দিলারা মেসবাহ
আমার একবিন্দু দাম নেই সংসারে। কেউ আমাকে পোঁছে না।সংসারে যে ডিঙি রোজ বাইতে হয়, সেই তেলতেলা আবলুস লগিটা কিন্তু আমার খসখসা বদসুরত আঙুলের ভাঁজে।কারিশমা পুরাই হেফজ আমার। তারপরও কী বিষয়! খোপ খোপ ঘরের বান্দরগুলা,তওবা তওবা বান্দাগুলা তাদের সিডিউল মাফিক নিদ্রা মুক্ত হয়ে কপাট খোলে। চক্ষু- লাটিম বন বন।
জনান্তিকে বলে রাখি,আমার আঙুলগুলো নাকি চাঁপাফুলের কলি সদ্য বয়ঃসন্ধিতে বান্ধবীরা বলত।লজ্জা পেতাম। সে যাক। কসম এই সাতজন্মের বান্দীরেই তালাশ করে। ননদিনী পুরুষালী খরখরে গলায় সোনালি সকালে বলে, ‘কুন সুম থেইকা বিছরাইতাছি।আমার একডা জরুরি কাম পড়ছে। নাস্তা পানি কতদ্দুর?’ ‘দিতাছি তাওয়াও রুটি।চায়ের পানি ফুটতাছে মরিয়ম।’ আলগা মমতা মিশিয়ে জবাব পেশ করতে হয়। আজকাল এই রকম ভড়ং শিখতে হয়েছে। ধৈর্যের সুতাগাছায় মাঞ্জা মারি আর গীত গাই- যে সহে সে রহে।
একজন একজন করে বান্দাসকল জমিদারি দিকদারি শুরু করবে। সহি বাত। আর তিন ননদিনী রায়বাঘিনী সিনানে যাত্রা করবে,গজেন্দ্রগমনে।তারপর পায়চারি করবে, ভেজা চুল শুকাবে,আইবুড়ো বোনেরা গোপন প্রেমিকদের বিষয় আশয়ের আলাপও করে ফিসফিস। হেসে ঢলে পড়ে।আমি নিরন্তর আটার কাইয়ে দুসরা ময়ান ডলি। রসুইঘরে তাওয়ায় হাতরুটি ভরা পোয়াতি, আলু কুটি চিরল চিরল। রুটি সেঁকার অপূর্ব সুঘ্রাণ বাতাস মঁ মঁ। রাজার দুলালিরা ফেস পাউডার ঘষতে ঘষতে নির্ঘাত বলবে, ‘অহনো বুটের ডাইল চড়ান নাই? ক্লাসে আজ্জাও লেইট হইব।বুঝতাম পারসি গো।’ চিলতে পাকঘরে পানিপথের যুদ্ধের মতলব। পাখির মা সকালের সাইক্লোন পার করে উদয় হবে।মনে মনে রাগ বাড়তে থাকে ছুটা বুয়ার উপর।
খানিক বাদেই বয়সে বড়ো,সম্পর্কে ছোট বান্দা বিপুল বিক্রমে হাজির হবে।বুক কেন জানি ধড়ফড় করে। মানুষগুলা খালি আমার খুঁত খোঁজে। মাঝে মধ্যে নিন্দাসূচক পটকা ফুটাতেও কসুর করে না। বিন্দুমাত্র বিলম্ব করে না। পুরান ঢাকার স্যাঁতসেঁতে ভ্যাপসা গন্ধময় টিনশেড লম্বা বাড়ি। হাজার তিরিশ টাকার জমি, কোনকালের।জংলা জমি ছিল।সদাশিব মার্কা স্বামীধন হাবিবউল্লাহ মৃধা কোনো এক রাতে কী মনে করে এসব গল্প করেছিল।সাড়ে চার কাঠা জমি সেই কিনেছে। ভদ্রলোকটাকে বুঝে উঠতে পারিনি আজও। ভাবের পাগল,না সেয়ানা পাগল।না বুঝতে বুঝতে কেটে যায় দিন। মেস বাড়ির মতো বাড়িটা। এ ঘরে ও ঘরে আমার দুর্বার চলাচল। কেননা নুন থেকে চুন খসলে এই আমার চৌদ্দ গুষ্টির মাথায় ঘোল ঢেলে দেওয়া এ বাড়ির সদস্যদের ফরজ কাম। ভাজা ভাজা আধা পোড়া প্রায় রোজদিনের ধারাপাত।
সবচাইতে মোক্ষম ছ্যাঁকায় ওস্তাদ একজন। বয়সে বড়ো,সম্পর্কে ছোট। চোখ মুখের ভাঁজে বছর ভর চৈত্রের ফুটিফাটা খরা। কুতকুতে চোখ দিয়ে কুড়ে খায়,গিলে খায়।বত্রিশ দাঁতে চাবায়। মনে হয় চাপাতি দিয়ে কোপায়ও! সম্পর্কে ছোট,বয়সে বড়ো।আন্দামান ফেরত! সবে উনিশের আমি। বুক ধড়ফড় করে। শ্যামল আমার পলকা শরীর, সারাক্ষণ চাবুক মেরে মেরে সচল রাখি। রাত পোহালে বিছানায় উঠে বসি।নিজেকে ধমকাই, আদরও করি, নো নো নট আলস্য। পরিপাটি করে আচড়ে উঁচু করে একঢাল চুল বজ্র আঁটুনি দিয়ে বিকেলের নামে খোঁপা বাঁধি।কসম বৈকালের নামে। একদ- পিড়িটা পেতেও বসি না। মোড়া পেতে বা ইজিচেয়ারে আয়েশ করে বসি না একরকম ত্রাসে! রায়বাঘিনী তিনজন চোখ মটকে অবলীলায় বলে বসবে, ‘রিল্লাক্স মুডে রইছেন বাবিছাব। বহুত মজা।’
