নূর-ই আলম সিদ্দিকী
নরেন্দ্রনাথ মিত্র / জন্ম : ১৯১৬-১৯৭৫
বাংলা ভাষার শক্তিশালী ছোটগল্পকার নরেন্দ্রনাথ মিত্র (১৯১৬-১৯৭৬)। কালপ্রবাহে এ কথাসাহিত্যিকের জন্মের পর অতিক্রান্ত হলো অনেকগুলো বছর। দিনসংখ্যা গণনায় তাঁর জন্মবার্ষিক ৩০ জানুয়ারি। জগতের কৃতীমানরা পৃথিবী ছেড়ে চলে যান, পেছনে রেখে যান তাঁদের অসামান্য কৃতি। সেই সৃষ্টি সরণিতে পা ফেলে পরবর্তী প্রজন্ম সামনে চলা এবং উপরে ওঠার দিশা পায়। আলোকিত পূর্বসূরিদের সাহিত্য পাঠ তাই উত্তর-প্রজন্মের জন্য প্রাসঙ্গিকভাবে অপরিহার্য। বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় নরেন্দ্রনাথ মিত্র একজন সার্থক কথানির্মাতা। যাঁর জীবন-সন্ধানী ও নৈর্ব্যক্তিক ভাব-মানসকে জানা আমাদের প্রয়োজনেই একান্ত অপরিহার্য অনুষঙ্গ। দুঃখজনক হলেও সত্য মানবিক অনুভূতিতে দ্যুতিমান এই লেখকের সাহিত্যকর্ম নিয়ে এপার-ওপার বাংলায় তেমন আয়োজন চোখে পড়েনা বললেই চলে। আয়োজনের ঘনঘটা আকার পাওয়া না পাওয়া বড় কথা নয়। বরং বিপুল পরিমাণ গল্প,উপন্যাস ও প্রবন্ধে তিনি কতখানি প্রাতিস্বিক তাই বিবেচনার বিষয়। নরেন্দ্রনাথ মিত্র ৪০-এর দশকের গল্পকার। ১৯১৬ সনে অবিভক্ত বাঙলার ফরিদপুরের ভাঙা থানায় তাঁর জন্ম। এই মহান লেখক যে সময় গল্পের জগতে প্রবেশ করেন তখন বাংলার আকাশ ছিলো অসংখ্য ঘটনার বিষবাষ্পে উত্তপ্ত। মোরা একবৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান/মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তার প্রাণ-অভিন্ন এই বোধ ভেঙ্গে যায় ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের আঘাতে। এরপর বাংলার আকাশে ঘটে একের পর এক অস্বাভাবিক ঘটনা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দোলায় প্রকম্পিত হয়ে ওঠে সমাজ, রাষ্ট্র ও মানবিকতা। সাহিত্যধারায় বাংলা ছোটগল্পের আঙিনা তখন রবীন্দ্র-প্রভাব উত্তরণে কল্লোলীয় ও মার্কসবাদী ঘরানার লেখকদের পদচারণায় উদীপ্ত। একইসঙ্গে সাহিত্য-ভূমি আলোড়িত হয়ে ওঠে ফ্রয়েডীয় ধারণায়। এক কথায় বিশ্বসাহিত্যের বিষয় ও প্রকরণ নিয়ে শুরু হয় বাংলা সাহিত্যের নিরীক্ষা। ঠিক সে সময়ে বাংলার মানুষের ভাগ্যে সব থেকে বড় দুর্ঘটনা ঘটে। ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইনে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে চিরদিনের বিরোধ সৃষ্টি হয়। ১৯৩৯ সনের বিশ্বযুদ্ধ ভারতবর্ষে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ঔপনিবেশিক শাসকদের অবহেলা আর তৎকালীন বাঙলা সরকারের ব্যর্থতায় ১৯৪৩ সনে নেমে আসে ভয়াল দুর্ভিক্ষ। খাদ্য অভাবে মারা যায় প্রায় ৩৫ লক্ষ মানুষ। পরের বছর ১৯৪৪ সনে দেখা দেয় বস্ত্রসংকট। অন্ন ও বস্ত্রের অভাবে দিশাহারা হয়ে পড়ে দেশবাসী। ১৯৪৫-এর যুদ্ধ শেষ হতেই স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ হয় নতুন মাত্রা। মানুষের জীবন থিতু না হতেই ১৯৪৬ সনে সংঘটিত হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতো মারাত্মক বিপর্যয়। এই দুর্বিপাকের মধ্যে ঘটে ’৪৭ সালে দেশভাগ। যুদ্ধ মন্বন্তর, দাঙ্গা ও দেশভাগের অভিশাপে মানুষের পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবনে দেখা দেয় গভীর যন্ত্রণা ও নৈরাজ্য। সোজাকথায়, ব্যক্তি-পরিবার ও সমাজজীবনে প্রচলিত বিশ্বাস,ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধ বিনষ্টি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্লাবন তার সবটুকুকে শিকড়সমেত ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ছেচল্লিশ ও সাতচল্লিশ উত্তর সময়ে এপার-ওপার বাংলার প্রায় এক