এমরান কবির
আকাশ নেমে এসেছে যেন। তাই বৃষ্টি পড়ার অবকাশ নেই কয়েকদিন হলো। কখনো গুঁড়ি গুঁড়ি, কখনো রিমঝিম, কখনো প্রবল, কখনো ঝিরঝিরি, কখনো উড়াল। চলছে এভাবেই। কখনো তার তীব্রতা এতই বেশি যে ধারা-পতন ভেদ করে অল্প দূরে কী আছে তাও দেখা যায় না। এর সাথে রয়েছে ঝড়ো হাওয়া। ঝড়ো হাওয়ার জন্য বারান্দার ভেতরে, ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ছে পানি। বারান্দায় আসুক ঠিক আছে, যেহেতু ঘনঘোর বর্ষা। কিন্তু ঘর? সেটা অন্তত পানির দাপট থেকে মুক্ত থাকতে পারত। কিন্তু পারছে না।
বৃষ্টি এভাবে ভিজিয়ে দেবে কেউ ভাবতে পারিনি। কারণ সুকঠোর রোদ ছিল। ভ্যাপসা গরম ছিল। বাতাসে আর্দ্রতা ছিল ভয়ানক। ফলে ঘামছিল সবাই। অবস্থা এমন যেন হাঁসফাঁস অবস্থা। এরকম পরিস্থিতি থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার উপায় নেই যেন। আবহাওয়া অফিসের কোনো সুসংবাদ ছিল না। আশা ছেড়ে দেয়ার মতোই ব্যাপার। অনেকটা অসহায় হয়ে মেনে নেয়ার মতো। হোক রোদই হোক তাহলে। বৃষ্টি না হলে আমরা আর কীইবা করতে পারি অপেক্ষা করা ছাড়া!
কিন্তু কীভাবে যে কী হয়ে গেল! আকাশ নেমে এলো। প্রথমে আমরা মহল্লার সবাই রাস্তায় নেমে এলাম। আহ কী সুন্দর বৃষ্টি! ঝাঁঝালো বাতাসের থাপ্পড় নেই। ভ্যাপসা গরম দিয়ে সিদ্ধ হওয়ার জো নেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষার প্রহর নেই। গাছের দিকে, গাছের পাতার দিকে তাকিয়ে পাতা নড়ার লক্ষণ-বিচার নেই।
তবে একটা সমস্যা দেখা দিলো। ঝড়ো হাওয়া এতটাই ঝড়ো হয়ে উঠলো যে বাহিরে থাকা নিরাপদ থাকলো না আর। মহল্লার কয়েকজন আহত হলো। ডাল ভেঙে পড়লো একজনের মাথায়। ইলেকট্রিসিটির তার ভেঙে পড়লো জমে থাকা পানির ভেতরে। সেখানে একজন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেল। আনন্দে লাফাতে লাফাতে পানির নিচে গর্তের ভেতরে পা ঢুকে একজন মচকে ফেলল পা। এ মহল্লার প্রায় প্রতিটি পরিবারেরই কেউ না কেউ আক্রান্ত হলো বৃষ্টি-উদযাপনের ঘটনায়। ফলে বয়োজ্যেষ্ঠ এবং নেতৃস্থানীয়গণ পরামর্শ দিলো কারো আনন্দ করার ইচ্ছে থাকলে ছাদে গিয়ে করো। সেটাই অধিকতর নিরাপদ।
অনেকেই সে-আদেশ মেনে নিয়ে ছাদমুখী হয়ে গেল। বহুদিন পর বৃষ্টি হওয়াতে মহল্লার সবাই যেন নিজেকে একটু মুক্ত করতে চাইলো রোদ-ঝলসিত জীবন থেকে। স্কুল-কলেজের বালাই নেই। বৃষ্টি যখন সিট দেয় তখন যার যার প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নিয়ে চলে আসে বাসায়। আর নিয়ম করে সবাই ছাদে যায় প্রতিদিন।
