বি শে ষ সংখ্যা : নারীর গল্প
দিলারা মেসবাহ
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ : সঞ্জয় দে রিপন
সুরমা বু আমার সহোদরা। একবছর দুই মাসের ফারাক। হাড্ডিসারমায়ের বুকে আমরা নাকি লেপ্টে থাকতাম। মায়ের বুকে দুধের নহর।রঙচটা ব্লাউজ ভিজে সপসপে হয়ে থাকত। আর কোনো শিশু খাদ্যের জোগান ছিল না সংসারে।নানিমা কালিজিরা ভর্তা,লাউ ইত্যাদিরেঁধে খাওয়াতেনমাকে। আঁচলের গেরো থেকে টাকা কড়ি নিঃশব্দে গুঁজে দিতেন পাশের বাড়ির সবুজ মিয়ার হাতে।বাজার করে দিতেন সবুজ ভাই।প্রিয় নীরা খালা হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতেন। ধূসর স্মৃতি কথা।
একটি বিষয় জানান দেয়া জরুরি মনে হলো। মানে আমাদের পিতৃদেব দুই আধ ময়লা লিকলিকে কন্যা শিশুকে টিকটিকির ছাও বিবেচনা করে কচিৎ ফিরে তাকাননি। অ্যাডলফ হিটলার বাবাপরপড়শির মতো বিরাজমান থাকতেন। কিন্তু কর্তৃত্ব ছিল তুঙ্গে।
নানিমা আনাজপাতি কুটতেন বঁটি পেতে। ঘোমটার আড়ালে কান্না গিলে ফেলতেন নিত্য।
চারমাস জান্নাত ভিলার খেদমত করেমুলাডুলি চলে গেলেন। নোনাধরা ভিলা হাপুস নয়নে কাঁদল। জামরুল পাতা কাঁদল,কুয়াতলা, কলপাড়, হাঁড়ি কড়াই কাঁদল। মা কলের পুতুল,দম শেষ। পাথর হয়ে বসে থাকা বিনে আর কোনোকানাগলিও চেনা নেই বেচারি মৌমাছির।
উঠোনেপড়ে না সকালবেলার ঝাঁটা। পোড়ো বাড়ির দশা।হিটলার বাবাস্টেশন রোডের জান্নাত ভিলা থেকে প্রায় নিয়ম করেমোক্তারপাড়া যান। মেঝো বোনের সরগরম বাড়ি।কই,গলদা আর মুরগির কষা খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে ভিলায় পা রাখেন। বিগত চারমাস গুণনিধি জামাতাকেএলাচি হাকিমপুরি জর্দা দিয়ে পান সাজিয়েদিতেন বিনীতা শাশুড়ি। হাতইষৎ কাঁপলেও অবয়বে শান্ত ছায়া।
পিয়ারি বেগম,আম্মা আমার!মৌমাছি মায়েরপোয়াতি দশা ক্রমেঘুচলবটে। শ্যামলা রোগা টলটলায়মানশরীর তাঁর। রাণী মৌমাছি না,মা মজুর মৌমাছি। জান্নাত ভিলার চাকে মধুর জোগানদার।সাধ আহ্লাদ বিশ্রামপ্রতœসিন্দুকে।
মা তোগুনাহগার। দুই দুইটি ইঁদুর ছানা জন্ম দিয়েছেনির্লজ্জমেয়েলোক।শিশু দুটি কিনা মেয়েছেলে।আমরা বেড়ে উঠছি অনেকটা বেয়াদবের মতো। হিলহিলে লম্বাকৃষ্ণ মূর্তি। অচিরেই ফ্রকের ঝুলখাটো হয়ে যায়। টেনে টেনে হাঁটু ঢাকতে হয়।
বারো তেরো বছর বয়স। দখিন হাওয়া, জামরুলের পাতা, ভোর বিহানের পক্ষী মগজে অবিদ্যার ঘোল ঢালে। ডেপোমি শিখি অজান্তে। আমাদেরমাথা ভরা তাজা ঘিলু। ঘৃত মাখন ডিম দুধের জোগান যদিও মেলেনি মোটে। বিধাতার বিবিধ তামাশার মোজেজানাদানআমরা কী করেবুঝি!
সবুর চাচা,চন্দন দাআমাদের সাহিত্য পাঠে আসক্তি তৈরিকরতে ওস্তাদ। দশম শ্রেণির আমি মুখস্থ করি শেষের কবিতা,শবনম।সুরমা বু নিশিরাতেউপুড় হয়ে পড়েন চাঁদের অমাবস্যা। যুবক শিক্ষকের দুঃখেফুঁপিয়ে কেঁদে সারা। ছোট ভাইটি মানিক সেও পড়–য়া। ফুলের গন্ধে ঘুম আসে নাপড়ে। কতোযে প্রশ্ন তার।
তখন আমরা ওড়না পরি। নাৎসি ক্যাম্পেজোছনা যাপনেও পিছিয়ে পড়ি না। স্যাতলা পড়া ছাদে শতরঞ্জি বিছিয়ে সাপলুডু খেলি।
হিটলার বাবাজান দিনমান সিরাজগঞ্জ শহরেরএ মাথা ও মাথা নানা বাহানায় বিচিত্র কর্মে বুঁদ হয়ে থাকেন। আরও কিছু রসের নহর নাকি তাঁকেউদ্বেল করে। কানকথাগুলোফালতুলোকজনের বায়বীয় বাহাস হয়তো। মানতে চাই না।
মা যেন দাগীআসামী।দিনমান, এমনকি মধ্যরাত পর্যন্ত দৌড়ের উপর। নিস্তার নেই। আহাওই করুণ মুখের ভাঁজে দেখি কচি পাতার হালকালালিমা।মানুষটাকে কখনওচৈত্র বিকেলে গা ধুয়ে দিঘল চুলে বেণী গাঁথতে দেখিনি। কাজল পড়তেও না।টিপ পরা তো দূর অস্ত!