কোটি পনের লক্ষ মানুষ জীবনের নিরাপত্তা আর অজানা ভয়ে পূর্ব-পশ্চিমে ছুটতে থাকে। ঘরহারা মানুষ চোখের নিমিষে অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক জীবনে হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। দেশভাগের অভিঘাতে ছিন্নমূল মানুষে ভরে যায় কলকাতাসহ তার আশে-পাশের এলাকা। শূন্য হাতে অচেনা জায়গায় জীবনের মৌলিক সমস্যা-সংকটে অসহায় মানুষগুলো চারিদিকে অন্ধকার দেখতে থাকে। একইসঙ্গে কলকাতায় বসবাসকারী মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনেও নেমে আসে অপ্রত্যাশিত দুর্দশা। বাঁচার তাগিদে বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবনে ঘটে অবনমন। গল্পকার নরেন্দ্রনাথ মিত্র ঠিক এই সময়ে বাংলা ছোটগল্প রচনায় হাত দেন। রবীন্দ্রনাথ আর তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের (মানিক-বিভূতি-তারাশঙ্কর) সৃষ্টিসম্ভারে বাঙলা সাহিত্যের আকাশ তখন আলোকময়। সেই আলোকদীপ্র সময়ে নরেন্দ্রনাথ গল্পের জগতে নিজেকে প্রকাশ করেন। নরেন্দ্রনাথ মিত্র ব্যক্তিমানুষ হিসেবে ছিলেন মানবিক ও সংবেদনশীল। ফলে প্রত্যক্ষ বিশ্বরাজনীতি ও ভারতবর্ষের অভ্যন্তরীণ সংকট ও তা থেকে সৃষ্ট ক্ষত তাঁর শিল্পীহৃদয়ে গভীর ছাপ ফেলে। চল্লিশের দশকের বিক্ষুব্ধ সময় ও তার করুণ পরিণতি তাঁর লেখায় জায়গা পেতে থাকে সামাজিক দায়বোধ থেকে। লেখনি শুরু করেছিলেন ১৯৩৬ সনে দেশ পত্রিকায় ‘মূক’ নামক কবিতা দিয়ে। একই বছরে ঐ পত্রিকাতে প্রথম গল্প-মৃত্যু ও জীবন- লিখে পা রাখেন গল্পের আঙিনায়। তারপর থেকে নিয়মিত লিখতে থাকেন গল্প, প্রবন্ধ ও উপন্যাস। সাহিত্যের অন্য শাখা থেকে ছোটগল্প বিনির্মাণে সবচেয়ে বেশি সফলতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। বলতে দ্বিধা নেই তাঁর গল্প বৈশিষ্ট্যে ও অভিনবত্বে বাংলা সাহিত্যে তথা বিশ্বসাহিত্যে এক অনন্য সৃষ্টি। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্প, উপন্যাস মূল্যায়ন করে একশ্রেণির সাহিত্যিক ও গবেষক বলেছেন তিনি নাগরিক মনস্ক মধ্যবিত্ত জীবনের পালাকার। আবার আরেক শ্রেণির সাহিত্যসমালোচক তাঁকে অভিহিত করেছেন মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত জীবনের চিত্রকর হিসেবে। কেউ কেউ আবার তাঁর গল্পে সমসাময়িক ঘটনার প্রত্যক্ষ পরিচয় নেই বলেও অভিমত রেখেছেন। অর্থাৎ রাজনীতির প্রত্যক্ষ উত্তাপ নিয়ে কম গল্প রচনা করেছেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র। কিন্তু প্রকৃত বিষয় হলো তাঁর গল্পে সে সময়ের ঘটনা নয় বরং ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় জনজীবনে যে অবর্ণনীয় কষ্ট ও যাতনা এসেছে তাই শিল্পিত সত্যের অঙ্গীকারে পরিস্ফুটিত করেছেন। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্পের শরীর জুড়ে আছে দেশভাগোত্তর সময়ের বিপন্ন ও অসহায় মানুষের মর্মন্তুদ চাহনি। তাঁর গল্পের বিষয় সম্পর্কে বলতে গিয়ে সমালোচক বলেন, দেশের দুর্দশা মন্বন্তর এবং মানুষের মধ্যে যে বেকারত্ব,হতাশা বোধ এসেছিল সেই সব নিয়েই তিনি গল্প উপন্যাস রচনা করেছেন। তাই তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যে যুদ্ধ বা মন্বন্তরের তুলনায় যুদ্ধ বা মন্বন্তরের কবলে পড়া মানুষের দুর্দশার কথা বেশি পাওয়া যায়। ১৯৪৭-এর বেদনাময় ঘটনা ঘরহারা মানুষকে অভিশাপের অন্ধকারে নিক্ষেপ করে। উন্মূল মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত অসহায় বাঙালি আশ্রয় নেয় ফুটপাত, রেলস্টেশন ও বস্তিতে। পূর্ব-জীবনের প্রবহমান অর্থনৈতিক বিন্যাস নষ্ট হবার কারণে তারা হতাশ হয়ে পড়ে। নতুন