বেশিদিন থাকবো না আর
মহাদেব সাহা
বেশিদিন থাকবো না আর চলে যাবো গোলাপের
গাঢ় গিঁট খুলে
চলে যাবো পিঁড়ির গহন স্নেহ ভেঙে, চলে যাবে,
অনেক বসেছি
বেশি তো থাকবো না আর চলে যাবো মেঘ রেখে,
মমতাও রেখে
মন্ময় কাঁথাটি রেখে চলে যাবো বেশি দেরি নেই!
কুশন ও কার্পেটের নিবিড় গোধূলি ফেলে চলে যাবো
চাই কি ফুলের শুশ্রƒষা আর ফুলদানিরও আদর,
চলে যাবো এখাবে বসার সুখ ফেলে, চলে যাবে
বেত, বাঁশ, বস্তুকে মাড়িয়ে,
বেশি দেরি নেই চলে যাবো জমাট মঞ্চেরও মোহ ভেঙে
মেধাকেও পরাবো বিরহ, আত্মাকেও অনন্ত বিচ্ছেদ।
বেশিদিন থাকবো না চলে যাবো এই তীব্র টান
ভেদ করে, ফেলে রেখে এই আন্তরিকতার জামা,
হাতের সেলাই
অধিক থাকবো না আর অনেক জড়িয়ে গেছি চলে যাবো
আসর ভাঙার আগে, আচ্ছন্নতা উন্মেষেরও আগে
চলে যাবো চোখের জলেরও আগে না হলে পারবো না।
শীতের ক্বাসিদা
নাসির আহমেদ
শীতের অস্তিত্ব ছিল একদিন জীবনদর্শন:
জীবনকে মনে হতো কলিম মাঝির ফুটো নাও
দুঃখজল সেঁচে নৌকো কোনোমতে বাঁচিয়ে রেখেই
প্রমত্তা নদীতে নিত্য এপার ওপার।
এখন শীতের কথা ভাবছি যখন
তখন কিছুই পষ্ট ভাসছে না চোখে কুয়াশায়।
অনর্থক জীবনের পথে পথে দেখি
গহীন কুয়াশা যেন রহস্যের মায়া দুঃখময়।
আজ ভিন্ন প্রশ্ন জাগে,শীত কি মায়ের মুখ
দূর পাড়াগায়?
প্রবাসী সন্তান যার- মাতৃস্নেহ-তৃষ্ণা হাহাকার?
ট্রেনের জানালা-পথে অস্পষ্ট দ্রুত পার হওয়া
সবুজ শ্যামল প্রকৃতির মায়াছবি? বুঝতে পারি না।
ধানকাটা শূন্য মাঠ, কচুরিপানায় ছাওয়া জলহীন খাল?
প্রচ- কাঁপুনি নিয়ে নাড়ার আগুনে হাত সেঁকে বেঁচে থাকা, নাকি
সূর্যেরপ্রতীক্ষা নিয়ে ভয়াবহ অন্ধকারে নিরন্ন জীবন?
শীত মানে মাতৃহীন জীবনে কি মাকে পাওয়া সকালের রোদ?
নাকি জন্মভূমি জুড়ে বর্গীর তা-ব দেখে সম্মিলিত ক্রোধ?
ঘোলা রোদ
হাসান কল্লোল
নিজের মুখচ্ছবি এবং যাদের দেখবার জন্য
একদা আকুল ছিল প্রাণ
ঘ্রাণের ঘৃণায় কিংবা প্রেমের আলসেমিতে তাদের
অনেকেই চলে গেছে তাদের মন্দিরে
কোটরে পাখি ও বেজীদের সাথে আমার
বেশ সখ্য! হাত-পা বিছিয়ে বসে থাকা
আমার একলা দুপুর তাদেরই সংগে কাটে,
দেখি প্রায় ঝিমুচ্ছে অলস পুকুর!
নতজানু হয়নি বলে কখনো হবেনা
এমন তো নয়
¯্রষ্টা ছাড়া আর কোন শরীরী বা অশরীরী
অস্তিত্ব নাই অসীম জেনে
তাকেই সর্বশক্তিমান মানি
জানি তোমাদের কেউ কেউ দেব সেজে
দেবী সেজে চাইছো আনত কুর্নিশ।
শীষ দিয়ে লেজ মেলে যে পাখি চলে গেল;
সে কি ছিল আমাদের বোন?
শীত বিকেলের ঘোলা রোদে এখন আমি
প্রতিদিন দুঃখ শুকাই
ফ্ল্যাশব্যাক : রাজপুণ্যাহ
হাফিজ রশিদ খান
মাঘের বাতাস ঠা-ায় কাঁপতে-কাঁপতে এসেছ বুঝি
বোমাং পরগনার
রাজপুণ্যা’র খবর নিয়ে
ওখানে রাজার ছেলে শিশিরবিন্দুর স্বচ্ছ জামা গায়ে
ঘাসের ওপর হেঁটে যায়
নিশি পাহারায়
বেতছড়া পাহাড়ের কালো মোরগের
চকচকে পালকের রোদ নাচে
জরদ সকালে
ওখানে ত্রিপুরা শ্যামাঙ্গিনী
দোচোয়ানি বিকেলে ঘামের গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে
উলের জাম্পার কিনিতে মেলায় যায়
তুমি বুঝি সেই আগুন পোয়ানো শৈত্যের বাহন-
এলে আমার খিড়কি দিয়ে...
কোথাও উন্মুক্ত হলে
খালেদ হামিদী
কোথাও উন্মুক্ত হলে ঘুমন্ত নরের শুধু উদ্ধত শরম
তমাল ফুলের ধারা এর ওপর কীভাবে ঝরিছে না জেনে
তুমি ‘কাঁথা, কাঁথা!’ হেঁকে দিতে চাইলে ঢেকে
কে তবে সকাল চিরে ছুটে যায় দুই হাতে কুয়াশা সরিয়ে?
