রাবেয়া খানম
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বাঙালি জাতিসত্তায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তার বহুধা বিস্তৃত প্রতিভায়। বিশ্ব সাহিত্যের আসরে বাংলা সাহিত্য কে প্রতিষ্ঠিত করেছেন আপন প্রতিভগুনে। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যা তাঁর হাতে স্পর্শিত হয়নি। আজও তিনি চর্চিত হচ্ছে নানাভাবে। তেমনি আজও রহস্যাবৃত কবির পূর্বপুরুষের পরিচয়। এখনো আমরা অনেকেই জানিনা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ব পুরুষের শেকড় এই বাংলার মাটিতেই প্রথিত। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ কুশারী বংশধরেরা আজও বসবাস করছেন খুলনার জেলার রূপসা উপজেলার পিঠাভোগ গ্রামে।
রবীন্দ্রনাথের পদবী আমরা জানি ঠাকুর হিসেবে। কিন্তু তাঁর পূর্বপুরুষের পদবী ছিল কুশারী। কুশারী বংশধারার একটি শাখা পরবর্তীকালে লোকমুখে ঠাকুর অভিধা পায়। কুশারীরা ছিলেন ব্রাহ্মণ। কুশারী ব্রাহ্মণরা খুলনা জেলার রূপসা উপজেলার ভৈরব তীরবর্তী পিঠাভোগ গ্রামে বাস করতেন। পিঠাভোগের কুশারী ব্রাহ্মণরা ঘটনাক্রমে পতিত অর্থাৎ সমাজচুত্য হয়েছিলেন পীরালি ব্রাহ্মণে। এই পীরালি ব্রাহ্মণই পরবর্তীকালে কলকাতা এসে ঠাকুর হিসেবে পরিচিতি পান।
কুশারী বংশের ইতিহাস বেশ বিস্তৃত। ইতিহাস অনুসারে খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে আদি শূরের রাজত্বকালে বঙ্গদেশ ছিল বৌদ্ধ ধর্ম প্রভাবাচ্ছন্ন। তাই বঙ্গদেশে হিন্দু ধর্মের পুনরুদ্ধার প্রচার ও প্রসারের জন্য কানোকুব্জ থেকে পাঁচজন ব্রাহ্মণ বঙ্গদেশে আসেন। এই পাঁচ সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ হলেন-
শান্ডিল্য গোত্রীয় ক্ষিতীশ, বাৎশ্যগোত্রীয় সুধানিধি, সাবর্ণগোত্রীয় সৌভরি, ভরদ্বাজগোত্রীয় মেধাতিথি, কাশ্যপগোত্রীয় বীতরাগ।
শান্ডিল্য গোত্রীয় ক্ষিতীশ-এর বংশানুক্রম থেকে উদ্ভব হয় কুশারী বংশের। কাশ্যপ গোত্রীয় বীতরাগ এর বংশানুক্রমের একটি শাখা থেকে উদ্ভব হয় পীরালি ব্রাহ্মণ ধারার।
শান্ডিল্য গোত্রের বংশজাত ভট্ট নারায়ণ। জানা যায় ভট্টনারায়ণের পুত্র দ্বীন নাথ মহারাজা ক্ষিতীশূরের কাছ থেকে বর্ধমান জেলার কুশ নামক গ্রামে বসবাস করার দান স্বত্ব অধিকার পান। এতে করে ভট্টনারায়ণ কুশারী গোত্রভুক্ত হন (বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ব্রাহ্মণ কা-, পৃষ্ঠা ১২১)।
খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকে কুশারী গোত্রের লোকেরা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। যেমন- ঢাকা, বাঁকুড়া ও খুলনার পিঠাভোগ গ্রামে। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষরা খুলনার পিঠা ভোগের কুশারী। দ্বীননাথ কুশারীর অষ্টম পুরুষ তারানাথ কুশারী। তিনি খুলনা জেলার রূপসা উপজেলার ভৈরব তীরবর্তী পিঠাভোগ গ্রামে বসবাস শুরু করেন। সেখান থেকে রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষের উপাধি কুশারী হয় (রবীন্দ্র জীবনী, প্রথম খ-, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়)।
তারানাথ কুশারীর দুই ছেলে। রাম গোপাল ও রামনাথ। রাম গোপালের পুত্র জগন্নাথ কুশারী। এই জগন্নাথ কুশারী থেকেই কুশারী বংশের ধারাটি ভিন্ন প্রবাহে বইতে থাকে এবং ঠাকুর পদবীর সূচনা ঘটে। কীভাবে? তা জানতে আমাদের ঘুরে আসতে হবে খুলনার দক্ষিণডিহি গ্রাম থেকে। পূর্বেই বলেছি বঙ্গে আসা পঞ্চ ব্রাহ্মণের একজন কাশ্যপ গোত্রীয় বীতরাগ। তাঁর ছেলে দক্ষের বংশানুক্রমের একটি ধারা আমরা পাই খুলনার দক্ষিণডিহিতে। তাঁরা রায়চৌধুরী উপাধি পেয়েছিলেন। তাদের একজন রাজা দক্ষিণানাথ রায় চৌধুরী। দক্ষিণানাথ রায় চৌধুরীর চার ছেলে। কামদেব, জয়দেব, রতিদেব ও শুকদেব। তখন খানজাহান আলী বঙ্গে আসেন (পঞ্চদশ শতকের দিকে)। তিনি খুলনার দক্ষিণডিহির পয়োগ্রাম অধিকার করে সেখানে একটি শহর প্রতিষ্ঠা