ত। গান ও কবিতার অনুধ্যানে সত্যি তিনি নিজের মধ্যে তৈরি করেছিলেন এক নিভৃত জীবন, আবার তা ছিল একদমই রুটিন বাঁধা। কাজের ফাঁকে প্রিয় শিল্পীর গানের সিডি সংগ্রহে যেমন ছুটে যেতেন আজিজ সুপার মার্কেটে কিংবা যেকোনো অডিও শপে তেমনি কবিতার তৃষ্ণায় ছুটে যেতেন পুরানা পল্টনের উন্মুক্ত পুরাতন বইয়ের স্টলে। ছককাটা হিসেবি সংসার থেকে অর্থ বাঁচিয়ে গানের সিডি ও কবিতার বই সংগ্রহ করে এভাবেই ভাব-জগতের রসদ ভারি করতেন তিনি। মাথায় যখন ছিল না বৈষয়িক বুদ্ধি তখন তার কী আর কোনো সঞ্চয় থাকার কথা? সাংবাদিকতার অনিশ্চিত জীবনেও তাই স্কুল শিক্ষিকা সহধর্মিনীকে নিয়ে তার সংসারটা ছিল শিল্পিত এক সুখী গৃহকোণ।

ভেতরে-টেতরে দুঃখকষ্ট হয়তো ছিল, একজন কবির জীবনে এ আর অমূলক কী! তবে তা তার কবিতাকেই করেছে পুষ্পিত। পুষ্পের মতোই নরম কোমল ভাষার এক কবি ছিলেন তিনি। জীবনের যাতনা তার কবিতার স্বাভাবিক এক অলঙ্কার হয়ে উঠেছিল আর তিনি সেখানে প্রাণের বাঁশিতে সুর তুলতেন আপন মনে। কবিতায় তিনি বিশ্বাস করতেন প্রাকৃতিক নিয়মে জীবনের অনিবার্য পরিণতি।

নিশ্চিত পতন দেখে কেটে গেছে একটি জীবন

একটি-একটি পাতা ঝরে গেছে; মর্মরিত বন

ক্রমশ নৈঃশব্দ্যে ডুবে বর্ণহীনতায় গেছে ভরে।

নতুন ফুলের মেলা জমে গেছে পাতাদের ঘরে

নিবিড় শৈশব এসে ভরে দিয়ে গেছে শূন্যশাখা;

গোধূলি নেমেছে স্থির অদৃশ্য দূরের গন্ধমাখা;

ঘিরেছে সবুজ আরো গাঢ় হয়ে, নিবেদিত হয়ে;

দিনান্তের মন্দ্র হাওয়া মন্ত্রের আদলে গেছে বয়ে।

পাতার ঘূর্ণিতে ধীরে ঝরে গেছে নিভৃত জীবন,

নেমেছে নীরব সন্ধ্যা, মৌন করে দিয়ে গেছে বন।

[বনের নিয়ম]

প্রকৃতির এই পালাবদলের ভেতর জীবনের প্রাপ্তি ও শূন্যতাকে কত সহজেই না তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন এই কবিতায়।

এই সহজতা তার কাব্যবৈশিষ্ট্যেরই উপাচার। যদিও তিনি কবিতায় রচনাকৌশলের চেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন প্রাণের অনুসন্ধানকে, খুঁজেছেন প্রকৃতি ও বিদ্যমান বাস্তবতায় সেই প্রাণতরঙ্গ। ফলে তিনি মূলধারার কবি।

জল ও বায়ুর মধ্যে ঘুরেফিরে যারা বেঁচেছিল কিংবা বেঁচে নেই,

সহজ-সরল সোজা জীবন কাটিয়ে গেল যারা এভাবেই

সেই জীবনের জন্য প্রার্থনায় জানু পেতে বসে থেকে পথে

গ্রামগঞ্জ ভরে উঠছে ক্রমে ক্রমে সংখ্যাতীত হতে ও আহতে।

[জলবায়ু]

তিনি যে মূলধারার কবি জীবন সম্পর্কে তাঁর এই উপলব্ধি আরও স্পষ্ট করে দেয়। তিনি দেখছেন স্বপ্নহীন এক প্রেত জীবন তার সামনে, তাকে নিয়ে উপহাস করছে।

