alt

সাময়িকী

ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-৪

লোরকার দেশে

চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ

: বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫

(পূর্ব প্রকাশের পর)

আলহাম্বরা থেকে হোটেলে ফেরার পথেই লোরকার সুরকার বন্ধু মানুয়েল দে ফাইয়ার স্মৃতি যাদুঘর। ভাবলাম বাড়িটিতে একটু ঘুরে আসি, কারণ এতে জড়িয়ে আছে বন্ধুর সাথে লোরকারও স্মৃতি।

গ্রানাদার অতি পুরাতন এলাকা রিয়ালহো। এখানে পাশাপাশি রয়েছে মধ্যযুগীয়, গথিক ও রেনেসাঁ স্থাপত্যরীতির ভবন। মুসলিম আমলে এটি ছিল গ্রানাদার সর্বপ্রধান ইহুদি এলাকা, পনের শতাব্দী ধরে ছিল তাদের বসবাস। এক পর্যায়ে এখানে বাস করত বিশ হাজারের অধিক ইহুদি। ১৪৯২ সালে ক্যাথলিকরা গ্রানাদা দখলের পর তাদের বহিষ্কার করা হয়।

রিয়ালহো এলাকায় পৌঁছে সহজেই খুঁজে পাই মানুয়েল দে ফাইয়ার স্মৃতি যাদুঘর- একটি দোতলা বাড়ি, যেখানে তিনি বাস করেছেন দীর্ঘ ১৮ বছর। তার আগে ছিলেন প্যারিসে। ততদিনে মানুয়েল দে ফাইয়ার বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন, ঘুরে বেড়াচ্ছেন সারা ইউরোপ। সেখান থেকে স্থায়ীভাবে গ্রানাদায় চলে এসে এই বাসায় ওঠেন ১৯২১ সালে। স্পেনের গৃহযুদ্ধের শেষ বছর, ১৯৩৯ সালে তিনি আবার প্যারিস চলে যান।

ম্যানুয়েল দে ফাইয়ার এবং ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা- এ দুজনের গভীর বন্ধুত্বের সাক্ষী হয়ে আছে বাড়িটির প্রতিটি কক্ষ। লোরকা প্রায়ই এ বাসায় আসতেন, খেতেন, পিয়ানো বাজাতেন- ফাঁকে ফাইয়ার ও অন্যদের নিয়ে গ্রানাদার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্য কাজ করতেন।

একটি কক্ষে দেখলাম ফাইয়ারকে দেয়া লোরকার একটি উপহার- তারের তৈরি এক বাদ্যযন্ত্র, যার নাম জিথার। লোরকা-র ব্যবহৃত একটি চেয়ার চিহ্নিত হয়ে আছে তাঁর নামে। ফাইয়ার পিয়ানো রুমে তাঁর পিয়ানো, অন্য একটি কক্ষে রয়েছে সুন্দর একটি গ্রামোফোন। ফ্যাশান দুরস্ত বিভিন্ন হ্যাট পড়তেন মানুয়েল দে ফাইয়ার, একটি কক্ষে তার কিছু শোভা পাচ্ছে। এ বাসার দ্বিতীয় তলায় ম্যানুয়েল দে ফাইয়ার আর্কাইভ, যেখানে তাঁর লাইব্রেরি, ও সাথে অন্যান্য দলিলপত্র রাখা আছে।

মানুয়েল দে ফাইয়ার স্মৃতি যাদুঘরে ঘুরতে ঘুরতে এক তরুণের সাথে পরিচয় হলো। হোসুয়া মেহিয়া, গ্রানাডা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছে মেক্সিকো সিটি থেকে, আন্ত-বিশ্ববিদ্যালয় কর্মসূচির মাধ্যমে পুরাতত্ত্বের উপর মাস্টার্স করছে। সে খুবই মিশুক ও প্রাণবন্ত। ইংরেজি ও স্পেনীয় ভাষা মিলিয়ে কথা বলে, আর আমাদের মতো তাড়াহুড়ো করে বলে। স্পেনের অন্যান্য শহরের বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিয়ে গ্রানাদারটি বেছে নেয়ার কারণ সে বলল: এখানকার দুটি বিশেষ আকর্ষণ- আলহাম্বরা ও লোরকা। বললাম, এ দুটি আমারও খুব প্রিয়, এই মাত্র আলহাম্বরা দেখে আসলাম, এখন লোরকার স্মৃতি খুঁজছি গ্রানাদার পথে প্রান্তরে। তখন হোসুয়া খুব খুশী হয়ে বলল, স্পেনীয় ভাষাভাষি মানুষের বাইরের কেউ লোরকা নিয়ে উৎসাহী হবে, তা আমার চিন্তার বাইরে ছিল। বললাম, আমাদের দেশে- বাংলাদেশে- লোরকা-র অসংখ্য ভক্ত আছে, লোরকার কবিতা আমাদের বাংলা ভাষায় অনূদিত, আর বহুলভাবে পঠিত। মেহিয়া ভীষণ বিস্মিত হয়ে গেল। বলল, তাইতো বলা হয়, শিল্পীদের নির্দিষ্ট কোনো দেশ নেই, একক কোনো ভাষা নেই- তারা সব দেশের, সব ভাষার।

মানুয়েল দে ফাইয়ার স্মৃতি যাদুঘর দেখা শেষ হলে হোসুয়া বলল, এর পরে তোমাদের আর কোন প্রোগাম আছে? আমি বললাম, বিশেষ কিছু নাই। হোসুয়া বলল, তাহলে চল, কাছেই লোরকার স্মৃতি জড়ানো কিছু জায়গা আছে। একসাথে দেখা যাবে। হেঁটে যেতে বেশি সময় লাগবে না।

কয়েক মিনিট হেঁটে আমরা পেয়ে গেলাম আলহাম্বরা প্যালেস হোটেল। নামের সাথে যখন আলহাম্বরা যুক্ত আছে, হোটেলটি রাজকীয় তো হবেই, তার উপর আছে লোরকার স্মৃতি। খোঁজ নিয়ে সবাই চলে গেলাম ভেতরে, বিখ্যাত থিয়াথ্রিতো হলে। হলটি লোরকার অনুষ্ঠানের পর থেকে অপরিবর্তিত রাখা আছে। সেদিনের মতো এখনো এর আসন সংখ্যা ১২০। ২৪তম জন্মবার্ষিকীর দুই দিন পর, ৭ জুন, ১৯২২, এই হলে লোরকা আবৃত্তি করেন তাঁর কাব্য পয়েমা দেল কান্তে হনদো। লোরকা এই প্রথম কোন অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করলেন। এই অনুষ্ঠান ছিল এক সপ্তাহ পরের আলহাম্বরা-র চত্বরে অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক ফ্লেমেনকো সঙ্গীত প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি ও প্রচারণা বিশেষ। এর পর থেকেই লোরকা তাঁর কবিতা বন্ধুমহলে আবৃত্তি করে শোনাতে শুরু করলেন। তাই তাঁর অনেক কবিতা গ্রন্থাকারে প্রকাশের আগেই জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়।

লোরকার পয়েমা দেল কান্তে হনদো কাব্য থেকে এক কবিতার অংশ:

