alt

সাময়িকী

বায়োস্কোপ

আহমেদ ফরিদ

: বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫

অলঙ্করণ : শতাব্দী জাহিদ

রূপবান বিবি চইলা আইলো,

আরে, রূপবান বিবি চইলা আইলো

রূপবান বিবির নাক দেখ, চোখ দেখ, মুখ দেখ,

দেখ রে, দেখ,

দেখ, দেখ।

রূপবানু চইলা গেল, রসিক দাদু চইলা আইল,

দাদু বড় রসিক আছে, দাদুর কান্দে বাছুর আছে।

অবাক বিস¥য়ে দেখি এক বুড়া সাহেব কাঁধে নাদুস নুদুস একটা বাছুর নিয়ে দাঁড়িয়ে। রূপবান বিবির সাজসজ্জা দেখে তো আমাদের চক্ষু চড়ক গাছ। এত সুন্দর কোনো মেয়ে হয়! এভাবে একের পর এক দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যায়, অবাক বিস¥য়ে আমরা সেই দৃশ্য দেখি।

আমাদের সে সিনেমা দেখার হোতা বেঙ্গা ভাই। তাকে অনেকে ডেঙ্গা বেঙ্গাও বলে। টিং টিংয়ে ল¤¦া বলে তার এ নাম। অবশ্য তার বেঙ্গা নামের শানে নজুল আমাদের জানা নেই। বেঙ থেকে তার নাম বেঙ্গা নাকি অন্য কোনো কিছু থেকে এ নামাকরণটি হয়েছে তা গবেষণার বিষয়। নামের উৎস নিয়ে কে কোথায় আর গবেষণা করেছে!

বেঙ্গা ভাই নেচে নেচে গান গাইছে। পরনে তার লাল-নীল তালি দেয়া জামা-পাজামা। মাথায় কাগজের রঙিন টুপি। নাচের তালে তালে পায়ের ঘুঙ্গুর বেজে চলছে। আমরা তার সিনেমা বক্সের বড় ছিদ্র দিয়ে একের পর এক দৃশ্য দেখে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে বেঙ্গা ভাই উপরের ফোঁকর দিয়ে দৃশ্য দেখে নিচ্ছে যাতে গানের সাথে দৃশ্যের মিল থাকে। তার হাতের ঘটঘটি বেজে চলছে সমানে।

তার ঘটঘটির আওয়াজ আমাদের কানে মধু বর্ষণ করলেও অনেক অভিভাবকের কাছে সে এক উপদ্রব। গ্রামের অধিকাংশ মানুষই খুব গরিব। বেঙ্গা ভাইয়ের সিনেমা বাচ্চাদের দেখানোর মতো পয়সা তাদের নেই। বেঙ্গা ভাই আবার ‘ফেল কড়ি মাখ তেল’ তত্ত্বে বিশ্বাসী। তিনি গান ধরেন-

ও রে ও পোলা-পান,

কাইন্দা কাইটা পয়সা আন,

পয়সা না দিলে

দুলা ভাইয়ের লেঙ্গুর ধইরা টান।

যাদের দুলা ভাই পয়সা কিংবা চাল নেই তাদের পক্ষে বেঙ্গা ভাইয়ের সিনেমা দেখা সম্ভব হয় না। তারা বেঙ্গা ভাইয়ের নাচ-গান আর অঙ্গভঙ্গি দেখেই সন্তুষ্ট। দেখা যাক আর না যাক তার ঘটঘটির আওয়াজ শোনামাত্র ছেলেমেয়েরা পিঁপড়ের সারির মতো দলে দলে ছুটে আসে। অধিকাংশই দিগ¤¦র। গায়ে সুতাটি পর্যন্ত নেই। কারো কারো নাক দিয়ে সর্দি ঝরছে, কারও গালে সর্দি শুকিয়ে ছটছটে হয়ে গিয়েছে। শুধু যে বাচ্চারা বেঙ্গা ভাইয়ের সিনেমা দেখে তা নয়, মাঝে মাঝে বড়রা ও দেখে। অবশ্য বড়রা টাকা দিতে চায়না। এ নিয়ে মাঝে মাঝে ঝামেলাও হয়।

বেঙ্গা ভাই আমাদের কাছে হিরু। সে যেভাবে আমাদেরকে আনন্দ দেয় অন্য কেউ সেভাবে পারে না। সে সিনেমার বাক্স না নিয়ে আসলেও আমরা তার পিছনে পিছনে ঘুরি, মজার মজার কথা শুনি।

গ্রামে যাত্রা হবে। দেখতে যাব। কিন্তু দেখব কী ভাবে? বাড়ি থেকে অনুমতি নেই। মাকে রাজি করালাম। শর্ত হলো বাবা যখন সালিশের উদ্দেশ্যে বের হবে তখন আমরা বের হব এবং ঘণ্টা তিনেক দেখে বাবা ফিরে আসার আগেই বাসায় চলে আসতে হবে। সঙ্গে যাবে জহির চাচা। জহির চাচা আমার চেয়ে বয়সে চার পাঁচ বছরের বড়। উত্তেজনায় বুক ঢিপ ঢিপ করছে।কখন বের হব। বাবা খেয়েদেয়ে বের হতেই আমরাও বের হয়ে গেলাম। যাত্রা হচ্ছে দক্ষিণ গ্রামে।

শীতের রাত। খেয়েদেয়ে অনেকেই লেপকাঁথার নীচে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। চষা ক্ষেতে স্টেজ তৈরি করা হয়েছে। কয়েকটি চৌকি পাশাপাশি বসিয়ে চৌকির নিচে মাটি দেয়া হয়েছে যাতে করে লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপিতে স্টেজ ভেঙ্গে না পড়ে। স্টেজের চার কোনায় চারটি খুঁটি, উপরে সামিয়ানা। চার খুঁটিতে চারটি হ্যাজাক লাইট ঝুলানো। এগুলো ঠিকঠাক রাখার জন্য দুই তিন জন লোক সদা নিয়োজিত থাকে। এক সাথে লাইট চারটি কখনও জ্বলে না। দেখা গেল তুমুল উত্তেজনার মূহূর্তে চারটি লাইটই নিভে গেছে। তখন শুরু হয় চিৎকার চেঁচামেচি। স্টেজের চারি পাশে নেড়া বিছানো। দর্শকদের বসার জন্য এটিই আসন। আমরা গিয়ে দেখি সামনের দিকে কোন জায়গা নেই। মাঝামাঝি জায়গায় বসার আসন পেলাম। বন্দনা দিয়ে যাত্র শরু হলো।

