অলস লোকেদের ব্যস্ততা
খালেদ হোসাইন
অলস লোকেদের ব্যস্ততার শেষ নেই।
তাদের নিজস্ব বাস্তবতা
রন্ধ্রহীন অন্ধকারের মতো।
মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ
প্রবলভাবে জেগে উঠে
সবকিছু কার্যকর করতে চায়।
সবকিছু–তার পুরোটা চেনা নয়।
অধিকাংশ কল্পনাতীত।
২
অন্যের মন-মর্জি, মমতা ও ক্ষমতা-
মূলত সামর্থ্যরে উপর, নির্ভর ক’রে
স্বপ্ন দেখা ঠিক নয়।
তাতে মুখ থুবড়ে পড়ে
মহাপরিকল্পনা।
কাউকে আমি আমার স্বপ্ন বাস্তবায়নের
দায়িত্ব দিতে চাই না।
যদিও কেউ কেউ মাইক্রোফোনে
খুব হম্বিতম্বি করতে থাকে-
আমল নির্বিশেষে।
দু’টি কবিতা
কামরুল হাসান
রূপ নিয়ে কালোর কবরে
রূপ নিয়ে তাদের গর্ব কাল গর্ভাশয়ে প্রোথিত ভ্রƒণের
মিলিত কোলাজ হতে গিয়ে যৌবনের অশেষ তেজের
অপভ্রংশ পড়ে থাকে দলিত শয্যায় কত যে মুখভঙ্গি
এরা পথে রেখে গেছে, মুগ্ধ কালোর দিকে কত যে মুখোশ
ছুঁড়ে রতিতীব্র হয়েছে বেহুঁশ, এখন পিষ্ট হতে ভালবাসে
নগর সৌধচূড়া, খোঁপা থেকে খুলে যাওয়া নিভৃতের ফুলে।
রাত্রির আঁধারের নিচে কী করে যে প্রস্ফুটিত করে তোলে রূপ
তখন কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে পাওয়া যায়, তখন থুত্থুরে
পিতামহী ঘনিষ্ঠ দাঁড়ায়, লোলচর্ম এতখানি লুক্কায়িত ছিল
ঐ টানটান ¯েœহের প্রলেপ, ঐ তেজোদীপ্ত অহঙ্কারী গ্রীবা
ঘোরাতে ঘোরাতে তারা কবেকার, চলে গেল কালোর কবরে।
হাউজ টিউটর
ভুল পাঠে ভরে থাকে বালিকা জীবন!
কে শেখায়, কে শিখে এই ধন্ধে যাপিত তরল
যতনে তুলিয়া গেল কত শত সতীনের দল!
অঙ্ক মেলে না আর ব্যাকরণে ভুল হয়ে যায়
অশেষ পাঠের শেষে শূন্য ওঠে জীবন খাতায়!
মেধা নয়, দীপ্তি নয় বয়সের আশ্চর্য চিন্ময়
কীর্তি নয় সচ্ছলতা নয়, এক মুগ্ধ বিস্ময়!
ভুলে ভরা পদ্যের শেষে শুদ্ধ ¯িœগ্ধ মুখখানি
যখন ফিরাল গ্রীবা, কুড়ি কুড়ি বছর তলানি!
তখন পালেও লেগেছে হাওয়া নদী খরতর
ভবনদী সমুখে ছোটে, সাথে ঐ তরী তরতর!
