alt

সাময়িকী

রবিউল হুসাইন

সরল প্রাণের সোপান

শামস্ হক

: বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৫

কবি রবিউল হুসাইন, আমাদের রবিদা সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে তাঁরই পছন্দনীয় কবি পাবলো নেরুদার একটি উক্তি খুবই যথাযথ বলে মনে হয়, তা হলো, “ভালোবাসা একটুখানি, ভুলে যাওয়া কত দীর্ঘ।”

রবিদার সাথে আমার মেলামেশা খুব বেশি দিনের নয়, কিন্তু তাঁকে ভুলে যাওয়া বড় কঠিন। রবিউল হুসাইনের প্রতিভা বহুমুখী। তাঁর স্থাপত্য শিল্প এবং সাহিত্যের মূল্যায়নের ধৃষ্টতা এমনকি ক্ষমতাও আমার নেই। মানুষ রবিদাকে যতটুকু দেখেছি, সেই স্মৃতি-চারণটুকুই এই আলেখ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

রবিদার জন্ম ১৯৪৩ সালের ৩১ জানুয়ারি, ঝিনেদা জেলার শৈলকূপা থানার রতিডাঙ্গা গ্রামে। ছোটোখাটো গোল-গাল চেহারার সদা হাস্য এই মানুষটি দেহগত দিক থেকে হয়ত পৃথিবীর বেশি জায়গা জুড়ে ছিলেন না তবে মনের পরিধি এবং কাজের ব্যাপ্তি ছিলো সুবিশাল। তাঁর চরিত্রের সবিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাঁর রসবোধ। বিষণœতা যখন অন্তরীণ করে ফেলে, মন ভারি হয়ে যায়, সব কিছুতেই যখন অনিহা, রবিদার সামনে গেলে সব ভার এক মুহূর্তে কোথায় যেন উবে যেতো। একটা হাসি দিয়ে বলতেন, আচ্ছালামু আলায় বেশি। তিনি কম দিতে রাজি নন। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ, না বলে বলতেন, থ্যাংক ইউ রুই মাছ। এমনি করে পরতে পরতে মানুষকে হাসি তামাশার মাধ্যমে উজ্জীবিত করে তুলতেন। মন বৈকল্যের কোনো অবকাশ রবিদার সামনে বসে থাকলে পাওয়া কঠিন ছিলো।

রবিদা সর্ম্পকে এতো কথা, এতো স্মৃতি জমা হয়ে আছে যা এই স্বল্প পরিসরে বলা কঠিন।

আড্ডার মধ্যমণি হয়ে থাকতেন রবিদা। কেবলমাত্র শুক্রবার ব্যতীত প্রায় প্রতিটা দিন আমরা বসতাম কবি ও প্রকৌশলী খোরশেদ বাহারের সেগুন বাগিচার চেম্বারে। কবি বেলাল চৌধুরী, কবি রফিক আজাদ, কখনো কখনো ছড়াকার আলম তালুকদার, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, শিহাব সরকার- এরা কেউই আজ আর নেই। এখানে সাহিত্য সংস্কৃতি, রাজনীতি, গান বাজনা থেকে শুরু করে রাজা উজির মারা সবই হতো। কখন যে রাত্রি দ্বিপ্রহর হয়ে যেতো আমরা ঠিকই পেতাম না। এই আড্ডার আসরে রবিদার আক্রমণের স্বীকার হতাম আমি সবচেয়ে বেশি, কেননা আমার এন্টেনায় এরিয়াল ছিলো না, ওটা সীমাবদ্ধ চার দেয়ালের মধ্যেই, স্টান্ড করা থাকতো। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি ঐ আসরে আমিই ছিলাম সবচেয়ে নির্বোধ। জ্ঞান গরিমা তো নেইই, সমকালীন ঘটনা প্রবাহ সংক্রান্তেও ছিলাম অনাকিবহাল অথবা স্বল্প অবহিত। যার ফলে নবিসি প্রশ্ন করতাম আর শুরু হতো রবিদার ভর্ৎসনাপূর্ণ বাক্যবাণ! “সাধে কি বলে, ঝিনেদার মানুষ আলে খাটো!” আমি বলতাম, ঠিকই বলেছেন রবিদা, রতনে ছাড়া রতন চিনবে কেমন করে? তখন সকলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়তাম। ঐ অড্ডায় আমরা ভুলে যেতাম আমাদের বয়স, আমাদের অবস্থা, অবস্থান। অফুরন্ত হাসি, অনাবিল আনন্দ। হাসতে হাসতে কখনও দাঁড়িয়ে পড়তাম অমনি রবিদা বলে উঠতেন- “এই আপনার টেলিভিশন সরান।” বুঝতে পারতাম না, বোকার মতো চেয়ে থাকতাম। পরে বুঝলাম আমার পশ্চাতদেশের কারণে তাঁর টেলিভিশন দেখতে অসুবিধা হচ্ছে, তাই আমাকে আমার টেলিভিশন সরাতে বলছেন। এমনই সব টুকরো টুকরো ঘটনা স্মৃতির চাদরে আলপনা হয়ে রয়ে গেছে।