কান্নার রামধনু

একটি পাহাড় থেকে

আর-এক পাহাড়ের দিকে চলে যায়।

জলপাই বীথি থেকে

কালো এক রামধনু

নীল রাত্রির বুকে আকাশে হারায়।৫

আলহাম্বরা প্যালেস হোটেল থেকে বের হয়ে আবার হোসুয়াকে অনুসরণ করতে লাগলাম। ১৫ মিনিট হেঁটে আমরা পৌঁছলাম এক ব্যস্ত এলাকায়, ৫২ কায়ে মেসোনাস-এ, এখানেই বিখ্যাত হয়ে আছে এক প্রিন্টিং প্রেস-ভেনথুরা থ্রাভেসেথ পাউলিনো। এই প্রেসটি ১৯১৮ সালে ছাপিয়েছিল লোরকার ১ম বই ইমপ্রেসিওনেস ই পায়সাহেস (অনুভূতি ও ভূদৃশ্য)। এটি একটি ভ্রমণ কাহিনী, কবিতার বই নয়, কারণ লোরকা তখনো কবিতা লেখা শুরু করেননি। তাঁর বয়স তখন মাত্র ১৯ বছর। তার আগে লোরকা ১৯১৪ সালে গ্রানাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর প্রস্তুতিমূলক বছর শুরু করেন। সেটি উত্তীর্ণ হবার পর সেখানে ভর্তি হন ১৯১৬ সালে।। ছাত্রদের জন্য গ্রানাদা বিশ্ববিদ্যালয় কয়েকটি ভ্রমণের আয়োজন করে, তার মধ্যে ১৯১৬ সালে দুটি, ১৯১৭ সালে দুটি- মোট চারটি ভ্রমণে অংশ নিয়ে লোরকা স্পেনের বিভিন্ন স্থান সফর করেন। লোরকা তখন ছবি আঁকতেন, পিয়ানো বাজাতেন। তাই তাঁর লেখা এই ভ্রমণ কাহিনীতে গদ্যের সাথে মিশে আছে ছবির রঙ, গানের সুর। লোরকার প্রথম বইটি প্রকাশে আর্থিক সহায়তা করেছেন তাঁর পিতা ফেদেরিকো গার্সিয়া রদরিগাজ। তিনি ছিলেন অবস্থাúন্ন ব্যক্তি, তারপরও লোরকার বইয়ে অর্থ ব্যয়ের আগে বইটির পা-ুলিপি তিনি কয়েকজনকে দেখিয়ে যাচাই করে নিয়েছিলেন, সেটি চলবে কিনা।

প্রিন্টিং প্রেস দেখা শেষ হলে হোসুয়া আবার জিজ্ঞেস করল, তোমরা কি পরিশ্রান্ত? তোমাদের কি তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে? আমি বললাম, কোনো অসুবিধে নেই, তোমার সাথে আরো ঘুরতে পারব। নাবিল নাতাশা বলল, আমরা একটু ড্রিংক্স ও ¯œ্যাক খেয়ে আবার বেড়াব। হোসুয়া বলল, গুড আইডিয়া। পাশেই প্লাজা দে থ্রিনিদাদ, সেখানে একটু বিশ্রাম নিয়ে আমি তোমাদের এমন এক জায়গায় নিয়ে যাব, যা লোরকাকে নিয়ে তৈরি সবচেয়ে সুন্দর প্রকল্প।

প্লাজা দে থ্রিনিদাদ গ্রানাদার আরেকটি বড় প্লাজা, অর্থাৎ নগর চত্বর। শহরের কেন্দ্রে অবস্থান, তার পরও এটিশান্ত ও নির্মল এক পার্ক। বড় বড় পপলার ও ওক গাছ এর সবদিক ঢেকে দিয়েছে সবুজের আবরণে। তার নিচে ঝরাপাতার মাঝে অনেকগুলি বেঞ্চ পাতা, তার একটিতে আমরা বসে পড়লাম। গ্রানাদার পার্ক ও প্লাজায় প্রায়ই দেখি শত বছরের পুরনো ফোয়ারা। এখানেও দেখি তাই। পার্কের কেন্দ্রে বসানো সুদৃশ্য এক ফোয়ারার জলধারা ¯িœগ্ধ পরিবেশকে ¯িœগ্ধতর করে তুলেছে। সারাদিনের শ্রান্তি কাটতে বেশি সময় লাগল না। সবার ঘুম ঘুম ভাব এসে গেল। হোসুয়া বলল, এখন একটি সিয়েস্তা নিতে পারলে ভাল লাগতো। আমি বলে উঠলাম, সিয়েস্তা কি? সে একটু অবাক হয়ে বলল, তোমরা এটি খেয়াল করোনি? বললাম, এখানে আজ আমাদের মাত্র তৃতীয় দিন- এখনো স্পেনের সাথে হানিমুন চলছে। হোসুয়া বলল, এখানে সবাই দেরিতে লাঞ্চ খায়, ২টা থেকে ৩টায়, এর পর ঘুমাতে যায়। দুপরের এই ঘুমকে বলে সিয়েস্তা। এর জন্য অনেক দোকানপাট, অফিস দুপুর ২টা-৪টা বন্ধ থাকে। এরপর ৪টায় সব আবার চালু হয়। দেরি করে বাড়ি ফিরে তারা ডিনার করে ৯টা-১০টার দিকে। এ নিয়মটি আমাদের মেক্সিকোতেও খুব জনপ্রিয়। সেখানে ৩টার পর পুরো শহর ঘুমিয়ে পড়ে, আবার ৫টায় জেগে উঠে। শুধু মেক্সিকো নয়, এটি পুরো ল্যাটিন আমেরিকায় জনপ্রিয়। স্পেনীয়রা ল্যাটিন আমেরিকা দখল ও দীর্ঘদিন শাসন করে। তারা কি এ অভ্যেসটি নিজ দেশ থেকে কলোনীতে নিয়ে গেল, না সেখান থেকে নিয়ে আসল, তা এক গবেষণার বিষয় হতে পারে। আমি খুব মজা করে বললাম, শুধু স্পেনীয়ভাষীরা যে সিয়েস্তা পছন্দ করে তা নয়, আমাদের বাংলা ভাষীদের কাছেও এটি সমান জনপ্রিয়। আমরা একে বলি দিবানিদ্রা। শোন, আমার জীবনের এক মজার অভিজ্ঞতা।

বছর ত্রিশেক আগে আমি কাজ করতাম চা বাগানে। দুপুর ১টায় কাজ থেকে কাছেই বাংলোতে লাঞ্চের জন্য যেতাম। লাঞ্চ সেরে ২টা পর্যন্ত ঘুমাতাম। এরপর বারান্দায় বসে আয়েস করে চা পান করে ৩টায় আবার কাজে যেতাম। থাকতাম ৬টা পর্যন্ত। তবে বাংলাদেশের শহরে এটি খুব একটা চালু নয়। আর আমেরিকাতে দিবানিদ্রা দিলে চাকরিতে সমস্যা হতে পারে।

হোসুয়া বলল, পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার, বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মাঝে অনেক মিলও আছে।

আমি বললাম, ঠিকই বলেছ। আমার অনেক হিস্পানিক বন্ধু আছে। তাদের দেখেছি আবেগপ্রবণ, আড্ডাবাজ ও পরিবার-কেন্দ্রিক। স্পেনীয়রা মনে হয় বাকি ইউরোপীয়দের চেয়ে বেশি আবেগপ্রবণ। আমাদের বাঙালিরাও অনেকটা তাই।

