মুনীর সিরাজ
প্রাক-কথন
এক বছরের কিছু বেশি সময় আগে আমার ছেলে সুহাব যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি প্রদেশের ন্যু-আর্ক শহর থেকে জার্সি সিটিতে তার আবাসস্থল পরিবর্তন করে। সেই সুবাদে এই আমার দ্বিতীয়বার জার্সি সিটিতে আসা। ২০ এপ্রিল ২০২৫। যেখানে গমন যেখানেই ভ্রমণ। সেই স্থানের মানুষ, ইতিহাস, বসবাস, সংস্কৃতি, ভাষা ইত্যাদি জানার একটা তীব্র বাসনা আমাকে পেয়ে বসে। তারই ফলশ্রুতি জার্সি সিটি নিয়ে এই নিবন্ধ।
জার্সি সিটি
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি প্রদেশের জার্সি সিটি শহরটি জনসংখ্যার দিক থেকে নিউ জার্সির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এর বর্তমান জনসংখ্যা (২০২০-২১) ২,৯২,৪৪৯ জন। চল্লিশটি ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা এখানে ৫২ শতাংশ। ২০২০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই শহরের ৪২.৫ শতাংশ মানুষ বহিরাগত, অর্থ্যাৎ তাদের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অন্য কোনো দেশে। জাতিগত বিভাজনের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এই শহরটিই সবচেয়ে বৈচিত্র্যময়। জার্সি সিটির পূর্ব পাশে বিশাল হাডসন নদী, নিউইয়র্ক উপসাগর, হ্যাক এন্ড স্যাক নদী এবং ন্যু-আর্ক উপসাগর।
সম্মিলিতভাবে জার্সি সিটির পূর্ব দিকের জলসীমা ৩০.৭ মাইল। এই বিশাল জলসীমার সুবাদে নিউইয়র্ক নিউ জর্সি নৌ-বন্দর এবং জার্সি নৌবন্দরে মহাসাগরীয় জাহাজ চলাচল করে। হল্যান্ড টানেল, দ্রুত চলাচলের জন্য রেললাইন ‘পাথ’ ও বন্দরের ফেরি চলাচলের মাধ্যমে এই শহর নিউ ইয়র্ক শহরের ইতিহাস বিখ্যাত ম্যানহাটনের সাথে যুক্ত।
ওলন্দাজদের আগমন
ইউরোপীয় ডাচ্ নাগরিকরাই প্রথম জার্সি সিটির পত্তন শুরু করে। ডাচ্রা নেদারল্যান্ডস-এর আদিবাসী, যাদের বাংলা ভাষায় ওলন্দাজ বলে অভিহিত করা হয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে ওলন্দাজরা প্যাভোনিয়াতে বসবাস শুরু করে- যা পরবর্তী সময়ে বার্জেন নামে পরিচিতি লাভ করে। ওলন্দাজদের এই চিরস্থায়ী বসতি স্থাপনের মাধ্যমেই যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি প্রদেশের সূত্রপাত। ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চলটি ইংরেজদের দখলে চলে যায়। ১৮৩৮ সালে জার্সি সিটি, ১৮৫১ সালে ভ্যান ভর্স্ট উপশহর, ১৮৭০ সালে বার্জেন সিটি এবং হাডসন সিটি, ১৮৭৩ সালে গ্রিনভিল সংযুক্ত হয়ে বৃহত্তর জার্সি সিটির পত্তন ঘটে।
লু-এর জার্সি থিয়েটার, হোয়াইট ঈগল হল, লিবার্টি সাইন্স সেন্টার, এলিস আইল্যান্ড জাদুঘর, আধুনিক চিত্রশিল্পের প্রতিষ্ঠান ‘মানা’ এবং জার্সি সিটির ইতিহাসের জাদুঘর- এই শহরের ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক পরিম-লের পরিচায়ক।
নিউ নেদারল্যান্ড
