মারিও ভার্গাস য়োসার গল্প
অনুবাদ: ফজল হাসান
কামড় খেয়ে আমি আমার বাম কান হারিয়েছি। আমার মনে হয় ঘটনাটি ঘটেছিল অন্য মানুষের সঙ্গে লড়াই করার সময়। তবে কানের যে পাতলা চিকন অংশটুকু রয়ে গেছে, তার মাধ্যমে আমি পৃথিবীর সব শব্দ শুনতে পারি। এমনকি আমি দেখতেও পারি, তবে খানিকটা অসুবিধা হয় এবং দৃশ্যমান জিনিসগুলো কিছুটা বিকৃত দেখায়। আমার মুখের বাম দিকে যে নীলচে স্ফীত অংশটি রয়েছে, তা হলো চোখ। কিন্তু আমি বুঝতে পারি যে, এক পলকের জন্য তাকিয়ে দেখলে চোখের মতো দেখায় না। সত্যি কথা হলো চোখটি তার আসল জায়গায়ই রয়েছে এবং তা আকৃতি ও রঙের জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে পরম বিস্ময়কর বস্তু। দাবানলের ধোঁয়া থাকা সত্ত্বেও অনন্ত অন্ধকার আমার অগ্রাহ্য করা উচিত ছিল- আমি মনে করতে পারছি না সেটি বোমা ছিল, নাকি আক্রমণ ছিল- বেঁচে থাকা লোকজন অন্ধ হয়েছে এবং তাদের মাথা ন্যাড়া হয়ে গিয়েছে। আমি ভাগ্যবান যে, শুধু একটি চোখ হারিয়েছি; ষোলবার অস্ত্রোপচারের পরে চক্ষু বিশেষজ্ঞরা আমার অন্য চোখ রক্ষা করেছেন। সেই চোখে কোনো পাতা নেই এবং ক্রমাগত পানি ঝরে পড়ে। তবে চোখটি আমার টেলিভিশন দেখা এবং, সবচেয়ে বড় কথা, শত্রুর চেহারা শনাক্ত করার জন্য যথেষ্ট।
আমি যে কাচের দেয়ালঘেরা চৌকোনা ঘরের মধ্যে আছি, তা আমার বাড়ি। আমি সেই দেয়াল দিয়ে বাইরের সব কিছু দেখতে পারি, কিন্তু বাইরে থেকে কেউ আমাকে দেখতে পারে না: বিষয়টি নিঃসন্দেহে সুবিধাজনক এবং নিরাপদ। বর্তমানে এমন ধরনের ভয়ঙ্কর অসংখ্য ফাঁদ পাতা যায়। আমার ঘরের দেয়ালগুলো বুলেট-অভেদ্য, জীবাণু-অভেদ্য, বিকিরণ-অভেদ্য এবং শব্দ-অভেদ্য। দেয়ালের গায়ে স্থায়ীভাবে আমার বগলের এবং কস্তুরীর ঘ্রাণ লেগে আছে, যা আমাকে- শুধু আমাকে, আমি জানি- দারুণ আনন্দ দেয়।
আমার ঘ্রাণশক্তি খুবই প্রখর। আমি আমার নাক দিয়েই সবচেয়ে বেশি আনন্দ এবং সবচেয়ে বেশি দুঃখকষ্ট অনুভব করি। আমি কি একে নাক বলব- বিশাল এবং পাতলা ঝিল্লির অঙ্গ, যা এত গন্ধ ধারণ করে, এমনকি সবচেয়ে সূক্ষ্ম ঘ্রাণও? আমি সাদা পাঁচড়ার সঙ্গে ধূসর স্ফীত অংশটি বোঝাতে চেয়েছি: যা আমার মুখের সমান্তরাল অংশ থেকে শুরু হয়েছে এবং আমার ঘাড় পর্যন্ত ঝুলে পড়েছে, যা ষাঁড়ের মতো চর্বিযুক্ত। এই স্ফীত নাকটি গলার বাড়তি অংশ কিংবা আদমের আপেলের কারণে নয়, বরং এটি অ্যাক্রোম্যাগালি১-র কারণে চর্বি জমে বড় হয়েছে। এটা আমার নাক। আমি জানি, নাকটি সুন্দরও নয়, প্রয়োজনীয়ও নয়। আমার নাকের অত্যধিক সংবেদনশীলতা এক ধরনের অবর্ণনীয় যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে যখন আশেপাশে কোনো ইঁদুর মরে গিয়ে পচে যায় অথবা যখন দুর্গন্ধযুক্ত জিনিসপত্র আমার বাড়ির মধ্য দিয়েপ্রবাহিত নালা দিয়ে বয়ে যায়। তারপরেও আমি আমার নাককে অত্যন্ত সমীহ করি। মাঝে মধ্যে মনে হয়, আমার নাক হলো আমার আত্মার আসন।
