alt

সাময়িকী

মুনীর চৌধুরীর নাটক ‘কবর’

প্রতিবাদী চেতনার উর্বর ময়দান

সালাহউদদীন আহমেদ মিলটন

: বৃহস্পতিবার, ০৬ মার্চ ২০২৫

মুনীর চৌধুরী

নাটক যেমন গভীর জীবনবোধের শুদ্ধ চেতনা সঞ্চারী, তেমনি আধিপত্যবাদীদের বিরুদ্ধে ঝলসে ওঠা বিপ্লবী শক্তিও বটে। আর এ শক্তি যেন মুনীর চৌধুরীর সত্তায়এক উজ্জ্বলতর শব্দ বিক্ষোভে পরিস্ফুটিত হয়েছিল। তাই তো রাজনৈতিক বাস্তবতার নিবিড়পর্যবেক্ষণে শিল্পমগ্ন কারিগর মুনীর চৌধুরীর যথার্থ প্রগাঢ় অনুভবে দেদীপ্যমান নাটক ‘কবর’ যেন সমকালীন চেতনাকেও ঋদ্ধ করে।

‘কবর’ নাটকটি রচনার প্রেক্ষাপট এক বিরল ইতিহাস। মহান ভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে মুনীর চৌধুরীকে ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করা হলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাঁকে প্রথমে দিনাজপুর জেলে এবং পরবর্তীতে ঢাকা কেন্দ্রীয়কারাগারে স্থানান্তরিত করেন। এ সময়বামপন্থী নেতা বিপ্লবী রণেশদাশগুপ্তও ঢাকা কেন্দ্রীয়কারাগারে বন্দী ছিলেন।মূলত রণেশ দাশগুপ্তের অনুরোধের ভিত্তিতেই মুনীর চৌধুরী ‘কবর’ নাটকটি রচনা করেন এবং তা ২১ ফেব্রুয়ারি (১৯৫৩) রাত ১০টায়বিপ্লবী ফনী চক্রবর্তীর নির্দেশনা ও কারাবন্দীদের অভিনয়েঢাকা কেন্দ্রীয়কারাগারের ভেতরেই হারিকেনের আলোয়প্রথম মঞ্চায়িত হয়। এ যেন কালজয়ী শৈল্পিক প্রতিবাদের এক মহান মোড়ক উন্মোচন।

নাটকটি মহান ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও মুনীর চৌধুরীর ক্ষুরধার লেখনীর আঁচড়েএ যেন হয়েওঠে চিরন্তন, সকল কালের সকল অন্যায়-অবিচার, নিপীড়ন-নির্যাতন, শোষণ-দুঃশাসন আর সা¤্রাজ্যবাদী হিং¯্রতার বিরুদ্ধে আপামর জনতার প্রতিবাদী চেতনার এক উর্বর ময়দান। এ যেন হয়েওঠে যুগে-যুগে, কালে-কালে, দৃপ্ত পদচারণায়উন্মুখ সূর্যালোকিত শক্তি।