করেন। তবে তিনি নিজে সেখানে বেশি দিন থাকেননি। তাঁর উজীর মোঃ তাহেরকে পয়োগ্রামের দায়িত্ব দিয়ে তিনি বাগেরহাটের দিকে চলে যান। এ তাহের সম্পর্কে যতদূর জানা যায়, “এই ব্যক্তি পূর্বে ব্রাহ্মণ ছিলেন। এক মুসলমানির প্রেমে পড়িয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ইহার নিবাস ছিল নবদ্বীপের নিকটস্থ পিরলিয়া বা পিরল্যা গ্রাম। ইসলাম ধর্মে গোঁড়ামি দেখিয়া অথবা পিরলিয়া গ্রামে বাস থাকায় লোকে তাহাকে পিরল্যা খাঁ বলিয়া ডাকিত (রবীন্দ্র জীবনী, প্রথম খ-, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় )।
কামদেব জয়দেব রায়চৌধুরী তাহেরের অধীনে চাকরি করতেন। একদিন রোজার সময় তাহের আনমনে একটি লেবুর গন্ধ শুকছিলেন তখন কামদেব রায় চৌধুরী বলেন, “আমাদের শাস্ত্র অনুসারে ঘ্রাণে অর্ধেক ভোজন হয় সুতরাং রোজা নষ্ট হলো।” তাহের মুসলমান হলেও ব্রাহ্মণ সন্তান। কামদেবের বিদ্রƒপ সহজেই বুঝতে পারেন। তাই প্রতিশোধের জন্য একদিন তাহের প্রধান হিন্দু মুসলমান প্রজাদের দরবারে আহ্বান করেন। পাশেই রান্না হচ্ছিল গরুর মাংস। দরবার মাংসের গন্ধে ভরপুর। গরুর মাংসের গন্ধ বুঝতে পেরে কামদেব ও জয়দেব নাকে কাপড় দিয়ে বসেন। তখন পীরালি মোহাম্মদ তাহের তাদের নাকে কাপড় দেয়ার কারণ জানতে চাইলে, তাঁরা জানান নাকে মাংসের গন্ধ আসছে। তাহের বল্লো, ঘ্রাণে যখন অর্ধেক ভোজন হয় তখন নিশ্চয়ই গোমাংসের ঘ্রাণে তোমাদের জাত গেছে। তাদের জোর করে মাংস খাওয়ানো হয়। ফলে কামদেব ও জয়দেব ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হন। তাদের বলা হতো পীরালি মুসলমান। কামদেব ও জয়দেবই প্রথম পীরালি মুসলমান। সে সময় যারা ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হতেন তাদের বলা হত পীরালি মুসলমান। আবার রক্ষণশীল হিন্দু কুলাচার্যরা মুসলমান সংস্পর্শের কারণে বা নানা তুচ্ছ কারণে ব্রাহ্মণদের সমাজ চ্যুত করতেন। তাদের বলা হতো পীরালি ব্রাহ্মণ। তেমনি কামদেব জয়দেবের অপর দুই ভাই রতিদেব ও সুখদেব রায় চৌধুরী ভাইদের দোষের কারণে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের রোষানলে পড়ে ব্রাহ্মণ সমাজ চ্যুত হন। তাদের বলা হতো পীরালি ব্রাহ্মণ। সমাজে পীরালি ব্রাহ্মণদের মান মর্যাদা ছিল খুবই করুণ। পীরালি ব্রাহ্মণ হওয়ার কারণে রতিদেব ও শুকদেব কে সমাজে নানা উৎপীড়নের শিকার হতে হয়। কোন উঁচু শ্রেণির ব্রাহ্মণ পীরালি ব্রাহ্মণের ঘরে কোনো মেয়ে বিয়ে দিতেন না বা বিয়ে করতেন না। সমাজে তাদের হেনস্তার অন্ত ছিল না।
রতিদেব মনের দুঃখে গ্রাম ছেড়ে চলে যান। শুকদেবকে তার বোন ও মেয়ের বিয়ে নিয়ে বেশ বিপাকে পড়তে হয়। অনেক চেষ্টা ও অর্থ ব্যয় করে তিনি বোনের বিয়ে দেন। এখন মেয়ের বিয়ে দেন কী রূপে? কদিন পর তারও সমাধান হয়। হঠাৎ একদিন প্রচ- ঝড় বৃষ্টির রাতে এক জমিদার নিরুপায় হয়ে শুকদেবের বাড়ি আশ্রয় নেন। তিনি আর কেউ নন, খুলনার পিঠাভোগ গ্রামের জমিদার জগন্নাথ কুশারী। এই জগন্নাথ কুশারীর সাথে শুকদেব তার মেয়ের বিয়ে দেন। কি কারণে জগন্নাথ কুশারী তাৎক্ষণিক এ বিয়ে করেছিলেন তা স্পষ্ট জানা যায় না। পীরালি ব্রাহ্মণের ঘরে বিয়ে করার অপরাধে জগন্নাথ কুশারীকে তার আত্মীয়-স্বজন বৈবাহিক দোষে দুষ্টু অভিধায় সমাজচ্যুত করেন। ফলে জগন্নাথ কুশারী ব্রাহ্মণ থেকে পীরালি ব্রাহ্মণে অন্তর্ভুক্ত হন। তাই রবীন্দ্রনাথ নিজেকে বলেছিলেন ব্রাত্য অর্থাৎ পতিত এই পতিত বংশের দায় রবীন্দ্রনাথকে বহন করতে হয়েছে। সমাজচুত্য হয়ে জগন্নাথ কুশারী পিঠাভোগ ত্যাগ করে খুলনার দক্ষিণডিহিতে বারোপাড়ার নরেন্দ্রপুর গ্রামে বসবাস শুরু করেন। এই জগন্নাথ কুশারীই ঠাকুর পরিবারের আদি পুরুষ (রবীন্দ্র জীবনী, প্রথম খ-, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়)।