একটা দিনের ঘটনা মনে হলে এখনও নিজেকে ভীষণ অপরাধী বলে মনে হয়। ঘটনাটা এরকম- একদিন আমি, বাহার ভাই ও রবিদা ঢাকা ক্লাব থেকে খানাপিনা সেরে বাহার ভাই-এর গাড়িতে বাসার দিকে রওনা হবো। রাত তখন ১১/১২ টা। গাড়ির দরজার সামনে আসতেই বাহার ভাই আমাকে বললেন যে, আমার বাসা পর্যন্ত যেতে পারবেন না রবিদার বাসার সামনে আমাকে নামিয়ে দেয়া হবে, আমাকে ঐটুকু হেঁটে যেতে হবে।

আমি হেঁটে যেতে নারাজ, বাহার ভাই তো আমাকে রাগান্বিত করার জন্যে তার কথাতেই অনড় থাকলেন। আমি রেগে গিয়ে বললাম, যান, আপনার গাড়িতেই যাব না, বলেই সোজা হাঁটা দিলাম। রবিদাও আমার পিছু পিছু হাঁটছেন আর বলছেন, “আরে হক সাহেব দাঁড়ান।” কে কার কথা শোনে; রাগে তখন আমার কান মাথা সব গরম। রবিদা গাড়িতে না উঠে আমার পিছু পিছু একেবারে হাতিরপুল বাজার পর্যন্ত চলে এলেন। রবিদা বয়স্ক এবং মোটাসোটা মানুষ, রীতিমতো হাঁপাচ্ছেন এবং সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেছে। মনে হলো, কাজটা আমি ভাল করছি না। আমি দাঁড়ালাম। আমাকে বললেন, এতো সেন্টিমেনটাল হলে চলে? ওতো আপনার সাথে ইয়ারকি করছিলো। যাহোক, সে রাতে আমরা বাড়ি ফিরলাম। সে দিন কি কষ্টটাই না আমি রবিদাকে দিয়েছি। প্রায় দেড় দুমাইল পথ এ ভাবে সজোরে হেঁটে আসা তাঁর জন্য শুধু কষ্টকরই নয়, বিপজ্জনকও বটে। আজ মনে হয়, কতটা ¯েœহ-ভালবাসা থাকলে এভাবে আমাকে প্রশমিত করার জন্যে গাড়িতে না উঠে হেঁটে হেঁটে আমার পিছু নেয়া সম্ভব! শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আমার যে সামান্য পরিচয়, টুকিটাকি বসা ওঠা সবই হয়েছে রবিদার সুবাদে। কোথাও কোনো আচার অনুষ্ঠান থাকলে রবিদা আমাকে সেখানে নিয়েই ছাড়তেন। আমি অনেক সময় বলতাম, আমি তো আমন্ত্রিত নই, আমি কেন যাব? স্বভাবসুলভভাবে ধমকের সুরেই বলে উঠতেন- “আরে জ্বালা! আমি বলছি আপনি চলেন। কে দাওয়াত দিলো না দিলো তা আপনার দেখার দরকার কী?” জাতীয় যাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলা একাডেমি, আলিয়াস ফ্রঁসেস, কচি কাঁচার মেলা, শিল্পকলা একাডেমি, পাবলিক লাইবেরি, ঢাকা ক্লাব, আন্তর্জাতিক ভাষা ইন্সটিটিউট আরও অনেক অনেক প্রতিষ্ঠানে আমাকে নিয়ে যেতেন, সেখানে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতেন এবং ক্ষেত্র মতো কবিতা পাঠ বা কিছু বলারও সুযোগ তৈরি করে দিতেন। এটা যে শুধু আমার জন্যে করতেন না নয়, যিনিই তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন প্রত্যেককেই বিকশিত করার ইন্ধন-শক্তি যুগিয়েছেন কবি রবিউল হুসাইন। বলা বাহুল্য, আজকে যারা শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও স্থাপত্য শিল্পে সুপ্রতিষ্ঠিত তাদের অনেকেই এই পর্যায়ে এসেছেন রবিদার হাত ধরে। তাদের কেউ কেউ এটা হয়ত এখন স্বীকারও করেন না। অথচ তারা রবিদাকে উপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবেই ব্যবহার করেছেন। কবি রবিউল হুসাইন ছিলেন কাজপাগল মানুষ। আমরা অনেকেই নিজেদেরকে এলিট শ্রেণিতে উন্নীত করার চেষ্টায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারগুলোতে দেহের মধ্যপ্রদেশ স্থাপন করে পুতুল হয়ে বসে থাকি, কিন্তু কবি রবিউল হুসাইন ছিলেন প্রতিষ্ঠানগুলোর কামলা বিশেষ, আমলা নন।

একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে রবিদার ব্যক্তিগত চিকিৎসক বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডাঃ হারিসুল হক বার বার সর্তক করে রবিদাকে বলেছেন, “আপনি পরিপূর্ণ বিশ্রামে থাকুন, আপনার রক্তের প্লাটিলেট কাউন্ট মারাত্মকভাবে কমে গেছে”। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আলিয়াস ফ্রঁসেসে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে, সেখানে না গেলেই নয়। এমতাবস্থায় প্রফেসর হারিসুল হক আমাকে ফোন করে বলেছিলেন, “হক ভাই, রবিদাকে ঠেকান, তার অবস্থা মোটেও ভাল নয়”। তার বিশ্রাম প্রয়োজন এবং পারলে আজই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া উচিৎ।” আমি সাথে সাথেই রবিদার বাসায় চলে যাই এবং গুরুত্বের সাথে তাঁকে বাসার বাইরে না যাওয়ার অনুনয় জানাই। কিন্তু তিনি তা শোনেন নি। উপরন্তু ঐ অনুষ্ঠানে আমাকে যাবার জন্যে পীড়াপীড়ি করলেন। আমি অবশ্য যাইনি, কিন্তু রবিদা ঠিকই সেখানে গেলেন এবং তার পরের দিন হাসপাতালে ভর্তি হলেন। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি।