‘কবর’ নাটকটিতে গোরস্থানের অতিপ্রাকৃত রহস্যময়, ভয়াবহ, অশরীরী পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে এবং মোট ৬টি চরিত্রের (নেতা, হাফিজ, মুর্দা ফকির, গার্ড, মূর্তি-১, মূর্তি-২) অবতারণা করা হলেও নেতা, হাফিজ এবং মুর্দা ফকির চরিত্রের উপস্থিতি পুরো নাটকজুড়েলক্ষ্য করা যায়। এখানে ‘নেতা’ চরিত্রটি ভীতু স্বভাবের হলেও তা যেন তিনি অন্য কাউকে বুঝতে দিতে চান না। তিনি মাদকাসক্ত এবং তার মধ্যে এক ধরনের দাম্ভিক ও উগ্রতা পরিলক্ষিত হয়। মূলত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণের যাঁতাকলে বাংলা পদপৃষ্ঠ হয়েছে বারবার। আর তাদেরই একজন প্রতিনিধি হিসেবে ‘নেতা’ চরিত্রটি নাট্যকার উপস্থাপন করেছেন। ইন্সপেক্টর হাফিজ তৈলমর্দনে যথেষ্ট পারদর্শী। তার আদর্শ বিবর্জিত লোভাতুর চিন্তা-ভাবনা তাকে মেরুদ-হীন একজন ধূর্ত ও কৌশলী মানবে পরিণত করেছে। তিনি যখন নেতাকে উদ্দেশ্য করে বলেনÑ ‘সরকারই মা-বাপ। যখন যে দল হুকুম চালায়তার হুকুমই তালিম করি।’ তখন এ যেন সমাজের এক চরমতম অধঃপতনের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে বলেই প্রতীয়মান হয়। মুর্দা ফকির চরিত্রটি মূলত নাট্যকারের নিজস্ব সত্তার প্রতীক। মহান ভাষা আন্দোলনে মুনীর চৌধুরী তার প্রিয়ছাত্রদের মৃত্যু যেন কোনভাবেই মেনে নিতে পারেন নি। তিনি মুর্দা ফকিরের সংলাপে তা আরো স্পষ্ট করেনÑ ‘আমি ওদের ভালো করে দেখেছি, ওরা মুর্দা নয়। মরেনি। মরবে না। ওরা কখনও কবরে যাবে না। কবরের নিচে ওরা কেউ থাকবে না। উঠে চলে আসবে।’ মূলত মুনীর চৌধুরীর ব্যথাদীর্ণ বুকের হাহাকার যেন দেশ ও জাতির অবরুদ্ধ অশ্রু। গার্ড চরিত্রটি গোরস্থানের পাহারাদার অনেকটা সাদাসিধে মানুষ। মূর্তি-১ ও মূর্তি-২ চরিত্র দুটি মূলত ভাষা শহীদ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

নাটকটি মূলত শেষ রাতে গোরস্থানে ভাষা শহীদদের লাশ দাফনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। ছাত্ররা যখন ভাষার দাবিতে কারফিউ ভেঙ্গে উদ্দামগতিতে এগিয়েযান, তখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশে পুলিশ নির্মমভাবে গুলিবর্ষণ করে। এতে বেশ কয়েকজন ছাত্র শহীদ হলে, তাদের লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে একজন নেতার নেতৃত্বে পুলিশ ইন্সপেক্টর হাফিজকে দিয়েলাশগুলো একটি গোরস্থানে আনা হয়।

নাটকটিতে গোর খুঁড়োদের সরাসরি উপস্থিতি না থাকলেও হাফিজের সংলাপের মধ্য দিয়েতাদের প্রতিবাদী উচ্চারণ স্পষ্ট হয়Ñ‘মুসলমানের মুর্দা, দাফন নেই, কাফন নেই, জানাজা নেই? তার ওপর একটা আলাদা কবর পর্যন্ত পাবে না? এ হতে পারে না, কভি নেহি।’ এখানে গোর খুঁড়োদের সংলাপ-ই যেন মুনীর চৌধুরীর শাণিত প্রতিবাদ হয়েধরা দেয়। এ যেন বাংলার আপামর জনতাকে জালিমের বিরুদ্ধে সাহসী করে তুলতে নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর এক অনন্য প্রয়াস।

আমরা বলতেই পারিÑ মুনীর চৌধুরীর চিন্তার গভীরতা ও অসাধারণ শিল্পকৌশলে ‘কবর’ নাটকটি যেন হয়েওঠে এক বিপ্লবী ক্যানভাস। ‘ঝুঁটা’ শব্দ প্রয়োগের মধ্য দিয়েমুর্দা ফকিরের মঞ্চে আবির্ভাব ঘটলে দেখা যায়Ñহাফিজ ও নেতা সভয়ে চিৎকার করে ওঠে এবং ‘নেতা’ তার হৃৎপি- চেপে ধরেন। এখানে নাট্যকার মূলত ‘ঝুঁটা’ শব্দটিকে দাম্ভিক দখলদার পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। যার শক্তিশালী বিস্ফোরণ যেন নেতার হৃৎপি- নয়, বরং তাদের পৈশাচিকতার মসনদ কাঁপিয়ে তোলেন। মুর্দা ফকির যখন বলে ওঠেনÑ ‘এ লাশের গন্ধ অন্যরকম। ওষুধের, গ্যাসের, বারুদের গন্ধ। এ মুর্দা কবরে থাকবে না। বিশ-পঁচিশ-ত্রিশ হাত যত নিচেই মাটিচাপা দাও না কেনÑ এ মুর্দা থাকবে না। কবর ভেঙে বেরিয়েচলে আসবে। উঠে আসবে।’