জগন্নাথ কুশারীর পাঁচপুত্রের মধ্যে পুরুষোত্তম কুশারী থেকে ঠাকুর বংশের ধারা প্রবাহিত। পুরুষোত্তম কুশারীর তার পৈত্রিক বসতভিটা পিঠাভোগের সাথে একটি যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। কেননা জগন্নাথ কুশারীর জমিদারিও তার সম্পদ সব হস্তান্তর না হলেও কিছু অংশ পুরুষোত্তম কুশারী তার আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বন্টন করে দেন (ওয়েস্ট ল্যান্ড রিপোর্ট ১৮৭১ পৃষ্ঠা ১৮)। পুরুষোত্তম কুশারীর পরবর্তী বংশধর পঞ্চানন কুশারী। পঞ্চানন কুশারী পিঠাভোগ ও নরেন্দ্রপুর এর জ্ঞাতিদের সাথে বিরোধ বা এমনি কারণে পিঠাভোগ ও নরেন্দ্রপুরের সমস্ত স্থাবর সম্পত্তি ভাইকে হস্তান্তর করে কলকাতা পাড়ি জমান। পঞ্চানন কুশারী নরেন্দ্রপুর নাকি পিঠাভোগ থেকে কলকাতা চলে যান তা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। তবে ডঃ সতীশ চন্দ্র মিত্র তার যশোর খুলনার ইতিহাস, প্রথম খ-, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ এর পাদটিকায় উল্লেখ করেন- “কথিত আছে ঠাকুর বংশের এক পূর্বপুরুষ পঞ্চানন কুশারী খুলনা জেলার পিঠাভোগ গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া কালীঘাটের সন্নিকটে গোবিন্দপুর আসিয়া বাস করেন। সে সময় গোবিন্দপুরে জেলে, মালো, কৈবর্ত প্রভৃতি জাতির বাস ছিল। তারা নবাগত ব্রাহ্মণকে ঠাকুর বলিয়াই ডাকিতেন।” আরো জানা যায় এই সময় ভাগীরথী নদীর তীরে ইংরেজদের বাণিজ্য তৈরী ভীরতো। সেই জাহাজে মাল ওঠা নামানোর ঠিকাদারি ও খাদ্য সামগ্রী সরবরাহের ব্যবসা করতেন পঞ্চানন কুশারী। এ কাজে নিম্ন শ্রেণীর হিন্দু শ্রমিকরা পঞ্চানন কুশারীকে ঠাকুর মশায় বলে ডাকতো। জাহাজের ক্যাপ্টেনদের কাছেও তিনি ঠাকুর বলে পরিচিতি পান। তাদের কাগজপত্রে TAGORE বা TAGOUR লেখা দেখা যায়। এখান থেকেই ঠাকুর উপাধির প্রচলন শুরু হয় (রবীন্দ্র জীবনী, ১ম খ-, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়)। এভাবেই কুশারী পদবী বদলে ঠাকুর পদবীর প্রচলন শুরু হয়।
পঞ্চানন ঠাকুরের পরবর্তী বংশধরেরা ইংরেজদের সাথে ওঠাবসা ও ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। কালক্রমে তারা অনেক ধন-সম্পদের মালিক হন এবং কলকাতায় নিজেদের মান মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন। এই ঠাকুর বংশের রামলোচনের দত্ত পুত্র দ্বারকানাথ ঠাকুর বিশাল জমিদারির মালিক হন। কলকাতায় ঠাকুরদের স্থায়ী বসবাস শুরু হয়। জোড়াসাঁকো ঠাকুর বংশে ১৮৬১ সালে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পঞ্চানন ঠাকুরের পরবর্তী সপ্তম পুরুষ। ঠাকুর পরিবার সমাজে নিজেদেরকে সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেও পীরালি ব্রাহ্মণের অপবাদ গুছাতে পারেননি, গোঁড়া ব্রাহ্মণ সমাজের কাছ হতে। ফলে ঠাকুর পরিবারের ছেলেদের বিয়ে নিয়ে বেশ বিড়ম্বনা পোহাতে হতো। পীরালি ব্রাহ্মণ হওয়ার কারণে রবীন্দ্রনাথসহ তার পূর্বপুরুষরা খুলনার ফুলতলার দক্ষিণডিহির পীরালি ব্রাহ্মণ ঘরে বিয়ে করেছেন বংশ পরম্পরায়। দ্বারকানাথ ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথের পিতামহ) বিয়ে করেন ফুলতলার দক্ষিণডিহির পীরালী ব্রাহ্মণ কন্যা দিগম্বরী দেবীকে। দ্বারকানাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথের পিতা) বিয়ে করেন দক্ষিণ ডিহির পীড়ালিব্রাহ্মণ কন্যা সারদা দেবীকে। দেবেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (রবীন্দ্রনাথের দাদা) বিয়ে হয়েছিল দক্ষিণ ডিহির নরেন্দ্রপুরের পীরালি ব্রাহ্মণ ঘরের মেয়ে জ্ঞানদা নন্দিনীর সাথে। রবীন্দ্রনাথের ২২বছর বয়সে বিয়ে হয় দক্ষিণডিহির পীরালি ব্রাহ্মণ বেণীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণীর সাথে। ঠাকুর বাড়ির প্রথা অনুযায়ী বিয়ের পর ভবতারিণী দেবীর নাম রাখা হয় মৃণালিনী দেবী।
