মূল: কামিলা শামসি অনুবাদ: ফজল হাসান
(অনুবাদকের কথা: পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখিকা কামিলা শামসি রচিত ছোটগল্প ‘শাঁকচুন্নি’ (ইংরেজি শিরোনাম ‘চুরাইল’) পাকিস্তানি পুরুষতান্ত্রিক লোককাহিনীর একটি নারীবাদী ব্যাখ্যা এবং শাঁকচুন্নি পৌরাণিক কাহিনী দ্বারা অনুপ্রাণিত- একজন মহিলার বিদ্বেষপূর্ণ চেতনা, যা পুরুষদের মৃত্যুর দিকে প্রলুব্ধ করে। এখানে শাঁকচুন্নির কিংবদন্তি বর্তমানে ইংল্যান্ডে বসবাসকারী একটি পাকিস্তানি পরিবারের গতিশীলতার বৈশিষ্ট্য রয়েছে। উল্লেখ্য, এই গল্পটি ‘বিবিসি ন্যাশনাল শর্ট স্টোরি অ্যাওয়ার্ড ২০২৩’ পেয়েছে।)
আমার জন্মের কয়েক সপ্তাহ পরেই বাবা আমাকে নিয়ে ইংল্যান্ডে চলে আসেন। কেননা তিনি নিজেকে এবং আমাকে আমার মায়ের বিদেহী আত্মার প্রভাব থেকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। আমার মা আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। যখন আমার বয়স ছয় বছর, তখন আমার চাচাতো বোন জয়নব আমাকে ঘটনার আড়ালে লুকিয়ে থাকা আমার ভূমিকার কথা বলেছে। সেই সময় বাবা আমাকে নিয়ে ম্যানচেস্টার থেকে লন্ডনে স্থায়ী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ম্যানচেস্টারে আমরা জয়নবের বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতাম। সত্যি কথাটা শোনা জরুরি, এগারো বছর বয়সী জয়নব আমাকে গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলল সে জানে না ছোট চাচাতো বোনকে কখন আবার দেখতে পাবে। আমার জন্মের আগে মায়ের চার বার গর্ভপাত হয়েছিল এবং দ্বিতীয় গর্ভপাতের পরে ডাক্তাররা আর গর্ভধারণ না করার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমার মা দত্তক নেওয়ার কথা বলেছিলেন, কিন্তু আমার বাবা জেদ ধরেছিলেন এবং বলেছিলেন যে, তাঁর ঔরসের পুত্র সন্তান থাকতে হবে। একসময় দুনিয়া প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, যখন প্রকৃতি মানুষকে কী বলতে চাইছে, যা মানুষেরা বুঝতে অস্বীকার করে: বাবার সেই সিদ্ধান্ত তাঁকে ভুল ধরনের সন্তান দিয়েছে এবং যার জন্য তিনি তাঁর স্ত্রীকে হারিয়েছেন।
তখন ছিল গ্রীষ্মকাল। আমরা জয়নবের শোবার ঘরের মেঝেতে বসেছিলাম। তার সেই ঘরে সে আমার সঙ্গে থাকতে সম্মত হয়েছিল, কারণ আমার তখন চাচির বিছানার পাশের দোলনা ছেড়ে দেওয়ার মতো যথেষ্ট বয়স হয়েছিল। সেরেনা উইলিয়ামস১ এবং ‘ওয়ান ডিরেকশন’২ আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল, যখন জুলাই মাসের বৃষ্টি বাইরের দুনিয়াকে প্রত্যাশিতভাবে ঝাপসা করে তুলেছিল। জয়নব আমার হাতটা তার হাতে তুলে নিয়েছিল। পরের মুহূর্তটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সে বলেছিল। আমার বয়স যখন মাত্র কয়েকদিন, তখন বাবা শুনতে পেয়েছিলেন যে, আমাদের বাড়ির অদূরে রাস্তার উল্টোদিকে বেড়ে ওঠা পিপুল গাছ থেকে এক মহিলা বাবার নাম ধরে ডেকেছিল। প্রথমবার ডাকার পর বাবা মুখ তুলে তাকিয়েছিলেন এবং দ্বিতীয়বার ডাকার সময় তিনি দরজার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। তৃতীয়বার কোনো ডাক শুনতে না পেয়ে তিনি ভীষণ ভয় আর আতঙ্কে রক্তশূন্য হয়ে অসাড় হয়ে গিয়েছিলেন। আমার আয়া সব দেখেছে এবং সে-ই আমাদের গ্রামে ঘটনাটি রটিয়ে দিয়েছিল যে, আমার মা শাঁকচুন্নি হয়ে গেছেন।
সন্তান প্রসবকালীন মারা যাওয়া মহিলারা প্রায়শই শাঁকচুন্নি হয়ে যান। তারা পিপুল গাছে বাস করার শখের কারণে এবং তাদের শিকারদের সুমিষ্ট কণ্ঠে ডাকার জন্য পরিচিত। শাঁকচুন্নির প্রলোভনে পড়ার জন্য কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার রাত সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়। কেননা যে কেউ তখনই কেবল তার মুখের সৌন্দর্য দেখতে পরে এবং গোড়ালির দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া পায়ের প্রকাশ্য চিহ্নটি এড়িয়ে যেতে পারে। শাঁকচুন্নির অন্য সঙ্কেতটি হলো সে সবসময় তার শিকারের নাম দু’বার ডাকে- কখনো একবার নয়, এমনকি তিনবারও নয়। সে পুরুষদের তার গোপন আস্তানায় প্রলুব্ধ করে এবং তাদের সেখানে রাখে, তাদের জীবনীশক্তি নিঃশেষ করে দেয়, যতক্ষণ না তারা বৃদ্ধ হয়ে যায়। যখন শাঁকচুন্নি শিকারীদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে দেয়, তখন তারা দেখতে পায় যে কয়েক দশক কেটে গেছে এবং তারা জানত যে সবাই মারা গেছে, তাই তারা একা এবং প্রেমহীন জীবন সমাপ্ত করে।
মূলত রিপ ভ্যান উইঙ্কল ছিল এমন প্রফুল্ল একজন পুরুষের গল্প, যে কিনা শাঁকচুন্নির প্রলোভনের শিকার হয়ে যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার সঙ্গে দূরে সরে গিয়েছিল। তবে শুধু আমার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য জয়নব তার স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ‘যৌনতা’ শব্দটি আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে সংক্ষেপে বলেছিল। তারপর সে পুনরায় গম্ভীর হয়ে বলল: তোমার বাবা বলেছেন যে, তিনি আর কখনো পাকিস্তানে ফিরে যাবেন না। কারণ সেটি এক ভয়ঙ্কর জায়গা, এমনকি কেউ তাঁকে বিশ্বাস করবে না। তিনি কিছুতেই ফিরে যাবেন না, কেননা তিনি ভয় পাচ্ছেন যে, শাঁকচুন্নি তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে।
আমার ছয় বছর বয়সে আমরা ম্যানচেস্টার থেকে লন্ডনে জায়গা বদল করেছি, আট বছর বয়সে ওয়েম্বলি থেকে কুইনস্ পার্কে গিয়েছি এবং নয় বছর বয়সে কুইনস্ পার্ক থেকে কেনসিংটনে বসতি গড়ে তুলেছি। অবশেষে কেনসিংটনের এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে স্থানান্তরিত হওয়ার সময় বাবার জীবনে উচ্চাকাক্সক্ষার ধরা পড়ে। তখন আমার বয়স ছিল বারো বছর। তিনি বাকিংহাম প্যালেস থেকে ছয়টি বাড়ির পরেই লন্ডনের সপ্তম বৃহত্তম একটি বাগানসহ বাড়ি ক্রয় করেন এবং বলেন যে, আমরা আর কখনো কোথাও যাবো না। তুমি এখন বন্ধু-বান্ধব জোগাতে পারো, তিনি আরও বলেছিলেন, যেন আমার চরিত্রের অস্বস্তি আর নিরাপত্তাহীনতার চেয়ে বাড়িঘরের ঠিকানার পরিবর্তনই আমার সামাজিক জীবনকে বাধাগ্রস্ত করেছে। তিনি আমাকে তাঁর জানা মতে সবচেয়ে ব্যয়বহুল স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন এবং বলেছিলেন যে, আমি যেন আজেবাজে মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা না করি। তাঁর সেই সতর্ক বাণী শোনার পর আমার মনে হয়েছিল যে, তিনি অন্য পাকিস্তানিদের বোঝাতে চেয়েছিলেন। তাঁর ভাইয়ের প্রতি প্রচ- ঘৃণা ছিল। কেননা তাঁর ভাই ইংরেজ হওয়ার কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে ইংল্যান্ডে চলে গিয়েছিল- কেউ যদি অতিথি হিসেবে কারও বাড়িতে যান, তাহলে তাকে অবশ্যই বাড়ির লোকজনের সন্তুষ্ট হওয়ার উপায় খুঁজে বের করতে হবে, বাবা এ ধরনের কথা বলতে পছন্দ করতেন। ইংরেজদের কাছে পরিচিত হওয়ার তাঁর অন্যতম উপায় ছিল স্কোয়াশ খেলায় অংশগ্রহণ করা, উচ্চারণ শেখার জন্য শিক্ষক নিয়োগ করা, চারুকলা প্রসারের জন্য চাঁদা দেওয়া এবং শুধু সম্মানিত পুরুষদের জন্য নির্ধারিত ক্লাবের সদস্য হওয়া। কিন্তু আমাকে নিখুঁত অভিবাসী কন্যা হিসেবে দেখানোর জন্য তাঁর সমস্তপ্রচেষ্টা হতাশায় পরিণত হয়েছে: পিয়ানো শিক্ষক, টেনিস কোচ, ফরাসি আয়া কেবল সামান্য চিহ্ন রেখেছে, দ্রুত বাজে ছাপ ফেলে গেছে।