এই হচ্ছে রবিদার দায়িত্ব বোধ। যে সব প্রতিষ্ঠানের সাথে রবিদা জড়িত ছিলেন প্রত্যেকটিতে তার পরিশ্রমের এবং মনোনিয়োগের স্বীকৃতি পাওয়া যায়। বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউট, জাতীয় কবিতা পরিষদ, কেন্দ্রীয় কচি কাঁচার মেলা, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, বঙ্গবন্ধু জাদুঘর, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সমালোচক সংঘ, কবি রফিক আজাদ স্মৃতি পর্ষদ, চিত্র প্রকাশনীর মুখ্য উপদেষ্টা এমনি অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন যেগুলোতে তিনি অকান্ত পরিশ্রম এবং সেবা দিয়ে এসেছেন।

কবি রবিউল হুসাইনের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ এবং সেটাকে বাংলার প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে চিরকালের ছাপচিত্র করে এঁকে দেয়ার যে অভিপ্রায় এবং প্রয়াস তা কখনই অস্বীকার করা যাবে না। তিনি বলতেন আমরা যারা স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে বয়ঃপ্রাপ্ত ছিলাম তাদের অনেকেই আজ আর নেই। কিছুকাল পরে আর হয়তো একজনও থাকবেন না। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিৎ স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন স্মৃতিগুলোকে অক্ষরাবদ্ধ করে রাখা যাতে আগামী প্রজন্ম সেটাকে উপলদ্ধি করতে পারে এবং রাষ্ট্র বিনির্মাণে সেই চেতনার প্রতিফলন ঘটাতে পারে।

রবিদার চরিত্রের আর একটা বিশেষ দিক ছিলো চোখে পড়ার মতো। একেবারেই শিশুসুলভ আচরণ। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে চট করে পরিত্যক্ত জিনিস উঠিয়ে নিতেন, যেমন কালিহীন শিশ কলম, পাখির পালক, সাইকেলের ফেলে দেয়া স্পোক ইত্যাকার সব দ্রবাদি কুড়িয়ে নিয়ে সেগুলোকে সযতেœ রেখে দিতেন। তার কর্মস্থল শহীদুল্লাহ এন্ড এসোসিয়েটস-এর যে চেয়ারটাতে উনি বসতেন তার পিছনের দেয়ালে সুবিন্যস্তভাবে পাখির পালক সাজানো অবস্থায় দেখা গেছে। একবার জিজ্ঞাসাও করেছিলাম কেন তিনি এটা করেন, হাসতে হাসতে জবাব দিয়েছিলেন “পাইলেও পাইতে পারি অমূল্য রতন।”

আজ মনে হয় এই প্রবণতা থেকেই হয়ত তিনি অনেক মূল্যহীন এবং গুরুত্বহীন ব্যক্তি বিশেষকে সযতেœ এ দেশের শো’কেসে স্থান করে দিয়েছেন, যারা কোনো দিনও তার কোনো কাজে আসেনি। অপরকে প্রশংসা করা, বাহবা, অনুপ্রেরণা দেওয়া যেন ছিলো রবিদার গায়ের গহনা। একটা কবিতা বা একটা লেখা নিয়ে গেলে দেখে বলতেন, ভালই হয়েছে। অনেক সময় টুকিটাকি ভুল বানান ঠিকঠাক করে দিয়ে বলতেন, লেখাটা চালিয়ে যান। কোনো কোনো সময় নিজেই কবিতাটা কাগজে পাঠিয়ে ছাপাবার ব্যবস্থা করে দিতেন। রাত জেগে কষ্ট করে নিঃস্বার্থভাবে আমাদের অনেকের লেখার প্রুফ দেখা থেকে শুরু করে সেটাকে নির্ভুল করার ব্যবস্থা নিতেন।

কবি রবিউল হুসাইন মুলত স্থাপত্য বিদ্যায় বিদ্বান, কিন্তু বাংলা সাহিত্য, বাংলা ব্যাকরণ, বানান ইত্যাদির বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। অনুরূপভাবে ইংরেজি সাহিত্যেও তাঁর সাবলীল বিচরণ ছিলো। অনেক ইংরেজি কবিতার অনুবাদও করেছেন।