উত্তরে বন্দনা করি হিমালয় পর্বতের নাম- চারিদিক এবং পির আউলিয়ার নাম বন্দনা করে যাত্রা শুরু হলো। যাত্রার নাম আমার ঠিক মনে নেই। একটি পয়সা কিংবা দুইটি পয়সা এরকম একটা কিছু। যাত্রার প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ধনী গরিবের দ্বন্দ¡। নাটক জমে উঠেছে।

‘একটি পয়সা দাও গো বাবু, একটি পয়সা দাও

চোখের জলে বুক ভেসে যায়,

একটি পয়সা দাও’

বলে ভিক্ষার থলে হাতে যে লোকটি প্রবেশ করল তাকে প্রকৃত ভিক্ষুক হতে পৃথক করা কঠিন। তার গান ও কান্না দেখে আমার চোখেও পানি চলে আসল। কিন্তু বাবুরা অর্থাৎ ধনীরা তাকে পয়সা দিচ্ছে না। উপরন্তু একজন তাকে লাথি মেরে ফেলে দিল। দর্শকরা হায় হায় করে উঠল। কয়েকজন উত্তেজিত হয়ে স্টেজে উঠে ধনীদের মারে আর কী! দর্শকদের চোখে পানি, সেই সাথে আমারও। তন্ময় হয়ে দেখছি। এমন সময় লাগল প্র¯্রাব।

চাচা একটু বাইরে যাওয়া দরকার।

হু!

চাচা বাইরে যাওয়া দরকার, আমি আবার বলি।

বাইরে! বাইরে কেন?

প্র¯্রাব লাগছে।

থাপড়াইয়া দাঁত ফালাইয়া দিমু। বাড়িতে ভালো কইরা প্র¯্রাব কইরা আসতে পারস নাই।এতো লোকের মাঝখান দিয়ে তরে লইয়া বাইরে যামু কেমনে? চাইপা রাখ।

কিছুক্ষণ বহু কষ্টে চাইপা রাখি। যাত্রা দেখব কি আমি চাইপা রাখতে ব্যস্ত।

চাচা, আর পারতেছি না।

চাচা আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে থাকালেন। সে দৃষ্টিতে আমার ভস¥ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। যাত্রার স্টেজে তার দৃষ্টি আবদ্ধ। স্টেজে তখন খল নায়িকা মৌসুমি। মৌসুমি অত্যাধুনিকা শহুরে মেয়ে। পরনের শার্ট প্যান্ট খুবই টাইট। তার বিশেষ অঙ্গগুলো লোভনীয়ভাবে পরিস্ফুট হয়ে পড়েছে। চাচার দৃষ্টি সে দিকে।

অরে চিনছস নি?

কেমনে চিনব? এ রকম সুন্দর মেয়ে কি আমাদের গ্রামে আছে?

আরে বেকুব, ওতো আমার বন্ধু দুলাইল্লা। চাচা আবার যাত্রার দিকে মনোযোগ দিলেন। দুলাল চাচার এত ল¤¦া চুল আর অত বড় বুক হইল কেমনে? অর্বাচীনের মতো আমার প্রশ্ন?

‘সাজ রে, বোকা, সাজ’ চাচার উত্তর।

চাচা, আর পারতেছি না। কী করব?

থাপড়াইয়া দাঁত ফালাইয়া দিমু। বেশি লাগলে লুঙ্গি উঁচাইয়া নেড়া সরাইয়া মাটিতে করে ফেল। খবরদার, শব্দ যেন না হয়।

সাধু, সাধু! অতি উত্তম প্রস্তাব। জগতে এত মধুর বাণী মনে হয় জীবনে এই প্রথম শুনলাম। নেড়া সরালাম, হাত দিয়ে ছোট মতো একটা গর্ত করলাম মাটিতে, তার পর লুঙ্গি উঁচু করে বিশেষ অঙ্গটি মাটির কাছাকাছি সংস্থাপন করে কাজ সেরে ফেললাম। তেমন কোনো শব্দ হলো না। আর হলেও কেউ তা শুনতে পেত না। কারণ তখনও উদ্ভিন্ন যৌবনা মৌসুমী স্টেইজ দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে এবং প্রচ- শব্দে ব্যাক-গ্রাউন্ড মিউজিক বাজছে। দর্শকদের চক্ষু এবং কর্ত অন্য দিকে নিবদ্ধ করার সুযোগ কোথায়?

মোসুমীর প্রস্থানের পর মঞ্চে প্রবেশ করলেন বিবেক সাহেব। তার ল¤¦া দাঁড়ি, ল¤¦া চুল। পরনে একটি সাদা ধূতি। হাতে ত্রিশূলের মতো কী একটা যেন। তিনি গান ধরলেন।

