alt

সাময়িকী

ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-২

লোরকার দেশে

চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ

: বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৫

(পূর্ব প্রকাশের পর)

আজকের ভোর সাথে নিয়ে এলো উজ্জ্বল সূর্য ও হিমেল হাওয়া। ভোরের ¯িœগ্ধ সজীবতা আর ‘আলহাম্বরা’ দেখার উম্মুখতা মিলে আমাদের মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে আছে।

মূলত ‘আলহাম্বরা’দেখার জন্যই ভ্রমণকারীরা গ্রানাদা আসেন। কারণ এটি পশ্চিমা জগতে ইসলামী স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।

আমার স্মৃতিতে জমা আছে ‘আলহাম্বরা’-র এক মায়াবী ছবি। প্রায় ৪৫ বছর আগে পড়েছিলাম ওয়াশিংটন আরভিং-এর ঞধষবং ড়ভ ঃযব অষযধসনৎধআলহাম্বরা-র এক জীবন্ত বর্ণনা, সাথে বহু লোককাহিনী। তখন থেকেই স্বপ্ন ছিল এ সুন্দর সৃষ্টি দেখব, আজ সে স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে।

ট্রাভেল অফিসে টিকিট দেখিয়ে আমাদের ট্যুর নিশ্চিত করলাম। মাসখানেক আগেই অনলাইনে টিকিট কিনেছিলাম। হলুদ পতাকা হাতে আমাদের গাইড সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বললো, পতাকাটি দিকচিহ্ন, তাকে অনুসরণ করতে সুবিধা হবে। গলায় ঝোলানোর জন্য দিল একটি করে হলুদ ব্যাজ, আর তার বর্ণনা শোনার জন্য দিল রিসিভার-সহ হেডফোন। এক এক করে নাম ধরে ডেকে সবাইর সাথে পরিচিত হলো রশিদ বকরিম- একজন স্পেনীয় আরব, সুন্দর চেহারা, চমৎকার ব্যবহার। বলল, আমাকে সবাই বকরিম বলে ডাকবে। ইতিহাসের ছোটখাট একটি পাঠ দিয়ে বকরিম শুরু করল তার যাত্রা।

গ্রানাদার ভাঙাগড়ার ইতিহাসের এক বড় সাক্ষী হয়ে আছে আলহাম্বরা। শুরু করা যাক গড়ার ইতিহাস দিয়ে, যার শুরু ১২৩৮ সালে, যখন আলহাম্বরা-র নির্মাণ কাজ শুরু করেন নাসিরীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ ইবনে আল আমর। তাঁর রাজত্বকাল ছাড়িয়ে ১৩৫৮ সাল পর্যন্ত চলে এর কাজ।

১৪৯২ সালে ক্যাথলিকরা গ্রানাদা জয় করেন। এর পরে যেন শুরু হলো আলহাম্বরা-র দুর্দিন। ১৫২৭ সালে পঞ্চম চার্লস আলহাম্বরা এলাকায় শুরু করেন তাঁর প্রাসাদ নির্মাণ। এতে পাশের নাসরীয় প্রাসাদের কিছু অংশের ক্ষতি সাধিত হয়। ১৮১২ সালে আইবেরিয়ান উপদ্বীপ যুদ্ধে ফরাসি সৈন্যরা আলহাম্বরা-র কিছু টাওয়ার ধ্বংস করে। এরপর আসে ১৮২১ সালের ভূমিকম্প, যাতে এটি আরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

‘আলহাম্বরা’ অনেকদিন অযতেœ, অবহেলায় পড়ে ছিল। ১৮৩২ সালে আমেরিকার লেখক ওয়াশিংটন আরভিং-এর ঞধষবং ড়ভ ঃযব অষযধসনৎধ বইটি প্রকাশিত হবার পর সবদিকে আলহাম্বরা নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায়- একই সাথে এর সৌন্দর্য ও দুর্দশা সবার চোখে পড়ে। শুরু হয় পুনরুদ্ধার ও সংস্কার কাজ- স্থপতি হোসে কনথ্রেরাস ছিলেন তার তত্ত্বাবধানে।

১৯৮৪ সালে ইউনেস্কো আলহাম্বরাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করে।

একনাগাড়ে এতক্ষণ বলে বকরিম একটু দম ফেলে বলল, আলহাম্বরা-র কাহিনী আরো অনেক বড়, বাকিটা দেখাতে দেখাতে বলবো। হাঁটতে হাঁটতে সে আবার শুরু করল তার বর্ণনা।

আলহাম্বরা-য় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে প্রকৃতির সাথে স্থাপত্যের সুষমাকে- যেখানে আলো ও বাতাস খেলা করে প্রাসাদের অলিন্দে ও খিলানে, আর ছড়িয়ে পড়ে সাথের উদ্যান ও ঝর্নাধারায়, ফাঁকে ফাঁকে দৃশ্যমান আলো-ছায়া- সব মিলে সৃষ্টি করা হয়েছে এক নান্দনিক দৃশ্যের। প্রাসাদের জানালা দিয়ে দেখা যায় একদিকে গ্রানাদা, বিশেষ করে আলবাইসিন, অন্যদিকে পর্বতমালা সিয়ারা নেভাদা ও এর উপত্যকা, ঢালু সবুজ তৃণভূমি।

আলহাম্বরা-র প্রধান তিনটি এলাকা-নাসিরীয় প্রাসাদ, হেনেরআলিফে ও আল কাছাবা। নাসরিদ প্রাসাদ ছিল গ্রানাদার মুসলিম শাসকদের বাসস্থান ও রাজসভা, হেনেরআলিফে তাদের গ্রীষ্মকালীন আবাস, যেটি মূলত বাগান, আর আল কাছাবা একটি দুর্গ।

এক শহরের মাঝে আরেক শহর- আলহাম্বরা- ১৭৩০ মিটার বা প্রায় ১ মাইল দীর্ঘ দেয়াল দিয়ে ঘেরা, সাথে রয়েছে ৩০টি টাওয়ার ও ৪টি সদর দরজা। সবচেয়ে সুদৃশ্য সদর দরজা পুয়েরতা দে লা জাসটিসিয়া দিয়ে আমরা আলহাম্বরা-য় প্রবেশ করি। এ দরজার প্রধান বৈশিষ্ট্য পাথরের উপর ছায়াচিত্রের সূক্ষ্ম কাজ। এর প্রধান খিলানে রয়েছে একটি হাতের সুন্দর নকশা, ভেতরের খিলানে রয়েছে একটি চাবির নকশা। পুয়েরতা দে লা জাসটিসিয়াকে আল হাম্বরা-র প্রতীক হিসেবে ধরা হয়।

একটু হেঁটে আমরা পৌঁছি মেকসুয়ার প্রাসাদে, যা নাসিরীয় প্রাসাদসমূহের অন্যতম একটি প্রাসাদ। ঢুকতেই মেচুকার চত্বর- একটি তোরণ-শোভিত বারান্দা ও সুন্দর বাগান, সাথে গোলাকার দুটি ফোয়ারা। এরপর এক হল-ঘর, নাম মেকসুয়ার হল- বিভিন্ন সময়ে চলে এর বহু পরিবর্তন। এর ভেতরের ছাদে রয়েছে কাঠের সূক্ষ্ম ও রঙিন নকশার কাজ। সম্ভবত এখানে ছিল রাজকীয় বিচারালয়, কারণ এর দরজার উপর একটি টাইলে লেখা: ‘প্রবেশ করো এবং চেয়ে দেখ। ন্যায় বিচার পেতে ভীত হয়ো না, কারণ এখানে তুমি তা পাবে’। মেকসুয়ার হল এর এক প্রান্ত থেকে দেখা যায় আলবাইসিন, হলের সে কোনায় রয়েছে এক নামাজ-ঘর, সাথে কেবলামুখী মিহরাব। এর পাশেই রয়েছে খিলান-সমৃদ্ধ আরেকটি চত্বর- মেকসুয়ার চত্বর- যার উত্তর দিকে রয়েছে একটি বারান্দা-সংযুক্ত কক্ষ, যা গোল্ডেন চেম্বার নামে পরিচিত। এর পাশের মূল প্রাসাদে সুলতানের সাথে সাক্ষাতের আগে অভ্যাগতরা এ কক্ষে অপেক্ষা করতেন।

এরপর পৌঁছি দক্ষিণ পাশের একটি সুন্দর তোরণ, ফ্যাসাদা দে কোমারেজ-এ, যা কোমারিজ প্রাসাদের প্রধান প্রবেশদ্বার। আরবি ক্যালিগ্রাফি ও অন্যন্য সূক্ষ্ম নকশায় প্রবেশদ্বারটি শোভিত। এর জানালাগুলির উপরে আরবিতে লেখা আছে: ‘ওয়ালা গালিবা ইল্লাল্লাহ’, অর্থ, ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনো বিজয়ী নাই’। এই বাণী লিখিত আছে আলহাম্বরা-র আরো বহু স্থানে, সব মিলিয়ে হাজার বারেরও অধিক। বাণীটি নাসিরীয় শাসকদের নীতিবাক্য হিসেবে বিভিন্ন স্থানে উদ্ধৃত। আলহাম্বরা-র বিভিন্ন স্থানে খোদাই করা আছে পবিত্র কোরআনের বহু আয়াত। তাছাড়া আছে প্রাচীন বিভিন্ন কবিতার পংক্তি, এর মধ্যে আছে মুরিশ চার কবি ইবনে জামরাক, ইবনে ইয়াইয়াব, ইবনে আল খাতিব ও ইবনে ফারকুন লিখিত কবিতা।