(শেষে) ভাবতে ভাবতে দিন চলে যায়, রাত্রি চলে আসে,

দুঃখগুলো ঘুরতে থাকে সুখের আশেপাশে।

স্বপ্নগুলো হারিয়ে যাচ্ছে

জীবন একটা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে,

বাড়িয়ে দিয়ে হাহা-ধ্বনি জীবন হাহা হাসে।

(যাত্রা)

শান্তিময় বিশ্বাস সেই মৌলিক কবি যিনি বিলীয়মান বাস্তবতার ভেতর থেকে জীবনের মূল সুরটি তুলে আনেন কবিতায় এবং সহজ ও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তার রূপ দিতে সচেষ্ট ছিলেন। ফলে তাঁর কবিতাকে সহজে শনাক্ত করা যায়। চিন্তনে ও ভাষাভঙ্গিতে তাঁর কবিতার এই স্বাতন্ত্র্য পাঁচ দশক অধিক কালের কাব্য সাধনার একমাত্র ফসল ‘হাঙরের মতো হিংস্র ইলিশের মতো মায়াবী’ (১৯৮৭) কবিতাগ্রন্থের নামকরণেই ধরে নেয়া যায়। মানবজীবনের অস্তিত্বের সংগ্রামে যেমন রয়েছে নিষ্ঠুরতা তেমনি মায়ার এক সম্মোহন। এই দ্বান্দ্বিক অবস্থান থেকে জীবন ও বাস্তবতার উপলব্ধি তাঁর কবিতাকে করে তোলে সংগীতের মতো অবিনাশী যেখানে মিশে থাকে গোপন এক আলোর মায়াবী ইশারা।

ক্ষয় হতে হতে দাগ বুঝি-বা উধাও।

যদিও সামান্য তার চিহ্ন রয়ে গেছে

আবছায়া; নদীপথে চলে গেলে নাও

যেমন জলের রেখা ধীরে যায় মুছে

নতুন ঢেউয়ের তোড়ে, তেমনই এ স্মৃতি

ধুয়ে মুছে গেছে সব, সময়ের টানে।

গভীর মমতা ভরা বেদনার গীতি

দগ্ধ হতে হতে হতে হারিয়েছে মানে।

এতো যে রোদন আর এতো আত্মত্যাগ

এতো নিষ্ঠুরতা এতো দুঃখের দহন

এতো যে বিশাল ক্ষিপ্র মুক্তির সংরাগ

এতো আকাক্সক্ষায় মোড়া স্মৃতির গহন

আলো ছায়া স্বপ্নরেখা, জলজ্যান্ত দাগ

তাও ধুয়ে যায়, শুধু থাকে সম্মোহন।

[দাগ]

বাস্তবতার গভীরে ঢুকলেই কেবল জীবন সম্পর্কে এরকম একটা অর্থপূর্ণ সংকেত দেয়া সম্ভব। ফলে শান্তিময় বিশ্বাসের কবিতা মানেই একটা নতুন দিক সৃষ্টি, মিত বাকপ্রতিমায় মানেহীন পরিপার্শ্বের মধ্যেও মানে খুঁজে ফেরা। তাঁর সেই উপলব্ধির দরোজা পেরিয়ে আমাদের বেশিদূর যেতে দেননি তিনি। একটিমাত্র কবিতাগ্রন্থে কী তা সম্ভব? পড়তেন গোগ্রাসে কিন্তু লিখতেন খুবই কম। আর আত্মপ্রচারেও যে অনাগ্রহী ছিলেন জীবদ্দশায় একটিমাত্র গ্রন্থ প্রকাশেই তা জ্বলন্ত। তবু রেখে গেছেন একাধিক গ্রন্থ প্রকাশের মতো কিছু কবিতা। তার মধ্যে ‘আমার ভ্রমণ বসে থাকা’ নামে দ্বিতীয় গ্রন্থটি খেয়া প্রকাশন থেকে বের করার কথা ছিল। কিন্তু সেই সুযোগ না দিয়েই তিনি ২০১১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। সেই সঙ্গে চিরদিনের মতো আমাদেরও। কিন্তু মিতবাক কৌতুকপ্রবণ চিরতরুণ সুন্দর মানুষটাকে এক যুগের নিবিড় সম্পর্ক থেকে খারিজ করা যে অসম্ভব। ১৯৪৬ সালে নেত্রকোনায় জন্ম নেয়া এই অজাত শত্রু মানুষটার যদিও জীবনের সমাপ্তি ঘটল ৬৭ বছরে নিজের শরীরে দীর্ঘদিনের আশ্রয় নেয়া হৃদরোগে। কিন্তু সাংবাদিক সহকর্মী থেকে তাঁর সৃষ্টিশীল সত্তার উত্তাপে আমাদের সম্পর্কটা গড়িয়েছিল অনেক দূর...