হোসুয়া বলল, আমি অনেকদিন স্পেনে আছি, ইউরোপের অনেক দেশেও গিয়েছি। ইউরোপ থেকে স্পেন মনে হয় আলাদা- পিরেনিস পর্বতমালা একে ভৌগোলিক দিকে থেকে শুধু নয়, মানসিক দিক থেকেও আলাদা করে দিয়েছে। আবার স্পেনের উত্তর থেকে স্পেনের দক্ষিণ অর্থাৎ, আন্দালুসিয়া, অনেকটা ভিন্ন। আটশ’ বছরের মুসলিম শাসন ও অন্যান্য সভ্যতা ভিন্নভাবে গঠন করে আন্দালুসিয়াকে। তবে মোটের উপর স্পেন এক মেল্টিং পট- প্রাচ্য ও প্রতীচ্য, ইউরোপ ও আফ্রিকার।

আমাদের এ ইতিহাস ও ভূগোল আলাপে নাবিল ও নাতাশা খুব একটা খুশি হলোনা। তারা তো সব সময় বলে, তোমরা ঘুরতে থাক অতীতে, চিন্তিত থাক ভবিষ্যৎ নিয়ে, তবে ভুলে থাক বর্তমানকে। পরিবেশ একটু পরিবর্তনের আশায় আমি বললাম, চলো, তোমরা কি খাবে বলো! বর্তমানে ফিরে আসার এক রকম প্রচেষ্টা।

হোসুয়া বলল, স্পেনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ¯œ্যাক কী, তা তোমরা জান? তাপাস, বলেই আমি হাসতে লাগলাম। হোসুয়া-র বিস্ময়ের ভাব দেখে বলতে লাগলাম, সবদিকে দেখি তাপাস-এর ছবি, তাপাস বার-এর বিজ্ঞাপন। সে বলল, ঠিকই বলেছ। তুমি খেয়েছ? আমি না বলতেই সে বলল, তোমরা আজ এটি ট্রাই করে দেখ। স্পেনে এটি একটি জনপ্রিয় ¯œ্যাক, খাওয়া হয় বিয়ার বা ওয়াইন সহকারে, বেশিরভাগ সময় বিকেলের আড্ডায়। এখানে অনেক রেঁস্তোরা দেখবে, তাপাস বার, যেখানে শত রকমের তাপাস তৈরী হয়। কোনটি শুধু সবজির, কোনোটির সাথে মাছ, বা মাংস, আবার সাথে বিভিন্ন রকমের মসলা। আর স্পেনের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার বলা যায় পাইয়া। চালের সাথে জাফরান, সবজি, মাংস, সাথে অনেকসময় সি-ফুড। আমি বলে উঠলাম, তার কাছাকাছি আমাদেরও একটি প্রিয় খাবার আছে, আমরা বলি বিরিয়ানী। পাইয়া আরেকদিন খেয়ে দেখব। আজ তাপাস দিয়ে স্পেনীয় খাওয়া শুরু করি। দেখি কতটুকু আমরা হজম করতে পারি।

সবাই মিলে কাছের এক তাপাস বারে গেলাম। কত রকমের তাপাস- অর্ডার দেয়াই এক সমস্যা! মেনু দেখতে দেখতে, বিশ্লেষণ করতে করতে মনে হয় রাত পার হয়ে যাবে। আমাদের অবস্থা দেখে হোসুয়া এগিয়ে আসল। তার সাহায্যে শেষ পর্যস্ত অর্ডার দিতে পারলাম। আমি অর্ডার দিলাম সবচেয়ে সাধারণ, সবচেয়ে সস্তা তাপাস- প্যাতাসাস ব্রাভাস, যা হলো মসলাদার ভাজা আলু। ফারজানা কোন ঝুঁকি না নিয়ে আমাকে অনুসরণ করল। নাতাশা অর্ডার করল এম্পানাডা গ্যালেগা, যা মূলত একটি বড় পাই- টুনা মাছ, ডিম ও কাটা জলপাই দিয়ে ভরা। নাবিল সবসময় নতুন খাওয়া পরীক্ষা করে দেখতে চায়। গ্যাম্বাস আল আজিলো, নামটিই তার খুব পছন্দ, তাই সে এটি অর্ডার দিল। এটি তেমন কিছু নয়, রসুন দিয়ে ভাজা চিংড়ি। আমরা সবাই অর্ডার দিলাম অরেঞ্জ জুস, পাশে রাখা তাজা কমলা থেকে তৈরি। হোসুয়া নিল চোরিজো, যা হলো স্প্যানিশ সসেজ। সাথে মাও ব্রান্ডের বিয়ার। সে বলল, মাও হচ্ছে খাঁটি স্পেনীয় বিয়ার, যা ১৮৯০ সাল থেকে তৈরি হচ্ছে।

জীবনে প্রথমবার তাপাস খাওয়া- আমাদের সবার বেশ ভাল লাগল। তবে আমি বাঙালির সিঙ্গাড়া, চটপটি, ভাত-ডাল-ভর্তা-শাক-মাছ বেশি পছন্দ করি। এগুলো পেলে অন্য কিছু খেতে চাই না। নাবিল বলে, বাবা, তুমি কমফর্ট জোনের বাইরে যেতে চাও না। তোমাকে এ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমি বললাম, আমার অনেক লেইট হয়ে গেছে। বরং তোমরা দু’জন ট্রাই করো।

ঘোরাঘুরি, খাওয়া-দাওয়া আর আলাপ-সালাপে আমরা সম্ভবত ভুলে গেছি আমাদের আসল গন্তব্য। হোসুয়াকে স্মরণ করিয়ে দিলাম যে, লোরকার সবচেয়ে সুন্দর প্রকল্পে নিয়ে যাবার কথা ছিল তার। সে বলল, আমার মনে আছে। ধীরেসুস্থে যাচ্ছি, কারণ এটি খুলবে পাঁচটায়। দুইটায় বন্ধ হয়ে পাঁচটায় খুলে থাকবে আটটা পর্যন্ত।

লোরকার প্রকল্পে যাবার পথেই পড়ল আরেক গোল চত্বর-প্লাজা দ্য রোমানিয়া- এ যেন প্রকৃতি ও স্থাপত্যের সমারোহ। চারপাশে পাম গাছের সারি, তার মাঝে উঁচু হয়ে আছে গ্রানাদা ক্যাথেড্রালের বেল টাওয়ার। বসে, দাঁড়িয়ে, হেঁটে আড্ডা দিচ্ছে তরুণ, যুবক, প্রৌঢ়- সবাই। প্লাজার কেন্দ্রে ব্রোঞ্জের এক অনুপম ভাস্কর্য- এক আগুয়াদর, তার পাশে পানির ব্যাগ বহন করছে তার গাধা। আগুয়াদর- পুরুষ বা নারী- অতীতে গাধার পিঠে চড়িয়ে চামড়ার বাকেটে করে সুপেয় পানি নিয়ে আসত- গ্রাম থেকে শহরে বিক্রির জন্য। বহু বছর আগে এদের বিবরণ পড়েছিলাম ওয়াশিংটন আরভিং এর দঞধষবং ড়ভ ঃযব অষযধসনৎধ’, বইতে, এখন এদের প্রতিমূর্তি দেখে মনে পড়ে গেল।