অমন দৌড়েও ধাক্কা না খেলেও পরস্পর ঘুম-ভাঙা নর
ভুলেও দেখে না চোখে সর্ষেফুল।
তাই আমরা সরে এলে মনে পড়ে ওঝা তোর কীসের আছর
ছাড়াতে এসেই সরিষার ভূত দেখে
পালায় সহসা?
‘কাছে তুই নাই, তোর স্মৃতির অদম্য ভূত জড়ায় আমারে।
এমন মায়ার আলিঙ্গন ত্রিভুবনে
নাই রে, বিশ্বাস কর।’ ‘তাড়া আছে, ননদিনী দেইখ্যা লাইব, যাই।’
বলেই মিলিয়ে গেলে কোথায় যে হায়!
অথচ বটেশ্বরের ক্ষেতে, উয়ারীরও
মাঠে মাঠে নিজেদের কত যে হারাই
সরিষার আদিগন্ত হলুদ সমুদ্রে!
নাগরিক শীতরাত্রি
রহিমা আখতার কল্পনা
নিঃসঙ্গ কুকুরের গলায় ব্যথিত রাত্রি আর্তনাদ করে।
নিঃসঙ্গ রাত্রিকাল
বালকবেলার সীমিতবিত্ত গ্রামজীবন, মায়াময় গৃহস্থ জীবন
ফিরে ফিরে আসে উজ্জ্বলতা-পিপাসায় মৃতপ্রায় এই রাতে।
জোছনার মধুঢালা চাঁদ
জাগরিত এই রাতে বুঝি নামবে লেকের জলে,
সারিবদ্ধ নাগরিক বাতিমালা অর্ধবৃত্ত আয়তনে
মেলে আছে নীলচে আলোর মগ্ন আলিঙ্গন,
ওই চাঁদ নেমে এলে বুকে টেনে নেবে বলে
ম্রিয়মাণ জেগে আছে কালো জলভরা লেকের হৃদয়, চুপ-
বাতাসে উড়ছে শীত, বাতাস জড়িয়ে ধরে প্রবল নামছে শীত।
আজ বহুদূর, বহুদূরে হাতছানি দেয়া সেই সুদূরের রাত,
শীতরাত, পূর্ণিমাদুধের ধারাজলে স্নানশেষে
ফুল্ল জোছনার লগ্ন, মায়া-নক্ষত্রের কৈশোরিক রাত
ভীষণ ভীষণ মনে পড়ে।
সুনসান মধ্যরাতে কুকপক্ষীর ডাক
বাঁশঝাড়ে ঝিরিঝিরি শীতল বাতাস এলোমেলো
বসতবাড়ির প্রাচীন গাছের কোটরে লুকানো
তক্ষকের প্রহর-ঘোষণা-করা ভয় জাগানিয়া তীব্র তীব্র ডাক
স্মৃতিময় ঐশ্বর্যময় সেই আপন অন্ধকার
বড় বেশি বড় বেশি মনে পড়ে আজ।
দূরে নাগরিক বেওয়ারিশ কুকুর যাচ্ছে ডেকে
বুঝি বা সে ভয়ে আর্ত, বুঝিবা সে মধ্যমাঠে একা
নামগোত্রহীন মামুলি কুকুর তারস্বরে কাঁদছে করুণ
সে এখন তারি মতো সঙ্গহীন রাত্রির সুখের দুঃখের বান্ধব সহচর।
নির্বান্ধব কুয়াশাকাতর ঘুমন্ত শীতের রাত-
বাতাসে উড়ছে শীত, বাতাস জড়িয়ে ধরে প্রবল নামছে শীত
পথকুকুরের পরিশ্রান্ত কণ্ঠনালীতে নগর কেমন কাঁদছে!
মাঘের সকাল
মাহফুজ আল-হোসেন
কুয়াশার কম্বল মুড়ি দেয়া হঠকারী মাঘের সকাল
কেন জানিনা প্রণয় বোঝেনা
দেখে না বিবস্ত্র বৃক্ষের ক্ষয়কাশ
শোনে না দূরাগত কান্নার আহির ভৈরব
অথচ বিবাগী রৌদ্রের সাথে দুপুরের বনিবনা
ঝুলে আছে গার্হস্থ্য লাউয়ের ডগায়
আর অ্যাকুরিয়ামের রঙিন কলহাস্যে ভরে থাক
আসন্ন সমুদ্রযাত্রার হেলেনিক লাফঝাঁপ
ৃবাসনা
মুজিব ইরম
যদি আসি
যেন ফের
সর্ষেখেতে ফুল হয়ে ফুটি
শীতফুলের আয়ু
মালেক মুস্তাকিম
আসন্ন শীতকালের মতো ছোট হয়ে আসে আমাদের আয়ু-
কুয়াশারা লিখে রাখে সুইসাইড নোট
গোপন ব্যালটে
সময় একটা শামুকের খোল-
তার ভেতরে লুকিয়ে থাকে ধানপাতার দৌড়
পথের ধারে দুটো নিশ্বাস রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে ট্রাফিকরুম
ছোট হয়ে আসে অপেক্ষা-
প্রকা- বটগাছের ভেতর স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে মানুষ
জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে শুয়ে থাকা রাস্তায় ফুটে আছে বিয়োগচিহ্ন।
রাতের মলাট পেরুলেই পায়ের কাছে নেমে আসে শীতকাল।
লঞ্চঘাটে লেখা কবিতা
মাসুদার রহমান
তুমি কী ঘুমিয়ে পড়েছ! তুমিও কী জেগে আছো
এই তীব্র শীতের রাতে!
