সৌম্য সালেক
এটা একটা পরিভ্রমণের ইতিবৃত্ত; এর ভ্রমিকের নাম মহাপ্রাজ্ঞ ব্যাসদেব। দীর্ঘ জীবন পেলে অনেকেই অনেক কিছু প্রত্যক্ষ করতে পারেন তবে ব্যাসদেব যা দেখেছেন এটা বিরল। একটি ধ্বংস হতে চলা রাজবংশকে সুরক্ষার জন্য পুত্র উৎপাদন; পা-ু ও ধৃতরাষ্ট্র দুই পুত্রের মধ্য দিয়ে কৌরব এবং পা-বদের বিকাশ, প্রসার আর কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে নির্বংশ হওয়া অবধি প্রত্যক্ষণ। একজীবনে আপন রক্তের বিপুল প্রসার এবং তার নির্মম যবনিকা দেখার এমন চরম দ্বিবিধ পরিণতির গল্প জগতে সম্ভবত কম রয়েছে। তবে এই ঘটনাপ্রবাহের বাইরে ব্যাসদেব ও তার সঙ্গদের জীবনব্যাপী সত্য সন্ধানের প্রচেষ্টা ও পরিভ্রমণ আমার কাছে অধিক তাৎপর্যবহ মনে হয়েছে। এই দীর্ঘ তপস্যার ফলে কি তারা সত্যের দেখা পেয়েছে কিংবা পেয়েছে এমন কোনো ধ্রুব যা অবলম্বনে চূড়ান্ত মুক্তি। না তেমন কিছুর ঈঙ্গিত এখানে নেই। তাহলে কি সত্য সন্ধানের প্রচেষ্টাই আসল বিষয়, তার উদ্ধার কিংবা দিশা প্রাপ্তির চেয়েও মহত্তর? হতে পারে সন্ধানই বড় বিষয়। কুরুযুদ্ধ প্রত্যক্ষণের পর বৃদ্ধ বিধ্বস্ত পৈল যখন ব্যাসের সঙ্গে অগ্রবর্তী হতে অপারগ, তখন শেষবারের মতো ব্যাস তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘পৈল আমরা কি ভুল করেছি?’ পৈল বলব: জানি না গুরুদেব। জীবনচর্যার বিষয়ে মন্তব্য করার মতো পরিণত আমি নই। যখন ব্যাস তাকে জোর দিয়ে অন্তর থেকে বলার জন্য আদেশ দিলেন তখন পৈল পুনরায় বললেন: ‘গুরুদেব, আমি বৃদ্ধ অভিজ্ঞ প্রাজ্ঞ এবং সত্যানুসন্ধানী হওয়ায় আগে যেখানে ছিলাম এখনো ঠিক সেখানেই আছি।’ অবাক বিষয় হলো আশ্রমের দিকে তাদের শেষ যাত্রায় পৈল ছাড়া অন্য সঙ্গ অর্থাৎ সুমন্ত, জৈমিনি এবং বৈশম্পায়নের ভাষ্যও প্রায় একই রকম ছিল। তারা দীর্ঘজীবনে সন্ধানের ব্রতযাপন করেও ধ্রুব সম্পর্কে নির্দিষ্ট মন্তব্য করতে পারেননি।
আখ্যানের একটি জায়গা আমাকে চরমভাবে আক্রান্ত করেছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে যখন সঙ্গসমেত ব্যাস ফিরছিলেন, তখন হঠাৎ একটি শিশুর কান্না শুনলেন। আশপাশে কান্নার উৎস সন্ধান করেও যখন তারা কিছুই পেল না, তখন ব্যাস বললেন, কিছু কি শুনতে পেলে বৈশম্পায়ন?
বৈশম্পায়ন বললেন, হ্যাঁ, গুরুদেব।
-কী?
-অশ্রুত কান্নার শব্দ।
-অশ্রুত?
-কার?