একদিন বাবা বাড়ি ফিরে এসে আমাকে রান্নাঘরে দেখতে পেলেন এবং যদিও আমি স্যান্ডউইচ বানানোর জন্য ফ্রিজের সবজির ড্রয়ারে ঝুঁকে পড়া ছাড়০া আর কিছুই করছিলাম না, তবুও আমাকে দেখে তিনি ক্রোধে চিৎকার করে ওঠেন।
আমি যা কিছুই করি না কেন, তোমাকে সব সময় মাঠে কাজ করা কিষাণীর মতো দেখাবে, তিনি বললেন।
আর তারপরই ঘটে এক অলৌকিক ঘটনা। আমার বয়স ষোল বছর, জয়নব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো ফলাফল করার পর ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিংয়ের চাকরি নিয়ে লন্ডনে চলে আসে। বাবা আমাকে যেমন করে তৈরি করতে চেয়েছিলেন, তার সব কিছুই জয়নবের মধ্যে ছিল: স্টাইলিশ, অল্প কথায় দক্ষ, উচ্চাভিলাষী, সিটি নারী ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে ওপেনিং ব্যাট করা। তিনি জয়নবকে আমাদের বাড়ির সঙ্গে এমন আচরণ করতে উৎসাহিত করেছিলেন যেন বাড়িটি ওরই ছিল, এমনকি যখনই তিনি ওকে সামনের দরজা দিয়ে হাঁটতে দেখতেন, ওর রসিকতায় হাসতেন, ওর জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন, তখন আনন্দ উপলব্ধি করতেন। আমি এসবের জন্য ওকে ঘৃণা করতে পারিনি এবং সে দ্রুত আমার জীবনের উজ্জ্বল কেন্দ্র হিসেবে তার পুরনো অবস্থানটি উদ্ধার করে। তার বিনিময়ে সে আমার সান্নিধ্যে সত্যিকারের আনন্দ খুঁজে পায়, যা আমাকে চিন্তামুক্ত করেছিল এবং তার সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতে বাধ্য করেছিল, যা আমি অন্য কারও সঙ্গে কখনো করিনি।
জয়নবের পুনরায় আবির্ভাব হওয়ার জন্য আমার মনে পুরনো স্মৃতি ফিরে আসে এবং একদিন বিকেলে আমি তাকে শাঁকচুন্নি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি।
শরতের অস্বাভাবিক গরমের দিনে আমরা ছাতার নিচে পাশের বাগানের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসি। সেই সময় সে তার ফোনে কিছু একটা টাইপ করে।
শোনো! এসব পরিস্থিতিতে একজন মহিলা শাঁকচুন্নি হয়ে উঠতে পারে।
সন্তান প্রসবের সময় মারা যাওয়া এবং এটাই হলো প্রথম পরিস্থিতি। এছাড়াও গর্ভাবস্থায় মারা যায়।
শুয়ে থাকার সময়ে মারা যাওয়া (আমাদের ‘শুয়ে থাকা’ বিষয়টি সন্ধান করতে হয়েছিল, যার অর্থ রবিবার সকালে আলসেমি করে শুয়ে থাকা নয়)। বিছানায় শুয়ে মারা যাওয়া।
ঋতু¯্রাব চলাকালীন মারা যাওয়া। কোনো অস্বাভাবিক কিংবা মর্মান্তিক উপায়ে মৃত্যুবরণ করা। এমন একটি জীবন পেরিয়ে মারা যাওয়া যে জীবনে মহিলা একজন পুরুষের হাতে নির্যাতনের অভিজ্ঞতা অর্জন করে। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যাওয়া ওই মহিলা। সামান্য কিংবা অপরিপূর্ণ যৌন অভিজ্ঞতার পরে মারা যাওয়া।
ঠিক আছে! জয়নব বলল।
তারপরই আমরা মৃত মহিলাদের নাম চিৎকার করে বলতে শুরু করি, যারা এখন স্পষ্টতই শাঁকচুন্নি: মেরিলিন মনরো (বিছানায় মারা যান); জয়নবের এক সময়ের প্রতিবেশী আন্টি রুবিনা (স্পষ্টতই কোনো যৌন পরিপূর্ণতা ছিল না); অ্যামি ওয়াইনহাউস (অস্বাভাবিক মৃত্যু); ক্যারি ফিশার (মর্মান্তিক মৃত্যু, কারণ প্রিন্সেস লিয়া যেভাবেই মারা যান না কেন, তা ছিল দুঃখজনক); প্রিন্সেস ডায়ানা (স্বামীর বাড়ির লোকজন)।
সেদিন বিকেলের দিকে বাবা জানতে চাইলেন, আমি আর জয়নব প্রচ- অনিয়ন্ত্রিত আবেগ নিয়ে কেন হাসাহাসি করেছি, যার জন্য তাঁকে তাঁর পড়ার ঘরের জানালা বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। তিনি যখন কথাটি বলেছেন, তখন তিনি বেরিয়ে যাচ্ছিলেন এবং তাঁর হাতে ছিল সামনের দরজার চাবি। আমি জানতাম যে, বাবার কথাটি একটি প্রশ্ন হিসেবে একধরনের তিরস্কার ছিল। তা জানা সত্ত্বেও আমি তাঁর প্রশ্নের জবাব দেওয়ার বিষয়টি বেছে নিয়েছি: শাঁকচুন্নি।
বাবা চাবিগুলো তাঁর পকেটে রাখেন, কিন্তু রাখার আগেই আমি তাঁর স্থির হাতে চাবির আওয়াজ শুনতে পেলাম।
কুসংস্কারাচ্ছন্ন আজেবাজে কথা, তিনি বললেন এবং বলেই আমাকে একা ফেলে চলে যান। আমার বয়স যখন তেরো বছর ছিল, তখন আমরা আমাদের আয়াকে ছেড়ে দিয়েছি এবং তার পরিবর্তে বাবা সারা বাড়ি জুড়ে ক্যামেরা লাগিয়েছেন, সম্ভবত এ কারণে যে তাঁর অনুপস্থিতিতে আমার উপর কোনো ধরনের বিপদ আসতে পারে: আমাকে কেউ খুন করতে কিংবা আহত অথবা কোনো ধরনের হামলা করতে পারে, বাইরে থেকে ফিরে এসে তিনি যেন এমন কোনো বিপর্যয়ের ফুটেজ পুনরায় চালিয়ে দেখতে পারেন। আমি প্রায়ই এসব ভেবেছি এবং জয়নবকে ছাড়া কখনই অন্য কারোর কাছে উচ্চৈঃস্বরে বলিনি।
পরদিন জয়নব বার্তা পাঠিয়ে জানায় যে, বাবা আমার সঙ্গে দেখা করতে তাকে নিষেধ করেছেন। আমি কাঁদতে কাঁদতে বাবার কাছে যাই। তিনি বললেন, ঠিক এধরনের খারাপ প্রভাব থেকে তোমাকে দূরে রাখার জন্য আমি সারা জীবন চেষ্টা করেছি।
আমার ভেতরে আমি সামান্য স্বস্তি অনুভব করি, কারণ আমাকে জয়নবের আশেপাশে তাঁকে দেখতে হবে না এবং জানবো যে তিনি ভালোবাসতে অক্ষম নন, তিনি শুধুমাত্র আমাকে ভালোবাসতে অক্ষম।
আমার বাবার মতে আমাদের অভিবাসন কাহিনীর সংস্করণটি ছিল এরকম: যখন আমার মা মারা যান, তখন আমার চাচা ম্যানচেস্টার থেকে ফোন করে বাবাকে বলেছিলেন যে, তাঁর ব্যবসা প্রসারিত হচ্ছে এবং বাবার সহায়তায় পেলে তিনি তা করতে পারেন, এমনকি আমার চাচী আমাকে আমার বড় বোন হিসেবে জয়নবের সঙ্গে লালন-পালন করবেন। আর তাই আমার বাবা ইংল্যান্ডে আসেন, মূলত আমার জন্যই। ইংল্যান্ডে একবার পৌঁছানোর পরেই তিনি দুটি জিনিস দেখতে পেলেন: (ক) যে দেশটি তিনি ছেড়ে এসেছেন, তা একটি আস্তাকুঁড় এবং সেখানে তিনি আর কখনই ফিরে যেতে ইচ্ছুক নন এবং (খ) তিনি এখানে একজন ধন্যাঢ্য ব্যক্তি হতে পারেন, তবে তাঁর ভাইয়ের মিনি-ক্যাব কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত থাকা অবস্থায় নয়। তাঁর বেশ কয়েকটি উদ্যোগ ছিল ব্যর্থ, তবে তিনি মুসলমান খদ্দেরদের নিশানা করে একটি বিয়েশাদীর অ্যাপ থেকে (‘ভেন্যু ভাড়া, ক্যাটারিং, গাড়ি পরিষেবা এবং আমাদের সমস্ত সন্তুষ্ট গ্রাহকদের জন্য পোশাক সেলাইয়ে ছাড়!’) প্রথম মিলিয়ন পাউন্ড আয় করেন।
আপনি আর বিয়ে করলে না কেন? আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, যখন ভাবলাম যে তাঁর সঙ্গে আরও একবার কথা বলতে পারব। আপনি কি ছেলে আশা করেননি? মাঝেমধ্যে তাঁর জীবনে স্বল্পমেয়াদী বান্ধবী ছিল, কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, মহিলাদের সঙ্গে তাঁর বেশিরভাগ সম্পর্ক ছিল সাদামাটা দেওয়া-নেওয়া।
