রকিবুল হাসান
কবি সৈয়দ আবদুস সাদিকের জন্ম কুষ্টিয়ার কুমারখালীর সেরকান্দি গ্রামে। তাঁর কাব্যগ্রন্থ: ঘনীভূত শব্দের বসতি, তবুও বসবাস, অনুগত্য সর্বস্বত্ব, নিরন্তর এইসব, এবং স্বীকারোক্তি, জলশ্যাওলার ফুল, অপ্রত্যাশিত সন্ধি, কালো চুল কৃষ্ণচূড়া, কৃষ্ণপক্ষ ঘোড়দৌড়, না গৃহে না সমাজে, তুমি শ্রমণ আমি ভিক্ষু প্রভৃতি। কবিতাসমগ্র প্রথম খ-, দ্বিতীয় খ- ও তৃতীয় খ- প্রকাশিত হয়েছে। অসংখ্য রুবাইয়াৎ রচনা করেছেন।
কবি সৈয়দ আবদুস সাদিক গত ১৯ অক্টোবর প্রয়াত হয়েছেন। এটা আমার জন্য গভীর শোকের। লিখতে বসে চুপ করে বসে আছি অনেকক্ষণ। কী লিখবো! কেন লিখবো! কেন লিখতে হয় এরকম মৃত্যু নিয়ে! লেখক হলেই কী এই বেদনাবহন অনিবার্য! না লিখলে তো আরও বেশি যন্ত্রণাবহন করতে হয় বুকের ভেতর! না পারছি লিখতে, না পারছি এই বেদনা নিয়ে না-লিখে চুপ থাকতে। কতো মৃত্যু চলে যায় চোখের সামনে, মনের ভেতর। সব মৃত্যু তো নাড়া দেয় না। সব মৃত্যু তো অন্ধকারের মতো একা একা বসিয়ে রাখে না। কোনো কোনো মৃত্যু ভেতরটাকে দুমড়েমুচড়ে ফেলে, নদীর পাড়ভাঙার মতো ভেঙে ফেলে। ক্ষত-বিক্ষত করে। কতকিছু ভাবায়। কোনো কোনো মৃত্যু শুকনো পাতার মতো ভেসে যায়, চোখেও হয়তো পড়ে না। কোনো কোনো মৃত্যু বুকের ভেতর পাথরের মতো ভারি হয়ে থাকে। সৈয়দ আবদুস সাদিকে মৃত্যু আমার বুকের ভেতর পাথর-ভারি হয়ে বসে গেছে। চলে গেলেন তিনি। বেদনায় অন্ধকারের মতো একাকী চুপচাপ হয়ে আছি নিজের ভেতর। কোনোভাবেই বিশ^াস হচ্ছে না, তিনি নেইÑ এই পৃথিবীর সব হিসাব-নিকাশ চুকে দিয়ে চলে গেছেন, বহু দূরে। আমাদের চোখ অতদূরে কখনো কোনোভাবেই আর পৌছুবে না। মানুষ তো কোনো না সময় চলেই যায়Ñ ঠেকানোর কোনো পথ নেইÑ আমরাও যাবোÑ দুদিন আগে আর পরে। কিন্তু যতক্ষণ বেঁচে থাকে, ততক্ষণ আপনজন হারানো বেদনা বুকের ভেতর পাথর করে বহনের কষ্ট যে কতোটা তা আপনজন হারানোরাই অনুভব করতে পারে। কবি সৈয়দ আবদুস সাদিক কী আমাদের আপনজন ছিলেনÑ অবশ্যই আপনজন ছিলেনÑ ভালোবাসার মানুষ ছিলেনÑ শ্রদ্ধার মানুষ ছিলেন। শিশুর মতো অভিমানভরা মানুষ ছিলেন। একটু ভালোবাসলেই, একটু সম্মান করলেই শিশুর মতো সব ভুলে যেতেন। আমরা তাঁকে কতটুকু ভালোবাসতে পেরেছি, জানি না। তবে তিনি মন ভরে প্রাণ ভরে পুরো হৃদয় দিয়ে আমাদের ভালোবেসেছিলেন, ভালোবাসতে পেরেছিলেন।
কেন জানি তিনি আমাকে খুব পছন্দ করতেন। ভালোবাসতেন। কুমারখালীর কবি-নাট্যকার লিটন আব্বাসকে ভালোবাসতেন। কবি সিদ্দিক প্রামাণিককে ভালোবাসতেন। যারা লেখালেখি করতেন সবার প্রতি তাঁর অন্ধ ভালোবাসা ছিলো। ভালোবাসতেন কুমারখালীকে। ঢাকার জীবনযাপন ছেড়ে কুমারখালীতেই আবাস গড়েছিলেন স্থায়ীভাবে। বাড়িটার নামও দিয়েছিলেন নিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থের নামানুসারেÑ ‘তবুও বসবাস’। সেই বাড়িতে প্রথম গিয়েছিলাম ৫ আগস্ট, ২০১৫ সালে। ঝড়বৃষ্টির রাতে। ভয়াবহ ঝড়বৃষ্টি। কীভাবে যে দমকা