জায়গায় ছিন্নমূল মানুষ দেখতে পায় সামনে নিরাশা, ব্যথা-বেদনা,দুঃখ আর বিড়ম্বনা। বিপন্ন বাঙালির এই প্রতিকূল প্রতিবেশ, বিক্ষিপ্ত সামাজিক বিন্যাস, বাঁচার ব্যাকুল চেষ্টা,মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা এবং নর-নারীর সম্পর্কের নানান দিককে গল্পে সযতেœ তুলে ধরেছেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র। তবে বিক্ষুব্ধ সময়ের ছিন্নমূল মানুষের ভেতরের এই বেদনাকে শিল্পরূপ দিতে গিয়ে রাজনীতি ও দাঙ্গার মতো ভয়ানক ক্ষতকে নিয়ে তিনি আক্ষরিক অর্থে খুব বেশি গল্পে রচনা করেননি। নিজের গল্প সম্পর্কে তাই এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, ঘৃণা বিদ্বেষ ব্যঙ্গ বিদ্রƒপ বৈরিতা আমাকে লেখায় প্রবৃত্ত করেনি। বরং বিপরীত দিকের প্রীতি প্রেম সৌহার্দ্য, স্নেহ, শ্রদ্ধা ভালোবাসা,পারিবারিক গ-ির ভেতরে ও বাইরে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিচিত্র সম্পর্ক, বার বার আমার গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে। আমরা তাঁর গল্পে ভেতর তাই চেনা মানুষের সমস্যা ও তা থেকে উত্তীর্ণ হবার সংগ্রাম এবং তাদের সদর্থক পরিণতি প্রচেষ্টাকে লক্ষ করি। সামাজিক-অর্থনৈতিক জীবনের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিমানুষের মর্মবেদনার সুরটিকে তিনি অনুরণিত করে তুলেছেন গল্পের ভেতর। নরেন্দ্রনাথের গল্প নিবিড় পাঠে নজরে পড়ে দেশভাগের গল্প, প্রেমের গল্প, অর্থ-সংকটের গল্প, সামাজিক সমস্যার গল্প,মনস্তত্ত্বের গল্প এবং পতিতা ও বিধবাদের অনুরাগের গল্প। বিষয়বৈচিত্র্য প্রবণতার প্রেক্ষাপটে বিভাজনকৃত তাঁর গল্পগুলো যেমন জীবনবাস্তবতায় উজ্জ্বল, তেমনি স্বতন্ত্র পরিচয়েও দীপ্যমান। দেশভাগ পরের ইতিহাসে চোখ রাখলে আমরা লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু মানুষের পরিবর্তনশীল অসহায় জীবনকে পাই। যারা প্রতি মুহূর্তে পিষ্ট হয়েছে অপ্রত্যাশিত সমস্যায়। ছিন্নমূল জীবনে মাথা গোঁজার একটু সুযোগ পেলেও বেঁচে থাকার সংগ্রামে প্রতিমুহূর্তে ক্লেদাক্ত হয়েছে নিজের মধ্যে। অস্তিত্ব রক্ষার জন্য জীবনযুদ্ধে নেমে তারা শৈশবে অর্জিত মূল্যবোধ বিসর্জন দিতে না পারার যন্ত্রণায় ছটফট করেছে অহর্নিশ। গল্পকারের দেশভাগের উপর রচিত গল্পের মধ্যে আমরা এই অসহায়ত্বের প্রত্যক্ষ ছবির সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠি। এ জাতীয় গল্পগুলোর মধ্যে-দাঁতা, হেডমাস্টার, পেশা,আকিঞ্চন, কাঠগোলাপ,চিঠি, ঠোঙা, রঙ, শুল্ক অন্যতম। জীবনের মৌল অনুভূতির নাম প্রেম। সব শিল্পের প্রেরণা হিসেবে কাজ করে এই প্রেম। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের প্রেমনির্ভর গল্পের সংখ্যা প্রচুর। তাঁর রচিত প্রেমের গল্পের ব্যাপক রকমফের। তার মধ্যে অসম প্রেমের গল্প,দাম্পত্য প্রেমের গল্প,অবৈধ প্রণয়ের গল্প,অবিবাহিত নর-নারীর গল্প প্রভৃতি। মানবজীবনের সঙ্গে টাকার সম্পর্ক অভিন্ন। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের এই অর্থ-সংকটের কথা নরেন্দ্রনাথের গল্পে নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে। সাহিত্যের ভিন্ন সংরূপ থেকে কথাসাহিত্যে জীবন ও টাকার সংযোগ প্রবল। বাংলা উপন্যাসে যাঁদের লেখায় প্রথম অর্থ-সংকটের কথা পাই,তাঁরা হলেন- তারকনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের। এরপর অর্থ-সংকটকে দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথের দেনাপাওনা গল্পে। কিন্তু ততদিনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অর্থনৈতিক পরিকাঠামো যে মানব অস্তিত্বের নিয়ামক- এই নির্মম