কিন্তু এখানেও একটা সমস্যা দেখা দিলো। টানা বৃষ্টি নেই আর। বিরতি দিয়ে দিয়ে আসে এখন। প্রায় প্রতিদিনই বৃষ্টি হয়। মহল্লার লোকজন নিয়ম করে ছাদে যায় বৃষ্টি-আনন্দে মেতে উঠতে।
বলা নেই কওয়া নেই একদিন হঠাৎ একজনের ছাদে একটা বাজ পড়লো। একই পরিবারের কয়েকজনের মৃত্যু হলো বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে। পাড়ার আকাশটা হয়ে গেল তাদের ছাদ। সবাই তাকিয়ে থাকলো সেই ছাদের দিকে। হঠাৎ হয়ে ওঠা আকাশের দিকে তাকিয়ে সবাই বিহ্বল হয়ে গেল। সমবেদনা জানালো যে যার মতো। শেষকৃত্যের পর যার যার মতো বাসায় ফিরে এলো। চোখ মুছল বেদনায়। কেউ প্রকাশ্যে মুছল। কেউ গোপনে। সবাই ভেবেছিল এরপর কেউ আর ছাদে যাবে না। কিন্তু সবার অনুমান মিথ্যে হয়ে গেল। দেখা গেল ঘটনা ঘটার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই পাড়ার সবাই ছাদে উঠল। হালকা রোদ উঠেছিল আজ। রোদের আমেজ পেতে নাকি প্রলম্বিত বৃষ্টির আনন্দকে আরো একটু উপভোগ করতে- ঠিক বোঝা গেল না- পাড়ার সবাইকে ছাদে দেখা গেল। শুধু একটি ছাদে কাউকে দেখা গেল না। যে ছাদে গতকাল বাজ পড়েছিল।
হালকা রোদ থাকলেও আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। মেঘ দেখা গেল শীঘ্রই। কিংবা মেঘ এসে হালকা রোদ ঢেকে দিলো। যা-ই বলি না কেন, যেভাবেই বলি না কেন, একটুপরই শুরু হলো বৃষ্টি। সাথে ঝড়ো হাওয়া। মহল্লাবাসী এভাবে ক্ষণেকের ছাদবাসী হয়ে ভুলে গেলো গতকালের বাজ পড়ে ঝরে যাওয়া কয়েকটি তাজা প্রাণের কথা। তারা আনন্দে মেতে উঠল বৃষ্টির সাথে। ঝড়ো হাওয়ার সাথে শুরু হলো অপূর্ব মিতালী। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে আজও বাজ পড়লো একটি ছাদে। একদিন আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়ে গেল।
শোক নেমে এলো আবার সবার বুকের ভেতরে। সবাই একত্রিত হয়ে সমবেদনা জানিয়ে শেষকৃত্য সম্পাদন করল। এবং যথারীতি যার যার বাসায় ফিরে এসে টিভি দেখতে থাকলো। কেউ কেউ ফেসবুকে ঢুকে পড়লো। কেউ কেউ টিকটকে। এরই মধ্যে ছাদে যাওয়া নিয়ে, বাজ পড়া নিয়ে, বয়োজ্যেষ্ঠদের আদেশ-নিষেধ নিয়ে, শোক করা নিয়ে এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত নিয়ে ট্রল আর মিমে মেতে উঠলো অনেকেই।
পরদিন একই রকম ঘটনা ঘটলে পাড়ার জ্ঞানীগুণী ও বয়োজ্যেষ্ঠগণ সবাইকে বলে দিলো আর ছাদে যাওয়া যাবে না। দানে দানে তিন দান। পরপর তিনটি ঘটনা ঘটার পর দায়িত্বশীল জ্ঞানী ও বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেয়া যায় না। মহল্লার সবাই তাঁদের কথা মেনে নিয়ে যার যার মতো বাসায় ফিরলো। প্রকাশ্যে বা গোপনে কেউ ছাদে উঠল না এরপর থেকে।
