alt

সাময়িকী

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি : একটি পর্যবেক্ষণ

কামরুল ইসলাম

: বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫

শিল্পী : রাজিব রায়

(পূর্ব প্রকাশের পর)

৩.

১৯১৮ সালে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় সম্মেলনে ভাষা প-িতদের নিয়ে এক আলোচনা সভায় ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন- ‘শুধু ভারত কেন, সমগ্র এশিয়া মহাদেশেই বাংলা ভাষার স্থান হবে সর্বোচ্চ। ভাব-সম্পদ ও সাহিত্যগুণে বাংলা ভাষা এশিয়ার ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে অদ্বিতীয়।’ ১৯২১ সালে মওলানা আকরম খাঁ, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য বৃটিশ সরকরের কাছে আবেদনও করেছিলেন এবং ১৯২৩ সালে চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে একদল মানুষ ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’-এ সম্প্রদায়গত হিংসা-বিদ্বেষ দূর করার উদ্দেশ্যে বিশেষ করে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এক নিগূঢ় বন্ধন সৃষ্টির জন্য বাংলা ভাষার ব্যাপক প্রসারের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ একটি চুক্তি। এই চুক্তিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।

১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ স্বাধীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষে মত প্রকাশ করলে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এই মতের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর আমাদের ওপর উর্দুকে চাপিয়ে দেবার প্রচেষ্টা কিংবা আরবি হরফে বাংলা লেখার মতো প্রস্তাবনাও ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে করাচিতে এই প্রস্তাব আনা হয় যে ইংরেজির পাশাপাশি উর্দুও পাকিস্তান গণপরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে গণ্য হবে। সংশোধনী প্রস্তাবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি উত্থাপন করেন। তিনি সেদিন আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন- So sir, I am voicing the sentiments of the vast millions of our state and therefore Bengali should not be treated as provincial language. It should be treated as the language of the state.

সেদিন গণপরিষদের মুসলিম সদস্যরা তাঁর প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিল। উর্দুভাষী প্রভাবশালী মুসলিম লীগ নেতা খাজা নাজিমউদ্দীন তীব্রভাবে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানও ব্যক্তিগত আক্রমণ করে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন। আমরা জানি ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের বাঙালি স্পিকার তমিজ উদ্দীন খান রায় দিলেন প্রস্তাবটির বিরুদ্ধে। পরদিন ২৬ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ক্ষোভ ও কষ্ট নিয়ে করাচি ত্যাগ করেছিলেন। ১৯৭১ সালে এই বরেণ্য ভাষাসৈনিককে পাকিস্তানি হানাদাররা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ গঠিত হয় সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদ। আমরা জানি যে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষাদিবস পালন করা হয়ে থাকে। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমুন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন গণপরিষদে বাংলা ভাষা প্রচলনের বিরোধিীতা করায় মার্চ মাসে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে লাঠিলার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করা হয় এবং অনেক ছাত্র নেতাকে গ্রেফতার করা হয়।

২১ মার্চ জিন্নাহ সাহেব ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে সরাসরি ঘোষণা দিলেন- পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে- উর্দু। পরে কার্জন হলেও তিনি একই কথা বললেন। সেখানে ছাত্ররা নো নো করে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। পরে একদল ছাত্র জিন্নাহ সাহেবের সাথে দেখা করে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানালে তিনি তা নাকোচ করে দেন। এই ঘোষণার ফলে এদেশের মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল, তা ক্রমশ বিস্তৃত হতে থাকে। বাঙালি মুসলমানের মোহ ভঙ্গ হয়। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের স্বরূপ উন্মোচিত হয় এবং সর্বস্তরের মানুষ সোচ্চার হয়ে ওঠে। ১৯৪৮ সমালের ৩১ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন- ‘আমরা হিন্দু বা মুসলিম যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি।’ তাঁর এই একটি বাক্য অনেক বাঙালি মুসলমানের মন থেকে মুছে গিয়েছিল তারা বাঙালি না মুসলমান- এই দ্বন্দ্ব। ১৯৫১ সালের ১৬ মার্চ কুমিল্লায় শিক্ষকদের এক সম্মেলনে তিনি সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন- বাংলা ভাষা অবহেলিত হইলে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিদ্রোহ করিব। নতুন ভাষা আরোপ করা পূর্ববঙ্গে গণহত্যারই শামিল হইবে।