আমার কোনো হাত কিংবা পা নেই, শুধু চারটি খুঁটির মতো কাটা অংশ। সেগুলো সঠিকভাবে আরোগ্য লাভ করেছে এবং তারা শক্ত হয়েছে। তাই আমি মাটিতে ভর করে চলাফেরা করতে সক্ষম এবং বেশ সহজেই ঘুরে বেড়াতে পারি- এমনকি তাড়াতাড়ি চলতে পারি, যদি প্রয়োজন হয়। আমার শত্রুরা কখনোই আমাকে ধরতে পারেনি। কীভাবে আমি আমার হাত এবং পা হারিয়েছি, তা এখন মনে করতে পারছি না।
আমার যৌনাঙ্গ অক্ষত আছে। আমি সঙ্গম করতে পারি, যদি কোনো যুবক বা যুবতী আমার অংশীদার হিসেবে অভিনয় করে আমাকে আমার নিজের অবস্থান তৈরি করার সুযোগ করে দেয়, যাতে আমার ফুসকিগুলো ফেটে না যায়: যদি সেগুলো ফেটে যায়, পুঁজ বের হয়ে দুর্গন্ধ ছড়ায়, তাহলে আমি অসহ্য ব্যথা অনুভব করব। আমি ব্যভিচার পছন্দ করি এবং একটি নির্দিষ্ট অর্থে বলব যে, আমি একজন অত্যধিক ইন্দ্রিয়পরায়ণ পুরুষ। তবে এ বিষয়টি সবসময় কার্যকর হয় না এবং অকাল বীর্যপাতের অনেক অপমানজনক উদাহরণ আছে। তবে অন্য সময়ে আমার মধ্যে প্রলম্বিত এবং প্রচ- উত্তেজনার পুনরাবৃত্তি দেখা যায়, যা আমাকে অনুভব করতে সাহায্য করে যেন আমি অন্যতম প্রধান দেবদূত গ্যাব্রিয়েলের মতো বাতাসে চলমান এবং জ্বলজ্বলে। আমি আমার প্রেমিকাদের মধ্যে যে ঘৃণা জাগিয়ে তুলি, তা আকর্ষণে এবং এমনকী প্রলাপে পরিণত হয়। একবার তারা যখন সেই অবস্থার ধকল কাটিয়ে ওঠে- প্রায় সবসময় পানীয় কিংবা নিষিদ্ধ মাদক দ্রব্যের সাহায্যে- তাদের প্রাথমিক পর্যায়ের অনিচ্ছা কাটিয়ে ওঠার পর তারা বিছানায় আমার সঙ্গে নিজেদের পুনরায় জড়াতে রাজি হয়। রমণীরা আমাকে ভালোবাসতে আসে। আত্মার প্রত্যন্ত গভীরে বন্য প্রাণি সবসময় সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়, যেমন অনেক উপকথা ও পৌরাণিক কাহিনী এবং কোনো সুদর্শন যুবকের হৃদয়ে বিকৃত যৌন আকাক্সক্ষা খুঁজে না পাওয়ার বিরল ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। তাদের কেউই আমার ভালোবাসার পাত্র-পাত্রী হওয়ার জন্য কখনো আফসোস করে না। তারা শিখেছে যে, সব কিছুই হলো এবং হতে পারে যৌন উত্তেজনা; যখন সঙ্গমের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন অন্ত্র ও শরীরের নিম্নতম কার্যকলাপ আধ্যাত্মিক এবং আভিজাত্য হয়। জেরন্ড২-এর মতো- ঢেঁকুর তোলা, প্র¯্রাব করা, মলত্যাগ করা- সবকিছু নৃত্য করে এবং নিচের দিকে নেমে আসে। এদের প্রতি আমরা সকলেই প্রলুব্ধ হই, তবে খুব কমই আত্মসমর্পণ করি- পরে তাদের সঙ্গে এক ধরনের বিষণœ স্মৃতির মতো থেকে যায়।