ব্লাউজ ভেসে যায় দুধের নহরে। আধ পেটা খেয়েও এমন সুধা জমে বুকে আমার আত্মজার জন্যে। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে আহ্লাদ করারও জো নাই।সময় মেলে না। ভোরের সূর্য গা মোচড় দিয়ে ওঠে। খানিকটা সময় অপচয় করি বটে। মিনিট দশেক ঘুমন্ত শিশুর দিকে তাকিয়ে থাকি।একধরনের বাতিক আমার। গা মোচড় দিয়ে উঠে খানিক জিরাই। বেআইনি ব্যাপার! তবে নিজেকে বেশি আস্কারা দেই না। মাথায় উঠে নাচতে পারে। ভেবে ভেবে বেকুব বনে যাই, কেমন করে গোপীবাগ আড়াই লেনের মেসবাড়ি মার্কা বাড়ি টার মূল চালিকাশক্তি হতে হলো। নিজের পিঠ নিজে চাপড়ে দেই। জয় হোক। হেরে যাবে না নিশি তুমি।
এই ঘিঞ্জি, চিটচিটে টিনশেডের বাড়িটার তিনটি খোপে সুখনিদ্রায় বেহুঁশ হয়ে থাকে অন্যান্য জনাদশেক সুখিজন। বেলা করে তারা উঠবে।জমিদার। রোজদিনের বারোমাস্যা গীত। তবে এ যাবত এইটা কঠিন সত্যি এই আমি আল্লাহর পেয়ারা বান্দা আমার জাগরণের হেরফের হবার নয়।ওই দশ বারো মিনিট আমি মহিমান্বিত আল্লাহ পাকের কাছে সাফ কবলা দলিল দস্তাবেজ লিখে নিয়েছি।
চৈত্র মাসে টিনশেডের আগুন গরম হল্কা। বান্দা হাজির। সবে রসুইঘরের পাট চুকিয়ে শিকল তুলেছি।বয়সে বড়ো ,বিবেচনায় বিষ। ‘এহ্ বাবি দেখছনি কিরহম গামাচি হইছে। গাইলা দেও।চিরবিরায় গো।’ শরীরে বোঁটকা গন্ধ ঘামের। উদাম বুক পিঠ। থাম্বা থাম্বা লোমশ হাত। পিত্তি জ্বলে যায়। ডাকাত, ভয়াবহ। আচমকা আজব বিনয়, ‘বাবি সোনা মানিক। এদিক আইস।ডরাও নাহি। বাগ না ভল্লুক আমি’ মাথার ভিতর হাজার ঝিঝিঁ। পিত্তি জ্বলে যায়। মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। আল্লাহ পাক দয়ার সাগর। ঠিক তখনই টুপুর চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। দৌড়ে পালিয়ে বাঁচি।
আর একদিন বৈশাখ মাসের ঝড়ো দুপুর। বান্দার জ্বর। ভাশুর,ননদেরা জারি করে গেল নসিহত। ভাশুর কিঞ্চিত নরম গলায় বলে গেলেন, ‘মনুর জ্বর। পাগলারে দেইখ। কী খাইবো খিয়াল খবর রাইখ পুটুর মা।’ আমার মেয়ের নাম টুপুর তারা ডাকে পুটু। দামড়া বান্দা কোঁকায়,ঘর দুয়ারে মাতম। মরার কোঁকানি গু-াটার। মুখে কেন যে গালাগাল আসে? ‘বাবি গো সারা গতরে বেদনা। কাছে আহ।’ থার্মোমিটার জিবের তলায় দিয়ে টেম্পারেচার দেখতে গেলাম। বান্দা বলে, ‘বগোলে দ্যাও।’ আচমকা কি হয় জানি! আমি অন্ধকারে থৈ পাই না। ময়াল সাপের ফোঁসফোঁসানি,নাগপাশ থেকে দরজায় হুমড়ি খেয়ে পড়ি। ঘটনা গিলে খেতে হয়। পাঁচ কান হলে আমিই আসামি। গিলে খাই সমগ্র অন্ধকার। সদাশিব ভাব ধরা স্বামীধনকে কিঞ্চিত বিবরণ দিতে গেলে তিনি নিতান্ত উদাস হয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।
এক বিকেলে হাসতে হাসতে আমাকে বুঝিয়েছিল, ‘দেওরা ভাবী রঙ তামাশার সম্পর্ক। সহজ হওন লাগব নিশি,বুঝলা। সগলরে ভালো রাখা তোমার কাম।বাড়ির বৌ তুমি। সোনা কিন্তুক পুড়ে পুড়ে খাঁটি হয়।’ ভদ্রলোক মহান, যাদুকর বটে। আমি নিশি ভিমরি খাই। দুই হাতে কাঁটা সরাই,ফুটবে ফুল ফুটবে- আমার গহিনে কিছু গরল,কিছু গলদ, কিছু কুহক জট পাকায়। জেদি হতে থাকি নিজের অজান্তে। এই আড়াই লেনের বাড়ির কেউ একজন বলেছিল,আমি গভীর জলের মাছ। এই মন্তব্যের জন্যে আমি নাখোশ হইনি,বরং জেগে উঠেছি। নেহায়েত ক্যাবলা গোবেচারা নই?
গেটের লাগোয়া এক মনোহর কৃষ্ণচূড়া গাছ। ঝিরিঝিরি তার পাতা। মৌসুমে সে রানির সাজে সজ্জিত হয়। আমার বন্ধু।কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি মনের আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠি। কয়েক মুহূর্ত পর্যন্ত সুখি হই।কী প্রগাঢ় রক্তলাল! চাচাশ্বশুর প্রায় মাসখানিক বাদে বাদেই এ বাড়িতে চলে আসেন। বুঝি সঠিক সেবাযতœ এখানে পান।মুরুব্বি আমার। সেবার ত্রুটি করিনা। এবার তিনি আমার জন্যে একটি কেতাব উপহার হিসেবে এনেছেন। তাঁর পঠিত বই। ‘মরণের আগে ও পরে।’ তিনি মাঝেমধ্যে ময়মুরুব্বিদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সেবাপরায়ণ হবার বিষয়ে ইসলামের অনুশাসনের কথা বলেন। স্নেহ করেন বলেই হয়তোবা সতর্ক করেন। যাহোক তাঁর পছন্দের খাবার তৈরি করতে আমি ছুটে যাই পাকঘরে। কেতাবি অনুশাসনের কথা মনে থাকে না। নিজস্ব ঘোরের আওতায় ঢুকে পড়ি। পাখির মা কলপাড়ে বাসন মাজে আর বকবক করে, ‘এত থালবাটি হান্ডি পাতিল মাজন সোজা কতা।’