পঞ্চানন কুশারীর অপর ভাই শুকদেব মতান্তরে প্রিয়নাথ কুশারীর বংশধারাটি ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণ হিসেবে পিঠাভোগে বসবাস করতে থাকেন। পীরালি ব্রাহ্মণদের সাথে তারা আর কোনো বিবাহ সম্পর্কে জড়ান না। এ ধারার তারিনীকান্ত কুশারী ইংরেজ কোম্পানির সাথে ব্যবসা করতো। রূপসা বাগেরহাট লাইট রেলওয়ে কোম্পানিতে ম্যানেজারি করে তিনি বেশ অর্থবিত্তের মালিক হন। তিনি কুশারী বাড়ির জগন্নাথ কুশারীর অংশভূত ৯.৩৫ একর জমির মালিকানা পান এবং সেখানে একটি পুকুর ও একটি বড় অট্টালিকা নির্মাণ করেন। তারিনীকান্ত কুশারী আলাইপুর থেকে স্টিমারঘাট পিঠাভোগে স্থাপন করেন (উরংঃৎরপঃ এধুবঃঃববৎ, শযঁষহধ ১৯২১)
কলকাতার “বাণীমন্দির নাট্য পরিষদ” কুশারী পরিবার নামে একটি নাট্যমঞ্চস্থ করে ১৯৫৩ সালে। এতে পিঠাভোগের কুশারী পরিবারের সমাজ পতন পীরালি ব্রাহ্মণ হওয়া ও তৎপরবর্তী কাহিনী উঠে আসে। এ নিয়ে আরো অধিক কিছু জানা না গেলেও এ নাটক মঞ্চায়নের একটি আমন্ত্রণপত্র এর সত্যতা প্রমাণ করে। আমন্ত্রণ পত্রটি বর্তমানে পিঠা ভোগে বসবাসকারী কুশারী বংশধররে প্রতিনিধিদের কাছে রয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের আদি পুরুষ কুশারী বংশধরেরা আজও খুলনা জেলার রূপসা উপজেলার ভৈরব-এর তীরে পিঠাভোগ গ্রামে বসবাস করছেন অনেকটা দিনদরিদ্র বেশেই। তারিনী কান্তের তৈরি আদি বাড়িটি আজ আর নেই। আর্থিক দেনার কারণে কবির পূর্বপুরুষের একমাত্র দালানটি বিক্রি করে দেন কুশারী পরিবার বাধ্য হয়েই। এক ঠিকাদারের কাছে মাত্র ২ লক্ষ ২০ হাজার টাকায়। এটি ১৯৯৪ সালের দিকের ঘটনা। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সরকার আদি বসত ভিটাটি উদ্ধার করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সপ্তম পূর্বপুরুষের বসতভিটার ওপর ২৪ শে নভেম্বর শুক্রবার ১৯৯৫ সালে স্থাপন করা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবক্ষ একটি প্রস্তর মূর্তি। উদ্বোধন হয় রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহশালা নামক প্রতিষ্ঠানের। ২০১১-১২ অর্থবছরে সাতটি বর্গে পরীক্ষামূলক প্রতœতাত্ত্বিক খনন কাজ পরিচালনা করা হয় ঐ স্থানের। বর্তমানে এটি রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহশালা নামে জাতীয় প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। সেখানে গড়ে উঠেছে রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহশালা। এখানে এবং দক্ষিণ ডিহিতে প্রতিবছর ২৫ শে বৈশাখ একযোগে তিন দিনব্যাপী মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
রবীন্দ্র গবেষক সুশান্ত সরকার জানান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিভার স্পর্শে বাঙালি পেয়েছে আত্ম পরিচয়। রবীন্দ্রনাথ হয়ে দাঁড়িয়েছেন তাঁর জাতিসত্তা অহঙ্কার। সেই রবীন্দ্রনাথকে জানতে আমাদের খুঁজে পেতে হবে তাঁর ঐতিহ্যের ইতিহাস। সে ক্ষেত্রে তাঁর পিতৃকুল ও মাতৃকুল উভয়ই বাংলাদেশের খুলনা জেলার পিঠাভোগ ও ফুলতলার দক্ষিণডিহি গ্রামের আদি বাসিন্দা। এই তথ্যগুলো রবীন্দ্র জীবনীকারদের হাতে স্পর্শিত হয়েছে মাত্র, বিস্তারিত হয়নি। ১৯৯৫ সালে কাজী রিয়াজুল হকের প্রচেষ্টায় পিঠাভোগ গ্রামে প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্র সংগ্রহ স্মৃতিশালার প্রেক্ষাপটে সেই রবীন্দ্র ঐতিহ্যকে খুঁজে বের করা আপামর বাঙালির জন্য আনন্দের।”
কুশারী বংশের ১৭তম পুরুষ গোপালচন্দ্র কুশারী। তিনি পিঠাভোগেই বসবাস করেন। তিনি বলেন, “রবীন্দ্রনাথ নিয়ে গবেষণা করতে হলে রবীন্দ্রনাথকে জানতে হলে প্রথমেই তাঁর এই আদি পুরুষের বংশ পরিচয় ও বসতভিটা সম্পর্কে জানতে হবে। কেননা রবীন্দ্রনাথের শিকড় এ বাংলাদেশের পিঠা ভোগেই। প্রথমদিকে রবীন্দ্র স্মৃতি পাঠাগার, গানের স্কুল, রবীন্দ্র ইনস্টিটিউট স্থাপন প্রভৃতি বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও পরে আর তা বাস্তবায়িত হয়নি। উদ্যোগ গুলোর বাস্তবায়ন হওয়া প্রয়োজন।”
রাবেয়া খানম