তাঁর পরীক্ষাধর্মী লেখাগুলো দেখলে স্তম্ভিত হতে হয়। তার লেখা একটি কবিতার কথা উল্লেখ করা যায়, কবিতাটির নাম ‘জনৌষধি।’ এটি মাত্রাবৃত্তে লেখা। একই লাইনে প্রথমে এক মাত্রা পরে দুই মাত্রা, তার পর তিনমাত্রা, চার মাত্রা, পাঁচ ও ছয় মাত্রায় কবিতাটি সম্পন্ন করেছেন, যা সচরাচার দৃষ্ট হয় না। করি রবিউল হুসাইনের সাহিত্য চর্চা ছিলো বহুমুখী। কবিতা প্রবন্ধ, উপন্যাস, কিশোর উপন্যাস, ছোট গল্প, গ্রন্থ সম্পাদনা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের তিনি নজির রেখে গেছেন। স্থাপত্যকর্মও তার প্রশংসিত হয়েছে। চলচ্চিত্র ও চিত্রসমালোচনায় তার মুন্সিয়ানার ছাপ রেখে গেছেন। পুরস্কারের ঝুলিও তার অপূর্ণ ছিলো না। একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, সাহিত্য পুরস্কার, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার, আইএবি পুরস্কার, সার্চ চেয়ারম্যান মেডেল, মুক্ত আকাশ পুরস্কার ইত্যাদি পুরস্কারে তিনি ভূষিত হয়েছেন। তিনি বলতেন পুরস্কার তিনি পেয়েছেন ঠিকই তবে তিরস্কার এবং অবহেলাও তিনি কম পাননি। এজন্যে তিনি তার স্থির বিন্দুর মোহন সংকট গ্রস্থখানি এভাবেই উৎসর্গ করেছেন।

“যারা আমাকে বিভিন্ন সময়ে অসময়ে, জ্ঞানে অজ্ঞানে, কারণে অকারণে বুঝে না বুঝে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য অপমান অসম্মান অবহেলা ঈর্ষা আর অবমূল্যায়ন দ্বারা নিজেদের মেকী ব্যক্তিত্ব বাড়ানোর অবাস্তব অপচেষ্টা করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে সেইসব ‘কেন’ জম্মা মানুষদের প্রতি বিব্রত বিবেচনায়” কবির এই ক্লেশসিক্ত ব্যঙ্গ উৎসর্গের নিশ্চয় কোনো কারণ ছিলো। তার জীবনে ধন্যবাদ, ক্রেস্ট, পুরস্কার নিঃসন্দেহে প্রেরণাত্মক। তবে প্রকৃত অর্থেই তার যেটুকু পাওয়ার ছিলো, সেটুকু তিনি পাননি অথচ সেটা ছিলো তার ন্যায়ানুগ প্রত্যাশা Legitimate Expectation যা হোক, তিনি আজ পাওয়া না পাওয়ার ঊর্ধ্বে। তবে কষ্ট হয়, যখন শুনি ২৫ নভেম্বর ২০১৯ তারিখের সন্ধ্যা থেকে ২৬ নভেম্বর ভোর চারটা পর্যন্ত প্রচ- শ্বাসকষ্টে থাকা সত্ত্বেও আইসিইউতে / সিসিইউতে তার একটু স্থান হয়নি। যখন দেখি তার ক্রয়কৃত জোয়ার সাহারা মৌজার ৪৯ শতক জমি সাবেক সরকারের শাসন কালে স্থাপনাগুলো বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে সে জমি অধিগ্রহণ করে বর্তমান সরকার কোটি টাকার বিনিময়ে সেগুলো বিভিন্ন ব্যক্তির নামে বরাদ্দ দিয়ে লাভবান হয়েছে অথচ মাত্র ৫ (পাঁচ) কাঠা জমি ক্ষতিপূরণ বাবদ হাইকোর্টের নির্দেশ অনুসারে তাকে বরাদ্দ দেওয়া আদেশ থাকা সত্ত্বেও আজও আইনের পথ পরিক্রমায় পড়ে প্রচ- এক জিজ্ঞাসাচিহ্ন বুকে নিয়ে তার শেষ নিঃশ্বাস টুকু নিতে হলো, যখন শুনি তার কর্মস্থলে তিনি ৩৬ (ছত্রিশ) মাস যাবৎ বেতন না পেয়ে দিনাতিপাত করেছেন, যখন দেখি তার একটা মাত্র অসহায় সন্তান এতো এতো শুভাকাক্সক্ষী থাকা সত্ত্বেও একটু কর্মসংস্থান তাঁর আজও হয়নি, অথবা দেখি রবিদার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীটাও আমরা বে-মালুম ভুলে গেছি তখন তাঁরই কবিতার (তরজমাকৃত) দুটো লাইন মনে পড়ে,

“আমার আত্মা এলোমেলো, সুখী দুঃখী অফুরন্ত।

ভাবিত, গভীর নির্জনতায় সমাধিস্থ প্রদীপ।

তুমি কে, কে তুমি?”

রবিদা তুমি চলে গেলে তবু রয়ে গেলে।

ছবি

আড়াই লেনের কৃষ্ণচূড়া

ছবি

গিরিশচন্দ্র ঘোষের নাটক ইতিহাস ও দেশপ্রেম

ছবি

নিজস্বতার অনন্য প্রমাণ

ছবি

বইমেলায় আসছে নতুন বই

ছবি

হাসান আজিজুল হকের দর্শনচিন্তা

ছবি

শীতের পদাবলি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য মানবতারই জয়গান