ছাদে উঠলে প্রাণনাশের ভয় আর জ্ঞানীদের বারণ থাকলেও বারান্দায় যেতে তো আর মানা নেই। তাই যখনই বৃষ্টি শুরু হয় তখনই সবাই বারন্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। ঝড়ো হাওয়া এতো বেড়ে যায় যে সবাই ভিজে যায়। এমনকি বৃষ্টির ঝাপটা ঘরের ভেতরে এসে সবকিছু ভিজিয়ে দেয়।
ফেসবুকে একজন এটা নিয়ে একটা পোস্ট দিলে একে একে সবাই একইরকম ঘটনার কথা বলতে থাকে। বিছানা বালিশ আসবাবপত্র সবকিছু ভিজে যাচ্ছে। এমনকি ডাইনিং টেবিল, ড্রয়িং রুম বারান্দা থেকে অনেক দূরে হলেও ভিজে যাচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মহল্লার জ্ঞানীগুণীগণের পরামর্শ চাইলে তারা কেন জানি খুব নীরব হয়ে যান। একে একে সবাই যখন বলেন একই রকম সমস্যার কথা, তখন তাঁরা নিষ্প্রাণ চোখে একে অপরের দিকে তাকান। এরপর তাঁরা এবং আমরা অর্থাৎ মহল্লার সবাই একমত হই যে, আমরা কেউ বারান্দায় যাব না। যেহেতু বারান্দা খুললেই সমস্যা দেখা দিচ্ছে তাহলে না খুললেই হয়। সমস্যা খেল খতম। ঠিকই তো। সবাই এই কথা মেনে নিয়ে বাড়ি ফিরলে এক ধরনের স্বস্তি নেমে এলো মহল্লার ভেতরে। যাক বাবা সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া গেল।
কিন্তু সমস্যা গেল না তাতেও। বৃষ্টি ঝড়ো হওয়া সমেত ঢুকে পড়তে শুরু করলো জানালা দিয়ে। বন্ধ থাকলেও, খোলা থাকলেও।
এরপর দেখো গেলো বৃষ্টি হলেও ভিজে যাচ্ছে ঘরের অভ্যন্তর, রোদ থাকলেও।
বাহিরের সমস্যা সমাধানের জন্য ছাদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এরপর সিদ্ধান্ত হলো বারান্দায় বসে উপভোগ করতে। সেটাও যখন বাতিল হলো তখন ছিল শুধু ঘর। এখন ঘরেও সমস্যা হওয়াতে সবাই চুপসে গেল। এরপর কী? রোদেও সুকঠিন উত্তাপ থেকে সবাই মুক্তি চাইলেও এরকম বৃষ্টি-বিড়ম্বনা চায়নি কেউই। খুঁজে বের করতে হবে এরকম পরিস্থিতি থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
একজন বলল, ‘সমস্যা রোদের। রোদ আটকালে এধরনের ঝামেলা হবে না।
একজন বলল, ‘রোদের সমস্যা কীভাবে। এটা তো বৃষ্টির সমস্যা’।
একজন বলল, ‘এটা এককভাবে রোদের সমস্যাও নয়, বৃষ্টির সমস্যাও নয়। খামোখা একে অপরকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।’
আরেকজন বলল, ‘আসলে দুটোরই সমস্যা। দুই সমস্যাই দূর করা উচিৎ।’ তিনি আরেকজন অধিকতর জ্ঞানীর দিকে ইঙ্গিত করলে তাঁর দিকে সবাই মনোনিবেশ করল। কী বলবেন তিনি!