তখন বিদগ্ধজন বুঝে ফেলেÑ এ যেন নাট্যকার তার উন্মাদ চিত্তে প্রতিবাদের এক নতুন অধ্যায়বিনির্মাণে বদ্ধপরিকর। তিনি যেন ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতিসত্তার বিদ্রোহে অবিচল শক্তিধর এক বিশাল তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ তেজস্বীতায়উদ্দীপ্ত।

মুর্দা ফকির আরো স্পষ্ট করে যখন বলেনÑ ‘গন্ধ। তোমাদের গায়েমরা মানুষের গন্ধ। তোমরা এখানে কী করছ? যাও, তাড়াতাড়িকবরে যাও।’ তখন বুঝতেই পারিÑ এ সংলাপের মধ্য দিয়েই যেন নাট্যকার তাঁর তীব্র ঘৃণায়বিদ্রোহী উত্তাপ ছড়িয়েদিয়েছে বাংলার প্রতিটি প্রাণে প্রাণে। জুলুমবাজ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর যে পতন অনিবার্য, এ সংলাপের মধ্য দিয়েই তার সারসত্য প্রকাশিত হয়েছে।

প্রসঙ্গত বলতেই হয়Ñমূর্তি-১ (ছাত্র) ও মূর্তি-২ (হাইকোর্টের কেরানি) চরিত্র দুটির সংলাপের মধ্যেও যেন এক প্রবল প্রতিবাদী চেতনার উন্মেষ উন্মোচিত হয়েছে। নেতা তাদেরকে বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেও তারা নির্ভীক চিত্তে একটাই উত্তর দেয়Ñ‘কবরে যাব না। আমি বাঁচব।’

একপর্যায়ে নেতা যখন উত্তেজিতভাবে বলে ওঠেনÑ ‘একটা একটা করে গুলি করে আমি সব মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেব। হাজার হাজার হাত মাটির নিচে সব পুঁতে ফেলব।... গুলি, সবগুলোকে আবার গুলি কর।’ তখন মুহূর্তেই যেন মুর্দা ফকিরের বজ্রকণ্ঠে ধ্বনিত হয়Ñ‘তোরা কোথায় গেলি? সব ঘুমিয়েনাকি? উঠে আয়। তাড়াতাড়িউঠে আয়। সব মিছিল করে উঠে আয়। গুলি। গুলি হবে। স্ফূর্তি করে উঠে আয়সব। কোথায়গেলি? সব উঠে আয়। মিছিল করে আয়এদিকে। আজ গুলি? গুলি হবে আজ। কবর খালি করে সব উঠে আয়।’ মুর্দা ফকিরের এ আহ্বানই যেন এক অসম সংগ্রামের প্রেরণা যোগায়। এ যেন শোষণ-পীড়ন, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে এক মহাবিদ্রোহ। এ যেন অবরুদ্ধ মানুষের মুক্তির জন্য বিপ্লবী ইশতেহার।

মূলত মুনীর চৌধুরী এ সংলাপের মধ্য দিয়েহাজার বছরের বন্দি শিকল ভেঙ্গে বাঙালি জাতিসত্তার স্বাধীনতা ও মুক্তি তথা অধিকার আদায়েআপামর জনতাকে জেগে ওঠার উদাত্ত আহ্বান জানালেন। তাঁর এ সাহসী উচ্চারণ যেন মুক্তির নেশায়ছড়িয়ে গেল পঞ্চান্ন হাজার পাঁচশত আটানব্বই বর্গমাইল। আসলে পুরো নাটকটিই যেন বাঙালি অস্তিত্বের সংগ্রাম আর দুর্বিনীত বীরত্বের বিপুল শক্তির উদ্ভাসে ঋদ্ধ। আমরা যদি আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করি, তবে বলতেই হয়Ñ‘কবর’ নাটকের গভীরতা ও মাহাত্ম্য এতই সুদূরপ্রসারী, তা একদিকে যেমন আত্মবোধের উত্থান ও সাম্যবাদী সমাজ মনস্কতার চূড়ান্ত উদাহরণ, অন্যদিকে অসম শক্তিমত্তায়উন্মত্ত পৃথিবীর বিবর্জিত বিবেকের বিকারগ্রস্ত চিত্র উন্মোচিত হয়েছে।