তবু পাখির মা আছে বলে রক্ষা। কামাই কম দেয়। চটপটে। খানিকটা দরদ আছে আমার জন্যে। সময়মতো খাওয়া দাওয়া করি না বলে শাসন করে! মনে শীতল বাতাস বয়।আর কোনো মানুষজন এইটুকু দরদ তো দেখায় না। নিজেকে চিমটি কাটি, এতশত আউলা ভাবনায় সময় নষ্ট। তুমি শক্তসিধা থাক নিশি।শান্তি পাবে একটু। আহা আমার বন্ধু পাখির মা,আর কৃষ্ণচূড়া গাছটি।
বাবার বাড়িতে বুকশেলফের ভাঁজে ভাঁজে আমার বালিকা বয়সের অতুল আনন্দ জমা আছে। কত বই,প্রিয় অক্ষরে বোনা। রবীন্দ্রনাথ,বিভূতিভূষণ,শরৎ, রিজিয়া রহমান, আশাপূর্ণা। আমার ভালোবাসার অরূপরতন। কত কাল ফেলে এসেছি সবুজ পৃথিবী আমার। আমার ছোট্ট রূপসী দয়ালু বাগান। সব ছেড়ে শিকড়সমেত আমি স্বামীবাগ আড়াই লেনে- সিরাজগঞ্জে আমলা পাড়ায় ঝুলে রইল নিশির সকল সবুজবীথি,তারুণ্য। তবু নতুন লতাপাতায় ফুলেল হবার কোশেশ রইল।আমি হেরে গেলে বাবা যে কষ্ট পাবেন।ভয়াবহ স্ট্রোক কাটিয়ে তিনি ফিরে এসেছেন,মায়ার সংসারে। সে এমন সময়- তড়িঘড়ি ব্যাঙ্কার হাবিবউল্লাহ মৃধার হাতে আমাকে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন বাবা মা।
আমি অচেনা ভদ্রলোকটির মুখের দিকে চেয়েও দেখিনি, শুধু বাবার মলিন মুখের দিকে কড়া নজর রেখেছিলাম। বাবা কিছুটা স্বস্তি পেলেন কিনা সেটাই আসল বিষয়। বাবা মা দুজনের চোখ ভরা জল।একমাত্র সন্তান বিদায়ের চিরন্তন হাহাকার। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম,আমি মানিয়ে নেব। বাবা মা শিক্ষক, এলাকায় তাঁদের সুনাম, আদর্শ পরিবার। গৃহ নামের বাড়িটায় অঢেল প্রাচুর্য নেই,আছে শান্তি। এমনকি তিনবেলা সুষম খাদ্যাভ্যাস, পরিমিত। আমি বলি অমৃতের স্বাদ।
এত এত ঘোরগ্রস্ত যাপনের হালচাল, তথাপি আমি আচমকা বালিকা বয়সের অতুল মৌতাতে মাতাল হয়ে উঠি। দৈব আশীর্বাদ। বলদা গার্ডেন আমার ভ্রমণের অমরাবতী। ক্যামেলিয়া খুঁজি,সূর্যঘড়ি দেখি। আমাজান লিলির দেখা পাই। আমি তখন রানির সাজে হৃদয়কে সাজাই। পরাভূত আড়াই লেনের সকল কেচ্ছা। আচমকা আজব স্বামীধনকে কেমনে জানি লাইনে আনি। শুক্রবারের দুপুরের ভোজনে বেগুন রূপচান্দা শুটকির ভুনা খাইয়ে কিঞ্চিত খুশি করেছিলাম বৈকি। অভিসার সিনেমা হলে সানফ্লাওয়ার দেখলাম। জীবন সুন্দর। তবু ক্রন্দন! বুঝতে আর বাকি নেই,ক্রন্দন,বন্ধন, নন্দন জীবনের চক্র,চক্কর।
বিকেলে টেবিলে চা মুড়ি ভুনা, টোস্ট সাজিয়ে নন্দিনীদের জন্যে অপেক্ষায় আছি। ওরা চটি বাজিয়ে ওড়না উড়িয়ে এলো। রূপা চায়ে চুমুক দিতে দিতেই পাশের বাড়ির রুমানার ভাইয়ের শ্বশুরকুলের কাহিনি বয়ান শুরু করল, ‘মনি ভাইয়ের সোনার কপাল। নতুন বাবির বাপে দুনিয়ার খাট পালং, সেটে সেটে কাচের বসনকোসন দিয়া ঘরবাড়ি সাজাইয়া দিসে।আর কি কমু গো গয়নাগাটি ঝুমঝুমা। আমগর বাইজানের কপাল ঠনাঠনা।’ আমি চুপসে যাই। কিছুক্ষণ বাদে নিজেকে বুঝাই। অবিদ্যা!... আর একদিন ওই কমিনা বান্দা কাসুন্দি ঘাটে, নসু মোক্তারের মাইয়ার ঢকডিল বালাই আছিল। হেরা জমিন লিখা দিতে চাইছিল। দেওয়া থোওয়ার কমতি হইত না। নসু কাকার দিলডা বড়ো। বাইজানে কিয়েরে বুঝল না।আইজও বুঝতাম পারি না। পিত্তি জ্বলে যায়। টুপুরকে ঘুম পাড়াতে ঘরে যাই। মোবাইল টিপে লো ভলিউমে শুনি,আমার হলো শুরু, তোমার হলো সারা।মাঝে মধ্যে এরকম খোঁটা তারা রসিয়ে রসিয়ে দেয়। আফসোস আর আফসোস!