একবারও আমি বুঝতে পারিনি যে উত্তরাধিকার রেখে যাওয়ার আরও অনেক উপায় আছে, তিনি বললেন। তিনি এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন, যিনি নিজের নাম বিভিন্ন জায়গায় যুক্ত করতে পছন্দ করতেন, যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি, সংস্কার করা থিয়েটারের বর্ধিত বারান্দা, জাদুঘরের দেওয়াল।
আর আমি কী? আমি জিজ্ঞেস করি।
তিনি টিভি চালু করেন এবং ‘ডানচিং উইথ দ্য স্টারস্’ অনুষ্ঠান দেখায় মনোনিবেশ করেন।
জয়নবের সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাত চলতে থাকে, তবে গোপনে। পরের গ্রীষ্ম পর্যন্ত সে আর আমাদের বাড়িতে আসেনি, যখন সে হলওয়ে ছাড়া অন্য কোথাও যায়নি, তার পেছনে সদর দরজা খোলা ছিল এবং বাবাকে জানাতে বলেছিল যে, সে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চায়।
পাকিস্তানে তখন ছিল গ্রীষ্মকালের বন্যা, নজিরবিহীন ধ্বংস। জয়নব তার বিনিয়োগ ব্যাংকিংয়ের চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল এবং বন্যা ত্রাণে সহায়তা করতে পাকিস্তানে গিয়েছিল। সে আমার বাবাকে বলেছিল যে, সে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, হাতে টুপি (সে ফেডোরা টুপি পরেছিল, যা কথা বলার সময় সামনের দিকটা বাবার দিকে ছিল), সে যে সহায়তা সংস্থার সঙ্গে কাজ করবে, সেখানে অনুদান চাইতে এসেছে। আমাদের গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে গেছে, সে বলল।
আমার গ্রাম কেনসিংটন এবং চেলসি, বাবা বললেন এবং গোড়ালির উপর ভর করে ঘুরে দাঁড়ালেন। তাঁর ভুঁড়ি বাড়া সত্ত্বেও চলাফেরায় তিনি এখনো চটপটে।
আপনার পরিবার সবকিছু হারিয়েছে, জয়নব রীতিমতো উঁচু গলায় বলল। আপনার চাচারা, আপনার চাচাতো ভাইবোনেরা।
তিনি হলঘর পেরিয়ে পড়ার ঘরে ঢুকতে যাওয়ার একটুও থামলেন না। আমার মনে পড়ল একবারই আমি তাঁর শরীরকে মানসিক চাপের জন্য অতি সামান্য মনমরা হতে দেখেছিলাম।
আমি জয়নবকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে নিকটতম টাকা তোলার যন্ত্রের কাছে নিয়ে যাই, যাতে আমি আমার ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে সর্বোচ্চ পরিমাণ টাকা তুলতে পারি এবং আমাদের কথোপকথন শাঁকচুন্নির বিষয়ে ফিরে আসে, যে শাঁকচুন্নি পাকিস্তান থেকে নির্বাসনে আসার জন্য আমাকে প্ররোচিত করেছিল এবং তারপর জয়নবকে আমার বাড়ি থেকে বহিষ্কার করেছিল।
শাঁকচুন্নি পুরুষতন্ত্রের শিকার, যে পুরুষের ওপর প্রতিশোধ নেয়, আমি বললাম। আমার মনে হয়, শাঁকচুন্নি এক ধরনের নারীবাদী?
সে শুধু শয়তান, জয়নাব বলল। এছাড়া শাঁকচুন্নি অশুভ, কারণ সে আকর্ষণীয় এবং যৌন সংযমহীন।
শাঁকচুন্নি পুরুষতন্ত্রের অপরাধবোধের বহিঃপ্রকাশ, আমি বললাম।
শাঁকচুন্নি দোষীদের প্রতারণার শিকার হওয়ার সুযোগ করে দেয়, জয়নব বলল।
এমনকি যখন শাঁকচুন্নিরা শিকার হয়, তখনো তারা পঞ্চাশ বছরের দীর্ঘ উত্থানের সঙ্গে নিজেদের যৌন-দেবতা করে তোলে, যা অপার্থিব সৌন্দর্যের একজন মহিলা যথেষ্ট পরিমাণে পেতে পারে না।
জয়নব হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে।
তোমার নিজের মধ্যে এই সংস্করণটি আরও বেশি হয়ে উঠুক, সে বলল।
সত্যি, আসলে অদ্ভুত কোনো শাঁকচুন্নি নেই?
হ্যাঁ, তেমনই, সেই রকমই।
আমি জয়নবকে বলেছি যে, আমার বয়স যখন আঠারো বছর হবে, তখন আমি আমাদের পারিবারিক গ্রামে যাব এবং মায়ের কবর পরিদর্শন করব। কিন্তু জয়নব পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে বলেছে যে, বন্যার পানিতে মায়ের কবর হারিয়ে গেছে, গ্রামের প্রতিটি ঘরবাড়ির সঙ্গে। এমনকি পিপুল গাছও ধ্বংস হয়ে গেছে, সে আরও বলেছে। সে আমার হাতে ছয়-সাত ইঞ্চি দীর্ঘ সবুজ-বাদামী ডালের অংশ দিয়েছে, যার থেকে হৃদয় আকৃতির কচি পাতা গজিয়ে উঠেছিল। এটাই একমাত্র জিনিস, যা আমি তোমার জন্য নিয়ে আসতে পেরেছি, সে বলল। মনে করো এটা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উদ্বাস্তু।
প্রতিকূল পরিবেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উদ্বাস্তু, ইংল্যান্ডে পিপুল গাছ জন্মাতে পারে না জেনে বললাম। বেঁচে থাকার জন্য তাদের প্রয়োজন রোদ এবং আর্দ্রতা। তবুও আমি আমাদের বাগানের কোণে ডালটি রোপণ করেছি, যেখানে সবচেয়ে বেশি সূর্যের আলো থাকে। ইংল্যান্ডে তখনও গ্রীষ্মকাল এবং আগের যে কোনো গ্রীষ্মকালের চেয়ে গরম পড়েছিল। পরের সপ্তাহগুলোতে ডালটি কয়েক সেন্টিমিটার বড় হয় এবং তারপর শরৎ আসে, তারপর আসে শীতকাল। যদিও পিপুল গাছটি মারা যায়নি, বরং মাটি ও পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো, মালী গাছটি উপড়ে ফেলতে চেয়েছিল, যতক্ষণ না আমাদের শ্রীলঙ্কার বাবুর্চি তাকে বলেছিল যে, গাছটির ধর্মীয় তাৎপর্য রয়েছে। আমার বাবা জানতেন না যে, তাঁর গ্রামের এই অংশটি ইংরেজ বাগানে বেড়ে উঠছে, যা তিনি বাড়ির জানালা থেকে দর্শনার্থীদের প্রশংসার সঙ্গে দেখার জন্য সম্পূর্ণ অলঙ্কার হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন।
পরের বছর গ্রীষ্মকালের গরম নির্ধারিত সময়ের আগেভাগেই এসেছিল, অনেক বেশি ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে। জুন মাসের মধ্যে লন্ডনে আমাদের পানি দেওয়ার পাইপ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং বাগানের ঘাস পুড়ে গিয়েছিল ও গাছপালা শুকিয়ে গিয়েছিল। সাপ্তাহিক এক বন্ধ দিনের সকালে রান্নাঘরের কল থেকে শুধু এক ফোঁটা পানি বেরিয়ে এসেছিল। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম খরার কারণে, কিন্তু অন্য কলে পানি ছিল। বাবা বলেছিলেন যে, তিনি একজন কলের মিস্ত্রীকে ডাকবেন এবং আমি এ সম্পর্কে আর কোনো চিন্তা করিনি, যতক্ষণ না আমি বাগানের এক কোণ থেকে, যেখানে আমি গত কয়েক মাস ধরে হাঁটিনি, বাবার গর্জন শুনতে পেলাম।
পিপুল গাছটি পাঁচ কিংবা ছয় ফুট উঁচু। গাছটির হৃৎপি- আকৃতির পাতাগুলো ছিল পুরু এবং চকচকে। কলের মিস্ত্রীর হাতে ছিল তার ফোন এবং ফোনের অ্যাপগুলোর মধ্যে গাছপালা শনাক্ত করার একটি অ্যাপ চালু ছিল। মিস্ত্রী গাছটিকে ‘আক্রমণাত্মক’ বলে অভিহিত করেছে; সে বলেছে, পানির সন্ধানে গাছের শেকড় অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারে। সেটা আমাদের পানির পাইপের মধ্যে ঢুকে গেছে, হয়তো ইতোমধ্যে ঘরের ভিতের ভেতরে ঢুকে গেছে।
এখানে গাছটি কেমন করে এলো? বাবা জিজ্ঞেস করেন।
আমি তাঁকে বললাম যে, জয়নব আমাদের বাড়ির রাস্তার উল্টোদিকের পিপুল গাছ থেকে কেটে এনেছে।
বাবার চেহারা! যেমন একজন মানুষ তাঁর নিজের মধ্যে অনেক পুরনো এবং গভীর এক অসুস্থতার ইঙ্গিত পাচ্ছেন যে, তা দিয়ে তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাটা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।