‘ওরে নতুন পথে চল।’ তিনি ধনীদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন বাঁকা পথ ছেড়ে সোজা পথে আসার জন্য। করুণ সুরে বাজছে সানাই, ঢোল, বাঁশি ইত্যাদি। বিবেকের কাজ হলো গান গেয়ে মানুষের বিবেক জাগ্রত করা। তার গান হচ্ছে অন্যায়, অত্যাচার আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে। আহা! আমাদের সমাজে যদি সে রকম কিছু বিবেক থাকতেন! বিবেকের গান শেষ, তিনি চলে গেলেন। এর মধ্যেই শুরু হলো মারামারি। জান বাঁচানোর জন্য সবাই দৌঁড়াচ্ছে। চাচা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে দৌঁড় লাগালো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আয়োজোকবৃন্দ সমস্যা মিটিয়ে ফেললেন। পরে জানা গেল পেছনের লোক সামনে আসার জন্য এ সাজানো মারামারি লাগিয়েছিল। কোনো রকমে আগের জায়গার কাছাকাছি বসার সুযোগ পেলাম। তুমুল জোরে বাদ্যযন্ত্র বেজে চলছে। গ্রিন রুমের দিকে তাকিয়ে আছি পরবর্তিতে কী আসে দেখার জন্য। রঙিন কী যেন একটা আসছে, অল্প অল্প দেখা যাচ্ছে। ক্রমে তা স্পষ্ট হলো। সে যে আমাদের বেঙ্গা ভাই! পরণে লাল নীল জামা পায়জামা, মাথায় লাল নীল ল¤¦া হেঁট। সাদা ও লালে চিত্রিত মুখম-ল। হাতে মাথার সমান উঁচু লাঠি। লাঠির মাথাটি বাঁকা। সেখানে কাগজের একটি মালা জড়ানো। তিনি তার লাঠি নিয়ে চারিদিকে একটি চক্কর দিয়ে সবাইকে সালাম জানালেন। তারপর নূরপুর, ফুলপুর, গোকর্ত, জ্যেঠা গ্রাম, আশুরাইল, শ্রীঘর, বেণীপাড়া তেনিঘর ইত্যাদির সুরে নাসিরনগর থানার একশ’ ত্রিশটি গ্রামের নাম মুর্হূতের মধ্যে বলে ফেললেন। দর্শকদের তুমুল হাততালি। হাততালি শেষ হওয়ার সাথে সাথে আবার প্রচ- বাদ্য। বাদ্যের সুর স্তিমিত হয়ে আসলে তিনি আবার ধরলেন গান। গানের কথাগুলোর মধ্যে যথেষ্ট অশ্ললতা আছে, কিন্তু দর্শকরা গোগ্রাসে সেগুলি গিলছে। গানের কথাগুলো এরকম:

উত্তরে গেলাম রে, উঁচার উপর উঁচা,

ব্যাঙার হরি মুত্তে বইছে

ব্যাঙে মারল ...চা।

পাঠক নিজ গুণে বুঝে নিন। গানটি যে বেঙ্গা ভাইয়ের রচনা আর সুর করা তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই। গান শেষে বেঙ্গা ভাইয়ের প্রস্থান। দর্শকদের তুমুল হাততালি যেন আর থামতেই চায় না। আমি অভিভূত। বেঙ্গা ভাইকে মনে মনে ওস্তাদ মানলাম। আগামীকালই তাকে ধরতে হবে। আমাকে যেন সে সিনেমা চালানো আর গান শেখায়। কী হবে এ সব বি এ ডি বেড, এম এ ডি মেড এবং কালো কাক ভালো নাক ইত্যাদি হাবিজাবি পড়ালেখা শিখে! যাকগে, দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন, ধর্মের জয় অধর্মের পরাজয় এ নীতিকথার মধ্য দিয়েই সম্ভবত সেদিনকার যাত্রা পালা শেষ হয়েছিল।

আনন্দের আয়োজন যেখানে বেঙ্গা ভাই সেখানে। গ্রামে যাত্রা মানেই বেঙ্গা ভাই। বিচিত্র পোশাক-আশাক আর গান নিয়ে সে হাজির হবেই সেসব অনুষ্ঠানে। সবাইকে সে হাসায় আনন্দ দান করে। কিন্তু কোনো পেশায় সে বেশি দিন টিকতে পারে না। সিনেমা দেখানো বাদ দিয়ে এবার সে কুরু করলো ঝাপ বানানোর ব্যবসা। ঝাপ হলো এক ধরনের পার্টিসান যা বসত ঘরকে দু’ভাগ করে। গ্রামে অধিকাংশ বাড়িতেই বৈঠকখানা থাকে না। বাহিরের লোকজন বা মেহমান আসলে ঝাপের একপাশে পুরুষ এবং অন্য পার্শ্বে মহিলারা থাকেন। যার ঘরের ঝাপ যত সুন্দর তার তত বেশি নামডাক। বেঙ্গা ভাইয়ের তৈরি ঝাপগুলো খুবই সুন্দর, নকশাদার, রঙিন বাঁশ এবং বেতের তৈরি। তার তৈরি ঝাপের চাহিদাও বেশি। কিন্তু এ পেশাও তার পক্ষে বেশি দিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি; কারণ এগুলোর দাম গ্রামের সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার বাহিরে। ফলে আবার তার পেশার পরিবর্তন। এবার বেঙ্গা ভাইয়ের কাঁধে উঠল বিরাট এক বাক্স। না, সে সিনেমার বাক্স নয়। এটি কাঠমিস্ত্রির বাক্স। এর ভিতরে থাকে হাতুড়ি, বাটাল, বাইশ, রেদা ইত্য্যদি। বেঙ্গা ভাই এবার মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চৌকি, দরোজা ইত্যাদি সারায়। লাঙ্গল, চকম ইত্যাদি যন্ত্রপাতি তৈরি করে। জাত মিস্ত্রি নয় বলে বড় কাজ সে করতে পারে না। সেজন্য তার মনে কোন দুঃখ নেই।

একদিন সে এলো আমাদের বাড়িতে লাঙ্গল না চকম (মই) বানানোর জন্য। খুব আগ্রহ নিয়ে তার কাজ দেখতে লাগলাম। কানে কাঠ-পে›িসল গুজা, মাথায় তেল জবজবে বাবড়ি চুল। মজার মজার কথা বলছে আর কাজ করছে। মুগ্ধ হয়ে তার কাজ দেখছি আর যন্ত্রপাতিগুলো নাড়ছি।

মাস্টর তোমার বুদ্ধি কেমন অইছে দেখি। একটা শিলুক দেই ভাঙ্গাও তো। গ্রামে ছাত্রদেরকেও সে সময় মাস্টার বলে স¤ে¦াধন করা হতো।

আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। ভালো ছাত্র হিসেবে কিছু নাম ডাক হয়েছে।

‘বলো তোমার শ্লোক’ আমি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করি।

হাতড়া-বাটাল বাইশ খান,

চোরে নিল তিন খান,

রইল বাকি কয় খান?