এখন যা জার্সি সিটি নামে পরিচিত সেখানে একসময় বসবাস করত আমেরিকান আদি আধিবাসীদের লেনাপি নামে পরিচিত একটি উপজাতি। পরে তারা স্থান ত্যাগে বাধ্য হয়ে দেলোয়ারে ইন্ডিয়ান নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে হেনরি হাডসন নামক এক ওলন্দাজ নাবিক পূর্ব এশিয়ার খোঁজে ভুল পথে একটি ছোট ‘অর্ধচন্দ্র (Half Mean ev Half-moon)’ নামক সমুদ্রগামী জাহাজে জার্সি সিটির উত্তরে নদীতে নোঙর করে। এরই ফলে এই অঞ্চল শাসন ও নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৬২১ খ্রিস্টাব্দে Dutch West Indian Company প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং ১৬২৩ সালে জার্সি সিটি ও তার সংলগ্ন এলাকার নতুন নামকরণ করা হয় ‘নিউ নেদারল্যান্ড’। নিউ নেদারল্যান্ডকে হল্যান্ড-এর একটি প্রদেশের মর্যাদা দেয়া হয়। ওলন্দাজ অধিকৃত নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের দক্ষিণাঞ্চলের নাম ছিল New Amsterdam। এই নতুন আমস্টারডাম থেকেই ওলন্দাজ কর্তৃপক্ষ নিউ নেদারল্যান্ড-এর প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করত।
নিউ আমস্টারডাম-এর কর্তৃপক্ষ মাইকেল রেনির্য়েজ পৌ নামক এক ব্যক্তিকে ওলন্দাজ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় একখ- জমি অনুদান প্রদান করেন। শর্ত ছিল এই যে তিনি উক্ত এলাকায় চার বছরে অন্তত ৫০ জন ওলন্দাজ নাগরিকদের একটি বসতি গড়ে তুলবেন। রেনির্য়েজ হাডসন নদীর পশ্চিম পারের জার্সি এলাকা পছন্দ করেন এবং স্থানীয় লেনাপি উপজাতির কাছ থেকে ৮০ ফ্যাদম ওয়ামপাম (ঝিনুক থেকে সংগৃহীত মুক্তার মালা-১৪৬ মিটার), ২০ ফ্যাদম (৩৭ মিটার) কাপড়, ১২ টি কেটলি, ৬টি বন্দুক, ২টি কম্বল, একটি জোড়া কেটলি এবং আধা ব্যারেল বিয়ারের বিনিময়ে এক খ- জমি অধিগ্রহণ করেন। ১৬৩০ সালের ২২ নভেম্বর এই চুক্তি সম্পাদিত হয়। তবে রেনির্য়েজ তার দায়িত্বে অমনোযোগী ছিলেন এবং ১৬৩৩ সালে তিনি তার কাজে ব্যর্থ হয়ে পুরো সম্পত্তি কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেন। ক্রমান্বয়ে স্থানীয় প্রশাসক পরিবর্তিত হতে থাকে। নতুন নতুন দালান-কোঠা নির্মিত হতে থাকে। উক্ত বছরেই কমিউনিপো এলকায় নতুন সুপারিনটেনডেন্ট নিযুক্ত হন জ্যাঁ এভারস্টেন বাউট। পরে কর্নেলিয়াস হেনরিক ভ্যান ভর্স্ট স্থানীয় প্রশাসক নিযুক্ত হন। তিনি রেনির্য়েজ পৌ-এর ‘পৗ’ শব্দের ল্যাটিন অর্থে স্থানটি নাম করেন ‘প্যাভোানিয়া’। তিনি ওলন্দাজদের মধ্যে প্রভাবশালী ছিলেন। কিন্তু স্থানীয় লেনাপি জনসাধারণের সাথে তার সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে।
ওলন্দাজ-লেনাপি যুদ্ধ
স্থানীয় মহাপরিচালক উইলিয়াম ক্লেফ্টের কারণেই প্রধানত স্থানীয় উপজাতি ও ওলন্দাজদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কেøফ্ট স্থানীয় আদি জনসাধারনের উপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে দেন এবং তাদেরকে উচ্ছেদ করার কাজে লিপ্ত হন। উইলিয়াম লেনাপিদের সাথে যুদ্ধ বাধিয়ে দেন। ‘ক্লেফ্ট্স ওয়ার’ নামে এই যুদ্ধ পরিচিত। ওলন্দাজদের নির্মম হত্যাকা-ে প্যাভোনিয়াতে ১৬৪৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি এই যুদ্ধে ১২০ জন লেনাপি নিহত হন। ক্লেফ্টের পরিবর্তে ১৬৪৭ সালে পিটার সুইভেসান্ট নিউ নেদারল্যান্ডের মহাপরিচালক নিযুক্ত হন। লেনাপি উপজাতি মূলত তিনটি শাখায় বিভক্ত ছিল। ‘মুনছি’ নামে পরিচিত তার একটি শাখা