বৃহস্পতিবার, ০৬ মার্চ ২০২৫
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বাঙালি জাতিসত্তায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তার বহুধা বিস্তৃত প্রতিভায়। বিশ্ব সাহিত্যের আসরে বাংলা সাহিত্য কে প্রতিষ্ঠিত করেছেন আপন প্রতিভগুনে। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যা তাঁর হাতে স্পর্শিত হয়নি। আজও তিনি চর্চিত হচ্ছে নানাভাবে। তেমনি আজও রহস্যাবৃত কবির পূর্বপুরুষের পরিচয়। এখনো আমরা অনেকেই জানিনা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ব পুরুষের শেকড় এই বাংলার মাটিতেই প্রথিত। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ কুশারী বংশধরেরা আজও বসবাস করছেন খুলনার জেলার রূপসা উপজেলার পিঠাভোগ গ্রামে।
রবীন্দ্রনাথের পদবী আমরা জানি ঠাকুর হিসেবে। কিন্তু তাঁর পূর্বপুরুষের পদবী ছিল কুশারী। কুশারী বংশধারার একটি শাখা পরবর্তীকালে লোকমুখে ঠাকুর অভিধা পায়। কুশারীরা ছিলেন ব্রাহ্মণ। কুশারী ব্রাহ্মণরা খুলনা জেলার রূপসা উপজেলার ভৈরব তীরবর্তী পিঠাভোগ গ্রামে বাস করতেন। পিঠাভোগের কুশারী ব্রাহ্মণরা ঘটনাক্রমে পতিত অর্থাৎ সমাজচুত্য হয়েছিলেন পীরালি ব্রাহ্মণে। এই পীরালি ব্রাহ্মণই পরবর্তীকালে কলকাতা এসে ঠাকুর হিসেবে পরিচিতি পান।
কুশারী বংশের ইতিহাস বেশ বিস্তৃত। ইতিহাস অনুসারে খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে আদি শূরের রাজত্বকালে বঙ্গদেশ ছিল বৌদ্ধ ধর্ম প্রভাবাচ্ছন্ন। তাই বঙ্গদেশে হিন্দু ধর্মের পুনরুদ্ধার প্রচার ও প্রসারের জন্য কানোকুব্জ থেকে পাঁচজন ব্রাহ্মণ বঙ্গদেশে আসেন। এই পাঁচ সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ হলেন-
শান্ডিল্য গোত্রীয় ক্ষিতীশ, বাৎশ্যগোত্রীয় সুধানিধি, সাবর্ণগোত্রীয় সৌভরি, ভরদ্বাজগোত্রীয় মেধাতিথি, কাশ্যপগোত্রীয় বীতরাগ।
শান্ডিল্য গোত্রীয় ক্ষিতীশ-এর বংশানুক্রম থেকে উদ্ভব হয় কুশারী বংশের। কাশ্যপ গোত্রীয় বীতরাগ এর বংশানুক্রমের একটি শাখা থেকে উদ্ভব হয় পীরালি ব্রাহ্মণ ধারার।
শান্ডিল্য গোত্রের বংশজাত ভট্ট নারায়ণ। জানা যায় ভট্টনারায়ণের পুত্র দ্বীন নাথ মহারাজা ক্ষিতীশূরের কাছ থেকে বর্ধমান জেলার কুশ নামক গ্রামে বসবাস করার দান স্বত্ব অধিকার পান। এতে করে ভট্টনারায়ণ কুশারী গোত্রভুক্ত হন (বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ব্রাহ্মণ কা-, পৃষ্ঠা ১২১)।
খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকে কুশারী গোত্রের লোকেরা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। যেমন- ঢাকা, বাঁকুড়া ও খুলনার পিঠাভোগ গ্রামে। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষরা খুলনার পিঠা ভোগের কুশারী। দ্বীননাথ কুশারীর অষ্টম পুরুষ তারানাথ কুশারী। তিনি খুলনা জেলার রূপসা উপজেলার ভৈরব তীরবর্তী পিঠাভোগ গ্রামে বসবাস শুরু করেন। সেখান থেকে রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষের উপাধি কুশারী হয় (রবীন্দ্র জীবনী, প্রথম খ-, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়)।
তারানাথ কুশারীর দুই ছেলে। রাম গোপাল ও রামনাথ। রাম গোপালের পুত্র জগন্নাথ কুশারী। এই জগন্নাথ কুশারী থেকেই কুশারী বংশের ধারাটি ভিন্ন প্রবাহে বইতে থাকে এবং ঠাকুর পদবীর সূচনা ঘটে। কীভাবে? তা জানতে আমাদের ঘুরে আসতে হবে খুলনার দক্ষিণডিহি গ্রাম থেকে। পূর্বেই বলেছি বঙ্গে আসা পঞ্চ ব্রাহ্মণের একজন কাশ্যপ গোত্রীয় বীতরাগ। তাঁর ছেলে দক্ষের বংশানুক্রমের একটি ধারা আমরা পাই খুলনার দক্ষিণডিহিতে। তাঁরা রায়চৌধুরী উপাধি পেয়েছিলেন। তাদের একজন রাজা দক্ষিণানাথ রায় চৌধুরী। দক্ষিণানাথ রায় চৌধুরীর চার ছেলে। কামদেব, জয়দেব, রতিদেব ও শুকদেব। তখন খানজাহান আলী বঙ্গে আসেন (পঞ্চদশ শতকের দিকে)। তিনি খুলনার দক্ষিণডিহির পয়োগ্রাম অধিকার করে সেখানে একটি