এতো খুব সোজা। বাকি থাকবে উনিশ খান, আমার চটজলদি জবাব। উত্তর শুনে বেঙ্গা ভাইয়ের হো হো হাসি। যারা উত্তরটা জানেন তারাও হাসছেন। আমি বেঙ্গা ভাইযের কান হতে কলম টেনে নিয়ে অংক কষে দেখালাম বাইশটি জিনিস হতে তিনটি জিনিস বাদ দিলে উনিশটি জিনিসের কম বা বেশি কোনো অবস্থাতেই থাকতে পারে না।

বেঙ্গা ভাই হাতুড়ি, বাটালি এবং বাইশ নামক যন্ত্রটি একসাথে রাখল। আমাকে এ তিনটি জিনিস সরাতে বলল। আমি সরালাম।

এখন কয়টা জিনিস আছে? আমাকে জিজ্ঞেস করল।

কিছুই নাই। আমার উত্তর।

মাস্টর বুদ্ধি খেলাও, বুদ্ধি খেলাও।

এমনি ধরনের নানা রকম কৌতুক এবং শ্লোকে তার মাথা ভর্তি।

আর একদিনের ঘটনা।

বেঙ্গা ভাই, কোত্থেকে আইলা?

নাইল্যা (পাটগাছ) কাটতে গেছিলাম।

তুমি একাই?

হ্যাঁ।

তা কতটুকু জমির নাইল্যা কাটলে?

এক কানির।

বল কি? তুমি একাই এক কানি জমির নাইল্যা কাইটা ফেললে?

আরে, আমি না, হিয়াল (শিয়াল) কাটছে, হিয়াল।

শিয়াল কীভাবে কাটল তোমার এককানি পাটখেত?

আরে মাস্টর, বুদ্ধি থাকলে শ্বশুর বাড়িত কামলা খেটে খেতে হয় না।

বল না, শিয়াল কীভাবে তোমার পাটগাছ কাটল। আমার কৌতূহল তুঙ্গে।

সকালে নাইল্যা কাটতে গেলাম দাও (দা) হাতে নিয়ে। গিয়ে দেখলাম এক হিয়াইল্যা হাগতে বইছে। দিলাম দাও দিয়া বাউড়াল। দাওয়ের আছাড় (বাট) ঢুইকা গেল হিয়াইল্যার পিছন দিয়া। দাওটা রইল বাহিরে। হিয়াইল্যা দৌঁড়ায় আর নাইল্যা গাছ কাটা হয়। হিয়াইল্যা যে দিকে যায় আমি তারে উল্টা দিক দিয়া ধাওয়া দেই। এইভাবে আমার এক কানি খেতের নাইল্যা কাটা হয়ে যায়।

এ ধরনের আজব আজব গল্প সে আমাদেরকে শুনায়। তাকে দেখলেই কারণে অকারণে মানুষের মন খুশি হয়।

দিন যায়, বয়স বাড়ে, কলেজে পড়ি। এক ছুটিতে বাড়ি এসেছি। বসে আছি গাছ তলায় হাওয়া খেতে। বেঙ্গা ভাই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। একটু কুজো হয়ে হাটছে। কাঁধে গামছা ঝোলানো। শরীর দুর্বল।

বেঙ্গা ভাই, বেঙ্গা ভাই, বলে জোরে জোরে ডাকলাম।

বেঙ্গা ভাই যেন একটু চমকে উঠল। ঘাড় ফিরিয়ে আমাকে দেখল। আমাকে দেখে আনন্দে তার চোখ চকচক করে উঠল।

মাস্টর কবে আইছ?

গতকাল বেঙ্গা ভাই। তোমাকে তো কাহিল লাগছে। কী হইছে তোমার?

আর বলোনা রে, ভাই। গায়ে জ্বর, খুশ খুইস্যা কাশ। শরীরে জোর নাই, কাজকর্ম করতে পারি না।

বলো কী? কাজকর্ম না করতে পারলে তোমার দিন চলে কীভাবে?

আর দিন চলা। পুলাডা অইছে বাউন্ডাইল্যা। সারাদিন খালি মাইনসের বাইত ঘুরে। কোনোদিন খাই, কোনোদিন খাই না। অসুখের কোনো চিকিৎসাও করতে পারতেছি না। তোমার ভাবি মাইনসের বাড়ি বাড়ি ঘুরে যা পায় তা দিয়ে কোনো রকম চলে আর কী?

বলো কী? তাতো দেখি তোমার কঠিন অবস্থা।

হ ভাই, খুব খারাপ অবস্থা। দেখো তো, আমার শরীরের এলাজ করার লাইগ্যা কিছু সাহায্য করতে পার কিনা মাস্টার। বেঙ্গা ভাই এর কণ্ঠে মিনতি ঝরে পড়ে।

আমার ছোটবেলার স্বপ্নের নায়ক বেঙ্গা ভাই। আজ তার কী দূরাবস্থা। মনের অজান্তেই বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে বেঙ্গা ভাইয়ের জন্য।

ছবি

আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘ভাঙানৌকা’

ছবি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

জরিনা আখতারের কবিতা আত্ম-আবিষ্কার ও মুক্তি

ছবি

শহীদ সাবেরের সাহিত্য চিন্তা ও জীবনের সমন্বয়

ছবি

বাংলা ছোটগল্পের অনন্য রূপকার নরেন্দ্রনাথ মিত্র

ছবি

প্রেম, দর্শন ও অখণ্ডতা

ছবি

প্রতিবাদী চেতনার উর্বর ময়দান

ছবি

রবীন্দ্রনাথের আদি পুরুষের শেকড়

ছবি

ভেঙে পড়ে অন্তর্গহনের প্রগাঢ় অনুভূতি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

রহস্যময় পাহাড়ী মানব

ছবি

ফ্রিদা কাহলো : আত্মপ্রকাশের রঙিন ক্যানভাস

ছবি

জ্যাজ সংঙ্গীতের তাৎক্ষণিক সৃষ্টিশীলতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