নৈর্ব্যক্তিক অনুরাগ
কিব লোহানী
এক মাইল পর্যন্ত হেঁটে আসা পথ
অজানা একটি বাড়ির সামনে এসে থামলো
বিস্তৃতভাবে প্যানেলিং করা এমন সুন্দর একটি বাড়ি
পরিত্যাক্ত হতে পারে! ভাবাই যায় না।
‘ক্ষমা কোরো আমি যদি কোনো ভাঙ্গা জানালায়
দাঁড়িয়ে তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করি।’ বললো আতিফ
‘বাইরের দরজাগুলো আমাদের এখানে থামিয়ে দিতে চাইছে
এখানে যিনি বসবাস করতেন আমি তাঁর সাথে তোমার
পরিচয় করিয়ে দিতে চাই।
কবি যিনি কবিতা লিখতেন ও সেগুলো ছাপার অক্ষরে
প্রকাশিত হতো। সব কিছুই ছিলো তাঁর জানালার ভেতরের
সাজানো ফুল আর জানালার বাহিরের পাখিদের নিয়ে।
শরীর তাঁকে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলো
প্রায় সম্পূর্ণ জীবন যাপন বিছানায়, লেখালেখিও বিছানায়।
আমরা ঘরময় ছিটানো ভাঙ্গা কাঁচের টুকরোর
উপর দিয়ে অস্বচ্ছন্দতা নিয়ে এগুচ্ছিলাম।
বাড়িটি থেকে সবকিছু ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে
শুধু কবির কবিতা ছাড়া।
নিঝুম নিস্তব্ধ বাড়ির মেঝেতে কার্টন ভর্তি
একটি পূর্ণ সংস্করণ, উপচে বাইরে পড়ছে প্রাচুর্যের মতো
অথবা মহিলা-কবির প্রেমিক হৃদয়ের মতো
জানালার পাশে ছড়িয়ে দিয়েছে আলোর দিকে
যেখানে বয়ে আসা বৃষ্টি সেগুলোকে
ভিজিয়ে ফুলিয়ে ফেলেছে।
দুষ্টু ছেলে ও অপেশাদার শিকারীরা জানতো কী করতে হবে,
পাথর ও সীসার গুলতি মেরে অরক্ষিত জানালাগুলোকে
ভেঙ্গে চুরমার করেছে, ঝাড় না দেয়া মেঝেতে সেই কাঁচ ছড়িয়ে,
কবিতার স্নিগ্ধ চরণগুলো এই আগ্রাসন থেকে কীভাবে রক্ষা পেলো?
বই কি অপ্রয়োজনীয় কারণে ছুঁড়ে ফেলা হয়?
ওরা ওখানে পড়ে থাকে এখন বা কখনো
যখন কেউ অল্প খুলে দেখে পায়ের কাছে ফেলে দেয়।
এখানে এসবই ছিলো বিক্রি করা বা বিলিয়ে দেয়ার জন্য।
আতিফ, কার্টনের গভীর থেকে কুমারী মোড়কে ঢাকা
একটি নতুন বই তুলে নিলো
সে একটি পড়তে থাকলো আমি একটি,
চিলেকোঠার বোলতাগুলো নিমিষে হারিয়ে গেছে।
বাড়ি ফিরে আসার পথে পকেটে থাকা
ছোট বইটির কথা বারবার মনে পড়ছিলো
সেটি পকেটেই ছিলো। আমি জানি স্বর্গে বসে
মহিলা-কবি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, হৃদয় ভারমুক্ত
হয়েছে অন্তত একটি বই সুন্দরভাবে চলে গেছে বলে।
তাঁর উপর আমার দাবি, যদিও সামান্য, দাবিই বটে,
প্রচেষ্টাটি তিনি কি অনুভব করেছেন? একসময়, তিনি