যাই মধু আহরণে- কেবলইঠোঁটে কুলুপ। মনের মধ্যে কিসের তাড়া,দাঁড়াবার সময় তো নাই। ভাঙ্গারিলালচানের কাছেকান্দা ভাঙ্গা তোবড়ানো ডেকচি,হাড়গোড় বের করাথালাবাসন বেচে ওষুধের পয়সা জোগান।
মনে মনে যথেষ্ট নিন্দা করি।বিস্তর নিন্দা। তুমি তো নোনাময় ভিলার বাঁচনমরণ।বাবাজান যতক্ষণ বাড়িতে তুমি জননী চোখের পাতাও ফেল না। নিশ্বাস নিতে ভুলে যাও? হাজারো ফুট ফরমাশ ভদ্রলোকের।
তারপর ভর্তা ভাজি ডলে আমাদের হা মুখের গ্রাস রচনা। পাইজাম চালেবলকের সুবাস,মসুরি ডালে পাঁচফোড়নের সম্ভার। কালোমেয়েদেরওরসনার বাসনা উথলায়।বাপধনের জন্যে ঢাকনা দেওয়া জামবাটিতে কাতলা মাছের সোনালি সালুন হেফাজতে রাখেন মা। অলিখিতবিধান।
মাকে নানা উছিলায় শুনাই কবির অভিলাষ- ‘জাগোনারী জাগো বহ্নিশিখা।’ মায়ের পেটে এলেম আছে। একদা এক বিজন রাতে মা আমাদের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র লুদ্ধক চিনিয়েছিলেন।উদয়পদ্মের কথা বলতেন। তাঁর চোখের তারায় সহ¯্র দীপাবলি ফিনকি দিয়ে উঠতক্ষণিকের জন্যে!
ভাই মানিক। দশ বছরের ছোট। মায়ের বদনামখানিকটা ঘুচল কী? চোখে পড়ে না।ফুপুরাসপ্তাহে একবারনিয়ম করেবেড়াতে আসেন।এ্যাডলফ হিটলার বাজানের বাজারেরথলি উপচে পড়ার দশা।নিতান্ত শৈশবে ফুপুদেরআগমনে আহ্লাদ করতে যেয়ে গোল্লা গোল্লা আগুনচোখ দেখে চুপসে গেছি। আর কি ভুল হবার কায়দা আছে।
বড়ো হচ্ছি, ডেপোমি শিখতে হচ্ছে। ছোট ফুপুবিসমিল্লাহরবাঁশিতে ফুঁ দেন, ‘মেয়া দুইটা পয়দা হইছে। চামড়া কালা।এগরে ঘরগেরস্তি শিখাও।পর্দাপুশিদা, আদবলেহাজের তো বালাই নাই। বিদ্যা শিখায়া বুড়া হাড্ডি বানাবা না। সময় মতোবিয়াশাদী দেওয়া ফরজ,জানবা। ভাইডার মনে কতো দুঃখু।’
মা ফর্সারায়বাঘিনীর বয়ান শোনেন,নতমুখে।কপাটের আড়ালে আমি ফুঁসতে থাকি। বিদায়ের আগ মুহূর্তে মেঝো ফুপুর উত্তেজক বাণী, ‘অহনওখানদানি রান্ধন বাড়ন শিখলা না।কি কবো। পোলাওয়েবেরেস্তা দিতে ভুইলা গেলা? গরুর গোস্তে একমনআলু দিয়া আলুথালু ঝোল রানছ।একদিন মোক্তারপাড়ায় আসো।শিখায়া দিবনে।বাপেরবড়ি থেকা একগাছি সুতাও আনো নাই।খানদানি নিশানি আর কি আনবা। তোমাগরমুরাদ বুঝি পিয়ারি।কপাল পোড়া সোনার ভাইডার!গছায়া দিছে একখান খ্যাংরাকাঠির নমুনা।’
সিল্কের নকশাদার বোরখা থলথলে শরীরে পরিধান করেন দুই ফুপু। পুঁতি জরির পেটা কাজ করা। চকচকে।চটজলদিহাতমোজাওপরে ফেলেন তাঁরা। খোরমা ফুপুএকমায়া। কারও মতো নয়। ফুপার হাঁপানির টান বেড়েছে,তাই আমাদের মাদাম তেরেসাধানবন্দিথেকে আসতে পারেন নাই। খোরমা ফুপু মানেই বেলি ফুলের সুবাস।ছোট দুই ফুপুরগয়নাগাটিরঝুমঝুমা, মাথা চক্কর দেয়। ফুপুরা জড়িময় বোরখার পাল তুলেচলে যান। মৌমাছি মা ব্যতিব্যস্ত। চিনামাটির বাসনকোসন ধুয়েমুছে আঙুরলতা আলমারিতে পাটে পাটে গুছিয়ে রাখতে হবে। দাঁড়াবার সময় তো নাই।
সেদিন কোজাগরী পূর্ণিমার বান। জামরুল পাতার ঝরকা কাটা নকশি বিছিয়ে পড়েছে উঠোনে,ভিলার মৃত্যুমুখি দেওয়ালে।
মাদুপুরেনবাব চাচার নিরাময় ফার্মেসিতে গিয়েছিলেন। নির্জন যখন ইস্টিশন রোডের পথঘাট। ভাঙ্গারি লতুর কাছে পুরনো পেপার,আমাদের রাফখাতা,কানা ভাঙ্গা কড়াই বেচে কটা টাকা উপার্জন করেছিলেন।উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ কিনেছেন দুই পাতা। বাবা তো বিরাটবস।তাঁর ইনসুলিনের টাকারচিন্তা করতে হয় না। মা নিয়ম করে বাবার ইনসুলিন পুশ করেন। একগলা ঘোমটা টেনেপিয়ারি আম্মাত্রস্ত হরিণীর মতো অচিন তরাসে ঘরে ফিরছিলেন। আচমকা চোখে অন্ধকার।পড়ে গেলেন হাবির ভ্যারাইটি স্টোরের সামনে। হাবিবুর হাত ধরে টেনেটুনে তোলে। কেন উদাম পথে পড়ে গেলেন! অপরাধ যেন তাঁরই।
জোছনা পাগল আমরা বিনোদনের কিছু পন্থারপ্ত করেছি। সেয়ানা হয়ে উঠছি ! যেহেতু বিধাতামগজে তাজা রসদ কিছুটা ভরে দিয়েছেন। চন্দন দা রংপুরের নিসবেতগঞ্জের মনা কারিগরের চমৎকার শতরঞ্জি উপহার দিয়েছেন। বছর দুই হবে।জোছনা রাত আমাদের আশীর্বাদ।