আমার সবচেয়ে বড় অহংকার আমার মুখ। হতাশায় আর্তচিৎকার করার কারণে মুখটি প্রশস্ত নয়। আমার তীক্ষè ও শুভ্র দাঁত দেখানোর জন্য আমি মুখটি এমন করে রাখি। আমার দাঁতগুলো কী ঈর্ষণীয় নয়? মাত্র দুটি বা তিনটি দাঁত পড়ে গেছে। বাকি দাঁতগুলো শক্তিশালী, মাংসাশী এবং সেগুলো পাথর পিষতে পারে। কিন্তু সেসব দাঁত বাছুরের স্তনবৃন্ত ও নিতম্ব খেতে ভালোবাসে, মুরগি ও মোরগের বুকের ও উরুর মাংস অথবা ছোট পাখির হাড় চিবাতে পছন্দ করে। মাংস খাওয়া দেবতাদের বিশেষ অধিকার।
আমি চরম দুর্দশাগ্রস্ত নই এবং আমি কারোর করুণা চাই না। আমি যেমন আছি, তেমনই থাকব, এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। অন্যের আরও খারাপ অবস্থা জানতে পারা অবশ্যই বিশাল সান্ত¡না। এটা সম্ভব যে ঈশ্বর আছেন। কিন্তু ইতিহাসের এই পর্যায়ে, যা কিছু ঘটেছে, তার কী আদৌ কোনো গুরুত্ব আছে? হয়তো পৃথিবীটা আরও ভালো হতে পারত। সম্ভবত। কিন্তু প্রশ্ন করে লাভ কী? আমি বেঁচে গেছি এবং উল্টোদিকে তাকালে দেখা যায় যে, আমি মানব জাতির অংশ।
আমাকে কাছ থেকে দেখ, হে আমার ভালবাসা! আমাকে চিনো, নিজেকেও চিনে নাও।
পাদটীকা: (মূল গল্পে নেই, তবে পাঠকের সুবিধার্থে দেওয়া হলো)
১ অ্যাক্রোম্যাগালি : বিরল এবং গুরুতর অসুখ। যখন মানুষের শরীরে উচ্চ মাত্রায় গ্রোথ হরমোন থাকে, তখন এই রোগ দেখে যায়। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এই রোগের প্রবণতা বেশি এবং এতে কিছু হাড়, অঙ্গ এবং অন্যান্য টিস্যু বড় হয়।
২ জেরন্ড : ল্যাটিন ‘জেরন্ডিয়াম’ শব্দ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ কোনো কাজ ‘সম্পাদন করা’। জেরন্ড সাধারণ প্রত্যয় ‘রহম’ যোগ করে ক্রিয়াকে (াবৎন) বিশেষ্যতে (হড়ঁহ) রূপান্তরিত করে, যেমন ৎঁহহরহম (দৌঁড়ানো), ংরহমরহম (গান গাওয়া), ৎিরঃরহম (লেখা) ইত্যাদি।
গল্পসূত্র: ‘মুখ’ গল্পটিস্প্যানিশ ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ডায়ানা থোরল্ড, যা ব্রিটেনের বিখ্যাত গ্রান্টা ম্যাগাজিনে (সংখ্যা ২৮, ১ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯) প্রকাশিত হয়েছে।