মিনিট বিশ বাদে মনে পড়ে এখন আমার ঝুল ঝাড়তে হবে।ভাশুর বারান্দায় পায়চারি করতে করতে বলেছিলেন, ‘বাড়ির ঝুলমুল ঝাড়নের মানুষ নাই।’ দিব্যি এই আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে তির ছোড়া, ক্ষেপণাস্ত্র।
নিশিত রাতে স্বামীধনের দানবীয় স্পর্শ অনুভব করি। সারাদিনের অকথ্য ক্লান্তি। ঘুম আঠার মতো দুচোখের পাতায়। ‘এমুন ঘুমে রাত কাবার করবা। লক্ষী পক্ষী বৌডা আমার। আমার নিদ্রা পলাইছে কিন্তুক নিশি বিবি।’ ঘুমের ঘোরে কেঁপে কেঁপে উঠি। দুঃস্বপ্নের মধ্যে আধা জাগা আমি।মনে হয় দুশমনরে মারি পেল্লায় লাথি।
শীত পড়েছে বেশ।টিনের চালে ভোররাতে শিশির ঝরে টুপটাপ। আমার দুইটা গাঁদা গাছে টেনিস বলের সাইজ হলুদ ফুল ফুটেছে। পাকঘরের জানালার ভাঙ্গা পাল্লার ফাঁক দিয়ে গাঁদাফুলে নজর আটকে যায়।ভাবতে চেষ্টা করি জীবন সুন্দর। লাইফ ইজ বিউটিফুল। রুটি সেঁকার সৌরভ থৈথৈ করে, লুকোচুরি খেলে বাতাসে। বুটের ডালে কিছু এলাচি দারচিনি ফেলে বসে আছি। জমিদার বাবুবিবিরা উদয় হবে।
দুপুরে মধ্যাহ্ন ভোজের কিঞ্চিত স্পেশাল আয়োজন। কই মাছ,নতুন ফুলকপি,নতুন আলু দিয়ে গাঢ় ঝোল। শিম কুমড়া বড়ির সাথে শোল মাছের সালুন। মাসকলাইয়র ফাকির সাথে কিছু রুইয়ের কাটা কুটার দোস্তি। বিসমিল্লাহ বলে রান্না চড়াই।মগ্ন হয়ে থাকি থিসিস সম্পাদনা করি। সুপারভাইজারদের মনঃপূত হবে কিনা সেই ত্রাসে।রাঁধুনিকে যে সামান্য সাধুবাদ জানাতে হয় সেই কালচার এ মেসবাড়িতে নেই বললেই চলে।
রোদভাসা দিন নয় আজ। পাকঘরে সন্ধ্যার আঁধার। লাইট সহসা জ্বালাই না।বিল উঠবে অহেতুক। কড়া নিষেধ। টিমটিমে আলোটা জ্বালাতেই হয়। রসুই ঘর, যেন হাবিয়া দোজখের ট্রু কপি। মাথার উপরে তক্তার উপরে তেলাপোকার রাম রাজত্ব।ভাসুর মুরুব্বি আচমকা দুয়ারে পা দিয়েই সুইচ অফ করে দেয়।ফরফর করে একটা তেলাপোকা উড়ে এসে কইমাছের তরকারির উপর পড়ে। হুড়মুড় করে লাইট জ্বালাই।ডাব্বু চামচ দিয়ে ঝোলসহ বজ্জাতটাকে উঠাই।পাখনাও ভেজে নাই। নতুন কালে একবার তাজা শিং মাছের মধ্যে একটা মরা মাছ ছিল।আমি যতœ করে রেঁধেছি। পাখির মা পরে বলেছিল একটা মাছ মৃত ছিল। তখন জটিল সংসারের অযোগ্য সরল সিধা ছিলাম। মনে হলো একটা মাছ মৃত ছিল বিষয়টি গোপনকরা গোনাহ। যাহা সত্য তাহাই বলিব।বিবেকের কাছে সফেদ থাকা লাগবে। মৃদুস্বরে বললাম, ‘ভাইজান,একটা মাছ মরা ছিল।জানতাম না। ভাসুর কড়মড় করে তাকালেন, ‘হেই কাহিনি কওনের কাম কি। বেকুব।’ শিং মাছের সালুন নিঃশেষ হয়ে গেল।
বিরাট বেকুব ছিলাম, কিঞ্চিত চালাক হচ্ছি নাকি? বাটি ভরা কই মাছ, নতুন আলুর ডুবসাঁতার। আমি ঘটনার অবতারণা করি না। হঠাৎ ওঠে ঝড়। ‘তেলাচোরা পড়ছিল শুনছি সালুনে। হেই কথা গোপনে রাখছ?’ ভাসুরের গর্জন। সাথে সাথে সভাসদগনের নানাবিধ বিষোদগার।মনে হলো গভীর ষড়যন্ত্রের ফিকির। কিছু সময় পাথরের হাল, দাঁড়িয়ে রইলাম। ঘরে গিয়ে টুপুরকে কোলে তুলে জড়িয়ে ধরলাম।দুচোখে ফোটা কান্নার জল।আমি সহজে চোখের পানি ফেলি না। টুপুর আধো আধো কথা শিখেছে। গলা জড়িয়ে শিশু আমার বলে, ‘তুমি কানতাছ মা?’
কয়দিন পর পরই একটা প্রসঙ্গে কথা কানে আসে।আমার বাবা কঞ্জুস। হাতের ফাঁক গলিয়ে পানি গড়ায় না।আমের মৌসুমে ঝুড়ি ভরা আম আসে না।ঈদে পার্বণে কোনো উপহার আসে না। কেমন বাপ গো। কবরে একপা সয় সম্পত্তির বিধি বন্দোবস্তের হুঁশ নাই। আমি কান দেই না। কিন্তু ভ্রুকুঞ্চনগুলো বিষ তীর হয়ে ওঠে বৈকি।
বাবাকে তলব পাঠানো হয়েছিল। বিকেলের কোচে বাবা এই প্রথম গোপীবাগ এলেন। অভ্যর্থনা আপ্যায়নের বালাই নেই। বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম। তিনি কাঁপছেন।
বয়সে বড়ো,সম্পর্কে ছোট বান্দা যেন জমা করা রাগে তা-বের অপেক্ষায়- ভাশুর জলদ গম্ভীরমুখে স্বরে আদ্যোপান্ত বলতে লাগলেন।কত বানোয়াট কটুবাক্য। বাবা চূড়ান্ত অপমানে বাকরুদ্ধ। একসময় প্রখ্যাত শিক্ষক আমার বাবা মোমিন মীর ভরাট গলায় উচ্চারণ করলেন, ‘বিরাট ভুল হয়ে গেছে মা নিশি।আমাকে মাফ করে দে।’