বাইরে নির্জনতা; থেকে থেকে ট্রাক ও লরির শব্দ
পেঁচা ডাকে। কখনো হঠাৎ পরিযায়ী হাঁস অন্ধকার আকাশে
ডেকে ডেকে উড়ে যায়
এমন শীতের রাতে বালিশে মাথা রেখে নিজ হৃৎপি-ের
শব্দও শোনা যায়
তুমি কি শুনতে পাচ্ছো, লঞ্চঘাট থেকে ‘এম ভি মাসুদার’ নামে
এক লঞ্চ ভেঁপু দিয়ে নিরুদ্দেশ চলে যাচ্ছে
রিমঝিম রিমঝিম
জুনান নাশিত
শীত এলে ভালোবাসা মরে যায়
নাকি জেগে ওঠে?
আমরা জানি না
আমাদের ভালোবাসাবাসি
বিসমিল্লা খাঁর সানাইয়ের চেয়েও
বিনিদ্র, বিনয়ী।
‘কাফকাজ লাস্ট লাভ’ আমরা পড়েছি
বহুবার, শৃঙ্গারের আগে
বেহালার বুনোট ছড়িয়ে
প্রতিটি সঙ্গম সুখে
প্রতিধ্বনিত নীরবে ‘লাভ এন্ড লাস্ট’
পড়েছি দু’জনে একাগ্র উদাস রাতে
তখন বসন্ত ছিল, নাকি শীত?
নাকি বর্ষা অথবা শরত?
কি ছিল কে ছিল তাকিয়ে দেখিনি
দেখেছি দু’জন দু’জনারে।
এখন পুরোটা বছর জুড়েই শীত
এখন দূরের মেঘনার বুকে
কুয়াশা প্রাচীর রিমঝিম রিমঝিম!
চিরায়ত বাংলায়
হাদিউল ইসলাম
মাঘ যায়
মুকুলে ছেয়েছে মন
পরাগায়নের গানে
আজ উচাটন
কুয়াশা রচিত ভোর
ছিঁড়ে বেরুচ্ছে রোদ্দুর
স্বরচিত তার মুখ
একপ্রস্ত সুখ
গাছে গাছে জাতিশ্মর
পথে বিছানো অন্তর
পাতার মর্মর
মাথার উপরে কোকিলের স্বর
হাওয়াময় গ্রাম
প্রজাপতি লিখে তার নাম
ফুলেদের গা’য়
চিরায়ত বাংলায়
কুয়াশা দিন
মুশাররাত
শিশিরকণায় আমাদের আজ
ভিজেছে পায়ের তালু
সর্ষে ফুলের রেণু মাখা মৌ
যৌবনে আলুথালু
আমাদের আজ বিরহী সকাল
কী চাই, কী চাই মন
ধোঁয়াশার মতো আবছায়া হয়ে
আসে কি পথিকজন?
আমাদের আজ লেপ-কাঁথা মুড়ে
পিঠাপুলি খাওয়া দিন
মায়া মাখা হাত, শীতের প্রভাত
মাতৃত্বের ঋণ!
আমাদের আজ কুয়াশার দিন
আকাশের মন ভারি
রাতের আগেই নামিয়ে আঁধার
সূর্য দিয়েছে আড়ি।
জলমগ্ন শীত
সঞ্জয় দেওয়ান
যতœ করে পণ করেছি
এবার শীতে তোমার হবো;
কঠোর ব্রতের আগল ভেঙে
এবার শীতে নষ্ট হবো!
কাটবো সাঁতার পদ্মপুকুর জলে
বিবাগী হাওয়ার ¯্রােতে।
একটু না হয় চুম্বন দিও
জোছনা ঝরা রাতে
আগুন মেখে ঠোঁটের সীমান্তে।
এবার মধুময় শীতে রাতভর
তোমার খোলা চুলের গন্ধে নিমজ্জিত হবো;
সমুদ্র স্নানে ডুবে যাবো
হিম সকালের সোনালি রোদে।
চলেই যাব যখন জানি
ঠিকই এবার পুড়বো নগ্ন
বুকের দারুণ উত্তাপে!
যাত্রাপালায় শীত আবছায়া
সোহেল মাজহার
বিশ্বাস করুন কোনো বদ অভ্যাস নেই তার
কেবলই রক্তে জেগে ওঠে ঢেউ, স্মৃতির বিকার...
রাত গভীর হলেই নরেচরে ওঠে কেউ- যেনো দীর্ঘ ঘুম শেষে জাদুগ্রস্ত সম্মোহিত মানুষের মতো। অথচ দেখুন কী সাধারণ বেশভূষা, শরীরের উৎকট ঘামের ঘ্রাণে আকণ্ঠ ডুবে থেকে সে ঠিক সন্ধ্যা শেষে ফিরে আসে পাখির নীড়ে নয়, বাবুইপাখির আত্মতৃপ্ত বাসায় নয়, মরচে ধরা টিনের বাড়িতে... যেখানে শীতের কুয়াশা ঝরে বৃষ্টির মতো ফোঁটায় ফোঁটায়... মুখরা বউয়ের কাছে গোবেচারা ছাড়া তার আর কীইবা পরিচয় থাকতে পারে! কিন্তু শীত এলেই অন্য মানুষ, আতর- সুর্মার মঁ-মঁ গন্ধে হেঁটে যাচ্ছে সংকোচে নুয়ে যাওয়া অপরাধী নয়, যাত্রাপালার হিরো, উদ্যত কেউ... ডানাকাটা পরীর দেহে- শরীরের ভাঁজে ভাঁজে ওঠে সমুদ্রের উদ্দাম ঢেউ, সর্বনাশা... নর্তকীর পায়ের কাছে দেদার দু’হাতে ছড়িয়ে যাচ্ছে মুদ্রার ঝনাৎ ঝনাৎ ধ্বনি কোমরের খাঁজে, পীনোন্নত স্তনের ঈষৎ আহবানে... আসলে সে একজন নিরাবেগ মানুষ। তবু যাত্রা পালায় সে কাকে খোঁজে? কৈশোরে হারালো যাকে, কলেজের ব্ল্যাকবোর্ডে অগোচরে যে নাম বারবার লিখে মুছে দিতো সংকোচে, কিংবা আজও সর্বনাম ও বিশেষণের আড়ালে কে তাকে নিয়ে যায় কুয়াশার ঘোর রহস্যে শীতের সাদৃশ্যে... আবছায়ার অস্পষ্ট আদলে।
এ কেমন ঋতু রোগ শীত এলেই কুহকী-স্বপ্নে দেয় হানা
ভেসে ওঠে তাবৎ মুখের আবছায়া, যাত্রাপালার নজরানা
শীতপাখি
এমরান কবির
তবে, ভাবে ও প্রভাবে
আঁকা যায় না এইসব দৃশ্য
কেননা দৃশ্যের মধ্যে এসে পড়েছেন তীর
প্রতি ইঞ্চিতে তার যত বিদ্ধতা
ততই রক্তভাষ্য
এই দৃশ্য আঁকা যায় না
জীবনের উড়ালে এসে সহ¯্রপথে
এ কেমন মৃত্যুবিভ্রম!