ছবি

বইতরণী সাহিত্য পুরস্কার পেলেন শুক্লা গাঙ্গুলী

ছবি

‘শব্দঘর’ আহমদ রফিক সংখ্যা ও তাঁকে সম্মাননা প্রদান

ছবি

নিজস্বতার অনন্য প্রমাণ

ছবি

ঈশ্বরের সত্য দর্শন

ছবি

মঞ্চে প্রবেশ

ছবি

আমি মাকারিও নই

ছবি

মৃতজন গল্প রচনা করে

ছবি

সম্পত্তি বিতর্ক: কেন পদত্যাগ করতে হলো টিউলিপ সিদ্দিককে

ছবি

রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা ফেব্রুয়ারিতে

ছবি

মধুসূদনের সাহিত্যে নৈরাশ্যবাদ

ছবি

বিদূষী নবনীতা বনাম মানুষ নবনীতা

ছবি

দুটি অণুগল্প

ছবি

উপমা-চিত্রে দ্যোতনার সঞ্চারণ

সাময়িকী কবিতা

ছবি

প্রয়োজনে ডাক দিও

ছবি

মাকারিও

ছবি

আমার সহযাত্রী

ছবি

নাগিব মাহফুজের নির্বাচিত ১০ স্বপ্ন

ছবি

একটি ভাঙ্গা থালা

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কবিতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বাদশা আকবর

ছবি

নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ও প্রতিরোধ এবং পুনর্জাগরণের প্রতীক নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ও

ছবি

সাহিত্যের ভবিষ্যৎ

ছবি

হৃদয় প্রক্ষালক কবি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

ছবি

বহুবাচনিকতা ও শিল্পের নন্দন

ছবি

সেদিন দু’দ- এই বাংলার তীর

ছবি

বিকল্প জীবন

tab

সাময়িকী

রবিউল হুসাইন

সরল প্রাণের সোপান

শামস্ হক

বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৫

কবি রবিউল হুসাইন, আমাদের রবিদা সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে তাঁরই পছন্দনীয় কবি পাবলো নেরুদার একটি উক্তি খুবই যথাযথ বলে মনে হয়, তা হলো, “ভালোবাসা একটুখানি, ভুলে যাওয়া কত দীর্ঘ।”

রবিদার সাথে আমার মেলামেশা খুব বেশি দিনের নয়, কিন্তু তাঁকে ভুলে যাওয়া বড় কঠিন। রবিউল হুসাইনের প্রতিভা বহুমুখী। তাঁর স্থাপত্য শিল্প এবং সাহিত্যের মূল্যায়নের ধৃষ্টতা এমনকি ক্ষমতাও আমার নেই। মানুষ রবিদাকে যতটুকু দেখেছি, সেই স্মৃতি-চারণটুকুই এই আলেখ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

রবিদার জন্ম ১৯৪৩ সালের ৩১ জানুয়ারি, ঝিনেদা জেলার শৈলকূপা থানার রতিডাঙ্গা গ্রামে। ছোটোখাটো গোল-গাল চেহারার সদা হাস্য এই মানুষটি দেহগত দিক থেকে হয়ত পৃথিবীর বেশি জায়গা জুড়ে ছিলেন না তবে মনের পরিধি এবং কাজের ব্যাপ্তি ছিলো সুবিশাল। তাঁর চরিত্রের সবিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাঁর রসবোধ। বিষণœতা যখন অন্তরীণ করে ফেলে, মন ভারি হয়ে যায়, সব কিছুতেই যখন অনিহা, রবিদার সামনে গেলে সব ভার এক মুহূর্তে কোথায় যেন উবে যেতো। একটা হাসি দিয়ে বলতেন, আচ্ছালামু আলায় বেশি। তিনি কম দিতে রাজি নন। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ, না বলে বলতেন, থ্যাংক ইউ রুই মাছ। এমনি করে পরতে পরতে মানুষকে হাসি তামাশার মাধ্যমে উজ্জীবিত করে তুলতেন। মন বৈকল্যের কোনো অবকাশ রবিদার সামনে বসে থাকলে পাওয়া কঠিন ছিলো।

রবিদা সর্ম্পকে এতো কথা, এতো স্মৃতি জমা হয়ে আছে যা এই স্বল্প পরিসরে বলা কঠিন।

আড্ডার মধ্যমণি হয়ে থাকতেন রবিদা। কেবলমাত্র শুক্রবার ব্যতীত প্রায় প্রতিটা দিন আমরা বসতাম কবি ও প্রকৌশলী খোরশেদ বাহারের সেগুন বাগিচার চেম্বারে। কবি বেলাল চৌধুরী, কবি রফিক আজাদ, কখনো কখনো ছড়াকার আলম তালুকদার, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, শিহাব সরকার- এরা কেউই আজ আর নেই। এখানে সাহিত্য সংস্কৃতি, রাজনীতি, গান বাজনা থেকে শুরু করে রাজা উজির মারা সবই হতো। কখন যে রাত্রি দ্বিপ্রহর হয়ে যেতো আমরা ঠিকই পেতাম না। এই আড্ডার আসরে রবিদার আক্রমণের স্বীকার হতাম আমি সবচেয়ে বেশি, কেননা আমার এন্টেনায় এরিয়াল ছিলো না, ওটা সীমাবদ্ধ চার দেয়ালের মধ্যেই, স্টান্ড করা থাকতো। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি ঐ আসরে আমিই ছিলাম সবচেয়ে নির্বোধ। জ্ঞান গরিমা তো নেইই, সমকালীন ঘটনা প্রবাহ সংক্রান্তেও ছিলাম অনাকিবহাল অথবা স্বল্প অবহিত। যার ফলে নবিসি প্রশ্ন করতাম আর শুরু হতো রবিদার ভর্ৎসনাপূর্ণ বাক্যবাণ! “সাধে কি বলে, ঝিনেদার মানুষ আলে খাটো!” আমি বলতাম, ঠিকই বলেছেন রবিদা, রতনে ছাড়া রতন চিনবে কেমন করে? তখন সকলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়তাম। ঐ অড্ডায় আমরা ভুলে যেতাম আমাদের বয়স, আমাদের অবস্থা, অবস্থান। অফুরন্ত হাসি, অনাবিল আনন্দ। হাসতে হাসতে কখনও দাঁড়িয়ে পড়তাম অমনি রবিদা বলে উঠতেন- “এই আপনার টেলিভিশন সরান।” বুঝতে পারতাম না, বোকার মতো চেয়ে থাকতাম। পরে বুঝলাম আমার পশ্চাতদেশের কারণে তাঁর টেলিভিশন দেখতে অসুবিধা হচ্ছে, তাই আমাকে আমার টেলিভিশন সরাতে বলছেন। এমনই সব টুকরো টুকরো ঘটনা স্মৃতির চাদরে আলপনা হয়ে রয়ে গেছে।

