সাদ কামালীর গল্প
মিলন আশরাফ
(পূর্ব প্রকাশের পর)
ছোটগল্পে সাদ কামালী মননশীল মানুষের মনোজগতের কাব্যিক রূপকার। শুধু আঙ্গিক আর আখ্যানই নয়, তাঁর নিজস্ব রচনারীতি সচেতন পাঠককে আকর্ষণ করে অনায়াসে। তাঁর গল্পে বাউল জীবন, লোকদর্শন, গ্রাম, কুমার নদ, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ফিরে ফিরে আসে। তিনি যেন বারবার তাঁর বেড়ে ওঠার জায়গাগুলোর নিখুঁত ছবি এঁকে আমাদেরকে দেখান নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে। তাঁর অনেক গল্পে প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে চরিত্রগুলোও একটা নিবিড় যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। আপাতত ‘সমান্তরাল’ গল্পটায় মনোযোগ দিলে আমরা দেখতে পাবো মানব চরিত্র কুসু ও ফুকুর সঙ্গে সমান্তরাল হয়ে কীভাবে কেঁচো, পিঁপড়া, হাঁস, মুরগি, গরু ছাগল এককাতারে দাঁড়িয়ে আছে। এরপর গল্পকার নৌকায় ভাসিয়ে কুমার নদের হোগলাকান্দি গ্রামে নিয়ে যান আমাদেরকে। বন্যার মওসুম। বানভাসি মানুষের চিৎকার কানে বাজে। নৌকার ভেতর ফুকু স্রোতের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত হয়। বন্যার স্রোতে ভেসে আসে মানুষ ও গরুর বিষ্ঠা। হঠাৎ দূরে তাকিয়ে ফুকু দেখে নেয় কীভাবে হাজীদের ফজলি আম গাছে ডালে দুটি খোঁপে পাশাপাশি মুরগি ও কবুতরের ঘর আছে। সমাজের নিচুতলার মানুষের সঙ্গে উপরতলা মানুষের সংঘর্ষ চিরকালীন। গল্পকারের ভাষায়, ‘আনুকে উঠিয়ে ফুকু হুকুম করে, দুইডা কইতর আনছি রাইনদাদে। আনুর হয়তো বুঝতে একটু সময় লাগে। ফুকু আবার বলে, আমি কুইটা দিবানে, তুই চুলা দরা। আনু আধা বোজা গলায় বলে, মরবার জইন্যে এত ফূর্তি চ্যাতছে? ফুকু হঠাৎ চিৎকার দিয়ে ওঠে, কথা বাড়াবি তো এহনই চুবাইয়া মারব।’ তিক্ততায় গলা উগরে উঠলে গল্পকার জ্যোৎস্না রাতে ঢেউয়ের মধ্যে আমাদের চোখ বন্ধ করে ভেসে যেতে আহ্বান জানান। স্বপ্ন দেখান নতুন জীবনের। সেই স্বপ্নে ঘাড় কাত করে ঢুকে পড়ে ফুকু। তার শরীর নিশপিশ করে, সে চায় সন্তান আনু ও বউ কুসু কথা বলুক, গান করুক। সে বলে, ‘এখনো তো মরে যাইনি, জীবন কেমন ভেসে ভেসেই বেঁচে আছে। বন্যা কখনো মরবে কিন্তু প্রাণ তো তারপরও থাকবে।’ অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে গল্পকার আমাদেরকে বেঁচে থাকতেই পরমার্শ দেন। তবে এ বাঁচা লড়াইয়ের বাঁচা। বন্যার সঙ্গে লড়তে লড়তে ফুকু কেমন জানি হিংস্র হয়ে ওঠে। গল্পে একপর্যায়ে আমরা দেখি, সামান্য তর্কতেই নৌকার খোলের মধ্য থেকে দা বেরকরে, বিপদে পড়লে ফুকু খুনও করতে পারে। ফুলসূতি গ্রামের কথা এখনও ভুলেনি। অল্প বয়সের একটা ছেলে সাঁতরায়ে সাঁতরায়ে একটা