দোল পূর্ণিমার রাতে আমরা তিন ভাই বোন স্যাতলা পড়া ছাদে শতরঞ্জির বিছানায় সাপলুডু মাত্র বিছিয়েছি।বুট ভাজা,চিনা বাদাম বাটি ভরা। জানান দিয়ে রাখি আমি মামুদপুরে দুইজন গর্ধভ ক্যাটাগরির ছাত্রী পড়াই। সুরমা বুজি সুযোগ পেলেই কী সুন্দর বটুয়া বানান। ন্যাপকিনে সুতার নকশা করেন। পরান মামারমৌসুমি স্টোরে জমা দিলে সাতদিনে নতুনঅর্ডার।
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন শতবছর আগেই শিখিয়ে গেছেন মেয়েদের অর্থনৈতিক মুক্তির বিকল্প নেই। খুব মানি।
মৌমাছি মা কৃষিকাজে পয়মন্ত ছিলেন।মন দিলেন অতঃপর।টমেটো, বেগুন, কাঁচামরিচ উঠোনের পুবে বেশ ফলত। বাজার খরচের হিসেবের অংক সহজতর হতো। বদমেজাজি হিটলার বাবা অহেতুক বকবক করতেন।মা চিরন্তন দাগী আসামি। মা লেবু, আ¤্রপালির কলম করতে করতে প্রায় ওস্তাদ বনে গেলেন।বীজ থেকে চারাগাছ করতেন।নামমাত্র হাদিয়া রাখতেন। উপহারওদিতেন।এই উপার্জন শুধু রক্তচাপের ওষুধ কেনার জন্যে। এক অভিশপ্তবিকেলে দেখেছি ফুলে ফুলে সয়লাব বেলির ঝাড় গর্জন করতে করতে টেনেহিঁচড়ে তুলে ফেললেনহিটলার বাবা। মা কুয়াতলায় ডেকচি মাজার অছিলায় গুমরে গুমরে কেঁদেছিলেন।
‘বেলি ফুলের মালা জড়ায়া কোন নাগরের মন ভুলাবার নিয়ত,হ্যাঁ গো পিয়ারি বিবি।’বাপধনের করকরে সংলাপ।
বলছিলাম দোল পূর্ণিমার রাতের কথা। হঠাৎবাবার চঞ্চল চটির দুদ্দাড় আওয়াজ। চিলেকোঠার দিকে ধেয়ে আসছে।
‘তোমরা গুলতানি মারতাছ?তোমার মা শিঙি মাছের মতোন মোচড় দিতাছে।’
আমরা বেহুঁশের মতো ছুটে যাইমোতালেব চাচা এমবিবিএস-এর বাড়ি।প্রায় পাঁজাকোলা করে হাজির করি তাঁকে। টেথিস্কোপ বুকে ধরে বেদিশা তিনি। ‘নাইরে নাই। আল্লাহ পাক তুলে নিছেন!’ আমরা তিন অভাগা কু-ুলি পাকিয়ে জড়াজড়ি করেথ মেরে থাকি।বিলাপ করে কান্নার যে শক্তি তা যেন কোনো দানব কেড়ে নিয়েছে। ডাক্তারচাচা ভুল বকতেছেন! আমি চিক্কুর দিয়ে উঠি। মানিক মরা মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে,কচি হাত দুটো সাঁড়াশি শক্ত।
সংসারে আটা,চাল, নুন তেলের নতুন হিসাবের খাতা খোলা হলো।জমা খরচের হিসেব মেলাতেন সুরমা বুজি। হিটলার বাবাকিনা অভিভাবক?বিনা ওজরে বা অতি তুচ্ছ কারণে বেল্ট দিয়েসপাংসপাং বারি মারতেন পিঠে।বিড়বিড় করেবলতেন, ‘মরলে বাঁচি!’
আমি কাজল, এসএসসি দেবো। সুরমা বুজি সবে ইন্টার পাস করেছেন। আষাঢ় মাস,কালো মেঘ থমথম করছে আকাশে। হন্তদন্তবাবা ঘরে ঢুকলেন,সাথে ট্যারা ঘটক। চা মিষ্টি খেয়েমহল্লার সহজলভ্য ঘটক প্রায় নাচতে নাচতে বিদায় হলো।
দুই দিন বাদে সোলাইমান পাটোয়ারীরসাথে আমার পরম সহোদরার তিন কবুল সমাপ্ত হলো। হুজুর দুলাভাই জোব্বা পাগড়িতে নওশা সেজে এসেছেন। এক সপ্তাহ জান্নাত ভিলায় অবস্থান করলেন। বুজি আমি পাকঘর সামলাই। দুলামিয়া শ্যালিকার সাথেমশকরা করার মওকা খোঁজে।সুরমা বুনির্জন দুপুরে আমাকে জড়িয়ে কী কান্নাটাই না করলেন। ছোট্ট মানিকের চোখ দিয়ে টপটপ করে আষাঢ়ের ধারা।বুজি কেন ওই জোব্বাওলালোকটার বৌ হবে।
এ্যাডলফ হিটলারসকালেগর্জন করে বলে গেলেন, ‘যাও যার যার রাস্তা দেখ। বোঝা কমাও।ঘাড় সোজা করি। আর শোন তোমরা কেউ বাপেরবাড়ি বাপেরবাড়ি করবা না। মনে করবা বাপেরবাড়ি যমুনা খায়া ফেলাইছে। সুরমা মন দিয়া সংসার সামাল দিবা। আয় উন্নতির দিক খেয়ালখবর রাখবা। স্বামী ধন বড় ধন মেয়ালোকের জীবনে।মন জোগায়া চলবা।উনিশ বিশ যেননা শুনি। বাপের বাড়ি একপ্রকার হারাম জানবা।’
মায়েরে যেদিন আজিমপুরে গোর দিয়ে আসছি সেদিন থেকে বাপের বাড়ির মায়া বাদাবনের বাঘের গ্রাস।সুরমা বুজি মাসুমপুরে হুজুর পতিধনের সংসারে মন্দ নেই।রাতারাতি বুজি বদলে গেছে। দিন রাত সংসারের কেচ্ছা। ছেলেমেয়েরসুকীর্তি শুরু করলে মোটে শেষ হয় না। কন্ট্রাক্টরপাটোয়ারীর প্রথম বিবি প্রয়াত, সেটা কোনো বিষয় নয়। সুরমা বুও মৌমাছি। না রাণী,না মজুর।এক অনিবার্য মোমবাতি।