গোলাম মুরশিদ বলছেন-

‘সত্যিকার অর্থে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে এ আন্দোলন শুরু হলেও আসলে এ ছিল গণতান্ত্রিক আন্দোলন। অধিকার আদায়ের আন্দোলন। এমনকি ভাষাভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলন। এ আন্দোলনে একদিকে যেমন রাজনীতিকরা যোগ দিচ্ছিলেন, অন্যদিকে তেমনি যোগ দিচ্ছিলেন শিক্ষিত সমাজ- ছাত্র এবং শিক্ষকরা।’ (মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর, একটি নির্দলীয় ইতিহাস, পৃ. ৩৩)

খাজা নাজিম উদ্দীন ১৯৪৮ সালে ভাষা সংগ্রাম পরিষদকে কথা দিয়েছিলন যে, তিনি বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবেন। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুর পর খাজা নাজিম উদ্দিন ১৪ অক্টোবর পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান নিহত হলে ১৭ অক্টোবর তিনি প্রধানমন্ত্রীর অতিরিক্ত দায়িত্ব পান। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয অর্থ সচিব গোলাম মুহম্মদ গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হলে ১৯৫১ সালের ২৪ অক্টোবর তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পূর্ণ দায়িত্ব পান এবং তার আগেকার ওয়াদা আর রাখলেন না। তিনি আবার ভাষার প্রশ্নে সরব হয়ে উঠলেন এবং উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষার করার ঘোষণা দিলেন। তখন নূরুল আমীন মুখ্যমন্ত্রী। ২১ ফেরুয়ারি গুলি হলো ছাত্র-জনতার ওপর। অনেক তরুণ ছাত্র ও জনতা শহিদ হন। যাঁদের মধ্যে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার ও শফিউর উল্লেখযোগ্য। তবে এই পাঁচজন ছাড়াও অনেক মানুষ শহিদ হয়েছিলেন- তাদের সংখ্যা বিভিন্ন বই ও পত্রিকায় বিভিন্ন রকমের রয়েছে। অনেক লাশ গুম করাও হয়েছিল। ব্যাপক সংগ্রামের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা বাধ্য হলো ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে।

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর প্যারিসে ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ সভায় ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এব্যাপারে কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে বসবাসরত রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম নামের দুই প্রবাসীর নাম আমাদের উল্লেখ করতেই হয়। তারাই প্রথম জাতিসংঘের ইউনেস্কোর দপ্তরে চিঠি লিখে এই দাবি জানিয়েছিল। চিঠি পাওয়ার পর ইউনেস্কোর এক কর্মকর্তা আন্না মারিয়া তাদের এই চিঠির প্রশংসা করে জানিয়েছিল এ ব্যাপারে রাষ্ট্রীয়ভাবে যোগাযোগ করতে হবে। পরে তদানীন্তন সরকার প্রধানের বিশেষ উদ্যোগে অনেক চিঠিপত্র আদান-প্রদানের মাধ্যমে এই স্বীকৃতি অর্জিত হয়। অবশ্য এই মাতৃভাষা দিবসের ব্যাপক অর্থ হলো পৃথিবীর প্রত্যেকটি জাতি তার নিজ নিজ ভাষাকে সম্মান দেবে, তাকে বিকশিত করবে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, আদিবাসীসহ মাইনর জাতীগোষ্ঠীর ভাষাগুলোকেও রক্ষা করাসহ সুসংহত করার কথা বলা হয়েছে।