ফ্যাসাদা দে কোমারেজ উন্মুক্ত হয়েছে জলাশয় ও বাগান সমৃদ্ধ এক বিশাল আঙিনায়, যার নাম মার্টেল চত্বর। চিরসবুজ মার্টেল গাছগুলি সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে জলাশয়ের দু’পাশে, তাই এ নাম। এ চত্বর থেকে দেখা যায় কোমারিজ টাওয়ার। জলাশয়ের চারপাশে রয়েছে হাঁটার সুদৃশ্য পথ। এ জলাশয়ের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে দেখলাম এর উপর পড়া কোমারিজ টাওয়ারসহ পুরো প্রাসাদের প্রতিবিম্ব। মনে হয় কোমারিজ টাওয়ার পানির উপর ভাসছে। কী অনন্য দৃশ্য! বকরিম বলল, মিরর ইমেজ-এর ছবি তুলবে? সবাই একসাথে রাজি হয়ে গেল। একে একে সবাই ছবি তুলতে লাগল। আমরা চারজন জলাশয়ের এক প্রান্তে দাঁিড়য়ে অপেক্ষা করলাম। বকরিম অপর প্রান্ত থেকে আমাদের ছবি তুলল। আমাদের চারজনের দাঁড়ানো ছবি, আর জলাশয়ের পানিতে পড়া আমাদের প্রতিবিম্ব, তার উপর কোমারিজ টাওয়ারের প্রতিবিম্ব। পানিতে উপরের স্থাপনার প্রতিবিম্বে নকশার প্রয়োগ করা হয়েছে আগ্রার তাজমহলে- প্রায় তিনশ বছর পরে (১৬৩০-৪৭) সময়ে।

মার্টেল চত্বর পার হয়ে সামনে পড়ল দি হল অফ দি বোট (সালা ডি লা বারাকা)। লম্বা এ ঘরটির দু’দিকে রয়েছে দু’টি করে ছায়াকুঞ্জ, আর উপরে আছে বিভিন্ন নকশা খোদাই করা কাঠের সিলিং, যা আকৃতিতে মনে হবে এক উল্টোনো-নৌকা। এ কক্ষে রয়েছে জাফরির কাজের অনিন্দ্য সুন্দর জানালা।

আলহাম্বরা-র দালানগুলো বাইরে সাদাসিধে, কিন্তু ভেতরে বেশ জমকালো। কোমারিজ প্রাসাদও এর ব্যতিক্রম নয়। গ্রানাদায় অনেক দূর থেকে দেখা যায় ৪৫ মিটার উঁচু কোমারিজ টাওয়ার- যা আলহাম্বরা-র সর্বোচ্চ টাওয়ার, এর ভেতরেই কোমারিজ প্রাসাদ। হল অব অ্যাম্বাসেডরস এ প্রাসাদের অংশ। এখানে ঢুকেই নাতাশা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল- ওয়াও, ইটজ আলহাম্বরা-স মোস্ট বিউটিফুল প্লেস। বকরিম সাথে সাথেই বলল, ইউ আর অ্যাবসলিউটলি রাইট! ইটস আলহাম্বরা-স মোস্ট বিউটিফুল রুম।

হল অব অ্যাম্বাসেডরস সত্যিই খুব নান্দনিক এক কক্ষ। এটি ছিল বিদেশী দূত ও অন্যান্য অতিথির সাথে সুলতানদের সাক্ষাতের স্থান। এর আরেক নাম সিংহাসন কক্ষ। কারণ সুলতান সিংহাসনে বসে বিপরীত দিক থেকে আসা অভ্যাগতদের সাক্ষাৎ দান করতেন। দরজা, জানালা, মেঝে, দেয়াল, ছাদ- কক্ষটির সবই শোভিত অনুপম শিল্পকর্মে- জ্যামিতিক নকশা, আরবি ক্যালিগ্রাফি ও রঙিন টাইলস-এ। ওপরের সিলিং-এ বসানো ৮০১৭টি কাঠের টুকরা দিয়ে তৈরি গম্বুজ, সূক্ষ্ম কারুকাজ করা প্রতিটি কাঠের টুকরা বিচিত্র বিন্যাসে একত্রে সাজানো। ব্যালকনির পাশে বসানো রঙিন কাঁচ- যা ভেদ করে বর্ণিল আলো প্রাসাদে প্রবেশ করে একে করে তোলে স্বপ্নীল।

হল অব অ্যাম্বাসেডরস-এর ভেতরেই, ১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাস তাঁর শেষ আর্জি পেশ করেন রাজা ফার্দিনান্ড, রানী ইসাবেলা ও সালামানকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের কাছে, যাতে তাঁর দূর প্রাচ্যের সমুদ্র যাত্রার প্রয়োজনীয় অর্থ ও জনবল দেয়া হয়। রাণী ইসাবেলা ছাড়া সবাই এর বিরোধিতা করেন। রাণী বলে উঠলেন:‘সি, সিনর’, অর্থাৎ ‘হ্যাঁ, মহাশয়’! ৩ আগস্ট, ১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাস তিনটি জাহাজ নিয়ে তাঁর পরিকল্পিত সমুদ্রযাত্রা শুরু করেন। এর পরের ইতিহাস সবার জানা।

স্বপ্নীল এক পরিবেশে, মুগ্ধতার এক ঘোরে অনেকক্ষণ কেটে গেল। সম্বিৎ ফিরে পেলাম যখন বকরিম বলল, আমাদের দেখার আরো অনেক কিছু বাকি আছে, আলহাম্বরা-র অর্ধেকও দেখা হয়নি। তাই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

আলহাম্বরা-র অর্ধেক শেষ হবে কি, নাসিরীয় প্রাসাদই দেখা শেষ হয়নি। এরপর আছে আলকাছাবা ও হেনেরআলিফে। মনে হলো বকরিম দেখার গতি একটু বাড়িয়ে দিল।

এতক্ষণ নাবিল ও নাতাশা কোনো কিছু বলেনি, দেখছিল সবকিছু, আর শুনছিল বকরিমের ভাষ্য। এবার নাবিল বলল, আলহাম্বরা-র প্লান মনে হয় বেশ জটিল। বকরিম বলল, ঠিকই বলেছ। এটি এক সাথে একটি মহাপরিকল্পনায় তৈরি হয়নি, তাই সুবিন্যস্ত নয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শাসক তাঁদের ইচ্ছে বা প্রয়োজন মতো আলহাম্বরা-র পরিবর্তন পরিবর্ধন করেছেন।

আলহাম্বরা ঘুরে দেখার সময় অনেকে হাতে রাখেন এর প্ল্যান ও বিবরণী সম্বলিত ভিজিটরস গাইড বুক, যা অনেক কিছু বুঝতে সহায়তা করে। গাইড বুক নিয়ে ঘুরতে যাওয়া আমারও অনেক পুরনো অভ্যেস। এবার গাইড বুক কিনতে গেলে নাতাশা বলে উঠল, তা লাগবে না। আমরা নিজেরাই পারব ভালো দেখতে ও বুঝতে। আমি বললাম, ঠিক আছে। আমাদের সব দেখা শেষ হয়ে গেলে গাইড বুক কিনতে পারি, যাতে এসব মনে থাকে। নাবিল ও নাতাশা দু’জনেই বলল, সব মনে রাখার কি দরকার আছে?