দেলোয়ারে নদীর উপরিভাগের অববাহিকায় বসবাস করত। নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি এবং পেনসিলভেনিয়ার অঞ্চল জুড়ে ছিল এদের আবাসস্থল। ওলন্দাজরা মুনছিদের আক্রমণ করার ফলে উপজাতির লোকেরা ১৬৫৮ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর প্যাভোনিয়া আক্রমণ করে এবং এতে ৪০ জন ওলন্দাজ নিহত হয়। উপজাতির লোকেরা প্রধানত ১০০ ওলন্দাজ নারী ও শিশুকে বন্দি করে নিয়ে যায়।
নিউ জার্সি প্রদেশ
১৬৬৪ সালের ২৭ আগস্ট ইংরেজরা চারটি যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে নিউ ইয়র্ক বন্দরে নোঙর করে। তারা আমাসটারডাম দুর্গ দখল করে নেয়। ক্রমশ তারা সমগ্র নিউ নেদারল্যান্ড এলাকা দখল করে নেয়। এর ফলেই যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় অ্যাঙলো-ডাচ্ যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। ১৬৬৪ সালে একটি ঋণ চুক্তি সম্পাদানের জন্য জেমস নামক ডিউক অব ইয়র্ক হাডসন নদী ও দেলোয়ারে নদীর মধ্যবর্তী স্থলভাগ স্যার জর্জ কার্টারেটকে প্রদান করেন। কার্টারেট নিজ বাড়ি জার্সি দ্বীপের নাম অনুযায়ী স্থানটির নাম করেন ‘নিউ জার্সি’ যা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সমৃদ্ধ প্রদেশ।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে পৌলাস হুক এলাকায় যাতায়াতের জন্য দৃঢ় ঘোড়ার গাড়ির (Coach) প্রচলন করা হয়। এই ঘোড়ার গাড়িগুলি চারটি ঘোড়া এবং কখনো ছয়টি ঘোড়া দিয়ে টানা হতো। ঢাকার ঘোড়ার গাড়ি চালাকেরা এখনও কোচোয়ান বা গাড়োয়ান নামে পরিচিত। কার্টারেট নিউ জার্সি ও নিউ ইয়র্কের মধ্যে ‘ফেরি’ সার্ভিসেরও প্রচলন করেন। ১৭৭৬ সালে আমেরিকান বিপ্লবের নেতা জেনারেল জর্জ ওয়াশিংটন হাডসন নদীর পশ্চিমে কয়েকটি দুর্গ নির্মাণ করেন। তার একটি ছিল পৌলাস হুক নামক স্থানে। উদ্দেশ্য বৃটিশরা যাতে নিউ ইয়র্ক ও নিউ জার্সি আক্রমণ করতে না পারে। কিন্তু ১৭৭৬ সালের ২৩শে মে ব্রিটিশরা পৌলাস হুক দুর্গ দখল করে নেয় । কিন্তু জর্জ ওয়াশিংটন ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করে ব্রিটিশদের পরাজিত করেন এবং ২২ নভেম্বর ১৭৮৩ সালে ব্রিটিশ সৈন্য বাহিনী পৌলাস হুক পরিত্যাগ করে চলে যান।
নিউ ইয়র্ক, ন্যু-আর্ক, নিউ জার্সি
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ১৮০৪ সালে আলেকজান্ডার হ্যামিনটন নামক এক ব্যক্তি বৃহত্তর নিউ ইয়র্ক শহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন এবং ভবিষ্যত বাণী করেন যে, ‘হাডসন নদীর পূর্ব পারে একদিন একটি বিশাল শহর গড়ে উঠবে’। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পর নিউ নেদারল্যান্ড নামে খ্যাত সকল ছোট ছোট উপশহরগুলিকে একীভূত করে জার্সি সিটির পরিপূর্ণ রূপ প্রনয়ণ করা হয়। হ্যাক এ্যান্ড স্যাক নদীর পূর্ব পারের হাডসন কাউন্টি (হাডসন শহর). বার্জেন সিটি, গ্রীনভিল-জার্সি সিটির সাথে সংযুক্ত করে একটি মিউনিসিপালিটি গড়ে তোলা হয় এবং ওলন্দাজ শাসিত নিউ নেদারল্যান্ড এলাকাটিতে ১৮৭০ সালের ৩ মে তারিখে বৃহত্তর জার্সি সিটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দীর প্রাক্কালে জার্সি সিটি এবং ন্যু-আর্ক শহর- শিক্ষা, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, পথ ঘাট, টানেল, পুল, আকাশচুম্বি অট্টলিকা এবং বিভিন্ন বর্ণ-গোত্রের আধিবাসীদের নিয়ে আরো সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। ন্যু-আর্ক এবং নিউ জার্সি শহর দুটি এখন নিউ ইয়র্ক শহরের সাথে পাল্লা দিয়েই বেড়ে উঠছে।