তিনি বললেন, ‘রোদ ও বৃষ্টির জন্য আকাশ দায়ী। আকাশটাকেই ধ্বংস করে দেয়া দরকার।’
তার কথা সবার পছন্দ হলো। যার যা আছে তাই নিয়ে আকাশের দিকে যেতে থাকলো সবাই। দৌড়াচ্ছে আর দৌড়াচ্ছে। আরেকটু গেলেই আকাশটা ধরা যাবে। আকাশের প্রান্তটা ধরা যাবে। সামিয়ানার প্রান্ত ধরে টান দেয়ার মতো করে টান দিতে হবে। তাহলেই খেল খতম।
সবাই আকাশের প্রান্ত ধরার জন্য দৌড়াতে থাকলো।
এমরান কবির
বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫
আকাশ নেমে এসেছে যেন। তাই বৃষ্টি পড়ার অবকাশ নেই কয়েকদিন হলো। কখনো গুঁড়ি গুঁড়ি, কখনো রিমঝিম, কখনো প্রবল, কখনো ঝিরঝিরি, কখনো উড়াল। চলছে এভাবেই। কখনো তার তীব্রতা এতই বেশি যে ধারা-পতন ভেদ করে অল্প দূরে কী আছে তাও দেখা যায় না। এর সাথে রয়েছে ঝড়ো হাওয়া। ঝড়ো হাওয়ার জন্য বারান্দার ভেতরে, ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ছে পানি। বারান্দায় আসুক ঠিক আছে, যেহেতু ঘনঘোর বর্ষা। কিন্তু ঘর? সেটা অন্তত পানির দাপট থেকে মুক্ত থাকতে পারত। কিন্তু পারছে না।
বৃষ্টি এভাবে ভিজিয়ে দেবে কেউ ভাবতে পারিনি। কারণ সুকঠোর রোদ ছিল। ভ্যাপসা গরম ছিল। বাতাসে আর্দ্রতা ছিল ভয়ানক। ফলে ঘামছিল সবাই। অবস্থা এমন যেন হাঁসফাঁস অবস্থা। এরকম পরিস্থিতি থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার উপায় নেই যেন। আবহাওয়া অফিসের কোনো সুসংবাদ ছিল না। আশা ছেড়ে দেয়ার মতোই ব্যাপার। অনেকটা অসহায় হয়ে মেনে নেয়ার মতো। হোক রোদই হোক তাহলে। বৃষ্টি না হলে আমরা আর কীইবা করতে পারি অপেক্ষা করা ছাড়া!
কিন্তু কীভাবে যে কী হয়ে গেল! আকাশ নেমে এলো। প্রথমে আমরা মহল্লার সবাই রাস্তায় নেমে এলাম। আহ কী সুন্দর বৃষ্টি! ঝাঁঝালো বাতাসের থাপ্পড় নেই। ভ্যাপসা গরম দিয়ে সিদ্ধ হওয়ার জো নেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষার প্রহর নেই। গাছের দিকে, গাছের পাতার দিকে তাকিয়ে পাতা নড়ার লক্ষণ-বিচার নেই।
তবে একটা সমস্যা দেখা দিলো। ঝড়ো হাওয়া এতটাই ঝড়ো হয়ে উঠলো যে বাহিরে থাকা নিরাপদ থাকলো না আর। মহল্লার কয়েকজন আহত হলো। ডাল ভেঙে পড়লো একজনের মাথায়। ইলেকট্রিসিটির তার ভেঙে পড়লো জমে থাকা পানির ভেতরে। সেখানে একজন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেল। আনন্দে লাফাতে লাফাতে পানির নিচে গর্তের ভেতরে পা ঢুকে একজন মচকে ফেলল পা। এ মহল্লার প্রায় প্রতিটি পরিবারেরই কেউ না কেউ আক্রান্ত হলো বৃষ্টি-উদযাপনের ঘটনায়। ফলে বয়োজ্যেষ্ঠ এবং নেতৃস্থানীয়গণ পরামর্শ দিলো কারো আনন্দ করার ইচ্ছে থাকলে ছাদে গিয়ে করো। সেটাই অধিকতর নিরাপদ।
অনেকেই সে-আদেশ মেনে নিয়ে ছাদমুখী হয়ে গেল। বহুদিন পর বৃষ্টি হওয়াতে মহল্লার সবাই যেন নিজেকে একটু মুক্ত করতে চাইলো রোদ-ঝলসিত জীবন থেকে। স্কুল-কলেজের বালাই নেই। বৃষ্টি যখন সিট দেয় তখন যার যার প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নিয়ে চলে আসে বাসায়। আর নিয়ম করে সবাই ছাদে যায় প্রতিদিন।