এরপর আমরা গেলাম কোর্ট অব লায়ন চত্বরে, যেখানে পাথরে খোদাই করা বারোটি সিংহের ভাস্কর্য পানিপ্রবাহের সাথে সংযুক্ত, আর সবার কেন্দ্রে রয়েছে গোলাকার মার্বেল বেসিনের উপর এক ঝর্না। চত্বরকে ঘিরে রেখেছে ১২৪টি সরু কলাম। ছবি তোলার জন্য এ চত্বরটি জনপ্রিয়, সবদিকে পর্যটক, আমরাও ছবি তোলার জন্য লাইনে দাঁড়ালাম। চত্বরে সিংহের সাথে, ঝর্নার সাথে ছবি তুললাম- বসে, দাঁড়িয়ে, দলবদ্ধভাবে, এবং একাকী। আগের মতোই বকরিম সাহায্য করল।

এ চত্বরের চারপাশে রয়েছে অনেকগুলি প্রাসাদ ও হল। দক্ষিণে রয়েছে সালা দে লস আবেনসেরাহেস- সুলতানদের বৈঠকখানা। এ কক্ষের সিলিং- মৌচাকের মতো খাঁজে তৈরি করা আট-পার্শি¦ক তারার অনুপম এক শিল্পকর্ম- অবাক হয়ে আমরা সবাই দেখলাম, আর ছবি তুললাম।

চত্বরের পূর্বদিকে রয়েছে বড় হলঘর, সালা দে লস রেয়াস, যা পাঁচভাগে বিভক্ত। এর তিনটি হলঘর পাশের চত্বরের পোর্টিকোর আলোয় আলোকিত। এ তিনটি হলঘরের মাঝে রয়েছে দুটি আলাদা কক্ষ যা পুরোপুরি ছায়ায় ঢাকা। যে কোন দিক থেকেই হল ঘরটি দেখলে মনে হবে আলো ছায়ার এক ক্রম-সজ্জা। বকরিম তার বর্ণনা শেষ করার সাথে সাথে নাবিল ও নাতাশা পরীক্ষা করতে গেল আলো ছায়ার ক্রম-সজ্জাটিকে- দেখে সত্যিই খুশি হলো।

এর পরের গন্তব্য সালা দে ডস এরমানাস। কোর্ট অব লায়ন চত্বরের উত্তর দিকে দু’টি সুদৃশ্য খিলান দিয়ে এর ভেতরে ঢুকলাম। এ হল ঘরের মেঝের কেন্দ্রে স্থাপিত দুটি সাদা মার্বেল স্ল্যাব, যা মিলেছে এক ঝর্নায়। এখানেও দেখলাম মৌচাকের মতো খাঁজে তৈরি করা নিখুঁত শিল্পকর্মের এক সিলিং। এ কক্ষের পুরো দেয়ালে স্টাকো আর্টে আঁকা মুরিশ কবি ইবন জামরাকের এক কবিতা, যার ক’টি অনূদিত লাইন: .....

নয়নের পুলকের তরে কত কি আয়োজন!

মহৎ আত্মা আমার মাঝে খুঁজে পাবে নব হৃদয়:

কবজের মতো কৃত্তিকা গুচ্ছ-নক্ষত্র তারে করে রক্ষা,

শান্ত সমীরণের যাদু তার পালক।

জ্যোতির্ময়, অনন্য এক প্রাসাদশৃঙ্গ,

দেখায় অনুপম শোভা,

দৃষ্টির সামনে ও আড়ালে।১

...

নাসিরীয় প্রাসাদসমূহ দেখা এখানেই শেষ- নাটকীয়ভাবে বলল বকরিম। অনেকে স্পষ্টতই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, আর মনে মনে হয়তো বলল- যাক বাঁচা গেল, ইতিহাসের প্রান্তরে আর কতো হাঁটা যায়! জীবনানন্দ তো হাজার বছর হেঁটেছিলেন কবিতার শরীরে, পৃথিবীর বুকে নয়।

অনেকে হতাশ হলো যখন বকরিম বলল, এখন যাব আলহাম্বরার সাথে ১৬শ শতাব্দীতে যোগ করা অংশে, যেখানে কিছুদিন ছিলেন ওয়াশিংটন আরভিং, তাঁর কাহিনী দিয়ে শুরু করি।

ওয়াশিংটন আরভিং মাদ্রিদ অবস্থান করে ক্রিস্টোফার কলম্বাস-র জীবনী লিখছিলেন। সেটি শেষ করে ১৮২৮ সালে তিনি গ্রানাদা বেড়াতে আসেন। গ্রানাদা দেখে তিনি মন্তব্য করেন: দধ সড়ংঃ ঢ়রপঃঁৎবংয়ঁব ধহফ নবধঁঃরভঁষ পরঃু, ংরঃঁধঃবফ রহ ড়হব ড়ভ ঃযব ষড়াবষরবংঃ ষধহফংপধঢ়বং ঃযধঃ ও যধাব বাবৎ ংববহ’। সেসময় ওয়াশিংটন আরভিং দেখতে আসেন আলহাম্বরা, যা তাকে গভীরভাবে অভিভূত করে। এর প্রতি প্রবল টানে পরের বছর তিনি গ্রানাদায় ফিরে আসেন। আলহাম্বরা-র গভর্নর ও গ্রানাদার আর্চবিশপকে ওয়াশিংটন আরভিং অনুরোধ করেন, যাতে তাঁকে এ প্রাসাদে থাকার ও এর আর্কাইভের দুর্লভ নথিপত্র দেখার অনুমতি দেয়া হয়। লেখক ও কূটনীতিক হিসেবে ওয়াশিংটন আরভিং ততদিনে বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন। তাই তাঁর অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হয়নি।

মাত্র ৩ মাস- ১৮২৯ সালের ৪ঠা মে থেকে ২৯ শে জুলাই-ওয়াশিংটন আরভিং আলহাম্বরা-য় অবস্থান করেন। প্রথমে তিনি নাসিরীয় প্রাসাদের উপরের তলার কক্ষগুলোতে থাকতেন। কিছুদিন পর চলে যান এম্পেরর’স চেম্বার-এ, পরে যার নাম দেয়া হয় ওয়াশিংটন আরভিং রুম। সে সময় ১৭ বছরের এক স্থানীয় বালক মাতিও হিমেনেস-র সহায়তায় তিনি আলহাম্বরা-র উপর বিভিন্ন ইতিহাস, গল্প ও মিথ সংগ্রহ করেন। এ কক্ষে বসে তিনি লিখেন তাঁর বিখ্যাত বই ঞধষবং ড়ভ ঃযব অষযধসনৎধ। তাই এর প্রবেশপথে ১৯১৪ সালে ওয়াশিংটন আরভিং-এর স্মরণে একটি প্লাক স্থাপন করা হয়, যেখানে স্প্যানীয় ভাষায় লেখা আছে : ‘ওয়াশিংটন আরভিং ১৮২৯ সালে তাঁর টেইলস অব আলহাম্বরা এই কক্ষগুলিতে লিখেছেন’। এ কাহিনী বলতে বলতে বকরিম এই কক্ষ ও প্লাকটির সামনে সবাইকে নিয়ে আসল। আমি এসবের ছবি তুলতে চাইলে নাতাশা নিষেধ করে বলল, প্লিজ লিভ ইন দ্য মোমেন্ট।

তবুও আমি ফিরে গেলাম বর্তমান থেকে অতীতে- এ দুটি সবসময় হাত ধরাধরি করে চলে, বিশেষ করে আলহাম্বরা-য়, তাদের আলাদা করা কঠিন। ফিরে গেলাম ৪৫ বছর আগে, যখন পড়ছিলাম ঞধষবং ড়ভ ঃযব অষযধসনৎধ, এখন সে আলহাম্বরা-র ভেতরেই আছি, আর সে কক্ষটির সামনে দাঁড়ানো যেখানে ওয়াশিংটন আরভিং এ বইটি লিখেছেন, আর বিখ্যাত করেছেন আলহাম্বরাকে, সাথে নিজেকেও। তাঁরই স্মরণে প্লাক। মনে মনে এ মহান লেখকের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। নাবিল নাতাশাকে কিছু বললাম না, বললে হয়তো বলবে, সবকিছুতেই তোমাদের সেন্টিমেন্ট।

ওয়াশিংটন আরভিং এর কক্ষ থেকে পাশে পঞ্চম কার্লোস প্রাসাদ-এ আমাদের নিয়ে গেল বকরিম। আসা-যাওয়ার পথে এটিকে বাইরে থেকে দেখেছি, মনে হয়েছে- উড়ে এসে জুড়ে বসা। বিশাল স্থাপত্য, তবে আলহাম্বরা-র সাথে বেমানান। এর এলাকার ভেতরে স্থাপিত হলেও ইতিহাস ও স্থাপত্যে এটি আলহাম্বরা-র বাইরের জগতের। এর নির্মাণ নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হয়েছে। বকরিম জানাল, হয়তো সে কারণেই ১৫২৭ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হলেও ১৬৩৭ সাল পর্যন্ত তা অসম্পূর্ণ ছিল। এরপর সে অবস্থায় রেখে দেয়া হয়। ১৯২৩ সালের পরে এর কাজ সম্পূর্ণ করা হয়। যাই হোক, আলহাম্বরা-র দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থাপনার মাঝে এটি স্থান করে নিয়েছে।

ক্যাথলিক আমলে তৈরি রেনেসাঁ স্টাইলের স্থাপত্য পঞ্চম কার্লোস প্রাসাদ। বর্গাকার দালানের মাঝে গোলাকার চত্বর- রেনেসাঁ স্টাইলের এ স্থাপত্য সে সময় জনপ্রিয় ছিল। পঞ্চম কার্লোস প্রাসাদেও এ নকশা অনুসরণ করা হয়। বিপরীতে, আলহাম্বরা-র স্থাপত্যে রয়েছে প্রাসাদের মাঝে মাঝে আয়তাকার চত্বর।