লেখক পরিচিতি: সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী পেরুভীয় স্প্যানিশ লেখক মারিও ভার্গাস য়োসা (জন্ম: ২৮ মার্চ ১৯৩৬: মৃত্যু: ১৩ এপ্রিল ২০২৫) ছিলেন একাধারে একজন ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাহিত্য সমালোচক, সাংবাদিক ও সম্প্রচারক। তাঁর পুরো নাম হোর্হে মারিও পেদ্রো ভার্গাস য়োসা। তাঁর বহুল প্রশংসিত প্রথম উপন্যাস ‘দ্য টাইম অব দ্য হিরো ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর সর্বাধিক পরিচিত এবং পাঠক নন্দিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে দ্য গ্রিন হাউস (১৯৬৫), আন্ট জুলিয়া অ্যান্ড দ্য স্ক্রিপ্ট রাইটার (১৯৭৭), দ্য ওয়ার অব দ্য এন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড (১৯৮২) এবং দ্য ব্যাড গার্ল (২০০৬)। সমাজ পরিবর্তনের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা প্রথম দিকের উপন্যাস, প্রবন্ধ ও নাটকে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। তিনি ১৯৯০ সালে পেরুর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পরাজিত হন এবং ১৯৯৩ সালে স্পেনের নাগরিকত্ব লাভ করেন। তিনি স্প্যানিশ ভাষার মর্যাদাপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কার ‘সার্ভান্তেস প্রাইজ’ (১৯৯৪) এবং সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার (২০১০) লাভ করেন।
মারিও ভার্গাস য়োসার গল্প
অনুবাদ: ফজল হাসান
বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫
কামড় খেয়ে আমি আমার বাম কান হারিয়েছি। আমার মনে হয় ঘটনাটি ঘটেছিল অন্য মানুষের সঙ্গে লড়াই করার সময়। তবে কানের যে পাতলা চিকন অংশটুকু রয়ে গেছে, তার মাধ্যমে আমি পৃথিবীর সব শব্দ শুনতে পারি। এমনকি আমি দেখতেও পারি, তবে খানিকটা অসুবিধা হয় এবং দৃশ্যমান জিনিসগুলো কিছুটা বিকৃত দেখায়। আমার মুখের বাম দিকে যে নীলচে স্ফীত অংশটি রয়েছে, তা হলো চোখ। কিন্তু আমি বুঝতে পারি যে, এক পলকের জন্য তাকিয়ে দেখলে চোখের মতো দেখায় না। সত্যি কথা হলো চোখটি তার আসল জায়গায়ই রয়েছে এবং তা আকৃতি ও রঙের জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে পরম বিস্ময়কর বস্তু। দাবানলের ধোঁয়া থাকা সত্ত্বেও অনন্ত অন্ধকার আমার অগ্রাহ্য করা উচিত ছিল- আমি মনে করতে পারছি না সেটি বোমা ছিল, নাকি আক্রমণ ছিল- বেঁচে থাকা লোকজন অন্ধ হয়েছে এবং তাদের মাথা ন্যাড়া হয়ে গিয়েছে। আমি ভাগ্যবান যে, শুধু একটি চোখ হারিয়েছি; ষোলবার অস্ত্রোপচারের পরে চক্ষু বিশেষজ্ঞরা আমার অন্য চোখ রক্ষা করেছেন। সেই চোখে কোনো পাতা নেই এবং ক্রমাগত পানি ঝরে পড়ে। তবে চোখটি আমার টেলিভিশন দেখা এবং, সবচেয়ে বড় কথা, শত্রুর চেহারা শনাক্ত করার জন্য যথেষ্ট।