সত্যের মুখোমুখি হয় কথাসাহিত্য। অতঃপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে বিশ্ব বাজারে যে অর্থনৈতিক মন্দা নেমে আসে তার প্রভাব পড়ে বাঙালি জীবনে। যুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা আর দেশভাগের ফলে দেশে বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বিরূপ এই পরিস্থিতিতে অর্থের কারণে জীবনের সকল ক্ষেত্র ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। একজন বড় মাপের শিল্পী হিসেবে নরেন্দ্রনাথ মিত্র বিষয়টিকে গভীরভাবে অনুভব করেন। এবং অসামান্য দক্ষতায় তাঁর গল্পে টাকা ও মনস্তত্ত্বের আশ্চর্য রসায়ন ঘটান। বিত্তহীন মানুষের অর্থ-সংকটের উপর তিনি লিখেছেন, চোর,সিগারেট,একটি দশ টাকার নোট, চড়াই-উৎরাই ও ছবির মতো অসাধারণ গল্প। গল্পের ভাষা নির্মাণের ক্ষেত্রেও নরেন্দ্রনাথ মিত্র বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। গল্পের প্লটের সঙ্গে চরিত্রের কার্যকারণ সূত্র গড়ে ওঠে ভাষার মাধ্যমে। কেননা কাহিনী চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যায় গল্পের চরিত্রসমূহের পারস্পরিক সংলাপের ভেতর দিয়ে। ফলে ভাববস্তুর সঙ্গে যথাযথ ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে একজন সাহিত্যিক তাঁর সাহিত্যকর্মকে শিল্পিত মাত্রায় নিয়ে যেতে পারেন। শুধু তাই নয়, একজন কৃতিমান লেখকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো গল্পের ভাষায় স্বাতন্ত্রিকতা সৃষ্টি। নরেন্দ্রনাথ মিত্র তাঁর গল্পে ভাষার বৈচিত্র্য ব্যবহারেও কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি ভাষা প্রয়োগে সমকালের অন্য গল্পকারদের থেকে যে প্রাতিস্বিকতার পরিচয় দিয়েছেন তাহলো তাঁর গল্পে ভাষার প্রাঞ্জল ব্যবহার। গল্পের ভাষা সহজ-সরল বলে তা পাঠ করে পাঠকের ক্লান্তি অনুভব হয় না কখনো। গল্পকারের বিখ্যাত ‘পালঙ্ক’ গল্পের একটি ছোট্ট উক্তির মাধ্যমে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাঁর যথার্থ দক্ষতার পরিচয় অনুভব করা যায়- দুধে জল মিশাইছিস বইলা চিঠিতেও জল মিশাইছস, তোর সবটাতেই জল হারামজাদা। নরেন্দ্রনাথ মিত্র ছোটগল্পের একজন বড় লেখক। কিন্তু শক্তিশালী কথানির্মাতা হয়েও তিনি অনেকটাই যেন পাঠকের আড়ালে রয়েছেন। অথচ তাঁর রচনায় দেখানো সমাজ ও মানুষকে আমাদের অগ্রগতির প্রয়োজনেই আজ একান্তভাবে জানা দরকার। বিখ্যাত এ-লেখকের সৃষ্টির পরিচয় জানতে এবং চল্লিশ থেকে সত্তরের দশকের বিপন্ন মানুষের জীবনবাস্তবতা বুঝতে পাঠকের তথা আমাদের উঠে আসতে হবে তাঁর সৃষ্টির আঙিনায়। কিন্তু সে জন্য প্রয়োজন গভীর অনুসন্ধিৎসু মন, অসীম ধৈর্য ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধ। গল্পকার নরেন্দ্রনাথ মিত্র আলোকিত পৃথিবীতে এসেছিলেন ১৯১৬ সালের ত্রিশ জানুয়ারি। বাঙালি পাঠকের কাছে আপন প্রতিভায় স্মরণীয় রয়েছেন মানব হয়ে তাঁর অবিস্মরণীয় সৃষ্টির মধ্যে। কৃতিমান এই লেখককে স্মরণ করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বাণীর প্রস্বরে প্রতিধ্বনি করি বারংবার প্রতিবার-
“জীবনের যাত্রাপথে যাত্রীদল চলে
বিরাম বিরতিহীন কে বা মনে রাখে।
তবুও তারি মাঝে ক্ষণিক দাঁড়ায়ে স্মৃতির ফলকে
যাঁরা পদচিহ্ন রাখে,তারা মনে থাকে।”
২০২৫ সালের ৩০ জানুয়ারিতে পূর্ণ হলো এ মহান লেখকের জন্মের একশত নয় বছর। প্রতিভাবান এ-গল্পকারকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। নরেন্দ্রনাথ মিত্র বাঙালি পাঠকের মাঝে বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আজ, এখন, তখন এবং সর্বক্ষণ।
নূর-ই আলম সিদ্দিকী