ইফতেখারের সাথে বিয়েটা চটজলদি সারতে হলো।বাপেরবড়ি হাবিয়া দোজখ। তবু মনে পড়ে নিসবেতগঞ্জের সাতরঙা শতরঞ্জি, জোছনা ধোয়া লুডুর গুটি। আর যত খুনসুটি। মৃতকাচপোকার টিপের যাদু। ফাল্গুনে, বৈশাখে শাড়ি। মালা, বেলফুলের।
খিড়কি দুয়ার দিয়ে চলে যেতাম নন্দিতাদের বাড়ি। পাশেই চন্দনদাদের গেট ভরতি চন্দ্রপ্রভার বন্যা। দেবদূতেরমতোচন্দন দা বেরিয়ে আসতেন। মাসিমা আমাদের কখনও কাসুন্দি মাখা আম,নাড়ু খাওয়াতেন। চন্দন দা সতীনাথ ভাদুড়ির ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ ওজনদার উপন্যাসটি সুরমা বুজির হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘পড়া শেষ করে সময় করে আসবে আলোচনা হবে। কাজলও এসো।’ আমাকেও নিরাশ করতেন না। হাসান আজিজুল হকের ‘আগুন পাখি’ পড়তে দিয়েছিলেন।
‘তোমরা পালা পার্বণউদযাপন করো,বড়ো সুন্দর। আমার এখন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সহোদরা কবিতা কথা হঠাৎ মনে এলো। ‘না, সে নয়।অন্য কেউ এসেছিল।ঘুমো তুই ঘুমো।/এখনো রয়েছে রাত্রি, রোদ্দুরেচুমো/লাগেনি শিশিরে।’
গলার কাছে কষ্ট দলা পাকায়। কিসে কষ্ট বুঝি না।
সুরমাবু কেন যে ডালিমের লালিমায় রাঙা হয়ে উঠতেন!... বুঝি আবার বুঝিও না।
বুজি আমার এখন অন্য নারী। জীবনে পতিব্রতা নারী দেখেছি মৌমাছি মাকে। এখন দেখি সহোদরাকে। মাঝেমধ্যে নিশি পাওয়া মানুষের মতো বুবুকে দেখতে যাই। বুজি কই! হিজাব ঢাকা পরহেজগার অন্য কেউ।দুই হাতে ময়দা ময়ান করছেনবা গরুর গোশতের কষানো নিয়ে ব্যতিব্যস্ত! তিন চারজন গৃহকর্মী। সরগরম ঘরগেরস্তি। বুবুর কি খানিক বিবিয়ানা চলন? বুঝতে চাই না। আতর লোবানের মৃদু গন্ধ বাতাসে উড়ে বেড়ায়।
‘বুজি আসো দুইটা কথা কই। মনডাএত্তো খারাপ লাগতাছে।’ বুজি আনমনা। বুজি গোশত কষায় বেহেশতি মসল্লা দিয়ে। বুজি ঘোমটা দিঘল করে। নতুন নমুনা। বুজি বদলে গেছে।
‘বুঝিস না কাজলা তিনি আমার হাতের রান্না ছাড়া মুখে তুলতে পারেননা।জলসায় যাবেন দুই দিনেরজন্যে।নরসিংদি।হাজারেহাজার ভক্ত আশেকান মুমিনদের মজলিস। ওয়াজ মাহফিলে আরও বিখ্যাতআলেম মাওলানারা জমায়েত হবেন।ওনারওয়াজ শুনতে আসবেন বহু আশেকান দিওয়ানা।’
আমি উঠে দাঁড়াই। আমার পরীক্ষার খাতা জমেছে। সালেহা ইসহাক গার্লস স্কুলে আমি দশম শ্রেণির বাংলা পড়াই। মেয়ে ঢাকা ভার্সিটিতে ফিজিক্সে। ছেলে চারুকলায়। ঘরে ইফতেখার হয়তো শুনছে‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই চিরদিন কেন পাই না।’ ওর ফেভারিট। রুটিন মাফিক আজ নিশি ভিডিও কল করবে।
বুধবার। বুজিটুলটুলির মায়ের মারফত খবর পাঠিয়েছেন। ছুটে গেলাম। বুজি তো ঘোড়ায়জিন পরিয়েখাড়া থাকেন। টের পাই বুজির পতিধন বাপের মতো খরখরে মেজাজি না হলেও সামন্ত প্রভুর আলামত।
যদিও বুরঘোর গেরস্ত জীবন বিষয়েসার্বক্ষণিকগবেষণার মতলবনেই। তবু বুজির তরেমনকেন যে কান্দে ছাই।ভেবেছিলাম মাতৃস্নেহের বিকল্প হবে বুজি। সে গুড়ে বালি। পতিব্রতা নিছক গৃহিণী, সহোদরা।
বুজি মোড়া পেতে বসে গরুর দুধ জ্বাল দিচ্ছে। ভেজা চুল দিয়ে পানি ঝরছে।চার কেজি দুধ, বলকায় বু হু হু করে ওঠে। বু চুলার আঁচ নিভু নিভু করে। আয়েশ করে বসে।
‘আয় কাজলা।কয়ডা জরুরি কথা কই। তোর মেয়া তো আমারও মেয়া। শুনলাম ওড়না পরে না।মিছিলে যায় বেডা মানুষের সাথে। ছেলেমেয়ে ঢাকা শহরে পাঠায়ানিশ্চিন্ত থাকা যায়। কড়া নজর রাখা লাগবে। মান ইজ্জতের সওয়াল।’
কে তোমারে এসব কয় বুজি।
‘আমার ওমর ব্যাটা।’
ওমর ব্যাটা ফেরেববাজ আমি জানি। সে নিশির জন্যে সত্য মিথ্যা বলতে পারে। ভাব খাতির জমাতে শোচনীয় দশা হয়েছিল।নিশিরব্যক্তিত্ব আমি জানি।তবু মন দমে যায়। বুজি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ আরও।
‘বিপুল বুয়েটে চান্স পেয়ে পড়তে গেল চারুকলায়ঘোড়ারডিম পড়তে। হে কি জয়নুল আবেদিন হইতে পারব? সুলতান,র’নবী? ওই সব ছিচকা জুলফিওয়ালা আর্টিস্ট না পাইবেনামযশ, না টাকাকড়ি। মাস্টারি, বেহুদা সমাজসেবা নিয়া থাকিস দিওয়ানা। হুঁশ কর কাজলা।’
আমার জবানে কে সিলগালা মেরে দিল!