-মানবাত্মার।
পরে ব্যাস বললেন: ‘মানবাত্মার? বৈশম্পায়ন, মানবাত্মা বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। মানবাত্মা মৃত, মানুষ তাকে হত্যা করেছে!’ আজ ফিলিস্তিনের দিকে তাকালে মনে হয়, সত্যিই জগতে মানবাত্মা বলে কিছু নেই, মানুষ তাকে হত্যা করেছে। গাজা ও বৈরুতের বিধ্বস্ত মৃত মুমূর্ষু জনপদের দৃশ্য দেখলে মনে হয়, পৃথিবীতে সভ্যতা বলে কিছু নেই, আমরা নীতি ও ন্যায্যতার যে বয়ান পড়েছি আর বিশ্বনেতারা যা বলছে এসব শঠতা আর প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়!
উপন্যাসের আরেকটি জায়গা আমাকে দারুণভাবে আকর্ষণ করেছে। কুরুক্ষেত্র থেকে ফিরে চলার পথে ব্যাস সবান্ধব মেঘরাজ নামে এক প্রতাপশালী ব্যক্তির গৃহে দুদিনের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন, যদিও সেসময় যুদ্ধে পুত্রকে হারিয়ে মেঘরাজ বিষণœ ও শোকগ্রস্ত ছিলেন। তিনি কথায় কথায় ব্যাসের কাছে তাঁর সেনাধ্যক্ষ পিতার এক অভিনব ঘটনার কথা বলেছেন। তার পিতা অস্ত্রের সঙ্গে কথা বলতেন, অস্ত্র তার কথার জবাব দিতেন। তিনি একদিন বল্লমকে জিজ্ঞেস করলেন, আগামীকালের যুদ্ধে তোমার সাহায্যে আমি প্রথম যে ব্যক্তিকে হত্যা করব, তার সঙ্গে আমার কেমন সম্পর্ক? বল্লম জবাব দিলÑ মিত্রবৎ। দ্বিতীয়, তৃতীয় এমনকি দশম ব্যক্তির ক্ষেত্রেও বল্লম বললো, মিত্রবৎ।
তারপর পর্যায়ক্রমে তিনি, তলোয়ার এবং গদাকেও একই প্রশ্ন করলো, যাদের আমি হত্যা করবো তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কেমন, অস্ত্রগুলো বলল, তারা তোমার ভাই এবং বন্ধু। তখন লোকটি বিভ্রান্তভাবে বললেন, আমরা যদি আমাদের মিত্রদের এবং আমাদের শত্রুরা যদি তাদের মিত্রদের হত্যা করে তাহলে যুদ্ধ হবে কাদের সঙ্গে কাদের? তলোয়ার জবাব দিলো: মিত্রের সঙ্গে মিত্রের, ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের!
এজগতে সবাই একই রঙের রক্তের উত্তরাধিকার, সবাই মানবপ্রজাতি, সবাই মানুষ, ভাই ভাই, সকলে সকলের বন্ধু এবং মিত্র; এই বোধ যদি সঞ্চারিত হতো তাহলে পৃথিবী থেকে যুদ্ধ এবং হত্যাকা-ের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতো। আহা, মানুষ যদি মানুষকে ভাই-বন্ধুরূপে অন্তরে লালন করতো, ভাইয়ের বেদনায় যদি ব্যথিত হতো ভাই!
একটি জায়গায় আমি স্তব্ধ হয়েছি, ভেতরে অদ্ভুত এক ভীতি জেগেছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ঠিক পূর্বমুহূর্তে যখন যোদ্ধারা অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার অপেক্ষায়, যখন জিঘাংসা ভিন্ন তাদের হৃদয়ে অন্য কিছুর অস্তিত্ব নেই তখন কৃষ্ণ বললেন: ‘অর্জুন, আমি ভয়ঙ্কর কালরূপে আবির্ভূত হয়ে সমুদয় মানুষকে বিনাশ করতে প্রবৃত্ত!’