কলের মিস্ত্রী, ফোনের পর্দায় তাকিয়ে কিছু একটা পড়ছিল, বলল যে গাছটি সরাতে আমাদের একজন বিশেষজ্ঞকে ডাকতে হবে। গাছটি কেটে ফেলুন এবং শিকড় বাড়তে থাকবে। এরই মধ্যে কতটুকু ক্ষতি হয়েছে, তা জানা মুশকিল।
সেই রাতে বাবা বসার ঘরে দাঁড়িয়ে থাকেন, যে ঘরটি কদাচিৎ ব্যবহৃত হয়, এবং তিনি লন্ডনের সপ্তম বৃহৎ বাগানের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বাতাস আসা-যাওয়া করার জন্য আমরা রাতেরবেলা জানালা খুলে রাখতাম, কিন্তু যখনই আমি তাঁর খোঁজে বাড়ির ভেতর হাঁটি, তখনই আমি দেখলাম যে প্রতিটি জানালা বন্ধ এবং তালা লাগানো। আমি তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াই।
তুমি কী তাকে দেখেছ? বাবা জিজ্ঞেস করেন।
এটা ছিল একটা ছোট্ট জিনিস, ছবিতে যে চওড়া কা-ের পিপুল গাছের সৌন্দর্য দেখেছি, তার তুলনায় ঝুলন্ত শেকড় আর তাদের বিশাল উচ্চতা কিছুই না। আমরা বেশ অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকি, শুধু তাঁর নিঃশ্বাসের শব্দ হচ্ছিল, অদ্ভুত আর কর্কশ শব্দ। তিনি আমার উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বলে মনে হয়নি, এমনকি আমি প্রশ্নের জবাব দিইনি বলেও তাঁর মনে হয়নি। মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ সরে যায়; মৃদুমন্দ বাতাসে গাছের ডাল-পাতা নড়ছিল। দেখলাম একটা রোগা দেহ দু’হাত বাড়িয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। আমি অলোকিক কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, একই নাম দু’বার উচ্চারণ করেছে।
আমার নাম।
বাবা আমার দিকে তাকালেন।
অত্যন্ত শান্তভাবে, যেন আমি এ কথাটা শোনার জন্য সারা জীবন অপেক্ষা করছি, আমি জানালার কাছে যাই এবং পাল্লা খুলি। বাবা আমার হাত চেপে ধরেন।
আপনি যদি কাজটা করেন, তাহলে তিনি পছন্দ করবেন না, আমি বললাম এবং তৎক্ষণাৎ বাবা হাত সরিয়ে নেন যেন আমার হাতের ত্বকে বিষ মেশানো হয়েছে।
আমি বাগানে প্রবেশ করি। আমার খালি পায়ের নিচে মরা ঘাস। পোড়া জায়গা জুড়ে গাছটি অপেক্ষা করছে। আমি হয়তো অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা আমার চাচাতো বোন জয়নবকে খুঁজে পাব। হয়তো আমি শাঁকচুন্নির আসল সত্য জানতে পারব, পৌরাণিক পুরুষরা তার চারপাশে যে কাহিনী বুনেছিল, তার চেয়ে অনেক পুরনো এক প্রাণি, যা তার গল্পের কেন্দ্রবিন্দু হতে বেপরোয়া ছিল।
এক কদম, তারপর আরেক কদম, তরপর আরও এক কদম। আমি থামলাম, ঘাসের উপর বসে পা জোড়া বাঁকা করে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরি এবং আমার মুখ আকাশের দিকে উঠে যায়। কোনো তাড়াহুড়া নেই। আমি সেখানে কিছুক্ষণ বসে থাকতে চাই। বাবা দাঁড়িয়ে আমাকে দেখবেন এবং শাঁকচুন্নির কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি তাঁর অন্তরে গভীরভাবে গেঁথে যাবে, তাঁর অন্তরের প্রতিটি ভিত্তি কাঁপিয়ে দিবে।
পাদটীকা:
মূল গল্পে নেই, তবে পাঠকের সুবিধার্থে দেওয়া হলো- অনুবাদক।
১সেরেনা উইলিয়ামস (জন্ম ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৮১) একজন আমেরিকান প্রাক্তন পেশাদার টেনিস খেলোয়াড়, যিনি সর্বকালের অন্যতম সেরা টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিতি পেয়েছিলেন।
২‘ওয়ান ডিরেকশন’ ছিল ২০১০ সালে লন্ডনে গঠিত একটি ইংলিশ-আইরিশ পপ বয় ব্যান্ড। পরে এই ব্যান্ডটি সর্বকালের সর্বাধিক বিক্রিত বয় ব্যান্ডগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে ওঠে এবং ২০১৬ সালে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে বিশ্বের বৃহত্তম বয় ব্যান্ড হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।
গল্পসূত্র:
‘শাঁকচুন্নি’ গল্পটি কামিলা শামসির ইংরেজিতে ‘চুরাইল’ গল্পের অনুবাদ। এটি নারীবাদী ছোটগল্প সংকলন ‘ফিউরিজ’ (২০২৩ সালে প্রকাশিত)-এর জন্য লেখা হয়েছিল এবং সেখানে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গল্পটি ‘বেস্ট ব্রিটিশ শর্ট স্টোরিজ ২০২৪’ (সম্পাদক: নিকোলাস রয়েল) গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়। এছাড়া গল্পটি দ্য বার্সেলোনা রিভিউতে (অনলাইন সংস্করণ) প্রকাশিত হয় (২০২৪, সংখ্যা: ১১১)।
লেখক পরিচিতি:
পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বৃটিশ নারী লেখক কামিলা শামসি একজন ঔপন্যাসিক, গল্পকার এবং কলামিস্ট। তিনি ১৯৭৩ সালে করাচিতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি স্বনামধন্য সাহিত্য সমালোচক ও লেখিকা মুনিজা শামসির কন্যা, প্রখ্যাত ভারতীয় ঔপন্যাসিক আতিয়া হোসেনের ভাগ্নি এবং স্মৃতিকথা লেখিকা বেগম জাহানারা হাবিবুল্লাহর নাতনী। তাঁর শৈশব কেটেছে করাচিতে এবং সেখানেই তিনি স্কুলের পড়াশোনা সমাপ্ত করেন। পরে তিনি নিউ ইয়র্কের হ্যামিল্টন কলেজ থেকে ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ে বিএ এবং আমহার্স্টের ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএফএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি আটটি উপন্যাসের রচয়িতা। তাঁর প্রথম উপন্যাস ইন দ্য সিটি বাই দ্য সি প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে। এই উপন্যাসটি যুক্তরাজ্যের জন লেওলিন রাইস পুরস্কারের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পেয়েছিল এবং ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের সাহিত্যের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পুরস্কার লাভ করে। তাঁর অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে বার্ন্ট শ্যাডোস (২০০৯, অরেঞ্জ প্রাইজ, সংক্ষিপ্ত তালিকা), অ্যা গড ইন এভরি স্টোন (২০১৪, উইমেনস বেইলি প্রাইজ ও ওয়াল্টার স্কট প্রাইজ, সংক্ষিপ্ত তালিকা) এবং বেস্ট অব ফ্রেন্ডস (২০২২, ইন্ডি বুক অ্যাওয়ার্ডস, সংক্ষিপ্ত তালিকা)। তবে তাঁর সর্বাধিক প্রশংসিত ও পাঠক নন্দিত উপন্যাসটি হলো হোম ফায়ার (২০১৭), যা ‘যুদ্ধকালীন প্রেম, পরিবার এবং রাষ্ট্রের জটিলতার শক্তিশালী গল্প’ হিসেবে বিবিসি বর্ণনা করেছে। উপন্যাসটি ২০১৭ সালে ‘বুকার প্রাইজ’-এর জন্য দীর্ঘ তালিকায় ও ‘ইন্টারন্যাশনাল ডাবলিন লিটারেরি অ্যাওয়ার্ড’-এর সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পেয়েছিল। তবে উপন্যাসটি ২০১৮ সালে ‘উইমেন’স প্রাইজ ফর ফিকশন’ জিতেছে। তিনি ব্রিটেনের বেশ কয়েকটি সাহিত্য পুরস্কারের বিচারক ছিলেন। ফেন্স: দ্য মুসলিম কেস (২০০৯) তাঁর নন-ফিকশন গ্রন্থ। ২০১১ সালে তিনি রয়্যাল সোসাইটি অব লিটারেচারের ফেলো নির্বাচিত হন। ২০১৩ সালে তিনি ‘গ্রান্টা লিস্ট অব ২০ বেস্ট ইয়ং ব্রিটিশ রাইটার’-এর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন। বর্তমানে তিনি লন্ডনে বসবাস করছেন।