কার্লোস প্রাসাদের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য এর অ্যাকোস্টিকস চত্বরের কেন্দ্রে কোনো শব্দ করলে তা চারপাশে আরো জোরে শোনা যায়। বকরিম বলল, তোমরা পরীক্ষা করে দেখ। অনেকে, তার মধ্যে ছিল নাবিল ও নাতাশা- চত্বরের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে গান গাইল- সত্যিই, সব দিকে আরো বড় শব্দে শোনা গেল সে গান! ধ্বনি সম্বন্ধীয় এ বৈশিষ্ট্যের জন্যই হয়তো এখানে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক সঙ্গীত ও নাচ উৎসব।

পঞ্চম কার্লোস নিজে তো নয়ই, এ প্রাসাদে কোনো রাজা রাণী বাস করেননি। বর্তমানে এর প্রথম তলায় রয়েছে আলহাম্বরা মিউজিয়ম, আর উপরের তলায় রয়েছে গ্রানাদা ফাইন আর্টস মিউজিয়ম। বকরিম বলল, ট্যুর শেষ হওয়ার পরে তোমরা মিউজিয়ম-এ আসতে পার। আলাদা কোনো টিকিট লাগবে না। তবে এখন আমরা মিউজিয়ম-এ না ঢুকে শুধু প্রাসাদের চার পাশে দেখব।

এরপর আমরা গেলাম হার্দিনেছ দেল পার্তাল বা পার্তাল বাগানে। চারিদিকে বাগান, একপাশে রয়েছে এক বিশাল, মনোরম জলাশয়, সাথে ৫টি খিলান সমৃদ্ধ খোলা বারান্দা- টাওয়ার অফ দি লেডিস- দোতলাতে রয়েছে একটি বিশাল লুকআউট পয়েন্ট, যেখান থেকে দেখা যায় দারো নদীর উপত্যকা, আলবাইসিন ও হেনেরআলিফে বাগান। হাঁটতে হাঁটতে একটি বাগানের সামনে পৌঁছতেই বকরিম আমাদের বলল, এগুলি হলো ডালিম ফলের গাছ। মুররা তাদের সাথে ডালিম, কমলা ইত্যাদি নিয়ে আসে গ্রানাদা তথা স্পেনে। আর তাদের জয় করা নতুন এলাকার নাম দেয় ‘গ্রানাদা’, যার স্পেনীয় অর্থ ‘ডালিম’। ক্রমে ডালিম হয়ে উঠে গ্রানাদার প্রতীক। এখন শীতকাল, ফল পাকার সময় পার হয়ে গেছে, তবে আমাদের সামনের গাছগুলিতে এখনো কিছু পাকা ডািলম শোভা পাচ্ছে।

বকরিম মজা করে বলল, এতক্ষণ আমরা অতীতে ছিলাম, এবার অতীত থেকে আরো অতীতের দিকে যাব। এরপর সে আমাদের নিয়ে গেল আলহাম্বরা-র দক্ষিণ-পূর্বের সেকানো-তে, যা প্রায় বিলুপ্ত এক এলাকা। মুসলিম আমলে এটি ছিল ঘন বসতিপূর্ণ, মদিনাত আল হামরা, সংক্ষেপে মদিনা বা শহর। সে সময় রাজপরিষদের কর্মকর্তা ও তাদের কর্মচারীরা এখানে বাস করতেন। তাদের জন্য প্রাসাদ, বাসগৃহ, গণ ¯œানাগার, মসজিদ, কেনাকাটার বাজার ও বাগান ছিল। আরো ছিল বিভিন্ন পেশা ও ব্যবসায়ের স্থাপনা, যেমন, ট্যানারি, সিরামিক শপ, ওয়ার্কশপ ইত্যাদি। বেশিরভাগ ভবনের- তার মাঝে প্রাসাদও আছে- এখন শুধু ধ্বংসাবশেষ আছে, তবে মূল ভবনের কাঠামো দৃশ্যমান।

দু’ঘণ্টার উপর সময় পার হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে আলহাম্বরা দেখা শেষ হবে না, চলছে তো চলছেই। অনিন্দ্যসুন্দর এ স্থাপত্য দেখার আনন্দ সত্ত্বেও কারো মাঝে চলে এসেছে একঘেঁয়েমি, কারো মাঝে ক্লান্তি। শুরু হয়েছিল মনোরম এক প্রাসাদ দিয়ে, এখন এসে পড়লাম শহরের ধ্বংসাবশেষে। নাবিল নাতাশা তো বলেই বসল, এসব পুরনো ঘরবাড়ি দেখাটা একদম বোরিং, তার চেয়ে আমরা অন্য কিছু দেখি। আমি বললাম, নতুন পুরনো, সুন্দর অসুন্দর, সবই জীবনের অংশ, তাই সবই আমাদের দেখা উচিত।

জবভ:

১. ঞযব অষযধসনৎধ ওহংপৎরঢ়ঃরড়হ, ওনহ তধসধৎধশ, ঃৎধহংষধঃবফ নু ঈযৎরংঃড়ঢ়যবৎ গরফফষবঃড়হ ্ খবঃরপরধ এধৎপরধ-ঋধষপড়হ, ঞযব চধৎরং জবারব,ি রংংঁব ১১৮, ঝঢ়ৎরহম ১৯৯১

টীকা:

১) প্রথম ইউসুফ ও তাঁর পুত্র পঞ্চম মুহম্মদের ষাট বছরের শাসনামলে (১৩৩৩-১৩৯১) আলহাম্বরা-র ভেতরের কারুকাজ ও অলংকরণ সম্পূর্ণ করা হয়।

২) ক্যাথলিক রাজা রাণী, ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা, ১৪৯২ সালে গ্রানাদা জয় করেন। অবসান ঘটে ৭১১ সালে শুরু হওয়া ৭৮১ বছরের মুসলিম শাসনের, সেই সাথে অবসান ঘটে ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধের, ৭৮১ বছরের যুদ্ধ- রিকনকুইছতা- যা ছিল স্পেনকে আবার ক্যাথলিক শাসনে ফিরিয়ে আনার যুদ্ধ। ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা আলহাম্বরা-য় বাস করে এখান থেকে রাজকর্ম পরিচালনা করতে থাকেন।

৩) পঞ্চম চার্লস রেঁনেসাযুগীয় স্থাপত্য-শৈলীতে আলহাম্বরা এলাকায় তাঁর প্রাসাদ নির্মাণ শুরু করেন। এর স্থপতি ছিলেন মাইকেল এঞ্জেলোর ছাত্র পেদ্রো মেচুকা । ১৫২৭ সালে শুরু হলেও ১৬৩৭ সালে তা অসম্পূর্ণ অবস্থায় রেখে দেয়া হয়। ১৯২৩ সালের পরে এর কাজ সম্পূর্ণ করা হয়।

৪) আলহাম্বরা পুনরুদ্ধার ও সংস্কার কাজের তত্ত্বাবধানে ছিলেন স্থপতি হোসে কনথ্রেরাস। তাঁর মৃত্যুর পর ছেলে রাফায়েল ও পৌত্র মারিয়ানো এ কাজ চালিয়ে যান ।

৫) স্পেনের রাজা পঞ্চম কার্লোস-র নির্দেশে ১৫২৮ সালে আলহাম্বরা-র সালা দে ডস হারমানাস এর পাশে নির্মাণ করা হয় এম্পেররস চেম্বার, পরে তার নাম দেয়া হয় ওয়াশিংটন আরভিং রুম। তবে কার্লোস কোন সময় এখানে বাস করেননি। এর একটি কক্ষ সালাস দ্য লাস ফ্রুটাস, ওয়াশিংটন আরভিং এর অবস্থানে ধন্য হয়ে আছে।

ছবি

ফার্স্ট টিউসডে’স : আমার প্রথম মঙ্গলবার সন্ধ্যার গন্তব্য

ছবি

আজ লাবণ্যর বিয়ে

ছবি

সংস্কৃতির পরম্পরা, অভিঘাত-অভিজ্ঞান ইতিহাস বিচার-বিশ্লেষণ

ছবি

তুষার গায়েন-এর কবিতা

ফিলিস্তিনের তিনটি কবিতা

ছবি

এক বিস্ময় প্রতিভা

ছবি

দিওয়ান-ই-মাখফি : জেব-উন-নিশা

ছবি

বৈচিত্র্যে ভরা ‘যদিও উত্তরমেঘ’

ছবি

রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের কথা

ছবি

মোহ কাঠের নৌকা : জীবন-সংগ্রামের এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি

ছবি

শাঁকচুন্নি

ছবি

মেঘনাদবধ, এক নতুন দৃশ্যভাষা

ছবি

নতুন কবিতার সন্ধানে

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

গণহত্যার বিরুদ্ধে কবিতা

ছবি

আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘ভাঙানৌকা’