জার্সি সিটির লেনাপি জনগোষ্টীর পরিণতি
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান নিউ জার্সি প্রদেশ কোনো জনমানবশূন্য বিরানভূমি ছিল না। পেলিও-ইন্ডিয়ান গোষ্ঠীর মানুষরা এখানে বসবাস শুরু করে ১৩০০০ বছর আগে থেকে। পরে এ স্থানটিতে লেন্নি-লেনাপি জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা বসবাস শুরু করে। ইউরোপিয়ানরা আসার আগে এই সমস্ত এলাকায় লেন্নি-লেনাপিরাই বাস করত। তাদের বাসস্থান ‘লেন-আপি’ নামে পরিচিত ছিল যার অর্থ হচ্ছে ‘আমরা আবার এসেছি এখানে’। লেন্নি-লেনাপি অর্থ হচ্ছে মূল জনগোষ্ঠী (Original People)। ইউরোপীয়দের মধ্যে ওলন্দাজরাই প্রথম লেনাপিদের সংস্পর্শে আসে এবং এই জাতিগোষ্ঠীকে তারা ‘বন্য-জংলি’ মানুষ The wild men of the woods’ বলে সম্বোধন করত। স্থানীয়রা তাদের আবাসভূমিকে Lenapi hoking নামেও পরিচয় প্রদান করত, অর্থাৎ আমাদের আবাসভূমি- ‘The land where we dwell’। ওলন্দাজরা প্রথম লেনাপিদের আবাসস্থলকে Gershok নামকরণ করে পরে তা বদলে করা হয় জার্সি (Jersey)।
১৫২৪ সালে জিওভানি দ্য ভেরাজ্জানো নামে এক ওলন্দাজ তার জাহাজ নিউ ইয়র্ক উপসাগরের নিচের দিকে নোঙর করেন। ইউরোপীয়ানদের মধ্যে তিনিই প্রথম লেনাপি জনগোষ্ঠীর সংস্পর্শে আসেন। ক্রমশ ওলন্দাজরা অসম শর্তে লেনাপিদের জমি ক্রয় করতে থাকেন। ১৬৫৫ সালের মধ্যে এই স্থানটি নিউ নেদারল্যান্ড নাম হয়ে যায় এবং লেনাপিদের দান করা ম্যানহাটনের দক্ষিণ অংশের নাম দেয়া হয় নিউ আমস্টারডাম। এখান খেকেই ওলন্দাজরা তাদের প্রশাসন পরিচালনা করত। প্যাভোনিয়া চুক্তির ফলে ওলন্দাজরা ম্যানহাটন দ্বীপ, হ্যাক এন্ড স্যাক এবং পাসায়েক নদীর অববাহিকায় জমি অধিগ্রহণ করতে সক্ষম হয়। প্যাভোনিয়াই মূলত বর্তমানের জার্সি সিটি। ইউরোপীয়ানদের সাথে একের পর এক যুদ্ধ, বসন্ত, কলেরা, টাইফয়েড ইত্যাদি রোগে মূল জনগোষ্ঠীর বহু মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ক্রমশ তারা দুর্বল ও শক্তিহীন হয়ে পড়ে। রোগমুক্ত স্থানীয় লোকের বহুলাংশ ইউরোপিয়ান ভাইরাস ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করে। ক্রমশ ইউরোপীয় আধিপত্যের কারণে জার্সি সিটি এবং নিউ জার্সি সহ প্রায় সমগ্র আমেরিকাতে স্থানীয় জনগোষ্ঠী প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। বর্তমানে আমেরিকার জনসংখ্যার শুধু ২ শতাশং আদিবাসীদের দ্বারা সংগঠিত।
বর্তমানে লেন্নি-লেনাপির জনসংখ্যা দুই লক্ষ। জার্সি সিটির আশেপাশে আরেসিক, কোভেন পয়েন্ট, কমোনিপো, হারসিমার্ক এবং গ্রিনভিল নামক ছোট ছোট স্থানে তারা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে বসবাস করছে।
মুনীর সিরাজ
বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫
প্রাক-কথন
এক বছরের কিছু বেশি সময় আগে আমার ছেলে সুহাব যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি প্রদেশের ন্যু-আর্ক শহর থেকে জার্সি সিটিতে তার আবাসস্থল পরিবর্তন করে। সেই সুবাদে এই আমার দ্বিতীয়বার জার্সি সিটিতে আসা। ২০ এপ্রিল ২০২৫। যেখানে গমন যেখানেই ভ্রমণ। সেই স্থানের মানুষ, ইতিহাস, বসবাস, সংস্কৃতি, ভাষা ইত্যাদি জানার একটা তীব্র বাসনা আমাকে পেয়ে বসে। তারই ফলশ্রুতি জার্সি সিটি নিয়ে এই নিবন্ধ।
জার্সি সিটি
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি প্রদেশের জার্সি সিটি শহরটি জনসংখ্যার দিক থেকে নিউ জার্সির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এর বর্তমান জনসংখ্যা (২০২০-২১) ২,৯২,৪৪৯ জন। চল্লিশটি ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা এখানে ৫২ শতাংশ। ২০২০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই শহরের ৪২.৫ শতাংশ মানুষ বহিরাগত, অর্থ্যাৎ তাদের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অন্য কোনো দেশে। জাতিগত বিভাজনের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এই শহরটিই সবচেয়ে বৈচিত্র্যময়। জার্সি সিটির পূর্ব পাশে বিশাল হাডসন নদী, নিউইয়র্ক উপসাগর, হ্যাক এন্ড স্যাক নদী এবং ন্যু-আর্ক উপসাগর।
সম্মিলিতভাবে জার্সি সিটির পূর্ব দিকের জলসীমা ৩০.৭ মাইল। এই বিশাল জলসীমার সুবাদে নিউইয়র্ক নিউ জর্সি নৌ-বন্দর এবং জার্সি নৌবন্দরে মহাসাগরীয় জাহাজ চলাচল করে। হল্যান্ড টানেল, দ্রুত চলাচলের জন্য রেললাইন ‘পাথ’ ও বন্দরের ফেরি চলাচলের মাধ্যমে এই শহর নিউ ইয়র্ক শহরের ইতিহাস বিখ্যাত ম্যানহাটনের সাথে যুক্ত।
ওলন্দাজদের আগমন
ইউরোপীয় ডাচ্ নাগরিকরাই প্রথম জার্সি সিটির পত্তন শুরু করে। ডাচ্রা নেদারল্যান্ডস-এর আদিবাসী, যাদের বাংলা ভাষায় ওলন্দাজ বলে অভিহিত করা হয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে ওলন্দাজরা প্যাভোনিয়াতে বসবাস শুরু করে- যা পরবর্তী সময়ে বার্জেন নামে পরিচিতি লাভ করে। ওলন্দাজদের এই চিরস্থায়ী বসতি স্থাপনের মাধ্যমেই যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি প্রদেশের সূত্রপাত। ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চলটি ইংরেজদের দখলে চলে যায়। ১৮৩৮ সালে জার্সি সিটি, ১৮৫১ সালে ভ্যান ভর্স্ট উপশহর, ১৮৭০ সালে বার্জেন সিটি এবং হাডসন সিটি, ১৮৭৩ সালে গ্রিনভিল সংযুক্ত হয়ে বৃহত্তর জার্সি সিটির পত্তন ঘটে।
লু-এর জার্সি থিয়েটার, হোয়াইট ঈগল হল, লিবার্টি সাইন্স সেন্টার, এলিস আইল্যান্ড জাদুঘর, আধুনিক চিত্রশিল্পের প্রতিষ্ঠান ‘মানা’ এবং জার্সি সিটির ইতিহাসের জাদুঘর- এই শহরের ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক পরিম-লের পরিচায়ক।
নিউ নেদারল্যান্ড
