alt

সাময়িকী

শহীদ সাবেরের সাহিত্য চিন্তা ও জীবনের সমন্বয়

ইলিয়াস বাবর

: বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫

শহীদ সাবের / জন্ম : ১৮ ডিসেম্বর ১৯৩০; মৃত্যু : ৩১ মার্চ ১৯৭১ প্রতিকৃতি : মাসুক হেলাল

আমরা মূলত ব্যক্তি নয় তার সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা করতে ভালোবাসি। ব্যক্তির চেয়ে বহু বড় তার সৃষ্টিসম্ভার। সৃজন-ক্ষমতায় একজন ব্যক্তিমানুষ ছাড়িয়ে যান নিজেকে। তথাপি ব্যক্তির জন্ম, ঠিকুজি, বেড়ে ওঠা প্রভাব ফেলে তার মানসগঠনে। ফলত সৃষ্টির আলাপ হলে অনিবার্যভাবে হাজির হয় তাতে জীবনের কথা, শেকড়ের কথা। শহীদ সাবেরের জন্ম ডিসেম্বর ১৮, ১৯৩০ সালে। তখন এই উপমহাদেশ বিট্রিশদের অধীন। বলা চলে জন্মসূত্রে সাবের বিট্রিশ পিরিয়ড যেমন চাক্ষুষ করেন তেমনি পাকিস্তান কালও। তাঁর পিতা সালামত উল্যাহ ছিলেন সরকারি চাকুরে, যাদের পূর্বপুরুষ ছিল পর্তুগিজ অধ্যুষিত দেয়াঙের অধিবাসী। অবশ্য পরে তিনি থিতু হন চট্টগ্রাম শহরের চন্দনপুরায় পিতার নির্মিত বাড়িতে। মাতা শফিকা খাতুন, সামলাতেন গেরস্তকর্ম। কক্সবাজার জেলার ঈদগাঁস্থ সোনাপুকুর গ্রামে নানারবাড়িতে সাবেরের জন্ম। বাবা যেহেতু সরকারি চাকুরে, সাবেরকে নানা বিদ্যালয়ে শিক্ষা নিতে হয়, এমনকি তা তৎসময়ের বিখ্যাত কলকাতায়ও। ঈদগাঁ প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে কলকাতা, ফিরে এসে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল, এরপরে চট্টগ্রাম কলেজ। অনিয়মিত ছাত্র হিসেবে জগন্নাথ কলেজ থেকে বসেন বিএ পরীক্ষায়। ছাত্র হিসেবে সাবের ছিলেন তুমুল মেধাবী, যা সাক্ষ্য দেয় তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাসনদ। এমনকি কেন্দ্রীয় ইনফরমেশন সার্ভিসের পরীক্ষায় কৃতকার্যদের মধ্যে তার অবস্থান ছিল শীর্ষে। একই সাথে পড়াশোনা, লেখালেখি, শিক্ষকতা, অনুবাদ, রাজনীতি, এত কিছু একজন অসাধারণ মেধাবী ও শ্রমনিষ্ঠ মানুষের পক্ষেই কেবল সম্ভব।

একজন লেখক চিন্তার বীজ, নিজেকে সমৃদ্ধ করবার সার পেয়ে থাকেন তাঁর শৈশব থেকে। শহীদ সাবেরের দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগের সাথে যুক্ত হয় মানুষ দেখার সুবর্ণ সূত্র। আর ছিল জন্মসূত্রে পাওয়া লোনার বিস্তার, দরিয়ার বিশালতা। দেশভাগের কঠিন দুর্যোগ তাকে দিয়েছে অনন্য শিক্ষা, চলে আসেন এ বঙ্গে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, কত বড় বড় ঘটনা তাকে সমৃদ্ধ করেছে, জিজ্ঞাসু করেছে ভাবা যায়! সৎমায়ের সাথে ছিলেন, ছোট ভাইবোনদের দায়িত্ব নিতে হয়েছে নিজের ছাত্রত্ব না যাবার কালে। সংসারের অমল-ধবল রূপ তাকে দেখতে হয়েছে শৈশবে অথচ তার নানাজান ছিলেন ঈদগাঁর জমিদার। জীবন তাকে নিয়ে কঠিন খেলায় নিয়োজিত ছিল যেনবা। ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্র ফেডারেশনের এক কর্মিসভায় বক্তৃতারত অবস্থায় অন্যদের সাথে সাবেরকেও রাজবন্দী হিসেবে পাঠানো হয় চট্টগ্রাম জেলে। তখন সাবের সদ্য মেট্রিক পাস করে ভর্তি হয়েছেন চট্টগ্রাম কলেজে। একাডেমিক বিদ্যায়তনের বড় পরিসরে যাবার প্রাক্কালে তাঁকে যেতে হলো, রাষ্ট্রের শেকলে! অবশ্য যার চিন্তা এমন, “শুধু আপনার ছেলে নই, সমাজেরও” তাঁকে আটকাতে পারে পৃথিবীর কোন মোহ? সাবেরের স্বল্পায়ুর জীবনে ছিল কেবল যুদ্ধ আর যুদ্ধ। পাকিস্তানী দুঃশাসনের কবলে কতিপয় মানুষের মুক্তির সংগ্রামটা ছিল মূলত সবারই সংগ্রাম। কিন্তু যারা থাকে অগ্রভাগে, যাদের বিবেক ভর্তি থাকে মানবিকতায় তাদের দিতে হয় চড়া দাম। সাবের জেল থেকে মুক্তি পায় ১৯৫৪ সালে। অথচ মুক্তি পেতে পারতেন আরো আগে; যেমনটা দেখি সাবেরের গল্পে পিতার জবানীতে, “তুমি রাজনীতি করবে না লিখে দিলে সহজেই মুক্তি পেতে পারো”। শহীদ সাবেরের মতো মানুষেরা হারতে জানে না, নিজেকে বিলিয়ে দেয়, বিক্রি করে নয়। ছাত্র হিসেবে অসম্ভব মেধাবী মানুষটাই ১৯৫৮ সালের শেষ দিকে মানসিক সংকটে পড়েন। “বিশ্রি দুর্গন্ধে পাশে দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে” ওঠার কথা অনেকেরই। কারণ তখন সাবেরের চলাফেরা ছিল আক্ষরিক অর্থেই পাগলপ্রায়। নিজ জাতিকে মুক্তি দিতে হয়নি যার চালচুলো, পরিশীলিত জীবন ছিল যার থেকে যোজন যোজন দূরত্বে; রাজনীতি করার অপরাধে সবচে’ ভালো ফল করেও পায়নি সম্মানজনক সরকারি চাকরি তিনি শহীদ সাবের। “সরকারে ঢুকে পড়েই সরকারের চরিত্র বদলাতে হবে” ভাবনার প্রতিফলন হয়নি তার। হায়, এক জীবনের সমস্ত বেদনার মতো তাঁর শেষ সমাপ্তিও হয় অতি করুণ। সচেতন রাজনীতির তো বটে এদেশে প্রথম ও সর্বশেষ ‘সাম্যের সাহিত্যিক শহিদ’ শহীদ সাবের। সারা জীবন প্রশ্ন করে যাওয়া সাবের ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চের ৩১ তারিখ ঢাকার বংশাল রোডে অবস্থিত দৈনিক সংবাদ অফিসে পাক হানাদারদের দেয়া আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যান। একটা অধ্যায়ের এমন সমাপ্তি মুখ খুলে দিয়েছে অজস্রপ্রশ্নের, ইতিহাসে যুক্ত করেছে নির্মমতার কালো ছায়া।

শব্দের সন্তান, সৃজনের জমি-জিরাত: জীবনের আয়ু ক্ষয় করে লিখে যান সাহিত্যিকেরা। তাদের জীবনতৃঞ্চা তাড়িয়ে বেড়ায় শব্দে শব্দে। কিন্তু সময় বলে একটা কথা থাকে। আপনি জীবন থেকে কত সময় পেলেন লেখালেখি নামের সাধনার পেছনে, কত রাত জাগলেন তার তরে? আজকের মতো সেন্সরবিহীন ফেসবুকে দুই লাইন লিখে যদি লেখক হবার মওকা থাকতো তখন তবে ভিন্ন কথা। শহীদ সাবেরদের যেতে হয়েছে জহুরী সম্পাদকদের সম্পাদনার ভেতর দিয়ে। ফলে বাড়তি প্রস্তুতির বিষয় যেমন ছিল, তেমনি হৃদয় দিয়ে খেয়াল করতে হয়েছিল পরিপার্শ্ব। সাহিত্যের করুণ ইতিহাসে জীবন থেকে অতি কম সময় পেয়েও যারা ফুলে-ফলে স্বোপার্জিত আলোয় উদ্ভাসিত তাদের অবিস্মরণীয় নাম নজরুল, সুকান্ত, সাবের প্রমুখ। তাঁদের কর্মতৎপরতা শুধু সাহিত্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, রাজনীতি, সম্পাদনা যেমন ছিল তেমনি ছিল মানুষের পক্ষে জেগে থাকবার অদম্য স্পৃহা। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যেমনটা বলেন, “জগন্নাথ কলেজ থেকে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে বিএ পাস করলেন; কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছেন একটি স্কুলে, এবং লিখছিলেন ছোটগল্প, কিশোরদের জন্য রচনা, কবিতা, অনুবাদ। অল্প সময়ে অনেক কাজ করেছেন তিনি।” কিন্তু জীবন কখনো কখনো এমন নিষ্ঠুর খেলা খেলে যেখানে হাত থাকে না কারো। তারা হয়ে ওঠেন স্বল্পায়ুর অতিপ্রজ মানবিক মানুষ, যারা ইতিহাস সৃষ্টি করেন।