ছবি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বায়োস্কোপ

ছবি

জরিনা আখতারের কবিতা আত্ম-আবিষ্কার ও মুক্তি

ছবি

শহীদ সাবেরের সাহিত্য চিন্তা ও জীবনের সমন্বয়

ছবি

বাংলা ছোটগল্পের অনন্য রূপকার নরেন্দ্রনাথ মিত্র

ছবি

প্রেম, দর্শন ও অখণ্ডতা

ছবি

প্রতিবাদী চেতনার উর্বর ময়দান

ছবি

রবীন্দ্রনাথের আদি পুরুষের শেকড়

ছবি

ভেঙে পড়ে অন্তর্গহনের প্রগাঢ় অনুভূতি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

রহস্যময় পাহাড়ী মানব

ছবি

ফ্রিদা কাহলো : আত্মপ্রকাশের রঙিন ক্যানভাস

ছবি

জ্যাজ সংঙ্গীতের তাৎক্ষণিক সৃষ্টিশীলতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

নক্ষত্রের ধ্রুবতারা অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী

ছবি

নজরুল ও তাঁর সুন্দর

ছবি

নতুন বইয়ের খবর

ছবি

‘আমার চোখ যখন আমাকেই দেখে’- প্রেম ও প্রকৃতির সেতুবন্ধ

ছবি

পূষন ও বৃষ্টির গল্প

ছবি

নিরামিষ চর্চার বিরল আখ্যান

tab

সাময়িকী

ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-২

লোরকার দেশে

চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ

বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৫

(পূর্ব প্রকাশের পর)

আজকের ভোর সাথে নিয়ে এলো উজ্জ্বল সূর্য ও হিমেল হাওয়া। ভোরের ¯িœগ্ধ সজীবতা আর ‘আলহাম্বরা’ দেখার উম্মুখতা মিলে আমাদের মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে আছে।

মূলত ‘আলহাম্বরা’দেখার জন্যই ভ্রমণকারীরা গ্রানাদা আসেন। কারণ এটি পশ্চিমা জগতে ইসলামী স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।

আমার স্মৃতিতে জমা আছে ‘আলহাম্বরা’-র এক মায়াবী ছবি। প্রায় ৪৫ বছর আগে পড়েছিলাম ওয়াশিংটন আরভিং-এর ঞধষবং ড়ভ ঃযব অষযধসনৎধআলহাম্বরা-র এক জীবন্ত বর্ণনা, সাথে বহু লোককাহিনী। তখন থেকেই স্বপ্ন ছিল এ সুন্দর সৃষ্টি দেখব, আজ সে স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে।

ট্রাভেল অফিসে টিকিট দেখিয়ে আমাদের ট্যুর নিশ্চিত করলাম। মাসখানেক আগেই অনলাইনে টিকিট কিনেছিলাম। হলুদ পতাকা হাতে আমাদের গাইড সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বললো, পতাকাটি দিকচিহ্ন, তাকে অনুসরণ করতে সুবিধা হবে। গলায় ঝোলানোর জন্য দিল একটি করে হলুদ ব্যাজ, আর তার বর্ণনা শোনার জন্য দিল রিসিভার-সহ হেডফোন। এক এক করে নাম ধরে ডেকে সবাইর সাথে পরিচিত হলো রশিদ বকরিম- একজন স্পেনীয় আরব, সুন্দর চেহারা, চমৎকার ব্যবহার। বলল, আমাকে সবাই বকরিম বলে ডাকবে। ইতিহাসের ছোটখাট একটি পাঠ দিয়ে বকরিম শুরু করল তার যাত্রা।

গ্রানাদার ভাঙাগড়ার ইতিহাসের এক বড় সাক্ষী হয়ে আছে আলহাম্বরা। শুরু করা যাক গড়ার ইতিহাস দিয়ে, যার শুরু ১২৩৮ সালে, যখন আলহাম্বরা-র নির্মাণ কাজ শুরু করেন নাসিরীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ ইবনে আল আমর। তাঁর রাজত্বকাল ছাড়িয়ে ১৩৫৮ সাল পর্যন্ত চলে এর কাজ।

১৪৯২ সালে ক্যাথলিকরা গ্রানাদা জয় করেন। এর পরে যেন শুরু হলো আলহাম্বরা-র দুর্দিন। ১৫২৭ সালে পঞ্চম চার্লস আলহাম্বরা এলাকায় শুরু করেন তাঁর প্রাসাদ নির্মাণ। এতে পাশের নাসরীয় প্রাসাদের কিছু অংশের ক্ষতি সাধিত হয়। ১৮১২ সালে আইবেরিয়ান উপদ্বীপ যুদ্ধে ফরাসি সৈন্যরা আলহাম্বরা-র কিছু টাওয়ার ধ্বংস করে। এরপর আসে ১৮২১ সালের ভূমিকম্প, যাতে এটি আরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

‘আলহাম্বরা’ অনেকদিন অযতেœ, অবহেলায় পড়ে ছিল। ১৮৩২ সালে আমেরিকার লেখক ওয়াশিংটন আরভিং-এর ঞধষবং ড়ভ ঃযব অষযধসনৎধ বইটি প্রকাশিত হবার পর সবদিকে আলহাম্বরা নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায়- একই সাথে এর সৌন্দর্য ও দুর্দশা সবার চোখে পড়ে। শুরু হয় পুনরুদ্ধার ও সংস্কার কাজ- স্থপতি হোসে কনথ্রেরাস ছিলেন তার তত্ত্বাবধানে।

১৯৮৪ সালে ইউনেস্কো আলহাম্বরাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করে।

একনাগাড়ে এতক্ষণ বলে বকরিম একটু দম ফেলে বলল, আলহাম্বরা-র কাহিনী আরো অনেক বড়, বাকিটা দেখাতে দেখাতে বলবো। হাঁটতে হাঁটতে সে আবার শুরু করল তার বর্ণনা।

আলহাম্বরা-য় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে প্রকৃতির সাথে স্থাপত্যের সুষমাকে- যেখানে আলো ও বাতাস খেলা করে প্রাসাদের অলিন্দে ও খিলানে, আর ছড়িয়ে পড়ে সাথের উদ্যান ও ঝর্নাধারায়, ফাঁকে ফাঁকে দৃশ্যমান আলো-ছায়া- সব মিলে সৃষ্টি করা হয়েছে এক নান্দনিক দৃশ্যের। প্রাসাদের জানালা দিয়ে দেখা যায় একদিকে গ্রানাদা, বিশেষ করে আলবাইসিন, অন্যদিকে পর্বতমালা সিয়ারা নেভাদা ও এর উপত্যকা, ঢালু সবুজ তৃণভূমি।

আলহাম্বরা-র প্রধান তিনটি এলাকা-নাসিরীয় প্রাসাদ, হেনেরআলিফে ও আল কাছাবা। নাসরিদ প্রাসাদ ছিল গ্রানাদার মুসলিম শাসকদের বাসস্থান ও রাজসভা, হেনেরআলিফে তাদের গ্রীষ্মকালীন আবাস, যেটি মূলত বাগান, আর আল কাছাবা একটি দুর্গ।

এক শহরের মাঝে আরেক শহর- আলহাম্বরা- ১৭৩০ মিটার বা প্রায় ১ মাইল দীর্ঘ দেয়াল দিয়ে ঘেরা, সাথে রয়েছে ৩০টি টাওয়ার ও ৪টি সদর দরজা। সবচেয়ে সুদৃশ্য সদর দরজা পুয়েরতা দে লা জাসটিসিয়া দিয়ে আমরা আলহাম্বরা-য় প্রবেশ করি। এ দরজার প্রধান বৈশিষ্ট্য পাথরের উপর ছায়াচিত্রের সূক্ষ্ম কাজ। এর প্রধান খিলানে রয়েছে একটি হাতের সুন্দর নকশা, ভেতরের খিলানে রয়েছে একটি চাবির নকশা। পুয়েরতা দে লা জাসটিসিয়াকে আল হাম্বরা-র প্রতীক হিসেবে ধরা হয়।

একটু হেঁটে আমরা পৌঁছি মেকসুয়ার প্রাসাদে, যা নাসিরীয় প্রাসাদসমূহের অন্যতম একটি প্রাসাদ। ঢুকতেই মেচুকার চত্বর- একটি তোরণ-শোভিত বারান্দা ও সুন্দর বাগান, সাথে গোলাকার দুটি ফোয়ারা। এরপর এক হল-ঘর, নাম মেকসুয়ার হল- বিভিন্ন সময়ে চলে এর বহু পরিবর্তন। এর ভেতরের ছাদে রয়েছে কাঠের সূক্ষ্ম ও রঙিন নকশার কাজ। সম্ভবত এখানে ছিল রাজকীয় বিচারালয়, কারণ এর দরজার উপর একটি টাইলে লেখা: ‘প্রবেশ করো এবং চেয়ে দেখ। ন্যায় বিচার পেতে ভীত হয়ো না, কারণ এখানে তুমি তা পাবে’। মেকসুয়ার হল এর এক প্রান্ত থেকে দেখা যায় আলবাইসিন, হলের সে কোনায় রয়েছে এক নামাজ-ঘর, সাথে কেবলামুখী মিহরাব। এর পাশেই রয়েছে খিলান-সমৃদ্ধ আরেকটি চত্বর- মেকসুয়ার চত্বর- যার উত্তর দিকে রয়েছে একটি বারান্দা-সংযুক্ত কক্ষ, যা গোল্ডেন চেম্বার নামে পরিচিত। এর পাশের মূল প্রাসাদে সুলতানের সাথে সাক্ষাতের আগে অভ্যাগতরা এ কক্ষে অপেক্ষা করতেন।