বাছুরকে কোথাও নিয়ে যাচ্ছিল। খালের মধ্যে স্রোত বেশ। দু’পাশের গ্রাম ভেসে গেছে। ছেলেটি কখনো কখনো হিজল গাছের বা গোটা গাছের ডাল ধরে জিরিয়ে আবার বাছুর তাড়া করছিল। ফুকু কিছুক্ষণ চারপাশ দেখে ধীরে ধীরে ছেলেটির পিছন পিছন আসে। সুযোগমত ছেলেটিকে পিছনে ফেলে বাছুরটিকে নৌকায় তুলে নেয়। আনুও সাহায্য করে। ছেলেটি চিৎকার দিয়ে দ্রুত এগিয়ে এসে নৌকা ধরে ফেলে। আনু নৌকার খোলের থেকে টিনের মগ নিয়ে ছেলেটির হাতে বাড়ি মারে। ফুকু চইড় দিয়ে ঠেলা দিলেও ছেলেটি হাত বদলিয়ে ধরে রাখে। কুসু আতঙ্কে তাকিয়ে দেখে কেউ আসছে কিনা। হঠাৎ ফুকু নৌকার পাটাতন থেকে দা বের করে ছেলেটির হাতে কোপ মেরে দেয়। আনু কুসু দু’জনেই চিৎকার করে ওঠে। ফুকু নৌকার খোল থেকে কাটা আঙুল ফেলতে ফেলতে আনু দেখে ফেলে জালি শশার মতো কচি আঙুল। গা শিউরে ওঠে। বানভাসি মানুষের আরও একটা চিত্র ছায়াছবির মতো আমাদের চোখের সামনে পর্দা ঝুলিয়ে দেখিয়ে দেন গল্পকার সাদ কামালী। ‘দু’সারিতে ঠেসে বসে সশব্দে অপেক্ষা করছে শতশত মানুষ।’ হ্যাঁ রিলিফ দেওয়া হবে। মন্ত্রী সাগরেদসহ হাজির, সঙ্গে গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার। এরপর কী ঘটবে আমরা অনুমান করতে পারি। যত দোষ গরিবের ঘাড়ে পড়বে। একপর্যায়ে নেতাদের একজন ফুকুকে বলেই ফেলে, ‘দেহিস আবার রিলিফ চুরি করিস না।’ গল্পকার এখানে মোক্ষম সুযোগটা নেন, দ্বন্দ্বটা জমিয়ে ক্ষির বানিয়ে মনে মনে ঠিকই ফুকুর মুখে চালান করেন, ‘চুতমারানি, তোমাগো খবরও জানি’। প্রকৃতির কাছ থেকে মাফ পেলেও মানুষের হাত থেকে রেহায় পায় না শোষিত মানুষগুলো। নেতাদের আলো অন্ধকারের খেলা চলে। অন্ধকারে স্কুল ঘরে মনুষ্য জানোয়ার খুবলে খেয়ে ফেলে কুসুকে।
নিচু স্বরের গল্প ‘পুতুলপুরাণ’। শীতকালের খেজুর রসের মতো এর স্বাদ জিইয়ে রাখা। দ্বন্দ্বটা পুরানো। এখনও অমীমাংসিত। নারী পুরুষের সেই চিরায়ত দ্বন্দ্বটা ধীর লয়ে গল্পে গল্পে বলে যান সাদ কামালী। ‘পুতুলপুরাণ’ গল্পে শুরুতেই দ্বন্দ্ব ধরিয়ে দেন গল্পকার ঠিক এভাবে, ‘আরে, ব্যাটা লোকে ফাল পাড়ে/বীর্য থলি কান্দে চড়ে/নিজ গুণে নিজে হাসে/ রাত করে জমি চাষে...।’ প্রতিউত্তর। ‘আরে জমি যদি তোর হতো/শস্য দানা যাই হতো/খুশি মনে ঘরে তুলে/ নিজে খেতি প্রাণ খুলে..।’ ব্যাস শুরু হয়ে যায়। এযেন গ্রামের সেই চিরচেনা কবিগানের লড়াই। গল্পের ভেতরেই এসব পদ্যের ব্যাখ্যা চরিত্রদের মুখে সেঁটে দিয়েছেন গল্পকার। যেমন আলেয়া ও বসির বয়াতির দেখ্ভাল রান্নাবান্না করার মানুষ মানিকগঞ্জের বড় সিঙ্গাইর গ্রামের পারুল। সে বোঝে, ‘হ লাঙ্গলের চোদন ছাড়া খ্যাত মাটির প্যাট বান্দে না, এইডা ঠিকই কতা বু।’ আলেয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘শোন পারুল, যেই জমিতে লাঙ্গল চাষ নাই সেইখানেও গাছগাছড়া জন্মে, লাঙ্গল ব্যাটারে ক’ পারলে নিজে নিজেই ফসল ফলাও দেহি তোমার ক্ষেমতা, কতো তোমার লিঙ্গের জোর, কতো তোমার বীর্যের বড়াই।’ ফকিরি ভাষায় খিস্তিখেউড় নতুন নয়। পুরো দর্শনে ঠাসা এসব যুক্তিতর্ক। এভাবে দিনের পর দিন আলেয়া মারেফতের লড়াই চালিয়ে যায়। তারপর একসময় বিদ্রোহ করে বসে। কোরান হাদিস সংহিত ওইসব অংশই বয়াতিরা পড়ে যেখানে পুরুষের পক্ষের যুক্তি ও নারীর পক্ষেরও যুক্তি আছে। তবে আলেয়ার সব সময় মনে হয় বসির বয়াতির অথবা কেতাবের অপমানের জবাবে নিজের পক্ষে বলার মতো কিছুই তার মনে আসে না। কারণ বলতে পারার দায়িত্ব বসির বয়াতির বা চান্দুর। সে কখনো বলার চেষ্টাও করেনি। কিন্তু এক পালায় একটা গান তার বেশ মনে ধরে, শেষটুকু বিশেষ করে। ‘আরে, মিথ্যা তারা খোদার দোহাই দেন/ এই আসরের শ্রোতা যত্ত/ শুনেন দুখের সব সত্য/ পুরুষ মানুষ বয়ান লেখেন/বিধান বলেই শাসন করেন।’ আলেয়া চিন্তা করে এই পদ কোনো পুরুষ লোকের হতে পারে না। বয়াতি কোনো মাইয়া লোকের কাছ থেকে মেরে দিয়েছে। আলেয়া এখন এই গানের অর্থ বোঝে। লেখকের বর্ণনায়, ‘বসির বয়াতির শাস্ত্রের দোহাই, যুক্তি যদি পুরুষলোকেরই লেখা হয়, তবে তা যেমন অবশ্য পালনীয় বিধান হতে পারে না, তেমনি ওই বিধান বলে নারীকে হেয় এমনকি সাক্ষী হিসেবে অযোগ্য শারিয়া আইনেরই ভিত্তি কোথায়!’ এর জন্য বসির বয়াতিকে সে দোষী সাব্যস্ত করে। তার মাথায় এক ভয়ানক প্রতিশোধ কাজ করে। সে বয়াতিকে খুন করার পরিকল্পনা আঁটে। একাজে পারুলকে ব্যবহার করতে চায় সে। পারুল কিছুতেই রাজিহতে চায় না। যুক্তিতর্কে সমস্যা বেড়েই চলে। কোন খেই খুঁজে পায় না আলেয়া। হার মেনে নেয়। নতুন পালার গান বাঁধা হয়। আলেয়া যেন সেই পুতুল হয়েই বয়াতির সঙ্গে গলা মেলায়। এমনকি মহিন ফকিরের সঙ্গে দেখা করার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। সাদ কামালী’র ভাষায়, ‘ঘাড় মটকানো পুতুলের মতো।’ ফকিরি গানের ভাব, ভাষা, দর্শন আলাদা। এ বিষয়ে সাদ কামালীর নিজস্ব একটা ব্যাখ্যা আছে। তিনি বলেন, “ফকিরি সাধনা মূলত বাতেনি, গভীর। তার প্রকাশের শব্দও আলাদা। যেমন, ‘বাঁকার ঘাটে/বিদ্যাবুদ্ধি রয় না ঘটে-/কাম নামে কুমির জুটে/চিবিয়ে চুষে খায় তাকে।’ নারীদের জননাঙ্গের উপমা ফকিরের কাছে বাঁকা নদী। নারীদেহের বাঁকানদীর ঘাটে কামনা-কুমির পুরুষের সারবস্তু চিবিয়ে চুষে খায়। এই ভাষাবোধ এই দর্শনবোধ প্রকাশের জন্যই তৈরি, ফকিরি ভাষায় গুরুলিঙ্গ হলো মুর্শিদের কথা, ফকিরি গানে যোনি হচ্ছে শ্রবণ ইন্দ্রিয়।” এক্ষেত্রে দেবেশ রায়ের কথাটাও যুক্তিযুক্ত। তিনি বলেন, ‘লেখকদের প্রতিটি শব্দের ইতিহাস জানতে হয়। শব্দের ইতিহাস অর্থ শুধু কালিক, ধাতুগত, ব্যবহারিক দিকই নয়, এর সঙ্গে বোধ জড়িত।’