তাঁর সবগুলো বই থেকেই পরিত্রাণ পাবেন।
পুরোনো প্রাসাদ
শেখ মাসুম কামাল
কল্পনা করো, তুমি দাঁড়িয়ে আছো
পুরোনো কোনো প্রাসাদের সামনে, প্রাসাদের বাইরে
বাহারি আঙিনা, আঙিনায়
পাষাণ-মূর্তির শিউলি-ভেজা হাতে
রাজহংসীর পালক, ঘন-কালো কেশ এবং
চরণচিহ্ন অগণিত মানুষের,
বহুকাল আগের,
একালে খুব নগণ্য একটা টেবিল
পড়ে আছে প্রাসাদের বাইরে। প্রাসাদের অভ্যন্তরে
ঐশ্বর্যের ফুটফুটে চাঁদ, চঞ্চলতা নেই
নেই কোনো কোলাহল। কালের সাগরে ডুবে গেছে
প্রাসাদের অতীত যৌবন।
অন্তিমে দিশাশিখা
মনজুর শামস
সামনের অবোধ্য দৃশ্যে মুমূর্ষুর ঘোলাচোখ মেলে তাকালাম
মরণশয্যায় হাল ছেড়ে দেয়া জীবনের শেষদৃশ্য দেখে নেয়ার
নিরাবেগ আকুতির মতো; অনিবার্য- কিন্তু আকাক্সক্ষাহীন
অনেকটা বছরের শেষ দিনটির শেষ প্রহরের রুটিনকাজের মতো
দেখলাম- ফুল, প্রজাপতি আর নদী-মাঠ-ঘাটের পাংশুটে অথর্ব যাত্রা
যেন- ফুটতে হয় বলেই ফুটছে, উড়তে হয় বলেই উড়ছে, চলতে হয় বলেই চলছে
বনে বনে আগুন জ¦লছে, দেশে দেশে অসম বাণিজ্যপোতের গনগনে গোলা ছোড়াছুড়ি
লালশালুর জাঁকালো প্রত্যাবর্তনে সদিচ্ছা-আকাশ থেকে শে^ত বলাকাদের মুখ থুবড়ে পড়া
চরম হতাশায় স্বেচ্ছায় শেষ নিশ^াস টেনে নেয়ার আগে টিভিস্ক্রিনে চোখ পড়ে গেলো
দেখলাম- মুহুর্মুহু বোমার আঘাতে গাজার ল-ভ- ধ্বংসস্তূপ থেকে বেঁচে থাকার
উদগ্র আকাক্সক্ষায় মৃত্যুকূপ থেকে জীবনের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে রক্তাক্ত ফিলিস্তিনি শিশু
নিমেষে উধাও হলো মরণদশা, চোখের সামনের আবারো দেখতে পেলাম সবুজের দোল
সূর্যফুল
বাশার মাহফুজ
না।কখনোই না।
বিষাদ ভুলে আঙিনায় ফোটেনি রক্তজবা
ভুল করেও প্রচার হয়নি ভাঁটফুলের ঘ্রাণ!
মিথ্যে সহযাত্রী ভুল নিয়ে ফুল দিয়ে বলেছিল সুখী হও!
প্রজাপতি সকালের কাছে প্রার্থনারত রোদের
মুখ ঝলসে আমাদের দেখা হয়েছিল।
অপ্রচারিত এই আমাকে বিখ্যাত বিলবোর্ডে
ঝুলিয়ে দেওয়া আত্মহনন- শোকের মিছিল
না কখনোই না বিষাদ ভুলে ফোটেনি সূর্যফুল!
দুপরি ক্লান্তিহীন
খালেদ মাহবুব মোর্শেদ
পুষ্পবতীর পদমূলে পুষ্পার্ঘ্য অর্পিতে গিয়ে তুমি
স্বেচ্ছায় ফিরিয়ে দিয়েছিলে নিবেদিত পত্র-মালা;
পুষ্পবতীকে বলিনি আমি অতীতের সে কাহিনী
প্রীতিমাখা স্মৃতিপলি প্রাণে পুষে আজো পথ চলি।
সচেতন সুখানুভাবে জমাই পলি
জীবনের জয়মালা পরাজয়ে যাই পদে দলি...