শহর প্রতিষ্ঠা করেন। তবে তিনি নিজে সেখানে বেশি দিন থাকেননি। তাঁর উজীর মোঃ তাহেরকে পয়োগ্রামের দায়িত্ব দিয়ে তিনি বাগেরহাটের দিকে চলে যান। এ তাহের সম্পর্কে যতদূর জানা যায়, “এই ব্যক্তি পূর্বে ব্রাহ্মণ ছিলেন। এক মুসলমানির প্রেমে পড়িয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ইহার নিবাস ছিল নবদ্বীপের নিকটস্থ পিরলিয়া বা পিরল্যা গ্রাম। ইসলাম ধর্মে গোঁড়ামি দেখিয়া অথবা পিরলিয়া গ্রামে বাস থাকায় লোকে তাহাকে পিরল্যা খাঁ বলিয়া ডাকিত (রবীন্দ্র জীবনী, প্রথম খ-, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় )।
কামদেব জয়দেব রায়চৌধুরী তাহেরের অধীনে চাকরি করতেন। একদিন রোজার সময় তাহের আনমনে একটি লেবুর গন্ধ শুকছিলেন তখন কামদেব রায় চৌধুরী বলেন, “আমাদের শাস্ত্র অনুসারে ঘ্রাণে অর্ধেক ভোজন হয় সুতরাং রোজা নষ্ট হলো।” তাহের মুসলমান হলেও ব্রাহ্মণ সন্তান। কামদেবের বিদ্রƒপ সহজেই বুঝতে পারেন। তাই প্রতিশোধের জন্য একদিন তাহের প্রধান হিন্দু মুসলমান প্রজাদের দরবারে আহ্বান করেন। পাশেই রান্না হচ্ছিল গরুর মাংস। দরবার মাংসের গন্ধে ভরপুর। গরুর মাংসের গন্ধ বুঝতে পেরে কামদেব ও জয়দেব নাকে কাপড় দিয়ে বসেন। তখন পীরালি মোহাম্মদ তাহের তাদের নাকে কাপড় দেয়ার কারণ জানতে চাইলে, তাঁরা জানান নাকে মাংসের গন্ধ আসছে। তাহের বল্লো, ঘ্রাণে যখন অর্ধেক ভোজন হয় তখন নিশ্চয়ই গোমাংসের ঘ্রাণে তোমাদের জাত গেছে। তাদের জোর করে মাংস খাওয়ানো হয়। ফলে কামদেব ও জয়দেব ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হন। তাদের বলা হতো পীরালি মুসলমান। কামদেব ও জয়দেবই প্রথম পীরালি মুসলমান। সে সময় যারা ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হতেন তাদের বলা হত পীরালি মুসলমান। আবার রক্ষণশীল হিন্দু কুলাচার্যরা মুসলমান সংস্পর্শের কারণে বা নানা তুচ্ছ কারণে ব্রাহ্মণদের সমাজ চ্যুত করতেন। তাদের বলা হতো পীরালি ব্রাহ্মণ। তেমনি কামদেব জয়দেবের অপর দুই ভাই রতিদেব ও সুখদেব রায় চৌধুরী ভাইদের দোষের কারণে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের রোষানলে পড়ে ব্রাহ্মণ সমাজ চ্যুত হন। তাদের বলা হতো পীরালি ব্রাহ্মণ। সমাজে পীরালি ব্রাহ্মণদের মান মর্যাদা ছিল খুবই করুণ। পীরালি ব্রাহ্মণ হওয়ার কারণে রতিদেব ও শুকদেব কে সমাজে নানা উৎপীড়নের শিকার হতে হয়। কোন উঁচু শ্রেণির ব্রাহ্মণ পীরালি ব্রাহ্মণের ঘরে কোনো মেয়ে বিয়ে দিতেন না বা বিয়ে করতেন না। সমাজে তাদের হেনস্তার অন্ত ছিল না।
রতিদেব মনের দুঃখে গ্রাম ছেড়ে চলে যান। শুকদেবকে তার বোন ও মেয়ের বিয়ে নিয়ে বেশ বিপাকে পড়তে হয়। অনেক চেষ্টা ও অর্থ ব্যয় করে তিনি বোনের বিয়ে দেন। এখন মেয়ের বিয়ে দেন কী রূপে? কদিন পর তারও সমাধান হয়। হঠাৎ একদিন প্রচ- ঝড় বৃষ্টির রাতে এক জমিদার নিরুপায় হয়ে শুকদেবের বাড়ি আশ্রয় নেন। তিনি আর কেউ নন, খুলনার পিঠাভোগ গ্রামের জমিদার জগন্নাথ কুশারী। এই জগন্নাথ কুশারীর সাথে শুকদেব তার মেয়ের বিয়ে দেন। কি কারণে জগন্নাথ কুশারী তাৎক্ষণিক এ বিয়ে করেছিলেন তা স্পষ্ট জানা যায় না। পীরালি ব্রাহ্মণের ঘরে বিয়ে করার অপরাধে জগন্নাথ কুশারীকে তার আত্মীয়-স্বজন বৈবাহিক দোষে দুষ্টু অভিধায় সমাজচ্যুত করেন। ফলে জগন্নাথ কুশারী ব্রাহ্মণ থেকে পীরালি ব্রাহ্মণে অন্তর্ভুক্ত হন। তাই রবীন্দ্রনাথ নিজেকে বলেছিলেন ব্রাত্য অর্থাৎ পতিত এই পতিত বংশের দায় রবীন্দ্রনাথকে বহন করতে হয়েছে। সমাজচুত্য হয়ে জগন্নাথ কুশারী পিঠাভোগ ত্যাগ করে খুলনার দক্ষিণডিহিতে বারোপাড়ার নরেন্দ্রপুর গ্রামে বসবাস শুরু করেন। এই জগন্নাথ কুশারীই ঠাকুর পরিবারের আদি পুরুষ (রবীন্দ্র জীবনী, প্রথম খ-, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়)।