সংকলনের শেষ গল্প ‘তেলাপোকার জার্নাল’ ভাষিত হয়েছে ফ্রয়েডকথিত লিবিডো চেতনা। গল্পের প্রথম লাইন পড়েই একটু হোঁচট খেতে পারে পাঠক। গল্পকার শুরু করেছেন এভাবে, ‘নুরুল ফজল এখন সঙ্গমে অক্ষম। মরা টাকি মাছের মতো ন্যাতানো অঙ্গটি অনাদরে শরীরের সঙ্গে কোনো রকমে আটকে আছে। নুরুল ফজল অথবা নাজনীন বেগম কোনোভাবেই ওই অঙ্গটিতে উত্তেজনা ছড়াতে পারছে না।’ ভালোলাগা গল্প থেকে মাত্র কয়েকটির কথা হলো শুধু, মুক্তিযুদ্ধের অসাধারণ গল্পটিকিটঘরসহ, আসমানে ফিরে যা, জননী অথবা আত্মজার গল্প, কোরবানি, জৈবকথা, প্রাকৃত সম্পর্কের উপকথা, দুধ অথবা বীজের উপকথা, সাদা রক্ত, সমান্তরাল, তাজামরা মানুষের গোশতো, রাস্তার কালো পিচে পেট্রলের পোড়া গন্ধ, মাছের আঁশ,বৃক্ষবোধ ইত্যাদি গল্পের কথা অন্য সময় হবে। ‘সাদ কামালীর গল্প : একজন পাঠকের দৃষ্টিতে থেকে শেষ কথাটি বলি, “সাদ কামালী তাঁর গল্পে প্রতীকী উপস্থাপনের মাধ্যমেমানুষের জীবনের বিশৃঙ্খলা ও বিরোধকে যেমন চিত্রিত করেছেন, তেমনি মানুষের চরিত্র ও স্বভাবের মধ্যে যে-জটিলতা, যে-বুদ্ধিদীপ্ততা- তাকেও পরিবেশন করেছেন। তাঁর গল্পের চরিত্রের মধ্যে অনুভূতির গভীরতা যেমন অভিব্যক্ত হয়েছে, তেমনি সেখানে পরিচয় পাওয়া যায় সংবেদনশীলতারও। আবার কখনো-কখনো নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে যে চিরন্তন দীপ্তি ও স্পন্দন, তারও সন্ধান করেছেন। ... ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী এই গল্পকার তাঁর গল্পে চরিত্রের আত্মগত অনুভূতি প্রকাশের দিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন; ফলে, অনেক সময় বিষয়ের বস্তুগত তথ্যকে তিনি এড়িয়ে গিয়েছেন। এইটি একদিকে যেমন শিল্পী-মানসের সংযমী-পরিচয় বহন করে, তেমনি অন্যদিকে, এই সংযমী-মনোভাবে তাঁর গল্পের গঠনেও এনে দিয়েছে পরিমিত পরিচর্য্যার প্রকাশ। সব মিলিয়ে সাদ কামালীর গল্পের জগৎকে বলা যায়- হার্বাট রিডের ভাষা ধার নিয়ে- ‘world of images, capable of symbolizing the fertility of artist’s vision and of expressing his creative joy” গল্পকার সাদ কামালীসর্বদা নিরীক্ষাপ্রবণ। এই কারণে কোনো কোনো পাঠকের কাছে তাঁর রচনা দুর্বোধ্য মনে হতে পারে। এক্ষেত্রে চলুন শুরুর মতো শেষটাও ফকনারের কাছে যাই। ফকনারের বিরুদ্ধে একটি বড়ো নালিশ ছিল এই যে, তার বই দুই বা তিনবার পাঠ করেও পাঠক বুঝতে পারে না। ফকনার’র জবাব, চতুর্থবার পড়–ন। (সমাপ্ত)
সাদ কামালীর গল্প
মিলন আশরাফ
বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৫
(পূর্ব প্রকাশের পর)
ছোটগল্পে সাদ কামালী মননশীল মানুষের মনোজগতের কাব্যিক রূপকার। শুধু আঙ্গিক আর আখ্যানই নয়, তাঁর নিজস্ব রচনারীতি সচেতন পাঠককে আকর্ষণ করে অনায়াসে। তাঁর গল্পে বাউল জীবন, লোকদর্শন, গ্রাম, কুমার নদ, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ফিরে ফিরে আসে। তিনি যেন বারবার তাঁর বেড়ে ওঠার জায়গাগুলোর নিখুঁত ছবি এঁকে আমাদেরকে দেখান নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে। তাঁর অনেক গল্পে প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে চরিত্রগুলোও একটা নিবিড় যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। আপাতত ‘সমান্তরাল’ গল্পটায় মনোযোগ দিলে আমরা দেখতে পাবো মানব চরিত্র কুসু ও ফুকুর সঙ্গে সমান্তরাল হয়ে কীভাবে কেঁচো, পিঁপড়া, হাঁস, মুরগি, গরু ছাগল এককাতারে দাঁড়িয়ে আছে। এরপর গল্পকার নৌকায় ভাসিয়ে কুমার নদের হোগলাকান্দি গ্রামে নিয়ে যান আমাদেরকে। বন্যার মওসুম। বানভাসি মানুষের চিৎকার কানে বাজে। নৌকার ভেতর ফুকু স্রোতের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত হয়। বন্যার স্রোতে ভেসে আসে মানুষ ও গরুর বিষ্ঠা। হঠাৎ দূরে তাকিয়ে ফুকু দেখে নেয় কীভাবে হাজীদের ফজলি আম গাছে ডালে দুটি খোঁপে পাশাপাশি মুরগি ও কবুতরের ঘর আছে। সমাজের নিচুতলার মানুষের সঙ্গে উপরতলা মানুষের সংঘর্ষ চিরকালীন। গল্পকারের ভাষায়, ‘আনুকে উঠিয়ে ফুকু হুকুম করে, দুইডা কইতর আনছি রাইনদাদে। আনুর হয়তো বুঝতে একটু সময় লাগে। ফুকু আবার বলে, আমি কুইটা দিবানে, তুই চুলা দরা। আনু আধা বোজা গলায় বলে, মরবার জইন্যে এত ফূর্তি চ্যাতছে? ফুকু হঠাৎ চিৎকার দিয়ে ওঠে, কথা বাড়াবি তো এহনই চুবাইয়া মারব।’ তিক্ততায় গলা উগরে উঠলে গল্পকার জ্যোৎস্না রাতে ঢেউয়ের মধ্যে আমাদের চোখ বন্ধ করে ভেসে যেতে আহ্বান জানান। স্বপ্ন দেখান নতুন জীবনের। সেই স্বপ্নে ঘাড় কাত করে ঢুকে পড়ে ফুকু। তার শরীর নিশপিশ করে, সে চায় সন্তান আনু ও বউ কুসু কথা বলুক, গান করুক। সে বলে, ‘এখনো তো মরে যাইনি, জীবন কেমন ভেসে ভেসেই বেঁচে আছে। বন্যা কখনো মরবে কিন্তু প্রাণ তো তারপরও থাকবে।’ অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে গল্পকার আমাদেরকে বেঁচে থাকতেই পরমার্শ দেন। তবে এ বাঁচা লড়াইয়ের বাঁচা। বন্যার সঙ্গে লড়তে লড়তে ফুকু কেমন জানি হিংস্র হয়ে ওঠে। গল্পে একপর্যায়ে আমরা দেখি, সামান্য তর্কতেই নৌকার খোলের মধ্য থেকে দা বেরকরে, বিপদে পড়লে ফুকু খুনও করতে পারে। ফুলসূতি গ্রামের কথা এখনও ভুলেনি। অল্প বয়সের একটা