কিন্তু এখানেও একটা সমস্যা দেখা দিলো। টানা বৃষ্টি নেই আর। বিরতি দিয়ে দিয়ে আসে এখন। প্রায় প্রতিদিনই বৃষ্টি হয়। মহল্লার লোকজন নিয়ম করে ছাদে যায় বৃষ্টি-আনন্দে মেতে উঠতে।
বলা নেই কওয়া নেই একদিন হঠাৎ একজনের ছাদে একটা বাজ পড়লো। একই পরিবারের কয়েকজনের মৃত্যু হলো বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে। পাড়ার আকাশটা হয়ে গেল তাদের ছাদ। সবাই তাকিয়ে থাকলো সেই ছাদের দিকে। হঠাৎ হয়ে ওঠা আকাশের দিকে তাকিয়ে সবাই বিহ্বল হয়ে গেল। সমবেদনা জানালো যে যার মতো। শেষকৃত্যের পর যার যার মতো বাসায় ফিরে এলো। চোখ মুছল বেদনায়। কেউ প্রকাশ্যে মুছল। কেউ গোপনে। সবাই ভেবেছিল এরপর কেউ আর ছাদে যাবে না। কিন্তু সবার অনুমান মিথ্যে হয়ে গেল। দেখা গেল ঘটনা ঘটার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই পাড়ার সবাই ছাদে উঠল। হালকা রোদ উঠেছিল আজ। রোদের আমেজ পেতে নাকি প্রলম্বিত বৃষ্টির আনন্দকে আরো একটু উপভোগ করতে- ঠিক বোঝা গেল না- পাড়ার সবাইকে ছাদে দেখা গেল। শুধু একটি ছাদে কাউকে দেখা গেল না। যে ছাদে গতকাল বাজ পড়েছিল।
হালকা রোদ থাকলেও আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। মেঘ দেখা গেল শীঘ্রই। কিংবা মেঘ এসে হালকা রোদ ঢেকে দিলো। যা-ই বলি না কেন, যেভাবেই বলি না কেন, একটুপরই শুরু হলো বৃষ্টি। সাথে ঝড়ো হাওয়া। মহল্লাবাসী এভাবে ক্ষণেকের ছাদবাসী হয়ে ভুলে গেলো গতকালের বাজ পড়ে ঝরে যাওয়া কয়েকটি তাজা প্রাণের কথা। তারা আনন্দে মেতে উঠল বৃষ্টির সাথে। ঝড়ো হাওয়ার সাথে শুরু হলো অপূর্ব মিতালী। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে আজও বাজ পড়লো একটি ছাদে। একদিন আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়ে গেল।
শোক নেমে এলো আবার সবার বুকের ভেতরে। সবাই একত্রিত হয়ে সমবেদনা জানিয়ে শেষকৃত্য সম্পাদন করল। এবং যথারীতি যার যার বাসায় ফিরে এসে টিভি দেখতে থাকলো। কেউ কেউ ফেসবুকে ঢুকে পড়লো। কেউ কেউ টিকটকে। এরই মধ্যে ছাদে যাওয়া নিয়ে, বাজ পড়া নিয়ে, বয়োজ্যেষ্ঠদের আদেশ-নিষেধ নিয়ে, শোক করা নিয়ে এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত নিয়ে ট্রল আর মিমে মেতে উঠলো অনেকেই।
পরদিন একই রকম ঘটনা ঘটলে পাড়ার জ্ঞানীগুণী ও বয়োজ্যেষ্ঠগণ সবাইকে বলে দিলো আর ছাদে যাওয়া যাবে না। দানে দানে তিন দান। পরপর তিনটি ঘটনা ঘটার পর দায়িত্বশীল জ্ঞানী ও বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেয়া যায় না। মহল্লার সবাই তাঁদের কথা মেনে নিয়ে যার যার মতো বাসায় ফিরলো। প্রকাশ্যে বা গোপনে কেউ ছাদে উঠল না এরপর থেকে।