জগন্নাথ কুশারীর পাঁচপুত্রের মধ্যে পুরুষোত্তম কুশারী থেকে ঠাকুর বংশের ধারা প্রবাহিত। পুরুষোত্তম কুশারীর তার পৈত্রিক বসতভিটা পিঠাভোগের সাথে একটি যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। কেননা জগন্নাথ কুশারীর জমিদারিও তার সম্পদ সব হস্তান্তর না হলেও কিছু অংশ পুরুষোত্তম কুশারী তার আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বন্টন করে দেন (ওয়েস্ট ল্যান্ড রিপোর্ট ১৮৭১ পৃষ্ঠা ১৮)। পুরুষোত্তম কুশারীর পরবর্তী বংশধর পঞ্চানন কুশারী। পঞ্চানন কুশারী পিঠাভোগ ও নরেন্দ্রপুর এর জ্ঞাতিদের সাথে বিরোধ বা এমনি কারণে পিঠাভোগ ও নরেন্দ্রপুরের সমস্ত স্থাবর সম্পত্তি ভাইকে হস্তান্তর করে কলকাতা পাড়ি জমান। পঞ্চানন কুশারী নরেন্দ্রপুর নাকি পিঠাভোগ থেকে কলকাতা চলে যান তা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। তবে ডঃ সতীশ চন্দ্র মিত্র তার যশোর খুলনার ইতিহাস, প্রথম খ-, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ এর পাদটিকায় উল্লেখ করেন- “কথিত আছে ঠাকুর বংশের এক পূর্বপুরুষ পঞ্চানন কুশারী খুলনা জেলার পিঠাভোগ গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া কালীঘাটের সন্নিকটে গোবিন্দপুর আসিয়া বাস করেন। সে সময় গোবিন্দপুরে জেলে, মালো, কৈবর্ত প্রভৃতি জাতির বাস ছিল। তারা নবাগত ব্রাহ্মণকে ঠাকুর বলিয়াই ডাকিতেন।” আরো জানা যায় এই সময় ভাগীরথী নদীর তীরে ইংরেজদের বাণিজ্য তৈরী ভীরতো। সেই জাহাজে মাল ওঠা নামানোর ঠিকাদারি ও খাদ্য সামগ্রী সরবরাহের ব্যবসা করতেন পঞ্চানন কুশারী। এ কাজে নিম্ন শ্রেণীর হিন্দু শ্রমিকরা পঞ্চানন কুশারীকে ঠাকুর মশায় বলে ডাকতো। জাহাজের ক্যাপ্টেনদের কাছেও তিনি ঠাকুর বলে পরিচিতি পান। তাদের কাগজপত্রে TAGORE বা TAGOUR লেখা দেখা যায়। এখান থেকেই ঠাকুর উপাধির প্রচলন শুরু হয় (রবীন্দ্র জীবনী, ১ম খ-, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়)। এভাবেই কুশারী পদবী বদলে ঠাকুর পদবীর প্রচলন শুরু হয়।
পঞ্চানন ঠাকুরের পরবর্তী বংশধরেরা ইংরেজদের সাথে ওঠাবসা ও ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। কালক্রমে তারা অনেক ধন-সম্পদের মালিক হন এবং কলকাতায় নিজেদের মান মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন। এই ঠাকুর বংশের রামলোচনের দত্ত পুত্র দ্বারকানাথ ঠাকুর বিশাল জমিদারির মালিক হন। কলকাতায় ঠাকুরদের স্থায়ী বসবাস শুরু হয়। জোড়াসাঁকো ঠাকুর বংশে ১৮৬১ সালে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পঞ্চানন ঠাকুরের পরবর্তী সপ্তম পুরুষ। ঠাকুর পরিবার সমাজে নিজেদেরকে সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেও পীরালি ব্রাহ্মণের অপবাদ গুছাতে পারেননি, গোঁড়া ব্রাহ্মণ সমাজের কাছ হতে। ফলে ঠাকুর পরিবারের ছেলেদের বিয়ে নিয়ে বেশ বিড়ম্বনা পোহাতে হতো। পীরালি ব্রাহ্মণ হওয়ার কারণে রবীন্দ্রনাথসহ তার পূর্বপুরুষরা খুলনার ফুলতলার দক্ষিণডিহির পীরালি ব্রাহ্মণ ঘরে বিয়ে করেছেন বংশ পরম্পরায়। দ্বারকানাথ ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথের পিতামহ) বিয়ে করেন ফুলতলার দক্ষিণডিহির পীরালী ব্রাহ্মণ কন্যা দিগম্বরী দেবীকে। দ্বারকানাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথের পিতা) বিয়ে করেন দক্ষিণ ডিহির পীড়ালিব্রাহ্মণ কন্যা সারদা দেবীকে। দেবেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (রবীন্দ্রনাথের দাদা) বিয়ে হয়েছিল দক্ষিণ ডিহির নরেন্দ্রপুরের পীরালি ব্রাহ্মণ ঘরের মেয়ে জ্ঞানদা নন্দিনীর সাথে। রবীন্দ্রনাথের ২২বছর বয়সে বিয়ে হয় দক্ষিণডিহির পীরালি ব্রাহ্মণ বেণীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণীর সাথে। ঠাকুর বাড়ির প্রথা অনুযায়ী বিয়ের পর ভবতারিণী দেবীর নাম রাখা হয় মৃণালিনী দেবী।