পাখি তবু উড়ে আসে শীতের রেখায়
আমরা হরণ করি তীর ও তীরবিদ্ধতায়
প্রথম প্রেম
নজরুল সাজু
তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম শিউলি ফুলের ভোরে,
মুক্তোর মতন টলমল চোখে স্বপ্নের ডাকে ঝরে।
তোমার সেই হাসি, গোপন ভাষা,
হৃদয়ের গভীরে সূক্ষ্ম ভালোবাসা।
দৃষ্টির আড়াল হতে চেয়েও,
প্রতিটি ধ্বনি, প্রতিটি ছোঁয়া, আমার মনে বয়ে নিয়ে গেছে স্রোত।
তোমার হাতের স্পর্শে লেগেছিল কাঁপন,
মনে হয়েছিল, এ যেন হাজার বছরের আপন।
তোমার খোলা চুলের গন্ধে মিশেছিল শীতের সুর,
সে কি প্রথম প্রেম ছিল, নাকি জীবনের এক মধুর।
বুঝিনি তখন, প্রেম এত গভীর,
জীবনের প্রতিটি বাঁকে রেখে যায় চির।
আজও মাঝে মাঝে দেখি সেই মুখ,
যেন আমার প্রথম প্রেমের চিরন্তন সুখ।
তুমি আছো, তুমি থাকবে, স্মৃতির ¯িœগ্ধে,
আমার হৃদয়ে লেখা থাকবে তোমার নাম,
প্রথম প্রেমের সেই কবিতার একমাত্র ছন্দে।
শীত মহিমা
জলিল আহমেদ
কুয়াশায় জর্জরিত আহত সকাল
নির্বাক বৃক্ষের স্থির হয়ে শুনে চলা হেমন্তের গান
অতিথি পাখিরা ঘষে ঠোঁট শিশিরের ঘাসে
নুয়ে পড়া বাঁশঝাড় বকের বিষ্ঠা গুণে ধারাপাত আঁকে।
ডুবে যাওয়া প্রাতঃভ্রমণের ইতিহাস খুঁজে পথচারি হাঁটে
সূর্যও ঘুমিয়ে থাকে শীতের আঁচড়ে, কুয়াশায় মুখ ঢেকে
সেই লজ্জায় তাপগুলি রেখে দেয় ডানার আড়ালে
কাকের প্রাতঃসাথি গ্রামশিশু হেসে হেসে খুন হয়...
এখনও ওঠেনি দেখ সকালের স্বাদ!
এবার সীমাহীন শীতে
সৌম্য সালেক
এবার সীমাহীন শীতে গাঁয়ের ছেলেরা সব জড়ো হবে পিতামহের পালঙ্কের কাছে, পুরনো কথার খোঁজে ওরা কাঁথা মুড়ি দিবে বিগত কাহনের তমসায়! সেসব না-লেখা গল্প আর না-দেখা দৃশ্যের বাঁকে ওদের প্রশ্ন ফিরে প্রপিতামহের আলুথালু আলাপনে, ফসলের মাঠে তার প্রখর দৃষ্টিপাত, শ্রান্তিগান, পথচলা- জীবনের বিচিত্র পারাপার!
চোখের কুয়াশা সরে গেলে, দূর হলো হৃদয়ের আবছায়া তবু অশক্ত-অশতিপর এই গল্পে রুদ্ধস্বর, এই গানে বাকহারা! বুঝি, আমাদের বিশুদ্ধ গানগুলি শব্দাতীত; প্রকৃত সংগীত হৃদয়ের তারে বাজে নিথর সীমানায়! তারপর বৃদ্ধ-বালকের চোখে খেলে তার ফেলে আসা দিন, খেপা বাছুরের পিছে ছুটে চলা, জলার অতলে ডুব, নতুন ধানের আবাহন।
পুরনো গল্পের ওমে ছেলেরা সব ঘুমিয়েছে; নিশুতি-নিদানে দুটো চোখ শুধু জেগে, ঘুম তার ফিরে গেছে তামাদি পৃষ্ঠায়, পুরনো ইচ্ছের ফাঁকে। ধীরে ধীরে গল্পভূক বালকেরা ডুবে যাবে নিঃস্বপ্ন নিদ্রায় আর জীবনের গান ছেড়ে পাড়ার প্রবীণেরা জড়ো হবে হলুদ পাতার পার্বণে- এবার সীমাহীন শীতে...
বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৫
বেশিদিন থাকবো না আর
মহাদেব সাহা
বেশিদিন থাকবো না আর চলে যাবো গোলাপের
গাঢ় গিঁট খুলে
চলে যাবো পিঁড়ির গহন স্নেহ ভেঙে, চলে যাবে,
অনেক বসেছি
বেশি তো থাকবো না আর চলে যাবো মেঘ রেখে,
মমতাও রেখে
মন্ময় কাঁথাটি রেখে চলে যাবো বেশি দেরি নেই!
কুশন ও কার্পেটের নিবিড় গোধূলি ফেলে চলে যাবো
চাই কি ফুলের শুশ্রƒষা আর ফুলদানিরও আদর,
চলে যাবো এখাবে বসার সুখ ফেলে, চলে যাবে
বেত, বাঁশ, বস্তুকে মাড়িয়ে,
বেশি দেরি নেই চলে যাবো জমাট মঞ্চেরও মোহ ভেঙে
মেধাকেও পরাবো বিরহ, আত্মাকেও অনন্ত বিচ্ছেদ।
বেশিদিন থাকবো না চলে যাবো এই তীব্র টান
ভেদ করে, ফেলে রেখে এই আন্তরিকতার জামা,
হাতের সেলাই
অধিক থাকবো না আর অনেক জড়িয়ে গেছি চলে যাবো
আসর ভাঙার আগে, আচ্ছন্নতা উন্মেষেরও আগে
চলে যাবো চোখের জলেরও আগে না হলে পারবো না।
শীতের ক্বাসিদা
নাসির আহমেদ
শীতের অস্তিত্ব ছিল একদিন জীবনদর্শন:
জীবনকে মনে হতো কলিম মাঝির ফুটো নাও
দুঃখজল সেঁচে নৌকো কোনোমতে বাঁচিয়ে রেখেই
প্রমত্তা নদীতে নিত্য এপার ওপার।
এখন শীতের কথা ভাবছি যখন
তখন কিছুই পষ্ট ভাসছে না চোখে কুয়াশায়।
অনর্থক জীবনের পথে পথে দেখি
গহীন কুয়াশা যেন রহস্যের মায়া দুঃখময়।
আজ ভিন্ন প্রশ্ন জাগে,শীত কি মায়ের মুখ
দূর পাড়াগায়?
প্রবাসী সন্তান যার- মাতৃস্নেহ-তৃষ্ণা হাহাকার?
ট্রেনের জানালা-পথে অস্পষ্ট দ্রুত পার হওয়া
সবুজ শ্যামল প্রকৃতির মায়াছবি? বুঝতে পারি না।
ধানকাটা শূন্য মাঠ, কচুরিপানায় ছাওয়া জলহীন খাল?
প্রচ- কাঁপুনি নিয়ে নাড়ার আগুনে হাত সেঁকে বেঁচে থাকা, নাকি
সূর্যেরপ্রতীক্ষা নিয়ে ভয়াবহ অন্ধকারে নিরন্ন জীবন?
শীত মানে মাতৃহীন জীবনে কি মাকে পাওয়া সকালের রোদ?
নাকি জন্মভূমি জুড়ে বর্গীর তা-ব দেখে সম্মিলিত ক্রোধ?
ঘোলা রোদ
হাসান কল্লোল
নিজের মুখচ্ছবি এবং যাদের দেখবার জন্য
একদা আকুল ছিল প্রাণ
ঘ্রাণের ঘৃণায় কিংবা প্রেমের আলসেমিতে তাদের
অনেকেই চলে গেছে তাদের মন্দিরে
কোটরে পাখি ও বেজীদের সাথে আমার
বেশ সখ্য! হাত-পা বিছিয়ে বসে থাকা
আমার একলা দুপুর তাদেরই সংগে কাটে,
দেখি প্রায় ঝিমুচ্ছে অলস পুকুর!
নতজানু হয়নি বলে কখনো হবেনা
এমন তো নয়
¯্রষ্টা ছাড়া আর কোন শরীরী বা অশরীরী
অস্তিত্ব নাই অসীম জেনে
তাকেই সর্বশক্তিমান মানি
জানি তোমাদের কেউ কেউ দেব সেজে
দেবী সেজে চাইছো আনত কুর্নিশ।
শীষ দিয়ে লেজ মেলে যে পাখি চলে গেল;
সে কি ছিল আমাদের বোন?
শীত বিকেলের ঘোলা রোদে এখন আমি
প্রতিদিন দুঃখ শুকাই
ফ্ল্যাশব্যাক : রাজপুণ্যাহ
হাফিজ রশিদ খান
মাঘের বাতাস ঠা-ায় কাঁপতে-কাঁপতে এসেছ বুঝি
বোমাং পরগনার
রাজপুণ্যা’র খবর নিয়ে
ওখানে রাজার ছেলে শিশিরবিন্দুর স্বচ্ছ জামা গায়ে
ঘাসের ওপর হেঁটে যায়
নিশি পাহারায়
বেতছড়া পাহাড়ের কালো মোরগের
চকচকে পালকের রোদ নাচে
জরদ সকালে
ওখানে ত্রিপুরা শ্যামাঙ্গিনী
দোচোয়ানি বিকেলে ঘামের গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে
উলের জাম্পার কিনিতে মেলায় যায়
তুমি বুঝি সেই আগুন পোয়ানো শৈত্যের বাহন-
এলে আমার খিড়কি দিয়ে...
কোথাও উন্মুক্ত হলে
খালেদ হামিদী
কোথাও উন্মুক্ত হলে ঘুমন্ত নরের শুধু উদ্ধত শরম
তমাল ফুলের ধারা এর ওপর কীভাবে ঝরিছে না জেনে
তুমি ‘কাঁথা, কাঁথা!’ হেঁকে দিতে চাইলে ঢেকে
কে তবে সকাল চিরে ছুটে যায় দুই হাতে কুয়াশা সরিয়ে?