এরপর পৌঁছি দক্ষিণ পাশের একটি সুন্দর তোরণ, ফ্যাসাদা দে কোমারেজ-এ, যা কোমারিজ প্রাসাদের প্রধান প্রবেশদ্বার। আরবি ক্যালিগ্রাফি ও অন্যন্য সূক্ষ্ম নকশায় প্রবেশদ্বারটি শোভিত। এর জানালাগুলির উপরে আরবিতে লেখা আছে: ‘ওয়ালা গালিবা ইল্লাল্লাহ’, অর্থ, ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনো বিজয়ী নাই’। এই বাণী লিখিত আছে আলহাম্বরা-র আরো বহু স্থানে, সব মিলিয়ে হাজার বারেরও অধিক। বাণীটি নাসিরীয় শাসকদের নীতিবাক্য হিসেবে বিভিন্ন স্থানে উদ্ধৃত। আলহাম্বরা-র বিভিন্ন স্থানে খোদাই করা আছে পবিত্র কোরআনের বহু আয়াত। তাছাড়া আছে প্রাচীন বিভিন্ন কবিতার পংক্তি, এর মধ্যে আছে মুরিশ চার কবি ইবনে জামরাক, ইবনে ইয়াইয়াব, ইবনে আল খাতিব ও ইবনে ফারকুন লিখিত কবিতা।

ফ্যাসাদা দে কোমারেজ উন্মুক্ত হয়েছে জলাশয় ও বাগান সমৃদ্ধ এক বিশাল আঙিনায়, যার নাম মার্টেল চত্বর। চিরসবুজ মার্টেল গাছগুলি সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে জলাশয়ের দু’পাশে, তাই এ নাম। এ চত্বর থেকে দেখা যায় কোমারিজ টাওয়ার। জলাশয়ের চারপাশে রয়েছে হাঁটার সুদৃশ্য পথ। এ জলাশয়ের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে দেখলাম এর উপর পড়া কোমারিজ টাওয়ারসহ পুরো প্রাসাদের প্রতিবিম্ব। মনে হয় কোমারিজ টাওয়ার পানির উপর ভাসছে। কী অনন্য দৃশ্য! বকরিম বলল, মিরর ইমেজ-এর ছবি তুলবে? সবাই একসাথে রাজি হয়ে গেল। একে একে সবাই ছবি তুলতে লাগল। আমরা চারজন জলাশয়ের এক প্রান্তে দাঁিড়য়ে অপেক্ষা করলাম। বকরিম অপর প্রান্ত থেকে আমাদের ছবি তুলল। আমাদের চারজনের দাঁড়ানো ছবি, আর জলাশয়ের পানিতে পড়া আমাদের প্রতিবিম্ব, তার উপর কোমারিজ টাওয়ারের প্রতিবিম্ব। পানিতে উপরের স্থাপনার প্রতিবিম্বে নকশার প্রয়োগ করা হয়েছে আগ্রার তাজমহলে- প্রায় তিনশ বছর পরে (১৬৩০-৪৭) সময়ে।

মার্টেল চত্বর পার হয়ে সামনে পড়ল দি হল অফ দি বোট (সালা ডি লা বারাকা)। লম্বা এ ঘরটির দু’দিকে রয়েছে দু’টি করে ছায়াকুঞ্জ, আর উপরে আছে বিভিন্ন নকশা খোদাই করা কাঠের সিলিং, যা আকৃতিতে মনে হবে এক উল্টোনো-নৌকা। এ কক্ষে রয়েছে জাফরির কাজের অনিন্দ্য সুন্দর জানালা।

আলহাম্বরা-র দালানগুলো বাইরে সাদাসিধে, কিন্তু ভেতরে বেশ জমকালো। কোমারিজ প্রাসাদও এর ব্যতিক্রম নয়। গ্রানাদায় অনেক দূর থেকে দেখা যায় ৪৫ মিটার উঁচু কোমারিজ টাওয়ার- যা আলহাম্বরা-র সর্বোচ্চ টাওয়ার, এর ভেতরেই কোমারিজ প্রাসাদ। হল অব অ্যাম্বাসেডরস এ প্রাসাদের অংশ। এখানে ঢুকেই নাতাশা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল- ওয়াও, ইটজ আলহাম্বরা-স মোস্ট বিউটিফুল প্লেস। বকরিম সাথে সাথেই বলল, ইউ আর অ্যাবসলিউটলি রাইট! ইটস আলহাম্বরা-স মোস্ট বিউটিফুল রুম।

হল অব অ্যাম্বাসেডরস সত্যিই খুব নান্দনিক এক কক্ষ। এটি ছিল বিদেশী দূত ও অন্যান্য অতিথির সাথে সুলতানদের সাক্ষাতের স্থান। এর আরেক নাম সিংহাসন কক্ষ। কারণ সুলতান সিংহাসনে বসে বিপরীত দিক থেকে আসা অভ্যাগতদের সাক্ষাৎ দান করতেন। দরজা, জানালা, মেঝে, দেয়াল, ছাদ- কক্ষটির সবই শোভিত অনুপম শিল্পকর্মে- জ্যামিতিক নকশা, আরবি ক্যালিগ্রাফি ও রঙিন টাইলস-এ। ওপরের সিলিং-এ বসানো ৮০১৭টি কাঠের টুকরা দিয়ে তৈরি গম্বুজ, সূক্ষ্ম কারুকাজ করা প্রতিটি কাঠের টুকরা বিচিত্র বিন্যাসে একত্রে সাজানো। ব্যালকনির পাশে বসানো রঙিন কাঁচ- যা ভেদ করে বর্ণিল আলো প্রাসাদে প্রবেশ করে একে করে তোলে স্বপ্নীল।

হল অব অ্যাম্বাসেডরস-এর ভেতরেই, ১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাস তাঁর শেষ আর্জি পেশ করেন রাজা ফার্দিনান্ড, রানী ইসাবেলা ও সালামানকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের কাছে, যাতে তাঁর দূর প্রাচ্যের সমুদ্র যাত্রার প্রয়োজনীয় অর্থ ও জনবল দেয়া হয়। রাণী ইসাবেলা ছাড়া সবাই এর বিরোধিতা করেন। রাণী বলে উঠলেন:‘সি, সিনর’, অর্থাৎ ‘হ্যাঁ, মহাশয়’! ৩ আগস্ট, ১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাস তিনটি জাহাজ নিয়ে তাঁর পরিকল্পিত সমুদ্রযাত্রা শুরু করেন। এর পরের ইতিহাস সবার জানা।

স্বপ্নীল এক পরিবেশে, মুগ্ধতার এক ঘোরে অনেকক্ষণ কেটে গেল। সম্বিৎ ফিরে পেলাম যখন বকরিম বলল, আমাদের দেখার আরো অনেক কিছু বাকি আছে, আলহাম্বরা-র অর্ধেকও দেখা হয়নি। তাই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

আলহাম্বরা-র অর্ধেক শেষ হবে কি, নাসিরীয় প্রাসাদই দেখা শেষ হয়নি। এরপর আছে আলকাছাবা ও হেনেরআলিফে। মনে হলো বকরিম দেখার গতি একটু বাড়িয়ে দিল।

এতক্ষণ নাবিল ও নাতাশা কোনো কিছু বলেনি, দেখছিল সবকিছু, আর শুনছিল বকরিমের ভাষ্য। এবার নাবিল বলল, আলহাম্বরা-র প্লান মনে হয় বেশ জটিল। বকরিম বলল, ঠিকই বলেছ। এটি এক সাথে একটি মহাপরিকল্পনায় তৈরি হয়নি, তাই সুবিন্যস্ত নয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শাসক তাঁদের ইচ্ছে বা প্রয়োজন মতো আলহাম্বরা-র পরিবর্তন পরিবর্ধন করেছেন।

আলহাম্বরা ঘুরে দেখার সময় অনেকে হাতে রাখেন এর প্ল্যান ও বিবরণী সম্বলিত ভিজিটরস গাইড বুক, যা অনেক কিছু বুঝতে সহায়তা করে। গাইড বুক নিয়ে ঘুরতে যাওয়া আমারও অনেক পুরনো অভ্যেস। এবার গাইড বুক কিনতে গেলে নাতাশা বলে উঠল, তা লাগবে না। আমরা নিজেরাই পারব ভালো দেখতে ও বুঝতে। আমি বললাম, ঠিক আছে। আমাদের সব দেখা শেষ হয়ে গেলে গাইড বুক কিনতে পারি, যাতে এসব মনে থাকে। নাবিল ও নাতাশা দু’জনেই বলল, সব মনে রাখার কি দরকার আছে?