প্লাজার চারপাশে স্যুভেনির শপ। প্রায়ই সবটিতেই মরক্কো থেকে আনা জিনিসপত্র- সুদৃশ্য কারুকাজের বাতি, উটের চমড়ার ব্যাগ, তলোয়ার, শাল, ফুলদানি, সিরামিকে আলহাম্বরা-র বিভিন্ন নকশা, আরো কত কি বিক্রি হচ্ছে। মরক্কো ও স্পেন এখনো পরস্পরের সাথে জড়িয়ে আছে।

গ্রানাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ক্যাম্পাস বেশি দূরে নয়, তাই অনেক ছাত্র-ছাত্রী এ প্লাজায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। গ্রানাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭টি ক্যাম্পাস মিলে ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা প্রায় ৬০,০০০। ৫টি ক্যাম্পাসের অবস্থান শহরে। এমনিতেই গ্রানাদা সজীব শহর, তার মাঝে তরুণ প্রাণের ব্যাপক উপস্থিতি এখন একে করে তুলেছে আরো প্রাণবন্ত।

গল্প করতে করতে হোসুয়া যেখানে আমাদের নিয়ে আসল, তা দেখে একই সাথে আনন্দিত ও বিস্মিত হলাম। আনন্দিত হবার কারণ, এ বিশাল ভবনের মাথায় বড় করে লেখা সেন্ট্রো দ্য ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা। এই তাহলে সুবিখ্যাত লোরকা সেন্টার। বিস্মিত হবার কারণ, এ এলাকার ঐতিহাসিক অবয়বের সাথে এই অত্যাধুনিক ভবন বেশ বেমানান। অবশ্য লোরকা-র সম্মানে আধুনিক স্থাপত্যের এক বড় নিদর্শন এ সুরম্য ভবন নির্মাণ করা হযেছে। ৪৭০০ বর্গমিটারের এ ভবনে রয়েছে একটি থিয়েটার, একটি বড় পাঠাগার, ও কয়েকটি প্রদর্শনী কক্ষ। আর আছে সমৃদ্ধ এক আর্কাইভ, যেখানে সংরক্ষিত আছে লোরকা ফাউন্ডেশানের দান করা লোরকার অমূল্য সৃষ্টিসম্পদ- তাঁর ৫০০০টি পা-ুলিপি, চিঠিপত্র, পেইন্টিং, স্কেচ, ছবি ইত্যাদি। এখানে লোরকার উপর গবেষণা ও আলোচনা হয়, আর সারা বছরই চলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সেমিনার, প্রদর্শনী। আমাদের সৌভাগ্য যে, এ সময় চলছে এক বিশেষ প্রদর্শনী-দখড়ৎপধ ধহফ ঃযব ধৎপযরাব. গবসড়ৎু রহ সড়ঃরড়হ’, প্রদর্শনী শুরু হয়েছে মাত্র দুই সপ্তাহ আগে, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪, চলবে ১১ মে, ২০২৫ পর্যন্ত। এটি মূলত এখানে সংরক্ষিত লোরকার সম্পূর্ণ আর্কাইভের প্রদর্শনী।

মনে হতো লোরকা শুধু কবিতাই লিখেছেন। এ প্রদর্শনীতে দেখলাম তাঁর বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর। পেইন্টিং ও স্কেচ আঁকা, পুতুল নাচের পুতুল তৈরি, নাটক লিখা ও পরিচালনা, গিটার ও পিয়ানো বাজানো, ফ্লেমেনকো সঙ্গীত প্রতিযোগিতার আয়োজন, আর কবিতাতো আছেই- মাত্র ৩৮ বছরের জীবনে এতসব কাজের সমারোহ। লোরকার এসব সৃষ্টি দেখতে দেখতে ভাবছিলাম একজন মানুষ কীভাবে এত ছোট জীবনে এত বড় কাজ করতে পারে!

আরো কত কিছু দেখার আছে জানার আছে লোরকাকে নিয়ে! তবুও আজকের মতো শেষ করতে হলো, কারণ লোরকা সেন্টার এখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখানে আবার আসার চিন্তা মাথায় নিয়ে ধীরে ধীরে বের হলাম।

হোসুয়াকে অনেক ধন্যবাদ দিলাম লোরকা সেন্টারে নিয়ে এসে লোরকার সাথে আরো পরিচিত করানোর জন্য। সে বলল, যোগাযোগ রাখবে, লোরকার আরো তথ্য দেবো। সানন্দে রাজি হয়ে হোসুয়া-র কাছ থেকে সেদিনের মতো বিদায় নিলাম।

হোটেল ২০ মিনিটের হাঁটার পথ, আমরা এ পথটুকু হেঁটে যেতেই সচরাচর পছন্দ করি। সারাদিনে অনেক কিছু দেখা, অনেক পথ হাঁটায় সবাই ক্লান্ত। তাই উবার ডেকে তাড়াতাড়ি হোটেলে পৌঁছে লবির পাশের রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লাম। এখানে রেস্টুরেন্ট অনেক রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। সবাই হালকা কিছু খেয়ে রুমে ঢুকে বিছানায় যেতে আর দেরি করলাম না। ক্লান্ত শরীর-মনে ঘুম আসল অচিরেই।

সকালে উঠে নাস্তা করতে করতে আলাপ চলল আজ কোথায় যাওয়া যায়। নাতাশা বলল ক্যাথলিকদের প্রধান চার্চ গ্রানাদা ক্যাথেড্রাল দেখতে যাবে। নাবিল দেখতে চায় আরবদের পুরনো বাজার আলকাইছেরিয়া। ইতিহাসের প্রতি তাদের আগ্রহ দেখে একটু অবাক হলাম। একটু ভেবে বললাম, ভালোই! ক্যাথলিক ও মুসলিম- গ্রানাদার ইতিহাসের এ দুটি বড় স্তম্ভকে তোমরা বেছে নিয়েছ। ইতিহাসে সব কিছুই পাশাপাশি থাকা উচিত, দেখা উচিত- কোন কিছু মুছে ফেলা ভুল।

দুটিই হোটেল থেকে বিশ পঁচিশ মিনিট পায়ে হাঁটার দূরত্বে, তাই হেঁটেই রওয়ানা দিলাম। (চলবে)

Ref:

৫. El Grito, ,কান্না, অনুবাদ: স্বপন ভট্টাচার্য

ছবি

নিউ নেদারল্যান্ডস: জার্র্সি এবং লেনাপি জনগোষ্ঠী

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বকুলীর সেইরাত

ছবি

আকাশের প্রান্ত

ছবি

মুখ

ছবি

বাংলাদেশের প্রথম নির্বাসিত কবি

ছবি

অগ্রজ দাউদ হায়দারের মহাপ্রয়াণ

ছবি

নারী যখন পাঠক নারী যখন লেখক

সাময়িকী কবিতা

মিত্র

ছবি

মৃত্যুর মৃদু উত্তাপ : পথের শেষ কোথায়

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বেলাল চৌধুরীর কবিতা

ছবি

পাঠের আগ্রহ থাকলে বইয়ের অভাব হয় না

ছবি

রবীন্দ্রগানে শঙ্খ ঘোষের মন

ছবি

ফার্স্ট টিউসডে’স : আমার প্রথম মঙ্গলবার সন্ধ্যার গন্তব্য

ছবি

আজ লাবণ্যর বিয়ে

ছবি

সংস্কৃতির পরম্পরা, অভিঘাত-অভিজ্ঞান ইতিহাস বিচার-বিশ্লেষণ

ছবি

তুষার গায়েন-এর কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ফিলিস্তিনের তিনটি কবিতা