এখানে একটা মজার বিষয় আছে। শেষ সময়ে, দেশ স্বাধীন-পূর্ব উত্তাল সময়ে শহীদ সাবেরের মানসিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। কিন্তু মযহারুল ইসলাম বাবলা যে প্রশ্ন রাখেন তা অযুত বিস্ময়ের যেমন জন্ম দেয় তেমনি মানসগঠনে সাবেরের স্তরটাও বোঝা যায়। তিনি প্রশ্ন তোলেন, “দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া পাগলামি না করেও পাগলের খ্যাতি ও দুর্নাম নিয়ে ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত কবিতা লিখতে পেরেছিলেন কীভাবে?” এ পয়েন্ট অতি গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি আমরা দেখতে পাই পত্রিকায় তাকে নিয়ে কিছু ছাপা হলে তার প্রতিবাদও করছেন সাবের। ছোটকালে “ছোটদের আসর”, “কিশোর সংঘ”, “ছন্দ শিখা”, “মুকুল ফৌজ” ইত্যাদি তাঁর লেখকমানস গঠনে সহায়তা করে। তার প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় সীমান্ত পত্রিকায় ১৯৪৮ সালে। শহীদ সাবেরের প্রকাশিত গ্রন্থগুলো: আরেক দুনিয়া থেকে (১৯৫৭) রোজনামচা জনরার এ লেখা প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতার নতুন সাহিত্য পত্রিকায় ১৯৫১ সালে, জামিল হোসেন ছন্মনামে, সাবের তখন জেলে। এবং এটা প্রকাশের পরেই বোদ্ধা পাঠকদের কাছে লেখক সম্পর্কে পড়ে যায় কৌতূহলের সাড়া। খোদ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লেখকের প্রসংশা করে চিঠি লিখেছেন সম্পাদককে। ছোটগল্প- এক টুকরো মেঘ (১৯৫৫), ক্ষুদে গোয়েন্দার অভিযান (১৯৫৮)। অনুবাদ- পুশকিনের ইস্কাপনের বিবি, গোগলের পাগলের ডায়েরি, ক্যাথারিন ওয়েন্স পিয়ারের কালো মেয়ের স্বপ্ন (১৯৫৮)। কবিতা লিখেছেন অসংখ্য, প্রকাশিতও হয়েছিল বিভিন্ন দৈনিকে, পত্রপত্রিকায় কিন্তু গ্রন্থভুক্ত হয়নি। সেলিনা হোসেন সম্পাদিত “শহীদ সাবের রচনাবলী” (১৯৮১), মুহম্মদ ইদরীস আলী প্রণীত বাংলা একাডেমি জীবনী গ্রন্থমালা “শহীদ সাবের” (১৯৮৯), মাযহারুল ইসলাম বাবলা সম্পাদিত “শহীদ সাবের রচনাসমগ্র (২০১২) প্রকাশিত হয়।

স্বীকৃতির খতিয়ান, সম্মানের দাগ-সূত্র: জগতে কোনো লেখকই পুরস্কারের জন্য লেখেন না। নিজের ভেতরকার তাড়নার শাব্দিক রূপই মূলত সৃজন সম্ভার। শহীদ সাবেরের মতো লেখকেরা পুরস্কারের জন্য লালায়িত তো ননই, জানতেনও না পুরস্কার নেয়ার কায়দা-কৌশল। তাদের ভাবনাটা এমন, “পুরস্কারের চেয়ে কাজটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ”। আজকাল কেউবা শরমের মাথা খেয়ে নিজ থেকে পুরস্কার চেয়ে নেন, রীতিমতো পুরস্কার দেয়ার জন্য হুমকি দিতেও ভুল করেন না! জীবদ্দশায় শহীদ সাবের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি-পৃষ্ঠপোষকতা পাননি। নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে ছিলেন উদাসীন, জগতের লাভালাভ নিয়েও। তবে রাষ্ট্র ১৯৭২ সালে সাবেরকে মরণোত্তর বাংলা একাডেমি পুরস্কার দিয়ে নিজেই ধন্য হয়। এছাড়াও ২০০৩ সালে কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার, ২০০৪ সালে কক্সবাজার পদক পান শহীদ সাবের। জন্মদেশের স্মৃতিকে জীবন্ত রাখার প্রয়াসে ২০০৮ সালে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, হুমায়ূন সিদ্দিকী ও মনির ইউসুফের তত্ত্বাবধানে কক্সবাজারের ঈদগাঁয়প্রতিষ্ঠা করা হয় “শহীদ সাবের পাঠাগার”। কতজনই তো পেয়ে যান সরকারের সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারগুলো, সেখানে শহীদ সাবেরের পাশে একটা একুশে পদক বা স্বাধীনতা পুরস্কার থাকলে বরং রাষ্ট্রই সম্মানিত হয় এটা নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। পুরস্কারের প্রাতিষ্ঠানিক ভ্যালু অস্বীকার করা যায় না, পুরস্কারের সাথে ভেসে আসা জনপ্রিয়তা ও জনগণ্যতাও ফেলনা নয়। কিন্তু শহীদ সাবেরদের মতো লেখকদের সবচে’ বড় পুরস্কার তাদের লেখা পড়ে উজ্জীবিত হওয়া কোনো তরুণের দ্রোহী ভাবনা; নিজেকে তো বটে সমাজকে বদলে ফেলার যে মনোবাসনা তারা পেয়ে থাকে সাবেরের লেখা থেকে তার মূল্য অসীম।

যাকে দিয়ে চেনা যায় সাবেরের গল্পের মুখ অথবা জীবন দিয়ে কেনা গল্পটা:উল্লেখ করার মতো অনেক সার্থক গল্পের স্রষ্টা শহীদ সাবের। পাঠকের মর্জি আলাদা, ফলত কারো বিচারে যেটা এড়িয়ে যায়, কারো বিচারে ওটাই চোখে লাগে। অভাজন গদ্যকারের সাবের-পাঠে এটাই মনে হয়, “যে গল্প কেউ বলেনি”-ই সাবেরের সেরা গল্প। এটা বলার নানাবিধ কারণ আছে বটে। তবে গল্পের নামটাও আকর্ষণ করার মতো, ভেতরের মালমসলাও। গল্পের গঠন, বিস্তার, বুনন, বিন্যাস এবং শেষপর্যন্ত যে টুইস্ট উপহার দেন গল্পকার তা হৃদয় ছোঁয়া। সাবেরের গল্পে মানুষের নানাবিধ রূপ থাকে, নিজের কথা থাকে, সমাজ ও সংসারের সারসত্য থাকে। কিন্তু এই গল্পে সাবের নিজেকে ছাড়িয়ে যেমন গেছেন তেমনি তার গল্পকার সত্তার ভেরিয়েশন বুঝবার সুযোগ পায় পাঠক।

“শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোক দেখি আমাকে ফেলেই চলে যাচ্ছেন।” গল্পের শুরুটা এভাবে। এই লাইন দিয়েই পাঠক প্রবেশ করেন দ্বিধার জগতে। গল্পের পরতে পরতে মজা। এগিয়ে যাবার দুর্বার তাড়না। সাবের এত রসিয়ে গল্পটা জমিয়েছেন, লোকে হয়তো বলবে জমে একেবারে ক্ষীর! বিভিন্ন হাতফেরতা হয়ে গল্পের কথক এমন জায়গায় এসে হাজির হন আর গল্পকারেরও এমন বয়ান পাঠক বুঝি বলেই বসবে, এ তো মধ্যপ্রাচ্যের কথা, আহারে বাঙালি নারী, আর থাকলো না কিছু! পড়া যাক গল্প থেকে, “আমার মসৃণ চকচকে বুক পঙ্কিল হয়ে যেতো সেই বৃদ্ধের কুৎসিৎ কামনায়। তার ওখানে ছিলাম মাত্র ছয়টি মাস। তারপরেই তার পরিবার পরিজন এসে পড়লেন। বৃদ্ধের স্ত্রী ছিলেন না। সব চেয়ে ছোট ছেলেটির বয়স ষোলো কি আঠারো। অবশেষে তার হাতেই পড়তে হলো আমাকে। প্রথম প্রথম গোপনে সময় কাটাতে আসতো সে আমার কাছে। আমার দিকে তাকাতেই তার মাথায় রক্ত উঠে যেত।” প্রিয় পাঠক কল্পনা করতে থাকুন গল্পের এমন একটি অংশ আর ভাবুন সাবেরের চিত্রকল্প কি ঠাস বুননের ক্ষমতা। এভাবে কত পরিবার ভিড় করে গল্পটাতে, কত মানুষ। একেবারে গল্পের শেষে গোমর ফাঁস করেন গল্পকার। আরেকটু পড়া যাক, “প্রিয় পাঠক এবং পাঠিকা। এতক্ষণে আমাকে নিশ্চয়ই চিনেছেন। আমি একটি বই। যেমন তেমন বই নই, বাজারে আমার হাজার হাজার কাটতি। ঘরে ঘরে গোপনে গোপনে আমার সঙ্গ লাভে ধন্য হচ্ছে দেশের আবাল বৃদ্ধ বনিতা।” এখানে বস্তু হিসেবে বইয়ের ভূমিকা ও মূল্যের সাথে গল্পকার হিসেবে সাবেরকেও বোঝার সুযোগ হয় আমাদের। এরকম এক কোনায় পড়ে থাকা বিষয়কে গল্পের কুলীন শরীরে নিয়ে আসা চাট্টিখানি কথা নয়। সেই সূত্রে “যে গল্প কেউ বলেনি” সাবেরের শ্রেষ্ঠ নির্মাণ।

গল্পের সাবের, সাবেরের গল্পের ভূগোল: শহীদ সাবেরের গল্প পাঠে মোটাদাগে পাঠকের সমুখে নি¤œ মধ্যবিত্তের জীবন ভেসে ওঠে। বলা চলে পারিবারিক প্রেক্ষাপটে একটা গল্প দাঁড় করান গল্পকার। পার্শ্বচরিত্র হিসেবে রসদ জোগায় সময় ও সমাজ। মূলত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও পরিপার্শ্ব মিলে সাবেরের গল্পগুলো হয়ে থাকে সুখপাঠ্য। সেই সময়ের সমাজচিত্রের সাথে মানুষের ছোট ছোট দুঃখ-কষ্ট, হাসি-কান্না, আবেগ গলাগলি করে তার গল্পে। সমাজকে চেনা, সমাজের মানুষকে জানা আর প্রচুর পড়ার মাধ্যমে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছিলেন শহীদ সাবের। নিজের জীবনেই তিনি দেখেছেন অর্থকষ্ট, পরিবারে একটি চাকরির গুরুত্ব ইত্যাদি। ফলে আত্মজৈবনিক ছায়া তার গল্প থেকে খুব বেশি দূরে অবস্থান করে না। দক্ষিণ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার টোন, শব্দব্যবহার এমনকি মাটিঘেঁষা একটা বিষয় সাবেরের গল্পকে সমৃদ্ধ করেছে। অনতিদীর্ঘ, মেদবিহীন, কখনো উত্তম পুরুষে, কখনো কথকের ভূমিকায়, কখনো ডায়ালগের ভারসাম্যে গল্পগুলো হয়ে ওঠে যুগের অনন্য দলিল। মানুষের আর্তি আর অভ্যাসের অদৃশ্য মিলনহেতু কোনো গল্পকে মনেহয় গতকালের লেখা। সাবের সেই সময়ের দৈনিকের পাতায় কি সাহিত্যপত্রিকায় অসংখ্য গল্প লিখেছেন, তাঁর খ্যাতিও মূলত গাল্পিক হিসেবে। এত বছর পরে, প্রচারের বিবিধ ঢামাঢোলের ভেতর বসে, প্রকাশের অজস্র মাধ্যম সামনে নিয়ে আমরা ভাবি, সাবের হৃদয় দিয়ে গল্পচর্চা করেছেন, ফলে এখনো প্রাসঙ্গিক তিনি সমসাময়িক গল্পকার হিসেবে।

“এক টুকরো মেঘ” গল্পের আনুকে কে না চেনে! চাকরির পূর্ব আর পরের অভিজ্ঞতা নিয়ে এই গল্প। আনু দেখে, খাবার সময় বাড়তি তরকারি চাইলে যাকে রীতিমতো খোটা দিতে ছাড়ে না, সেই তারাই একসময় বলে, “বেতন থেকে তুমি ভাইয়া কিছু কিছু টাকা জমিও। একটা হাতঘড়ি আর একখানা সাইকেল না হলে চলে না ব্যাটা ছেলেদের।” সংসারের করুণ চিত্রের পাশাপাশি সময়ের চিহ্ন ভেসে ওঠে গল্পে। সেই সময়ের ছেলেদের ক্রেজ, স্টাইল ইত্যাদি খুঁজে পায় পাঠক। আসলে একেকটা গল্প সময়ের সারচিহ্ন হয়ে যায় নির্মাণগুণে। মানুষের অন্তর্গত দুঃখ বাহিত বটেই, সংক্রামকও। “প্রাণের চেয়ে প্রিয়” গল্পটা সাবেরেরই জীবন থেকে নেয়া। আমরা দেখি, সাবেরের বাবা ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে জেলে দেখতে যান সাবেরকে। ছোট ভাইবোনের নানান প্রশ্ন। নানান কৌতূহল। সাবেরের অদম্য চরিত্রের বলিষ্ঠ প্রকাশ পায় গল্পে। ভাইবোনের সুন্দর সময়কে হাতড়ে বেড়ানো, খুনসুটি ইত্যাদি একাকার। ছাত্ররাজনীতি, সাম্যবাদ চর্চা, তৎসময়ের রাষ্ট্রের ভূমিকা, নিপীড়ন কতকিছু দেখিয়ে দেয় গল্পটা! আর আছে ভাষা-প্রকৌশল। “জেল আপিসের কপালে সতর্ক প্রহরীর মতো দুটো বিজলী বাতি ঝক ঝক করছে রোদে।” কিংবা “আজকাল তো লেখা-পড়া না জানা মেয়েদের দুলাই জুটবে না।” অথবা “তোমার মা বাবাই যদি মরে গেল, তবে কি হবে রাজনীতি দিয়ে। পলিটিক্স তোমাকে ভাত দেবে, না কাপড় দেবে?” বা “মানুষের জন্যেই পলিটিক্স। রাজনীতি মানুষের জন্য, একান্তভাবে মানুষের জন্য, সে রাজনীতির একজন ছাত্র হচ্ছি আমি।” এরকম সোনামাখা প্রশ্ন আর জিজ্ঞাসায় ভরপুর প্রাগুক্ত গল্পটি। দর্শনের ঘোর আছে, প্রাত্যহিক জীবনের আবেগ আছে। “ভাসুভাবীর জন্য” আরেক সার্থক গল্প সাবেরের। জমিদার প্রথা, জমিদারের ব্লু ব্লাড আর সম্পর্কের নানা সূত্র নিয়ে গল্পটা। প্রতিশোধপরায়ণ মানুষের হৃদয় কত নোংরা হয়, কতভাবে তারা নিজেদের চরিতার্থ পূরণ করে তার উদাহরণ গল্প কথকের মামা ওরফে জমিদার। যথারীতি এ গল্পেও আমরা সাবেরের জীবনের ছায়া দেখতে পাই। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি সম্মান পাবার আখাক্সক্ষা দেখা যায়- “বলত, মিঞার ভাগ্নে, অমুক মিঞা। আমার লজ্জা হতো না। বরং কেউ যদি আমায় যথেষ্ট সম্মান না দেখাত তাহলেই আমার খারাপ লাগত। মনে হতো এ আমার প্রাপ্য।” ছোট বয়সেও মানুষের এমন প্রত্যাশা অমূলক নয়, আমাদের দেশের শ্রেণিবিভাজন তাই শেখায় বৈকি। কিন্তু নসু ভাবীর জীবন দিতে হয় তার পিতার সাথে জমিদার মামার পূর্ব বৈরিতার মূল্য হিসেবে। গ্রামদেশের মাটির মানুষদের আন্তরিক তৎপরতা দেখা যায়, মেহেমানদারির বিষয়টা বোঝাও যায়। নারী নির্যাতন, শ্বশুরপক্ষের অত্যাচার, কত কিছু নীরবে ঘটে যায়! এবং গল্পের মাঝে রহস্য আছে, একটা চিঠি খুলে দেয় অনেক প্রশ্নের উত্তর। তবে এই গল্পটা সমাজের নানা দিকে ইশারা করে, খুলে দেয় বহু অন্ধকার দিক। “দেয়াল” গল্পটা আয়তনে একদম ছোট কিন্তু জেল জীবনের করুণ রাগিনীতে ভরপুর। জেলের সান্ত্রীর সাথে কয়েদীর ভাব হতে পারে কিন্তু পোশাক আর পদবীর যে ভার তা দূরত্ব তৈরি করবেই!