চারপাশে নয় কেউ পুরোপুরি সুখি
সময় কাটায় সবে পুষে দীর্ঘশ্বাস মুখোমুখি।
চেয়ে দেখি অপুষ্পক রয়ে গেলো তোমার বাগান
প্রাক্তন প্রেমের নামে পতাকা উড়িয়ে আমি গাই
ক্লানিহীন বিরহের ¯িœগ্ধ জয়গান।
নাকছাবি
রাকিবুল রকি
কিছু কদম শুকিয়ে আছে স্মৃতির আলমিরায়
বৃষ্টি পড়ে মন-উঠোনে অভিমানী ঘৃণায়
ঘৃণার উল্টো পিঠেই থাকে প্রেমের আবাহন
পথ বন্ধ, হাঁটে তবু ছাতা ছাড়া মন
ভেঁজা পাতার ভ্যাপসা ঘ্রাণই হলো স্মৃতির চাবি
তুমি হয়ে উঠেছে আজ তোমারই নাকছাবি।
সোনাবরণ নদী
ফাহমিদা লাইজু
এখানে পা ডুবিয়ে ছিলাম একদিন
নৌকায় বসে, ছলছল শব্দ তুলে-
শেষ বিকেলে, সূর্যের বিদায় রশ্মির অবকাশে।
আশ্চর্য আর ভীত হয়ে দেখলাম, আমার পা দুটো
সোনালি হয়ে গেছে!
আমার উপর যেমন সোনার প্রলেপ দেয় কর্মকার-
হাতুড়ির পিটুনি আর গনগনে আগুন;
প্রয়োজন হলো না তেমন কিছুর।
ছিল শুধু কোমল ভালবাসার একবিন্দু-
লোভাতুর মন, লালসা কিলবিল করে
হাতছানি দেয়-
ঝাঁপ দাও!
সোনার বরণে সাজাও গাত্র!
শকুনের চোখ ফের খসখসে রং খুবলে খায়;
এতদিনের অভিযোগ- কালো বরণ,
প্রকৃতির দীনতা মোচন হলো বলে
কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে।
এত সুন্দর সোনা বরণ নদীর বুকে
দু’ফোঁটা লোনাজল মিশে যায়,
কষ্টে না-কি আনন্দে বোঝা বড় দায়।
এক সুতো কাশফুল উড়ে এসে নাকে লাগে
অদ্ভুত মায়ার চাদরে ঢেকে যায় সময়
আর পাওয়া হয় না, চেয়েছি যা।
এখন আমি যেদিকে হাঁটি,
সামনের সব ছেয়ে যায় সোনালি আভায়,
পেছনে থাকে শুধু নিকষকালো অন্ধকার।
বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫
অলস লোকেদের ব্যস্ততা
খালেদ হোসাইন
অলস লোকেদের ব্যস্ততার শেষ নেই।
তাদের নিজস্ব বাস্তবতা
রন্ধ্রহীন অন্ধকারের মতো।
মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ
প্রবলভাবে জেগে উঠে
সবকিছু কার্যকর করতে চায়।
সবকিছু–তার পুরোটা চেনা নয়।
অধিকাংশ কল্পনাতীত।
২
অন্যের মন-মর্জি, মমতা ও ক্ষমতা-
মূলত সামর্থ্যরে উপর, নির্ভর ক’রে
স্বপ্ন দেখা ঠিক নয়।
তাতে মুখ থুবড়ে পড়ে
মহাপরিকল্পনা।
কাউকে আমি আমার স্বপ্ন বাস্তবায়নের
দায়িত্ব দিতে চাই না।
যদিও কেউ কেউ মাইক্রোফোনে
খুব হম্বিতম্বি করতে থাকে-
আমল নির্বিশেষে।
দু’টি কবিতা
কামরুল হাসান
রূপ নিয়ে কালোর কবরে
রূপ নিয়ে তাদের গর্ব কাল গর্ভাশয়ে প্রোথিত ভ্রƒণের
মিলিত কোলাজ হতে গিয়ে যৌবনের অশেষ তেজের
অপভ্রংশ পড়ে থাকে দলিত শয্যায় কত যে মুখভঙ্গি
এরা পথে রেখে গেছে, মুগ্ধ কালোর দিকে কত যে মুখোশ
ছুঁড়ে রতিতীব্র হয়েছে বেহুঁশ, এখন পিষ্ট হতে ভালবাসে
নগর সৌধচূড়া, খোঁপা থেকে খুলে যাওয়া নিভৃতের ফুলে।
রাত্রির আঁধারের নিচে কী করে যে প্রস্ফুটিত করে তোলে রূপ
তখন কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে পাওয়া যায়, তখন থুত্থুরে
পিতামহী ঘনিষ্ঠ দাঁড়ায়, লোলচর্ম এতখানি লুক্কায়িত ছিল
ঐ টানটান ¯েœহের প্রলেপ, ঐ তেজোদীপ্ত অহঙ্কারী গ্রীবা
ঘোরাতে ঘোরাতে তারা কবেকার, চলে গেল কালোর কবরে।
হাউজ টিউটর
ভুল পাঠে ভরে থাকে বালিকা জীবন!