ফোসফাঁস করে বান্দা বলে, ‘কারুনের ধন কব্বরে লইয়া যাইয়েন তালই। মেলাদিন তো হইল, কোন আওয়াজ নাই।বার্তা নাই। মাইয়া একখান পার কইরা বাচচেন নি।’
বাবা অভুক্ত। একগ্লাস লেবুর শরবত, কয়েক টুকরা পেঁপে হাতে পাখির মাকে দেখি।ওর চোখ লাল। বাবা সহসা সোজা হয়ে দাঁড়ান। হাতব্যাগ থেকে টুপুরের জন্যে একটা চাবি দেওয়া লাল গাড়ি বের করে ওকে কোলে তুলে নেন। রায়বাঘিনীরা বিদ্রƒপের হাসি বিনিময়ে উচ্ছল। কয়েক মুহূর্ত কেটে যায়। বাবার মলিন মুখে অচেনা দীপ্তি। আমার হাত শক্ত করে ধরেন। আমি কেন জানি হোঁচট খাই। টুপুরকে জড়িয়ে ধরতে যাই। জলদস্যুর মতো বান্দা ছুটে আসে। কী অবাক,কৃষ্ণচূড়া গাছটা আমাকে ডাকে।পাখির মায়ের মলিন আঁচল জামদানি নকশায় ঝলমল করে।দূরে ওই ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। তার চোখে কি ভাবের দশা।না কি নতুন কোন স্বপ্নের ইশারা! বাবার রোগা কব্জিতে এত শক্তি। আমার হাতে বাবার শক্ত বন্ধন। টিনের চালের ফুটো ভেদ করে একফালি চিকন রোদ লুটিয়ে পড়ে বাবার পায়ের পাতায়।
দিলারা মেসবাহ
বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৫
আমার একবিন্দু দাম নেই সংসারে। কেউ আমাকে পোঁছে না।সংসারে যে ডিঙি রোজ বাইতে হয়, সেই তেলতেলা আবলুস লগিটা কিন্তু আমার খসখসা বদসুরত আঙুলের ভাঁজে।কারিশমা পুরাই হেফজ আমার। তারপরও কী বিষয়! খোপ খোপ ঘরের বান্দরগুলা,তওবা তওবা বান্দাগুলা তাদের সিডিউল মাফিক নিদ্রা মুক্ত হয়ে কপাট খোলে। চক্ষু- লাটিম বন বন।
জনান্তিকে বলে রাখি,আমার আঙুলগুলো নাকি চাঁপাফুলের কলি সদ্য বয়ঃসন্ধিতে বান্ধবীরা বলত।লজ্জা পেতাম। সে যাক। কসম এই সাতজন্মের বান্দীরেই তালাশ করে। ননদিনী পুরুষালী খরখরে গলায় সোনালি সকালে বলে, ‘কুন সুম থেইকা বিছরাইতাছি।আমার একডা জরুরি কাম পড়ছে। নাস্তা পানি কতদ্দুর?’ ‘দিতাছি তাওয়াও রুটি।চায়ের পানি ফুটতাছে মরিয়ম।’ আলগা মমতা মিশিয়ে জবাব পেশ করতে হয়। আজকাল এই রকম ভড়ং শিখতে হয়েছে। ধৈর্যের সুতাগাছায় মাঞ্জা মারি আর গীত গাই- যে সহে সে রহে।
একজন একজন করে বান্দাসকল জমিদারি দিকদারি শুরু করবে। সহি বাত। আর তিন ননদিনী রায়বাঘিনী সিনানে যাত্রা করবে,গজেন্দ্রগমনে।তারপর পায়চারি করবে, ভেজা চুল শুকাবে,আইবুড়ো বোনেরা গোপন প্রেমিকদের বিষয় আশয়ের আলাপও করে ফিসফিস। হেসে ঢলে পড়ে।আমি নিরন্তর আটার কাইয়ে দুসরা ময়ান ডলি। রসুইঘরে তাওয়ায় হাতরুটি ভরা পোয়াতি, আলু কুটি চিরল চিরল। রুটি সেঁকার অপূর্ব সুঘ্রাণ বাতাস মঁ মঁ। রাজার দুলালিরা ফেস পাউডার ঘষতে ঘষতে নির্ঘাত বলবে, ‘অহনো বুটের ডাইল চড়ান নাই? ক্লাসে আজ্জাও লেইট হইব।বুঝতাম পারসি গো।’ চিলতে পাকঘরে পানিপথের যুদ্ধের মতলব। পাখির মা সকালের সাইক্লোন পার করে উদয় হবে।মনে মনে রাগ বাড়তে থাকে ছুটা বুয়ার উপর।
খানিক বাদেই বয়সে বড়ো,সম্পর্কে ছোট বান্দা বিপুল বিক্রমে হাজির হবে।বুক কেন জানি ধড়ফড় করে। মানুষগুলা খালি আমার খুঁত খোঁজে। মাঝে মধ্যে নিন্দাসূচক পটকা ফুটাতেও কসুর করে না। বিন্দুমাত্র বিলম্ব করে না। পুরান ঢাকার স্যাঁতসেঁতে ভ্যাপসা গন্ধময় টিনশেড লম্বা বাড়ি। হাজার তিরিশ টাকার জমি, কোনকালের।জংলা জমি ছিল।সদাশিব মার্কা স্বামীধন হাবিবউল্লাহ মৃধা কোনো এক রাতে কী মনে করে এসব গল্প করেছিল।সাড়ে চার কাঠা জমি সেই কিনেছে। ভদ্রলোকটাকে বুঝে উঠতে পারিনি আজও। ভাবের পাগল,না সেয়ানা পাগল।না বুঝতে বুঝতে কেটে যায় দিন। মেস বাড়ির মতো বাড়িটা। এ ঘরে ও ঘরে আমার দুর্বার চলাচল। কেননা নুন থেকে চুন খসলে এই আমার চৌদ্দ গুষ্টির মাথায় ঘোল ঢেলে দেওয়া এ বাড়ির সদস্যদের ফরজ কাম। ভাজা ভাজা আধা পোড়া প্রায় রোজদিনের ধারাপাত।