মূল: কামিলা শামসি অনুবাদ: ফজল হাসান
শুক্রবার, ১১ এপ্রিল ২০২৫
(অনুবাদকের কথা: পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখিকা কামিলা শামসি রচিত ছোটগল্প ‘শাঁকচুন্নি’ (ইংরেজি শিরোনাম ‘চুরাইল’) পাকিস্তানি পুরুষতান্ত্রিক লোককাহিনীর একটি নারীবাদী ব্যাখ্যা এবং শাঁকচুন্নি পৌরাণিক কাহিনী দ্বারা অনুপ্রাণিত- একজন মহিলার বিদ্বেষপূর্ণ চেতনা, যা পুরুষদের মৃত্যুর দিকে প্রলুব্ধ করে। এখানে শাঁকচুন্নির কিংবদন্তি বর্তমানে ইংল্যান্ডে বসবাসকারী একটি পাকিস্তানি পরিবারের গতিশীলতার বৈশিষ্ট্য রয়েছে। উল্লেখ্য, এই গল্পটি ‘বিবিসি ন্যাশনাল শর্ট স্টোরি অ্যাওয়ার্ড ২০২৩’ পেয়েছে।)
আমার জন্মের কয়েক সপ্তাহ পরেই বাবা আমাকে নিয়ে ইংল্যান্ডে চলে আসেন। কেননা তিনি নিজেকে এবং আমাকে আমার মায়ের বিদেহী আত্মার প্রভাব থেকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। আমার মা আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। যখন আমার বয়স ছয় বছর, তখন আমার চাচাতো বোন জয়নব আমাকে ঘটনার আড়ালে লুকিয়ে থাকা আমার ভূমিকার কথা বলেছে। সেই সময় বাবা আমাকে নিয়ে ম্যানচেস্টার থেকে লন্ডনে স্থায়ী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ম্যানচেস্টারে আমরা জয়নবের বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতাম। সত্যি কথাটা শোনা জরুরি, এগারো বছর বয়সী জয়নব আমাকে গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলল সে জানে না ছোট চাচাতো বোনকে কখন আবার দেখতে পাবে। আমার জন্মের আগে মায়ের চার বার গর্ভপাত হয়েছিল এবং দ্বিতীয় গর্ভপাতের পরে ডাক্তাররা আর গর্ভধারণ না করার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমার মা দত্তক নেওয়ার কথা বলেছিলেন, কিন্তু আমার বাবা জেদ ধরেছিলেন এবং বলেছিলেন যে, তাঁর ঔরসের পুত্র সন্তান থাকতে হবে। একসময় দুনিয়া প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, যখন প্রকৃতি মানুষকে কী বলতে চাইছে, যা মানুষেরা বুঝতে অস্বীকার করে: বাবার সেই সিদ্ধান্ত তাঁকে ভুল ধরনের সন্তান দিয়েছে এবং যার জন্য তিনি তাঁর স্ত্রীকে হারিয়েছেন।
তখন ছিল গ্রীষ্মকাল। আমরা জয়নবের শোবার ঘরের মেঝেতে বসেছিলাম। তার সেই ঘরে সে আমার সঙ্গে থাকতে সম্মত হয়েছিল, কারণ আমার তখন চাচির বিছানার পাশের দোলনা ছেড়ে দেওয়ার মতো যথেষ্ট বয়স হয়েছিল। সেরেনা উইলিয়ামস১ এবং ‘ওয়ান ডিরেকশন’২ আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল, যখন জুলাই মাসের বৃষ্টি বাইরের দুনিয়াকে প্রত্যাশিতভাবে ঝাপসা করে তুলেছিল। জয়নব আমার হাতটা তার হাতে তুলে নিয়েছিল। পরের মুহূর্তটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সে বলেছিল। আমার বয়স যখন মাত্র কয়েকদিন, তখন বাবা শুনতে পেয়েছিলেন যে, আমাদের বাড়ির অদূরে রাস্তার উল্টোদিকে বেড়ে ওঠা পিপুল গাছ থেকে এক মহিলা বাবার নাম ধরে ডেকেছিল। প্রথমবার ডাকার পর বাবা মুখ তুলে তাকিয়েছিলেন এবং দ্বিতীয়বার ডাকার সময় তিনি দরজার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। তৃতীয়বার কোনো ডাক শুনতে না পেয়ে তিনি ভীষণ ভয় আর আতঙ্কে রক্তশূন্য হয়ে অসাড় হয়ে গিয়েছিলেন। আমার আয়া সব দেখেছে এবং সে-ই আমাদের গ্রামে ঘটনাটি রটিয়ে দিয়েছিল যে, আমার মা শাঁকচুন্নি হয়ে গেছেন।
সন্তান প্রসবকালীন মারা যাওয়া মহিলারা প্রায়শই শাঁকচুন্নি হয়ে যান। তারা পিপুল গাছে বাস করার শখের কারণে এবং তাদের শিকারদের সুমিষ্ট কণ্ঠে ডাকার জন্য পরিচিত। শাঁকচুন্নির প্রলোভনে পড়ার জন্য কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার রাত সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়। কেননা যে কেউ তখনই কেবল তার মুখের সৌন্দর্য দেখতে পরে এবং গোড়ালির দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া পায়ের প্রকাশ্য চিহ্নটি এড়িয়ে যেতে পারে। শাঁকচুন্নির অন্য সঙ্কেতটি হলো সে সবসময় তার শিকারের নাম দু’বার ডাকে- কখনো একবার নয়, এমনকি তিনবারও নয়। সে পুরুষদের তার গোপন আস্তানায় প্রলুব্ধ করে এবং তাদের সেখানে রাখে, তাদের জীবনীশক্তি নিঃশেষ করে দেয়, যতক্ষণ না তারা বৃদ্ধ হয়ে যায়। যখন শাঁকচুন্নি শিকারীদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে দেয়, তখন তারা দেখতে পায় যে কয়েক দশক কেটে গেছে এবং তারা জানত যে সবাই মারা গেছে, তাই তারা একা এবং প্রেমহীন জীবন সমাপ্ত করে।
মূলত রিপ ভ্যান উইঙ্কল ছিল এমন প্রফুল্ল একজন পুরুষের গল্প, যে কিনা শাঁকচুন্নির প্রলোভনের শিকার হয়ে যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার সঙ্গে দূরে সরে গিয়েছিল। তবে শুধু আমার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য জয়নব তার স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ‘যৌনতা’ শব্দটি আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে সংক্ষেপে বলেছিল। তারপর সে পুনরায় গম্ভীর হয়ে বলল: তোমার বাবা বলেছেন যে, তিনি আর কখনো পাকিস্তানে ফিরে যাবেন না। কারণ সেটি এক ভয়ঙ্কর জায়গা, এমনকি কেউ তাঁকে বিশ্বাস করবে না। তিনি কিছুতেই ফিরে যাবেন না, কেননা তিনি ভয় পাচ্ছেন যে, শাঁকচুন্নি তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে।
আমার ছয় বছর বয়সে আমরা ম্যানচেস্টার থেকে লন্ডনে জায়গা বদল করেছি, আট বছর বয়সে ওয়েম্বলি থেকে কুইনস্ পার্কে গিয়েছি এবং নয় বছর বয়সে কুইনস্ পার্ক থেকে কেনসিংটনে বসতি গড়ে তুলেছি। অবশেষে কেনসিংটনের এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে স্থানান্তরিত হওয়ার সময় বাবার জীবনে উচ্চাকাক্সক্ষার ধরা পড়ে। তখন আমার বয়স ছিল বারো বছর। তিনি বাকিংহাম প্যালেস থেকে ছয়টি বাড়ির পরেই লন্ডনের সপ্তম বৃহত্তম একটি বাগানসহ বাড়ি ক্রয় করেন এবং বলেন যে, আমরা আর কখনো কোথাও যাবো না। তুমি এখন বন্ধু-বান্ধব জোগাতে পারো, তিনি আরও বলেছিলেন, যেন আমার চরিত্রের অস্বস্তি আর নিরাপত্তাহীনতার চেয়ে বাড়িঘরের ঠিকানার পরিবর্তনই আমার সামাজিক জীবনকে বাধাগ্রস্ত করেছে। তিনি আমাকে তাঁর জানা মতে সবচেয়ে ব্যয়বহুল স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন এবং বলেছিলেন যে, আমি যেন আজেবাজে মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা না করি। তাঁর সেই সতর্ক বাণী শোনার পর আমার মনে হয়েছিল যে, তিনি অন্য পাকিস্তানিদের বোঝাতে চেয়েছিলেন। তাঁর ভাইয়ের প্রতি প্রচ- ঘৃণা ছিল। কেননা তাঁর ভাই ইংরেজ হওয়ার কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে ইংল্যান্ডে চলে গিয়েছিল- কেউ যদি অতিথি হিসেবে কারও বাড়িতে যান, তাহলে তাকে অবশ্যই বাড়ির লোকজনের সন্তুষ্ট হওয়ার উপায় খুঁজে বের করতে হবে, বাবা এ ধরনের কথা বলতে পছন্দ করতেন। ইংরেজদের কাছে পরিচিত হওয়ার তাঁর অন্যতম উপায় ছিল স্কোয়াশ খেলায় অংশগ্রহণ করা, উচ্চারণ শেখার জন্য শিক্ষক নিয়োগ করা, চারুকলা প্রসারের জন্য চাঁদা দেওয়া এবং শুধু সম্মানিত পুরুষদের জন্য নির্ধারিত ক্লাবের সদস্য হওয়া। কিন্তু আমাকে নিখুঁত অভিবাসী কন্যা হিসেবে দেখানোর জন্য তাঁর সমস্তপ্রচেষ্টা হতাশায় পরিণত হয়েছে: পিয়ানো শিক্ষক, টেনিস কোচ, ফরাসি আয়া কেবল সামান্য চিহ্ন রেখেছে, দ্রুত বাজে ছাপ ফেলে গেছে।