‘কবর’ নাটকে মার্কিন নাট্যকার আরউইন শ-র ‘বারি দ্য ডেড’ (১৯৩৬) নাটকটির প্রভাব আছে বলে কিছু কিছু সমালোচক মনে করেন। ‘বারি দ্য ডেড’ নাটকটিতে বিশ্বযুদ্ধে নিহত তরুণরা কবরে যেতে অস্বীকার করেছেন, যা মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকের সাথে ভাবগত ঐক্য অনেকটাই বিদ্যমান। তবে প্রসঙ্গত বলতেই হয়Ñ‘কবর’ নাটকটির প্রেক্ষাপট ভাষা আন্দোলন হলেও মুনীর চৌধুরী সমাজের বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধেও মারাত্মক চপেটাঘাত করেছেন।

সবশেষে বলবোÑ নাটকটির পরিসমাপ্তি যেন মুনীর চৌধুরীর শাণিত চেতনাকে অনেকটাই আপোসকামী করেছে বলেই প্রতীয়মান হয়। তবে বলতেই হবেÑ ‘কবর’ নাটকটি ইতিহাসের ইতিহাস। যা যুগে-যুগে, কালে-কালে, সকল অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চেতনার এক উজ্জ্বল মাইলফলক।

ছবি

রবীন্দ্রনাথের আদি পুরুষের শেকড়

ছবি

ভেঙে পড়ে অন্তর্গহনের প্রগাঢ় অনুভূতি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফ্রিদা কাহলো : আত্মপ্রকাশের রঙিন ক্যানভাস

ছবি

জ্যাজ সংঙ্গীতের তাৎক্ষণিক সৃষ্টিশীলতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

নক্ষত্রের ধ্রুবতারা অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী

ছবি

নজরুল ও তাঁর সুন্দর

ছবি

নতুন বইয়ের খবর

ছবি

‘আমার চোখ যখন আমাকেই দেখে’- প্রেম ও প্রকৃতির সেতুবন্ধ

ছবি

পূষন ও বৃষ্টির গল্প

ছবি

নিরামিষ চর্চার বিরল আখ্যান

ছবি

‘আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ভ্রম

ছবি

পালকের চিহ্নগুলো

ছবি

নতুন বইয়ের খবর

ছবি

রফিক আজাদের কবিতা

ছবি

ধূসর পাণ্ডুলিপি পরিবহন

ছবি

চৈত্রের কোনো এক মধ্যরাতে

ছবি

দেশভাগের বিপর্যয় ও ‘জলপাইহাটি’র জীবনানন্দ দাশ

ছবি

সামান্য ভুল

সাময়িকী কবিতা

ছবি

আধুনিক বাংলা কবিতার প্রথাভাঙা মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত

ছবি

ধুলোময় জীবনের মেটাফর

ছবি

স্কুলটি ছোট্ট বটে

ছবি

নতুন বইয়ের খবর

ছবি

পালকের চিহ্নগুলো

ছবি

আদোনিসের কবিতা

ছবি

আড়াই লেনের কৃষ্ণচূড়া

ছবি

গিরিশচন্দ্র ঘোষের নাটক ইতিহাস ও দেশপ্রেম

ছবি

নিজস্বতার অনন্য প্রমাণ

ছবি

বইমেলায় আসছে নতুন বই

ছবি

সরল প্রাণের সোপান

ছবি

হাসান আজিজুল হকের দর্শনচিন্তা

ছবি

শীতের পদাবলি

tab

সাময়িকী

মুনীর চৌধুরীর নাটক ‘কবর’

প্রতিবাদী চেতনার উর্বর ময়দান

সালাহউদদীন আহমেদ মিলটন

মুনীর চৌধুরী

বৃহস্পতিবার, ০৬ মার্চ ২০২৫

নাটক যেমন গভীর জীবনবোধের শুদ্ধ চেতনা সঞ্চারী, তেমনি আধিপত্যবাদীদের বিরুদ্ধে ঝলসে ওঠা বিপ্লবী শক্তিও বটে। আর এ শক্তি যেন মুনীর চৌধুরীর সত্তায়এক উজ্জ্বলতর শব্দ বিক্ষোভে পরিস্ফুটিত হয়েছিল। তাই তো রাজনৈতিক বাস্তবতার নিবিড়পর্যবেক্ষণে শিল্পমগ্ন কারিগর মুনীর চৌধুরীর যথার্থ প্রগাঢ় অনুভবে দেদীপ্যমান নাটক ‘কবর’ যেন সমকালীন চেতনাকেও ঋদ্ধ করে।