সেই সম্পর্ককে খোদাই করে গেছেন তিনি আমার কবিতাগ্রন্থ ‘সব দাগ ওঠে না’র ফ্ল্যাপে: পুলক হাসান আমার প্রিয় অনুজ কবিদের অগ্রগণ্য। বাস্তবের বালি কল্পনার রক্তরসে জারিয়ে সহজে মানবভাষায় মুক্তাদানায় ফলিয়ে তুলতে পারেন এই কবি। আপাত জটিল কিন্তু বড় অনায়স এই প্রক্রিয়া। আছে ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন গল্পের ইশারা। আছে বাউলের সরল তরঙ্গভঙ্গ। আধুনিকের ভাঙা জীবন ছবি। ধ্বস্ত গ্রাম। অস্তগামী নিসর্গের অবশিষ্ট কোনো অস্ফুট শোভা। স্মৃতির ভেতর বসে থাকা নানা মানুষ। দার্শনিকতার মোড়কে বিদ্রুপের তীব্র শক্তিশেল-নিদারুণ অথচ মর্মভেদী। এরই মধ্যে উঁকি দিচ্ছে হাওয়ায় উড়ে যাওয়া সামাজিক বিশ্বাসের হালকা ছাইভস্মও। আর সবই কবির স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত, বাকবন্ধে চিত্রিত ও ধ্বনিত। নিটোল নয়, ভাঙা ভাঙা। একটি সরলরেখা যেভাবে সর্পিল ও বিষধর হয়ে ওঠে তার জ্যামিতি কবির আয়ত্বে।’

আত্মবিকারি সাহিত্য পরিম-লে একজন অগ্রজ কবির কাছ থেকে এ আমার অনেক বড় প্রাপ্তি। আমি আজ তার কথা তাকেই ফিরিয়ে দিতে চাইÑ আমার যতটুকু না, তাঁর কবিতাই বরং শতভাগ স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত বাকবন্ধে চিত্রিত ও ধ্বনিত। মিডিয়া শাসিত এই সময়ে জীবনের অতলচারি একজন প্রকৃত কবি হিসেবে শান্তিময় বিশ্বাস হয়তো আড়াল ও অনুল্লিখিতই থেকে যাবেন কিন্তু প্রকৃত কবিতাপ্রেমী, স্বতন্ত্র স্বর সন্ধানি তাকে খুঁজে ফিরবেন ঠিকই-অন্তত তার নির্মল কবিতাগুচ্ছের মায়াবী টানে।

ছবি

নার্গিস-উদ্যানে নজরুল তর্ক

ছবি

শহীদ কাদরীর কবি হয়ে ওঠা

ছবি

মাথার ওপর ছাতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অমিয়ভূষণ : ধ্রুপদীয়া আর স্ববিরোধের সমন্বয়

ছবি

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র স্বাতন্ত্র্য ও শ্রেষ্ঠত্ব

ছবি

মার্কেস ও আমার বিস্ময়

ছবি

সম্প্রীতির সাধক মরমী বাউল উকিল মুন্সী

ছবি

‘দিবারাত্রির কাব্য’ এবং ‘দ্য আউটসাইডার’ এক নিবিড় সাযুজ্য

ছবি

চুক্তি লিখন

ছবি

লিওপল্ড সেদর সেঙ্ঘর-এর কবিতা

ছবি

হিমু ও হুমায়ূন আহমেদ

শরতের পদাবলি

সাময়িকী কবিতা

মার্কিন চলচ্চিত্র জগতের প্রাণকেন্দ্র লস এঞ্জেলেস

ছবি

যুদ্ধের জানালায় দাঁড়িয়ে

ছবি

শব্দঘর : বিপ্লব, দ্রোহ ও গুচ্ছ কবিতা সংখ্যা

ছবি

সাহিত্যের দর্শনানুসন্ধান

ছবি

সালভাতর কোয়াসিমোদোর কবিতা

ছবি

টুটু

ছবি

অর্ধেক জীবন

ছবি

ক্যান্ডি, শ্রীলঙ্কায় বেড়ানোর আদর্শ জায়গা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

‘দূরের কার্নিশ’