ছাদে উঠলে প্রাণনাশের ভয় আর জ্ঞানীদের বারণ থাকলেও বারান্দায় যেতে তো আর মানা নেই। তাই যখনই বৃষ্টি শুরু হয় তখনই সবাই বারন্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। ঝড়ো হাওয়া এতো বেড়ে যায় যে সবাই ভিজে যায়। এমনকি বৃষ্টির ঝাপটা ঘরের ভেতরে এসে সবকিছু ভিজিয়ে দেয়।
ফেসবুকে একজন এটা নিয়ে একটা পোস্ট দিলে একে একে সবাই একইরকম ঘটনার কথা বলতে থাকে। বিছানা বালিশ আসবাবপত্র সবকিছু ভিজে যাচ্ছে। এমনকি ডাইনিং টেবিল, ড্রয়িং রুম বারান্দা থেকে অনেক দূরে হলেও ভিজে যাচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মহল্লার জ্ঞানীগুণীগণের পরামর্শ চাইলে তারা কেন জানি খুব নীরব হয়ে যান। একে একে সবাই যখন বলেন একই রকম সমস্যার কথা, তখন তাঁরা নিষ্প্রাণ চোখে একে অপরের দিকে তাকান। এরপর তাঁরা এবং আমরা অর্থাৎ মহল্লার সবাই একমত হই যে, আমরা কেউ বারান্দায় যাব না। যেহেতু বারান্দা খুললেই সমস্যা দেখা দিচ্ছে তাহলে না খুললেই হয়। সমস্যা খেল খতম। ঠিকই তো। সবাই এই কথা মেনে নিয়ে বাড়ি ফিরলে এক ধরনের স্বস্তি নেমে এলো মহল্লার ভেতরে। যাক বাবা সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া গেল।
কিন্তু সমস্যা গেল না তাতেও। বৃষ্টি ঝড়ো হওয়া সমেত ঢুকে পড়তে শুরু করলো জানালা দিয়ে। বন্ধ থাকলেও, খোলা থাকলেও।
এরপর দেখো গেলো বৃষ্টি হলেও ভিজে যাচ্ছে ঘরের অভ্যন্তর, রোদ থাকলেও।
বাহিরের সমস্যা সমাধানের জন্য ছাদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এরপর সিদ্ধান্ত হলো বারান্দায় বসে উপভোগ করতে। সেটাও যখন বাতিল হলো তখন ছিল শুধু ঘর। এখন ঘরেও সমস্যা হওয়াতে সবাই চুপসে গেল। এরপর কী? রোদেও সুকঠিন উত্তাপ থেকে সবাই মুক্তি চাইলেও এরকম বৃষ্টি-বিড়ম্বনা চায়নি কেউই। খুঁজে বের করতে হবে এরকম পরিস্থিতি থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
একজন বলল, ‘সমস্যা রোদের। রোদ আটকালে এধরনের ঝামেলা হবে না।
একজন বলল, ‘রোদের সমস্যা কীভাবে। এটা তো বৃষ্টির সমস্যা’।
একজন বলল, ‘এটা এককভাবে রোদের সমস্যাও নয়, বৃষ্টির সমস্যাও নয়। খামোখা একে অপরকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।’
আরেকজন বলল, ‘আসলে দুটোরই সমস্যা। দুই সমস্যাই দূর করা উচিৎ।’ তিনি আরেকজন অধিকতর জ্ঞানীর দিকে ইঙ্গিত করলে তাঁর দিকে সবাই মনোনিবেশ করল। কী বলবেন তিনি!
তিনি বললেন, ‘রোদ ও বৃষ্টির জন্য আকাশ দায়ী। আকাশটাকেই ধ্বংস করে দেয়া দরকার।’
তার কথা সবার পছন্দ হলো। যার যা আছে তাই নিয়ে আকাশের দিকে যেতে থাকলো সবাই। দৌড়াচ্ছে আর দৌড়াচ্ছে। আরেকটু গেলেই আকাশটা ধরা যাবে। আকাশের প্রান্তটা ধরা যাবে। সামিয়ানার প্রান্ত ধরে টান দেয়ার মতো করে টান দিতে হবে। তাহলেই খেল খতম।
সবাই আকাশের প্রান্ত ধরার জন্য দৌড়াতে থাকলো।