ছবি

এক বিস্ময় প্রতিভা

ছবি

দিওয়ান-ই-মাখফি : জেব-উন-নিশা

ছবি

বৈচিত্র্যে ভরা ‘যদিও উত্তরমেঘ’

ছবি

রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের কথা

ছবি

মোহ কাঠের নৌকা : জীবন-সংগ্রামের এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি

ছবি

শাঁকচুন্নি

ছবি

মেঘনাদবধ, এক নতুন দৃশ্যভাষা

ছবি

নতুন কবিতার সন্ধানে

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

গণহত্যার বিরুদ্ধে কবিতা

ছবি

আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘ভাঙানৌকা’

ছবি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বায়োস্কোপ

ছবি

জরিনা আখতারের কবিতা আত্ম-আবিষ্কার ও মুক্তি

ছবি

শহীদ সাবেরের সাহিত্য চিন্তা ও জীবনের সমন্বয়

tab

সাময়িকী

ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-৪

লোরকার দেশে

চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ

বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫

(পূর্ব প্রকাশের পর)

আলহাম্বরা থেকে হোটেলে ফেরার পথেই লোরকার সুরকার বন্ধু মানুয়েল দে ফাইয়ার স্মৃতি যাদুঘর। ভাবলাম বাড়িটিতে একটু ঘুরে আসি, কারণ এতে জড়িয়ে আছে বন্ধুর সাথে লোরকারও স্মৃতি।

গ্রানাদার অতি পুরাতন এলাকা রিয়ালহো। এখানে পাশাপাশি রয়েছে মধ্যযুগীয়, গথিক ও রেনেসাঁ স্থাপত্যরীতির ভবন। মুসলিম আমলে এটি ছিল গ্রানাদার সর্বপ্রধান ইহুদি এলাকা, পনের শতাব্দী ধরে ছিল তাদের বসবাস। এক পর্যায়ে এখানে বাস করত বিশ হাজারের অধিক ইহুদি। ১৪৯২ সালে ক্যাথলিকরা গ্রানাদা দখলের পর তাদের বহিষ্কার করা হয়।

রিয়ালহো এলাকায় পৌঁছে সহজেই খুঁজে পাই মানুয়েল দে ফাইয়ার স্মৃতি যাদুঘর- একটি দোতলা বাড়ি, যেখানে তিনি বাস করেছেন দীর্ঘ ১৮ বছর। তার আগে ছিলেন প্যারিসে। ততদিনে মানুয়েল দে ফাইয়ার বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন, ঘুরে বেড়াচ্ছেন সারা ইউরোপ। সেখান থেকে স্থায়ীভাবে গ্রানাদায় চলে এসে এই বাসায় ওঠেন ১৯২১ সালে। স্পেনের গৃহযুদ্ধের শেষ বছর, ১৯৩৯ সালে তিনি আবার প্যারিস চলে যান।

ম্যানুয়েল দে ফাইয়ার এবং ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা- এ দুজনের গভীর বন্ধুত্বের সাক্ষী হয়ে আছে বাড়িটির প্রতিটি কক্ষ। লোরকা প্রায়ই এ বাসায় আসতেন, খেতেন, পিয়ানো বাজাতেন- ফাঁকে ফাইয়ার ও অন্যদের নিয়ে গ্রানাদার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্য কাজ করতেন।

একটি কক্ষে দেখলাম ফাইয়ারকে দেয়া লোরকার একটি উপহার- তারের তৈরি এক বাদ্যযন্ত্র, যার নাম জিথার। লোরকা-র ব্যবহৃত একটি চেয়ার চিহ্নিত হয়ে আছে তাঁর নামে। ফাইয়ার পিয়ানো রুমে তাঁর পিয়ানো, অন্য একটি কক্ষে রয়েছে সুন্দর একটি গ্রামোফোন। ফ্যাশান দুরস্ত বিভিন্ন হ্যাট পড়তেন মানুয়েল দে ফাইয়ার, একটি কক্ষে তার কিছু শোভা পাচ্ছে। এ বাসার দ্বিতীয় তলায় ম্যানুয়েল দে ফাইয়ার আর্কাইভ, যেখানে তাঁর লাইব্রেরি, ও সাথে অন্যান্য দলিলপত্র রাখা আছে।

মানুয়েল দে ফাইয়ার স্মৃতি যাদুঘরে ঘুরতে ঘুরতে এক তরুণের সাথে পরিচয় হলো। হোসুয়া মেহিয়া, গ্রানাডা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছে মেক্সিকো সিটি থেকে, আন্ত-বিশ্ববিদ্যালয় কর্মসূচির মাধ্যমে পুরাতত্ত্বের উপর মাস্টার্স করছে। সে খুবই মিশুক ও প্রাণবন্ত। ইংরেজি ও স্পেনীয় ভাষা মিলিয়ে কথা বলে, আর আমাদের মতো তাড়াহুড়ো করে বলে। স্পেনের অন্যান্য শহরের বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিয়ে গ্রানাদারটি বেছে নেয়ার কারণ সে বলল: এখানকার দুটি বিশেষ আকর্ষণ- আলহাম্বরা ও লোরকা। বললাম, এ দুটি আমারও খুব প্রিয়, এই মাত্র আলহাম্বরা দেখে আসলাম, এখন লোরকার স্মৃতি খুঁজছি গ্রানাদার পথে প্রান্তরে। তখন হোসুয়া খুব খুশী হয়ে বলল, স্পেনীয় ভাষাভাষি মানুষের বাইরের কেউ লোরকা নিয়ে উৎসাহী হবে, তা আমার চিন্তার বাইরে ছিল। বললাম, আমাদের দেশে- বাংলাদেশে- লোরকা-র অসংখ্য ভক্ত আছে, লোরকার কবিতা আমাদের বাংলা ভাষায় অনূদিত, আর বহুলভাবে পঠিত। মেহিয়া ভীষণ বিস্মিত হয়ে গেল। বলল, তাইতো বলা হয়, শিল্পীদের নির্দিষ্ট কোনো দেশ নেই, একক কোনো ভাষা নেই- তারা সব দেশের, সব ভাষার।

মানুয়েল দে ফাইয়ার স্মৃতি যাদুঘর দেখা শেষ হলে হোসুয়া বলল, এর পরে তোমাদের আর কোন প্রোগাম আছে? আমি বললাম, বিশেষ কিছু নাই। হোসুয়া বলল, তাহলে চল, কাছেই লোরকার স্মৃতি জড়ানো কিছু জায়গা আছে। একসাথে দেখা যাবে। হেঁটে যেতে বেশি সময় লাগবে না।