মূলত সমাজ পোশাক দিয়ে, পদ দিয়ে যে অন্তর্গত ফারাক শিখিয়েছে আমাদের তার চমৎকার বয়ান “দেয়াল” গল্পটি। দুই বন্ধুর নিখাঁদ বন্ধুত্বের গল্প “যৌবন”। এখানে যৌবন একটা বয়সকে প্রেজেন্ট করে, বয়সের সৌন্দর্যকেও। আনিস ও ফিরোজের নানামুখি কথাবার্তার মধ্যে গল্প এগিয়ে যায়। ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া, চাকরি-বেতন ইত্যাদির মূল স্রোত ব্যক্তির লাভালাভের সাথে যুক্ত থাকলেও শেষতক গল্পটা হয়ে ওঠে সবার। সাম্যবাদের সৈনিক সাবের মানবিকতার একটা চোরাটান দিয়ে শেষ করেন গল্পটা। হয়তো পাঠক গল্প পড়তে পড়তে ভাবতেই পারেনি শেষে এমনটা হবে। অথচ এটাই গল্প, এটাই শিল্প। মানুষের অসহায়ত্বে যদি মন না কাঁদে তবে কিশোর যৌবন? গল্পে আনিসের ভূমিকাকে কাজী নজরুলের যৌবনদীপ্ত পুরুষের অবিকল মনেহয় আমাদের। ইতিবাচক পরিবর্তনে যৌবন তথা ওই বয়সের ভূমিকা আরেকবার মনে করিয়ে দেয় প্রাগুক্ত গল্পটা। আনিসের জবানিতে শোনা যাক, “করবো তো রোজই। কিন্তু সেই মুহূর্তে দুটো বিদেশী সৈনিক আর মেয়েটাকে দেখে আমার মনে হলো আমার চাদরের দরকার নেই, গায়ের গরমেই অনেকদিন চলতে পারবো।” সাবেরদের মতো ত্যাগী তরুণদের কল্পিত নগরের আদর্শ যুবক আনিস, যাদের ত্যাগে মানুষের উপযোগী হবে এই বসুধা। নি¤œ মধ্যবিত্তের সফল সাহিত্যিক রূপকার হিসেবে শহীদ সাবের উল্লেখযোগ্য।

“চালচুলো” গল্পটাতে মুঠোচাল রাখার মতো পাশ বইয়ে থাকে খুচরো কিছু টাকা। পরিমাণে কম হলেও নিদানে তা দেয় পর্যাপ্ত শেল্টার। তারউপর পরিবেশ চেনে না পকেটের অবস্থা। গল্পে পড়া যাক, “আজ কিন্তু সকিনা বিবি একগাল হাসি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, দিনটা আজ ভালো যাবে মনে হচ্ছে। বৃষ্টি তো পড়বেই। খোকা তোর কাছে পয়সা-টয়সা আছে? থাকলে দেনা এক পোয়া গোশ এনে খিচুড়ি রাঁধি।” বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি খেতে মন চায় সবারই। খোকা গোশত কিনে আনে, সাথে আনে বন্ধুকেও। কিন্তু অভাবের জীবন নানা পরীক্ষায় ভরপুর! কথিত মিথের প্রভাবও আছে গল্পে। যেই রান্না করা গোশত পাতিলসহ সবটুকু পড়ে যায় মাটিতে সেই গোশত আবারো খাওয়ার মতো করে নেয় পরিবারের শিশুরাই! এখানে নি¤œবিত্তের জীবন সংগ্রাম, না-হারা মানসিকতা ইত্যাদির ইঙ্গিত আছে প্রবলভাবে।

সাংবাদিকতা পেশার বৈচিত্র্য সম্পর্কে পাঠকমাত্রই জানেন। খবরের পেছনের খবর নিয়ে গল্প “শেষ সংবাদ”। একজন সাংবাদিক তার সবটুকু দিয়ে সংগ্রহ করে সংবাদ কিন্তু তার বউয়েরও তো সংবাদ হবার শখ জাগতে পারে! এখানে গল্পকারের কৌতুকবোধ শংসা পাওয়ার মতো। গল্পের নায়ক রফিক যে কি না বিশ্ব বার্তার রিপোর্টার তার বউয়ের প্রশ্নের জবাবে এমন উত্তর গল্পকেও করে তোলে সহজবোধ্য। সাংবাদিকের উত্তরের মাধ্যমে গল্পকারের রসবোধ পড়া যাক, “তোমার বাচ্চা হয়েছে, তাই কি আর একটা খবর হলো। এমন কত সেলিনার কত বাচ্চা হচ্ছে। তবু বিয়োতে যদি দু’পার বদলে চার পা ওয়ালা বাচ্চা একটা, তবে সে হতো একটা খবর।” বর্তমানে নামে-বেনামে মিডিয়ার চরিত্রটাই যেন বহু আগে খোলাসা করেন সাবের। কিন্তু সাংবাদিকদের চাকরির নিশ্চয়তা, বেতনের নিশ্চয়তা কি আছে? বিশেষত রফিকের মতো সৎ রিপোর্টারদের? ভূরি ভূরি অসৎ সাংবাদিকের ভিড়ে গল্পের শেষে দেখি কোন রকম নোটিশ ছাড়াই বন্ধ হয়ে যায় বিশ্ব বার্তা। যারা লেখেন অনাচারের খবর তারাই মালিকপক্ষের ইচ্ছের বলি হয়ে কর্মহীন হয়ে পড়ে রাতের অন্ধকারে। সাবের নিজেও সাংবাদিকতা করেছেন ফলে তিনি আগাগোড়াই বোঝেন এই পেশার কুরুকিসিম। গল্পপাঠশেষে পাঠকের তাই খারাপ লাগে রফিকের জন্য।

“আবেগ” গল্পটা একেবারে ক্ষীণ শরীরের। অভাবের টোটেম দিয়ে দেশ স্বাধীনপূর্ব অবস্থার একটা প্রেক্ষিত দেখতে পাই আলোচ্য গল্পে। দেশপ্রেমের শিখা যেন নিরন্তর জ্বলছে গল্পটাতে। আছে শহুরে বাড়িয়লার নিয়তির চিত্র, “আমরাও চলি বাড়ি ভাড়ার টাকা দিয়ে”। নানা ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে গল্পের একেবারে শেষে দেখি, ক্ষুদ্রমানুষের সীমা। তার যুদ্ধ, তার নিনাদ কেবল “বালিশের তুলা সমস্ত বিছানায় ছড়িয়ে গেলো” পর্যন্ত। এখানে গল্পকারের চিন্তার পরিধি ও ভাবনার বিস্তার সম্পর্কে জানা যায় শব্দের কারিশমায়।

শহীদ সাবেরের কিশোর গল্পের সংখ্যাও কম নয়। সেসব গল্প আবার আলাদা ভাষায় কি বিন্যাসে। অর্থাৎ সাবের গল্প রচনার সময় সচেতনভাবে খেয়াল রেখেছেন বয়সের বিষয়টা এবং সেই অনুযায়ী শব্দ তো বটে বিষয় নির্বাচনেও পরিচয় দিয়েছেন মুন্সিয়ানার। শহীদ সাবের একজন সময়সচেতন গল্পকার; সমাজ নিয়ে তাঁর ভাবনা, তাঁর প্রজন্ম ও পরিপার্শ্বকে পরখ করেছেন খুব কাছ থেকে, একেবারে হৃদয় দিয়ে। ফলে শহীদ সাবেরের গল্প এতকাল পরে এসেও প্রাসঙ্গিক হয়ে ধরা দেয় বিদগ্ধ পাঠককুলের কাছে।

ঋণ:

১. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

২. সন্জীদা খাতুন

৩. মযহারুল ইসলাম বাবলা

৪. কালাম আজাদ

ছবি

আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘ভাঙানৌকা’

ছবি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বায়োস্কোপ

ছবি

জরিনা আখতারের কবিতা আত্ম-আবিষ্কার ও মুক্তি

ছবি

বাংলা ছোটগল্পের অনন্য রূপকার নরেন্দ্রনাথ মিত্র

ছবি

প্রেম, দর্শন ও অখণ্ডতা

ছবি

প্রতিবাদী চেতনার উর্বর ময়দান

ছবি

রবীন্দ্রনাথের আদি পুরুষের শেকড়

ছবি

ভেঙে পড়ে অন্তর্গহনের প্রগাঢ় অনুভূতি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

রহস্যময় পাহাড়ী মানব

ছবি

ফ্রিদা কাহলো : আত্মপ্রকাশের রঙিন ক্যানভাস

ছবি

জ্যাজ সংঙ্গীতের তাৎক্ষণিক সৃষ্টিশীলতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