একদিন বাবা বাড়ি ফিরে এসে আমাকে রান্নাঘরে দেখতে পেলেন এবং যদিও আমি স্যান্ডউইচ বানানোর জন্য ফ্রিজের সবজির ড্রয়ারে ঝুঁকে পড়া ছাড়০া আর কিছুই করছিলাম না, তবুও আমাকে দেখে তিনি ক্রোধে চিৎকার করে ওঠেন।
আমি যা কিছুই করি না কেন, তোমাকে সব সময় মাঠে কাজ করা কিষাণীর মতো দেখাবে, তিনি বললেন।
আর তারপরই ঘটে এক অলৌকিক ঘটনা। আমার বয়স ষোল বছর, জয়নব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো ফলাফল করার পর ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিংয়ের চাকরি নিয়ে লন্ডনে চলে আসে। বাবা আমাকে যেমন করে তৈরি করতে চেয়েছিলেন, তার সব কিছুই জয়নবের মধ্যে ছিল: স্টাইলিশ, অল্প কথায় দক্ষ, উচ্চাভিলাষী, সিটি নারী ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে ওপেনিং ব্যাট করা। তিনি জয়নবকে আমাদের বাড়ির সঙ্গে এমন আচরণ করতে উৎসাহিত করেছিলেন যেন বাড়িটি ওরই ছিল, এমনকি যখনই তিনি ওকে সামনের দরজা দিয়ে হাঁটতে দেখতেন, ওর রসিকতায় হাসতেন, ওর জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন, তখন আনন্দ উপলব্ধি করতেন। আমি এসবের জন্য ওকে ঘৃণা করতে পারিনি এবং সে দ্রুত আমার জীবনের উজ্জ্বল কেন্দ্র হিসেবে তার পুরনো অবস্থানটি উদ্ধার করে। তার বিনিময়ে সে আমার সান্নিধ্যে সত্যিকারের আনন্দ খুঁজে পায়, যা আমাকে চিন্তামুক্ত করেছিল এবং তার সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতে বাধ্য করেছিল, যা আমি অন্য কারও সঙ্গে কখনো করিনি।
জয়নবের পুনরায় আবির্ভাব হওয়ার জন্য আমার মনে পুরনো স্মৃতি ফিরে আসে এবং একদিন বিকেলে আমি তাকে শাঁকচুন্নি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি।
শরতের অস্বাভাবিক গরমের দিনে আমরা ছাতার নিচে পাশের বাগানের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসি। সেই সময় সে তার ফোনে কিছু একটা টাইপ করে।
শোনো! এসব পরিস্থিতিতে একজন মহিলা শাঁকচুন্নি হয়ে উঠতে পারে।
সন্তান প্রসবের সময় মারা যাওয়া এবং এটাই হলো প্রথম পরিস্থিতি। এছাড়াও গর্ভাবস্থায় মারা যায়।
শুয়ে থাকার সময়ে মারা যাওয়া (আমাদের ‘শুয়ে থাকা’ বিষয়টি সন্ধান করতে হয়েছিল, যার অর্থ রবিবার সকালে আলসেমি করে শুয়ে থাকা নয়)। বিছানায় শুয়ে মারা যাওয়া।
ঋতু¯্রাব চলাকালীন মারা যাওয়া। কোনো অস্বাভাবিক কিংবা মর্মান্তিক উপায়ে মৃত্যুবরণ করা। এমন একটি জীবন পেরিয়ে মারা যাওয়া যে জীবনে মহিলা একজন পুরুষের হাতে নির্যাতনের অভিজ্ঞতা অর্জন করে। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যাওয়া ওই মহিলা। সামান্য কিংবা অপরিপূর্ণ যৌন অভিজ্ঞতার পরে মারা যাওয়া।
ঠিক আছে! জয়নব বলল।
তারপরই আমরা মৃত মহিলাদের নাম চিৎকার করে বলতে শুরু করি, যারা এখন স্পষ্টতই শাঁকচুন্নি: মেরিলিন মনরো (বিছানায় মারা যান); জয়নবের এক সময়ের প্রতিবেশী আন্টি রুবিনা (স্পষ্টতই কোনো যৌন পরিপূর্ণতা ছিল না); অ্যামি ওয়াইনহাউস (অস্বাভাবিক মৃত্যু); ক্যারি ফিশার (মর্মান্তিক মৃত্যু, কারণ প্রিন্সেস লিয়া যেভাবেই মারা যান না কেন, তা ছিল দুঃখজনক); প্রিন্সেস ডায়ানা (স্বামীর বাড়ির লোকজন)।
সেদিন বিকেলের দিকে বাবা জানতে চাইলেন, আমি আর জয়নব প্রচ- অনিয়ন্ত্রিত আবেগ নিয়ে কেন হাসাহাসি করেছি, যার জন্য তাঁকে তাঁর পড়ার ঘরের জানালা বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। তিনি যখন কথাটি বলেছেন, তখন তিনি বেরিয়ে যাচ্ছিলেন এবং তাঁর হাতে ছিল সামনের দরজার চাবি। আমি জানতাম যে, বাবার কথাটি একটি প্রশ্ন হিসেবে একধরনের তিরস্কার ছিল। তা জানা সত্ত্বেও আমি তাঁর প্রশ্নের জবাব দেওয়ার বিষয়টি বেছে নিয়েছি: শাঁকচুন্নি।
বাবা চাবিগুলো তাঁর পকেটে রাখেন, কিন্তু রাখার আগেই আমি তাঁর স্থির হাতে চাবির আওয়াজ শুনতে পেলাম।
কুসংস্কারাচ্ছন্ন আজেবাজে কথা, তিনি বললেন এবং বলেই আমাকে একা ফেলে চলে যান। আমার বয়স যখন তেরো বছর ছিল, তখন আমরা আমাদের আয়াকে ছেড়ে দিয়েছি এবং তার পরিবর্তে বাবা সারা বাড়ি জুড়ে ক্যামেরা লাগিয়েছেন, সম্ভবত এ কারণে যে তাঁর অনুপস্থিতিতে আমার উপর কোনো ধরনের বিপদ আসতে পারে: আমাকে কেউ খুন করতে কিংবা আহত অথবা কোনো ধরনের হামলা করতে পারে, বাইরে থেকে ফিরে এসে তিনি যেন এমন কোনো বিপর্যয়ের ফুটেজ পুনরায় চালিয়ে দেখতে পারেন। আমি প্রায়ই এসব ভেবেছি এবং জয়নবকে ছাড়া কখনই অন্য কারোর কাছে উচ্চৈঃস্বরে বলিনি।
পরদিন জয়নব বার্তা পাঠিয়ে জানায় যে, বাবা আমার সঙ্গে দেখা করতে তাকে নিষেধ করেছেন। আমি কাঁদতে কাঁদতে বাবার কাছে যাই। তিনি বললেন, ঠিক এধরনের খারাপ প্রভাব থেকে তোমাকে দূরে রাখার জন্য আমি সারা জীবন চেষ্টা করেছি।
আমার ভেতরে আমি সামান্য স্বস্তি অনুভব করি, কারণ আমাকে জয়নবের আশেপাশে তাঁকে দেখতে হবে না এবং জানবো যে তিনি ভালোবাসতে অক্ষম নন, তিনি শুধুমাত্র আমাকে ভালোবাসতে অক্ষম।
আমার বাবার মতে আমাদের অভিবাসন কাহিনীর সংস্করণটি ছিল এরকম: যখন আমার মা মারা যান, তখন আমার চাচা ম্যানচেস্টার থেকে ফোন করে বাবাকে বলেছিলেন যে, তাঁর ব্যবসা প্রসারিত হচ্ছে এবং বাবার সহায়তায় পেলে তিনি তা করতে পারেন, এমনকি আমার চাচী আমাকে আমার বড় বোন হিসেবে জয়নবের সঙ্গে লালন-পালন করবেন। আর তাই আমার বাবা ইংল্যান্ডে আসেন, মূলত আমার জন্যই। ইংল্যান্ডে একবার পৌঁছানোর পরেই তিনি দুটি জিনিস দেখতে পেলেন: (ক) যে দেশটি তিনি ছেড়ে এসেছেন, তা একটি আস্তাকুঁড় এবং সেখানে তিনি আর কখনই ফিরে যেতে ইচ্ছুক নন এবং (খ) তিনি এখানে একজন ধন্যাঢ্য ব্যক্তি হতে পারেন, তবে তাঁর ভাইয়ের মিনি-ক্যাব কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত থাকা অবস্থায় নয়। তাঁর বেশ কয়েকটি উদ্যোগ ছিল ব্যর্থ, তবে তিনি মুসলমান খদ্দেরদের নিশানা করে একটি বিয়েশাদীর অ্যাপ থেকে (‘ভেন্যু ভাড়া, ক্যাটারিং, গাড়ি পরিষেবা এবং আমাদের সমস্ত সন্তুষ্ট গ্রাহকদের জন্য পোশাক সেলাইয়ে ছাড়!’) প্রথম মিলিয়ন পাউন্ড আয় করেন।
আপনি আর বিয়ে করলে না কেন? আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, যখন ভাবলাম যে তাঁর সঙ্গে আরও একবার কথা বলতে পারব। আপনি কি ছেলে আশা করেননি? মাঝেমধ্যে তাঁর জীবনে স্বল্পমেয়াদী বান্ধবী ছিল, কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, মহিলাদের সঙ্গে তাঁর বেশিরভাগ সম্পর্ক ছিল সাদামাটা দেওয়া-নেওয়া।