নরেন্দ্রনাথ মিত্র / জন্ম : ১৯১৬-১৯৭৫
বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫
বাংলা ভাষার শক্তিশালী ছোটগল্পকার নরেন্দ্রনাথ মিত্র (১৯১৬-১৯৭৬)। কালপ্রবাহে এ কথাসাহিত্যিকের জন্মের পর অতিক্রান্ত হলো অনেকগুলো বছর। দিনসংখ্যা গণনায় তাঁর জন্মবার্ষিক ৩০ জানুয়ারি। জগতের কৃতীমানরা পৃথিবী ছেড়ে চলে যান, পেছনে রেখে যান তাঁদের অসামান্য কৃতি। সেই সৃষ্টি সরণিতে পা ফেলে পরবর্তী প্রজন্ম সামনে চলা এবং উপরে ওঠার দিশা পায়। আলোকিত পূর্বসূরিদের সাহিত্য পাঠ তাই উত্তর-প্রজন্মের জন্য প্রাসঙ্গিকভাবে অপরিহার্য। বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় নরেন্দ্রনাথ মিত্র একজন সার্থক কথানির্মাতা। যাঁর জীবন-সন্ধানী ও নৈর্ব্যক্তিক ভাব-মানসকে জানা আমাদের প্রয়োজনেই একান্ত অপরিহার্য অনুষঙ্গ। দুঃখজনক হলেও সত্য মানবিক অনুভূতিতে দ্যুতিমান এই লেখকের সাহিত্যকর্ম নিয়ে এপার-ওপার বাংলায় তেমন আয়োজন চোখে পড়েনা বললেই চলে। আয়োজনের ঘনঘটা আকার পাওয়া না পাওয়া বড় কথা নয়। বরং বিপুল পরিমাণ গল্প,উপন্যাস ও প্রবন্ধে তিনি কতখানি প্রাতিস্বিক তাই বিবেচনার বিষয়। নরেন্দ্রনাথ মিত্র ৪০-এর দশকের গল্পকার। ১৯১৬ সনে অবিভক্ত বাঙলার ফরিদপুরের ভাঙা থানায় তাঁর জন্ম। এই মহান লেখক যে সময় গল্পের জগতে প্রবেশ করেন তখন বাংলার আকাশ ছিলো অসংখ্য ঘটনার বিষবাষ্পে উত্তপ্ত। মোরা একবৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান/মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তার প্রাণ-অভিন্ন এই বোধ ভেঙ্গে যায় ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের আঘাতে। এরপর বাংলার আকাশে ঘটে একের পর এক অস্বাভাবিক ঘটনা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দোলায় প্রকম্পিত হয়ে ওঠে সমাজ, রাষ্ট্র ও মানবিকতা। সাহিত্যধারায় বাংলা ছোটগল্পের আঙিনা তখন রবীন্দ্র-প্রভাব উত্তরণে কল্লোলীয় ও মার্কসবাদী ঘরানার লেখকদের পদচারণায় উদীপ্ত। একইসঙ্গে সাহিত্য-ভূমি আলোড়িত হয়ে ওঠে ফ্রয়েডীয় ধারণায়। এক কথায় বিশ্বসাহিত্যের বিষয় ও প্রকরণ নিয়ে শুরু হয় বাংলা সাহিত্যের নিরীক্ষা। ঠিক সে সময়ে বাংলার মানুষের ভাগ্যে সব থেকে বড় দুর্ঘটনা ঘটে। ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইনে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে চিরদিনের বিরোধ সৃষ্টি হয়। ১৯৩৯ সনের বিশ্বযুদ্ধ ভারতবর্ষে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ঔপনিবেশিক শাসকদের অবহেলা আর তৎকালীন বাঙলা সরকারের ব্যর্থতায় ১৯৪৩ সনে নেমে আসে ভয়াল দুর্ভিক্ষ। খাদ্য অভাবে মারা যায় প্রায় ৩৫ লক্ষ মানুষ। পরের বছর ১৯৪৪ সনে দেখা দেয় বস্ত্রসংকট। অন্ন ও বস্ত্রের অভাবে দিশাহারা হয়ে পড়ে দেশবাসী। ১৯৪৫-এর যুদ্ধ শেষ হতেই স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ হয় নতুন মাত্রা। মানুষের জীবন থিতু না হতেই ১৯৪৬ সনে সংঘটিত হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতো মারাত্মক বিপর্যয়। এই দুর্বিপাকের মধ্যে ঘটে ’৪৭ সালে দেশভাগ। যুদ্ধ মন্বন্তর, দাঙ্গা ও দেশভাগের অভিশাপে মানুষের পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবনে দেখা দেয় গভীর যন্ত্রণা ও নৈরাজ্য। সোজাকথায়, ব্যক্তি-পরিবার ও সমাজজীবনে প্রচলিত বিশ্বাস,ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধ বিনষ্টি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্লাবন তার সবটুকুকে শিকড়সমেত ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ছেচল্লিশ ও সাতচল্লিশ উত্তর সময়ে