বরাক উপত্যকায় একদা যে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল এবং এগারটি তাজা প্রাণ আত্মাহুতি দিয়েছিল, সে খবর আমাদের অনেকেরই অজানা। অসমীয়াকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে সরকারের এই সিদ্ধান্তের চরম প্রতিবাদ হিসেবে গড়ে উঠেছিল এই আন্দোলন। বরাক উপত্যকার অধিকাংশ মানুষই বাংলায় কথা বলে। এখানে হিন্দু ও মুসলমান প্রায় সমান। শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে আন্দোলনকারীদের ওপর নৃশংসভাবে গুলি চালানো হয়েছিল। আসামের কাছাড় জেলায় ১৯৬১ সালের ১৯ মে সংঘটিত ঘটনাটি তাই বাঙালির দ্বিতীয় ভাষা আন্দোলন হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। ‘বরাক উপত্যকার কবিতা: অতন্দ্র গোষ্ঠী’ নামক প্রবন্ধের গোড়াতেই তপোধীর ভট্টাচার্য বরাক উপত্যকাবাসী বাঙালির দুর্নিবার নিয়তিকে তুলে ধরেছেন, “বাঙালির উত্তাপবলয় থেকে সুদূরতম প্রান্তে বরাক উপত্যকার বঙ্গভাষীজনেরা যতটা তিনদিক ঘেরা পাহাড়ের পাহারায় বন্দী, তার চেয়ে ঢের বেশি নিমজ্জিত তারা স্বখাত সলিলে। মমতাবিহীন কালস্রোতে নির্বাসিত শ্রীভূমির কথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ঐ ভূমি থেকে উৎখাত হওয়ার পরে ছিন্নমূল মানুষের স্বাভাবিক নিরাপত্তাহীনতা ও তজ্জনিত হীনম্মন্যতা হয়ে উঠলো বরাক উপত্যকাবাসী বাঙালির দুর্নিবার নিয়তি। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য এগারটি প্রাণ আহুতি দিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। এরা আরম্ভ জানেন কিন্তু সমাপ্তিটা জানেন না। উনিশ-এ মে তাই চৌত্রিশ বছর পরে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অজ্ঞাতপরিচয়, আর তেতাল্লিশ বছর আগের একুশে ফেব্রুয়ারি প্রতিবেশী সমভাষীদের মধ্যে আজো জ্বলন্ত অগ্নিবলয়।” (একবিংশ, দশ বছর পূর্তি সংখ্যা, নভেম্বর ১৯৯৬)। সেই আন্দোলনের সময় সেদিন কমলা ভট্টাচার্য নামের ১৬ বছরের নামের এক ছাত্রী নিহত হয়েছিলেন। তিনি ঐ বছর ১৭ মে মেট্রিক পরীক্ষা শেষ করেছিলেন। ১৯ তারিখে তিনি শহীদ হন। ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করা প্রথম নারী হিসেবে তিনি ইতিহাসের অংশ হয়ে রয়েছেন। উল্লেখ্য, এই রাজ্যের ৮০ ভাগ মানুষ বাংলায় কথা বলতো। পরে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপে বাংলাকে রাজ্যের দ্বিতীয় সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। (আগামী সংখ্যায় পড়ুন)

ছবি

পিয়াস মজিদের ‘রূপকথার রাস্তাঘাট’

ছবি

নজরুলের নিবেদিত কবিতা : অর্ঘ্যরে শিল্পরূপ

ছবি

বাঘাডাঙা গাঁও

ছবি

বুদ্ধদেব বসুর ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ বিষয়ভাবনা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

পথকবিতা: লোকবাংলার সাধারণ কবিতা

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

ক্ষমতার ভাষার বিপরীতে মাতৃভাষার সাধনা

ছবি

ফিলিস্তিনের বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে অণুগল্প

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

শিল্পী সুনীল কুমারের ‘পথের গল্প’-এর স্বরূপ

ছবি

রাত গভীর

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

‘এ নয় আঁখিজল’

জ্যৈষ্ঠের পদাবলি

ছবি

ওসামা অ্যালোমারের একঝুড়ি খুদে গল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