পঞ্চানন কুশারীর অপর ভাই শুকদেব মতান্তরে প্রিয়নাথ কুশারীর বংশধারাটি ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণ হিসেবে পিঠাভোগে বসবাস করতে থাকেন। পীরালি ব্রাহ্মণদের সাথে তারা আর কোনো বিবাহ সম্পর্কে জড়ান না। এ ধারার তারিনীকান্ত কুশারী ইংরেজ কোম্পানির সাথে ব্যবসা করতো। রূপসা বাগেরহাট লাইট রেলওয়ে কোম্পানিতে ম্যানেজারি করে তিনি বেশ অর্থবিত্তের মালিক হন। তিনি কুশারী বাড়ির জগন্নাথ কুশারীর অংশভূত ৯.৩৫ একর জমির মালিকানা পান এবং সেখানে একটি পুকুর ও একটি বড় অট্টালিকা নির্মাণ করেন। তারিনীকান্ত কুশারী আলাইপুর থেকে স্টিমারঘাট পিঠাভোগে স্থাপন করেন (উরংঃৎরপঃ এধুবঃঃববৎ, শযঁষহধ ১৯২১)
কলকাতার “বাণীমন্দির নাট্য পরিষদ” কুশারী পরিবার নামে একটি নাট্যমঞ্চস্থ করে ১৯৫৩ সালে। এতে পিঠাভোগের কুশারী পরিবারের সমাজ পতন পীরালি ব্রাহ্মণ হওয়া ও তৎপরবর্তী কাহিনী উঠে আসে। এ নিয়ে আরো অধিক কিছু জানা না গেলেও এ নাটক মঞ্চায়নের একটি আমন্ত্রণপত্র এর সত্যতা প্রমাণ করে। আমন্ত্রণ পত্রটি বর্তমানে পিঠা ভোগে বসবাসকারী কুশারী বংশধররে প্রতিনিধিদের কাছে রয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের আদি পুরুষ কুশারী বংশধরেরা আজও খুলনা জেলার রূপসা উপজেলার ভৈরব-এর তীরে পিঠাভোগ গ্রামে বসবাস করছেন অনেকটা দিনদরিদ্র বেশেই। তারিনী কান্তের তৈরি আদি বাড়িটি আজ আর নেই। আর্থিক দেনার কারণে কবির পূর্বপুরুষের একমাত্র দালানটি বিক্রি করে দেন কুশারী পরিবার বাধ্য হয়েই। এক ঠিকাদারের কাছে মাত্র ২ লক্ষ ২০ হাজার টাকায়। এটি ১৯৯৪ সালের দিকের ঘটনা। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সরকার আদি বসত ভিটাটি উদ্ধার করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সপ্তম পূর্বপুরুষের বসতভিটার ওপর ২৪ শে নভেম্বর শুক্রবার ১৯৯৫ সালে স্থাপন করা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবক্ষ একটি প্রস্তর মূর্তি। উদ্বোধন হয় রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহশালা নামক প্রতিষ্ঠানের। ২০১১-১২ অর্থবছরে সাতটি বর্গে পরীক্ষামূলক প্রতœতাত্ত্বিক খনন কাজ পরিচালনা করা হয় ঐ স্থানের। বর্তমানে এটি রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহশালা নামে জাতীয় প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। সেখানে গড়ে উঠেছে রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহশালা। এখানে এবং দক্ষিণ ডিহিতে প্রতিবছর ২৫ শে বৈশাখ একযোগে তিন দিনব্যাপী মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
রবীন্দ্র গবেষক সুশান্ত সরকার জানান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিভার স্পর্শে বাঙালি পেয়েছে আত্ম পরিচয়। রবীন্দ্রনাথ হয়ে দাঁড়িয়েছেন তাঁর জাতিসত্তা অহঙ্কার। সেই রবীন্দ্রনাথকে জানতে আমাদের খুঁজে পেতে হবে তাঁর ঐতিহ্যের ইতিহাস। সে ক্ষেত্রে তাঁর পিতৃকুল ও মাতৃকুল উভয়ই বাংলাদেশের খুলনা জেলার পিঠাভোগ ও ফুলতলার দক্ষিণডিহি গ্রামের আদি বাসিন্দা। এই তথ্যগুলো রবীন্দ্র জীবনীকারদের হাতে স্পর্শিত হয়েছে মাত্র, বিস্তারিত হয়নি। ১৯৯৫ সালে কাজী রিয়াজুল হকের প্রচেষ্টায় পিঠাভোগ গ্রামে প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্র সংগ্রহ স্মৃতিশালার প্রেক্ষাপটে সেই রবীন্দ্র ঐতিহ্যকে খুঁজে বের করা আপামর বাঙালির জন্য আনন্দের।”
কুশারী বংশের ১৭তম পুরুষ গোপালচন্দ্র কুশারী। তিনি পিঠাভোগেই বসবাস করেন। তিনি বলেন, “রবীন্দ্রনাথ নিয়ে গবেষণা করতে হলে রবীন্দ্রনাথকে জানতে হলে প্রথমেই তাঁর এই আদি পুরুষের বংশ পরিচয় ও বসতভিটা সম্পর্কে জানতে হবে। কেননা রবীন্দ্রনাথের শিকড় এ বাংলাদেশের পিঠা ভোগেই। প্রথমদিকে রবীন্দ্র স্মৃতি পাঠাগার, গানের স্কুল, রবীন্দ্র ইনস্টিটিউট স্থাপন প্রভৃতি বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও পরে আর তা বাস্তবায়িত হয়নি। উদ্যোগ গুলোর বাস্তবায়ন হওয়া প্রয়োজন।”