‘এইগুলা যদি তোর দুলামিয়ার কানে যায় নাউজুবিল্লাহ পড়তে পড়তে আমারেইনিন্দামন্দ করবেনে।বুনরে মেয়াটাকে শরিয়ত মাফিক চলার তামিল দে। দেখ আমার মরিয়ম বেটি তিনডাফুলের মত বাচ্চা,নামাজী স্বামী নিয়া নিরিবিলি সংসার করতাছে।’
সোমবার ইফতেখারেরজন্মদিন। কিছু স্পেশাল রান্না হয়েছিল। কাচ্চি বিরিয়ানি। ছেলেমেয়েরা বাবাকে সারপ্রাইজ দিতে হাজির।বুজি দুলাভাইকে বাড়ি বয়ে দাওয়াত দিয়ে এসেছিলাম।
বুজি এলেন হন্তদন্ত বিষণœ প্রায়, পর্দানশিন এক মহিলা।ইফতেখার জানতে চাইল দুলাভাই যে এলেন না?
বুজিরঘরোয়া ঘোড়ায় জিন লাগান। সামান্য ইতস্তত করে বললেন, ‘বেদাত কাজ। বে শরিয়তি এইজন্মদিন টিনের ঘটা করে আয়োজন। ওনার ওজর আছে।’ বুবু একটুখানি পায়েস মুখে দিয়ে পাঞ্জাবির প্যাকেট টেবিলের কোণে রেখে বিদায় নিলেন।
আমারঅত্যাশ্চর্যসহোদরা। একই হাঁড়ির ভাত খেয়েছি। বৈশাখে শাড়ি কাচপোকার টিপ। চাঁদের অমাবস্যা?...
ওহো সুরমা বু আপনের কলবের কয়লা সাফা করে দিসে দুলামিয়া। সাবাস। হাজার সাবাস।জিগার আঠার মহব্বতে আপনি মশগুল। এমন লাইলী মজনু!
সময় অসময়ে মায়ের জন্যে বুকের মধ্যে তুফান ওঠে।
পিয়ারি মা আমার চলে গেলেন হাওয়ার মতো। মৌমাছির গুঞ্জন ছড়িয়ে। কাঁকর বাছতে বাছতে-
হঠাৎ শুক্রবার সকালে মোহসীন মামা এলেন আষাঢ় মাসের ঝড় মাথায় করে।মামা মায়ের দুই বছরের বড়ো।কত দিন পর মামা এলেন। দুপুরে বোয়ালমাছের ঘন ঝোল তৃপ্তি করে খেলেন।সারাবিকেল সন্ধ্যা বাদলা মেঘের ডাকাডাকি।মায়ের হাজার কথা, স্মৃতির হাট।মামা অতিপুরানো ইতিহাসের পাতা খুলে ধরেন। আমরা এক শ্যামলা ষোড়শীর নিয়তির খেলারখোয়াব দেখি !...
‘পিয়ারির বিয়ের পাকা কথা হয়ে গেছে। হবু বর কলেজ শিক্ষক। রবিবার মুলাডুলির বাড়িতে আত্মীয় কুটুমেরমেলা।রঙিন গেট। ফরাস বিছানো বৈঠকঘর। জামাইয়ের জন্যে ‘সাগোরানা’ সাজানো। শ্যালিকার দল বরণডালা হাতে খাড়া।বিয়ের গীত হচ্ছে ছাতিম তলায়। তরফদার বাড়িতে ঝিলমিলি জোনাক জ্বলে।
আচমকা হঠাৎ এক বিষমাখা তির ছুটে এলো।হাটিকুমরুলের কাছে সড়ক দুর্ঘটনায় কলেজ শিক্ষক মোজাম্মেল,হবু বরপ্রাণ হারিয়েছেন।স্পট ডেট।
পিয়ারি বু কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে হয়ে গেলেন অপয়া। পাত্রপক্ষেরখা-ারণী কিছু মহিলা ষোলবছরের বোনটার জীবন কষ্টিকালা করে তুলল।অপয়া,অলক্ষী,ভাতারখাকি যত গালমন্দ করা যায়। বুবু ঘরের ভিতর বন্দী দশায় কাটান।পাড়া পড়শি সুযোগপেলেই টিপ্পনী কাটে। অপয়া- অপয়া।জন্মদাগী।অসতী অলক্ষী।কপাল পোড়া। তারপর দুম করে বাসেত মৃধার সাথে কবুল হয়ে যায়। হায় আমার শান্ত গুণবতী বোনটি লক্ষ্মী হতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। পয়মন্ত পিয়ারি হতে দিন-রাত হাপরের দিকদারি।’
মহসিনমামা এক প্রতœ সিন্দুকের ডালা খুলে দিলেন। আমি এক অবোধ শিশু যেন!হঠাৎ বলে উঠলাম ‘মৌমাছি মৌমাছি কোথা যাওনাচি নাচি/...দাঁড়াবার সময় তো নাই।’...