‘ব্রহ্মপুত্র দাঁড়াও’ কাব্যগ্রন্থে নীলদ্রোহের রেখাপাত

ছবি

নার্গিস-নজরুলের স্মৃতিধন্য দৌলতপুরে একদিন

ছবি

যেভাবে ভেঙেছিল এক মৌনতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

নজরুল সাহিত্যে নন্দনতত্ত্বের প্রেক্ষিত

ছবি

স্বাধীনতার কবি নজরুল

ছবি

নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত প্রতিভা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

দাউদ হায়দার: স্বকীয় ও নির্বাসিত

ছবি

অটোগ্রাফ

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি : একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

আলবেয়ার কামুর গল্পে অস্তিত্বের নিষ্ঠুরতা

ছবি

উপন্যাসের জন্মবীক্ষা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

কানাগলি

ছবি

পার্ল এস বাক-এর কবিতা

tab

সাময়িকী

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি : একটি পর্যবেক্ষণ

কামরুল ইসলাম

শিল্পী : রাজিব রায়

বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫

(পূর্ব প্রকাশের পর)

৩.

১৯১৮ সালে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় সম্মেলনে ভাষা প-িতদের নিয়ে এক আলোচনা সভায় ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন- ‘শুধু ভারত কেন, সমগ্র এশিয়া মহাদেশেই বাংলা ভাষার স্থান হবে সর্বোচ্চ। ভাব-সম্পদ ও সাহিত্যগুণে বাংলা ভাষা এশিয়ার ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে অদ্বিতীয়।’ ১৯২১ সালে মওলানা আকরম খাঁ, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য বৃটিশ সরকরের কাছে আবেদনও করেছিলেন এবং ১৯২৩ সালে চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে একদল মানুষ ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’-এ সম্প্রদায়গত হিংসা-বিদ্বেষ দূর করার উদ্দেশ্যে বিশেষ করে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এক নিগূঢ় বন্ধন সৃষ্টির জন্য বাংলা ভাষার ব্যাপক প্রসারের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ একটি চুক্তি। এই চুক্তিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।

১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ স্বাধীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষে মত প্রকাশ করলে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এই মতের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর আমাদের ওপর উর্দুকে চাপিয়ে দেবার প্রচেষ্টা কিংবা আরবি হরফে বাংলা লেখার মতো প্রস্তাবনাও ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে করাচিতে এই প্রস্তাব আনা হয় যে ইংরেজির পাশাপাশি উর্দুও পাকিস্তান গণপরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে গণ্য হবে। সংশোধনী প্রস্তাবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি উত্থাপন করেন। তিনি সেদিন আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন- So sir, I am voicing the sentiments of the vast millions of our state and therefore Bengali should not be treated as provincial language. It should be treated as the language of the state.

সেদিন গণপরিষদের মুসলিম সদস্যরা তাঁর প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিল। উর্দুভাষী প্রভাবশালী মুসলিম লীগ নেতা খাজা নাজিমউদ্দীন তীব্রভাবে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানও ব্যক্তিগত আক্রমণ করে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন। আমরা জানি ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের বাঙালি স্পিকার তমিজ উদ্দীন খান রায় দিলেন প্রস্তাবটির বিরুদ্ধে। পরদিন ২৬ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ক্ষোভ ও কষ্ট নিয়ে করাচি ত্যাগ করেছিলেন। ১৯৭১ সালে এই বরেণ্য ভাষাসৈনিককে পাকিস্তানি হানাদাররা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ গঠিত হয় সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদ। আমরা জানি যে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষাদিবস পালন করা হয়ে থাকে। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমুন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন গণপরিষদে বাংলা ভাষা প্রচলনের বিরোধিীতা করায় মার্চ মাসে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে লাঠিলার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করা হয় এবং অনেক ছাত্র নেতাকে গ্রেফতার করা হয়।