যুদ্ধোন্মাদ মুর্খ লোকদের মরিয়া হবার আগ্রাসন দেখে পরপর তিনি বললেন: ‘এই যুদ্ধোন্মাদ মূঢ় মানুষের দল জানে না আমি পূর্বেই এদের নিহত করেছি, এখন তুমি শুধু এই বিশাল বিনাশের নিমিত্তমাত্র হও।’
পবিত্র কোরআনের মাঝেও কিছু জায়গায় ভবিষ্যতকে এমন অতীত করে বর্ণনা করা হয়েছে, যেমন সূরা ইয়াসীনে বলা হয়েছে: ‘বস্তুত, এটা ছিল এক প্রচ- নাদ অতঃপর সঙ্গে সঙ্গে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো।’ যদি পূর্বের লিখিত বিবরণ মোতাবেক ইতোমধ্যে সবকিছু ঘটে থাকে তাহলে মানুষের কর্তব্য আসলে কী; কিংবা কোনো ঘটনায় তার হস্তক্ষেপ কতটুকু, এসব কি এমন বলে না যে মানুষ কেবলি ক্রীড়ানক! এই ভাবনায় আমি বিপর্যস্ত। মানুষ এবং অপরাপর সবকিছু কি এক মহাকালচক্রে বাঁধা আর তার সবকিছুই ইতোমধ্যে সম্পন্ন শুধু কালের সঙ্গে স্বাক্ষাতটুকু ছাড়া! আমি ভাবতে পারছি না; সম্ভবত আমার মতো অর্বাচীনের পক্ষে এ বিষয়ে বিশ্লেষণ কিংবা কথা বলার যে কেনো তৎপরতা ঝুঁকিপূর্ণ!
যেখানে মহাভারতের আখ্যানের ঐতিহাসিক ভিত্তির বিষয়ে প্রশ্ন আছে সেখানে ‘ব্যাস’ উপন্যাসের কাহিনীর সত্যাসত্য সম্পর্কে প্রশ্নের অনেক সুযোগ থাকা স্বাভাবিক যদিও গ্রন্থের ভূমিকায় লেখক নিজেই এ বিষয়ে বলেছেন যে, ‘মহাভারত ও অন্যান্য পৌরাণিক গ্রন্থে ব্যাসের জীবন সম্পর্কে যেটুকু তথ্য পাওয়া যায় তা একটি চরিত্র সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট নয়।’ তবে ব্যাসের জীবন সম্পর্কে প্রাপ্ত খ- খ- ঘটনাকে তিনি মহাভারতের ঘটনাপ্রবাহের সাথে যেভাবে প্রযুক্ত করেছেন এবং ঘটনার চেয়ে সত্য ও জীবন-নীতি সম্পর্কে পৌরাণিক ভাষ্যগুলোকে যেভাবে গ্রন্থনা করেছেন, এখানে লেখক শাহযাদ ফিরদাউসের কল্পনা শক্তি এবং সাহিত্যিক মুন্সিয়ানার প্রশস্তি গাইতে হয়।
আলোক রায়ের মতো আমারও মনে হয়, শাহযাদ ফিরদাউস এ কালের সত্যসন্ধানী এক মহৎ কথাশিল্পী।
ব্যাস উপন্যাসের আখ্যান বর্ণনা এবং অভিনব জীবনবীক্ষণ আমাকে রাত্রি জেগে বইটি শেষ করতে প্ররোচিত করেছে।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষে দুপক্ষের মাত্র দশজন জীবিত ছিল। মৃতদেহ আর ধ্বংসচিহ্নের মাঝে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ অশক্ত ব্যাস আর্তস্বরে বললেন, হায়, মাতা সত্যবতী! তোমার ভরতবংশের শেষ দেখে যাও, তোমার সাধের ভরতকুল! তাঁর ঠোঁট কেঁপে উঠল। স্বভাব-বর্জিত কণ্ঠস্বরে চিৎকার করে তিনি যা উচ্চারণ করলেন, সেই মর্মস্পর্শী ভাষণ বিদীর্ণ করেছে হৃদয়:
‘বিদ্যুদ্বধম এবাহং মৃত্যুম ঐচ্ছম’
আমি বজ্রাঘাতের মৃত্যু চেয়েছি, বজ্রাঘাতের মৃত্যু
হায়, আমার সন্তানরা পরস্পরকে আঘাত করেছে
পরস্পরকে হত্যা করেছে
পরস্পরকে ঘৃণা করেছে।
সহ¯্র বিনিদ্র রাত্রির তপস্যা, সহ¯্র দিনের নিরলস সাধনা
সহ¯্র জীবনের কৃচ্ছ্র সাধনার ফল
সহ¯্র জীবনের প্রজ্ঞার ফসল
একটি অপদার্থ তর্জনীর ক্রুদ্ধ ইঙ্গিতে ধূলিসাৎ হতে পারে!