আমি যে কাচের দেয়ালঘেরা চৌকোনা ঘরের মধ্যে আছি, তা আমার বাড়ি। আমি সেই দেয়াল দিয়ে বাইরের সব কিছু দেখতে পারি, কিন্তু বাইরে থেকে কেউ আমাকে দেখতে পারে না: বিষয়টি নিঃসন্দেহে সুবিধাজনক এবং নিরাপদ। বর্তমানে এমন ধরনের ভয়ঙ্কর অসংখ্য ফাঁদ পাতা যায়। আমার ঘরের দেয়ালগুলো বুলেট-অভেদ্য, জীবাণু-অভেদ্য, বিকিরণ-অভেদ্য এবং শব্দ-অভেদ্য। দেয়ালের গায়ে স্থায়ীভাবে আমার বগলের এবং কস্তুরীর ঘ্রাণ লেগে আছে, যা আমাকে- শুধু আমাকে, আমি জানি- দারুণ আনন্দ দেয়।
আমার ঘ্রাণশক্তি খুবই প্রখর। আমি আমার নাক দিয়েই সবচেয়ে বেশি আনন্দ এবং সবচেয়ে বেশি দুঃখকষ্ট অনুভব করি। আমি কি একে নাক বলব- বিশাল এবং পাতলা ঝিল্লির অঙ্গ, যা এত গন্ধ ধারণ করে, এমনকি সবচেয়ে সূক্ষ্ম ঘ্রাণও? আমি সাদা পাঁচড়ার সঙ্গে ধূসর স্ফীত অংশটি বোঝাতে চেয়েছি: যা আমার মুখের সমান্তরাল অংশ থেকে শুরু হয়েছে এবং আমার ঘাড় পর্যন্ত ঝুলে পড়েছে, যা ষাঁড়ের মতো চর্বিযুক্ত। এই স্ফীত নাকটি গলার বাড়তি অংশ কিংবা আদমের আপেলের কারণে নয়, বরং এটি অ্যাক্রোম্যাগালি১-র কারণে চর্বি জমে বড় হয়েছে। এটা আমার নাক। আমি জানি, নাকটি সুন্দরও নয়, প্রয়োজনীয়ও নয়। আমার নাকের অত্যধিক সংবেদনশীলতা এক ধরনের অবর্ণনীয় যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে যখন আশেপাশে কোনো ইঁদুর মরে গিয়ে পচে যায় অথবা যখন দুর্গন্ধযুক্ত জিনিসপত্র আমার বাড়ির মধ্য দিয়েপ্রবাহিত নালা দিয়ে বয়ে যায়। তারপরেও আমি আমার নাককে অত্যন্ত সমীহ করি। মাঝে মধ্যে মনে হয়, আমার নাক হলো আমার আত্মার আসন।
আমার কোনো হাত কিংবা পা নেই, শুধু চারটি খুঁটির মতো কাটা অংশ। সেগুলো সঠিকভাবে আরোগ্য লাভ করেছে এবং তারা শক্ত হয়েছে। তাই আমি মাটিতে ভর করে চলাফেরা করতে সক্ষম এবং বেশ সহজেই ঘুরে বেড়াতে পারি- এমনকি তাড়াতাড়ি চলতে পারি, যদি প্রয়োজন হয়। আমার শত্রুরা কখনোই আমাকে ধরতে পারেনি। কীভাবে আমি আমার হাত এবং পা হারিয়েছি, তা এখন মনে করতে পারছি না।
আমার যৌনাঙ্গ অক্ষত আছে। আমি সঙ্গম করতে পারি, যদি কোনো যুবক বা যুবতী আমার অংশীদার হিসেবে অভিনয় করে আমাকে আমার নিজের অবস্থান তৈরি করার সুযোগ করে দেয়, যাতে আমার ফুসকিগুলো ফেটে না যায়: যদি সেগুলো ফেটে যায়, পুঁজ বের হয়ে দুর্গন্ধ ছড়ায়, তাহলে আমি অসহ্য ব্যথা অনুভব করব। আমি ব্যভিচার পছন্দ করি এবং একটি নির্দিষ্ট অর্থে বলব যে, আমি একজন অত্যধিক ইন্দ্রিয়পরায়ণ পুরুষ। তবে এ বিষয়টি সবসময় কার্যকর হয় না এবং অকাল