সবচাইতে মোক্ষম ছ্যাঁকায় ওস্তাদ একজন। বয়সে বড়ো,সম্পর্কে ছোট। চোখ মুখের ভাঁজে বছর ভর চৈত্রের ফুটিফাটা খরা। কুতকুতে চোখ দিয়ে কুড়ে খায়,গিলে খায়।বত্রিশ দাঁতে চাবায়। মনে হয় চাপাতি দিয়ে কোপায়ও! সম্পর্কে ছোট,বয়সে বড়ো।আন্দামান ফেরত! সবে উনিশের আমি। বুক ধড়ফড় করে। শ্যামল আমার পলকা শরীর, সারাক্ষণ চাবুক মেরে মেরে সচল রাখি। রাত পোহালে বিছানায় উঠে বসি।নিজেকে ধমকাই, আদরও করি, নো নো নট আলস্য। পরিপাটি করে আচড়ে উঁচু করে একঢাল চুল বজ্র আঁটুনি দিয়ে বিকেলের নামে খোঁপা বাঁধি।কসম বৈকালের নামে। একদ- পিড়িটা পেতেও বসি না। মোড়া পেতে বা ইজিচেয়ারে আয়েশ করে বসি না একরকম ত্রাসে! রায়বাঘিনী তিনজন চোখ মটকে অবলীলায় বলে বসবে, ‘রিল্লাক্স মুডে রইছেন বাবিছাব। বহুত মজা।’
ব্লাউজ ভেসে যায় দুধের নহরে। আধ পেটা খেয়েও এমন সুধা জমে বুকে আমার আত্মজার জন্যে। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে আহ্লাদ করারও জো নাই।সময় মেলে না। ভোরের সূর্য গা মোচড় দিয়ে ওঠে। খানিকটা সময় অপচয় করি বটে। মিনিট দশেক ঘুমন্ত শিশুর দিকে তাকিয়ে থাকি।একধরনের বাতিক আমার। গা মোচড় দিয়ে উঠে খানিক জিরাই। বেআইনি ব্যাপার! তবে নিজেকে বেশি আস্কারা দেই না। মাথায় উঠে নাচতে পারে। ভেবে ভেবে বেকুব বনে যাই, কেমন করে গোপীবাগ আড়াই লেনের মেসবাড়ি মার্কা বাড়ি টার মূল চালিকাশক্তি হতে হলো। নিজের পিঠ নিজে চাপড়ে দেই। জয় হোক। হেরে যাবে না নিশি তুমি।
এই ঘিঞ্জি, চিটচিটে টিনশেডের বাড়িটার তিনটি খোপে সুখনিদ্রায় বেহুঁশ হয়ে থাকে অন্যান্য জনাদশেক সুখিজন। বেলা করে তারা উঠবে।জমিদার। রোজদিনের বারোমাস্যা গীত। তবে এ যাবত এইটা কঠিন সত্যি এই আমি আল্লাহর পেয়ারা বান্দা আমার জাগরণের হেরফের হবার নয়।ওই দশ বারো মিনিট আমি মহিমান্বিত আল্লাহ পাকের কাছে সাফ কবলা দলিল দস্তাবেজ লিখে নিয়েছি।
চৈত্র মাসে টিনশেডের আগুন গরম হল্কা। বান্দা হাজির। সবে রসুইঘরের পাট চুকিয়ে শিকল তুলেছি।বয়সে বড়ো ,বিবেচনায় বিষ। ‘এহ্ বাবি দেখছনি কিরহম গামাচি হইছে। গাইলা দেও।চিরবিরায় গো।’ শরীরে বোঁটকা গন্ধ ঘামের। উদাম বুক পিঠ। থাম্বা থাম্বা লোমশ হাত। পিত্তি জ্বলে যায়। ডাকাত, ভয়াবহ। আচমকা আজব বিনয়, ‘বাবি সোনা মানিক। এদিক আইস।ডরাও নাহি। বাগ না ভল্লুক আমি’ মাথার ভিতর হাজার ঝিঝিঁ। পিত্তি জ্বলে যায়। মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। আল্লাহ পাক দয়ার সাগর। ঠিক তখনই টুপুর চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। দৌড়ে পালিয়ে বাঁচি।
আর একদিন বৈশাখ মাসের ঝড়ো দুপুর। বান্দার জ্বর। ভাশুর,ননদেরা জারি করে গেল নসিহত। ভাশুর কিঞ্চিত নরম গলায় বলে গেলেন, ‘মনুর জ্বর। পাগলারে দেইখ। কী খাইবো খিয়াল খবর রাইখ পুটুর মা।’ আমার মেয়ের নাম টুপুর তারা ডাকে পুটু। দামড়া বান্দা কোঁকায়,ঘর দুয়ারে মাতম। মরার কোঁকানি গু-াটার। মুখে কেন যে গালাগাল আসে? ‘বাবি গো সারা গতরে বেদনা। কাছে আহ।’ থার্মোমিটার জিবের তলায় দিয়ে টেম্পারেচার দেখতে গেলাম। বান্দা বলে, ‘বগোলে দ্যাও।’ আচমকা কি হয় জানি! আমি অন্ধকারে থৈ পাই না। ময়াল সাপের ফোঁসফোঁসানি,নাগপাশ থেকে দরজায় হুমড়ি খেয়ে পড়ি। ঘটনা গিলে খেতে হয়। পাঁচ কান হলে আমিই আসামি। গিলে খাই সমগ্র অন্ধকার। সদাশিব ভাব ধরা স্বামীধনকে কিঞ্চিত বিবরণ দিতে গেলে তিনি নিতান্ত উদাস হয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।
এক বিকেলে হাসতে হাসতে আমাকে বুঝিয়েছিল, ‘দেওরা ভাবী রঙ তামাশার সম্পর্ক। সহজ হওন লাগব নিশি,বুঝলা। সগলরে ভালো রাখা তোমার কাম।বাড়ির বৌ তুমি। সোনা কিন্তুক পুড়ে পুড়ে খাঁটি হয়।’ ভদ্রলোক মহান, যাদুকর বটে। আমি নিশি ভিমরি খাই। দুই হাতে কাঁটা সরাই,ফুটবে ফুল ফুটবে- আমার গহিনে কিছু গরল,কিছু গলদ, কিছু কুহক জট পাকায়। জেদি হতে থাকি নিজের অজান্তে। এই আড়াই লেনের বাড়ির কেউ একজন বলেছিল,আমি গভীর জলের মাছ। এই মন্তব্যের জন্যে আমি নাখোশ হইনি,বরং জেগে উঠেছি। নেহায়েত ক্যাবলা গোবেচারা নই?