২১ মার্চ জিন্নাহ সাহেব ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে সরাসরি ঘোষণা দিলেন- পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে- উর্দু। পরে কার্জন হলেও তিনি একই কথা বললেন। সেখানে ছাত্ররা নো নো করে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। পরে একদল ছাত্র জিন্নাহ সাহেবের সাথে দেখা করে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানালে তিনি তা নাকোচ করে দেন। এই ঘোষণার ফলে এদেশের মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল, তা ক্রমশ বিস্তৃত হতে থাকে। বাঙালি মুসলমানের মোহ ভঙ্গ হয়। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের স্বরূপ উন্মোচিত হয় এবং সর্বস্তরের মানুষ সোচ্চার হয়ে ওঠে। ১৯৪৮ সমালের ৩১ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন- ‘আমরা হিন্দু বা মুসলিম যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি।’ তাঁর এই একটি বাক্য অনেক বাঙালি মুসলমানের মন থেকে মুছে গিয়েছিল তারা বাঙালি না মুসলমান- এই দ্বন্দ্ব। ১৯৫১ সালের ১৬ মার্চ কুমিল্লায় শিক্ষকদের এক সম্মেলনে তিনি সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন- বাংলা ভাষা অবহেলিত হইলে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিদ্রোহ করিব। নতুন ভাষা আরোপ করা পূর্ববঙ্গে গণহত্যারই শামিল হইবে।

গোলাম মুরশিদ বলছেন-

‘সত্যিকার অর্থে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে এ আন্দোলন শুরু হলেও আসলে এ ছিল গণতান্ত্রিক আন্দোলন। অধিকার আদায়ের আন্দোলন। এমনকি ভাষাভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলন। এ আন্দোলনে একদিকে যেমন রাজনীতিকরা যোগ দিচ্ছিলেন, অন্যদিকে তেমনি যোগ দিচ্ছিলেন শিক্ষিত সমাজ- ছাত্র এবং শিক্ষকরা।’ (মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর, একটি নির্দলীয় ইতিহাস, পৃ. ৩৩)

খাজা নাজিম উদ্দীন ১৯৪৮ সালে ভাষা সংগ্রাম পরিষদকে কথা দিয়েছিলন যে, তিনি বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবেন। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুর পর খাজা নাজিম উদ্দিন ১৪ অক্টোবর পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান নিহত হলে ১৭ অক্টোবর তিনি প্রধানমন্ত্রীর অতিরিক্ত দায়িত্ব পান। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয অর্থ সচিব গোলাম মুহম্মদ গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হলে ১৯৫১ সালের ২৪ অক্টোবর তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পূর্ণ দায়িত্ব পান এবং তার আগেকার ওয়াদা আর রাখলেন না। তিনি আবার ভাষার প্রশ্নে সরব হয়ে উঠলেন এবং উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষার করার ঘোষণা দিলেন। তখন নূরুল আমীন মুখ্যমন্ত্রী। ২১ ফেরুয়ারি গুলি হলো ছাত্র-জনতার ওপর। অনেক তরুণ ছাত্র ও জনতা শহিদ হন। যাঁদের মধ্যে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার ও শফিউর উল্লেখযোগ্য। তবে এই পাঁচজন ছাড়াও অনেক মানুষ শহিদ হয়েছিলেন- তাদের সংখ্যা বিভিন্ন বই ও পত্রিকায় বিভিন্ন রকমের রয়েছে। অনেক লাশ গুম করাও হয়েছিল। ব্যাপক সংগ্রামের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা বাধ্য হলো ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে।