বীর্যপাতের অনেক অপমানজনক উদাহরণ আছে। তবে অন্য সময়ে আমার মধ্যে প্রলম্বিত এবং প্রচ- উত্তেজনার পুনরাবৃত্তি দেখা যায়, যা আমাকে অনুভব করতে সাহায্য করে যেন আমি অন্যতম প্রধান দেবদূত গ্যাব্রিয়েলের মতো বাতাসে চলমান এবং জ্বলজ্বলে। আমি আমার প্রেমিকাদের মধ্যে যে ঘৃণা জাগিয়ে তুলি, তা আকর্ষণে এবং এমনকী প্রলাপে পরিণত হয়। একবার তারা যখন সেই অবস্থার ধকল কাটিয়ে ওঠে- প্রায় সবসময় পানীয় কিংবা নিষিদ্ধ মাদক দ্রব্যের সাহায্যে- তাদের প্রাথমিক পর্যায়ের অনিচ্ছা কাটিয়ে ওঠার পর তারা বিছানায় আমার সঙ্গে নিজেদের পুনরায় জড়াতে রাজি হয়। রমণীরা আমাকে ভালোবাসতে আসে। আত্মার প্রত্যন্ত গভীরে বন্য প্রাণি সবসময় সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়, যেমন অনেক উপকথা ও পৌরাণিক কাহিনী এবং কোনো সুদর্শন যুবকের হৃদয়ে বিকৃত যৌন আকাক্সক্ষা খুঁজে না পাওয়ার বিরল ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। তাদের কেউই আমার ভালোবাসার পাত্র-পাত্রী হওয়ার জন্য কখনো আফসোস করে না। তারা শিখেছে যে, সব কিছুই হলো এবং হতে পারে যৌন উত্তেজনা; যখন সঙ্গমের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন অন্ত্র ও শরীরের নিম্নতম কার্যকলাপ আধ্যাত্মিক এবং আভিজাত্য হয়। জেরন্ড২-এর মতো- ঢেঁকুর তোলা, প্র¯্রাব করা, মলত্যাগ করা- সবকিছু নৃত্য করে এবং নিচের দিকে নেমে আসে। এদের প্রতি আমরা সকলেই প্রলুব্ধ হই, তবে খুব কমই আত্মসমর্পণ করি- পরে তাদের সঙ্গে এক ধরনের বিষণœ স্মৃতির মতো থেকে যায়।
আমার সবচেয়ে বড় অহংকার আমার মুখ। হতাশায় আর্তচিৎকার করার কারণে মুখটি প্রশস্ত নয়। আমার তীক্ষè ও শুভ্র দাঁত দেখানোর জন্য আমি মুখটি এমন করে রাখি। আমার দাঁতগুলো কী ঈর্ষণীয় নয়? মাত্র দুটি বা তিনটি দাঁত পড়ে গেছে। বাকি দাঁতগুলো শক্তিশালী, মাংসাশী এবং সেগুলো পাথর পিষতে পারে। কিন্তু সেসব দাঁত বাছুরের স্তনবৃন্ত ও নিতম্ব খেতে ভালোবাসে, মুরগি ও মোরগের বুকের ও উরুর মাংস অথবা ছোট পাখির হাড় চিবাতে পছন্দ করে। মাংস খাওয়া দেবতাদের বিশেষ অধিকার।
আমি চরম দুর্দশাগ্রস্ত নই এবং আমি কারোর করুণা চাই না। আমি যেমন আছি, তেমনই থাকব, এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। অন্যের আরও খারাপ অবস্থা জানতে পারা অবশ্যই বিশাল সান্ত¡না। এটা সম্ভব যে ঈশ্বর আছেন। কিন্তু ইতিহাসের এই পর্যায়ে, যা কিছু ঘটেছে, তার কী আদৌ কোনো গুরুত্ব আছে? হয়তো পৃথিবীটা আরও ভালো হতে পারত। সম্ভবত। কিন্তু প্রশ্ন করে লাভ কী? আমি বেঁচে গেছি এবং উল্টোদিকে তাকালে দেখা যায় যে, আমি মানব জাতির অংশ।