গেটের লাগোয়া এক মনোহর কৃষ্ণচূড়া গাছ। ঝিরিঝিরি তার পাতা। মৌসুমে সে রানির সাজে সজ্জিত হয়। আমার বন্ধু।কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি মনের আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠি। কয়েক মুহূর্ত পর্যন্ত সুখি হই।কী প্রগাঢ় রক্তলাল! চাচাশ্বশুর প্রায় মাসখানিক বাদে বাদেই এ বাড়িতে চলে আসেন। বুঝি সঠিক সেবাযতœ এখানে পান।মুরুব্বি আমার। সেবার ত্রুটি করিনা। এবার তিনি আমার জন্যে একটি কেতাব উপহার হিসেবে এনেছেন। তাঁর পঠিত বই। ‘মরণের আগে ও পরে।’ তিনি মাঝেমধ্যে ময়মুরুব্বিদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সেবাপরায়ণ হবার বিষয়ে ইসলামের অনুশাসনের কথা বলেন। স্নেহ করেন বলেই হয়তোবা সতর্ক করেন। যাহোক তাঁর পছন্দের খাবার তৈরি করতে আমি ছুটে যাই পাকঘরে। কেতাবি অনুশাসনের কথা মনে থাকে না। নিজস্ব ঘোরের আওতায় ঢুকে পড়ি। পাখির মা কলপাড়ে বাসন মাজে আর বকবক করে, ‘এত থালবাটি হান্ডি পাতিল মাজন সোজা কতা।’
তবু পাখির মা আছে বলে রক্ষা। কামাই কম দেয়। চটপটে। খানিকটা দরদ আছে আমার জন্যে। সময়মতো খাওয়া দাওয়া করি না বলে শাসন করে! মনে শীতল বাতাস বয়।আর কোনো মানুষজন এইটুকু দরদ তো দেখায় না। নিজেকে চিমটি কাটি, এতশত আউলা ভাবনায় সময় নষ্ট। তুমি শক্তসিধা থাক নিশি।শান্তি পাবে একটু। আহা আমার বন্ধু পাখির মা,আর কৃষ্ণচূড়া গাছটি।
বাবার বাড়িতে বুকশেলফের ভাঁজে ভাঁজে আমার বালিকা বয়সের অতুল আনন্দ জমা আছে। কত বই,প্রিয় অক্ষরে বোনা। রবীন্দ্রনাথ,বিভূতিভূষণ,শরৎ, রিজিয়া রহমান, আশাপূর্ণা। আমার ভালোবাসার অরূপরতন। কত কাল ফেলে এসেছি সবুজ পৃথিবী আমার। আমার ছোট্ট রূপসী দয়ালু বাগান। সব ছেড়ে শিকড়সমেত আমি স্বামীবাগ আড়াই লেনে- সিরাজগঞ্জে আমলা পাড়ায় ঝুলে রইল নিশির সকল সবুজবীথি,তারুণ্য। তবু নতুন লতাপাতায় ফুলেল হবার কোশেশ রইল।আমি হেরে গেলে বাবা যে কষ্ট পাবেন।ভয়াবহ স্ট্রোক কাটিয়ে তিনি ফিরে এসেছেন,মায়ার সংসারে। সে এমন সময়- তড়িঘড়ি ব্যাঙ্কার হাবিবউল্লাহ মৃধার হাতে আমাকে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন বাবা মা।
আমি অচেনা ভদ্রলোকটির মুখের দিকে চেয়েও দেখিনি, শুধু বাবার মলিন মুখের দিকে কড়া নজর রেখেছিলাম। বাবা কিছুটা স্বস্তি পেলেন কিনা সেটাই আসল বিষয়। বাবা মা দুজনের চোখ ভরা জল।একমাত্র সন্তান বিদায়ের চিরন্তন হাহাকার। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম,আমি মানিয়ে নেব। বাবা মা শিক্ষক, এলাকায় তাঁদের সুনাম, আদর্শ পরিবার। গৃহ নামের বাড়িটায় অঢেল প্রাচুর্য নেই,আছে শান্তি। এমনকি তিনবেলা সুষম খাদ্যাভ্যাস, পরিমিত। আমি বলি অমৃতের স্বাদ।
এত এত ঘোরগ্রস্ত যাপনের হালচাল, তথাপি আমি আচমকা বালিকা বয়সের অতুল মৌতাতে মাতাল হয়ে উঠি। দৈব আশীর্বাদ। বলদা গার্ডেন আমার ভ্রমণের অমরাবতী। ক্যামেলিয়া খুঁজি,সূর্যঘড়ি দেখি। আমাজান লিলির দেখা পাই। আমি তখন রানির সাজে হৃদয়কে সাজাই। পরাভূত আড়াই লেনের সকল কেচ্ছা। আচমকা আজব স্বামীধনকে কেমনে জানি লাইনে আনি। শুক্রবারের দুপুরের ভোজনে বেগুন রূপচান্দা শুটকির ভুনা খাইয়ে কিঞ্চিত খুশি করেছিলাম বৈকি। অভিসার সিনেমা হলে সানফ্লাওয়ার দেখলাম। জীবন সুন্দর। তবু ক্রন্দন! বুঝতে আর বাকি নেই,ক্রন্দন,বন্ধন, নন্দন জীবনের চক্র,চক্কর।
বিকেলে টেবিলে চা মুড়ি ভুনা, টোস্ট সাজিয়ে নন্দিনীদের জন্যে অপেক্ষায় আছি। ওরা চটি বাজিয়ে ওড়না উড়িয়ে এলো। রূপা চায়ে চুমুক দিতে দিতেই পাশের বাড়ির রুমানার ভাইয়ের শ্বশুরকুলের কাহিনি বয়ান শুরু করল, ‘মনি ভাইয়ের সোনার কপাল। নতুন বাবির বাপে দুনিয়ার খাট পালং, সেটে সেটে কাচের বসনকোসন দিয়া ঘরবাড়ি সাজাইয়া দিসে।আর কি কমু গো গয়নাগাটি ঝুমঝুমা। আমগর বাইজানের কপাল ঠনাঠনা।’ আমি চুপসে যাই। কিছুক্ষণ বাদে নিজেকে বুঝাই। অবিদ্যা!... আর একদিন ওই কমিনা বান্দা কাসুন্দি ঘাটে, নসু মোক্তারের মাইয়ার ঢকডিল বালাই আছিল। হেরা জমিন লিখা দিতে চাইছিল। দেওয়া থোওয়ার কমতি হইত না। নসু কাকার দিলডা বড়ো। বাইজানে কিয়েরে বুঝল না।আইজও বুঝতাম পারি না। পিত্তি জ্বলে যায়। টুপুরকে ঘুম পাড়াতে ঘরে যাই। মোবাইল টিপে লো ভলিউমে শুনি,আমার হলো শুরু, তোমার হলো সারা।মাঝে মধ্যে এরকম খোঁটা তারা রসিয়ে রসিয়ে দেয়। আফসোস আর আফসোস!