অমন দৌড়েও ধাক্কা না খেলেও পরস্পর ঘুম-ভাঙা নর
ভুলেও দেখে না চোখে সর্ষেফুল।
তাই আমরা সরে এলে মনে পড়ে ওঝা তোর কীসের আছর
ছাড়াতে এসেই সরিষার ভূত দেখে
পালায় সহসা?
‘কাছে তুই নাই, তোর স্মৃতির অদম্য ভূত জড়ায় আমারে।
এমন মায়ার আলিঙ্গন ত্রিভুবনে
নাই রে, বিশ্বাস কর।’ ‘তাড়া আছে, ননদিনী দেইখ্যা লাইব, যাই।’
বলেই মিলিয়ে গেলে কোথায় যে হায়!
অথচ বটেশ্বরের ক্ষেতে, উয়ারীরও
মাঠে মাঠে নিজেদের কত যে হারাই
সরিষার আদিগন্ত হলুদ সমুদ্রে!
নাগরিক শীতরাত্রি
রহিমা আখতার কল্পনা
নিঃসঙ্গ কুকুরের গলায় ব্যথিত রাত্রি আর্তনাদ করে।
নিঃসঙ্গ রাত্রিকাল
বালকবেলার সীমিতবিত্ত গ্রামজীবন, মায়াময় গৃহস্থ জীবন
ফিরে ফিরে আসে উজ্জ্বলতা-পিপাসায় মৃতপ্রায় এই রাতে।
জোছনার মধুঢালা চাঁদ
জাগরিত এই রাতে বুঝি নামবে লেকের জলে,
সারিবদ্ধ নাগরিক বাতিমালা অর্ধবৃত্ত আয়তনে
মেলে আছে নীলচে আলোর মগ্ন আলিঙ্গন,
ওই চাঁদ নেমে এলে বুকে টেনে নেবে বলে
ম্রিয়মাণ জেগে আছে কালো জলভরা লেকের হৃদয়, চুপ-
বাতাসে উড়ছে শীত, বাতাস জড়িয়ে ধরে প্রবল নামছে শীত।
আজ বহুদূর, বহুদূরে হাতছানি দেয়া সেই সুদূরের রাত,
শীতরাত, পূর্ণিমাদুধের ধারাজলে স্নানশেষে
ফুল্ল জোছনার লগ্ন, মায়া-নক্ষত্রের কৈশোরিক রাত
ভীষণ ভীষণ মনে পড়ে।
সুনসান মধ্যরাতে কুকপক্ষীর ডাক
বাঁশঝাড়ে ঝিরিঝিরি শীতল বাতাস এলোমেলো
বসতবাড়ির প্রাচীন গাছের কোটরে লুকানো
তক্ষকের প্রহর-ঘোষণা-করা ভয় জাগানিয়া তীব্র তীব্র ডাক
স্মৃতিময় ঐশ্বর্যময় সেই আপন অন্ধকার
বড় বেশি বড় বেশি মনে পড়ে আজ।
দূরে নাগরিক বেওয়ারিশ কুকুর যাচ্ছে ডেকে
বুঝি বা সে ভয়ে আর্ত, বুঝিবা সে মধ্যমাঠে একা
নামগোত্রহীন মামুলি কুকুর তারস্বরে কাঁদছে করুণ
সে এখন তারি মতো সঙ্গহীন রাত্রির সুখের দুঃখের বান্ধব সহচর।
নির্বান্ধব কুয়াশাকাতর ঘুমন্ত শীতের রাত-
বাতাসে উড়ছে শীত, বাতাস জড়িয়ে ধরে প্রবল নামছে শীত
পথকুকুরের পরিশ্রান্ত কণ্ঠনালীতে নগর কেমন কাঁদছে!
মাঘের সকাল
মাহফুজ আল-হোসেন
কুয়াশার কম্বল মুড়ি দেয়া হঠকারী মাঘের সকাল
কেন জানিনা প্রণয় বোঝেনা
দেখে না বিবস্ত্র বৃক্ষের ক্ষয়কাশ
শোনে না দূরাগত কান্নার আহির ভৈরব
অথচ বিবাগী রৌদ্রের সাথে দুপুরের বনিবনা
ঝুলে আছে গার্হস্থ্য লাউয়ের ডগায়
আর অ্যাকুরিয়ামের রঙিন কলহাস্যে ভরে থাক
আসন্ন সমুদ্রযাত্রার হেলেনিক লাফঝাঁপ
ৃবাসনা
মুজিব ইরম
যদি আসি
যেন ফের
সর্ষেখেতে ফুল হয়ে ফুটি
শীতফুলের আয়ু
মালেক মুস্তাকিম
আসন্ন শীতকালের মতো ছোট হয়ে আসে আমাদের আয়ু-
কুয়াশারা লিখে রাখে সুইসাইড নোট
গোপন ব্যালটে
সময় একটা শামুকের খোল-
তার ভেতরে লুকিয়ে থাকে ধানপাতার দৌড়
পথের ধারে দুটো নিশ্বাস রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে ট্রাফিকরুম
ছোট হয়ে আসে অপেক্ষা-
প্রকা- বটগাছের ভেতর স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে মানুষ
জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে শুয়ে থাকা রাস্তায় ফুটে আছে বিয়োগচিহ্ন।
রাতের মলাট পেরুলেই পায়ের কাছে নেমে আসে শীতকাল।
লঞ্চঘাটে লেখা কবিতা
মাসুদার রহমান
তুমি কী ঘুমিয়ে পড়েছ! তুমিও কী জেগে আছো
এই তীব্র শীতের রাতে!