কে শেখায়, কে শিখে এই ধন্ধে যাপিত তরল
যতনে তুলিয়া গেল কত শত সতীনের দল!
অঙ্ক মেলে না আর ব্যাকরণে ভুল হয়ে যায়
অশেষ পাঠের শেষে শূন্য ওঠে জীবন খাতায়!
মেধা নয়, দীপ্তি নয় বয়সের আশ্চর্য চিন্ময়
কীর্তি নয় সচ্ছলতা নয়, এক মুগ্ধ বিস্ময়!
ভুলে ভরা পদ্যের শেষে শুদ্ধ ¯িœগ্ধ মুখখানি
যখন ফিরাল গ্রীবা, কুড়ি কুড়ি বছর তলানি!
তখন পালেও লেগেছে হাওয়া নদী খরতর
ভবনদী সমুখে ছোটে, সাথে ঐ তরী তরতর!
নৈর্ব্যক্তিক অনুরাগ
কিব লোহানী
এক মাইল পর্যন্ত হেঁটে আসা পথ
অজানা একটি বাড়ির সামনে এসে থামলো
বিস্তৃতভাবে প্যানেলিং করা এমন সুন্দর একটি বাড়ি
পরিত্যাক্ত হতে পারে! ভাবাই যায় না।
‘ক্ষমা কোরো আমি যদি কোনো ভাঙ্গা জানালায়
দাঁড়িয়ে তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করি।’ বললো আতিফ
‘বাইরের দরজাগুলো আমাদের এখানে থামিয়ে দিতে চাইছে
এখানে যিনি বসবাস করতেন আমি তাঁর সাথে তোমার
পরিচয় করিয়ে দিতে চাই।
কবি যিনি কবিতা লিখতেন ও সেগুলো ছাপার অক্ষরে
প্রকাশিত হতো। সব কিছুই ছিলো তাঁর জানালার ভেতরের
সাজানো ফুল আর জানালার বাহিরের পাখিদের নিয়ে।
শরীর তাঁকে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলো
প্রায় সম্পূর্ণ জীবন যাপন বিছানায়, লেখালেখিও বিছানায়।
আমরা ঘরময় ছিটানো ভাঙ্গা কাঁচের টুকরোর
উপর দিয়ে অস্বচ্ছন্দতা নিয়ে এগুচ্ছিলাম।
বাড়িটি থেকে সবকিছু ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে
শুধু কবির কবিতা ছাড়া।
নিঝুম নিস্তব্ধ বাড়ির মেঝেতে কার্টন ভর্তি
একটি পূর্ণ সংস্করণ, উপচে বাইরে পড়ছে প্রাচুর্যের মতো
অথবা মহিলা-কবির প্রেমিক হৃদয়ের মতো
জানালার পাশে ছড়িয়ে দিয়েছে আলোর দিকে
যেখানে বয়ে আসা বৃষ্টি সেগুলোকে
ভিজিয়ে ফুলিয়ে ফেলেছে।
দুষ্টু ছেলে ও অপেশাদার শিকারীরা জানতো কী করতে হবে,
পাথর ও সীসার গুলতি মেরে অরক্ষিত জানালাগুলোকে
ভেঙ্গে চুরমার করেছে, ঝাড় না দেয়া মেঝেতে সেই কাঁচ ছড়িয়ে,
কবিতার স্নিগ্ধ চরণগুলো এই আগ্রাসন থেকে কীভাবে রক্ষা পেলো?
বই কি অপ্রয়োজনীয় কারণে ছুঁড়ে ফেলা হয়?