কয়েক মিনিট হেঁটে আমরা পেয়ে গেলাম আলহাম্বরা প্যালেস হোটেল। নামের সাথে যখন আলহাম্বরা যুক্ত আছে, হোটেলটি রাজকীয় তো হবেই, তার উপর আছে লোরকার স্মৃতি। খোঁজ নিয়ে সবাই চলে গেলাম ভেতরে, বিখ্যাত থিয়াথ্রিতো হলে। হলটি লোরকার অনুষ্ঠানের পর থেকে অপরিবর্তিত রাখা আছে। সেদিনের মতো এখনো এর আসন সংখ্যা ১২০। ২৪তম জন্মবার্ষিকীর দুই দিন পর, ৭ জুন, ১৯২২, এই হলে লোরকা আবৃত্তি করেন তাঁর কাব্য পয়েমা দেল কান্তে হনদো। লোরকা এই প্রথম কোন অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করলেন। এই অনুষ্ঠান ছিল এক সপ্তাহ পরের আলহাম্বরা-র চত্বরে অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক ফ্লেমেনকো সঙ্গীত প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি ও প্রচারণা বিশেষ। এর পর থেকেই লোরকা তাঁর কবিতা বন্ধুমহলে আবৃত্তি করে শোনাতে শুরু করলেন। তাই তাঁর অনেক কবিতা গ্রন্থাকারে প্রকাশের আগেই জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়।

লোরকার পয়েমা দেল কান্তে হনদো কাব্য থেকে এক কবিতার অংশ:

কান্নার রামধনু

একটি পাহাড় থেকে

আর-এক পাহাড়ের দিকে চলে যায়।

জলপাই বীথি থেকে

কালো এক রামধনু

নীল রাত্রির বুকে আকাশে হারায়।৫

আলহাম্বরা প্যালেস হোটেল থেকে বের হয়ে আবার হোসুয়াকে অনুসরণ করতে লাগলাম। ১৫ মিনিট হেঁটে আমরা পৌঁছলাম এক ব্যস্ত এলাকায়, ৫২ কায়ে মেসোনাস-এ, এখানেই বিখ্যাত হয়ে আছে এক প্রিন্টিং প্রেস-ভেনথুরা থ্রাভেসেথ পাউলিনো। এই প্রেসটি ১৯১৮ সালে ছাপিয়েছিল লোরকার ১ম বই ইমপ্রেসিওনেস ই পায়সাহেস (অনুভূতি ও ভূদৃশ্য)। এটি একটি ভ্রমণ কাহিনী, কবিতার বই নয়, কারণ লোরকা তখনো কবিতা লেখা শুরু করেননি। তাঁর বয়স তখন মাত্র ১৯ বছর। তার আগে লোরকা ১৯১৪ সালে গ্রানাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর প্রস্তুতিমূলক বছর শুরু করেন। সেটি উত্তীর্ণ হবার পর সেখানে ভর্তি হন ১৯১৬ সালে।। ছাত্রদের জন্য গ্রানাদা বিশ্ববিদ্যালয় কয়েকটি ভ্রমণের আয়োজন করে, তার মধ্যে ১৯১৬ সালে দুটি, ১৯১৭ সালে দুটি- মোট চারটি ভ্রমণে অংশ নিয়ে লোরকা স্পেনের বিভিন্ন স্থান সফর করেন। লোরকা তখন ছবি আঁকতেন, পিয়ানো বাজাতেন। তাই তাঁর লেখা এই ভ্রমণ কাহিনীতে গদ্যের সাথে মিশে আছে ছবির রঙ, গানের সুর। লোরকার প্রথম বইটি প্রকাশে আর্থিক সহায়তা করেছেন তাঁর পিতা ফেদেরিকো গার্সিয়া রদরিগাজ। তিনি ছিলেন অবস্থাúন্ন ব্যক্তি, তারপরও লোরকার বইয়ে অর্থ ব্যয়ের আগে বইটির পা-ুলিপি তিনি কয়েকজনকে দেখিয়ে যাচাই করে নিয়েছিলেন, সেটি চলবে কিনা।

প্রিন্টিং প্রেস দেখা শেষ হলে হোসুয়া আবার জিজ্ঞেস করল, তোমরা কি পরিশ্রান্ত? তোমাদের কি তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে? আমি বললাম, কোনো অসুবিধে নেই, তোমার সাথে আরো ঘুরতে পারব। নাবিল নাতাশা বলল, আমরা একটু ড্রিংক্স ও ¯œ্যাক খেয়ে আবার বেড়াব। হোসুয়া বলল, গুড আইডিয়া। পাশেই প্লাজা দে থ্রিনিদাদ, সেখানে একটু বিশ্রাম নিয়ে আমি তোমাদের এমন এক জায়গায় নিয়ে যাব, যা লোরকাকে নিয়ে তৈরি সবচেয়ে সুন্দর প্রকল্প।

প্লাজা দে থ্রিনিদাদ গ্রানাদার আরেকটি বড় প্লাজা, অর্থাৎ নগর চত্বর। শহরের কেন্দ্রে অবস্থান, তার পরও এটিশান্ত ও নির্মল এক পার্ক। বড় বড় পপলার ও ওক গাছ এর সবদিক ঢেকে দিয়েছে সবুজের আবরণে। তার নিচে ঝরাপাতার মাঝে অনেকগুলি বেঞ্চ পাতা, তার একটিতে আমরা বসে পড়লাম। গ্রানাদার পার্ক ও প্লাজায় প্রায়ই দেখি শত বছরের পুরনো ফোয়ারা। এখানেও দেখি তাই। পার্কের কেন্দ্রে বসানো সুদৃশ্য এক ফোয়ারার জলধারা ¯িœগ্ধ পরিবেশকে ¯িœগ্ধতর করে তুলেছে। সারাদিনের শ্রান্তি কাটতে বেশি সময় লাগল না। সবার ঘুম ঘুম ভাব এসে গেল। হোসুয়া বলল, এখন একটি সিয়েস্তা নিতে পারলে ভাল লাগতো। আমি বলে উঠলাম, সিয়েস্তা কি? সে একটু অবাক হয়ে বলল, তোমরা এটি খেয়াল করোনি? বললাম, এখানে আজ আমাদের মাত্র তৃতীয় দিন- এখনো স্পেনের সাথে হানিমুন চলছে। হোসুয়া বলল, এখানে সবাই দেরিতে লাঞ্চ খায়, ২টা থেকে ৩টায়, এর পর ঘুমাতে যায়। দুপরের এই ঘুমকে বলে সিয়েস্তা। এর জন্য অনেক দোকানপাট, অফিস দুপুর ২টা-৪টা বন্ধ থাকে। এরপর ৪টায় সব আবার চালু হয়। দেরি করে বাড়ি ফিরে তারা ডিনার করে ৯টা-১০টার দিকে। এ নিয়মটি আমাদের মেক্সিকোতেও খুব জনপ্রিয়। সেখানে ৩টার পর পুরো শহর ঘুমিয়ে পড়ে, আবার ৫টায় জেগে উঠে। শুধু মেক্সিকো নয়, এটি পুরো ল্যাটিন আমেরিকায় জনপ্রিয়। স্পেনীয়রা ল্যাটিন আমেরিকা দখল ও দীর্ঘদিন শাসন করে। তারা কি এ অভ্যেসটি নিজ দেশ থেকে কলোনীতে নিয়ে গেল, না সেখান থেকে নিয়ে আসল, তা এক গবেষণার বিষয় হতে পারে। আমি খুব মজা করে বললাম, শুধু স্পেনীয়ভাষীরা যে সিয়েস্তা পছন্দ করে তা নয়, আমাদের বাংলা ভাষীদের কাছেও এটি সমান জনপ্রিয়। আমরা একে বলি দিবানিদ্রা। শোন, আমার জীবনের এক মজার অভিজ্ঞতা।