এখন যা জার্সি সিটি নামে পরিচিত সেখানে একসময় বসবাস করত আমেরিকান আদি আধিবাসীদের লেনাপি নামে পরিচিত একটি উপজাতি। পরে তারা স্থান ত্যাগে বাধ্য হয়ে দেলোয়ারে ইন্ডিয়ান নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে হেনরি হাডসন নামক এক ওলন্দাজ নাবিক পূর্ব এশিয়ার খোঁজে ভুল পথে একটি ছোট ‘অর্ধচন্দ্র (Half Mean ev Half-moon)’ নামক সমুদ্রগামী জাহাজে জার্সি সিটির উত্তরে নদীতে নোঙর করে। এরই ফলে এই অঞ্চল শাসন ও নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৬২১ খ্রিস্টাব্দে Dutch West Indian Company প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং ১৬২৩ সালে জার্সি সিটি ও তার সংলগ্ন এলাকার নতুন নামকরণ করা হয় ‘নিউ নেদারল্যান্ড’। নিউ নেদারল্যান্ডকে হল্যান্ড-এর একটি প্রদেশের মর্যাদা দেয়া হয়। ওলন্দাজ অধিকৃত নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের দক্ষিণাঞ্চলের নাম ছিল New Amsterdam। এই নতুন আমস্টারডাম থেকেই ওলন্দাজ কর্তৃপক্ষ নিউ নেদারল্যান্ড-এর প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করত।
নিউ আমস্টারডাম-এর কর্তৃপক্ষ মাইকেল রেনির্য়েজ পৌ নামক এক ব্যক্তিকে ওলন্দাজ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় একখ- জমি অনুদান প্রদান করেন। শর্ত ছিল এই যে তিনি উক্ত এলাকায় চার বছরে অন্তত ৫০ জন ওলন্দাজ নাগরিকদের একটি বসতি গড়ে তুলবেন। রেনির্য়েজ হাডসন নদীর পশ্চিম পারের জার্সি এলাকা পছন্দ করেন এবং স্থানীয় লেনাপি উপজাতির কাছ থেকে ৮০ ফ্যাদম ওয়ামপাম (ঝিনুক থেকে সংগৃহীত মুক্তার মালা-১৪৬ মিটার), ২০ ফ্যাদম (৩৭ মিটার) কাপড়, ১২ টি কেটলি, ৬টি বন্দুক, ২টি কম্বল, একটি জোড়া কেটলি এবং আধা ব্যারেল বিয়ারের বিনিময়ে এক খ- জমি অধিগ্রহণ করেন। ১৬৩০ সালের ২২ নভেম্বর এই চুক্তি সম্পাদিত হয়। তবে রেনির্য়েজ তার দায়িত্বে অমনোযোগী ছিলেন এবং ১৬৩৩ সালে তিনি তার কাজে ব্যর্থ হয়ে পুরো সম্পত্তি কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেন। ক্রমান্বয়ে স্থানীয় প্রশাসক পরিবর্তিত হতে থাকে। নতুন নতুন দালান-কোঠা নির্মিত হতে থাকে। উক্ত বছরেই কমিউনিপো এলকায় নতুন সুপারিনটেনডেন্ট নিযুক্ত হন জ্যাঁ এভারস্টেন বাউট। পরে কর্নেলিয়াস হেনরিক ভ্যান ভর্স্ট স্থানীয় প্রশাসক নিযুক্ত হন। তিনি রেনির্য়েজ পৌ-এর ‘পৗ’ শব্দের ল্যাটিন অর্থে স্থানটি নাম করেন ‘প্যাভোানিয়া’। তিনি ওলন্দাজদের মধ্যে প্রভাবশালী ছিলেন। কিন্তু স্থানীয় লেনাপি জনসাধারণের সাথে তার সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে।
ওলন্দাজ-লেনাপি যুদ্ধ
স্থানীয় মহাপরিচালক উইলিয়াম ক্লেফ্টের কারণেই প্রধানত স্থানীয় উপজাতি ও ওলন্দাজদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কেøফ্ট স্থানীয় আদি জনসাধারনের উপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে দেন এবং তাদেরকে উচ্ছেদ করার কাজে লিপ্ত হন। উইলিয়াম লেনাপিদের সাথে যুদ্ধ বাধিয়ে দেন। ‘ক্লেফ্ট্স ওয়ার’ নামে এই যুদ্ধ পরিচিত। ওলন্দাজদের নির্মম হত্যাকা-ে প্যাভোনিয়াতে ১৬৪৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি এই যুদ্ধে ১২০ জন লেনাপি নিহত হন। ক্লেফ্টের পরিবর্তে ১৬৪৭ সালে পিটার সুইভেসান্ট নিউ নেদারল্যান্ডের মহাপরিচালক নিযুক্ত হন। লেনাপি উপজাতি মূলত তিনটি শাখায় বিভক্ত ছিল। ‘মুনছি’ নামে পরিচিত তার একটি শাখা দেলোয়ারে নদীর উপরিভাগের অববাহিকায় বসবাস করত। নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি এবং পেনসিলভেনিয়ার অঞ্চল জুড়ে ছিল এদের আবাসস্থল। ওলন্দাজরা মুনছিদের আক্রমণ করার ফলে উপজাতির লোকেরা ১৬৫৮ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর প্যাভোনিয়া আক্রমণ করে এবং এতে ৪০ জন ওলন্দাজ নিহত হয়। উপজাতির লোকেরা প্রধানত ১০০ ওলন্দাজ নারী ও শিশুকে বন্দি করে নিয়ে যায়।
নিউ জার্সি প্রদেশ
১৬৬৪ সালের ২৭ আগস্ট ইংরেজরা চারটি যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে নিউ ইয়র্ক বন্দরে নোঙর করে। তারা আমাসটারডাম দুর্গ দখল করে নেয়। ক্রমশ তারা সমগ্র নিউ নেদারল্যান্ড এলাকা দখল করে নেয়। এর ফলেই যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় অ্যাঙলো-ডাচ্ যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। ১৬৬৪ সালে একটি ঋণ চুক্তি সম্পাদানের জন্য জেমস নামক ডিউক অব ইয়র্ক হাডসন নদী ও দেলোয়ারে নদীর মধ্যবর্তী স্থলভাগ স্যার জর্জ কার্টারেটকে প্রদান করেন। কার্টারেট নিজ বাড়ি জার্সি দ্বীপের নাম অনুযায়ী স্থানটির নাম করেন ‘নিউ জার্সি’ যা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সমৃদ্ধ প্রদেশ।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে পৌলাস হুক এলাকায় যাতায়াতের জন্য দৃঢ় ঘোড়ার গাড়ির (Coach) প্রচলন করা হয়। এই ঘোড়ার গাড়িগুলি চারটি ঘোড়া এবং কখনো ছয়টি ঘোড়া দিয়ে টানা হতো। ঢাকার ঘোড়ার গাড়ি চালাকেরা এখনও কোচোয়ান বা গাড়োয়ান নামে পরিচিত। কার্টারেট নিউ জার্সি ও নিউ ইয়র্কের মধ্যে ‘ফেরি’ সার্ভিসেরও প্রচলন করেন। ১৭৭৬ সালে আমেরিকান বিপ্লবের নেতা জেনারেল জর্জ ওয়াশিংটন হাডসন নদীর পশ্চিমে কয়েকটি দুর্গ নির্মাণ করেন। তার একটি ছিল পৌলাস হুক নামক স্থানে। উদ্দেশ্য বৃটিশরা যাতে নিউ ইয়র্ক ও নিউ জার্সি আক্রমণ করতে না পারে। কিন্তু ১৭৭৬ সালের ২৩শে মে ব্রিটিশরা পৌলাস হুক দুর্গ দখল করে নেয় । কিন্তু জর্জ ওয়াশিংটন ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করে ব্রিটিশদের পরাজিত করেন এবং ২২ নভেম্বর ১৭৮৩ সালে ব্রিটিশ সৈন্য বাহিনী পৌলাস হুক পরিত্যাগ করে চলে যান।
নিউ ইয়র্ক, ন্যু-আর্ক, নিউ জার্সি
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ১৮০৪ সালে আলেকজান্ডার হ্যামিনটন নামক এক ব্যক্তি বৃহত্তর নিউ ইয়র্ক শহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন এবং ভবিষ্যত বাণী করেন যে, ‘হাডসন নদীর পূর্ব পারে একদিন একটি বিশাল শহর গড়ে উঠবে’। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পর নিউ নেদারল্যান্ড নামে খ্যাত সকল ছোট ছোট উপশহরগুলিকে একীভূত করে জার্সি সিটির পরিপূর্ণ রূপ প্রনয়ণ করা হয়। হ্যাক এ্যান্ড স্যাক নদীর পূর্ব পারের হাডসন কাউন্টি (হাডসন শহর). বার্জেন সিটি, গ্রীনভিল-জার্সি সিটির সাথে সংযুক্ত করে একটি মিউনিসিপালিটি গড়ে তোলা হয় এবং ওলন্দাজ শাসিত নিউ নেদারল্যান্ড এলাকাটিতে ১৮৭০ সালের ৩ মে তারিখে বৃহত্তর জার্সি সিটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দীর প্রাক্কালে জার্সি সিটি এবং ন্যু-আর্ক শহর- শিক্ষা, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, পথ ঘাট, টানেল, পুল, আকাশচুম্বি অট্টলিকা এবং বিভিন্ন বর্ণ-গোত্রের আধিবাসীদের নিয়ে আরো সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। ন্যু-আর্ক এবং নিউ জার্সি শহর দুটি এখন নিউ ইয়র্ক শহরের সাথে পাল্লা দিয়েই বেড়ে উঠছে।