নক্ষত্রের ধ্রুবতারা অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী

ছবি

নজরুল ও তাঁর সুন্দর

ছবি

নতুন বইয়ের খবর

ছবি

‘আমার চোখ যখন আমাকেই দেখে’- প্রেম ও প্রকৃতির সেতুবন্ধ

ছবি

পূষন ও বৃষ্টির গল্প

ছবি

নিরামিষ চর্চার বিরল আখ্যান

ছবি

‘আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ভ্রম

ছবি

পালকের চিহ্নগুলো

ছবি

নতুন বইয়ের খবর

ছবি

রফিক আজাদের কবিতা

ছবি

ধূসর পাণ্ডুলিপি পরিবহন

ছবি

চৈত্রের কোনো এক মধ্যরাতে

ছবি

দেশভাগের বিপর্যয় ও ‘জলপাইহাটি’র জীবনানন্দ দাশ

ছবি

সামান্য ভুল

সাময়িকী কবিতা

ছবি

আধুনিক বাংলা কবিতার প্রথাভাঙা মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত

ছবি

ধুলোময় জীবনের মেটাফর

ছবি

স্কুলটি ছোট্ট বটে

ছবি

নতুন বইয়ের খবর

ছবি

পালকের চিহ্নগুলো

tab

সাময়িকী

বায়োস্কোপ

আহমেদ ফরিদ

অলঙ্করণ : শতাব্দী জাহিদ

বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫

রূপবান বিবি চইলা আইলো,

আরে, রূপবান বিবি চইলা আইলো

রূপবান বিবির নাক দেখ, চোখ দেখ, মুখ দেখ,

দেখ রে, দেখ,

দেখ, দেখ।

রূপবানু চইলা গেল, রসিক দাদু চইলা আইল,

দাদু বড় রসিক আছে, দাদুর কান্দে বাছুর আছে।

অবাক বিস¥য়ে দেখি এক বুড়া সাহেব কাঁধে নাদুস নুদুস একটা বাছুর নিয়ে দাঁড়িয়ে। রূপবান বিবির সাজসজ্জা দেখে তো আমাদের চক্ষু চড়ক গাছ। এত সুন্দর কোনো মেয়ে হয়! এভাবে একের পর এক দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যায়, অবাক বিস¥য়ে আমরা সেই দৃশ্য দেখি।

আমাদের সে সিনেমা দেখার হোতা বেঙ্গা ভাই। তাকে অনেকে ডেঙ্গা বেঙ্গাও বলে। টিং টিংয়ে ল¤¦া বলে তার এ নাম। অবশ্য তার বেঙ্গা নামের শানে নজুল আমাদের জানা নেই। বেঙ থেকে তার নাম বেঙ্গা নাকি অন্য কোনো কিছু থেকে এ নামাকরণটি হয়েছে তা গবেষণার বিষয়। নামের উৎস নিয়ে কে কোথায় আর গবেষণা করেছে!

বেঙ্গা ভাই নেচে নেচে গান গাইছে। পরনে তার লাল-নীল তালি দেয়া জামা-পাজামা। মাথায় কাগজের রঙিন টুপি। নাচের তালে তালে পায়ের ঘুঙ্গুর বেজে চলছে। আমরা তার সিনেমা বক্সের বড় ছিদ্র দিয়ে একের পর এক দৃশ্য দেখে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে বেঙ্গা ভাই উপরের ফোঁকর দিয়ে দৃশ্য দেখে নিচ্ছে যাতে গানের সাথে দৃশ্যের মিল থাকে। তার হাতের ঘটঘটি বেজে চলছে সমানে।

তার ঘটঘটির আওয়াজ আমাদের কানে মধু বর্ষণ করলেও অনেক অভিভাবকের কাছে সে এক উপদ্রব। গ্রামের অধিকাংশ মানুষই খুব গরিব। বেঙ্গা ভাইয়ের সিনেমা বাচ্চাদের দেখানোর মতো পয়সা তাদের নেই। বেঙ্গা ভাই আবার ‘ফেল কড়ি মাখ তেল’ তত্ত্বে বিশ্বাসী। তিনি গান ধরেন-

ও রে ও পোলা-পান,

কাইন্দা কাইটা পয়সা আন,

পয়সা না দিলে

দুলা ভাইয়ের লেঙ্গুর ধইরা টান।

যাদের দুলা ভাই পয়সা কিংবা চাল নেই তাদের পক্ষে বেঙ্গা ভাইয়ের সিনেমা দেখা সম্ভব হয় না। তারা বেঙ্গা ভাইয়ের নাচ-গান আর অঙ্গভঙ্গি দেখেই সন্তুষ্ট। দেখা যাক আর না যাক তার ঘটঘটির আওয়াজ শোনামাত্র ছেলেমেয়েরা পিঁপড়ের সারির মতো দলে দলে ছুটে আসে। অধিকাংশই দিগ¤¦র। গায়ে সুতাটি পর্যন্ত নেই। কারো কারো নাক দিয়ে সর্দি ঝরছে, কারও গালে সর্দি শুকিয়ে ছটছটে হয়ে গিয়েছে। শুধু যে বাচ্চারা বেঙ্গা ভাইয়ের সিনেমা দেখে তা নয়, মাঝে মাঝে বড়রা ও দেখে। অবশ্য বড়রা টাকা দিতে চায়না। এ নিয়ে মাঝে মাঝে ঝামেলাও হয়।

বেঙ্গা ভাই আমাদের কাছে হিরু। সে যেভাবে আমাদেরকে আনন্দ দেয় অন্য কেউ সেভাবে পারে না। সে সিনেমার বাক্স না নিয়ে আসলেও আমরা তার পিছনে পিছনে ঘুরি, মজার মজার কথা শুনি।

গ্রামে যাত্রা হবে। দেখতে যাব। কিন্তু দেখব কী ভাবে? বাড়ি থেকে অনুমতি নেই। মাকে রাজি করালাম। শর্ত হলো বাবা যখন সালিশের উদ্দেশ্যে বের হবে তখন আমরা বের হব এবং ঘণ্টা তিনেক দেখে বাবা ফিরে আসার আগেই বাসায় চলে আসতে হবে। সঙ্গে যাবে জহির চাচা। জহির চাচা আমার চেয়ে বয়সে চার পাঁচ বছরের বড়। উত্তেজনায় বুক ঢিপ ঢিপ করছে।কখন বের হব। বাবা খেয়েদেয়ে বের হতেই আমরাও বের হয়ে গেলাম। যাত্রা হচ্ছে দক্ষিণ গ্রামে।