ছবি

কবিতায় উড়ন্ত সারস

ছবি

সাহিত্যের দর্শনানুসন্ধান

ছবি

রবীন্দ্রসংগীত চর্চা, বাংলাদেশে-

শক্তিমান কবির কলমে গল্প

ছবি

শহীদুল হকের জীবন ও আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতা

ছবি

জলবন্দী স্বপ্ন

সাময়িকী কবিতা

ছবি

কমল চক্রবর্তী, আদি ও অকৃত্রিম রিংমাস্টার

ছবি

নূরুল হক : আধুনিক মরমি কবি

ছবি

ও. হেনরি : ছোটগল্পের কালজয়ী অগ্রদূত

ছবি

নজরুল : বিশ্বতোরণে বৈজয়ন্তী মানব-বিজয়-কেতন

ছবি

নিছক সাজুর গল্প

tab

সাময়িকী

অস্থির পৃথিবীর মায়াবী কবি

পুলক হাসান

বৃহস্পতিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৪

গান আর কবিতার মধ্যে যার পৃথিবীর বন্ধন, সে-বন্ধন ছিন্ন করা বড় কঠিন, দারিদ্র্যের শত নিষ্পেষণেও তা হয় না মলিন, সে এমনি এক সম্মোহন বরং দিনে দিনে গাঢ় থেকে গাঢ়তর, নিবিড় থেকে আরও নিবিড়তর হয়ে থাকে সেই জীবনতৃষা, সেই বিশুদ্ধতায় অবগাহন। কোলাহলমুখর বাস্তবতার মধ্যেও তাই সে একা, নির্জনলোকের বাসিন্দা এবং নিত্য অন্বেষণে এক ব্রতচারি। যে-কোনো কবির শিল্পিত জীবনের চেয়ে সদ্য প্রয়াত কবি ও সাংবাদিক শান্তিময় বিশ্বাসের বেলায় এই সারসত্য যেন আরও জীবন্ত। গান ও কবিতার অনুধ্যানে সত্যি তিনি নিজের মধ্যে তৈরি করেছিলেন এক নিভৃত জীবন, আবার তা ছিল একদমই রুটিন বাঁধা। কাজের ফাঁকে প্রিয় শিল্পীর গানের সিডি সংগ্রহে যেমন ছুটে যেতেন আজিজ সুপার মার্কেটে কিংবা যেকোনো অডিও শপে তেমনি কবিতার তৃষ্ণায় ছুটে যেতেন পুরানা পল্টনের উন্মুক্ত পুরাতন বইয়ের স্টলে। ছককাটা হিসেবি সংসার থেকে অর্থ বাঁচিয়ে গানের সিডি ও কবিতার বই সংগ্রহ করে এভাবেই ভাব-জগতের রসদ ভারি করতেন তিনি। মাথায় যখন ছিল না বৈষয়িক বুদ্ধি তখন তার কী আর কোনো সঞ্চয় থাকার কথা? সাংবাদিকতার অনিশ্চিত জীবনেও তাই স্কুল শিক্ষিকা সহধর্মিনীকে নিয়ে তার সংসারটা ছিল শিল্পিত এক সুখী গৃহকোণ।

ভেতরে-টেতরে দুঃখকষ্ট হয়তো ছিল, একজন কবির জীবনে এ আর অমূলক কী! তবে তা তার কবিতাকেই করেছে পুষ্পিত। পুষ্পের মতোই নরম কোমল ভাষার এক কবি ছিলেন তিনি। জীবনের যাতনা তার কবিতার স্বাভাবিক এক অলঙ্কার হয়ে উঠেছিল আর তিনি সেখানে প্রাণের বাঁশিতে সুর তুলতেন আপন মনে। কবিতায় তিনি বিশ্বাস করতেন প্রাকৃতিক নিয়মে জীবনের অনিবার্য পরিণতি।

নিশ্চিত পতন দেখে কেটে গেছে একটি জীবন

একটি-একটি পাতা ঝরে গেছে; মর্মরিত বন

ক্রমশ নৈঃশব্দ্যে ডুবে বর্ণহীনতায় গেছে ভরে।

নতুন ফুলের মেলা জমে গেছে পাতাদের ঘরে

নিবিড় শৈশব এসে ভরে দিয়ে গেছে শূন্যশাখা;

গোধূলি নেমেছে স্থির অদৃশ্য দূরের গন্ধমাখা;

ঘিরেছে সবুজ আরো গাঢ় হয়ে, নিবেদিত হয়ে;