আমাকে কাছ থেকে দেখ, হে আমার ভালবাসা! আমাকে চিনো, নিজেকেও চিনে নাও।
পাদটীকা: (মূল গল্পে নেই, তবে পাঠকের সুবিধার্থে দেওয়া হলো)
১ অ্যাক্রোম্যাগালি : বিরল এবং গুরুতর অসুখ। যখন মানুষের শরীরে উচ্চ মাত্রায় গ্রোথ হরমোন থাকে, তখন এই রোগ দেখে যায়। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এই রোগের প্রবণতা বেশি এবং এতে কিছু হাড়, অঙ্গ এবং অন্যান্য টিস্যু বড় হয়।
২ জেরন্ড : ল্যাটিন ‘জেরন্ডিয়াম’ শব্দ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ কোনো কাজ ‘সম্পাদন করা’। জেরন্ড সাধারণ প্রত্যয় ‘রহম’ যোগ করে ক্রিয়াকে (াবৎন) বিশেষ্যতে (হড়ঁহ) রূপান্তরিত করে, যেমন ৎঁহহরহম (দৌঁড়ানো), ংরহমরহম (গান গাওয়া), ৎিরঃরহম (লেখা) ইত্যাদি।
গল্পসূত্র: ‘মুখ’ গল্পটিস্প্যানিশ ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ডায়ানা থোরল্ড, যা ব্রিটেনের বিখ্যাত গ্রান্টা ম্যাগাজিনে (সংখ্যা ২৮, ১ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯) প্রকাশিত হয়েছে।
লেখক পরিচিতি: সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী পেরুভীয় স্প্যানিশ লেখক মারিও ভার্গাস য়োসা (জন্ম: ২৮ মার্চ ১৯৩৬: মৃত্যু: ১৩ এপ্রিল ২০২৫) ছিলেন একাধারে একজন ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাহিত্য সমালোচক, সাংবাদিক ও সম্প্রচারক। তাঁর পুরো নাম হোর্হে মারিও পেদ্রো ভার্গাস য়োসা। তাঁর বহুল প্রশংসিত প্রথম উপন্যাস ‘দ্য টাইম অব দ্য হিরো ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর সর্বাধিক পরিচিত এবং পাঠক নন্দিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে দ্য গ্রিন হাউস (১৯৬৫), আন্ট জুলিয়া অ্যান্ড দ্য স্ক্রিপ্ট রাইটার (১৯৭৭), দ্য ওয়ার অব দ্য এন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড (১৯৮২) এবং দ্য ব্যাড গার্ল (২০০৬)। সমাজ পরিবর্তনের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা প্রথম দিকের উপন্যাস, প্রবন্ধ ও নাটকে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। তিনি ১৯৯০ সালে পেরুর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পরাজিত হন এবং ১৯৯৩ সালে স্পেনের নাগরিকত্ব লাভ করেন। তিনি স্প্যানিশ ভাষার মর্যাদাপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কার ‘সার্ভান্তেস প্রাইজ’ (১৯৯৪) এবং সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার (২০১০) লাভ করেন।