শীতের রাত। খেয়েদেয়ে অনেকেই লেপকাঁথার নীচে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। চষা ক্ষেতে স্টেজ তৈরি করা হয়েছে। কয়েকটি চৌকি পাশাপাশি বসিয়ে চৌকির নিচে মাটি দেয়া হয়েছে যাতে করে লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপিতে স্টেজ ভেঙ্গে না পড়ে। স্টেজের চার কোনায় চারটি খুঁটি, উপরে সামিয়ানা। চার খুঁটিতে চারটি হ্যাজাক লাইট ঝুলানো। এগুলো ঠিকঠাক রাখার জন্য দুই তিন জন লোক সদা নিয়োজিত থাকে। এক সাথে লাইট চারটি কখনও জ্বলে না। দেখা গেল তুমুল উত্তেজনার মূহূর্তে চারটি লাইটই নিভে গেছে। তখন শুরু হয় চিৎকার চেঁচামেচি। স্টেজের চারি পাশে নেড়া বিছানো। দর্শকদের বসার জন্য এটিই আসন। আমরা গিয়ে দেখি সামনের দিকে কোন জায়গা নেই। মাঝামাঝি জায়গায় বসার আসন পেলাম। বন্দনা দিয়ে যাত্র শরু হলো।

উত্তরে বন্দনা করি হিমালয় পর্বতের নাম- চারিদিক এবং পির আউলিয়ার নাম বন্দনা করে যাত্রা শুরু হলো। যাত্রার নাম আমার ঠিক মনে নেই। একটি পয়সা কিংবা দুইটি পয়সা এরকম একটা কিছু। যাত্রার প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ধনী গরিবের দ্বন্দ¡। নাটক জমে উঠেছে।

‘একটি পয়সা দাও গো বাবু, একটি পয়সা দাও

চোখের জলে বুক ভেসে যায়,

একটি পয়সা দাও’

বলে ভিক্ষার থলে হাতে যে লোকটি প্রবেশ করল তাকে প্রকৃত ভিক্ষুক হতে পৃথক করা কঠিন। তার গান ও কান্না দেখে আমার চোখেও পানি চলে আসল। কিন্তু বাবুরা অর্থাৎ ধনীরা তাকে পয়সা দিচ্ছে না। উপরন্তু একজন তাকে লাথি মেরে ফেলে দিল। দর্শকরা হায় হায় করে উঠল। কয়েকজন উত্তেজিত হয়ে স্টেজে উঠে ধনীদের মারে আর কী! দর্শকদের চোখে পানি, সেই সাথে আমারও। তন্ময় হয়ে দেখছি। এমন সময় লাগল প্র¯্রাব।

চাচা একটু বাইরে যাওয়া দরকার।

হু!

চাচা বাইরে যাওয়া দরকার, আমি আবার বলি।

বাইরে! বাইরে কেন?

প্র¯্রাব লাগছে।

থাপড়াইয়া দাঁত ফালাইয়া দিমু। বাড়িতে ভালো কইরা প্র¯্রাব কইরা আসতে পারস নাই।এতো লোকের মাঝখান দিয়ে তরে লইয়া বাইরে যামু কেমনে? চাইপা রাখ।

কিছুক্ষণ বহু কষ্টে চাইপা রাখি। যাত্রা দেখব কি আমি চাইপা রাখতে ব্যস্ত।

চাচা, আর পারতেছি না।

চাচা আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে থাকালেন। সে দৃষ্টিতে আমার ভস¥ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। যাত্রার স্টেজে তার দৃষ্টি আবদ্ধ। স্টেজে তখন খল নায়িকা মৌসুমি। মৌসুমি অত্যাধুনিকা শহুরে মেয়ে। পরনের শার্ট প্যান্ট খুবই টাইট। তার বিশেষ অঙ্গগুলো লোভনীয়ভাবে পরিস্ফুট হয়ে পড়েছে। চাচার দৃষ্টি সে দিকে।

অরে চিনছস নি?

কেমনে চিনব? এ রকম সুন্দর মেয়ে কি আমাদের গ্রামে আছে?

আরে বেকুব, ওতো আমার বন্ধু দুলাইল্লা। চাচা আবার যাত্রার দিকে মনোযোগ দিলেন। দুলাল চাচার এত ল¤¦া চুল আর অত বড় বুক হইল কেমনে? অর্বাচীনের মতো আমার প্রশ্ন?

‘সাজ রে, বোকা, সাজ’ চাচার উত্তর।

চাচা, আর পারতেছি না। কী করব?

থাপড়াইয়া দাঁত ফালাইয়া দিমু। বেশি লাগলে লুঙ্গি উঁচাইয়া নেড়া সরাইয়া মাটিতে করে ফেল। খবরদার, শব্দ যেন না হয়।

সাধু, সাধু! অতি উত্তম প্রস্তাব। জগতে এত মধুর বাণী মনে হয় জীবনে এই প্রথম শুনলাম। নেড়া সরালাম, হাত দিয়ে ছোট মতো একটা গর্ত করলাম মাটিতে, তার পর লুঙ্গি উঁচু করে বিশেষ অঙ্গটি মাটির কাছাকাছি সংস্থাপন করে কাজ সেরে ফেললাম। তেমন কোনো শব্দ হলো না। আর হলেও কেউ তা শুনতে পেত না। কারণ তখনও উদ্ভিন্ন যৌবনা মৌসুমী স্টেইজ দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে এবং প্রচ- শব্দে ব্যাক-গ্রাউন্ড মিউজিক বাজছে। দর্শকদের চক্ষু এবং কর্ত অন্য দিকে নিবদ্ধ করার সুযোগ কোথায়?