বছর ত্রিশেক আগে আমি কাজ করতাম চা বাগানে। দুপুর ১টায় কাজ থেকে কাছেই বাংলোতে লাঞ্চের জন্য যেতাম। লাঞ্চ সেরে ২টা পর্যন্ত ঘুমাতাম। এরপর বারান্দায় বসে আয়েস করে চা পান করে ৩টায় আবার কাজে যেতাম। থাকতাম ৬টা পর্যন্ত। তবে বাংলাদেশের শহরে এটি খুব একটা চালু নয়। আর আমেরিকাতে দিবানিদ্রা দিলে চাকরিতে সমস্যা হতে পারে।

হোসুয়া বলল, পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার, বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মাঝে অনেক মিলও আছে।

আমি বললাম, ঠিকই বলেছ। আমার অনেক হিস্পানিক বন্ধু আছে। তাদের দেখেছি আবেগপ্রবণ, আড্ডাবাজ ও পরিবার-কেন্দ্রিক। স্পেনীয়রা মনে হয় বাকি ইউরোপীয়দের চেয়ে বেশি আবেগপ্রবণ। আমাদের বাঙালিরাও অনেকটা তাই।

হোসুয়া বলল, আমি অনেকদিন স্পেনে আছি, ইউরোপের অনেক দেশেও গিয়েছি। ইউরোপ থেকে স্পেন মনে হয় আলাদা- পিরেনিস পর্বতমালা একে ভৌগোলিক দিকে থেকে শুধু নয়, মানসিক দিক থেকেও আলাদা করে দিয়েছে। আবার স্পেনের উত্তর থেকে স্পেনের দক্ষিণ অর্থাৎ, আন্দালুসিয়া, অনেকটা ভিন্ন। আটশ’ বছরের মুসলিম শাসন ও অন্যান্য সভ্যতা ভিন্নভাবে গঠন করে আন্দালুসিয়াকে। তবে মোটের উপর স্পেন এক মেল্টিং পট- প্রাচ্য ও প্রতীচ্য, ইউরোপ ও আফ্রিকার।

আমাদের এ ইতিহাস ও ভূগোল আলাপে নাবিল ও নাতাশা খুব একটা খুশি হলোনা। তারা তো সব সময় বলে, তোমরা ঘুরতে থাক অতীতে, চিন্তিত থাক ভবিষ্যৎ নিয়ে, তবে ভুলে থাক বর্তমানকে। পরিবেশ একটু পরিবর্তনের আশায় আমি বললাম, চলো, তোমরা কি খাবে বলো! বর্তমানে ফিরে আসার এক রকম প্রচেষ্টা।

হোসুয়া বলল, স্পেনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ¯œ্যাক কী, তা তোমরা জান? তাপাস, বলেই আমি হাসতে লাগলাম। হোসুয়া-র বিস্ময়ের ভাব দেখে বলতে লাগলাম, সবদিকে দেখি তাপাস-এর ছবি, তাপাস বার-এর বিজ্ঞাপন। সে বলল, ঠিকই বলেছ। তুমি খেয়েছ? আমি না বলতেই সে বলল, তোমরা আজ এটি ট্রাই করে দেখ। স্পেনে এটি একটি জনপ্রিয় ¯œ্যাক, খাওয়া হয় বিয়ার বা ওয়াইন সহকারে, বেশিরভাগ সময় বিকেলের আড্ডায়। এখানে অনেক রেঁস্তোরা দেখবে, তাপাস বার, যেখানে শত রকমের তাপাস তৈরী হয়। কোনটি শুধু সবজির, কোনোটির সাথে মাছ, বা মাংস, আবার সাথে বিভিন্ন রকমের মসলা। আর স্পেনের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার বলা যায় পাইয়া। চালের সাথে জাফরান, সবজি, মাংস, সাথে অনেকসময় সি-ফুড। আমি বলে উঠলাম, তার কাছাকাছি আমাদেরও একটি প্রিয় খাবার আছে, আমরা বলি বিরিয়ানী। পাইয়া আরেকদিন খেয়ে দেখব। আজ তাপাস দিয়ে স্পেনীয় খাওয়া শুরু করি। দেখি কতটুকু আমরা হজম করতে পারি।

সবাই মিলে কাছের এক তাপাস বারে গেলাম। কত রকমের তাপাস- অর্ডার দেয়াই এক সমস্যা! মেনু দেখতে দেখতে, বিশ্লেষণ করতে করতে মনে হয় রাত পার হয়ে যাবে। আমাদের অবস্থা দেখে হোসুয়া এগিয়ে আসল। তার সাহায্যে শেষ পর্যস্ত অর্ডার দিতে পারলাম। আমি অর্ডার দিলাম সবচেয়ে সাধারণ, সবচেয়ে সস্তা তাপাস- প্যাতাসাস ব্রাভাস, যা হলো মসলাদার ভাজা আলু। ফারজানা কোন ঝুঁকি না নিয়ে আমাকে অনুসরণ করল। নাতাশা অর্ডার করল এম্পানাডা গ্যালেগা, যা মূলত একটি বড় পাই- টুনা মাছ, ডিম ও কাটা জলপাই দিয়ে ভরা। নাবিল সবসময় নতুন খাওয়া পরীক্ষা করে দেখতে চায়। গ্যাম্বাস আল আজিলো, নামটিই তার খুব পছন্দ, তাই সে এটি অর্ডার দিল। এটি তেমন কিছু নয়, রসুন দিয়ে ভাজা চিংড়ি। আমরা সবাই অর্ডার দিলাম অরেঞ্জ জুস, পাশে রাখা তাজা কমলা থেকে তৈরি। হোসুয়া নিল চোরিজো, যা হলো স্প্যানিশ সসেজ। সাথে মাও ব্রান্ডের বিয়ার। সে বলল, মাও হচ্ছে খাঁটি স্পেনীয় বিয়ার, যা ১৮৯০ সাল থেকে তৈরি হচ্ছে।

জীবনে প্রথমবার তাপাস খাওয়া- আমাদের সবার বেশ ভাল লাগল। তবে আমি বাঙালির সিঙ্গাড়া, চটপটি, ভাত-ডাল-ভর্তা-শাক-মাছ বেশি পছন্দ করি। এগুলো পেলে অন্য কিছু খেতে চাই না। নাবিল বলে, বাবা, তুমি কমফর্ট জোনের বাইরে যেতে চাও না। তোমাকে এ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমি বললাম, আমার অনেক লেইট হয়ে গেছে। বরং তোমরা দু’জন ট্রাই করো।

ঘোরাঘুরি, খাওয়া-দাওয়া আর আলাপ-সালাপে আমরা সম্ভবত ভুলে গেছি আমাদের আসল গন্তব্য। হোসুয়াকে স্মরণ করিয়ে দিলাম যে, লোরকার সবচেয়ে সুন্দর প্রকল্পে নিয়ে যাবার কথা ছিল তার। সে বলল, আমার মনে আছে। ধীরেসুস্থে যাচ্ছি, কারণ এটি খুলবে পাঁচটায়। দুইটায় বন্ধ হয়ে পাঁচটায় খুলে থাকবে আটটা পর্যন্ত।