এরপর আমরা গেলাম কোর্ট অব লায়ন চত্বরে, যেখানে পাথরে খোদাই করা বারোটি সিংহের ভাস্কর্য পানিপ্রবাহের সাথে সংযুক্ত, আর সবার কেন্দ্রে রয়েছে গোলাকার মার্বেল বেসিনের উপর এক ঝর্না। চত্বরকে ঘিরে রেখেছে ১২৪টি সরু কলাম। ছবি তোলার জন্য এ চত্বরটি জনপ্রিয়, সবদিকে পর্যটক, আমরাও ছবি তোলার জন্য লাইনে দাঁড়ালাম। চত্বরে সিংহের সাথে, ঝর্নার সাথে ছবি তুললাম- বসে, দাঁড়িয়ে, দলবদ্ধভাবে, এবং একাকী। আগের মতোই বকরিম সাহায্য করল।

এ চত্বরের চারপাশে রয়েছে অনেকগুলি প্রাসাদ ও হল। দক্ষিণে রয়েছে সালা দে লস আবেনসেরাহেস- সুলতানদের বৈঠকখানা। এ কক্ষের সিলিং- মৌচাকের মতো খাঁজে তৈরি করা আট-পার্শি¦ক তারার অনুপম এক শিল্পকর্ম- অবাক হয়ে আমরা সবাই দেখলাম, আর ছবি তুললাম।

চত্বরের পূর্বদিকে রয়েছে বড় হলঘর, সালা দে লস রেয়াস, যা পাঁচভাগে বিভক্ত। এর তিনটি হলঘর পাশের চত্বরের পোর্টিকোর আলোয় আলোকিত। এ তিনটি হলঘরের মাঝে রয়েছে দুটি আলাদা কক্ষ যা পুরোপুরি ছায়ায় ঢাকা। যে কোন দিক থেকেই হল ঘরটি দেখলে মনে হবে আলো ছায়ার এক ক্রম-সজ্জা। বকরিম তার বর্ণনা শেষ করার সাথে সাথে নাবিল ও নাতাশা পরীক্ষা করতে গেল আলো ছায়ার ক্রম-সজ্জাটিকে- দেখে সত্যিই খুশি হলো।

এর পরের গন্তব্য সালা দে ডস এরমানাস। কোর্ট অব লায়ন চত্বরের উত্তর দিকে দু’টি সুদৃশ্য খিলান দিয়ে এর ভেতরে ঢুকলাম। এ হল ঘরের মেঝের কেন্দ্রে স্থাপিত দুটি সাদা মার্বেল স্ল্যাব, যা মিলেছে এক ঝর্নায়। এখানেও দেখলাম মৌচাকের মতো খাঁজে তৈরি করা নিখুঁত শিল্পকর্মের এক সিলিং। এ কক্ষের পুরো দেয়ালে স্টাকো আর্টে আঁকা মুরিশ কবি ইবন জামরাকের এক কবিতা, যার ক’টি অনূদিত লাইন: .....

নয়নের পুলকের তরে কত কি আয়োজন!

মহৎ আত্মা আমার মাঝে খুঁজে পাবে নব হৃদয়:

কবজের মতো কৃত্তিকা গুচ্ছ-নক্ষত্র তারে করে রক্ষা,

শান্ত সমীরণের যাদু তার পালক।

জ্যোতির্ময়, অনন্য এক প্রাসাদশৃঙ্গ,

দেখায় অনুপম শোভা,

দৃষ্টির সামনে ও আড়ালে।১

...

নাসিরীয় প্রাসাদসমূহ দেখা এখানেই শেষ- নাটকীয়ভাবে বলল বকরিম। অনেকে স্পষ্টতই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, আর মনে মনে হয়তো বলল- যাক বাঁচা গেল, ইতিহাসের প্রান্তরে আর কতো হাঁটা যায়! জীবনানন্দ তো হাজার বছর হেঁটেছিলেন কবিতার শরীরে, পৃথিবীর বুকে নয়।

অনেকে হতাশ হলো যখন বকরিম বলল, এখন যাব আলহাম্বরার সাথে ১৬শ শতাব্দীতে যোগ করা অংশে, যেখানে কিছুদিন ছিলেন ওয়াশিংটন আরভিং, তাঁর কাহিনী দিয়ে শুরু করি।

ওয়াশিংটন আরভিং মাদ্রিদ অবস্থান করে ক্রিস্টোফার কলম্বাস-র জীবনী লিখছিলেন। সেটি শেষ করে ১৮২৮ সালে তিনি গ্রানাদা বেড়াতে আসেন। গ্রানাদা দেখে তিনি মন্তব্য করেন: দধ সড়ংঃ ঢ়রপঃঁৎবংয়ঁব ধহফ নবধঁঃরভঁষ পরঃু, ংরঃঁধঃবফ রহ ড়হব ড়ভ ঃযব ষড়াবষরবংঃ ষধহফংপধঢ়বং ঃযধঃ ও যধাব বাবৎ ংববহ’। সেসময় ওয়াশিংটন আরভিং দেখতে আসেন আলহাম্বরা, যা তাকে গভীরভাবে অভিভূত করে। এর প্রতি প্রবল টানে পরের বছর তিনি গ্রানাদায় ফিরে আসেন। আলহাম্বরা-র গভর্নর ও গ্রানাদার আর্চবিশপকে ওয়াশিংটন আরভিং অনুরোধ করেন, যাতে তাঁকে এ প্রাসাদে থাকার ও এর আর্কাইভের দুর্লভ নথিপত্র দেখার অনুমতি দেয়া হয়। লেখক ও কূটনীতিক হিসেবে ওয়াশিংটন আরভিং ততদিনে বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন। তাই তাঁর অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হয়নি।

মাত্র ৩ মাস- ১৮২৯ সালের ৪ঠা মে থেকে ২৯ শে জুলাই-ওয়াশিংটন আরভিং আলহাম্বরা-য় অবস্থান করেন। প্রথমে তিনি নাসিরীয় প্রাসাদের উপরের তলার কক্ষগুলোতে থাকতেন। কিছুদিন পর চলে যান এম্পেরর’স চেম্বার-এ, পরে যার নাম দেয়া হয় ওয়াশিংটন আরভিং রুম। সে সময় ১৭ বছরের এক স্থানীয় বালক মাতিও হিমেনেস-র সহায়তায় তিনি আলহাম্বরা-র উপর বিভিন্ন ইতিহাস, গল্প ও মিথ সংগ্রহ করেন। এ কক্ষে বসে তিনি লিখেন তাঁর বিখ্যাত বই ঞধষবং ড়ভ ঃযব অষযধসনৎধ। তাই এর প্রবেশপথে ১৯১৪ সালে ওয়াশিংটন আরভিং-এর স্মরণে একটি প্লাক স্থাপন করা হয়, যেখানে স্প্যানীয় ভাষায় লেখা আছে : ‘ওয়াশিংটন আরভিং ১৮২৯ সালে তাঁর টেইলস অব আলহাম্বরা এই কক্ষগুলিতে লিখেছেন’। এ কাহিনী বলতে বলতে বকরিম এই কক্ষ ও প্লাকটির সামনে সবাইকে নিয়ে আসল। আমি এসবের ছবি তুলতে চাইলে নাতাশা নিষেধ করে বলল, প্লিজ লিভ ইন দ্য মোমেন্ট।

তবুও আমি ফিরে গেলাম বর্তমান থেকে অতীতে- এ দুটি সবসময় হাত ধরাধরি করে চলে, বিশেষ করে আলহাম্বরা-য়, তাদের আলাদা করা কঠিন। ফিরে গেলাম ৪৫ বছর আগে, যখন পড়ছিলাম ঞধষবং ড়ভ ঃযব অষযধসনৎধ, এখন সে আলহাম্বরা-র ভেতরেই আছি, আর সে কক্ষটির সামনে দাঁড়ানো যেখানে ওয়াশিংটন আরভিং এ বইটি লিখেছেন, আর বিখ্যাত করেছেন আলহাম্বরাকে, সাথে নিজেকেও। তাঁরই স্মরণে প্লাক। মনে মনে এ মহান লেখকের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। নাবিল নাতাশাকে কিছু বললাম না, বললে হয়তো বলবে, সবকিছুতেই তোমাদের সেন্টিমেন্ট।