মোসুমীর প্রস্থানের পর মঞ্চে প্রবেশ করলেন বিবেক সাহেব। তার ল¤¦া দাঁড়ি, ল¤¦া চুল। পরনে একটি সাদা ধূতি। হাতে ত্রিশূলের মতো কী একটা যেন। তিনি গান ধরলেন।

‘ওরে নতুন পথে চল।’ তিনি ধনীদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন বাঁকা পথ ছেড়ে সোজা পথে আসার জন্য। করুণ সুরে বাজছে সানাই, ঢোল, বাঁশি ইত্যাদি। বিবেকের কাজ হলো গান গেয়ে মানুষের বিবেক জাগ্রত করা। তার গান হচ্ছে অন্যায়, অত্যাচার আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে। আহা! আমাদের সমাজে যদি সে রকম কিছু বিবেক থাকতেন! বিবেকের গান শেষ, তিনি চলে গেলেন। এর মধ্যেই শুরু হলো মারামারি। জান বাঁচানোর জন্য সবাই দৌঁড়াচ্ছে। চাচা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে দৌঁড় লাগালো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আয়োজোকবৃন্দ সমস্যা মিটিয়ে ফেললেন। পরে জানা গেল পেছনের লোক সামনে আসার জন্য এ সাজানো মারামারি লাগিয়েছিল। কোনো রকমে আগের জায়গার কাছাকাছি বসার সুযোগ পেলাম। তুমুল জোরে বাদ্যযন্ত্র বেজে চলছে। গ্রিন রুমের দিকে তাকিয়ে আছি পরবর্তিতে কী আসে দেখার জন্য। রঙিন কী যেন একটা আসছে, অল্প অল্প দেখা যাচ্ছে। ক্রমে তা স্পষ্ট হলো। সে যে আমাদের বেঙ্গা ভাই! পরণে লাল নীল জামা পায়জামা, মাথায় লাল নীল ল¤¦া হেঁট। সাদা ও লালে চিত্রিত মুখম-ল। হাতে মাথার সমান উঁচু লাঠি। লাঠির মাথাটি বাঁকা। সেখানে কাগজের একটি মালা জড়ানো। তিনি তার লাঠি নিয়ে চারিদিকে একটি চক্কর দিয়ে সবাইকে সালাম জানালেন। তারপর নূরপুর, ফুলপুর, গোকর্ত, জ্যেঠা গ্রাম, আশুরাইল, শ্রীঘর, বেণীপাড়া তেনিঘর ইত্যাদির সুরে নাসিরনগর থানার একশ’ ত্রিশটি গ্রামের নাম মুর্হূতের মধ্যে বলে ফেললেন। দর্শকদের তুমুল হাততালি। হাততালি শেষ হওয়ার সাথে সাথে আবার প্রচ- বাদ্য। বাদ্যের সুর স্তিমিত হয়ে আসলে তিনি আবার ধরলেন গান। গানের কথাগুলোর মধ্যে যথেষ্ট অশ্ললতা আছে, কিন্তু দর্শকরা গোগ্রাসে সেগুলি গিলছে। গানের কথাগুলো এরকম:

উত্তরে গেলাম রে, উঁচার উপর উঁচা,

ব্যাঙার হরি মুত্তে বইছে

ব্যাঙে মারল ...চা।

পাঠক নিজ গুণে বুঝে নিন। গানটি যে বেঙ্গা ভাইয়ের রচনা আর সুর করা তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই। গান শেষে বেঙ্গা ভাইয়ের প্রস্থান। দর্শকদের তুমুল হাততালি যেন আর থামতেই চায় না। আমি অভিভূত। বেঙ্গা ভাইকে মনে মনে ওস্তাদ মানলাম। আগামীকালই তাকে ধরতে হবে। আমাকে যেন সে সিনেমা চালানো আর গান শেখায়। কী হবে এ সব বি এ ডি বেড, এম এ ডি মেড এবং কালো কাক ভালো নাক ইত্যাদি হাবিজাবি পড়ালেখা শিখে! যাকগে, দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন, ধর্মের জয় অধর্মের পরাজয় এ নীতিকথার মধ্য দিয়েই সম্ভবত সেদিনকার যাত্রা পালা শেষ হয়েছিল।

আনন্দের আয়োজন যেখানে বেঙ্গা ভাই সেখানে। গ্রামে যাত্রা মানেই বেঙ্গা ভাই। বিচিত্র পোশাক-আশাক আর গান নিয়ে সে হাজির হবেই সেসব অনুষ্ঠানে। সবাইকে সে হাসায় আনন্দ দান করে। কিন্তু কোনো পেশায় সে বেশি দিন টিকতে পারে না। সিনেমা দেখানো বাদ দিয়ে এবার সে কুরু করলো ঝাপ বানানোর ব্যবসা। ঝাপ হলো এক ধরনের পার্টিসান যা বসত ঘরকে দু’ভাগ করে। গ্রামে অধিকাংশ বাড়িতেই বৈঠকখানা থাকে না। বাহিরের লোকজন বা মেহমান আসলে ঝাপের একপাশে পুরুষ এবং অন্য পার্শ্বে মহিলারা থাকেন। যার ঘরের ঝাপ যত সুন্দর তার তত বেশি নামডাক। বেঙ্গা ভাইয়ের তৈরি ঝাপগুলো খুবই সুন্দর, নকশাদার, রঙিন বাঁশ এবং বেতের তৈরি। তার তৈরি ঝাপের চাহিদাও বেশি। কিন্তু এ পেশাও তার পক্ষে বেশি দিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি; কারণ এগুলোর দাম গ্রামের সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার বাহিরে। ফলে আবার তার পেশার পরিবর্তন। এবার বেঙ্গা ভাইয়ের কাঁধে উঠল বিরাট এক বাক্স। না, সে সিনেমার বাক্স নয়। এটি কাঠমিস্ত্রির বাক্স। এর ভিতরে থাকে হাতুড়ি, বাটাল, বাইশ, রেদা ইত্য্যদি। বেঙ্গা ভাই এবার মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চৌকি, দরোজা ইত্যাদি সারায়। লাঙ্গল, চকম ইত্যাদি যন্ত্রপাতি তৈরি করে। জাত মিস্ত্রি নয় বলে বড় কাজ সে করতে পারে না। সেজন্য তার মনে কোন দুঃখ নেই।