দিনান্তের মন্দ্র হাওয়া মন্ত্রের আদলে গেছে বয়ে।

পাতার ঘূর্ণিতে ধীরে ঝরে গেছে নিভৃত জীবন,

নেমেছে নীরব সন্ধ্যা, মৌন করে দিয়ে গেছে বন।

[বনের নিয়ম]

প্রকৃতির এই পালাবদলের ভেতর জীবনের প্রাপ্তি ও শূন্যতাকে কত সহজেই না তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন এই কবিতায়।

এই সহজতা তার কাব্যবৈশিষ্ট্যেরই উপাচার। যদিও তিনি কবিতায় রচনাকৌশলের চেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন প্রাণের অনুসন্ধানকে, খুঁজেছেন প্রকৃতি ও বিদ্যমান বাস্তবতায় সেই প্রাণতরঙ্গ। ফলে তিনি মূলধারার কবি।

জল ও বায়ুর মধ্যে ঘুরেফিরে যারা বেঁচেছিল কিংবা বেঁচে নেই,

সহজ-সরল সোজা জীবন কাটিয়ে গেল যারা এভাবেই

সেই জীবনের জন্য প্রার্থনায় জানু পেতে বসে থেকে পথে

গ্রামগঞ্জ ভরে উঠছে ক্রমে ক্রমে সংখ্যাতীত হতে ও আহতে।

[জলবায়ু]

তিনি যে মূলধারার কবি জীবন সম্পর্কে তাঁর এই উপলব্ধি আরও স্পষ্ট করে দেয়। তিনি দেখছেন স্বপ্নহীন এক প্রেত জীবন তার সামনে, তাকে নিয়ে উপহাস করছে।

(শেষে) ভাবতে ভাবতে দিন চলে যায়, রাত্রি চলে আসে,

দুঃখগুলো ঘুরতে থাকে সুখের আশেপাশে।

স্বপ্নগুলো হারিয়ে যাচ্ছে

জীবন একটা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে,

বাড়িয়ে দিয়ে হাহা-ধ্বনি জীবন হাহা হাসে।

(যাত্রা)

শান্তিময় বিশ্বাস সেই মৌলিক কবি যিনি বিলীয়মান বাস্তবতার ভেতর থেকে জীবনের মূল সুরটি তুলে আনেন কবিতায় এবং সহজ ও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তার রূপ দিতে সচেষ্ট ছিলেন। ফলে তাঁর কবিতাকে সহজে শনাক্ত করা যায়। চিন্তনে ও ভাষাভঙ্গিতে তাঁর কবিতার এই স্বাতন্ত্র্য পাঁচ দশক অধিক কালের কাব্য সাধনার একমাত্র ফসল ‘হাঙরের মতো হিংস্র ইলিশের মতো মায়াবী’ (১৯৮৭) কবিতাগ্রন্থের নামকরণেই ধরে নেয়া যায়। মানবজীবনের অস্তিত্বের সংগ্রামে যেমন রয়েছে নিষ্ঠুরতা তেমনি মায়ার এক সম্মোহন। এই দ্বান্দ্বিক অবস্থান থেকে জীবন ও বাস্তবতার উপলব্ধি তাঁর কবিতাকে করে তোলে সংগীতের মতো অবিনাশী যেখানে মিশে থাকে গোপন এক আলোর মায়াবী ইশারা।

ক্ষয় হতে হতে দাগ বুঝি-বা উধাও।

যদিও সামান্য তার চিহ্ন রয়ে গেছে

আবছায়া; নদীপথে চলে গেলে নাও

যেমন জলের রেখা ধীরে যায় মুছে

নতুন ঢেউয়ের তোড়ে, তেমনই এ স্মৃতি

ধুয়ে মুছে গেছে সব, সময়ের টানে।

গভীর মমতা ভরা বেদনার গীতি

দগ্ধ হতে হতে হতে হারিয়েছে মানে।

এতো যে রোদন আর এতো আত্মত্যাগ

এতো নিষ্ঠুরতা এতো দুঃখের দহন

এতো যে বিশাল ক্ষিপ্র মুক্তির সংরাগ

এতো আকাক্সক্ষায় মোড়া স্মৃতির গহন

আলো ছায়া স্বপ্নরেখা, জলজ্যান্ত দাগ

তাও ধুয়ে যায়, শুধু থাকে সম্মোহন।

[দাগ]