পড়ন্তফাল্গুনের দিন। ডালে ডালেসোনালু, কৃষ্ণচূড়ার বৈভব।নিঝুম মহল্লা। সরাইল সারমেয় কয়েকটিআর কাক ডাকছে। মামা চলে গেলেনমুলাডুলি।
সন্ধ্যা আসন্ন। আদা চা নিয়ে বসেছি। বিবিয়ানা সুরমা বুজি কপাটের ওপাশে চিত্রবৎ খাড়া। চোখ জোড়া আমার বেকুব। হাতে সেই কিশোরকালের বাদামি রঙের লেদার ব্যাগ। আমি রবোটের মতো পাতিলেবুর ফালি কাটি। দ্রুততম সময়ে শরবত বানিয়ে ফেলি। বুজি কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘কাজলা পানি দে।’
তখন বুজি দমকে দমকে ক্রন্দন গিলে ফেলেন। বাপের বাড়িতে যেমন শাক ভাতের সাথে মথে নানাজাতের ক্রন্দন গিলে ফেলতাম আমরা। সেও এক অধীত বিদ্যা। শিল্পকলা!বুজি বেহুশ, চোখ দুইটা লিচু ফলের মতো ঘোলা।
‘কাজলারে সেই দরবেশ, সেই ফেরেশতারে আমি এতকালেওচিনি নাই। সেই লোকটা সুফিবাক্য কয়। ওয়াজে নসিহত করে। মধ্যে মধ্যে খানকা শরীফের রাস্তা ভুলভুলাইয়ারদিক নিয়া যায়! লোকটা যায় ছিনাল ঝিলিকের ঘরে।আরও যায় কুলটা ঝিনুকমালার দাওয়ায়।তিনি নাকি তাগরে ইসলামের দাওয়াত দিতেস্বয়ং হাজির হন।’
বুজির উন্মাদ দশা। হিজাব খসে গেছে। দিঘল চুল সাপের ফুা। কেউটেসাপের ফু। বুজি ফেটে পড়ে, যেন এক সুপ্ত আগ্নেয়গিরি, ‘ইসলামের খিদমতগার! থুঃ।’
প্রাণপণে ভুলতে চাওয়া একটা কালো দাগ ক্রমশ গাঢ়বর্ণ হয়ে উঠল। বুবু জান্নাত ভিলা থেকে বিদায় নেবার ঠিক আগের দিন দাঁড়িতে আঙুল দিয়ে চিরুনি করতে করতেজড়িয়ে ধরেছিল লোকটা,আমাকে। সাক্ষাৎপাইথন বুনো ভল্লুক!
‘শালিকা এমনভরা যুবতী। আমার পাওনা। বোনাস না নিয়া বিদায় হওয়া জায়েজ না।’
পুরোপুরি ঘোরগ্রস্ত বোধ শূন্য আমি।পাতালের কোনঅন্ধকারেতলিয়ে গেছি। কেমন করে যেন গোসলখানায় ঢুকে বালতি বালতি পানি ঢেলেছি। সিন্দুকেরগহীনে লুকিয়ে ফেলেছি আমার বিপর্যয়ের বিষণœতম অধ্যায়।কাকপক্ষীও জানে না।প্রাণপণে গগনবিদারী চিক্কুর গিলে খেতে হয়েছিল।...
বুজিপাথর প্রতিমারমতো শান্ত এখন। লেদারের ব্যাগ খুলে নক্সা করা সেইছোট্টকাঠেরবাক্সটা আলগোছে বের করলেন।উপরের ডালায় চন্দন সুবাস। চন্দনদা এক ফাল্গুনে উপহার দিয়েছিলেন। ডালার ভেতরে নীল ভেলভেটের আস্তর। তার উপরে কয়েকটি মৃত কাচপোকার ডানা। কিছুটা উজ্জ্বল রঙের আভাস। সহসাচোখ ভিজে ওঠে।
নকশিবাক্সের মালিকানা নিয়ে আমাদের খুনসুটি হতো। মান অভিমান কখনও খুচরো ঝগড়া!...
বুজি ভেজা গলায় বলেন, ‘কাজলা হাত পাত। এটা তোর।’ এইমাহেন্দ্রক্ষণে মানিকের জন্যে হুহু করে ওঠে মন।সুদূর মরুর দেশে ভাইটি আমার। তোরজোড় করে হিটলার বাবাই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
আমি সুরমা বুজিকে জাঁপটে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠি। বুজি প্রলাপবকছেন, ‘মা মা গো। কত দূরে তুমি।
মা রে আয়। আমি তোমার ওষুধ বাক্স ভরে কিনে দেব’ মা- সারা ঘরে মায়ের গায়েরগন্ধ। হায় ‘অপয়া’ নাম ঘোচাতে মা আমার মধ্যরাত অবধি দৌড়ের উপরে থাকতেন।
সহোদরাদের ক্রন্দন ছাতিম পাতায় লেপ্টে থাকে।জানালা বরাবর সপ্তপর্ণ। ফুল ফুটেছে অজ¯্র। মাতালকরা সুগন্ধ।
কোনো একদিন ছাতিম পাতার কাহিনি আর যত সুখদুঃখের ইতিকথা জোড়া দিয়ে আমি রাষ্ট্র করে দেবো,সহোদরার অমিত সাহসের পাঁয়তারা। দয়ালু আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় বলব, আমার মায়ের খুনি দিব্যি আছে, নতুন বৌ নিয়ে। জান্নাত ভিলা নিজের নামে লিখে নিয়েছে ডগমগে নবাগতা।
অনেক দিন আগেই ‘বাপের বাড়ি’ শব্দ দুটায় মরচে পড়ে গেছে। আমরা এক নয়া কিতাব পাঠ করব। যে কিতাবটির রচয়িতা সহোদরা ভগিনী, আমরা দুইজন।
বি শে ষ সংখ্যা : নারীর গল্প
দিলারা মেসবাহ
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ : সঞ্জয় দে রিপন
বৃহস্পতিবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সুরমা বু আমার সহোদরা। একবছর দুই মাসের ফারাক। হাড্ডিসারমায়ের বুকে আমরা নাকি লেপ্টে থাকতাম। মায়ের বুকে দুধের নহর।রঙচটা ব্লাউজ ভিজে সপসপে হয়ে থাকত। আর কোনো শিশু খাদ্যের জোগান ছিল না সংসারে।নানিমা কালিজিরা ভর্তা,লাউ ইত্যাদিরেঁধে খাওয়াতেনমাকে। আঁচলের গেরো থেকে টাকা কড়ি নিঃশব্দে গুঁজে দিতেন পাশের বাড়ির সবুজ মিয়ার হাতে।বাজার করে দিতেন সবুজ ভাই।প্রিয় নীরা খালা হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতেন। ধূসর স্মৃতি কথা।