একবারও আমি বুঝতে পারিনি যে উত্তরাধিকার রেখে যাওয়ার আরও অনেক উপায় আছে, তিনি বললেন। তিনি এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন, যিনি নিজের নাম বিভিন্ন জায়গায় যুক্ত করতে পছন্দ করতেন, যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি, সংস্কার করা থিয়েটারের বর্ধিত বারান্দা, জাদুঘরের দেওয়াল।
আর আমি কী? আমি জিজ্ঞেস করি।
তিনি টিভি চালু করেন এবং ‘ডানচিং উইথ দ্য স্টারস্’ অনুষ্ঠান দেখায় মনোনিবেশ করেন।
জয়নবের সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাত চলতে থাকে, তবে গোপনে। পরের গ্রীষ্ম পর্যন্ত সে আর আমাদের বাড়িতে আসেনি, যখন সে হলওয়ে ছাড়া অন্য কোথাও যায়নি, তার পেছনে সদর দরজা খোলা ছিল এবং বাবাকে জানাতে বলেছিল যে, সে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চায়।
পাকিস্তানে তখন ছিল গ্রীষ্মকালের বন্যা, নজিরবিহীন ধ্বংস। জয়নব তার বিনিয়োগ ব্যাংকিংয়ের চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল এবং বন্যা ত্রাণে সহায়তা করতে পাকিস্তানে গিয়েছিল। সে আমার বাবাকে বলেছিল যে, সে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, হাতে টুপি (সে ফেডোরা টুপি পরেছিল, যা কথা বলার সময় সামনের দিকটা বাবার দিকে ছিল), সে যে সহায়তা সংস্থার সঙ্গে কাজ করবে, সেখানে অনুদান চাইতে এসেছে। আমাদের গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে গেছে, সে বলল।
আমার গ্রাম কেনসিংটন এবং চেলসি, বাবা বললেন এবং গোড়ালির উপর ভর করে ঘুরে দাঁড়ালেন। তাঁর ভুঁড়ি বাড়া সত্ত্বেও চলাফেরায় তিনি এখনো চটপটে।
আপনার পরিবার সবকিছু হারিয়েছে, জয়নব রীতিমতো উঁচু গলায় বলল। আপনার চাচারা, আপনার চাচাতো ভাইবোনেরা।
তিনি হলঘর পেরিয়ে পড়ার ঘরে ঢুকতে যাওয়ার একটুও থামলেন না। আমার মনে পড়ল একবারই আমি তাঁর শরীরকে মানসিক চাপের জন্য অতি সামান্য মনমরা হতে দেখেছিলাম।
আমি জয়নবকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে নিকটতম টাকা তোলার যন্ত্রের কাছে নিয়ে যাই, যাতে আমি আমার ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে সর্বোচ্চ পরিমাণ টাকা তুলতে পারি এবং আমাদের কথোপকথন শাঁকচুন্নির বিষয়ে ফিরে আসে, যে শাঁকচুন্নি পাকিস্তান থেকে নির্বাসনে আসার জন্য আমাকে প্ররোচিত করেছিল এবং তারপর জয়নবকে আমার বাড়ি থেকে বহিষ্কার করেছিল।
শাঁকচুন্নি পুরুষতন্ত্রের শিকার, যে পুরুষের ওপর প্রতিশোধ নেয়, আমি বললাম। আমার মনে হয়, শাঁকচুন্নি এক ধরনের নারীবাদী?
সে শুধু শয়তান, জয়নাব বলল। এছাড়া শাঁকচুন্নি অশুভ, কারণ সে আকর্ষণীয় এবং যৌন সংযমহীন।
শাঁকচুন্নি পুরুষতন্ত্রের অপরাধবোধের বহিঃপ্রকাশ, আমি বললাম।
শাঁকচুন্নি দোষীদের প্রতারণার শিকার হওয়ার সুযোগ করে দেয়, জয়নব বলল।
এমনকি যখন শাঁকচুন্নিরা শিকার হয়, তখনো তারা পঞ্চাশ বছরের দীর্ঘ উত্থানের সঙ্গে নিজেদের যৌন-দেবতা করে তোলে, যা অপার্থিব সৌন্দর্যের একজন মহিলা যথেষ্ট পরিমাণে পেতে পারে না।
জয়নব হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে।
তোমার নিজের মধ্যে এই সংস্করণটি আরও বেশি হয়ে উঠুক, সে বলল।
সত্যি, আসলে অদ্ভুত কোনো শাঁকচুন্নি নেই?
হ্যাঁ, তেমনই, সেই রকমই।
আমি জয়নবকে বলেছি যে, আমার বয়স যখন আঠারো বছর হবে, তখন আমি আমাদের পারিবারিক গ্রামে যাব এবং মায়ের কবর পরিদর্শন করব। কিন্তু জয়নব পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে বলেছে যে, বন্যার পানিতে মায়ের কবর হারিয়ে গেছে, গ্রামের প্রতিটি ঘরবাড়ির সঙ্গে। এমনকি পিপুল গাছও ধ্বংস হয়ে গেছে, সে আরও বলেছে। সে আমার হাতে ছয়-সাত ইঞ্চি দীর্ঘ সবুজ-বাদামী ডালের অংশ দিয়েছে, যার থেকে হৃদয় আকৃতির কচি পাতা গজিয়ে উঠেছিল। এটাই একমাত্র জিনিস, যা আমি তোমার জন্য নিয়ে আসতে পেরেছি, সে বলল। মনে করো এটা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উদ্বাস্তু।
প্রতিকূল পরিবেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উদ্বাস্তু, ইংল্যান্ডে পিপুল গাছ জন্মাতে পারে না জেনে বললাম। বেঁচে থাকার জন্য তাদের প্রয়োজন রোদ এবং আর্দ্রতা। তবুও আমি আমাদের বাগানের কোণে ডালটি রোপণ করেছি, যেখানে সবচেয়ে বেশি সূর্যের আলো থাকে। ইংল্যান্ডে তখনও গ্রীষ্মকাল এবং আগের যে কোনো গ্রীষ্মকালের চেয়ে গরম পড়েছিল। পরের সপ্তাহগুলোতে ডালটি কয়েক সেন্টিমিটার বড় হয় এবং তারপর শরৎ আসে, তারপর আসে শীতকাল। যদিও পিপুল গাছটি মারা যায়নি, বরং মাটি ও পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো, মালী গাছটি উপড়ে ফেলতে চেয়েছিল, যতক্ষণ না আমাদের শ্রীলঙ্কার বাবুর্চি তাকে বলেছিল যে, গাছটির ধর্মীয় তাৎপর্য রয়েছে। আমার বাবা জানতেন না যে, তাঁর গ্রামের এই অংশটি ইংরেজ বাগানে বেড়ে উঠছে, যা তিনি বাড়ির জানালা থেকে দর্শনার্থীদের প্রশংসার সঙ্গে দেখার জন্য সম্পূর্ণ অলঙ্কার হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন।
পরের বছর গ্রীষ্মকালের গরম নির্ধারিত সময়ের আগেভাগেই এসেছিল, অনেক বেশি ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে। জুন মাসের মধ্যে লন্ডনে আমাদের পানি দেওয়ার পাইপ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং বাগানের ঘাস পুড়ে গিয়েছিল ও গাছপালা শুকিয়ে গিয়েছিল। সাপ্তাহিক এক বন্ধ দিনের সকালে রান্নাঘরের কল থেকে শুধু এক ফোঁটা পানি বেরিয়ে এসেছিল। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম খরার কারণে, কিন্তু অন্য কলে পানি ছিল। বাবা বলেছিলেন যে, তিনি একজন কলের মিস্ত্রীকে ডাকবেন এবং আমি এ সম্পর্কে আর কোনো চিন্তা করিনি, যতক্ষণ না আমি বাগানের এক কোণ থেকে, যেখানে আমি গত কয়েক মাস ধরে হাঁটিনি, বাবার গর্জন শুনতে পেলাম।
পিপুল গাছটি পাঁচ কিংবা ছয় ফুট উঁচু। গাছটির হৃৎপি- আকৃতির পাতাগুলো ছিল পুরু এবং চকচকে। কলের মিস্ত্রীর হাতে ছিল তার ফোন এবং ফোনের অ্যাপগুলোর মধ্যে গাছপালা শনাক্ত করার একটি অ্যাপ চালু ছিল। মিস্ত্রী গাছটিকে ‘আক্রমণাত্মক’ বলে অভিহিত করেছে; সে বলেছে, পানির সন্ধানে গাছের শেকড় অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারে। সেটা আমাদের পানির পাইপের মধ্যে ঢুকে গেছে, হয়তো ইতোমধ্যে ঘরের ভিতের ভেতরে ঢুকে গেছে।
এখানে গাছটি কেমন করে এলো? বাবা জিজ্ঞেস করেন।
আমি তাঁকে বললাম যে, জয়নব আমাদের বাড়ির রাস্তার উল্টোদিকের পিপুল গাছ থেকে কেটে এনেছে।
বাবার চেহারা! যেমন একজন মানুষ তাঁর নিজের মধ্যে অনেক পুরনো এবং গভীর এক অসুস্থতার ইঙ্গিত পাচ্ছেন যে, তা দিয়ে তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাটা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।