ছেলে সাঁতরায়ে সাঁতরায়ে একটা বাছুরকে কোথাও নিয়ে যাচ্ছিল। খালের মধ্যে স্রোত বেশ। দু’পাশের গ্রাম ভেসে গেছে। ছেলেটি কখনো কখনো হিজল গাছের বা গোটা গাছের ডাল ধরে জিরিয়ে আবার বাছুর তাড়া করছিল। ফুকু কিছুক্ষণ চারপাশ দেখে ধীরে ধীরে ছেলেটির পিছন পিছন আসে। সুযোগমত ছেলেটিকে পিছনে ফেলে বাছুরটিকে নৌকায় তুলে নেয়। আনুও সাহায্য করে। ছেলেটি চিৎকার দিয়ে দ্রুত এগিয়ে এসে নৌকা ধরে ফেলে। আনু নৌকার খোলের থেকে টিনের মগ নিয়ে ছেলেটির হাতে বাড়ি মারে। ফুকু চইড় দিয়ে ঠেলা দিলেও ছেলেটি হাত বদলিয়ে ধরে রাখে। কুসু আতঙ্কে তাকিয়ে দেখে কেউ আসছে কিনা। হঠাৎ ফুকু নৌকার পাটাতন থেকে দা বের করে ছেলেটির হাতে কোপ মেরে দেয়। আনু কুসু দু’জনেই চিৎকার করে ওঠে। ফুকু নৌকার খোল থেকে কাটা আঙুল ফেলতে ফেলতে আনু দেখে ফেলে জালি শশার মতো কচি আঙুল। গা শিউরে ওঠে। বানভাসি মানুষের আরও একটা চিত্র ছায়াছবির মতো আমাদের চোখের সামনে পর্দা ঝুলিয়ে দেখিয়ে দেন গল্পকার সাদ কামালী। ‘দু’সারিতে ঠেসে বসে সশব্দে অপেক্ষা করছে শতশত মানুষ।’ হ্যাঁ রিলিফ দেওয়া হবে। মন্ত্রী সাগরেদসহ হাজির, সঙ্গে গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার। এরপর কী ঘটবে আমরা অনুমান করতে পারি। যত দোষ গরিবের ঘাড়ে পড়বে। একপর্যায়ে নেতাদের একজন ফুকুকে বলেই ফেলে, ‘দেহিস আবার রিলিফ চুরি করিস না।’ গল্পকার এখানে মোক্ষম সুযোগটা নেন, দ্বন্দ্বটা জমিয়ে ক্ষির বানিয়ে মনে মনে ঠিকই ফুকুর মুখে চালান করেন, ‘চুতমারানি, তোমাগো খবরও জানি’। প্রকৃতির কাছ থেকে মাফ পেলেও মানুষের হাত থেকে রেহায় পায় না শোষিত মানুষগুলো। নেতাদের আলো অন্ধকারের খেলা চলে। অন্ধকারে স্কুল ঘরে মনুষ্য জানোয়ার খুবলে খেয়ে ফেলে কুসুকে।
নিচু স্বরের গল্প ‘পুতুলপুরাণ’। শীতকালের খেজুর রসের মতো এর স্বাদ জিইয়ে রাখা। দ্বন্দ্বটা পুরানো। এখনও অমীমাংসিত। নারী পুরুষের সেই চিরায়ত দ্বন্দ্বটা ধীর লয়ে গল্পে গল্পে বলে যান সাদ কামালী। ‘পুতুলপুরাণ’ গল্পে শুরুতেই দ্বন্দ্ব ধরিয়ে দেন গল্পকার ঠিক এভাবে, ‘আরে, ব্যাটা লোকে ফাল পাড়ে/বীর্য থলি কান্দে চড়ে/নিজ গুণে নিজে হাসে/ রাত করে জমি চাষে...।’ প্রতিউত্তর। ‘আরে জমি যদি তোর হতো/শস্য দানা যাই হতো/খুশি মনে ঘরে তুলে/ নিজে খেতি প্রাণ খুলে..।’ ব্যাস শুরু হয়ে যায়। এযেন গ্রামের সেই চিরচেনা কবিগানের লড়াই। গল্পের ভেতরেই এসব পদ্যের ব্যাখ্যা চরিত্রদের মুখে সেঁটে দিয়েছেন গল্পকার। যেমন আলেয়া ও বসির বয়াতির দেখ্ভাল রান্নাবান্না করার মানুষ মানিকগঞ্জের বড় সিঙ্গাইর গ্রামের পারুল। সে বোঝে, ‘হ লাঙ্গলের চোদন ছাড়া খ্যাত মাটির প্যাট বান্দে না, এইডা ঠিকই কতা বু।’ আলেয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘শোন পারুল, যেই জমিতে লাঙ্গল চাষ নাই সেইখানেও গাছগাছড়া জন্মে, লাঙ্গল ব্যাটারে ক’ পারলে নিজে নিজেই ফসল ফলাও দেহি তোমার ক্ষেমতা, কতো তোমার লিঙ্গের জোর, কতো তোমার বীর্যের বড়াই।’ ফকিরি ভাষায় খিস্তিখেউড় নতুন নয়। পুরো দর্শনে ঠাসা এসব যুক্তিতর্ক। এভাবে দিনের পর দিন আলেয়া মারেফতের লড়াই চালিয়ে যায়। তারপর একসময় বিদ্রোহ করে বসে। কোরান হাদিস সংহিত ওইসব অংশই বয়াতিরা পড়ে যেখানে পুরুষের পক্ষের যুক্তি ও নারীর পক্ষেরও যুক্তি আছে। তবে আলেয়ার সব সময় মনে হয় বসির বয়াতির অথবা কেতাবের অপমানের জবাবে নিজের পক্ষে বলার মতো কিছুই তার মনে আসে না। কারণ বলতে পারার দায়িত্ব বসির বয়াতির বা চান্দুর। সে কখনো বলার চেষ্টাও করেনি। কিন্তু এক পালায় একটা গান তার বেশ মনে ধরে, শেষটুকু বিশেষ করে। ‘আরে, মিথ্যা তারা খোদার দোহাই দেন/ এই আসরের শ্রোতা যত্ত/ শুনেন দুখের সব সত্য/ পুরুষ মানুষ বয়ান লেখেন/বিধান বলেই শাসন করেন।’ আলেয়া চিন্তা করে এই পদ কোনো পুরুষ লোকের হতে পারে না। বয়াতি কোনো মাইয়া লোকের কাছ থেকে মেরে দিয়েছে। আলেয়া এখন এই গানের অর্থ বোঝে। লেখকের বর্ণনায়, ‘বসির বয়াতির শাস্ত্রের দোহাই, যুক্তি যদি পুরুষলোকেরই লেখা হয়, তবে তা যেমন অবশ্য পালনীয় বিধান হতে পারে না, তেমনি ওই বিধান বলে নারীকে হেয় এমনকি সাক্ষী হিসেবে অযোগ্য শারিয়া আইনেরই ভিত্তি কোথায়!’ এর জন্য বসির বয়াতিকে সে দোষী সাব্যস্ত করে। তার মাথায় এক ভয়ানক প্রতিশোধ কাজ করে। সে বয়াতিকে খুন করার পরিকল্পনা আঁটে। একাজে পারুলকে ব্যবহার করতে চায় সে। পারুল কিছুতেই রাজিহতে চায় না। যুক্তিতর্কে সমস্যা বেড়েই চলে। কোন খেই খুঁজে পায় না আলেয়া। হার মেনে নেয়। নতুন পালার গান বাঁধা হয়। আলেয়া যেন সেই পুতুল হয়েই বয়াতির সঙ্গে গলা মেলায়। এমনকি মহিন ফকিরের সঙ্গে দেখা করার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। সাদ কামালী’র ভাষায়, ‘ঘাড় মটকানো পুতুলের মতো।’ ফকিরি গানের ভাব, ভাষা, দর্শন আলাদা। এ বিষয়ে সাদ কামালীর নিজস্ব একটা ব্যাখ্যা আছে। তিনি বলেন, “ফকিরি সাধনা মূলত বাতেনি, গভীর। তার প্রকাশের শব্দও আলাদা। যেমন, ‘বাঁকার ঘাটে/বিদ্যাবুদ্ধি রয় না ঘটে-/কাম নামে কুমির জুটে/চিবিয়ে চুষে খায় তাকে।’ নারীদের জননাঙ্গের উপমা ফকিরের কাছে বাঁকা নদী। নারীদেহের বাঁকানদীর ঘাটে কামনা-কুমির পুরুষের সারবস্তু চিবিয়ে চুষে খায়। এই ভাষাবোধ এই দর্শনবোধ প্রকাশের জন্যই তৈরি, ফকিরি ভাষায় গুরুলিঙ্গ হলো মুর্শিদের কথা, ফকিরি গানে যোনি হচ্ছে শ্রবণ ইন্দ্রিয়।” এক্ষেত্রে দেবেশ রায়ের কথাটাও যুক্তিযুক্ত। তিনি বলেন, ‘লেখকদের প্রতিটি শব্দের ইতিহাস জানতে হয়। শব্দের ইতিহাস অর্থ শুধু কালিক, ধাতুগত, ব্যবহারিক দিকই নয়, এর সঙ্গে বোধ জড়িত।’