এপার-ওপার বাংলার প্রায় এক কোটি পনের লক্ষ মানুষ জীবনের নিরাপত্তা আর অজানা ভয়ে পূর্ব-পশ্চিমে ছুটতে থাকে। ঘরহারা মানুষ চোখের নিমিষে অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক জীবনে হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। দেশভাগের অভিঘাতে ছিন্নমূল মানুষে ভরে যায় কলকাতাসহ তার আশে-পাশের এলাকা। শূন্য হাতে অচেনা জায়গায় জীবনের মৌলিক সমস্যা-সংকটে অসহায় মানুষগুলো চারিদিকে অন্ধকার দেখতে থাকে। একইসঙ্গে কলকাতায় বসবাসকারী মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনেও নেমে আসে অপ্রত্যাশিত দুর্দশা। বাঁচার তাগিদে বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবনে ঘটে অবনমন। গল্পকার নরেন্দ্রনাথ মিত্র ঠিক এই সময়ে বাংলা ছোটগল্প রচনায় হাত দেন। রবীন্দ্রনাথ আর তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের (মানিক-বিভূতি-তারাশঙ্কর) সৃষ্টিসম্ভারে বাঙলা সাহিত্যের আকাশ তখন আলোকময়। সেই আলোকদীপ্র সময়ে নরেন্দ্রনাথ গল্পের জগতে নিজেকে প্রকাশ করেন। নরেন্দ্রনাথ মিত্র ব্যক্তিমানুষ হিসেবে ছিলেন মানবিক ও সংবেদনশীল। ফলে প্রত্যক্ষ বিশ্বরাজনীতি ও ভারতবর্ষের অভ্যন্তরীণ সংকট ও তা থেকে সৃষ্ট ক্ষত তাঁর শিল্পীহৃদয়ে গভীর ছাপ ফেলে। চল্লিশের দশকের বিক্ষুব্ধ সময় ও তার করুণ পরিণতি তাঁর লেখায় জায়গা পেতে থাকে সামাজিক দায়বোধ থেকে। লেখনি শুরু করেছিলেন ১৯৩৬ সনে দেশ পত্রিকায় ‘মূক’ নামক কবিতা দিয়ে। একই বছরে ঐ পত্রিকাতে প্রথম গল্প-মৃত্যু ও জীবন- লিখে পা রাখেন গল্পের আঙিনায়। তারপর থেকে নিয়মিত লিখতে থাকেন গল্প, প্রবন্ধ ও উপন্যাস। সাহিত্যের অন্য শাখা থেকে ছোটগল্প বিনির্মাণে সবচেয়ে বেশি সফলতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। বলতে দ্বিধা নেই তাঁর গল্প বৈশিষ্ট্যে ও অভিনবত্বে বাংলা সাহিত্যে তথা বিশ্বসাহিত্যে এক অনন্য সৃষ্টি। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্প, উপন্যাস মূল্যায়ন করে একশ্রেণির সাহিত্যিক ও গবেষক বলেছেন তিনি নাগরিক মনস্ক মধ্যবিত্ত জীবনের পালাকার। আবার আরেক শ্রেণির সাহিত্যসমালোচক তাঁকে অভিহিত করেছেন মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত জীবনের চিত্রকর হিসেবে। কেউ কেউ আবার তাঁর গল্পে সমসাময়িক ঘটনার প্রত্যক্ষ পরিচয় নেই বলেও অভিমত রেখেছেন। অর্থাৎ রাজনীতির প্রত্যক্ষ উত্তাপ নিয়ে কম গল্প রচনা করেছেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র। কিন্তু প্রকৃত বিষয় হলো তাঁর গল্পে সে সময়ের ঘটনা নয় বরং ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় জনজীবনে যে অবর্ণনীয় কষ্ট ও যাতনা এসেছে তাই শিল্পিত সত্যের অঙ্গীকারে পরিস্ফুটিত করেছেন। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্পের শরীর জুড়ে আছে দেশভাগোত্তর সময়ের বিপন্ন ও অসহায় মানুষের মর্মন্তুদ চাহনি। তাঁর গল্পের বিষয় সম্পর্কে বলতে গিয়ে সমালোচক বলেন, দেশের দুর্দশা মন্বন্তর এবং মানুষের মধ্যে যে বেকারত্ব,হতাশা বোধ এসেছিল সেই সব নিয়েই তিনি গল্প উপন্যাস রচনা করেছেন। তাই তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যে যুদ্ধ বা মন্বন্তরের তুলনায় যুদ্ধ বা মন্বন্তরের কবলে পড়া মানুষের দুর্দশার কথা বেশি পাওয়া যায়। ১৯৪৭-এর বেদনাময় ঘটনা ঘরহারা মানুষকে অভিশাপের অন্ধকারে নিক্ষেপ করে। উন্মূল মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত অসহায় বাঙালি আশ্রয় নেয় ফুটপাত, রেলস্টেশন ও বস্তিতে। পূর্ব-জীবনের প্রবহমান অর্থনৈতিক বিন্যাস নষ্ট হবার কারণে