একটা দিনের ঘটনা মনে হলে এখনও নিজেকে ভীষণ অপরাধী বলে মনে হয়। ঘটনাটা এরকম- একদিন আমি, বাহার ভাই ও রবিদা ঢাকা ক্লাব থেকে খানাপিনা সেরে বাহার ভাই-এর গাড়িতে বাসার দিকে রওনা হবো। রাত তখন ১১/১২ টা। গাড়ির দরজার সামনে আসতেই বাহার ভাই আমাকে বললেন যে, আমার বাসা পর্যন্ত যেতে পারবেন না রবিদার বাসার সামনে আমাকে নামিয়ে দেয়া হবে, আমাকে ঐটুকু হেঁটে যেতে হবে।

আমি হেঁটে যেতে নারাজ, বাহার ভাই তো আমাকে রাগান্বিত করার জন্যে তার কথাতেই অনড় থাকলেন। আমি রেগে গিয়ে বললাম, যান, আপনার গাড়িতেই যাব না, বলেই সোজা হাঁটা দিলাম। রবিদাও আমার পিছু পিছু হাঁটছেন আর বলছেন, “আরে হক সাহেব দাঁড়ান।” কে কার কথা শোনে; রাগে তখন আমার কান মাথা সব গরম। রবিদা গাড়িতে না উঠে আমার পিছু পিছু একেবারে হাতিরপুল বাজার পর্যন্ত চলে এলেন। রবিদা বয়স্ক এবং মোটাসোটা মানুষ, রীতিমতো হাঁপাচ্ছেন এবং সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেছে। মনে হলো, কাজটা আমি ভাল করছি না। আমি দাঁড়ালাম। আমাকে বললেন, এতো সেন্টিমেনটাল হলে চলে? ওতো আপনার সাথে ইয়ারকি করছিলো। যাহোক, সে রাতে আমরা বাড়ি ফিরলাম। সে দিন কি কষ্টটাই না আমি রবিদাকে দিয়েছি। প্রায় দেড় দুমাইল পথ এ ভাবে সজোরে হেঁটে আসা তাঁর জন্য শুধু কষ্টকরই নয়, বিপজ্জনকও বটে। আজ মনে হয়, কতটা ¯েœহ-ভালবাসা থাকলে এভাবে আমাকে প্রশমিত করার জন্যে গাড়িতে না উঠে হেঁটে হেঁটে আমার পিছু নেয়া সম্ভব! শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আমার যে সামান্য পরিচয়, টুকিটাকি বসা ওঠা সবই হয়েছে রবিদার সুবাদে। কোথাও কোনো আচার অনুষ্ঠান থাকলে রবিদা আমাকে সেখানে নিয়েই ছাড়তেন। আমি অনেক সময় বলতাম, আমি তো আমন্ত্রিত নই, আমি কেন যাব? স্বভাবসুলভভাবে ধমকের সুরেই বলে উঠতেন- “আরে জ্বালা! আমি বলছি আপনি চলেন। কে দাওয়াত দিলো না দিলো তা আপনার দেখার দরকার কী?” জাতীয় যাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলা একাডেমি, আলিয়াস ফ্রঁসেস, কচি কাঁচার মেলা, শিল্পকলা একাডেমি, পাবলিক লাইবেরি, ঢাকা ক্লাব, আন্তর্জাতিক ভাষা ইন্সটিটিউট আরও অনেক অনেক প্রতিষ্ঠানে আমাকে নিয়ে যেতেন, সেখানে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতেন এবং ক্ষেত্র মতো কবিতা পাঠ বা কিছু বলারও সুযোগ তৈরি করে দিতেন। এটা যে শুধু আমার জন্যে করতেন না নয়, যিনিই তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন প্রত্যেককেই বিকশিত করার ইন্ধন-শক্তি যুগিয়েছেন কবি রবিউল হুসাইন। বলা বাহুল্য, আজকে যারা শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও স্থাপত্য শিল্পে সুপ্রতিষ্ঠিত তাদের অনেকেই এই পর্যায়ে এসেছেন রবিদার হাত ধরে। তাদের কেউ কেউ এটা হয়ত এখন স্বীকারও করেন না। অথচ তারা রবিদাকে উপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবেই ব্যবহার করেছেন। কবি রবিউল হুসাইন ছিলেন কাজপাগল মানুষ। আমরা অনেকেই নিজেদেরকে এলিট শ্রেণিতে উন্নীত করার চেষ্টায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারগুলোতে দেহের মধ্যপ্রদেশ স্থাপন করে পুতুল হয়ে বসে থাকি, কিন্তু কবি রবিউল হুসাইন ছিলেন প্রতিষ্ঠানগুলোর কামলা বিশেষ, আমলা নন।

একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে রবিদার ব্যক্তিগত চিকিৎসক বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডাঃ হারিসুল হক বার বার সর্তক করে রবিদাকে বলেছেন, “আপনি পরিপূর্ণ বিশ্রামে থাকুন, আপনার রক্তের প্লাটিলেট কাউন্ট মারাত্মকভাবে কমে গেছে”। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আলিয়াস ফ্রঁসেসে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে, সেখানে না গেলেই নয়। এমতাবস্থায় প্রফেসর হারিসুল হক আমাকে ফোন করে বলেছিলেন, “হক ভাই, রবিদাকে ঠেকান, তার অবস্থা মোটেও ভাল নয়”। তার বিশ্রাম প্রয়োজন এবং পারলে আজই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া উচিৎ।” আমি সাথে সাথেই রবিদার বাসায় চলে যাই এবং গুরুত্বের সাথে তাঁকে বাসার বাইরে না যাওয়ার অনুনয় জানাই। কিন্তু তিনি তা শোনেন নি। উপরন্তু ঐ অনুষ্ঠানে আমাকে যাবার জন্যে পীড়াপীড়ি করলেন। আমি অবশ্য যাইনি, কিন্তু রবিদা ঠিকই সেখানে গেলেন এবং তার পরের দিন হাসপাতালে ভর্তি হলেন। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি।

এই হচ্ছে রবিদার দায়িত্ব বোধ। যে সব প্রতিষ্ঠানের সাথে রবিদা জড়িত ছিলেন প্রত্যেকটিতে তার পরিশ্রমের এবং মনোনিয়োগের স্বীকৃতি পাওয়া যায়। বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউট, জাতীয় কবিতা পরিষদ, কেন্দ্রীয় কচি কাঁচার মেলা, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, বঙ্গবন্ধু জাদুঘর, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সমালোচক সংঘ, কবি রফিক আজাদ স্মৃতি পর্ষদ, চিত্র প্রকাশনীর মুখ্য উপদেষ্টা এমনি অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন যেগুলোতে তিনি অকান্ত পরিশ্রম এবং সেবা দিয়ে এসেছেন।

কবি রবিউল হুসাইনের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ এবং সেটাকে বাংলার প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে চিরকালের ছাপচিত্র করে এঁকে দেয়ার যে অভিপ্রায় এবং প্রয়াস তা কখনই অস্বীকার করা যাবে না। তিনি বলতেন আমরা যারা স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে বয়ঃপ্রাপ্ত ছিলাম তাদের অনেকেই আজ আর নেই। কিছুকাল পরে আর হয়তো একজনও থাকবেন না। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিৎ স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন স্মৃতিগুলোকে অক্ষরাবদ্ধ করে রাখা যাতে আগামী প্রজন্ম সেটাকে উপলদ্ধি করতে পারে এবং রাষ্ট্র বিনির্মাণে সেই চেতনার প্রতিফলন ঘটাতে পারে।

রবিদার চরিত্রের আর একটা বিশেষ দিক ছিলো চোখে পড়ার মতো। একেবারেই শিশুসুলভ আচরণ। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে চট করে পরিত্যক্ত জিনিস উঠিয়ে নিতেন, যেমন কালিহীন শিশ কলম, পাখির পালক, সাইকেলের ফেলে দেয়া স্পোক ইত্যাকার সব দ্রবাদি কুড়িয়ে নিয়ে সেগুলোকে সযতেœ রেখে দিতেন। তার কর্মস্থল শহীদুল্লাহ এন্ড এসোসিয়েটস-এর যে চেয়ারটাতে উনি বসতেন তার পিছনের দেয়ালে সুবিন্যস্তভাবে পাখির পালক সাজানো অবস্থায় দেখা গেছে। একবার জিজ্ঞাসাও করেছিলাম কেন তিনি এটা করেন, হাসতে হাসতে জবাব দিয়েছিলেন “পাইলেও পাইতে পারি অমূল্য রতন।”

আজ মনে হয় এই প্রবণতা থেকেই হয়ত তিনি অনেক মূল্যহীন এবং গুরুত্বহীন ব্যক্তি বিশেষকে সযতেœ এ দেশের শো’কেসে স্থান করে দিয়েছেন, যারা কোনো দিনও তার কোনো কাজে আসেনি। অপরকে প্রশংসা করা, বাহবা, অনুপ্রেরণা দেওয়া যেন ছিলো রবিদার গায়ের গহনা। একটা কবিতা বা একটা লেখা নিয়ে গেলে দেখে বলতেন, ভালই হয়েছে। অনেক সময় টুকিটাকি ভুল বানান ঠিকঠাক করে দিয়ে বলতেন, লেখাটা চালিয়ে যান। কোনো কোনো সময় নিজেই কবিতাটা কাগজে পাঠিয়ে ছাপাবার ব্যবস্থা করে দিতেন। রাত জেগে কষ্ট করে নিঃস্বার্থভাবে আমাদের অনেকের লেখার প্রুফ দেখা থেকে শুরু করে সেটাকে নির্ভুল করার ব্যবস্থা নিতেন।