হায় তর্জনী, হায় অপদার্থ তর্জনী!’
তিনি বললেন, বৈশম্পায়ন লিখে নাও :
লেলিহান লোভ আমন্ত্রণ করেছে ঈর্ষা
ঈর্ষা আমন্ত্রণ করেছে ক্রোধ
ক্রোধ আমন্ত্রণ করেছে যুদ্ধ
যুদ্ধ আমন্ত্রণ করেছে মৃত্যু
মৃত্যু হত্যা করেছে জীবন।
লিখে নাও :
এই সেই কাল, যে ঘৃণার মারণাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে জীবন।
অতিক্রম করেছে মৃত্যু
আর আক্রমণ করেছে অনাগত ভবিষ্যত!
সন্ধানী পাঠক ভাষাচিত্র থেকে প্রকাশিত বইটি সংগ্রহ করতে পারেন, এটা আপনাকে একটি দুর্দান্ত আখ্যানের সাথে এমন কিছু ভাষ্য উপহার দিবে যা অনন্য ও অভিনব। বইটি আমাকে উপহার দিয়েছেন প্রিয়জন কবি ও প্রাবন্ধিক সৈকত হাবিব, তাঁকে অশেষ ধন্যবাদ।
সৌম্য সালেক
বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪
এটা একটা পরিভ্রমণের ইতিবৃত্ত; এর ভ্রমিকের নাম মহাপ্রাজ্ঞ ব্যাসদেব। দীর্ঘ জীবন পেলে অনেকেই অনেক কিছু প্রত্যক্ষ করতে পারেন তবে ব্যাসদেব যা দেখেছেন এটা বিরল। একটি ধ্বংস হতে চলা রাজবংশকে সুরক্ষার জন্য পুত্র উৎপাদন; পা-ু ও ধৃতরাষ্ট্র দুই পুত্রের মধ্য দিয়ে কৌরব এবং পা-বদের বিকাশ, প্রসার আর কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে নির্বংশ হওয়া অবধি প্রত্যক্ষণ। একজীবনে আপন রক্তের বিপুল প্রসার এবং তার নির্মম যবনিকা দেখার এমন চরম দ্বিবিধ পরিণতির গল্প জগতে সম্ভবত কম রয়েছে। তবে এই ঘটনাপ্রবাহের বাইরে ব্যাসদেব ও তার সঙ্গদের জীবনব্যাপী সত্য সন্ধানের প্রচেষ্টা ও পরিভ্রমণ আমার কাছে অধিক তাৎপর্যবহ মনে হয়েছে। এই দীর্ঘ তপস্যার ফলে কি তারা সত্যের দেখা পেয়েছে কিংবা পেয়েছে এমন কোনো ধ্রুব যা অবলম্বনে চূড়ান্ত মুক্তি। না তেমন কিছুর ঈঙ্গিত এখানে নেই। তাহলে কি সত্য সন্ধানের প্রচেষ্টাই আসল বিষয়, তার উদ্ধার কিংবা দিশা প্রাপ্তির চেয়েও মহত্তর? হতে পারে সন্ধানই বড় বিষয়। কুরুযুদ্ধ প্রত্যক্ষণের পর বৃদ্ধ বিধ্বস্ত পৈল যখন ব্যাসের সঙ্গে অগ্রবর্তী হতে অপারগ, তখন শেষবারের মতো ব্যাস তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘পৈল আমরা কি ভুল করেছি?’ পৈল বলব: জানি না গুরুদেব। জীবনচর্যার বিষয়ে মন্তব্য করার মতো পরিণত আমি নই। যখন ব্যাস তাকে জোর দিয়ে অন্তর থেকে বলার জন্য আদেশ দিলেন তখন পৈল পুনরায় বললেন: ‘গুরুদেব, আমি বৃদ্ধ অভিজ্ঞ প্রাজ্ঞ এবং সত্যানুসন্ধানী হওয়ায় আগে যেখানে ছিলাম এখনো ঠিক সেখানেই আছি।’ অবাক বিষয় হলো আশ্রমের দিকে তাদের শেষ যাত্রায় পৈল ছাড়া অন্য সঙ্গ অর্থাৎ সুমন্ত, জৈমিনি এবং বৈশম্পায়নের ভাষ্যও প্রায় একই রকম ছিল। তারা দীর্ঘজীবনে সন্ধানের ব্রতযাপন করেও ধ্রুব সম্পর্কে নির্দিষ্ট মন্তব্য করতে পারেননি।