মিনিট বিশ বাদে মনে পড়ে এখন আমার ঝুল ঝাড়তে হবে।ভাশুর বারান্দায় পায়চারি করতে করতে বলেছিলেন, ‘বাড়ির ঝুলমুল ঝাড়নের মানুষ নাই।’ দিব্যি এই আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে তির ছোড়া, ক্ষেপণাস্ত্র।
নিশিত রাতে স্বামীধনের দানবীয় স্পর্শ অনুভব করি। সারাদিনের অকথ্য ক্লান্তি। ঘুম আঠার মতো দুচোখের পাতায়। ‘এমুন ঘুমে রাত কাবার করবা। লক্ষী পক্ষী বৌডা আমার। আমার নিদ্রা পলাইছে কিন্তুক নিশি বিবি।’ ঘুমের ঘোরে কেঁপে কেঁপে উঠি। দুঃস্বপ্নের মধ্যে আধা জাগা আমি।মনে হয় দুশমনরে মারি পেল্লায় লাথি।
শীত পড়েছে বেশ।টিনের চালে ভোররাতে শিশির ঝরে টুপটাপ। আমার দুইটা গাঁদা গাছে টেনিস বলের সাইজ হলুদ ফুল ফুটেছে। পাকঘরের জানালার ভাঙ্গা পাল্লার ফাঁক দিয়ে গাঁদাফুলে নজর আটকে যায়।ভাবতে চেষ্টা করি জীবন সুন্দর। লাইফ ইজ বিউটিফুল। রুটি সেঁকার সৌরভ থৈথৈ করে, লুকোচুরি খেলে বাতাসে। বুটের ডালে কিছু এলাচি দারচিনি ফেলে বসে আছি। জমিদার বাবুবিবিরা উদয় হবে।
দুপুরে মধ্যাহ্ন ভোজের কিঞ্চিত স্পেশাল আয়োজন। কই মাছ,নতুন ফুলকপি,নতুন আলু দিয়ে গাঢ় ঝোল। শিম কুমড়া বড়ির সাথে শোল মাছের সালুন। মাসকলাইয়র ফাকির সাথে কিছু রুইয়ের কাটা কুটার দোস্তি। বিসমিল্লাহ বলে রান্না চড়াই।মগ্ন হয়ে থাকি থিসিস সম্পাদনা করি। সুপারভাইজারদের মনঃপূত হবে কিনা সেই ত্রাসে।রাঁধুনিকে যে সামান্য সাধুবাদ জানাতে হয় সেই কালচার এ মেসবাড়িতে নেই বললেই চলে।
রোদভাসা দিন নয় আজ। পাকঘরে সন্ধ্যার আঁধার। লাইট সহসা জ্বালাই না।বিল উঠবে অহেতুক। কড়া নিষেধ। টিমটিমে আলোটা জ্বালাতেই হয়। রসুই ঘর, যেন হাবিয়া দোজখের ট্রু কপি। মাথার উপরে তক্তার উপরে তেলাপোকার রাম রাজত্ব।ভাসুর মুরুব্বি আচমকা দুয়ারে পা দিয়েই সুইচ অফ করে দেয়।ফরফর করে একটা তেলাপোকা উড়ে এসে কইমাছের তরকারির উপর পড়ে। হুড়মুড় করে লাইট জ্বালাই।ডাব্বু চামচ দিয়ে ঝোলসহ বজ্জাতটাকে উঠাই।পাখনাও ভেজে নাই। নতুন কালে একবার তাজা শিং মাছের মধ্যে একটা মরা মাছ ছিল।আমি যতœ করে রেঁধেছি। পাখির মা পরে বলেছিল একটা মাছ মৃত ছিল। তখন জটিল সংসারের অযোগ্য সরল সিধা ছিলাম। মনে হলো একটা মাছ মৃত ছিল বিষয়টি গোপনকরা গোনাহ। যাহা সত্য তাহাই বলিব।বিবেকের কাছে সফেদ থাকা লাগবে। মৃদুস্বরে বললাম, ‘ভাইজান,একটা মাছ মরা ছিল।জানতাম না। ভাসুর কড়মড় করে তাকালেন, ‘হেই কাহিনি কওনের কাম কি। বেকুব।’ শিং মাছের সালুন নিঃশেষ হয়ে গেল।
বিরাট বেকুব ছিলাম, কিঞ্চিত চালাক হচ্ছি নাকি? বাটি ভরা কই মাছ, নতুন আলুর ডুবসাঁতার। আমি ঘটনার অবতারণা করি না। হঠাৎ ওঠে ঝড়। ‘তেলাচোরা পড়ছিল শুনছি সালুনে। হেই কথা গোপনে রাখছ?’ ভাসুরের গর্জন। সাথে সাথে সভাসদগনের নানাবিধ বিষোদগার।মনে হলো গভীর ষড়যন্ত্রের ফিকির। কিছু সময় পাথরের হাল, দাঁড়িয়ে রইলাম। ঘরে গিয়ে টুপুরকে কোলে তুলে জড়িয়ে ধরলাম।দুচোখে ফোটা কান্নার জল।আমি সহজে চোখের পানি ফেলি না। টুপুর আধো আধো কথা শিখেছে। গলা জড়িয়ে শিশু আমার বলে, ‘তুমি কানতাছ মা?’
কয়দিন পর পরই একটা প্রসঙ্গে কথা কানে আসে।আমার বাবা কঞ্জুস। হাতের ফাঁক গলিয়ে পানি গড়ায় না।আমের মৌসুমে ঝুড়ি ভরা আম আসে না।ঈদে পার্বণে কোনো উপহার আসে না। কেমন বাপ গো। কবরে একপা সয় সম্পত্তির বিধি বন্দোবস্তের হুঁশ নাই। আমি কান দেই না। কিন্তু ভ্রুকুঞ্চনগুলো বিষ তীর হয়ে ওঠে বৈকি।
বাবাকে তলব পাঠানো হয়েছিল। বিকেলের কোচে বাবা এই প্রথম গোপীবাগ এলেন। অভ্যর্থনা আপ্যায়নের বালাই নেই। বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম। তিনি কাঁপছেন।
বয়সে বড়ো,সম্পর্কে ছোট বান্দা যেন জমা করা রাগে তা-বের অপেক্ষায়- ভাশুর জলদ গম্ভীরমুখে স্বরে আদ্যোপান্ত বলতে লাগলেন।কত বানোয়াট কটুবাক্য। বাবা চূড়ান্ত অপমানে বাকরুদ্ধ। একসময় প্রখ্যাত শিক্ষক আমার বাবা মোমিন মীর ভরাট গলায় উচ্চারণ করলেন, ‘বিরাট ভুল হয়ে গেছে মা নিশি।আমাকে মাফ করে দে।’
ফোসফাঁস করে বান্দা বলে, ‘কারুনের ধন কব্বরে লইয়া যাইয়েন তালই। মেলাদিন তো হইল, কোন আওয়াজ নাই।বার্তা নাই। মাইয়া একখান পার কইরা বাচচেন নি।’
বাবা অভুক্ত। একগ্লাস লেবুর শরবত, কয়েক টুকরা পেঁপে হাতে পাখির মাকে দেখি।ওর চোখ লাল। বাবা সহসা সোজা হয়ে দাঁড়ান। হাতব্যাগ থেকে টুপুরের জন্যে একটা চাবি দেওয়া লাল গাড়ি বের করে ওকে কোলে তুলে নেন। রায়বাঘিনীরা বিদ্রƒপের হাসি বিনিময়ে উচ্ছল। কয়েক মুহূর্ত কেটে যায়। বাবার মলিন মুখে অচেনা দীপ্তি। আমার হাত শক্ত করে ধরেন। আমি কেন জানি হোঁচট খাই। টুপুরকে জড়িয়ে ধরতে যাই। জলদস্যুর মতো বান্দা ছুটে আসে। কী অবাক,কৃষ্ণচূড়া গাছটা আমাকে ডাকে।পাখির মায়ের মলিন আঁচল জামদানি নকশায় ঝলমল করে।দূরে ওই ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। তার চোখে কি ভাবের দশা।না কি নতুন কোন স্বপ্নের ইশারা! বাবার রোগা কব্জিতে এত শক্তি। আমার হাতে বাবার শক্ত বন্ধন। টিনের চালের ফুটো ভেদ করে একফালি চিকন রোদ লুটিয়ে পড়ে বাবার পায়ের পাতায়।