বাস্তবতার গভীরে ঢুকলেই কেবল জীবন সম্পর্কে এরকম একটা অর্থপূর্ণ সংকেত দেয়া সম্ভব। ফলে শান্তিময় বিশ্বাসের কবিতা মানেই একটা নতুন দিক সৃষ্টি, মিত বাকপ্রতিমায় মানেহীন পরিপার্শ্বের মধ্যেও মানে খুঁজে ফেরা। তাঁর সেই উপলব্ধির দরোজা পেরিয়ে আমাদের বেশিদূর যেতে দেননি তিনি। একটিমাত্র কবিতাগ্রন্থে কী তা সম্ভব? পড়তেন গোগ্রাসে কিন্তু লিখতেন খুবই কম। আর আত্মপ্রচারেও যে অনাগ্রহী ছিলেন জীবদ্দশায় একটিমাত্র গ্রন্থ প্রকাশেই তা জ্বলন্ত। তবু রেখে গেছেন একাধিক গ্রন্থ প্রকাশের মতো কিছু কবিতা। তার মধ্যে ‘আমার ভ্রমণ বসে থাকা’ নামে দ্বিতীয় গ্রন্থটি খেয়া প্রকাশন থেকে বের করার কথা ছিল। কিন্তু সেই সুযোগ না দিয়েই তিনি ২০১১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। সেই সঙ্গে চিরদিনের মতো আমাদেরও। কিন্তু মিতবাক কৌতুকপ্রবণ চিরতরুণ সুন্দর মানুষটাকে এক যুগের নিবিড় সম্পর্ক থেকে খারিজ করা যে অসম্ভব। ১৯৪৬ সালে নেত্রকোনায় জন্ম নেয়া এই অজাত শত্রু মানুষটার যদিও জীবনের সমাপ্তি ঘটল ৬৭ বছরে নিজের শরীরে দীর্ঘদিনের আশ্রয় নেয়া হৃদরোগে। কিন্তু সাংবাদিক সহকর্মী থেকে তাঁর সৃষ্টিশীল সত্তার উত্তাপে আমাদের সম্পর্কটা গড়িয়েছিল অনেক দূর...

সেই সম্পর্ককে খোদাই করে গেছেন তিনি আমার কবিতাগ্রন্থ ‘সব দাগ ওঠে না’র ফ্ল্যাপে: পুলক হাসান আমার প্রিয় অনুজ কবিদের অগ্রগণ্য। বাস্তবের বালি কল্পনার রক্তরসে জারিয়ে সহজে মানবভাষায় মুক্তাদানায় ফলিয়ে তুলতে পারেন এই কবি। আপাত জটিল কিন্তু বড় অনায়স এই প্রক্রিয়া। আছে ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন গল্পের ইশারা। আছে বাউলের সরল তরঙ্গভঙ্গ। আধুনিকের ভাঙা জীবন ছবি। ধ্বস্ত গ্রাম। অস্তগামী নিসর্গের অবশিষ্ট কোনো অস্ফুট শোভা। স্মৃতির ভেতর বসে থাকা নানা মানুষ। দার্শনিকতার মোড়কে বিদ্রুপের তীব্র শক্তিশেল-নিদারুণ অথচ মর্মভেদী। এরই মধ্যে উঁকি দিচ্ছে হাওয়ায় উড়ে যাওয়া সামাজিক বিশ্বাসের হালকা ছাইভস্মও। আর সবই কবির স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত, বাকবন্ধে চিত্রিত ও ধ্বনিত। নিটোল নয়, ভাঙা ভাঙা। একটি সরলরেখা যেভাবে সর্পিল ও বিষধর হয়ে ওঠে তার জ্যামিতি কবির আয়ত্বে।’

আত্মবিকারি সাহিত্য পরিম-লে একজন অগ্রজ কবির কাছ থেকে এ আমার অনেক বড় প্রাপ্তি। আমি আজ তার কথা তাকেই ফিরিয়ে দিতে চাইÑ আমার যতটুকু না, তাঁর কবিতাই বরং শতভাগ স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত বাকবন্ধে চিত্রিত ও ধ্বনিত। মিডিয়া শাসিত এই সময়ে জীবনের অতলচারি একজন প্রকৃত কবি হিসেবে শান্তিময় বিশ্বাস হয়তো আড়াল ও অনুল্লিখিতই থেকে যাবেন কিন্তু প্রকৃত কবিতাপ্রেমী, স্বতন্ত্র স্বর সন্ধানি তাকে খুঁজে ফিরবেন ঠিকই-অন্তত তার নির্মল কবিতাগুচ্ছের মায়াবী টানে।

back to top