‘কবর’ নাটকটি রচনার প্রেক্ষাপট এক বিরল ইতিহাস। মহান ভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে মুনীর চৌধুরীকে ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করা হলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাঁকে প্রথমে দিনাজপুর জেলে এবং পরবর্তীতে ঢাকা কেন্দ্রীয়কারাগারে স্থানান্তরিত করেন। এ সময়বামপন্থী নেতা বিপ্লবী রণেশদাশগুপ্তও ঢাকা কেন্দ্রীয়কারাগারে বন্দী ছিলেন।মূলত রণেশ দাশগুপ্তের অনুরোধের ভিত্তিতেই মুনীর চৌধুরী ‘কবর’ নাটকটি রচনা করেন এবং তা ২১ ফেব্রুয়ারি (১৯৫৩) রাত ১০টায়বিপ্লবী ফনী চক্রবর্তীর নির্দেশনা ও কারাবন্দীদের অভিনয়েঢাকা কেন্দ্রীয়কারাগারের ভেতরেই হারিকেনের আলোয়প্রথম মঞ্চায়িত হয়। এ যেন কালজয়ী শৈল্পিক প্রতিবাদের এক মহান মোড়ক উন্মোচন।

নাটকটি মহান ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও মুনীর চৌধুরীর ক্ষুরধার লেখনীর আঁচড়েএ যেন হয়েওঠে চিরন্তন, সকল কালের সকল অন্যায়-অবিচার, নিপীড়ন-নির্যাতন, শোষণ-দুঃশাসন আর সা¤্রাজ্যবাদী হিং¯্রতার বিরুদ্ধে আপামর জনতার প্রতিবাদী চেতনার এক উর্বর ময়দান। এ যেন হয়েওঠে যুগে-যুগে, কালে-কালে, দৃপ্ত পদচারণায়উন্মুখ সূর্যালোকিত শক্তি।

‘কবর’ নাটকটিতে গোরস্থানের অতিপ্রাকৃত রহস্যময়, ভয়াবহ, অশরীরী পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে এবং মোট ৬টি চরিত্রের (নেতা, হাফিজ, মুর্দা ফকির, গার্ড, মূর্তি-১, মূর্তি-২) অবতারণা করা হলেও নেতা, হাফিজ এবং মুর্দা ফকির চরিত্রের উপস্থিতি পুরো নাটকজুড়েলক্ষ্য করা যায়। এখানে ‘নেতা’ চরিত্রটি ভীতু স্বভাবের হলেও তা যেন তিনি অন্য কাউকে বুঝতে দিতে চান না। তিনি মাদকাসক্ত এবং তার মধ্যে এক ধরনের দাম্ভিক ও উগ্রতা পরিলক্ষিত হয়। মূলত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণের যাঁতাকলে বাংলা পদপৃষ্ঠ হয়েছে বারবার। আর তাদেরই একজন প্রতিনিধি হিসেবে ‘নেতা’ চরিত্রটি নাট্যকার উপস্থাপন করেছেন। ইন্সপেক্টর হাফিজ তৈলমর্দনে যথেষ্ট পারদর্শী। তার আদর্শ বিবর্জিত লোভাতুর চিন্তা-ভাবনা তাকে মেরুদ-হীন একজন ধূর্ত ও কৌশলী মানবে পরিণত করেছে। তিনি যখন নেতাকে উদ্দেশ্য করে বলেনÑ ‘সরকারই মা-বাপ। যখন যে দল হুকুম চালায়তার হুকুমই তালিম করি।’ তখন এ যেন সমাজের এক চরমতম অধঃপতনের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে বলেই প্রতীয়মান হয়। মুর্দা ফকির চরিত্রটি মূলত নাট্যকারের নিজস্ব সত্তার প্রতীক। মহান ভাষা আন্দোলনে মুনীর চৌধুরী তার প্রিয়ছাত্রদের মৃত্যু যেন কোনভাবেই মেনে নিতে পারেন নি। তিনি মুর্দা ফকিরের সংলাপে তা আরো স্পষ্ট করেনÑ ‘আমি ওদের ভালো করে দেখেছি, ওরা মুর্দা নয়। মরেনি। মরবে না। ওরা কখনও কবরে যাবে না। কবরের নিচে ওরা কেউ থাকবে না। উঠে চলে আসবে।’ মূলত মুনীর চৌধুরীর ব্যথাদীর্ণ বুকের হাহাকার যেন দেশ ও জাতির অবরুদ্ধ অশ্রু। গার্ড চরিত্রটি গোরস্থানের পাহারাদার অনেকটা সাদাসিধে মানুষ। মূর্তি-১ ও মূর্তি-২ চরিত্র দুটি মূলত ভাষা শহীদ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