একদিন সে এলো আমাদের বাড়িতে লাঙ্গল না চকম (মই) বানানোর জন্য। খুব আগ্রহ নিয়ে তার কাজ দেখতে লাগলাম। কানে কাঠ-পে›িসল গুজা, মাথায় তেল জবজবে বাবড়ি চুল। মজার মজার কথা বলছে আর কাজ করছে। মুগ্ধ হয়ে তার কাজ দেখছি আর যন্ত্রপাতিগুলো নাড়ছি।

মাস্টর তোমার বুদ্ধি কেমন অইছে দেখি। একটা শিলুক দেই ভাঙ্গাও তো। গ্রামে ছাত্রদেরকেও সে সময় মাস্টার বলে স¤ে¦াধন করা হতো।

আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। ভালো ছাত্র হিসেবে কিছু নাম ডাক হয়েছে।

‘বলো তোমার শ্লোক’ আমি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করি।

হাতড়া-বাটাল বাইশ খান,

চোরে নিল তিন খান,

রইল বাকি কয় খান?

এতো খুব সোজা। বাকি থাকবে উনিশ খান, আমার চটজলদি জবাব। উত্তর শুনে বেঙ্গা ভাইয়ের হো হো হাসি। যারা উত্তরটা জানেন তারাও হাসছেন। আমি বেঙ্গা ভাইযের কান হতে কলম টেনে নিয়ে অংক কষে দেখালাম বাইশটি জিনিস হতে তিনটি জিনিস বাদ দিলে উনিশটি জিনিসের কম বা বেশি কোনো অবস্থাতেই থাকতে পারে না।

বেঙ্গা ভাই হাতুড়ি, বাটালি এবং বাইশ নামক যন্ত্রটি একসাথে রাখল। আমাকে এ তিনটি জিনিস সরাতে বলল। আমি সরালাম।

এখন কয়টা জিনিস আছে? আমাকে জিজ্ঞেস করল।

কিছুই নাই। আমার উত্তর।

মাস্টর বুদ্ধি খেলাও, বুদ্ধি খেলাও।

এমনি ধরনের নানা রকম কৌতুক এবং শ্লোকে তার মাথা ভর্তি।

আর একদিনের ঘটনা।

বেঙ্গা ভাই, কোত্থেকে আইলা?

নাইল্যা (পাটগাছ) কাটতে গেছিলাম।

তুমি একাই?

হ্যাঁ।

তা কতটুকু জমির নাইল্যা কাটলে?

এক কানির।

বল কি? তুমি একাই এক কানি জমির নাইল্যা কাইটা ফেললে?

আরে, আমি না, হিয়াল (শিয়াল) কাটছে, হিয়াল।

শিয়াল কীভাবে কাটল তোমার এককানি পাটখেত?

আরে মাস্টর, বুদ্ধি থাকলে শ্বশুর বাড়িত কামলা খেটে খেতে হয় না।

বল না, শিয়াল কীভাবে তোমার পাটগাছ কাটল। আমার কৌতূহল তুঙ্গে।

সকালে নাইল্যা কাটতে গেলাম দাও (দা) হাতে নিয়ে। গিয়ে দেখলাম এক হিয়াইল্যা হাগতে বইছে। দিলাম দাও দিয়া বাউড়াল। দাওয়ের আছাড় (বাট) ঢুইকা গেল হিয়াইল্যার পিছন দিয়া। দাওটা রইল বাহিরে। হিয়াইল্যা দৌঁড়ায় আর নাইল্যা গাছ কাটা হয়। হিয়াইল্যা যে দিকে যায় আমি তারে উল্টা দিক দিয়া ধাওয়া দেই। এইভাবে আমার এক কানি খেতের নাইল্যা কাটা হয়ে যায়।

এ ধরনের আজব আজব গল্প সে আমাদেরকে শুনায়। তাকে দেখলেই কারণে অকারণে মানুষের মন খুশি হয়।

দিন যায়, বয়স বাড়ে, কলেজে পড়ি। এক ছুটিতে বাড়ি এসেছি। বসে আছি গাছ তলায় হাওয়া খেতে। বেঙ্গা ভাই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। একটু কুজো হয়ে হাটছে। কাঁধে গামছা ঝোলানো। শরীর দুর্বল।

বেঙ্গা ভাই, বেঙ্গা ভাই, বলে জোরে জোরে ডাকলাম।

বেঙ্গা ভাই যেন একটু চমকে উঠল। ঘাড় ফিরিয়ে আমাকে দেখল। আমাকে দেখে আনন্দে তার চোখ চকচক করে উঠল।

মাস্টর কবে আইছ?

গতকাল বেঙ্গা ভাই। তোমাকে তো কাহিল লাগছে। কী হইছে তোমার?

আর বলোনা রে, ভাই। গায়ে জ্বর, খুশ খুইস্যা কাশ। শরীরে জোর নাই, কাজকর্ম করতে পারি না।

বলো কী? কাজকর্ম না করতে পারলে তোমার দিন চলে কীভাবে?

আর দিন চলা। পুলাডা অইছে বাউন্ডাইল্যা। সারাদিন খালি মাইনসের বাইত ঘুরে। কোনোদিন খাই, কোনোদিন খাই না। অসুখের কোনো চিকিৎসাও করতে পারতেছি না। তোমার ভাবি মাইনসের বাড়ি বাড়ি ঘুরে যা পায় তা দিয়ে কোনো রকম চলে আর কী?

বলো কী? তাতো দেখি তোমার কঠিন অবস্থা।

হ ভাই, খুব খারাপ অবস্থা। দেখো তো, আমার শরীরের এলাজ করার লাইগ্যা কিছু সাহায্য করতে পার কিনা মাস্টার। বেঙ্গা ভাই এর কণ্ঠে মিনতি ঝরে পড়ে।

আমার ছোটবেলার স্বপ্নের নায়ক বেঙ্গা ভাই। আজ তার কী দূরাবস্থা। মনের অজান্তেই বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে বেঙ্গা ভাইয়ের জন্য।

back to top