ওয়াশিংটন আরভিং এর কক্ষ থেকে পাশে পঞ্চম কার্লোস প্রাসাদ-এ আমাদের নিয়ে গেল বকরিম। আসা-যাওয়ার পথে এটিকে বাইরে থেকে দেখেছি, মনে হয়েছে- উড়ে এসে জুড়ে বসা। বিশাল স্থাপত্য, তবে আলহাম্বরা-র সাথে বেমানান। এর এলাকার ভেতরে স্থাপিত হলেও ইতিহাস ও স্থাপত্যে এটি আলহাম্বরা-র বাইরের জগতের। এর নির্মাণ নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হয়েছে। বকরিম জানাল, হয়তো সে কারণেই ১৫২৭ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হলেও ১৬৩৭ সাল পর্যন্ত তা অসম্পূর্ণ ছিল। এরপর সে অবস্থায় রেখে দেয়া হয়। ১৯২৩ সালের পরে এর কাজ সম্পূর্ণ করা হয়। যাই হোক, আলহাম্বরা-র দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থাপনার মাঝে এটি স্থান করে নিয়েছে।

ক্যাথলিক আমলে তৈরি রেনেসাঁ স্টাইলের স্থাপত্য পঞ্চম কার্লোস প্রাসাদ। বর্গাকার দালানের মাঝে গোলাকার চত্বর- রেনেসাঁ স্টাইলের এ স্থাপত্য সে সময় জনপ্রিয় ছিল। পঞ্চম কার্লোস প্রাসাদেও এ নকশা অনুসরণ করা হয়। বিপরীতে, আলহাম্বরা-র স্থাপত্যে রয়েছে প্রাসাদের মাঝে মাঝে আয়তাকার চত্বর।

কার্লোস প্রাসাদের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য এর অ্যাকোস্টিকস চত্বরের কেন্দ্রে কোনো শব্দ করলে তা চারপাশে আরো জোরে শোনা যায়। বকরিম বলল, তোমরা পরীক্ষা করে দেখ। অনেকে, তার মধ্যে ছিল নাবিল ও নাতাশা- চত্বরের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে গান গাইল- সত্যিই, সব দিকে আরো বড় শব্দে শোনা গেল সে গান! ধ্বনি সম্বন্ধীয় এ বৈশিষ্ট্যের জন্যই হয়তো এখানে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক সঙ্গীত ও নাচ উৎসব।

পঞ্চম কার্লোস নিজে তো নয়ই, এ প্রাসাদে কোনো রাজা রাণী বাস করেননি। বর্তমানে এর প্রথম তলায় রয়েছে আলহাম্বরা মিউজিয়ম, আর উপরের তলায় রয়েছে গ্রানাদা ফাইন আর্টস মিউজিয়ম। বকরিম বলল, ট্যুর শেষ হওয়ার পরে তোমরা মিউজিয়ম-এ আসতে পার। আলাদা কোনো টিকিট লাগবে না। তবে এখন আমরা মিউজিয়ম-এ না ঢুকে শুধু প্রাসাদের চার পাশে দেখব।

এরপর আমরা গেলাম হার্দিনেছ দেল পার্তাল বা পার্তাল বাগানে। চারিদিকে বাগান, একপাশে রয়েছে এক বিশাল, মনোরম জলাশয়, সাথে ৫টি খিলান সমৃদ্ধ খোলা বারান্দা- টাওয়ার অফ দি লেডিস- দোতলাতে রয়েছে একটি বিশাল লুকআউট পয়েন্ট, যেখান থেকে দেখা যায় দারো নদীর উপত্যকা, আলবাইসিন ও হেনেরআলিফে বাগান। হাঁটতে হাঁটতে একটি বাগানের সামনে পৌঁছতেই বকরিম আমাদের বলল, এগুলি হলো ডালিম ফলের গাছ। মুররা তাদের সাথে ডালিম, কমলা ইত্যাদি নিয়ে আসে গ্রানাদা তথা স্পেনে। আর তাদের জয় করা নতুন এলাকার নাম দেয় ‘গ্রানাদা’, যার স্পেনীয় অর্থ ‘ডালিম’। ক্রমে ডালিম হয়ে উঠে গ্রানাদার প্রতীক। এখন শীতকাল, ফল পাকার সময় পার হয়ে গেছে, তবে আমাদের সামনের গাছগুলিতে এখনো কিছু পাকা ডািলম শোভা পাচ্ছে।

বকরিম মজা করে বলল, এতক্ষণ আমরা অতীতে ছিলাম, এবার অতীত থেকে আরো অতীতের দিকে যাব। এরপর সে আমাদের নিয়ে গেল আলহাম্বরা-র দক্ষিণ-পূর্বের সেকানো-তে, যা প্রায় বিলুপ্ত এক এলাকা। মুসলিম আমলে এটি ছিল ঘন বসতিপূর্ণ, মদিনাত আল হামরা, সংক্ষেপে মদিনা বা শহর। সে সময় রাজপরিষদের কর্মকর্তা ও তাদের কর্মচারীরা এখানে বাস করতেন। তাদের জন্য প্রাসাদ, বাসগৃহ, গণ ¯œানাগার, মসজিদ, কেনাকাটার বাজার ও বাগান ছিল। আরো ছিল বিভিন্ন পেশা ও ব্যবসায়ের স্থাপনা, যেমন, ট্যানারি, সিরামিক শপ, ওয়ার্কশপ ইত্যাদি। বেশিরভাগ ভবনের- তার মাঝে প্রাসাদও আছে- এখন শুধু ধ্বংসাবশেষ আছে, তবে মূল ভবনের কাঠামো দৃশ্যমান।

দু’ঘণ্টার উপর সময় পার হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে আলহাম্বরা দেখা শেষ হবে না, চলছে তো চলছেই। অনিন্দ্যসুন্দর এ স্থাপত্য দেখার আনন্দ সত্ত্বেও কারো মাঝে চলে এসেছে একঘেঁয়েমি, কারো মাঝে ক্লান্তি। শুরু হয়েছিল মনোরম এক প্রাসাদ দিয়ে, এখন এসে পড়লাম শহরের ধ্বংসাবশেষে। নাবিল নাতাশা তো বলেই বসল, এসব পুরনো ঘরবাড়ি দেখাটা একদম বোরিং, তার চেয়ে আমরা অন্য কিছু দেখি। আমি বললাম, নতুন পুরনো, সুন্দর অসুন্দর, সবই জীবনের অংশ, তাই সবই আমাদের দেখা উচিত।

জবভ:

১. ঞযব অষযধসনৎধ ওহংপৎরঢ়ঃরড়হ, ওনহ তধসধৎধশ, ঃৎধহংষধঃবফ নু ঈযৎরংঃড়ঢ়যবৎ গরফফষবঃড়হ ্ খবঃরপরধ এধৎপরধ-ঋধষপড়হ, ঞযব চধৎরং জবারব,ি রংংঁব ১১৮, ঝঢ়ৎরহম ১৯৯১

টীকা:

১) প্রথম ইউসুফ ও তাঁর পুত্র পঞ্চম মুহম্মদের ষাট বছরের শাসনামলে (১৩৩৩-১৩৯১) আলহাম্বরা-র ভেতরের কারুকাজ ও অলংকরণ সম্পূর্ণ করা হয়।

২) ক্যাথলিক রাজা রাণী, ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা, ১৪৯২ সালে গ্রানাদা জয় করেন। অবসান ঘটে ৭১১ সালে শুরু হওয়া ৭৮১ বছরের মুসলিম শাসনের, সেই সাথে অবসান ঘটে ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধের, ৭৮১ বছরের যুদ্ধ- রিকনকুইছতা- যা ছিল স্পেনকে আবার ক্যাথলিক শাসনে ফিরিয়ে আনার যুদ্ধ। ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা আলহাম্বরা-য় বাস করে এখান থেকে রাজকর্ম পরিচালনা করতে থাকেন।

৩) পঞ্চম চার্লস রেঁনেসাযুগীয় স্থাপত্য-শৈলীতে আলহাম্বরা এলাকায় তাঁর প্রাসাদ নির্মাণ শুরু করেন। এর স্থপতি ছিলেন মাইকেল এঞ্জেলোর ছাত্র পেদ্রো মেচুকা । ১৫২৭ সালে শুরু হলেও ১৬৩৭ সালে তা অসম্পূর্ণ অবস্থায় রেখে দেয়া হয়। ১৯২৩ সালের পরে এর কাজ সম্পূর্ণ করা হয়।

৪) আলহাম্বরা পুনরুদ্ধার ও সংস্কার কাজের তত্ত্বাবধানে ছিলেন স্থপতি হোসে কনথ্রেরাস। তাঁর মৃত্যুর পর ছেলে রাফায়েল ও পৌত্র মারিয়ানো এ কাজ চালিয়ে যান ।

৫) স্পেনের রাজা পঞ্চম কার্লোস-র নির্দেশে ১৫২৮ সালে আলহাম্বরা-র সালা দে ডস হারমানাস এর পাশে নির্মাণ করা হয় এম্পেররস চেম্বার, পরে তার নাম দেয়া হয় ওয়াশিংটন আরভিং রুম। তবে কার্লোস কোন সময় এখানে বাস করেননি। এর একটি কক্ষ সালাস দ্য লাস ফ্রুটাস, ওয়াশিংটন আরভিং এর অবস্থানে ধন্য হয়ে আছে।

back to top