নাটকটি মূলত শেষ রাতে গোরস্থানে ভাষা শহীদদের লাশ দাফনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। ছাত্ররা যখন ভাষার দাবিতে কারফিউ ভেঙ্গে উদ্দামগতিতে এগিয়েযান, তখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশে পুলিশ নির্মমভাবে গুলিবর্ষণ করে। এতে বেশ কয়েকজন ছাত্র শহীদ হলে, তাদের লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে একজন নেতার নেতৃত্বে পুলিশ ইন্সপেক্টর হাফিজকে দিয়েলাশগুলো একটি গোরস্থানে আনা হয়।

নাটকটিতে গোর খুঁড়োদের সরাসরি উপস্থিতি না থাকলেও হাফিজের সংলাপের মধ্য দিয়েতাদের প্রতিবাদী উচ্চারণ স্পষ্ট হয়Ñ‘মুসলমানের মুর্দা, দাফন নেই, কাফন নেই, জানাজা নেই? তার ওপর একটা আলাদা কবর পর্যন্ত পাবে না? এ হতে পারে না, কভি নেহি।’ এখানে গোর খুঁড়োদের সংলাপ-ই যেন মুনীর চৌধুরীর শাণিত প্রতিবাদ হয়েধরা দেয়। এ যেন বাংলার আপামর জনতাকে জালিমের বিরুদ্ধে সাহসী করে তুলতে নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর এক অনন্য প্রয়াস।

আমরা বলতেই পারিÑ মুনীর চৌধুরীর চিন্তার গভীরতা ও অসাধারণ শিল্পকৌশলে ‘কবর’ নাটকটি যেন হয়েওঠে এক বিপ্লবী ক্যানভাস। ‘ঝুঁটা’ শব্দ প্রয়োগের মধ্য দিয়েমুর্দা ফকিরের মঞ্চে আবির্ভাব ঘটলে দেখা যায়Ñহাফিজ ও নেতা সভয়ে চিৎকার করে ওঠে এবং ‘নেতা’ তার হৃৎপি- চেপে ধরেন। এখানে নাট্যকার মূলত ‘ঝুঁটা’ শব্দটিকে দাম্ভিক দখলদার পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। যার শক্তিশালী বিস্ফোরণ যেন নেতার হৃৎপি- নয়, বরং তাদের পৈশাচিকতার মসনদ কাঁপিয়ে তোলেন। মুর্দা ফকির যখন বলে ওঠেনÑ ‘এ লাশের গন্ধ অন্যরকম। ওষুধের, গ্যাসের, বারুদের গন্ধ। এ মুর্দা কবরে থাকবে না। বিশ-পঁচিশ-ত্রিশ হাত যত নিচেই মাটিচাপা দাও না কেনÑ এ মুর্দা থাকবে না। কবর ভেঙে বেরিয়েচলে আসবে। উঠে আসবে।’

তখন বিদগ্ধজন বুঝে ফেলেÑ এ যেন নাট্যকার তার উন্মাদ চিত্তে প্রতিবাদের এক নতুন অধ্যায়বিনির্মাণে বদ্ধপরিকর। তিনি যেন ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতিসত্তার বিদ্রোহে অবিচল শক্তিধর এক বিশাল তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ তেজস্বীতায়উদ্দীপ্ত।

মুর্দা ফকির আরো স্পষ্ট করে যখন বলেনÑ ‘গন্ধ। তোমাদের গায়েমরা মানুষের গন্ধ। তোমরা এখানে কী করছ? যাও, তাড়াতাড়িকবরে যাও।’ তখন বুঝতেই পারিÑ এ সংলাপের মধ্য দিয়েই যেন নাট্যকার তাঁর তীব্র ঘৃণায়বিদ্রোহী উত্তাপ ছড়িয়েদিয়েছে বাংলার প্রতিটি প্রাণে প্রাণে। জুলুমবাজ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর যে পতন অনিবার্য, এ সংলাপের মধ্য দিয়েই তার সারসত্য প্রকাশিত হয়েছে।