একটি বিষয় জানান দেয়া জরুরি মনে হলো। মানে আমাদের পিতৃদেব দুই আধ ময়লা লিকলিকে কন্যা শিশুকে টিকটিকির ছাও বিবেচনা করে কচিৎ ফিরে তাকাননি। অ্যাডলফ হিটলার বাবাপরপড়শির মতো বিরাজমান থাকতেন। কিন্তু কর্তৃত্ব ছিল তুঙ্গে।
নানিমা আনাজপাতি কুটতেন বঁটি পেতে। ঘোমটার আড়ালে কান্না গিলে ফেলতেন নিত্য।
চারমাস জান্নাত ভিলার খেদমত করেমুলাডুলি চলে গেলেন। নোনাধরা ভিলা হাপুস নয়নে কাঁদল। জামরুল পাতা কাঁদল,কুয়াতলা, কলপাড়, হাঁড়ি কড়াই কাঁদল। মা কলের পুতুল,দম শেষ। পাথর হয়ে বসে থাকা বিনে আর কোনোকানাগলিও চেনা নেই বেচারি মৌমাছির।
উঠোনেপড়ে না সকালবেলার ঝাঁটা। পোড়ো বাড়ির দশা।হিটলার বাবাস্টেশন রোডের জান্নাত ভিলা থেকে প্রায় নিয়ম করেমোক্তারপাড়া যান। মেঝো বোনের সরগরম বাড়ি।কই,গলদা আর মুরগির কষা খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে ভিলায় পা রাখেন। বিগত চারমাস গুণনিধি জামাতাকেএলাচি হাকিমপুরি জর্দা দিয়ে পান সাজিয়েদিতেন বিনীতা শাশুড়ি। হাতইষৎ কাঁপলেও অবয়বে শান্ত ছায়া।
পিয়ারি বেগম,আম্মা আমার!মৌমাছি মায়েরপোয়াতি দশা ক্রমেঘুচলবটে। শ্যামলা রোগা টলটলায়মানশরীর তাঁর। রাণী মৌমাছি না,মা মজুর মৌমাছি। জান্নাত ভিলার চাকে মধুর জোগানদার।সাধ আহ্লাদ বিশ্রামপ্রতœসিন্দুকে।
মা তোগুনাহগার। দুই দুইটি ইঁদুর ছানা জন্ম দিয়েছেনির্লজ্জমেয়েলোক।শিশু দুটি কিনা মেয়েছেলে।আমরা বেড়ে উঠছি অনেকটা বেয়াদবের মতো। হিলহিলে লম্বাকৃষ্ণ মূর্তি। অচিরেই ফ্রকের ঝুলখাটো হয়ে যায়। টেনে টেনে হাঁটু ঢাকতে হয়।
বারো তেরো বছর বয়স। দখিন হাওয়া, জামরুলের পাতা, ভোর বিহানের পক্ষী মগজে অবিদ্যার ঘোল ঢালে। ডেপোমি শিখি অজান্তে। আমাদেরমাথা ভরা তাজা ঘিলু। ঘৃত মাখন ডিম দুধের জোগান যদিও মেলেনি মোটে। বিধাতার বিবিধ তামাশার মোজেজানাদানআমরা কী করেবুঝি!
সবুর চাচা,চন্দন দাআমাদের সাহিত্য পাঠে আসক্তি তৈরিকরতে ওস্তাদ। দশম শ্রেণির আমি মুখস্থ করি শেষের কবিতা,শবনম।সুরমা বু নিশিরাতেউপুড় হয়ে পড়েন চাঁদের অমাবস্যা। যুবক শিক্ষকের দুঃখেফুঁপিয়ে কেঁদে সারা। ছোট ভাইটি মানিক সেও পড়–য়া। ফুলের গন্ধে ঘুম আসে নাপড়ে। কতোযে প্রশ্ন তার।
তখন আমরা ওড়না পরি। নাৎসি ক্যাম্পেজোছনা যাপনেও পিছিয়ে পড়ি না। স্যাতলা পড়া ছাদে শতরঞ্জি বিছিয়ে সাপলুডু খেলি।
হিটলার বাবাজান দিনমান সিরাজগঞ্জ শহরেরএ মাথা ও মাথা নানা বাহানায় বিচিত্র কর্মে বুঁদ হয়ে থাকেন। আরও কিছু রসের নহর নাকি তাঁকেউদ্বেল করে। কানকথাগুলোফালতুলোকজনের বায়বীয় বাহাস হয়তো। মানতে চাই না।
মা যেন দাগীআসামী।দিনমান, এমনকি মধ্যরাত পর্যন্ত দৌড়ের উপর। নিস্তার নেই। আহাওই করুণ মুখের ভাঁজে দেখি কচি পাতার হালকালালিমা।মানুষটাকে কখনওচৈত্র বিকেলে গা ধুয়ে দিঘল চুলে বেণী গাঁথতে দেখিনি। কাজল পড়তেও না।টিপ পরা তো দূর অস্ত!
যাই মধু আহরণে- কেবলইঠোঁটে কুলুপ। মনের মধ্যে কিসের তাড়া,দাঁড়াবার সময় তো নাই। ভাঙ্গারিলালচানের কাছেকান্দা ভাঙ্গা তোবড়ানো ডেকচি,হাড়গোড় বের করাথালাবাসন বেচে ওষুধের পয়সা জোগান।
মনে মনে যথেষ্ট নিন্দা করি।বিস্তর নিন্দা। তুমি তো নোনাময় ভিলার বাঁচনমরণ।বাবাজান যতক্ষণ বাড়িতে তুমি জননী চোখের পাতাও ফেল না। নিশ্বাস নিতে ভুলে যাও? হাজারো ফুট ফরমাশ ভদ্রলোকের।
তারপর ভর্তা ভাজি ডলে আমাদের হা মুখের গ্রাস রচনা। পাইজাম চালেবলকের সুবাস,মসুরি ডালে পাঁচফোড়নের সম্ভার। কালোমেয়েদেরওরসনার বাসনা উথলায়।বাপধনের জন্যে ঢাকনা দেওয়া জামবাটিতে কাতলা মাছের সোনালি সালুন হেফাজতে রাখেন মা। অলিখিতবিধান।
মাকে নানা উছিলায় শুনাই কবির অভিলাষ- ‘জাগোনারী জাগো বহ্নিশিখা।’ মায়ের পেটে এলেম আছে। একদা এক বিজন রাতে মা আমাদের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র লুদ্ধক চিনিয়েছিলেন।উদয়পদ্মের কথা বলতেন। তাঁর চোখের তারায় সহ¯্র দীপাবলি ফিনকি দিয়ে উঠতক্ষণিকের জন্যে!