বাইরে নির্জনতা; থেকে থেকে ট্রাক ও লরির শব্দ
পেঁচা ডাকে। কখনো হঠাৎ পরিযায়ী হাঁস অন্ধকার আকাশে
ডেকে ডেকে উড়ে যায়
এমন শীতের রাতে বালিশে মাথা রেখে নিজ হৃৎপি-ের
শব্দও শোনা যায়
তুমি কি শুনতে পাচ্ছো, লঞ্চঘাট থেকে ‘এম ভি মাসুদার’ নামে
এক লঞ্চ ভেঁপু দিয়ে নিরুদ্দেশ চলে যাচ্ছে
রিমঝিম রিমঝিম
জুনান নাশিত
শীত এলে ভালোবাসা মরে যায়
নাকি জেগে ওঠে?
আমরা জানি না
আমাদের ভালোবাসাবাসি
বিসমিল্লা খাঁর সানাইয়ের চেয়েও
বিনিদ্র, বিনয়ী।
‘কাফকাজ লাস্ট লাভ’ আমরা পড়েছি
বহুবার, শৃঙ্গারের আগে
বেহালার বুনোট ছড়িয়ে
প্রতিটি সঙ্গম সুখে
প্রতিধ্বনিত নীরবে ‘লাভ এন্ড লাস্ট’
পড়েছি দু’জনে একাগ্র উদাস রাতে
তখন বসন্ত ছিল, নাকি শীত?
নাকি বর্ষা অথবা শরত?
কি ছিল কে ছিল তাকিয়ে দেখিনি
দেখেছি দু’জন দু’জনারে।
এখন পুরোটা বছর জুড়েই শীত
এখন দূরের মেঘনার বুকে
কুয়াশা প্রাচীর রিমঝিম রিমঝিম!
চিরায়ত বাংলায়
হাদিউল ইসলাম
মাঘ যায়
মুকুলে ছেয়েছে মন
পরাগায়নের গানে
আজ উচাটন
কুয়াশা রচিত ভোর
ছিঁড়ে বেরুচ্ছে রোদ্দুর
স্বরচিত তার মুখ
একপ্রস্ত সুখ
গাছে গাছে জাতিশ্মর
পথে বিছানো অন্তর
পাতার মর্মর
মাথার উপরে কোকিলের স্বর
হাওয়াময় গ্রাম
প্রজাপতি লিখে তার নাম
ফুলেদের গা’য়
চিরায়ত বাংলায়
কুয়াশা দিন
মুশাররাত
শিশিরকণায় আমাদের আজ
ভিজেছে পায়ের তালু
সর্ষে ফুলের রেণু মাখা মৌ
যৌবনে আলুথালু
আমাদের আজ বিরহী সকাল
কী চাই, কী চাই মন
ধোঁয়াশার মতো আবছায়া হয়ে
আসে কি পথিকজন?
আমাদের আজ লেপ-কাঁথা মুড়ে
পিঠাপুলি খাওয়া দিন
মায়া মাখা হাত, শীতের প্রভাত
মাতৃত্বের ঋণ!
আমাদের আজ কুয়াশার দিন
আকাশের মন ভারি
রাতের আগেই নামিয়ে আঁধার
সূর্য দিয়েছে আড়ি।
জলমগ্ন শীত
সঞ্জয় দেওয়ান
যতœ করে পণ করেছি
এবার শীতে তোমার হবো;
কঠোর ব্রতের আগল ভেঙে
এবার শীতে নষ্ট হবো!
কাটবো সাঁতার পদ্মপুকুর জলে
বিবাগী হাওয়ার ¯্রােতে।
একটু না হয় চুম্বন দিও
জোছনা ঝরা রাতে
আগুন মেখে ঠোঁটের সীমান্তে।
এবার মধুময় শীতে রাতভর
তোমার খোলা চুলের গন্ধে নিমজ্জিত হবো;
সমুদ্র স্নানে ডুবে যাবো
হিম সকালের সোনালি রোদে।
চলেই যাব যখন জানি
ঠিকই এবার পুড়বো নগ্ন
বুকের দারুণ উত্তাপে!
যাত্রাপালায় শীত আবছায়া
সোহেল মাজহার
বিশ্বাস করুন কোনো বদ অভ্যাস নেই তার
কেবলই রক্তে জেগে ওঠে ঢেউ, স্মৃতির বিকার...
রাত গভীর হলেই নরেচরে ওঠে কেউ- যেনো দীর্ঘ ঘুম শেষে জাদুগ্রস্ত সম্মোহিত মানুষের মতো। অথচ দেখুন কী সাধারণ বেশভূষা, শরীরের উৎকট ঘামের ঘ্রাণে আকণ্ঠ ডুবে থেকে সে ঠিক সন্ধ্যা শেষে ফিরে আসে পাখির নীড়ে নয়, বাবুইপাখির আত্মতৃপ্ত বাসায় নয়, মরচে ধরা টিনের বাড়িতে... যেখানে শীতের কুয়াশা ঝরে বৃষ্টির মতো ফোঁটায় ফোঁটায়... মুখরা বউয়ের কাছে গোবেচারা ছাড়া তার আর কীইবা পরিচয় থাকতে পারে! কিন্তু শীত এলেই অন্য মানুষ, আতর- সুর্মার মঁ-মঁ গন্ধে হেঁটে যাচ্ছে সংকোচে নুয়ে যাওয়া অপরাধী নয়, যাত্রাপালার হিরো, উদ্যত কেউ... ডানাকাটা পরীর দেহে- শরীরের ভাঁজে ভাঁজে ওঠে সমুদ্রের উদ্দাম ঢেউ, সর্বনাশা... নর্তকীর পায়ের কাছে দেদার দু’হাতে ছড়িয়ে যাচ্ছে মুদ্রার ঝনাৎ ঝনাৎ ধ্বনি কোমরের খাঁজে, পীনোন্নত স্তনের ঈষৎ আহবানে... আসলে সে একজন নিরাবেগ মানুষ। তবু যাত্রা পালায় সে কাকে খোঁজে? কৈশোরে হারালো যাকে, কলেজের ব্ল্যাকবোর্ডে অগোচরে যে নাম বারবার লিখে মুছে দিতো সংকোচে, কিংবা আজও সর্বনাম ও বিশেষণের আড়ালে কে তাকে নিয়ে যায় কুয়াশার ঘোর রহস্যে শীতের সাদৃশ্যে... আবছায়ার অস্পষ্ট আদলে।
এ কেমন ঋতু রোগ শীত এলেই কুহকী-স্বপ্নে দেয় হানা
ভেসে ওঠে তাবৎ মুখের আবছায়া, যাত্রাপালার নজরানা
শীতপাখি
এমরান কবির
তবে, ভাবে ও প্রভাবে
আঁকা যায় না এইসব দৃশ্য
কেননা দৃশ্যের মধ্যে এসে পড়েছেন তীর
প্রতি ইঞ্চিতে তার যত বিদ্ধতা
ততই রক্তভাষ্য
এই দৃশ্য আঁকা যায় না
জীবনের উড়ালে এসে সহ¯্রপথে
এ কেমন মৃত্যুবিভ্রম!