নক্ষত্রের ধ্রুবতারা অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী

ছবি

নজরুল ও তাঁর সুন্দর

ছবি

নতুন বইয়ের খবর

ছবি

‘আমার চোখ যখন আমাকেই দেখে’- প্রেম ও প্রকৃতির সেতুবন্ধ

ছবি

পূষন ও বৃষ্টির গল্প

ছবি

নিরামিষ চর্চার বিরল আখ্যান

ছবি

‘আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ভ্রম

ছবি

পালকের চিহ্নগুলো

ছবি

নতুন বইয়ের খবর

ছবি

রফিক আজাদের কবিতা

ছবি

ধূসর পাণ্ডুলিপি পরিবহন

ছবি

চৈত্রের কোনো এক মধ্যরাতে

ছবি

দেশভাগের বিপর্যয় ও ‘জলপাইহাটি’র জীবনানন্দ দাশ

ছবি

সামান্য ভুল

সাময়িকী কবিতা

ছবি

আধুনিক বাংলা কবিতার প্রথাভাঙা মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত

ছবি

ধুলোময় জীবনের মেটাফর

ছবি

স্কুলটি ছোট্ট বটে

ছবি

নতুন বইয়ের খবর

ছবি

পালকের চিহ্নগুলো

tab

সাময়িকী

শহীদ সাবেরের সাহিত্য চিন্তা ও জীবনের সমন্বয়

ইলিয়াস বাবর

শহীদ সাবের / জন্ম : ১৮ ডিসেম্বর ১৯৩০; মৃত্যু : ৩১ মার্চ ১৯৭১ প্রতিকৃতি : মাসুক হেলাল

বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫

আমরা মূলত ব্যক্তি নয় তার সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা করতে ভালোবাসি। ব্যক্তির চেয়ে বহু বড় তার সৃষ্টিসম্ভার। সৃজন-ক্ষমতায় একজন ব্যক্তিমানুষ ছাড়িয়ে যান নিজেকে। তথাপি ব্যক্তির জন্ম, ঠিকুজি, বেড়ে ওঠা প্রভাব ফেলে তার মানসগঠনে। ফলত সৃষ্টির আলাপ হলে অনিবার্যভাবে হাজির হয় তাতে জীবনের কথা, শেকড়ের কথা। শহীদ সাবেরের জন্ম ডিসেম্বর ১৮, ১৯৩০ সালে। তখন এই উপমহাদেশ বিট্রিশদের অধীন। বলা চলে জন্মসূত্রে সাবের বিট্রিশ পিরিয়ড যেমন চাক্ষুষ করেন তেমনি পাকিস্তান কালও। তাঁর পিতা সালামত উল্যাহ ছিলেন সরকারি চাকুরে, যাদের পূর্বপুরুষ ছিল পর্তুগিজ অধ্যুষিত দেয়াঙের অধিবাসী। অবশ্য পরে তিনি থিতু হন চট্টগ্রাম শহরের চন্দনপুরায় পিতার নির্মিত বাড়িতে। মাতা শফিকা খাতুন, সামলাতেন গেরস্তকর্ম। কক্সবাজার জেলার ঈদগাঁস্থ সোনাপুকুর গ্রামে নানারবাড়িতে সাবেরের জন্ম। বাবা যেহেতু সরকারি চাকুরে, সাবেরকে নানা বিদ্যালয়ে শিক্ষা নিতে হয়, এমনকি তা তৎসময়ের বিখ্যাত কলকাতায়ও। ঈদগাঁ প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে কলকাতা, ফিরে এসে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল, এরপরে চট্টগ্রাম কলেজ। অনিয়মিত ছাত্র হিসেবে জগন্নাথ কলেজ থেকে বসেন বিএ পরীক্ষায়। ছাত্র হিসেবে সাবের ছিলেন তুমুল মেধাবী, যা সাক্ষ্য দেয় তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাসনদ। এমনকি কেন্দ্রীয় ইনফরমেশন সার্ভিসের পরীক্ষায় কৃতকার্যদের মধ্যে তার অবস্থান ছিল শীর্ষে। একই সাথে পড়াশোনা, লেখালেখি, শিক্ষকতা, অনুবাদ, রাজনীতি, এত কিছু একজন অসাধারণ মেধাবী ও শ্রমনিষ্ঠ মানুষের পক্ষেই কেবল সম্ভব।

একজন লেখক চিন্তার বীজ, নিজেকে সমৃদ্ধ করবার সার পেয়ে থাকেন তাঁর শৈশব থেকে। শহীদ সাবেরের দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগের সাথে যুক্ত হয় মানুষ দেখার সুবর্ণ সূত্র। আর ছিল জন্মসূত্রে পাওয়া লোনার বিস্তার, দরিয়ার বিশালতা। দেশভাগের কঠিন দুর্যোগ তাকে দিয়েছে অনন্য শিক্ষা, চলে আসেন এ বঙ্গে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, কত বড় বড় ঘটনা তাকে সমৃদ্ধ করেছে, জিজ্ঞাসু করেছে ভাবা যায়! সৎমায়ের সাথে ছিলেন, ছোট ভাইবোনদের দায়িত্ব নিতে হয়েছে নিজের ছাত্রত্ব না যাবার কালে। সংসারের অমল-ধবল রূপ তাকে দেখতে হয়েছে শৈশবে অথচ তার নানাজান ছিলেন ঈদগাঁর জমিদার। জীবন তাকে নিয়ে কঠিন খেলায় নিয়োজিত ছিল যেনবা। ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্র ফেডারেশনের এক কর্মিসভায় বক্তৃতারত অবস্থায় অন্যদের সাথে সাবেরকেও রাজবন্দী হিসেবে পাঠানো হয় চট্টগ্রাম জেলে। তখন সাবের সদ্য মেট্রিক পাস করে ভর্তি হয়েছেন চট্টগ্রাম কলেজে। একাডেমিক বিদ্যায়তনের বড় পরিসরে যাবার প্রাক্কালে তাঁকে যেতে হলো, রাষ্ট্রের শেকলে! অবশ্য যার চিন্তা এমন, “শুধু আপনার ছেলে নই, সমাজেরও” তাঁকে আটকাতে পারে পৃথিবীর কোন মোহ? সাবেরের স্বল্পায়ুর জীবনে ছিল কেবল যুদ্ধ আর যুদ্ধ। পাকিস্তানী দুঃশাসনের কবলে কতিপয় মানুষের মুক্তির সংগ্রামটা ছিল মূলত সবারই সংগ্রাম। কিন্তু যারা থাকে অগ্রভাগে, যাদের বিবেক ভর্তি থাকে মানবিকতায় তাদের দিতে হয় চড়া দাম। সাবের জেল থেকে মুক্তি পায় ১৯৫৪ সালে। অথচ মুক্তি পেতে পারতেন আরো আগে; যেমনটা দেখি সাবেরের গল্পে পিতার জবানীতে, “তুমি রাজনীতি করবে না লিখে দিলে সহজেই মুক্তি পেতে পারো”। শহীদ সাবেরের মতো মানুষেরা হারতে জানে না, নিজেকে বিলিয়ে দেয়, বিক্রি করে নয়। ছাত্র হিসেবে অসম্ভব মেধাবী মানুষটাই ১৯৫৮ সালের শেষ দিকে মানসিক সংকটে পড়েন। “বিশ্রি দুর্গন্ধে পাশে দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে” ওঠার কথা অনেকেরই। কারণ তখন সাবেরের চলাফেরা ছিল আক্ষরিক অর্থেই পাগলপ্রায়। নিজ জাতিকে মুক্তি দিতে হয়নি যার চালচুলো, পরিশীলিত জীবন ছিল যার থেকে যোজন যোজন দূরত্বে; রাজনীতি করার অপরাধে সবচে’ ভালো ফল করেও পায়নি সম্মানজনক সরকারি চাকরি তিনি শহীদ সাবের। “সরকারে ঢুকে পড়েই সরকারের চরিত্র বদলাতে হবে” ভাবনার প্রতিফলন হয়নি তার। হায়, এক জীবনের সমস্ত বেদনার মতো তাঁর শেষ সমাপ্তিও হয় অতি করুণ। সচেতন রাজনীতির তো বটে এদেশে প্রথম ও সর্বশেষ ‘সাম্যের সাহিত্যিক শহিদ’ শহীদ সাবের। সারা জীবন প্রশ্ন করে যাওয়া সাবের ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চের ৩১ তারিখ ঢাকার বংশাল রোডে অবস্থিত দৈনিক সংবাদ অফিসে পাক হানাদারদের দেয়া আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যান। একটা অধ্যায়ের এমন সমাপ্তি মুখ খুলে দিয়েছে অজস্রপ্রশ্নের, ইতিহাসে যুক্ত করেছে নির্মমতার কালো ছায়া।