আখ্যানের একটি জায়গা আমাকে চরমভাবে আক্রান্ত করেছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে যখন সঙ্গসমেত ব্যাস ফিরছিলেন, তখন হঠাৎ একটি শিশুর কান্না শুনলেন। আশপাশে কান্নার উৎস সন্ধান করেও যখন তারা কিছুই পেল না, তখন ব্যাস বললেন, কিছু কি শুনতে পেলে বৈশম্পায়ন?
বৈশম্পায়ন বললেন, হ্যাঁ, গুরুদেব।
-কী?
-অশ্রুত কান্নার শব্দ।
-অশ্রুত?
-কার?
-মানবাত্মার।
পরে ব্যাস বললেন: ‘মানবাত্মার? বৈশম্পায়ন, মানবাত্মা বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। মানবাত্মা মৃত, মানুষ তাকে হত্যা করেছে!’ আজ ফিলিস্তিনের দিকে তাকালে মনে হয়, সত্যিই জগতে মানবাত্মা বলে কিছু নেই, মানুষ তাকে হত্যা করেছে। গাজা ও বৈরুতের বিধ্বস্ত মৃত মুমূর্ষু জনপদের দৃশ্য দেখলে মনে হয়, পৃথিবীতে সভ্যতা বলে কিছু নেই, আমরা নীতি ও ন্যায্যতার যে বয়ান পড়েছি আর বিশ্বনেতারা যা বলছে এসব শঠতা আর প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়!
উপন্যাসের আরেকটি জায়গা আমাকে দারুণভাবে আকর্ষণ করেছে। কুরুক্ষেত্র থেকে ফিরে চলার পথে ব্যাস সবান্ধব মেঘরাজ নামে এক প্রতাপশালী ব্যক্তির গৃহে দুদিনের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন, যদিও সেসময় যুদ্ধে পুত্রকে হারিয়ে মেঘরাজ বিষণœ ও শোকগ্রস্ত ছিলেন। তিনি কথায় কথায় ব্যাসের কাছে তাঁর সেনাধ্যক্ষ পিতার এক অভিনব ঘটনার কথা বলেছেন। তার পিতা অস্ত্রের সঙ্গে কথা বলতেন, অস্ত্র তার কথার জবাব দিতেন। তিনি একদিন বল্লমকে জিজ্ঞেস করলেন, আগামীকালের যুদ্ধে তোমার সাহায্যে আমি প্রথম যে ব্যক্তিকে হত্যা করব, তার সঙ্গে আমার কেমন সম্পর্ক? বল্লম জবাব দিলÑ মিত্রবৎ। দ্বিতীয়, তৃতীয় এমনকি দশম ব্যক্তির ক্ষেত্রেও বল্লম বললো, মিত্রবৎ।
তারপর পর্যায়ক্রমে তিনি, তলোয়ার এবং গদাকেও একই প্রশ্ন করলো, যাদের আমি হত্যা করবো তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কেমন, অস্ত্রগুলো বলল, তারা তোমার ভাই এবং বন্ধু। তখন লোকটি বিভ্রান্তভাবে বললেন, আমরা যদি আমাদের মিত্রদের এবং আমাদের শত্রুরা যদি তাদের মিত্রদের হত্যা করে তাহলে যুদ্ধ হবে কাদের সঙ্গে কাদের? তলোয়ার জবাব দিলো: মিত্রের সঙ্গে মিত্রের, ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের!