সংকলনের শেষ গল্প ‘তেলাপোকার জার্নাল’ ভাষিত হয়েছে ফ্রয়েডকথিত লিবিডো চেতনা। গল্পের প্রথম লাইন পড়েই একটু হোঁচট খেতে পারে পাঠক। গল্পকার শুরু করেছেন এভাবে, ‘নুরুল ফজল এখন সঙ্গমে অক্ষম। মরা টাকি মাছের মতো ন্যাতানো অঙ্গটি অনাদরে শরীরের সঙ্গে কোনো রকমে আটকে আছে। নুরুল ফজল অথবা নাজনীন বেগম কোনোভাবেই ওই অঙ্গটিতে উত্তেজনা ছড়াতে পারছে না।’ ভালোলাগা গল্প থেকে মাত্র কয়েকটির কথা হলো শুধু, মুক্তিযুদ্ধের অসাধারণ গল্পটিকিটঘরসহ, আসমানে ফিরে যা, জননী অথবা আত্মজার গল্প, কোরবানি, জৈবকথা, প্রাকৃত সম্পর্কের উপকথা, দুধ অথবা বীজের উপকথা, সাদা রক্ত, সমান্তরাল, তাজামরা মানুষের গোশতো, রাস্তার কালো পিচে পেট্রলের পোড়া গন্ধ, মাছের আঁশ,বৃক্ষবোধ ইত্যাদি গল্পের কথা অন্য সময় হবে। ‘সাদ কামালীর গল্প : একজন পাঠকের দৃষ্টিতে থেকে শেষ কথাটি বলি, “সাদ কামালী তাঁর গল্পে প্রতীকী উপস্থাপনের মাধ্যমেমানুষের জীবনের বিশৃঙ্খলা ও বিরোধকে যেমন চিত্রিত করেছেন, তেমনি মানুষের চরিত্র ও স্বভাবের মধ্যে যে-জটিলতা, যে-বুদ্ধিদীপ্ততা- তাকেও পরিবেশন করেছেন। তাঁর গল্পের চরিত্রের মধ্যে অনুভূতির গভীরতা যেমন অভিব্যক্ত হয়েছে, তেমনি সেখানে পরিচয় পাওয়া যায় সংবেদনশীলতারও। আবার কখনো-কখনো নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে যে চিরন্তন দীপ্তি ও স্পন্দন, তারও সন্ধান করেছেন। ... ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী এই গল্পকার তাঁর গল্পে চরিত্রের আত্মগত অনুভূতি প্রকাশের দিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন; ফলে, অনেক সময় বিষয়ের বস্তুগত তথ্যকে তিনি এড়িয়ে গিয়েছেন। এইটি একদিকে যেমন শিল্পী-মানসের সংযমী-পরিচয় বহন করে, তেমনি অন্যদিকে, এই সংযমী-মনোভাবে তাঁর গল্পের গঠনেও এনে দিয়েছে পরিমিত পরিচর্য্যার প্রকাশ। সব মিলিয়ে সাদ কামালীর গল্পের জগৎকে বলা যায়- হার্বাট রিডের ভাষা ধার নিয়ে- ‘world of images, capable of symbolizing the fertility of artist’s vision and of expressing his creative joy” গল্পকার সাদ কামালীসর্বদা নিরীক্ষাপ্রবণ। এই কারণে কোনো কোনো পাঠকের কাছে তাঁর রচনা দুর্বোধ্য মনে হতে পারে। এক্ষেত্রে চলুন শুরুর মতো শেষটাও ফকনারের কাছে যাই। ফকনারের বিরুদ্ধে একটি বড়ো নালিশ ছিল এই যে, তার বই দুই বা তিনবার পাঠ করেও পাঠক বুঝতে পারে না। ফকনার’র জবাব, চতুর্থবার পড়–ন। (সমাপ্ত)