শব্দের সন্তান, সৃজনের জমি-জিরাত: জীবনের আয়ু ক্ষয় করে লিখে যান সাহিত্যিকেরা। তাদের জীবনতৃঞ্চা তাড়িয়ে বেড়ায় শব্দে শব্দে। কিন্তু সময় বলে একটা কথা থাকে। আপনি জীবন থেকে কত সময় পেলেন লেখালেখি নামের সাধনার পেছনে, কত রাত জাগলেন তার তরে? আজকের মতো সেন্সরবিহীন ফেসবুকে দুই লাইন লিখে যদি লেখক হবার মওকা থাকতো তখন তবে ভিন্ন কথা। শহীদ সাবেরদের যেতে হয়েছে জহুরী সম্পাদকদের সম্পাদনার ভেতর দিয়ে। ফলে বাড়তি প্রস্তুতির বিষয় যেমন ছিল, তেমনি হৃদয় দিয়ে খেয়াল করতে হয়েছিল পরিপার্শ্ব। সাহিত্যের করুণ ইতিহাসে জীবন থেকে অতি কম সময় পেয়েও যারা ফুলে-ফলে স্বোপার্জিত আলোয় উদ্ভাসিত তাদের অবিস্মরণীয় নাম নজরুল, সুকান্ত, সাবের প্রমুখ। তাঁদের কর্মতৎপরতা শুধু সাহিত্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, রাজনীতি, সম্পাদনা যেমন ছিল তেমনি ছিল মানুষের পক্ষে জেগে থাকবার অদম্য স্পৃহা। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যেমনটা বলেন, “জগন্নাথ কলেজ থেকে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে বিএ পাস করলেন; কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছেন একটি স্কুলে, এবং লিখছিলেন ছোটগল্প, কিশোরদের জন্য রচনা, কবিতা, অনুবাদ। অল্প সময়ে অনেক কাজ করেছেন তিনি।” কিন্তু জীবন কখনো কখনো এমন নিষ্ঠুর খেলা খেলে যেখানে হাত থাকে না কারো। তারা হয়ে ওঠেন স্বল্পায়ুর অতিপ্রজ মানবিক মানুষ, যারা ইতিহাস সৃষ্টি করেন।

এখানে একটা মজার বিষয় আছে। শেষ সময়ে, দেশ স্বাধীন-পূর্ব উত্তাল সময়ে শহীদ সাবেরের মানসিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। কিন্তু মযহারুল ইসলাম বাবলা যে প্রশ্ন রাখেন তা অযুত বিস্ময়ের যেমন জন্ম দেয় তেমনি মানসগঠনে সাবেরের স্তরটাও বোঝা যায়। তিনি প্রশ্ন তোলেন, “দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া পাগলামি না করেও পাগলের খ্যাতি ও দুর্নাম নিয়ে ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত কবিতা লিখতে পেরেছিলেন কীভাবে?” এ পয়েন্ট অতি গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি আমরা দেখতে পাই পত্রিকায় তাকে নিয়ে কিছু ছাপা হলে তার প্রতিবাদও করছেন সাবের। ছোটকালে “ছোটদের আসর”, “কিশোর সংঘ”, “ছন্দ শিখা”, “মুকুল ফৌজ” ইত্যাদি তাঁর লেখকমানস গঠনে সহায়তা করে। তার প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় সীমান্ত পত্রিকায় ১৯৪৮ সালে। শহীদ সাবেরের প্রকাশিত গ্রন্থগুলো: আরেক দুনিয়া থেকে (১৯৫৭) রোজনামচা জনরার এ লেখা প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতার নতুন সাহিত্য পত্রিকায় ১৯৫১ সালে, জামিল হোসেন ছন্মনামে, সাবের তখন জেলে। এবং এটা প্রকাশের পরেই বোদ্ধা পাঠকদের কাছে লেখক সম্পর্কে পড়ে যায় কৌতূহলের সাড়া। খোদ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লেখকের প্রসংশা করে চিঠি লিখেছেন সম্পাদককে। ছোটগল্প- এক টুকরো মেঘ (১৯৫৫), ক্ষুদে গোয়েন্দার অভিযান (১৯৫৮)। অনুবাদ- পুশকিনের ইস্কাপনের বিবি, গোগলের পাগলের ডায়েরি, ক্যাথারিন ওয়েন্স পিয়ারের কালো মেয়ের স্বপ্ন (১৯৫৮)। কবিতা লিখেছেন অসংখ্য, প্রকাশিতও হয়েছিল বিভিন্ন দৈনিকে, পত্রপত্রিকায় কিন্তু গ্রন্থভুক্ত হয়নি। সেলিনা হোসেন সম্পাদিত “শহীদ সাবের রচনাবলী” (১৯৮১), মুহম্মদ ইদরীস আলী প্রণীত বাংলা একাডেমি জীবনী গ্রন্থমালা “শহীদ সাবের” (১৯৮৯), মাযহারুল ইসলাম বাবলা সম্পাদিত “শহীদ সাবের রচনাসমগ্র (২০১২) প্রকাশিত হয়।

স্বীকৃতির খতিয়ান, সম্মানের দাগ-সূত্র: জগতে কোনো লেখকই পুরস্কারের জন্য লেখেন না। নিজের ভেতরকার তাড়নার শাব্দিক রূপই মূলত সৃজন সম্ভার। শহীদ সাবেরের মতো লেখকেরা পুরস্কারের জন্য লালায়িত তো ননই, জানতেনও না পুরস্কার নেয়ার কায়দা-কৌশল। তাদের ভাবনাটা এমন, “পুরস্কারের চেয়ে কাজটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ”। আজকাল কেউবা শরমের মাথা খেয়ে নিজ থেকে পুরস্কার চেয়ে নেন, রীতিমতো পুরস্কার দেয়ার জন্য হুমকি দিতেও ভুল করেন না! জীবদ্দশায় শহীদ সাবের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি-পৃষ্ঠপোষকতা পাননি। নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে ছিলেন উদাসীন, জগতের লাভালাভ নিয়েও। তবে রাষ্ট্র ১৯৭২ সালে সাবেরকে মরণোত্তর বাংলা একাডেমি পুরস্কার দিয়ে নিজেই ধন্য হয়। এছাড়াও ২০০৩ সালে কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার, ২০০৪ সালে কক্সবাজার পদক পান শহীদ সাবের। জন্মদেশের স্মৃতিকে জীবন্ত রাখার প্রয়াসে ২০০৮ সালে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, হুমায়ূন সিদ্দিকী ও মনির ইউসুফের তত্ত্বাবধানে কক্সবাজারের ঈদগাঁয়প্রতিষ্ঠা করা হয় “শহীদ সাবের পাঠাগার”। কতজনই তো পেয়ে যান সরকারের সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারগুলো, সেখানে শহীদ সাবেরের পাশে একটা একুশে পদক বা স্বাধীনতা পুরস্কার থাকলে বরং রাষ্ট্রই সম্মানিত হয় এটা নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। পুরস্কারের প্রাতিষ্ঠানিক ভ্যালু অস্বীকার করা যায় না, পুরস্কারের সাথে ভেসে আসা জনপ্রিয়তা ও জনগণ্যতাও ফেলনা নয়। কিন্তু শহীদ সাবেরদের মতো লেখকদের সবচে’ বড় পুরস্কার তাদের লেখা পড়ে উজ্জীবিত হওয়া কোনো তরুণের দ্রোহী ভাবনা; নিজেকে তো বটে সমাজকে বদলে ফেলার যে মনোবাসনা তারা পেয়ে থাকে সাবেরের লেখা থেকে তার মূল্য অসীম।

যাকে দিয়ে চেনা যায় সাবেরের গল্পের মুখ অথবা জীবন দিয়ে কেনা গল্পটা:উল্লেখ করার মতো অনেক সার্থক গল্পের স্রষ্টা শহীদ সাবের। পাঠকের মর্জি আলাদা, ফলত কারো বিচারে যেটা এড়িয়ে যায়, কারো বিচারে ওটাই চোখে লাগে। অভাজন গদ্যকারের সাবের-পাঠে এটাই মনে হয়, “যে গল্প কেউ বলেনি”-ই সাবেরের সেরা গল্প। এটা বলার নানাবিধ কারণ আছে বটে। তবে গল্পের নামটাও আকর্ষণ করার মতো, ভেতরের মালমসলাও। গল্পের গঠন, বিস্তার, বুনন, বিন্যাস এবং শেষপর্যন্ত যে টুইস্ট উপহার দেন গল্পকার তা হৃদয় ছোঁয়া। সাবেরের গল্পে মানুষের নানাবিধ রূপ থাকে, নিজের কথা থাকে, সমাজ ও সংসারের সারসত্য থাকে। কিন্তু এই গল্পে সাবের নিজেকে ছাড়িয়ে যেমন গেছেন তেমনি তার গল্পকার সত্তার ভেরিয়েশন বুঝবার সুযোগ পায় পাঠক।

“শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোক দেখি আমাকে ফেলেই চলে যাচ্ছেন।” গল্পের শুরুটা এভাবে। এই লাইন দিয়েই পাঠক প্রবেশ করেন দ্বিধার জগতে। গল্পের পরতে পরতে মজা। এগিয়ে যাবার দুর্বার তাড়না। সাবের এত রসিয়ে গল্পটা জমিয়েছেন, লোকে হয়তো বলবে জমে একেবারে ক্ষীর! বিভিন্ন হাতফেরতা হয়ে গল্পের কথক এমন জায়গায় এসে হাজির হন আর গল্পকারেরও এমন বয়ান পাঠক বুঝি বলেই বসবে, এ তো মধ্যপ্রাচ্যের কথা, আহারে বাঙালি নারী, আর থাকলো না কিছু! পড়া যাক গল্প থেকে, “আমার মসৃণ চকচকে বুক পঙ্কিল হয়ে যেতো সেই বৃদ্ধের কুৎসিৎ কামনায়। তার ওখানে ছিলাম মাত্র ছয়টি মাস। তারপরেই তার পরিবার পরিজন এসে পড়লেন। বৃদ্ধের স্ত্রী ছিলেন না। সব চেয়ে ছোট ছেলেটির বয়স ষোলো কি আঠারো। অবশেষে তার হাতেই পড়তে হলো আমাকে। প্রথম প্রথম গোপনে সময় কাটাতে আসতো সে আমার কাছে। আমার দিকে তাকাতেই তার মাথায় রক্ত উঠে যেত।” প্রিয় পাঠক কল্পনা করতে থাকুন গল্পের এমন একটি অংশ আর ভাবুন সাবেরের চিত্রকল্প কি ঠাস বুননের ক্ষমতা। এভাবে কত পরিবার ভিড় করে গল্পটাতে, কত মানুষ। একেবারে গল্পের শেষে গোমর ফাঁস করেন গল্পকার। আরেকটু পড়া যাক, “প্রিয় পাঠক এবং পাঠিকা। এতক্ষণে আমাকে নিশ্চয়ই চিনেছেন। আমি একটি বই। যেমন তেমন বই নই, বাজারে আমার হাজার হাজার কাটতি। ঘরে ঘরে গোপনে গোপনে আমার সঙ্গ লাভে ধন্য হচ্ছে দেশের আবাল বৃদ্ধ বনিতা।” এখানে বস্তু হিসেবে বইয়ের ভূমিকা ও মূল্যের সাথে গল্পকার হিসেবে সাবেরকেও বোঝার সুযোগ হয় আমাদের। এরকম এক কোনায় পড়ে থাকা বিষয়কে গল্পের কুলীন শরীরে নিয়ে আসা চাট্টিখানি কথা নয়। সেই সূত্রে “যে গল্প কেউ বলেনি” সাবেরের শ্রেষ্ঠ নির্মাণ।

গল্পের সাবের, সাবেরের গল্পের ভূগোল: শহীদ সাবেরের গল্প পাঠে মোটাদাগে পাঠকের সমুখে নি¤œ মধ্যবিত্তের জীবন ভেসে ওঠে। বলা চলে পারিবারিক প্রেক্ষাপটে একটা গল্প দাঁড় করান গল্পকার। পার্শ্বচরিত্র হিসেবে রসদ জোগায় সময় ও সমাজ। মূলত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও পরিপার্শ্ব মিলে সাবেরের গল্পগুলো হয়ে থাকে সুখপাঠ্য। সেই সময়ের সমাজচিত্রের সাথে মানুষের ছোট ছোট দুঃখ-কষ্ট, হাসি-কান্না, আবেগ গলাগলি করে তার গল্পে। সমাজকে চেনা, সমাজের মানুষকে জানা আর প্রচুর পড়ার মাধ্যমে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছিলেন শহীদ সাবের। নিজের জীবনেই তিনি দেখেছেন অর্থকষ্ট, পরিবারে একটি চাকরির গুরুত্ব ইত্যাদি। ফলে আত্মজৈবনিক ছায়া তার গল্প থেকে খুব বেশি দূরে অবস্থান করে না। দক্ষিণ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার টোন, শব্দব্যবহার এমনকি মাটিঘেঁষা একটা বিষয় সাবেরের গল্পকে সমৃদ্ধ করেছে। অনতিদীর্ঘ, মেদবিহীন, কখনো উত্তম পুরুষে, কখনো কথকের ভূমিকায়, কখনো ডায়ালগের ভারসাম্যে গল্পগুলো হয়ে ওঠে যুগের অনন্য দলিল। মানুষের আর্তি আর অভ্যাসের অদৃশ্য মিলনহেতু কোনো গল্পকে মনেহয় গতকালের লেখা। সাবের সেই সময়ের দৈনিকের পাতায় কি সাহিত্যপত্রিকায় অসংখ্য গল্প লিখেছেন, তাঁর খ্যাতিও মূলত গাল্পিক হিসেবে। এত বছর পরে, প্রচারের বিবিধ ঢামাঢোলের ভেতর বসে, প্রকাশের অজস্র মাধ্যম সামনে নিয়ে আমরা ভাবি, সাবের হৃদয় দিয়ে গল্পচর্চা করেছেন, ফলে এখনো প্রাসঙ্গিক তিনি সমসাময়িক গল্পকার হিসেবে।

“এক টুকরো মেঘ” গল্পের আনুকে কে না চেনে! চাকরির পূর্ব আর পরের অভিজ্ঞতা নিয়ে এই গল্প। আনু দেখে, খাবার সময় বাড়তি তরকারি চাইলে যাকে রীতিমতো খোটা দিতে ছাড়ে না, সেই তারাই একসময় বলে, “বেতন থেকে তুমি ভাইয়া কিছু কিছু টাকা জমিও। একটা হাতঘড়ি আর একখানা সাইকেল না হলে চলে না ব্যাটা ছেলেদের।” সংসারের করুণ চিত্রের পাশাপাশি সময়ের চিহ্ন ভেসে ওঠে গল্পে। সেই সময়ের ছেলেদের ক্রেজ, স্টাইল ইত্যাদি খুঁজে পায় পাঠক। আসলে একেকটা গল্প সময়ের সারচিহ্ন হয়ে যায় নির্মাণগুণে। মানুষের অন্তর্গত দুঃখ বাহিত বটেই, সংক্রামকও। “প্রাণের চেয়ে প্রিয়” গল্পটা সাবেরেরই জীবন থেকে নেয়া। আমরা দেখি, সাবেরের বাবা ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে জেলে দেখতে যান সাবেরকে। ছোট ভাইবোনের নানান প্রশ্ন। নানান কৌতূহল। সাবেরের অদম্য চরিত্রের বলিষ্ঠ প্রকাশ পায় গল্পে। ভাইবোনের সুন্দর সময়কে হাতড়ে বেড়ানো, খুনসুটি ইত্যাদি একাকার। ছাত্ররাজনীতি, সাম্যবাদ চর্চা, তৎসময়ের রাষ্ট্রের ভূমিকা, নিপীড়ন কতকিছু দেখিয়ে দেয় গল্পটা! আর আছে ভাষা-প্রকৌশল। “জেল আপিসের কপালে সতর্ক প্রহরীর মতো দুটো বিজলী বাতি ঝক ঝক করছে রোদে।” কিংবা “আজকাল তো লেখা-পড়া না জানা মেয়েদের দুলাই জুটবে না।” অথবা “তোমার মা বাবাই যদি মরে গেল, তবে কি হবে রাজনীতি দিয়ে। পলিটিক্স তোমাকে ভাত দেবে, না কাপড় দেবে?” বা “মানুষের জন্যেই পলিটিক্স। রাজনীতি মানুষের জন্য, একান্তভাবে মানুষের জন্য, সে রাজনীতির একজন ছাত্র হচ্ছি আমি।” এরকম সোনামাখা প্রশ্ন আর জিজ্ঞাসায় ভরপুর প্রাগুক্ত গল্পটি। দর্শনের ঘোর আছে, প্রাত্যহিক জীবনের আবেগ আছে। “ভাসুভাবীর জন্য” আরেক সার্থক গল্প সাবেরের। জমিদার প্রথা, জমিদারের ব্লু ব্লাড আর সম্পর্কের নানা সূত্র নিয়ে গল্পটা। প্রতিশোধপরায়ণ মানুষের হৃদয় কত নোংরা হয়, কতভাবে তারা নিজেদের চরিতার্থ পূরণ করে তার উদাহরণ গল্প কথকের মামা ওরফে জমিদার। যথারীতি এ গল্পেও আমরা সাবেরের জীবনের ছায়া দেখতে পাই। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি সম্মান পাবার আখাক্সক্ষা দেখা যায়- “বলত, মিঞার ভাগ্নে, অমুক মিঞা। আমার লজ্জা হতো না। বরং কেউ যদি আমায় যথেষ্ট সম্মান না দেখাত তাহলেই আমার খারাপ লাগত। মনে হতো এ আমার প্রাপ্য।” ছোট বয়সেও মানুষের এমন প্রত্যাশা অমূলক নয়, আমাদের দেশের শ্রেণিবিভাজন তাই শেখায় বৈকি। কিন্তু নসু ভাবীর জীবন দিতে হয় তার পিতার সাথে জমিদার মামার পূর্ব বৈরিতার মূল্য হিসেবে। গ্রামদেশের মাটির মানুষদের আন্তরিক তৎপরতা দেখা যায়, মেহেমানদারির বিষয়টা বোঝাও যায়। নারী নির্যাতন, শ্বশুরপক্ষের অত্যাচার, কত কিছু নীরবে ঘটে যায়! এবং গল্পের মাঝে রহস্য আছে, একটা চিঠি খুলে দেয় অনেক প্রশ্নের উত্তর। তবে এই গল্পটা সমাজের নানা দিকে ইশারা করে, খুলে দেয় বহু অন্ধকার দিক। “দেয়াল” গল্পটা আয়তনে একদম ছোট কিন্তু জেল জীবনের করুণ রাগিনীতে ভরপুর। জেলের সান্ত্রীর সাথে কয়েদীর ভাব হতে পারে কিন্তু পোশাক আর পদবীর যে ভার তা দূরত্ব তৈরি করবেই!