ওরা ওখানে পড়ে থাকে এখন বা কখনো
যখন কেউ অল্প খুলে দেখে পায়ের কাছে ফেলে দেয়।
এখানে এসবই ছিলো বিক্রি করা বা বিলিয়ে দেয়ার জন্য।
আতিফ, কার্টনের গভীর থেকে কুমারী মোড়কে ঢাকা
একটি নতুন বই তুলে নিলো
সে একটি পড়তে থাকলো আমি একটি,
চিলেকোঠার বোলতাগুলো নিমিষে হারিয়ে গেছে।
বাড়ি ফিরে আসার পথে পকেটে থাকা
ছোট বইটির কথা বারবার মনে পড়ছিলো
সেটি পকেটেই ছিলো। আমি জানি স্বর্গে বসে
মহিলা-কবি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, হৃদয় ভারমুক্ত
হয়েছে অন্তত একটি বই সুন্দরভাবে চলে গেছে বলে।
তাঁর উপর আমার দাবি, যদিও সামান্য, দাবিই বটে,
প্রচেষ্টাটি তিনি কি অনুভব করেছেন? একসময়, তিনি
তাঁর সবগুলো বই থেকেই পরিত্রাণ পাবেন।
পুরোনো প্রাসাদ
শেখ মাসুম কামাল
কল্পনা করো, তুমি দাঁড়িয়ে আছো
পুরোনো কোনো প্রাসাদের সামনে, প্রাসাদের বাইরে
বাহারি আঙিনা, আঙিনায়
পাষাণ-মূর্তির শিউলি-ভেজা হাতে
রাজহংসীর পালক, ঘন-কালো কেশ এবং
চরণচিহ্ন অগণিত মানুষের,
বহুকাল আগের,
একালে খুব নগণ্য একটা টেবিল
পড়ে আছে প্রাসাদের বাইরে। প্রাসাদের অভ্যন্তরে
ঐশ্বর্যের ফুটফুটে চাঁদ, চঞ্চলতা নেই
নেই কোনো কোলাহল। কালের সাগরে ডুবে গেছে
প্রাসাদের অতীত যৌবন।
অন্তিমে দিশাশিখা
মনজুর শামস
সামনের অবোধ্য দৃশ্যে মুমূর্ষুর ঘোলাচোখ মেলে তাকালাম
মরণশয্যায় হাল ছেড়ে দেয়া জীবনের শেষদৃশ্য দেখে নেয়ার
নিরাবেগ আকুতির মতো; অনিবার্য- কিন্তু আকাক্সক্ষাহীন
অনেকটা বছরের শেষ দিনটির শেষ প্রহরের রুটিনকাজের মতো
দেখলাম- ফুল, প্রজাপতি আর নদী-মাঠ-ঘাটের পাংশুটে অথর্ব যাত্রা
যেন- ফুটতে হয় বলেই ফুটছে, উড়তে হয় বলেই উড়ছে, চলতে হয় বলেই চলছে
বনে বনে আগুন জ¦লছে, দেশে দেশে অসম বাণিজ্যপোতের গনগনে গোলা ছোড়াছুড়ি
লালশালুর জাঁকালো প্রত্যাবর্তনে সদিচ্ছা-আকাশ থেকে শে^ত বলাকাদের মুখ থুবড়ে পড়া
চরম হতাশায় স্বেচ্ছায় শেষ নিশ^াস টেনে নেয়ার আগে টিভিস্ক্রিনে চোখ পড়ে গেলো
দেখলাম- মুহুর্মুহু বোমার আঘাতে গাজার ল-ভ- ধ্বংসস্তূপ থেকে বেঁচে থাকার
উদগ্র আকাক্সক্ষায় মৃত্যুকূপ থেকে জীবনের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে রক্তাক্ত ফিলিস্তিনি শিশু
নিমেষে উধাও হলো মরণদশা, চোখের সামনের আবারো দেখতে পেলাম সবুজের দোল
সূর্যফুল
বাশার মাহফুজ
না।কখনোই না।
বিষাদ ভুলে আঙিনায় ফোটেনি রক্তজবা
ভুল করেও প্রচার হয়নি ভাঁটফুলের ঘ্রাণ!