লোরকার প্রকল্পে যাবার পথেই পড়ল আরেক গোল চত্বর-প্লাজা দ্য রোমানিয়া- এ যেন প্রকৃতি ও স্থাপত্যের সমারোহ। চারপাশে পাম গাছের সারি, তার মাঝে উঁচু হয়ে আছে গ্রানাদা ক্যাথেড্রালের বেল টাওয়ার। বসে, দাঁড়িয়ে, হেঁটে আড্ডা দিচ্ছে তরুণ, যুবক, প্রৌঢ়- সবাই। প্লাজার কেন্দ্রে ব্রোঞ্জের এক অনুপম ভাস্কর্য- এক আগুয়াদর, তার পাশে পানির ব্যাগ বহন করছে তার গাধা। আগুয়াদর- পুরুষ বা নারী- অতীতে গাধার পিঠে চড়িয়ে চামড়ার বাকেটে করে সুপেয় পানি নিয়ে আসত- গ্রাম থেকে শহরে বিক্রির জন্য। বহু বছর আগে এদের বিবরণ পড়েছিলাম ওয়াশিংটন আরভিং এর দঞধষবং ড়ভ ঃযব অষযধসনৎধ’, বইতে, এখন এদের প্রতিমূর্তি দেখে মনে পড়ে গেল।

প্লাজার চারপাশে স্যুভেনির শপ। প্রায়ই সবটিতেই মরক্কো থেকে আনা জিনিসপত্র- সুদৃশ্য কারুকাজের বাতি, উটের চমড়ার ব্যাগ, তলোয়ার, শাল, ফুলদানি, সিরামিকে আলহাম্বরা-র বিভিন্ন নকশা, আরো কত কি বিক্রি হচ্ছে। মরক্কো ও স্পেন এখনো পরস্পরের সাথে জড়িয়ে আছে।

গ্রানাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ক্যাম্পাস বেশি দূরে নয়, তাই অনেক ছাত্র-ছাত্রী এ প্লাজায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। গ্রানাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭টি ক্যাম্পাস মিলে ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা প্রায় ৬০,০০০। ৫টি ক্যাম্পাসের অবস্থান শহরে। এমনিতেই গ্রানাদা সজীব শহর, তার মাঝে তরুণ প্রাণের ব্যাপক উপস্থিতি এখন একে করে তুলেছে আরো প্রাণবন্ত।

গল্প করতে করতে হোসুয়া যেখানে আমাদের নিয়ে আসল, তা দেখে একই সাথে আনন্দিত ও বিস্মিত হলাম। আনন্দিত হবার কারণ, এ বিশাল ভবনের মাথায় বড় করে লেখা সেন্ট্রো দ্য ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা। এই তাহলে সুবিখ্যাত লোরকা সেন্টার। বিস্মিত হবার কারণ, এ এলাকার ঐতিহাসিক অবয়বের সাথে এই অত্যাধুনিক ভবন বেশ বেমানান। অবশ্য লোরকা-র সম্মানে আধুনিক স্থাপত্যের এক বড় নিদর্শন এ সুরম্য ভবন নির্মাণ করা হযেছে। ৪৭০০ বর্গমিটারের এ ভবনে রয়েছে একটি থিয়েটার, একটি বড় পাঠাগার, ও কয়েকটি প্রদর্শনী কক্ষ। আর আছে সমৃদ্ধ এক আর্কাইভ, যেখানে সংরক্ষিত আছে লোরকা ফাউন্ডেশানের দান করা লোরকার অমূল্য সৃষ্টিসম্পদ- তাঁর ৫০০০টি পা-ুলিপি, চিঠিপত্র, পেইন্টিং, স্কেচ, ছবি ইত্যাদি। এখানে লোরকার উপর গবেষণা ও আলোচনা হয়, আর সারা বছরই চলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সেমিনার, প্রদর্শনী। আমাদের সৌভাগ্য যে, এ সময় চলছে এক বিশেষ প্রদর্শনী-দখড়ৎপধ ধহফ ঃযব ধৎপযরাব. গবসড়ৎু রহ সড়ঃরড়হ’, প্রদর্শনী শুরু হয়েছে মাত্র দুই সপ্তাহ আগে, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪, চলবে ১১ মে, ২০২৫ পর্যন্ত। এটি মূলত এখানে সংরক্ষিত লোরকার সম্পূর্ণ আর্কাইভের প্রদর্শনী।

মনে হতো লোরকা শুধু কবিতাই লিখেছেন। এ প্রদর্শনীতে দেখলাম তাঁর বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর। পেইন্টিং ও স্কেচ আঁকা, পুতুল নাচের পুতুল তৈরি, নাটক লিখা ও পরিচালনা, গিটার ও পিয়ানো বাজানো, ফ্লেমেনকো সঙ্গীত প্রতিযোগিতার আয়োজন, আর কবিতাতো আছেই- মাত্র ৩৮ বছরের জীবনে এতসব কাজের সমারোহ। লোরকার এসব সৃষ্টি দেখতে দেখতে ভাবছিলাম একজন মানুষ কীভাবে এত ছোট জীবনে এত বড় কাজ করতে পারে!

আরো কত কিছু দেখার আছে জানার আছে লোরকাকে নিয়ে! তবুও আজকের মতো শেষ করতে হলো, কারণ লোরকা সেন্টার এখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখানে আবার আসার চিন্তা মাথায় নিয়ে ধীরে ধীরে বের হলাম।

হোসুয়াকে অনেক ধন্যবাদ দিলাম লোরকা সেন্টারে নিয়ে এসে লোরকার সাথে আরো পরিচিত করানোর জন্য। সে বলল, যোগাযোগ রাখবে, লোরকার আরো তথ্য দেবো। সানন্দে রাজি হয়ে হোসুয়া-র কাছ থেকে সেদিনের মতো বিদায় নিলাম।

হোটেল ২০ মিনিটের হাঁটার পথ, আমরা এ পথটুকু হেঁটে যেতেই সচরাচর পছন্দ করি। সারাদিনে অনেক কিছু দেখা, অনেক পথ হাঁটায় সবাই ক্লান্ত। তাই উবার ডেকে তাড়াতাড়ি হোটেলে পৌঁছে লবির পাশের রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লাম। এখানে রেস্টুরেন্ট অনেক রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। সবাই হালকা কিছু খেয়ে রুমে ঢুকে বিছানায় যেতে আর দেরি করলাম না। ক্লান্ত শরীর-মনে ঘুম আসল অচিরেই।

সকালে উঠে নাস্তা করতে করতে আলাপ চলল আজ কোথায় যাওয়া যায়। নাতাশা বলল ক্যাথলিকদের প্রধান চার্চ গ্রানাদা ক্যাথেড্রাল দেখতে যাবে। নাবিল দেখতে চায় আরবদের পুরনো বাজার আলকাইছেরিয়া। ইতিহাসের প্রতি তাদের আগ্রহ দেখে একটু অবাক হলাম। একটু ভেবে বললাম, ভালোই! ক্যাথলিক ও মুসলিম- গ্রানাদার ইতিহাসের এ দুটি বড় স্তম্ভকে তোমরা বেছে নিয়েছ। ইতিহাসে সব কিছুই পাশাপাশি থাকা উচিত, দেখা উচিত- কোন কিছু মুছে ফেলা ভুল।

দুটিই হোটেল থেকে বিশ পঁচিশ মিনিট পায়ে হাঁটার দূরত্বে, তাই হেঁটেই রওয়ানা দিলাম। (চলবে)

Ref:

৫. El Grito, ,কান্না, অনুবাদ: স্বপন ভট্টাচার্য

back to top