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর প্যারিসে ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ সভায় ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এব্যাপারে কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে বসবাসরত রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম নামের দুই প্রবাসীর নাম আমাদের উল্লেখ করতেই হয়। তারাই প্রথম জাতিসংঘের ইউনেস্কোর দপ্তরে চিঠি লিখে এই দাবি জানিয়েছিল। চিঠি পাওয়ার পর ইউনেস্কোর এক কর্মকর্তা আন্না মারিয়া তাদের এই চিঠির প্রশংসা করে জানিয়েছিল এ ব্যাপারে রাষ্ট্রীয়ভাবে যোগাযোগ করতে হবে। পরে তদানীন্তন সরকার প্রধানের বিশেষ উদ্যোগে অনেক চিঠিপত্র আদান-প্রদানের মাধ্যমে এই স্বীকৃতি অর্জিত হয়। অবশ্য এই মাতৃভাষা দিবসের ব্যাপক অর্থ হলো পৃথিবীর প্রত্যেকটি জাতি তার নিজ নিজ ভাষাকে সম্মান দেবে, তাকে বিকশিত করবে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, আদিবাসীসহ মাইনর জাতীগোষ্ঠীর ভাষাগুলোকেও রক্ষা করাসহ সুসংহত করার কথা বলা হয়েছে।

বরাক উপত্যকায় একদা যে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল এবং এগারটি তাজা প্রাণ আত্মাহুতি দিয়েছিল, সে খবর আমাদের অনেকেরই অজানা। অসমীয়াকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে সরকারের এই সিদ্ধান্তের চরম প্রতিবাদ হিসেবে গড়ে উঠেছিল এই আন্দোলন। বরাক উপত্যকার অধিকাংশ মানুষই বাংলায় কথা বলে। এখানে হিন্দু ও মুসলমান প্রায় সমান। শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে আন্দোলনকারীদের ওপর নৃশংসভাবে গুলি চালানো হয়েছিল। আসামের কাছাড় জেলায় ১৯৬১ সালের ১৯ মে সংঘটিত ঘটনাটি তাই বাঙালির দ্বিতীয় ভাষা আন্দোলন হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। ‘বরাক উপত্যকার কবিতা: অতন্দ্র গোষ্ঠী’ নামক প্রবন্ধের গোড়াতেই তপোধীর ভট্টাচার্য বরাক উপত্যকাবাসী বাঙালির দুর্নিবার নিয়তিকে তুলে ধরেছেন, “বাঙালির উত্তাপবলয় থেকে সুদূরতম প্রান্তে বরাক উপত্যকার বঙ্গভাষীজনেরা যতটা তিনদিক ঘেরা পাহাড়ের পাহারায় বন্দী, তার চেয়ে ঢের বেশি নিমজ্জিত তারা স্বখাত সলিলে। মমতাবিহীন কালস্রোতে নির্বাসিত শ্রীভূমির কথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ঐ ভূমি থেকে উৎখাত হওয়ার পরে ছিন্নমূল মানুষের স্বাভাবিক নিরাপত্তাহীনতা ও তজ্জনিত হীনম্মন্যতা হয়ে উঠলো বরাক উপত্যকাবাসী বাঙালির দুর্নিবার নিয়তি। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য এগারটি প্রাণ আহুতি দিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। এরা আরম্ভ জানেন কিন্তু সমাপ্তিটা জানেন না। উনিশ-এ মে তাই চৌত্রিশ বছর পরে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অজ্ঞাতপরিচয়, আর তেতাল্লিশ বছর আগের একুশে ফেব্রুয়ারি প্রতিবেশী সমভাষীদের মধ্যে আজো জ্বলন্ত অগ্নিবলয়।” (একবিংশ, দশ বছর পূর্তি সংখ্যা, নভেম্বর ১৯৯৬)। সেই আন্দোলনের সময় সেদিন কমলা ভট্টাচার্য নামের ১৬ বছরের নামের এক ছাত্রী নিহত হয়েছিলেন। তিনি ঐ বছর ১৭ মে মেট্রিক পরীক্ষা শেষ করেছিলেন। ১৯ তারিখে তিনি শহীদ হন। ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করা প্রথম নারী হিসেবে তিনি ইতিহাসের অংশ হয়ে রয়েছেন। উল্লেখ্য, এই রাজ্যের ৮০ ভাগ মানুষ বাংলায় কথা বলতো। পরে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপে বাংলাকে রাজ্যের দ্বিতীয় সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। (আগামী সংখ্যায় পড়ুন)

back to top