এজগতে সবাই একই রঙের রক্তের উত্তরাধিকার, সবাই মানবপ্রজাতি, সবাই মানুষ, ভাই ভাই, সকলে সকলের বন্ধু এবং মিত্র; এই বোধ যদি সঞ্চারিত হতো তাহলে পৃথিবী থেকে যুদ্ধ এবং হত্যাকা-ের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতো। আহা, মানুষ যদি মানুষকে ভাই-বন্ধুরূপে অন্তরে লালন করতো, ভাইয়ের বেদনায় যদি ব্যথিত হতো ভাই!
একটি জায়গায় আমি স্তব্ধ হয়েছি, ভেতরে অদ্ভুত এক ভীতি জেগেছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ঠিক পূর্বমুহূর্তে যখন যোদ্ধারা অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার অপেক্ষায়, যখন জিঘাংসা ভিন্ন তাদের হৃদয়ে অন্য কিছুর অস্তিত্ব নেই তখন কৃষ্ণ বললেন: ‘অর্জুন, আমি ভয়ঙ্কর কালরূপে আবির্ভূত হয়ে সমুদয় মানুষকে বিনাশ করতে প্রবৃত্ত!’
যুদ্ধোন্মাদ মুর্খ লোকদের মরিয়া হবার আগ্রাসন দেখে পরপর তিনি বললেন: ‘এই যুদ্ধোন্মাদ মূঢ় মানুষের দল জানে না আমি পূর্বেই এদের নিহত করেছি, এখন তুমি শুধু এই বিশাল বিনাশের নিমিত্তমাত্র হও।’
পবিত্র কোরআনের মাঝেও কিছু জায়গায় ভবিষ্যতকে এমন অতীত করে বর্ণনা করা হয়েছে, যেমন সূরা ইয়াসীনে বলা হয়েছে: ‘বস্তুত, এটা ছিল এক প্রচ- নাদ অতঃপর সঙ্গে সঙ্গে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো।’ যদি পূর্বের লিখিত বিবরণ মোতাবেক ইতোমধ্যে সবকিছু ঘটে থাকে তাহলে মানুষের কর্তব্য আসলে কী; কিংবা কোনো ঘটনায় তার হস্তক্ষেপ কতটুকু, এসব কি এমন বলে না যে মানুষ কেবলি ক্রীড়ানক! এই ভাবনায় আমি বিপর্যস্ত। মানুষ এবং অপরাপর সবকিছু কি এক মহাকালচক্রে বাঁধা আর তার সবকিছুই ইতোমধ্যে সম্পন্ন শুধু কালের সঙ্গে স্বাক্ষাতটুকু ছাড়া! আমি ভাবতে পারছি না; সম্ভবত আমার মতো অর্বাচীনের পক্ষে এ বিষয়ে বিশ্লেষণ কিংবা কথা বলার যে কেনো তৎপরতা ঝুঁকিপূর্ণ!