মূলত সমাজ পোশাক দিয়ে, পদ দিয়ে যে অন্তর্গত ফারাক শিখিয়েছে আমাদের তার চমৎকার বয়ান “দেয়াল” গল্পটি। দুই বন্ধুর নিখাঁদ বন্ধুত্বের গল্প “যৌবন”। এখানে যৌবন একটা বয়সকে প্রেজেন্ট করে, বয়সের সৌন্দর্যকেও। আনিস ও ফিরোজের নানামুখি কথাবার্তার মধ্যে গল্প এগিয়ে যায়। ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া, চাকরি-বেতন ইত্যাদির মূল স্রোত ব্যক্তির লাভালাভের সাথে যুক্ত থাকলেও শেষতক গল্পটা হয়ে ওঠে সবার। সাম্যবাদের সৈনিক সাবের মানবিকতার একটা চোরাটান দিয়ে শেষ করেন গল্পটা। হয়তো পাঠক গল্প পড়তে পড়তে ভাবতেই পারেনি শেষে এমনটা হবে। অথচ এটাই গল্প, এটাই শিল্প। মানুষের অসহায়ত্বে যদি মন না কাঁদে তবে কিশোর যৌবন? গল্পে আনিসের ভূমিকাকে কাজী নজরুলের যৌবনদীপ্ত পুরুষের অবিকল মনেহয় আমাদের। ইতিবাচক পরিবর্তনে যৌবন তথা ওই বয়সের ভূমিকা আরেকবার মনে করিয়ে দেয় প্রাগুক্ত গল্পটা। আনিসের জবানিতে শোনা যাক, “করবো তো রোজই। কিন্তু সেই মুহূর্তে দুটো বিদেশী সৈনিক আর মেয়েটাকে দেখে আমার মনে হলো আমার চাদরের দরকার নেই, গায়ের গরমেই অনেকদিন চলতে পারবো।” সাবেরদের মতো ত্যাগী তরুণদের কল্পিত নগরের আদর্শ যুবক আনিস, যাদের ত্যাগে মানুষের উপযোগী হবে এই বসুধা। নি¤œ মধ্যবিত্তের সফল সাহিত্যিক রূপকার হিসেবে শহীদ সাবের উল্লেখযোগ্য।

“চালচুলো” গল্পটাতে মুঠোচাল রাখার মতো পাশ বইয়ে থাকে খুচরো কিছু টাকা। পরিমাণে কম হলেও নিদানে তা দেয় পর্যাপ্ত শেল্টার। তারউপর পরিবেশ চেনে না পকেটের অবস্থা। গল্পে পড়া যাক, “আজ কিন্তু সকিনা বিবি একগাল হাসি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, দিনটা আজ ভালো যাবে মনে হচ্ছে। বৃষ্টি তো পড়বেই। খোকা তোর কাছে পয়সা-টয়সা আছে? থাকলে দেনা এক পোয়া গোশ এনে খিচুড়ি রাঁধি।” বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি খেতে মন চায় সবারই। খোকা গোশত কিনে আনে, সাথে আনে বন্ধুকেও। কিন্তু অভাবের জীবন নানা পরীক্ষায় ভরপুর! কথিত মিথের প্রভাবও আছে গল্পে। যেই রান্না করা গোশত পাতিলসহ সবটুকু পড়ে যায় মাটিতে সেই গোশত আবারো খাওয়ার মতো করে নেয় পরিবারের শিশুরাই! এখানে নি¤œবিত্তের জীবন সংগ্রাম, না-হারা মানসিকতা ইত্যাদির ইঙ্গিত আছে প্রবলভাবে।

সাংবাদিকতা পেশার বৈচিত্র্য সম্পর্কে পাঠকমাত্রই জানেন। খবরের পেছনের খবর নিয়ে গল্প “শেষ সংবাদ”। একজন সাংবাদিক তার সবটুকু দিয়ে সংগ্রহ করে সংবাদ কিন্তু তার বউয়েরও তো সংবাদ হবার শখ জাগতে পারে! এখানে গল্পকারের কৌতুকবোধ শংসা পাওয়ার মতো। গল্পের নায়ক রফিক যে কি না বিশ্ব বার্তার রিপোর্টার তার বউয়ের প্রশ্নের জবাবে এমন উত্তর গল্পকেও করে তোলে সহজবোধ্য। সাংবাদিকের উত্তরের মাধ্যমে গল্পকারের রসবোধ পড়া যাক, “তোমার বাচ্চা হয়েছে, তাই কি আর একটা খবর হলো। এমন কত সেলিনার কত বাচ্চা হচ্ছে। তবু বিয়োতে যদি দু’পার বদলে চার পা ওয়ালা বাচ্চা একটা, তবে সে হতো একটা খবর।” বর্তমানে নামে-বেনামে মিডিয়ার চরিত্রটাই যেন বহু আগে খোলাসা করেন সাবের। কিন্তু সাংবাদিকদের চাকরির নিশ্চয়তা, বেতনের নিশ্চয়তা কি আছে? বিশেষত রফিকের মতো সৎ রিপোর্টারদের? ভূরি ভূরি অসৎ সাংবাদিকের ভিড়ে গল্পের শেষে দেখি কোন রকম নোটিশ ছাড়াই বন্ধ হয়ে যায় বিশ্ব বার্তা। যারা লেখেন অনাচারের খবর তারাই মালিকপক্ষের ইচ্ছের বলি হয়ে কর্মহীন হয়ে পড়ে রাতের অন্ধকারে। সাবের নিজেও সাংবাদিকতা করেছেন ফলে তিনি আগাগোড়াই বোঝেন এই পেশার কুরুকিসিম। গল্পপাঠশেষে পাঠকের তাই খারাপ লাগে রফিকের জন্য।

“আবেগ” গল্পটা একেবারে ক্ষীণ শরীরের। অভাবের টোটেম দিয়ে দেশ স্বাধীনপূর্ব অবস্থার একটা প্রেক্ষিত দেখতে পাই আলোচ্য গল্পে। দেশপ্রেমের শিখা যেন নিরন্তর জ্বলছে গল্পটাতে। আছে শহুরে বাড়িয়লার নিয়তির চিত্র, “আমরাও চলি বাড়ি ভাড়ার টাকা দিয়ে”। নানা ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে গল্পের একেবারে শেষে দেখি, ক্ষুদ্রমানুষের সীমা। তার যুদ্ধ, তার নিনাদ কেবল “বালিশের তুলা সমস্ত বিছানায় ছড়িয়ে গেলো” পর্যন্ত। এখানে গল্পকারের চিন্তার পরিধি ও ভাবনার বিস্তার সম্পর্কে জানা যায় শব্দের কারিশমায়।

শহীদ সাবেরের কিশোর গল্পের সংখ্যাও কম নয়। সেসব গল্প আবার আলাদা ভাষায় কি বিন্যাসে। অর্থাৎ সাবের গল্প রচনার সময় সচেতনভাবে খেয়াল রেখেছেন বয়সের বিষয়টা এবং সেই অনুযায়ী শব্দ তো বটে বিষয় নির্বাচনেও পরিচয় দিয়েছেন মুন্সিয়ানার। শহীদ সাবের একজন সময়সচেতন গল্পকার; সমাজ নিয়ে তাঁর ভাবনা, তাঁর প্রজন্ম ও পরিপার্শ্বকে পরখ করেছেন খুব কাছ থেকে, একেবারে হৃদয় দিয়ে। ফলে শহীদ সাবেরের গল্প এতকাল পরে এসেও প্রাসঙ্গিক হয়ে ধরা দেয় বিদগ্ধ পাঠককুলের কাছে।

ঋণ:

১. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

২. সন্জীদা খাতুন

৩. মযহারুল ইসলাম বাবলা

৪. কালাম আজাদ

back to top