ঝড়বৃষ্টিতে ফেরিঘাট পার হয়ে ভিজেপুরে লোকাল বাসে ঠেলাঠেলি করে কুমারখালী গিয়েছিলামÑ গভীর আবেগেÑ কবি সৈয়দ আবদুস সাদিকের বাসায় যাবো বলে। কারণ, সাউথইস্ট বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথিÑ তাঁকে সম্মাননা স্মারক দেওয়া হবে। আমি তখন বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান। ভিজেপুরে তাঁর বাসায় আমি আর কবি লিটন আব্বাস যখন পৌছলাম, কার্ডটা হাতে তাঁর দিলাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আরে কী করেছেন কী করেছেন! ভিজে তো শেষ হয়ে গেছেন!’ তিনি কার্ডটা পড়লেন। তার দুই চোখে পানি। মনে হলো বৃষ্টির সব পানি হুট করে তাঁর চোখে নেমে এলো। বললেন, ‘আমি কী আর অতবড় কবি! আপনি যে সম্মান দিলেন, আমি খুব খুশি হয়েছি। এটা আমার জীবনে সবচেয়ে বড় পুরস্কার। আর কোনো পুরস্কার না পেলেও আমার দুঃখ নেই।’ সেদিন এই সামান্য প্রাপ্তিতে তাঁর যে আনন্দ দেখেছি, তা এই মুহূর্তে আমি বেদনাহত হৃদয়ে অনুভব করছি। তিনি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। অনুষ্ঠানে মাননীয় উপাচার্য প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেন, উপউপাচার্য প্রফেসর ড. হুমায়ুন কবীর চৌধুরী, আবৃত্তিশিল্পী নাজমুল আহসানসহ বিশ^বিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার, বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বিভাগীয় প্রধানগণসহ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন। পুরো হলরুম ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। কবি সৈয়দ আবদুস সাদিককে সেদিন পুষ্পতোড়া দিয়ে গ্রহণ করেন মাননীয় উপাচার্য। অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথিরা সবাই মিলে সৈয়দ আবদুস সাদিকের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন। কবি খুব খুশি হয়েছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে আমার রুমে এসে বললেন, ‘প্রফেসর সাহেব, আজ আপনারা আমাকে যে সম্মান দিলেন, আমি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়ে গেছি। বাংলা একাডেমি পুরস্কারের জন্য আমার আর দুঃখ নেই।’ সেদিন প্রায় সারাটা দিন বাংলা বিভাগে আমার সঙ্গে ছিলেন। আমার ‘ব্যর্থ ভয়ংকর দৌড়ের কাছে’ কাব্যগ্রন্থ থেকে অনেকগুলো কবিতা পড়লেন। অথচ নিজের কাব্যগ্রন্থ থেকে একটা কবিতাও পড়েননি। এ যেন এক অনুজের প্রতি গভীর মমত্বের প্রকাশ।
কুমারখালী গেলেই তাঁর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছি। সবসময় হয়তো তা সম্ভব হয়নি। পরে শুনলে খুব মন খারাপ করতেন। অভিমান করতেন। বলতেন, ‘কুমারখালী এলেন। চলে গেলেন। দেখাটা হলো না। আমার নতুন বইটা আপনাকে দেওয়া হলো না। কুরিয়ারে পাঠাইনি আপনাকে নিজে হাতে দেবো বলে।’ এমন করে এতোটা ভালোবেসে আর কখনোই বলবেন না তিনি। কথাগুলো কানের ভেতর দিয়ে মস্তিষ্কের কোষে কোষে আঘাত করছে, অভিমান-বেদনাভরা কণ্ঠ দিব্যি কর্ণকুহরে অনুভূত হচ্ছে। তখন বুঝিনি এই কথাগুলো একসময় কতোটা কষ্টের হয়ে বুকের ভেতর আছড়ে পড়বে! এখন তা অনুভব করছি। আমি বাড়িতে গেলে তিনি নিজেও কয়াগ্রামে আমাদের বাড়িতে আসতেন। কোনোদিন একটু থেকেই চলে যেতেন। কোনোদিন সারাদিনই থাকতেনÑ কবিতার কথা বলতেনÑ জীবনের কথা বলতেনÑ হতাশার কথা বলতেনÑ কুমারখালীর সাহিত্যচর্চার কথা বলতেনÑ স্বপ্ন দেখতেন কুমারখালীকে নিয়েÑ বলতেন লিটন আব্বাস একদিন ও অনেক নাম করবে। ওর লেখার হাতটা খুব ভালো। কবিতা গদ্য দুটোই ভালো লেখে। কুমারখালীর সাহিত্যচর্চাকে সেই তো এখন বাঁচিয়ে রেখেছে।’
কবি সৈয়দ আবদুস সাদিকের বাড়ির খানিকটা কাছে আমার একখ- জমি আছে জেনে একদিন তো জোর করে বললেন, ‘চলেন আপনার জমিটা দেখবো।’ জমির পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এখানে বাড়ি করবেন। এখানে সাহিত্যের আড্ডা করবেন। কুমারখালীকে আবার জাগিয়ে তুলবেন। আমরা সবাই মিলে আপনার এখানে সাহিত্য নিয়ে আড্ডা দেবো।’ কবি, আপনার সেই আশা পূরণ হয়নি, আর হবেও না কোনোদিন। আপনার কথাগুলো বেদনা হয়ে বুকের ভেতর বসতি নিয়েছে।
মাস ছয়েক আগে কয়া থেকে ঢাকায় আসার পথে আমি, মিলি ও কাব্য তাঁর ‘তবুও বসবাস’ বাড়িতে যাই। হঠাৎ আমাদেও দেখে কী যে খুশি হলেন! এটা খেতে দেন, ওটা খেতে দেন। নাতনিদের নিয়ে এসে কাছে বসিয়ে রাখলেন। আমাদের সঙ্গে পরিচয় করালেন। কাব্য নামটা ভীষণ পছন্দ তাঁর। বললেন, ‘বাবা কবি তো, সেই জন্য তোমার নাম ‘কাব্য’ দিয়েছে। কতো স্মৃতিÑ কতো কথা! তিনি আর কখনো কুমারখালী বাসস্ট্যান্ডের পাশে কবিতার বই নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবেন না, অস্থিব হয়ে বলবেন না, ‘প্রফেসর সাহেব, কতদূর? সমস্যা নেই, আমি দাঁড়িয়ে আছি। সাবধানে আসেন।’
প্রিয় কবি, আপনি আজ এতো দূর চলে গেছেন, কোনোভাবেই আপনার কাছে আর পৌঁছানো সম্ভব নয়। সহ¯্র চেষ্টা করেও সম্ভব নয়। আপনার কণ্ঠে আর কখনো শুনবো না, ‘আসেন আসেনÑ আমি দাঁড়িয়ে আছিÑ আপনার সঙ্গে দেখা না করে বাসায় যাচ্ছি না।’ কিন্তু আপনি তো আজ সত্যি চলে গেছেন, আমার জন্য একটুও অপেক্ষা করেননি, কারো জন্যেই করেননি। আমরাও কী আপনার কাছে ছুটে আসার চেষ্টা করেছি। ছুটে কী এসেছিলাম! না, আসিনি। এই কঠিন সত্য মানতেই হবে। আপনাকে আপনার যোগ্য সম্মান আমরা দিতে পারিনি। তবুও আপনি আমাদের মন ভরে ভালোবেসেছেন। আপনি বড় মনের মানুষ, তাই পেরেছেন। আমরা পারিনি। আপনার চলে যাওয়ার ভেতর দিয়েই এই সত্য আরও বেশি করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো। আর আপনিও কুমারখালীতে রবীন্দ্র-লালন-মীর মশাররফের সঙ্গে অনিবার্য উচ্চারিত নাম সৈয়দ আবদুস সাদিক নক্ষত্র উজ্জ্বলতায় আলোকিত হয়ে উঠবেনÑ সময়ের প্রবহমানে। কীর্তিমানের মৃত্যুতেই রচিত হয় অমরত্বÑআপনিও কীর্তিমান কবিÑ আপনিও মৃত্যুতেই রচনা করে গেলেন নিজের অমরত্ব।
রকিবুল হাসান
বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪
কবি সৈয়দ আবদুস সাদিকের জন্ম কুষ্টিয়ার কুমারখালীর সেরকান্দি গ্রামে। তাঁর কাব্যগ্রন্থ: ঘনীভূত শব্দের বসতি, তবুও বসবাস, অনুগত্য সর্বস্বত্ব, নিরন্তর এইসব, এবং স্বীকারোক্তি, জলশ্যাওলার ফুল, অপ্রত্যাশিত সন্ধি, কালো চুল কৃষ্ণচূড়া, কৃষ্ণপক্ষ ঘোড়দৌড়, না গৃহে না সমাজে, তুমি শ্রমণ আমি ভিক্ষু প্রভৃতি। কবিতাসমগ্র প্রথম খ-, দ্বিতীয় খ- ও তৃতীয় খ- প্রকাশিত হয়েছে। অসংখ্য রুবাইয়াৎ রচনা করেছেন।
কবি সৈয়দ আবদুস সাদিক গত ১৯ অক্টোবর প্রয়াত হয়েছেন। এটা আমার জন্য গভীর শোকের। লিখতে বসে চুপ করে বসে আছি অনেকক্ষণ। কী লিখবো! কেন লিখবো! কেন লিখতে হয় এরকম মৃত্যু নিয়ে! লেখক হলেই কী এই বেদনাবহন অনিবার্য! না লিখলে তো আরও বেশি যন্ত্রণাবহন করতে হয় বুকের ভেতর! না পারছি লিখতে, না পারছি এই বেদনা নিয়ে না-লিখে চুপ থাকতে। কতো মৃত্যু চলে যায় চোখের সামনে, মনের ভেতর। সব মৃত্যু তো নাড়া দেয় না। সব মৃত্যু তো অন্ধকারের মতো একা একা বসিয়ে রাখে না। কোনো কোনো মৃত্যু ভেতরটাকে দুমড়েমুচড়ে ফেলে, নদীর পাড়ভাঙার মতো ভেঙে ফেলে। ক্ষত-বিক্ষত করে। কতকিছু ভাবায়। কোনো কোনো মৃত্যু শুকনো পাতার মতো ভেসে যায়, চোখেও হয়তো পড়ে না। কোনো কোনো মৃত্যু বুকের ভেতর পাথরের মতো ভারি হয়ে থাকে। সৈয়দ আবদুস সাদিকে মৃত্যু আমার বুকের ভেতর পাথর-ভারি হয়ে বসে গেছে। চলে গেলেন তিনি। বেদনায় অন্ধকারের মতো একাকী চুপচাপ হয়ে আছি নিজের ভেতর। কোনোভাবেই বিশ^াস হচ্ছে না, তিনি নেইÑ এই পৃথিবীর সব হিসাব-নিকাশ চুকে দিয়ে চলে গেছেন, বহু দূরে। আমাদের চোখ অতদূরে কখনো কোনোভাবেই আর পৌছুবে না। মানুষ তো কোনো না সময় চলেই যায়Ñ ঠেকানোর কোনো পথ নেইÑ আমরাও যাবোÑ দুদিন আগে আর পরে। কিন্তু যতক্ষণ বেঁচে থাকে, ততক্ষণ আপনজন হারানো বেদনা বুকের ভেতর পাথর করে বহনের কষ্ট যে কতোটা তা আপনজন হারানোরাই অনুভব করতে পারে। কবি সৈয়দ আবদুস সাদিক কী আমাদের আপনজন ছিলেনÑ অবশ্যই আপনজন ছিলেনÑ ভালোবাসার মানুষ ছিলেনÑ শ্রদ্ধার মানুষ ছিলেন। শিশুর মতো অভিমানভরা মানুষ ছিলেন। একটু ভালোবাসলেই, একটু সম্মান করলেই শিশুর মতো সব ভুলে যেতেন। আমরা তাঁকে কতটুকু ভালোবাসতে পেরেছি, জানি না। তবে তিনি মন ভরে প্রাণ ভরে পুরো হৃদয় দিয়ে আমাদের ভালোবেসেছিলেন, ভালোবাসতে পেরেছিলেন।
কেন জানি তিনি আমাকে খুব পছন্দ করতেন। ভালোবাসতেন। কুমারখালীর কবি-নাট্যকার লিটন আব্বাসকে ভালোবাসতেন। কবি সিদ্দিক প্রামাণিককে ভালোবাসতেন। যারা লেখালেখি করতেন সবার প্রতি তাঁর অন্ধ ভালোবাসা ছিলো। ভালোবাসতেন কুমারখালীকে। ঢাকার জীবনযাপন ছেড়ে কুমারখালীতেই আবাস গড়েছিলেন স্থায়ীভাবে। বাড়িটার নামও দিয়েছিলেন নিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থের নামানুসারেÑ ‘তবুও বসবাস’। সেই বাড়িতে প্রথম গিয়েছিলাম ৫ আগস্ট, ২০১৫ সালে। ঝড়বৃষ্টির রাতে। ভয়াবহ ঝড়বৃষ্টি। কীভাবে যে দমকা ঝড়বৃষ্টিতে ফেরিঘাট পার হয়ে ভিজেপুরে লোকাল বাসে ঠেলাঠেলি করে কুমারখালী গিয়েছিলামÑ গভীর আবেগেÑ কবি সৈয়দ আবদুস সাদিকের বাসায় যাবো বলে। কারণ, সাউথইস্ট বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথিÑ তাঁকে সম্মাননা স্মারক দেওয়া হবে। আমি তখন বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান। ভিজেপুরে তাঁর বাসায় আমি আর কবি লিটন আব্বাস যখন পৌছলাম, কার্ডটা হাতে তাঁর দিলাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আরে কী করেছেন কী করেছেন! ভিজে তো শেষ হয়ে গেছেন!’ তিনি কার্ডটা পড়লেন। তার দুই চোখে পানি। মনে হলো বৃষ্টির সব পানি হুট করে তাঁর চোখে নেমে এলো। বললেন, ‘আমি কী আর অতবড় কবি! আপনি যে সম্মান দিলেন, আমি খুব খুশি হয়েছি। এটা আমার জীবনে সবচেয়ে বড় পুরস্কার। আর কোনো পুরস্কার না পেলেও আমার দুঃখ নেই।’ সেদিন এই সামান্য প্রাপ্তিতে তাঁর যে আনন্দ দেখেছি, তা এই মুহূর্তে আমি বেদনাহত হৃদয়ে অনুভব করছি। তিনি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। অনুষ্ঠানে মাননীয় উপাচার্য প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেন, উপউপাচার্য প্রফেসর ড. হুমায়ুন কবীর চৌধুরী, আবৃত্তিশিল্পী নাজমুল আহসানসহ বিশ^বিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার, বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বিভাগীয় প্রধানগণসহ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন। পুরো হলরুম ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। কবি সৈয়দ আবদুস সাদিককে সেদিন পুষ্পতোড়া দিয়ে গ্রহণ করেন মাননীয় উপাচার্য। অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথিরা সবাই মিলে সৈয়দ আবদুস সাদিকের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন। কবি খুব খুশি হয়েছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে আমার রুমে এসে বললেন, ‘প্রফেসর সাহেব, আজ আপনারা আমাকে যে সম্মান দিলেন, আমি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়ে গেছি। বাংলা একাডেমি পুরস্কারের জন্য আমার আর দুঃখ নেই।’ সেদিন প্রায় সারাটা দিন বাংলা বিভাগে আমার সঙ্গে ছিলেন। আমার ‘ব্যর্থ ভয়ংকর দৌড়ের কাছে’ কাব্যগ্রন্থ থেকে অনেকগুলো কবিতা পড়লেন। অথচ নিজের কাব্যগ্রন্থ থেকে একটা কবিতাও পড়েননি। এ যেন এক অনুজের প্রতি গভীর মমত্বের প্রকাশ।
কুমারখালী গেলেই তাঁর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছি। সবসময় হয়তো তা সম্ভব হয়নি। পরে শুনলে খুব মন খারাপ করতেন। অভিমান করতেন। বলতেন, ‘কুমারখালী এলেন। চলে গেলেন। দেখাটা হলো না। আমার নতুন বইটা আপনাকে দেওয়া হলো না। কুরিয়ারে পাঠাইনি আপনাকে নিজে হাতে দেবো বলে।’ এমন করে এতোটা ভালোবেসে আর কখনোই বলবেন না তিনি। কথাগুলো কানের ভেতর দিয়ে মস্তিষ্কের কোষে কোষে আঘাত করছে, অভিমান-বেদনাভরা কণ্ঠ দিব্যি কর্ণকুহরে অনুভূত হচ্ছে। তখন বুঝিনি এই কথাগুলো একসময় কতোটা কষ্টের হয়ে বুকের ভেতর আছড়ে পড়বে! এখন তা অনুভব করছি। আমি বাড়িতে গেলে তিনি নিজেও কয়াগ্রামে আমাদের বাড়িতে আসতেন। কোনোদিন একটু থেকেই চলে যেতেন। কোনোদিন সারাদিনই থাকতেনÑ কবিতার কথা বলতেনÑ জীবনের কথা বলতেনÑ হতাশার কথা বলতেনÑ কুমারখালীর সাহিত্যচর্চার কথা বলতেনÑ স্বপ্ন দেখতেন কুমারখালীকে নিয়েÑ বলতেন লিটন আব্বাস একদিন ও অনেক নাম করবে। ওর লেখার হাতটা খুব ভালো। কবিতা গদ্য দুটোই ভালো লেখে। কুমারখালীর সাহিত্যচর্চাকে সেই তো এখন বাঁচিয়ে রেখেছে।’
কবি সৈয়দ আবদুস সাদিকের বাড়ির খানিকটা কাছে আমার একখ- জমি আছে জেনে একদিন তো জোর করে বললেন, ‘চলেন আপনার জমিটা দেখবো।’ জমির পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এখানে বাড়ি করবেন। এখানে সাহিত্যের আড্ডা করবেন। কুমারখালীকে আবার জাগিয়ে তুলবেন। আমরা সবাই মিলে আপনার এখানে সাহিত্য নিয়ে আড্ডা দেবো।’ কবি, আপনার সেই আশা পূরণ হয়নি, আর হবেও না কোনোদিন। আপনার কথাগুলো বেদনা হয়ে বুকের ভেতর বসতি নিয়েছে।
মাস ছয়েক আগে কয়া থেকে ঢাকায় আসার পথে আমি, মিলি ও কাব্য তাঁর ‘তবুও বসবাস’ বাড়িতে যাই। হঠাৎ আমাদেও দেখে কী যে খুশি হলেন! এটা খেতে দেন, ওটা খেতে দেন। নাতনিদের নিয়ে এসে কাছে বসিয়ে রাখলেন। আমাদের সঙ্গে পরিচয় করালেন। কাব্য নামটা ভীষণ পছন্দ তাঁর। বললেন, ‘বাবা কবি তো, সেই জন্য তোমার নাম ‘কাব্য’ দিয়েছে। কতো স্মৃতিÑ কতো কথা! তিনি আর কখনো কুমারখালী বাসস্ট্যান্ডের পাশে কবিতার বই নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবেন না, অস্থিব হয়ে বলবেন না, ‘প্রফেসর সাহেব, কতদূর? সমস্যা নেই, আমি দাঁড়িয়ে আছি। সাবধানে আসেন।’
প্রিয় কবি, আপনি আজ এতো দূর চলে গেছেন, কোনোভাবেই আপনার কাছে আর পৌঁছানো সম্ভব নয়। সহ¯্র চেষ্টা করেও সম্ভব নয়। আপনার কণ্ঠে আর কখনো শুনবো না, ‘আসেন আসেনÑ আমি দাঁড়িয়ে আছিÑ আপনার সঙ্গে দেখা না করে বাসায় যাচ্ছি না।’ কিন্তু আপনি তো আজ সত্যি চলে গেছেন, আমার জন্য একটুও অপেক্ষা করেননি, কারো জন্যেই করেননি। আমরাও কী আপনার কাছে ছুটে আসার চেষ্টা করেছি। ছুটে কী এসেছিলাম! না, আসিনি। এই কঠিন সত্য মানতেই হবে। আপনাকে আপনার যোগ্য সম্মান আমরা দিতে পারিনি। তবুও আপনি আমাদের মন ভরে ভালোবেসেছেন। আপনি বড় মনের মানুষ, তাই পেরেছেন। আমরা পারিনি। আপনার চলে যাওয়ার ভেতর দিয়েই এই সত্য আরও বেশি করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো। আর আপনিও কুমারখালীতে রবীন্দ্র-লালন-মীর মশাররফের সঙ্গে অনিবার্য উচ্চারিত নাম সৈয়দ আবদুস সাদিক নক্ষত্র উজ্জ্বলতায় আলোকিত হয়ে উঠবেনÑ সময়ের প্রবহমানে। কীর্তিমানের মৃত্যুতেই রচিত হয় অমরত্বÑআপনিও কীর্তিমান কবিÑ আপনিও মৃত্যুতেই রচনা করে গেলেন নিজের অমরত্ব।