যেখানে মহাভারতের আখ্যানের ঐতিহাসিক ভিত্তির বিষয়ে প্রশ্ন আছে সেখানে ‘ব্যাস’ উপন্যাসের কাহিনীর সত্যাসত্য সম্পর্কে প্রশ্নের অনেক সুযোগ থাকা স্বাভাবিক যদিও গ্রন্থের ভূমিকায় লেখক নিজেই এ বিষয়ে বলেছেন যে, ‘মহাভারত ও অন্যান্য পৌরাণিক গ্রন্থে ব্যাসের জীবন সম্পর্কে যেটুকু তথ্য পাওয়া যায় তা একটি চরিত্র সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট নয়।’ তবে ব্যাসের জীবন সম্পর্কে প্রাপ্ত খ- খ- ঘটনাকে তিনি মহাভারতের ঘটনাপ্রবাহের সাথে যেভাবে প্রযুক্ত করেছেন এবং ঘটনার চেয়ে সত্য ও জীবন-নীতি সম্পর্কে পৌরাণিক ভাষ্যগুলোকে যেভাবে গ্রন্থনা করেছেন, এখানে লেখক শাহযাদ ফিরদাউসের কল্পনা শক্তি এবং সাহিত্যিক মুন্সিয়ানার প্রশস্তি গাইতে হয়।
আলোক রায়ের মতো আমারও মনে হয়, শাহযাদ ফিরদাউস এ কালের সত্যসন্ধানী এক মহৎ কথাশিল্পী।
ব্যাস উপন্যাসের আখ্যান বর্ণনা এবং অভিনব জীবনবীক্ষণ আমাকে রাত্রি জেগে বইটি শেষ করতে প্ররোচিত করেছে।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষে দুপক্ষের মাত্র দশজন জীবিত ছিল। মৃতদেহ আর ধ্বংসচিহ্নের মাঝে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ অশক্ত ব্যাস আর্তস্বরে বললেন, হায়, মাতা সত্যবতী! তোমার ভরতবংশের শেষ দেখে যাও, তোমার সাধের ভরতকুল! তাঁর ঠোঁট কেঁপে উঠল। স্বভাব-বর্জিত কণ্ঠস্বরে চিৎকার করে তিনি যা উচ্চারণ করলেন, সেই মর্মস্পর্শী ভাষণ বিদীর্ণ করেছে হৃদয়:
‘বিদ্যুদ্বধম এবাহং মৃত্যুম ঐচ্ছম’
আমি বজ্রাঘাতের মৃত্যু চেয়েছি, বজ্রাঘাতের মৃত্যু
হায়, আমার সন্তানরা পরস্পরকে আঘাত করেছে
পরস্পরকে হত্যা করেছে
পরস্পরকে ঘৃণা করেছে।
সহ¯্র বিনিদ্র রাত্রির তপস্যা, সহ¯্র দিনের নিরলস সাধনা
সহ¯্র জীবনের কৃচ্ছ্র সাধনার ফল
সহ¯্র জীবনের প্রজ্ঞার ফসল
একটি অপদার্থ তর্জনীর ক্রুদ্ধ ইঙ্গিতে ধূলিসাৎ হতে পারে!
হায় তর্জনী, হায় অপদার্থ তর্জনী!’
তিনি বললেন, বৈশম্পায়ন লিখে নাও :
লেলিহান লোভ আমন্ত্রণ করেছে ঈর্ষা
ঈর্ষা আমন্ত্রণ করেছে ক্রোধ
ক্রোধ আমন্ত্রণ করেছে যুদ্ধ
যুদ্ধ আমন্ত্রণ করেছে মৃত্যু
মৃত্যু হত্যা করেছে জীবন।
লিখে নাও :
এই সেই কাল, যে ঘৃণার মারণাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে জীবন।
অতিক্রম করেছে মৃত্যু
আর আক্রমণ করেছে অনাগত ভবিষ্যত!
সন্ধানী পাঠক ভাষাচিত্র থেকে প্রকাশিত বইটি সংগ্রহ করতে পারেন, এটা আপনাকে একটি দুর্দান্ত আখ্যানের সাথে এমন কিছু ভাষ্য উপহার দিবে যা অনন্য ও অভিনব। বইটি আমাকে উপহার দিয়েছেন প্রিয়জন কবি ও প্রাবন্ধিক সৈকত হাবিব, তাঁকে অশেষ ধন্যবাদ।