প্রসঙ্গত বলতেই হয়Ñমূর্তি-১ (ছাত্র) ও মূর্তি-২ (হাইকোর্টের কেরানি) চরিত্র দুটির সংলাপের মধ্যেও যেন এক প্রবল প্রতিবাদী চেতনার উন্মেষ উন্মোচিত হয়েছে। নেতা তাদেরকে বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেও তারা নির্ভীক চিত্তে একটাই উত্তর দেয়Ñ‘কবরে যাব না। আমি বাঁচব।’

একপর্যায়ে নেতা যখন উত্তেজিতভাবে বলে ওঠেনÑ ‘একটা একটা করে গুলি করে আমি সব মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেব। হাজার হাজার হাত মাটির নিচে সব পুঁতে ফেলব।... গুলি, সবগুলোকে আবার গুলি কর।’ তখন মুহূর্তেই যেন মুর্দা ফকিরের বজ্রকণ্ঠে ধ্বনিত হয়Ñ‘তোরা কোথায় গেলি? সব ঘুমিয়েনাকি? উঠে আয়। তাড়াতাড়িউঠে আয়। সব মিছিল করে উঠে আয়। গুলি। গুলি হবে। স্ফূর্তি করে উঠে আয়সব। কোথায়গেলি? সব উঠে আয়। মিছিল করে আয়এদিকে। আজ গুলি? গুলি হবে আজ। কবর খালি করে সব উঠে আয়।’ মুর্দা ফকিরের এ আহ্বানই যেন এক অসম সংগ্রামের প্রেরণা যোগায়। এ যেন শোষণ-পীড়ন, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে এক মহাবিদ্রোহ। এ যেন অবরুদ্ধ মানুষের মুক্তির জন্য বিপ্লবী ইশতেহার।

মূলত মুনীর চৌধুরী এ সংলাপের মধ্য দিয়েহাজার বছরের বন্দি শিকল ভেঙ্গে বাঙালি জাতিসত্তার স্বাধীনতা ও মুক্তি তথা অধিকার আদায়েআপামর জনতাকে জেগে ওঠার উদাত্ত আহ্বান জানালেন। তাঁর এ সাহসী উচ্চারণ যেন মুক্তির নেশায়ছড়িয়ে গেল পঞ্চান্ন হাজার পাঁচশত আটানব্বই বর্গমাইল। আসলে পুরো নাটকটিই যেন বাঙালি অস্তিত্বের সংগ্রাম আর দুর্বিনীত বীরত্বের বিপুল শক্তির উদ্ভাসে ঋদ্ধ। আমরা যদি আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করি, তবে বলতেই হয়Ñ‘কবর’ নাটকের গভীরতা ও মাহাত্ম্য এতই সুদূরপ্রসারী, তা একদিকে যেমন আত্মবোধের উত্থান ও সাম্যবাদী সমাজ মনস্কতার চূড়ান্ত উদাহরণ, অন্যদিকে অসম শক্তিমত্তায়উন্মত্ত পৃথিবীর বিবর্জিত বিবেকের বিকারগ্রস্ত চিত্র উন্মোচিত হয়েছে।

‘কবর’ নাটকে মার্কিন নাট্যকার আরউইন শ-র ‘বারি দ্য ডেড’ (১৯৩৬) নাটকটির প্রভাব আছে বলে কিছু কিছু সমালোচক মনে করেন। ‘বারি দ্য ডেড’ নাটকটিতে বিশ্বযুদ্ধে নিহত তরুণরা কবরে যেতে অস্বীকার করেছেন, যা মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকের সাথে ভাবগত ঐক্য অনেকটাই বিদ্যমান। তবে প্রসঙ্গত বলতেই হয়Ñ‘কবর’ নাটকটির প্রেক্ষাপট ভাষা আন্দোলন হলেও মুনীর চৌধুরী সমাজের বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধেও মারাত্মক চপেটাঘাত করেছেন।

সবশেষে বলবোÑ নাটকটির পরিসমাপ্তি যেন মুনীর চৌধুরীর শাণিত চেতনাকে অনেকটাই আপোসকামী করেছে বলেই প্রতীয়মান হয়। তবে বলতেই হবেÑ ‘কবর’ নাটকটি ইতিহাসের ইতিহাস। যা যুগে-যুগে, কালে-কালে, সকল অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চেতনার এক উজ্জ্বল মাইলফলক।

back to top