তারা হতাশ হয়ে পড়ে। নতুন জায়গায় ছিন্নমূল মানুষ দেখতে পায় সামনে নিরাশা, ব্যথা-বেদনা,দুঃখ আর বিড়ম্বনা। বিপন্ন বাঙালির এই প্রতিকূল প্রতিবেশ, বিক্ষিপ্ত সামাজিক বিন্যাস, বাঁচার ব্যাকুল চেষ্টা,মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা এবং নর-নারীর সম্পর্কের নানান দিককে গল্পে সযতেœ তুলে ধরেছেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র। তবে বিক্ষুব্ধ সময়ের ছিন্নমূল মানুষের ভেতরের এই বেদনাকে শিল্পরূপ দিতে গিয়ে রাজনীতি ও দাঙ্গার মতো ভয়ানক ক্ষতকে নিয়ে তিনি আক্ষরিক অর্থে খুব বেশি গল্পে রচনা করেননি। নিজের গল্প সম্পর্কে তাই এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, ঘৃণা বিদ্বেষ ব্যঙ্গ বিদ্রƒপ বৈরিতা আমাকে লেখায় প্রবৃত্ত করেনি। বরং বিপরীত দিকের প্রীতি প্রেম সৌহার্দ্য, স্নেহ, শ্রদ্ধা ভালোবাসা,পারিবারিক গ-ির ভেতরে ও বাইরে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিচিত্র সম্পর্ক, বার বার আমার গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে। আমরা তাঁর গল্পে ভেতর তাই চেনা মানুষের সমস্যা ও তা থেকে উত্তীর্ণ হবার সংগ্রাম এবং তাদের সদর্থক পরিণতি প্রচেষ্টাকে লক্ষ করি। সামাজিক-অর্থনৈতিক জীবনের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিমানুষের মর্মবেদনার সুরটিকে তিনি অনুরণিত করে তুলেছেন গল্পের ভেতর। নরেন্দ্রনাথের গল্প নিবিড় পাঠে নজরে পড়ে দেশভাগের গল্প, প্রেমের গল্প, অর্থ-সংকটের গল্প, সামাজিক সমস্যার গল্প,মনস্তত্ত্বের গল্প এবং পতিতা ও বিধবাদের অনুরাগের গল্প। বিষয়বৈচিত্র্য প্রবণতার প্রেক্ষাপটে বিভাজনকৃত তাঁর গল্পগুলো যেমন জীবনবাস্তবতায় উজ্জ্বল, তেমনি স্বতন্ত্র পরিচয়েও দীপ্যমান। দেশভাগ পরের ইতিহাসে চোখ রাখলে আমরা লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু মানুষের পরিবর্তনশীল অসহায় জীবনকে পাই। যারা প্রতি মুহূর্তে পিষ্ট হয়েছে অপ্রত্যাশিত সমস্যায়। ছিন্নমূল জীবনে মাথা গোঁজার একটু সুযোগ পেলেও বেঁচে থাকার সংগ্রামে প্রতিমুহূর্তে ক্লেদাক্ত হয়েছে নিজের মধ্যে। অস্তিত্ব রক্ষার জন্য জীবনযুদ্ধে নেমে তারা শৈশবে অর্জিত মূল্যবোধ বিসর্জন দিতে না পারার যন্ত্রণায় ছটফট করেছে অহর্নিশ। গল্পকারের দেশভাগের উপর রচিত গল্পের মধ্যে আমরা এই অসহায়ত্বের প্রত্যক্ষ ছবির সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠি। এ জাতীয় গল্পগুলোর মধ্যে-দাঁতা, হেডমাস্টার, পেশা,আকিঞ্চন, কাঠগোলাপ,চিঠি, ঠোঙা, রঙ, শুল্ক অন্যতম। জীবনের মৌল অনুভূতির নাম প্রেম। সব শিল্পের প্রেরণা হিসেবে কাজ করে এই প্রেম। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের প্রেমনির্ভর গল্পের সংখ্যা প্রচুর। তাঁর রচিত প্রেমের গল্পের ব্যাপক রকমফের। তার মধ্যে অসম প্রেমের গল্প,দাম্পত্য প্রেমের গল্প,অবৈধ প্রণয়ের গল্প,অবিবাহিত নর-নারীর গল্প প্রভৃতি। মানবজীবনের সঙ্গে টাকার সম্পর্ক অভিন্ন। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের এই অর্থ-সংকটের কথা নরেন্দ্রনাথের গল্পে নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে। সাহিত্যের ভিন্ন সংরূপ থেকে কথাসাহিত্যে জীবন ও টাকার সংযোগ প্রবল। বাংলা উপন্যাসে যাঁদের লেখায় প্রথম অর্থ-সংকটের কথা পাই,তাঁরা হলেন- তারকনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের। এরপর অর্থ-সংকটকে দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথের দেনাপাওনা গল্পে। কিন্তু ততদিনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অর্থনৈতিক পরিকাঠামো যে মানব অস্তিত্বের নিয়ামক- এই নির্মম সত্যের মুখোমুখি হয় কথাসাহিত্য। অতঃপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে বিশ্ব বাজারে যে অর্থনৈতিক মন্দা নেমে আসে তার প্রভাব পড়ে বাঙালি জীবনে। যুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা আর দেশভাগের ফলে দেশে বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বিরূপ এই পরিস্থিতিতে অর্থের কারণে জীবনের সকল ক্ষেত্র ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। একজন বড় মাপের শিল্পী হিসেবে নরেন্দ্রনাথ মিত্র বিষয়টিকে গভীরভাবে অনুভব করেন। এবং অসামান্য দক্ষতায় তাঁর গল্পে টাকা ও মনস্তত্ত্বের আশ্চর্য রসায়ন ঘটান। বিত্তহীন মানুষের অর্থ-সংকটের উপর তিনি লিখেছেন, চোর,সিগারেট,একটি দশ টাকার নোট, চড়াই-উৎরাই ও ছবির মতো অসাধারণ গল্প। গল্পের ভাষা নির্মাণের ক্ষেত্রেও নরেন্দ্রনাথ মিত্র বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। গল্পের প্লটের সঙ্গে চরিত্রের কার্যকারণ সূত্র গড়ে ওঠে ভাষার মাধ্যমে। কেননা কাহিনী চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যায় গল্পের চরিত্রসমূহের পারস্পরিক সংলাপের ভেতর দিয়ে। ফলে ভাববস্তুর সঙ্গে যথাযথ ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে একজন সাহিত্যিক তাঁর সাহিত্যকর্মকে শিল্পিত মাত্রায় নিয়ে যেতে পারেন। শুধু তাই নয়, একজন কৃতিমান লেখকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো গল্পের ভাষায় স্বাতন্ত্রিকতা সৃষ্টি। নরেন্দ্রনাথ মিত্র তাঁর গল্পে ভাষার বৈচিত্র্য ব্যবহারেও কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি ভাষা প্রয়োগে সমকালের অন্য গল্পকারদের থেকে যে প্রাতিস্বিকতার পরিচয় দিয়েছেন তাহলো তাঁর গল্পে ভাষার প্রাঞ্জল ব্যবহার। গল্পের ভাষা সহজ-সরল বলে তা পাঠ করে পাঠকের ক্লান্তি অনুভব হয় না কখনো। গল্পকারের বিখ্যাত ‘পালঙ্ক’ গল্পের একটি ছোট্ট উক্তির মাধ্যমে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাঁর যথার্থ দক্ষতার পরিচয় অনুভব করা যায়- দুধে জল মিশাইছিস বইলা চিঠিতেও জল মিশাইছস, তোর সবটাতেই জল হারামজাদা। নরেন্দ্রনাথ মিত্র ছোটগল্পের একজন বড় লেখক। কিন্তু শক্তিশালী কথানির্মাতা হয়েও তিনি অনেকটাই যেন পাঠকের আড়ালে রয়েছেন। অথচ তাঁর রচনায় দেখানো সমাজ ও মানুষকে আমাদের অগ্রগতির প্রয়োজনেই আজ একান্তভাবে জানা দরকার। বিখ্যাত এ-লেখকের সৃষ্টির পরিচয় জানতে এবং চল্লিশ থেকে সত্তরের দশকের বিপন্ন মানুষের জীবনবাস্তবতা বুঝতে পাঠকের তথা আমাদের উঠে আসতে হবে তাঁর সৃষ্টির আঙিনায়। কিন্তু সে জন্য প্রয়োজন গভীর অনুসন্ধিৎসু মন, অসীম ধৈর্য ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধ। গল্পকার নরেন্দ্রনাথ মিত্র আলোকিত পৃথিবীতে এসেছিলেন ১৯১৬ সালের ত্রিশ জানুয়ারি। বাঙালি পাঠকের কাছে আপন প্রতিভায় স্মরণীয় রয়েছেন মানব হয়ে তাঁর অবিস্মরণীয় সৃষ্টির মধ্যে। কৃতিমান এই লেখককে স্মরণ করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বাণীর প্রস্বরে প্রতিধ্বনি করি বারংবার প্রতিবার-
“জীবনের যাত্রাপথে যাত্রীদল চলে
বিরাম বিরতিহীন কে বা মনে রাখে।
তবুও তারি মাঝে ক্ষণিক দাঁড়ায়ে স্মৃতির ফলকে
যাঁরা পদচিহ্ন রাখে,তারা মনে থাকে।”
২০২৫ সালের ৩০ জানুয়ারিতে পূর্ণ হলো এ মহান লেখকের জন্মের একশত নয় বছর। প্রতিভাবান এ-গল্পকারকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। নরেন্দ্রনাথ মিত্র বাঙালি পাঠকের মাঝে বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আজ, এখন, তখন এবং সর্বক্ষণ।