কবি রবিউল হুসাইন মুলত স্থাপত্য বিদ্যায় বিদ্বান, কিন্তু বাংলা সাহিত্য, বাংলা ব্যাকরণ, বানান ইত্যাদির বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। অনুরূপভাবে ইংরেজি সাহিত্যেও তাঁর সাবলীল বিচরণ ছিলো। অনেক ইংরেজি কবিতার অনুবাদও করেছেন।

তাঁর পরীক্ষাধর্মী লেখাগুলো দেখলে স্তম্ভিত হতে হয়। তার লেখা একটি কবিতার কথা উল্লেখ করা যায়, কবিতাটির নাম ‘জনৌষধি।’ এটি মাত্রাবৃত্তে লেখা। একই লাইনে প্রথমে এক মাত্রা পরে দুই মাত্রা, তার পর তিনমাত্রা, চার মাত্রা, পাঁচ ও ছয় মাত্রায় কবিতাটি সম্পন্ন করেছেন, যা সচরাচার দৃষ্ট হয় না। করি রবিউল হুসাইনের সাহিত্য চর্চা ছিলো বহুমুখী। কবিতা প্রবন্ধ, উপন্যাস, কিশোর উপন্যাস, ছোট গল্প, গ্রন্থ সম্পাদনা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের তিনি নজির রেখে গেছেন। স্থাপত্যকর্মও তার প্রশংসিত হয়েছে। চলচ্চিত্র ও চিত্রসমালোচনায় তার মুন্সিয়ানার ছাপ রেখে গেছেন। পুরস্কারের ঝুলিও তার অপূর্ণ ছিলো না। একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, সাহিত্য পুরস্কার, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার, আইএবি পুরস্কার, সার্চ চেয়ারম্যান মেডেল, মুক্ত আকাশ পুরস্কার ইত্যাদি পুরস্কারে তিনি ভূষিত হয়েছেন। তিনি বলতেন পুরস্কার তিনি পেয়েছেন ঠিকই তবে তিরস্কার এবং অবহেলাও তিনি কম পাননি। এজন্যে তিনি তার স্থির বিন্দুর মোহন সংকট গ্রস্থখানি এভাবেই উৎসর্গ করেছেন।

“যারা আমাকে বিভিন্ন সময়ে অসময়ে, জ্ঞানে অজ্ঞানে, কারণে অকারণে বুঝে না বুঝে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য অপমান অসম্মান অবহেলা ঈর্ষা আর অবমূল্যায়ন দ্বারা নিজেদের মেকী ব্যক্তিত্ব বাড়ানোর অবাস্তব অপচেষ্টা করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে সেইসব ‘কেন’ জম্মা মানুষদের প্রতি বিব্রত বিবেচনায়” কবির এই ক্লেশসিক্ত ব্যঙ্গ উৎসর্গের নিশ্চয় কোনো কারণ ছিলো। তার জীবনে ধন্যবাদ, ক্রেস্ট, পুরস্কার নিঃসন্দেহে প্রেরণাত্মক। তবে প্রকৃত অর্থেই তার যেটুকু পাওয়ার ছিলো, সেটুকু তিনি পাননি অথচ সেটা ছিলো তার ন্যায়ানুগ প্রত্যাশা Legitimate Expectation যা হোক, তিনি আজ পাওয়া না পাওয়ার ঊর্ধ্বে। তবে কষ্ট হয়, যখন শুনি ২৫ নভেম্বর ২০১৯ তারিখের সন্ধ্যা থেকে ২৬ নভেম্বর ভোর চারটা পর্যন্ত প্রচ- শ্বাসকষ্টে থাকা সত্ত্বেও আইসিইউতে / সিসিইউতে তার একটু স্থান হয়নি। যখন দেখি তার ক্রয়কৃত জোয়ার সাহারা মৌজার ৪৯ শতক জমি সাবেক সরকারের শাসন কালে স্থাপনাগুলো বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে সে জমি অধিগ্রহণ করে বর্তমান সরকার কোটি টাকার বিনিময়ে সেগুলো বিভিন্ন ব্যক্তির নামে বরাদ্দ দিয়ে লাভবান হয়েছে অথচ মাত্র ৫ (পাঁচ) কাঠা জমি ক্ষতিপূরণ বাবদ হাইকোর্টের নির্দেশ অনুসারে তাকে বরাদ্দ দেওয়া আদেশ থাকা সত্ত্বেও আজও আইনের পথ পরিক্রমায় পড়ে প্রচ- এক জিজ্ঞাসাচিহ্ন বুকে নিয়ে তার শেষ নিঃশ্বাস টুকু নিতে হলো, যখন শুনি তার কর্মস্থলে তিনি ৩৬ (ছত্রিশ) মাস যাবৎ বেতন না পেয়ে দিনাতিপাত করেছেন, যখন দেখি তার একটা মাত্র অসহায় সন্তান এতো এতো শুভাকাক্সক্ষী থাকা সত্ত্বেও একটু কর্মসংস্থান তাঁর আজও হয়নি, অথবা দেখি রবিদার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীটাও আমরা বে-মালুম ভুলে গেছি তখন তাঁরই কবিতার (তরজমাকৃত) দুটো লাইন মনে পড়ে,

“আমার আত্মা এলোমেলো, সুখী দুঃখী অফুরন্ত।

ভাবিত, গভীর নির্জনতায় সমাধিস্থ প্রদীপ।

তুমি কে, কে তুমি?”

রবিদা তুমি চলে গেলে তবু রয়ে গেলে।

back to top