জার্সি সিটির লেনাপি জনগোষ্টীর পরিণতি
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান নিউ জার্সি প্রদেশ কোনো জনমানবশূন্য বিরানভূমি ছিল না। পেলিও-ইন্ডিয়ান গোষ্ঠীর মানুষরা এখানে বসবাস শুরু করে ১৩০০০ বছর আগে থেকে। পরে এ স্থানটিতে লেন্নি-লেনাপি জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা বসবাস শুরু করে। ইউরোপিয়ানরা আসার আগে এই সমস্ত এলাকায় লেন্নি-লেনাপিরাই বাস করত। তাদের বাসস্থান ‘লেন-আপি’ নামে পরিচিত ছিল যার অর্থ হচ্ছে ‘আমরা আবার এসেছি এখানে’। লেন্নি-লেনাপি অর্থ হচ্ছে মূল জনগোষ্ঠী (Original People)। ইউরোপীয়দের মধ্যে ওলন্দাজরাই প্রথম লেনাপিদের সংস্পর্শে আসে এবং এই জাতিগোষ্ঠীকে তারা ‘বন্য-জংলি’ মানুষ The wild men of the woods’ বলে সম্বোধন করত। স্থানীয়রা তাদের আবাসভূমিকে Lenapi hoking নামেও পরিচয় প্রদান করত, অর্থাৎ আমাদের আবাসভূমি- ‘The land where we dwell’। ওলন্দাজরা প্রথম লেনাপিদের আবাসস্থলকে Gershok নামকরণ করে পরে তা বদলে করা হয় জার্সি (Jersey)।
১৫২৪ সালে জিওভানি দ্য ভেরাজ্জানো নামে এক ওলন্দাজ তার জাহাজ নিউ ইয়র্ক উপসাগরের নিচের দিকে নোঙর করেন। ইউরোপীয়ানদের মধ্যে তিনিই প্রথম লেনাপি জনগোষ্ঠীর সংস্পর্শে আসেন। ক্রমশ ওলন্দাজরা অসম শর্তে লেনাপিদের জমি ক্রয় করতে থাকেন। ১৬৫৫ সালের মধ্যে এই স্থানটি নিউ নেদারল্যান্ড নাম হয়ে যায় এবং লেনাপিদের দান করা ম্যানহাটনের দক্ষিণ অংশের নাম দেয়া হয় নিউ আমস্টারডাম। এখান খেকেই ওলন্দাজরা তাদের প্রশাসন পরিচালনা করত। প্যাভোনিয়া চুক্তির ফলে ওলন্দাজরা ম্যানহাটন দ্বীপ, হ্যাক এন্ড স্যাক এবং পাসায়েক নদীর অববাহিকায় জমি অধিগ্রহণ করতে সক্ষম হয়। প্যাভোনিয়াই মূলত বর্তমানের জার্সি সিটি। ইউরোপীয়ানদের সাথে একের পর এক যুদ্ধ, বসন্ত, কলেরা, টাইফয়েড ইত্যাদি রোগে মূল জনগোষ্ঠীর বহু মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ক্রমশ তারা দুর্বল ও শক্তিহীন হয়ে পড়ে। রোগমুক্ত স্থানীয় লোকের বহুলাংশ ইউরোপিয়ান ভাইরাস ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করে। ক্রমশ ইউরোপীয় আধিপত্যের কারণে জার্সি সিটি এবং নিউ জার্সি সহ প্রায় সমগ্র আমেরিকাতে স্থানীয় জনগোষ্ঠী প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। বর্তমানে আমেরিকার জনসংখ্যার শুধু ২ শতাশং আদিবাসীদের দ্বারা সংগঠিত।
বর্তমানে লেন্নি-লেনাপির জনসংখ্যা দুই লক্ষ। জার্সি সিটির আশেপাশে আরেসিক, কোভেন পয়েন্ট, কমোনিপো, হারসিমার্ক এবং গ্রিনভিল নামক ছোট ছোট স্থানে তারা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে বসবাস করছে।