পাখি তবু উড়ে আসে শীতের রেখায়
আমরা হরণ করি তীর ও তীরবিদ্ধতায়
প্রথম প্রেম
নজরুল সাজু
তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম শিউলি ফুলের ভোরে,
মুক্তোর মতন টলমল চোখে স্বপ্নের ডাকে ঝরে।
তোমার সেই হাসি, গোপন ভাষা,
হৃদয়ের গভীরে সূক্ষ্ম ভালোবাসা।
দৃষ্টির আড়াল হতে চেয়েও,
প্রতিটি ধ্বনি, প্রতিটি ছোঁয়া, আমার মনে বয়ে নিয়ে গেছে স্রোত।
তোমার হাতের স্পর্শে লেগেছিল কাঁপন,
মনে হয়েছিল, এ যেন হাজার বছরের আপন।
তোমার খোলা চুলের গন্ধে মিশেছিল শীতের সুর,
সে কি প্রথম প্রেম ছিল, নাকি জীবনের এক মধুর।
বুঝিনি তখন, প্রেম এত গভীর,
জীবনের প্রতিটি বাঁকে রেখে যায় চির।
আজও মাঝে মাঝে দেখি সেই মুখ,
যেন আমার প্রথম প্রেমের চিরন্তন সুখ।
তুমি আছো, তুমি থাকবে, স্মৃতির ¯িœগ্ধে,
আমার হৃদয়ে লেখা থাকবে তোমার নাম,
প্রথম প্রেমের সেই কবিতার একমাত্র ছন্দে।
শীত মহিমা
জলিল আহমেদ
কুয়াশায় জর্জরিত আহত সকাল
নির্বাক বৃক্ষের স্থির হয়ে শুনে চলা হেমন্তের গান
অতিথি পাখিরা ঘষে ঠোঁট শিশিরের ঘাসে
নুয়ে পড়া বাঁশঝাড় বকের বিষ্ঠা গুণে ধারাপাত আঁকে।
ডুবে যাওয়া প্রাতঃভ্রমণের ইতিহাস খুঁজে পথচারি হাঁটে
সূর্যও ঘুমিয়ে থাকে শীতের আঁচড়ে, কুয়াশায় মুখ ঢেকে
সেই লজ্জায় তাপগুলি রেখে দেয় ডানার আড়ালে
কাকের প্রাতঃসাথি গ্রামশিশু হেসে হেসে খুন হয়...
এখনও ওঠেনি দেখ সকালের স্বাদ!
এবার সীমাহীন শীতে
সৌম্য সালেক
এবার সীমাহীন শীতে গাঁয়ের ছেলেরা সব জড়ো হবে পিতামহের পালঙ্কের কাছে, পুরনো কথার খোঁজে ওরা কাঁথা মুড়ি দিবে বিগত কাহনের তমসায়! সেসব না-লেখা গল্প আর না-দেখা দৃশ্যের বাঁকে ওদের প্রশ্ন ফিরে প্রপিতামহের আলুথালু আলাপনে, ফসলের মাঠে তার প্রখর দৃষ্টিপাত, শ্রান্তিগান, পথচলা- জীবনের বিচিত্র পারাপার!
চোখের কুয়াশা সরে গেলে, দূর হলো হৃদয়ের আবছায়া তবু অশক্ত-অশতিপর এই গল্পে রুদ্ধস্বর, এই গানে বাকহারা! বুঝি, আমাদের বিশুদ্ধ গানগুলি শব্দাতীত; প্রকৃত সংগীত হৃদয়ের তারে বাজে নিথর সীমানায়! তারপর বৃদ্ধ-বালকের চোখে খেলে তার ফেলে আসা দিন, খেপা বাছুরের পিছে ছুটে চলা, জলার অতলে ডুব, নতুন ধানের আবাহন।
পুরনো গল্পের ওমে ছেলেরা সব ঘুমিয়েছে; নিশুতি-নিদানে দুটো চোখ শুধু জেগে, ঘুম তার ফিরে গেছে তামাদি পৃষ্ঠায়, পুরনো ইচ্ছের ফাঁকে। ধীরে ধীরে গল্পভূক বালকেরা ডুবে যাবে নিঃস্বপ্ন নিদ্রায় আর জীবনের গান ছেড়ে পাড়ার প্রবীণেরা জড়ো হবে হলুদ পাতার পার্বণে- এবার সীমাহীন শীতে...