কলের মিস্ত্রী, ফোনের পর্দায় তাকিয়ে কিছু একটা পড়ছিল, বলল যে গাছটি সরাতে আমাদের একজন বিশেষজ্ঞকে ডাকতে হবে। গাছটি কেটে ফেলুন এবং শিকড় বাড়তে থাকবে। এরই মধ্যে কতটুকু ক্ষতি হয়েছে, তা জানা মুশকিল।
সেই রাতে বাবা বসার ঘরে দাঁড়িয়ে থাকেন, যে ঘরটি কদাচিৎ ব্যবহৃত হয়, এবং তিনি লন্ডনের সপ্তম বৃহৎ বাগানের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বাতাস আসা-যাওয়া করার জন্য আমরা রাতেরবেলা জানালা খুলে রাখতাম, কিন্তু যখনই আমি তাঁর খোঁজে বাড়ির ভেতর হাঁটি, তখনই আমি দেখলাম যে প্রতিটি জানালা বন্ধ এবং তালা লাগানো। আমি তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াই।
তুমি কী তাকে দেখেছ? বাবা জিজ্ঞেস করেন।
এটা ছিল একটা ছোট্ট জিনিস, ছবিতে যে চওড়া কা-ের পিপুল গাছের সৌন্দর্য দেখেছি, তার তুলনায় ঝুলন্ত শেকড় আর তাদের বিশাল উচ্চতা কিছুই না। আমরা বেশ অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকি, শুধু তাঁর নিঃশ্বাসের শব্দ হচ্ছিল, অদ্ভুত আর কর্কশ শব্দ। তিনি আমার উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বলে মনে হয়নি, এমনকি আমি প্রশ্নের জবাব দিইনি বলেও তাঁর মনে হয়নি। মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ সরে যায়; মৃদুমন্দ বাতাসে গাছের ডাল-পাতা নড়ছিল। দেখলাম একটা রোগা দেহ দু’হাত বাড়িয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। আমি অলোকিক কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, একই নাম দু’বার উচ্চারণ করেছে।
আমার নাম।
বাবা আমার দিকে তাকালেন।
অত্যন্ত শান্তভাবে, যেন আমি এ কথাটা শোনার জন্য সারা জীবন অপেক্ষা করছি, আমি জানালার কাছে যাই এবং পাল্লা খুলি। বাবা আমার হাত চেপে ধরেন।
আপনি যদি কাজটা করেন, তাহলে তিনি পছন্দ করবেন না, আমি বললাম এবং তৎক্ষণাৎ বাবা হাত সরিয়ে নেন যেন আমার হাতের ত্বকে বিষ মেশানো হয়েছে।
আমি বাগানে প্রবেশ করি। আমার খালি পায়ের নিচে মরা ঘাস। পোড়া জায়গা জুড়ে গাছটি অপেক্ষা করছে। আমি হয়তো অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা আমার চাচাতো বোন জয়নবকে খুঁজে পাব। হয়তো আমি শাঁকচুন্নির আসল সত্য জানতে পারব, পৌরাণিক পুরুষরা তার চারপাশে যে কাহিনী বুনেছিল, তার চেয়ে অনেক পুরনো এক প্রাণি, যা তার গল্পের কেন্দ্রবিন্দু হতে বেপরোয়া ছিল।
এক কদম, তারপর আরেক কদম, তরপর আরও এক কদম। আমি থামলাম, ঘাসের উপর বসে পা জোড়া বাঁকা করে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরি এবং আমার মুখ আকাশের দিকে উঠে যায়। কোনো তাড়াহুড়া নেই। আমি সেখানে কিছুক্ষণ বসে থাকতে চাই। বাবা দাঁড়িয়ে আমাকে দেখবেন এবং শাঁকচুন্নির কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি তাঁর অন্তরে গভীরভাবে গেঁথে যাবে, তাঁর অন্তরের প্রতিটি ভিত্তি কাঁপিয়ে দিবে।
পাদটীকা:
মূল গল্পে নেই, তবে পাঠকের সুবিধার্থে দেওয়া হলো- অনুবাদক।
১সেরেনা উইলিয়ামস (জন্ম ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৮১) একজন আমেরিকান প্রাক্তন পেশাদার টেনিস খেলোয়াড়, যিনি সর্বকালের অন্যতম সেরা টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিতি পেয়েছিলেন।
২‘ওয়ান ডিরেকশন’ ছিল ২০১০ সালে লন্ডনে গঠিত একটি ইংলিশ-আইরিশ পপ বয় ব্যান্ড। পরে এই ব্যান্ডটি সর্বকালের সর্বাধিক বিক্রিত বয় ব্যান্ডগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে ওঠে এবং ২০১৬ সালে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে বিশ্বের বৃহত্তম বয় ব্যান্ড হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।
গল্পসূত্র:
‘শাঁকচুন্নি’ গল্পটি কামিলা শামসির ইংরেজিতে ‘চুরাইল’ গল্পের অনুবাদ। এটি নারীবাদী ছোটগল্প সংকলন ‘ফিউরিজ’ (২০২৩ সালে প্রকাশিত)-এর জন্য লেখা হয়েছিল এবং সেখানে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গল্পটি ‘বেস্ট ব্রিটিশ শর্ট স্টোরিজ ২০২৪’ (সম্পাদক: নিকোলাস রয়েল) গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়। এছাড়া গল্পটি দ্য বার্সেলোনা রিভিউতে (অনলাইন সংস্করণ) প্রকাশিত হয় (২০২৪, সংখ্যা: ১১১)।
লেখক পরিচিতি:
পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বৃটিশ নারী লেখক কামিলা শামসি একজন ঔপন্যাসিক, গল্পকার এবং কলামিস্ট। তিনি ১৯৭৩ সালে করাচিতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি স্বনামধন্য সাহিত্য সমালোচক ও লেখিকা মুনিজা শামসির কন্যা, প্রখ্যাত ভারতীয় ঔপন্যাসিক আতিয়া হোসেনের ভাগ্নি এবং স্মৃতিকথা লেখিকা বেগম জাহানারা হাবিবুল্লাহর নাতনী। তাঁর শৈশব কেটেছে করাচিতে এবং সেখানেই তিনি স্কুলের পড়াশোনা সমাপ্ত করেন। পরে তিনি নিউ ইয়র্কের হ্যামিল্টন কলেজ থেকে ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ে বিএ এবং আমহার্স্টের ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএফএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি আটটি উপন্যাসের রচয়িতা। তাঁর প্রথম উপন্যাস ইন দ্য সিটি বাই দ্য সি প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে। এই উপন্যাসটি যুক্তরাজ্যের জন লেওলিন রাইস পুরস্কারের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পেয়েছিল এবং ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের সাহিত্যের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পুরস্কার লাভ করে। তাঁর অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে বার্ন্ট শ্যাডোস (২০০৯, অরেঞ্জ প্রাইজ, সংক্ষিপ্ত তালিকা), অ্যা গড ইন এভরি স্টোন (২০১৪, উইমেনস বেইলি প্রাইজ ও ওয়াল্টার স্কট প্রাইজ, সংক্ষিপ্ত তালিকা) এবং বেস্ট অব ফ্রেন্ডস (২০২২, ইন্ডি বুক অ্যাওয়ার্ডস, সংক্ষিপ্ত তালিকা)। তবে তাঁর সর্বাধিক প্রশংসিত ও পাঠক নন্দিত উপন্যাসটি হলো হোম ফায়ার (২০১৭), যা ‘যুদ্ধকালীন প্রেম, পরিবার এবং রাষ্ট্রের জটিলতার শক্তিশালী গল্প’ হিসেবে বিবিসি বর্ণনা করেছে। উপন্যাসটি ২০১৭ সালে ‘বুকার প্রাইজ’-এর জন্য দীর্ঘ তালিকায় ও ‘ইন্টারন্যাশনাল ডাবলিন লিটারেরি অ্যাওয়ার্ড’-এর সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পেয়েছিল। তবে উপন্যাসটি ২০১৮ সালে ‘উইমেন’স প্রাইজ ফর ফিকশন’ জিতেছে। তিনি ব্রিটেনের বেশ কয়েকটি সাহিত্য পুরস্কারের বিচারক ছিলেন। ফেন্স: দ্য মুসলিম কেস (২০০৯) তাঁর নন-ফিকশন গ্রন্থ। ২০১১ সালে তিনি রয়্যাল সোসাইটি অব লিটারেচারের ফেলো নির্বাচিত হন। ২০১৩ সালে তিনি ‘গ্রান্টা লিস্ট অব ২০ বেস্ট ইয়ং ব্রিটিশ রাইটার’-এর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন। বর্তমানে তিনি লন্ডনে বসবাস করছেন।