মিথ্যে সহযাত্রী ভুল নিয়ে ফুল দিয়ে বলেছিল সুখী হও!
প্রজাপতি সকালের কাছে প্রার্থনারত রোদের
মুখ ঝলসে আমাদের দেখা হয়েছিল।
অপ্রচারিত এই আমাকে বিখ্যাত বিলবোর্ডে
ঝুলিয়ে দেওয়া আত্মহনন- শোকের মিছিল
না কখনোই না বিষাদ ভুলে ফোটেনি সূর্যফুল!
দুপরি ক্লান্তিহীন
খালেদ মাহবুব মোর্শেদ
পুষ্পবতীর পদমূলে পুষ্পার্ঘ্য অর্পিতে গিয়ে তুমি
স্বেচ্ছায় ফিরিয়ে দিয়েছিলে নিবেদিত পত্র-মালা;
পুষ্পবতীকে বলিনি আমি অতীতের সে কাহিনী
প্রীতিমাখা স্মৃতিপলি প্রাণে পুষে আজো পথ চলি।
সচেতন সুখানুভাবে জমাই পলি
জীবনের জয়মালা পরাজয়ে যাই পদে দলি...
চারপাশে নয় কেউ পুরোপুরি সুখি
সময় কাটায় সবে পুষে দীর্ঘশ্বাস মুখোমুখি।
চেয়ে দেখি অপুষ্পক রয়ে গেলো তোমার বাগান
প্রাক্তন প্রেমের নামে পতাকা উড়িয়ে আমি গাই
ক্লানিহীন বিরহের ¯িœগ্ধ জয়গান।
নাকছাবি
রাকিবুল রকি
কিছু কদম শুকিয়ে আছে স্মৃতির আলমিরায়
বৃষ্টি পড়ে মন-উঠোনে অভিমানী ঘৃণায়
ঘৃণার উল্টো পিঠেই থাকে প্রেমের আবাহন
পথ বন্ধ, হাঁটে তবু ছাতা ছাড়া মন
ভেঁজা পাতার ভ্যাপসা ঘ্রাণই হলো স্মৃতির চাবি
তুমি হয়ে উঠেছে আজ তোমারই নাকছাবি।
সোনাবরণ নদী
ফাহমিদা লাইজু
এখানে পা ডুবিয়ে ছিলাম একদিন
নৌকায় বসে, ছলছল শব্দ তুলে-
শেষ বিকেলে, সূর্যের বিদায় রশ্মির অবকাশে।
আশ্চর্য আর ভীত হয়ে দেখলাম, আমার পা দুটো
সোনালি হয়ে গেছে!
আমার উপর যেমন সোনার প্রলেপ দেয় কর্মকার-
হাতুড়ির পিটুনি আর গনগনে আগুন;
প্রয়োজন হলো না তেমন কিছুর।
ছিল শুধু কোমল ভালবাসার একবিন্দু-
লোভাতুর মন, লালসা কিলবিল করে
হাতছানি দেয়-
ঝাঁপ দাও!
সোনার বরণে সাজাও গাত্র!
শকুনের চোখ ফের খসখসে রং খুবলে খায়;
এতদিনের অভিযোগ- কালো বরণ,
প্রকৃতির দীনতা মোচন হলো বলে
কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে।
এত সুন্দর সোনা বরণ নদীর বুকে
দু’ফোঁটা লোনাজল মিশে যায়,
কষ্টে না-কি আনন্দে বোঝা বড় দায়।
এক সুতো কাশফুল উড়ে এসে নাকে লাগে
অদ্ভুত মায়ার চাদরে ঢেকে যায় সময়
আর পাওয়া হয় না, চেয়েছি যা।
এখন আমি যেদিকে হাঁটি,
সামনের সব ছেয়ে যায় সোনালি আভায়,
পেছনে থাকে শুধু নিকষকালো অন্ধকার।