ভাই মানিক। দশ বছরের ছোট। মায়ের বদনামখানিকটা ঘুচল কী? চোখে পড়ে না।ফুপুরাসপ্তাহে একবারনিয়ম করেবেড়াতে আসেন।এ্যাডলফ হিটলার বাজানের বাজারেরথলি উপচে পড়ার দশা।নিতান্ত শৈশবে ফুপুদেরআগমনে আহ্লাদ করতে যেয়ে গোল্লা গোল্লা আগুনচোখ দেখে চুপসে গেছি। আর কি ভুল হবার কায়দা আছে।
বড়ো হচ্ছি, ডেপোমি শিখতে হচ্ছে। ছোট ফুপুবিসমিল্লাহরবাঁশিতে ফুঁ দেন, ‘মেয়া দুইটা পয়দা হইছে। চামড়া কালা।এগরে ঘরগেরস্তি শিখাও।পর্দাপুশিদা, আদবলেহাজের তো বালাই নাই। বিদ্যা শিখায়া বুড়া হাড্ডি বানাবা না। সময় মতোবিয়াশাদী দেওয়া ফরজ,জানবা। ভাইডার মনে কতো দুঃখু।’
মা ফর্সারায়বাঘিনীর বয়ান শোনেন,নতমুখে।কপাটের আড়ালে আমি ফুঁসতে থাকি। বিদায়ের আগ মুহূর্তে মেঝো ফুপুর উত্তেজক বাণী, ‘অহনওখানদানি রান্ধন বাড়ন শিখলা না।কি কবো। পোলাওয়েবেরেস্তা দিতে ভুইলা গেলা? গরুর গোস্তে একমনআলু দিয়া আলুথালু ঝোল রানছ।একদিন মোক্তারপাড়ায় আসো।শিখায়া দিবনে।বাপেরবড়ি থেকা একগাছি সুতাও আনো নাই।খানদানি নিশানি আর কি আনবা। তোমাগরমুরাদ বুঝি পিয়ারি।কপাল পোড়া সোনার ভাইডার!গছায়া দিছে একখান খ্যাংরাকাঠির নমুনা।’
সিল্কের নকশাদার বোরখা থলথলে শরীরে পরিধান করেন দুই ফুপু। পুঁতি জরির পেটা কাজ করা। চকচকে।চটজলদিহাতমোজাওপরে ফেলেন তাঁরা। খোরমা ফুপুএকমায়া। কারও মতো নয়। ফুপার হাঁপানির টান বেড়েছে,তাই আমাদের মাদাম তেরেসাধানবন্দিথেকে আসতে পারেন নাই। খোরমা ফুপু মানেই বেলি ফুলের সুবাস।ছোট দুই ফুপুরগয়নাগাটিরঝুমঝুমা, মাথা চক্কর দেয়। ফুপুরা জড়িময় বোরখার পাল তুলেচলে যান। মৌমাছি মা ব্যতিব্যস্ত। চিনামাটির বাসনকোসন ধুয়েমুছে আঙুরলতা আলমারিতে পাটে পাটে গুছিয়ে রাখতে হবে। দাঁড়াবার সময় তো নাই।
সেদিন কোজাগরী পূর্ণিমার বান। জামরুল পাতার ঝরকা কাটা নকশি বিছিয়ে পড়েছে উঠোনে,ভিলার মৃত্যুমুখি দেওয়ালে।
মাদুপুরেনবাব চাচার নিরাময় ফার্মেসিতে গিয়েছিলেন। নির্জন যখন ইস্টিশন রোডের পথঘাট। ভাঙ্গারি লতুর কাছে পুরনো পেপার,আমাদের রাফখাতা,কানা ভাঙ্গা কড়াই বেচে কটা টাকা উপার্জন করেছিলেন।উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ কিনেছেন দুই পাতা। বাবা তো বিরাটবস।তাঁর ইনসুলিনের টাকারচিন্তা করতে হয় না। মা নিয়ম করে বাবার ইনসুলিন পুশ করেন। একগলা ঘোমটা টেনেপিয়ারি আম্মাত্রস্ত হরিণীর মতো অচিন তরাসে ঘরে ফিরছিলেন। আচমকা চোখে অন্ধকার।পড়ে গেলেন হাবির ভ্যারাইটি স্টোরের সামনে। হাবিবুর হাত ধরে টেনেটুনে তোলে। কেন উদাম পথে পড়ে গেলেন! অপরাধ যেন তাঁরই।
জোছনা পাগল আমরা বিনোদনের কিছু পন্থারপ্ত করেছি। সেয়ানা হয়ে উঠছি ! যেহেতু বিধাতামগজে তাজা রসদ কিছুটা ভরে দিয়েছেন। চন্দন দা রংপুরের নিসবেতগঞ্জের মনা কারিগরের চমৎকার শতরঞ্জি উপহার দিয়েছেন। বছর দুই হবে।জোছনা রাত আমাদের আশীর্বাদ।
দোল পূর্ণিমার রাতে আমরা তিন ভাই বোন স্যাতলা পড়া ছাদে শতরঞ্জির বিছানায় সাপলুডু মাত্র বিছিয়েছি।বুট ভাজা,চিনা বাদাম বাটি ভরা। জানান দিয়ে রাখি আমি মামুদপুরে দুইজন গর্ধভ ক্যাটাগরির ছাত্রী পড়াই। সুরমা বুজি সুযোগ পেলেই কী সুন্দর বটুয়া বানান। ন্যাপকিনে সুতার নকশা করেন। পরান মামারমৌসুমি স্টোরে জমা দিলে সাতদিনে নতুনঅর্ডার।
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন শতবছর আগেই শিখিয়ে গেছেন মেয়েদের অর্থনৈতিক মুক্তির বিকল্প নেই। খুব মানি।
মৌমাছি মা কৃষিকাজে পয়মন্ত ছিলেন।মন দিলেন অতঃপর।টমেটো, বেগুন, কাঁচামরিচ উঠোনের পুবে বেশ ফলত। বাজার খরচের হিসেবের অংক সহজতর হতো। বদমেজাজি হিটলার বাবা অহেতুক বকবক করতেন।মা চিরন্তন দাগী আসামি। মা লেবু, আ¤্রপালির কলম করতে করতে প্রায় ওস্তাদ বনে গেলেন।বীজ থেকে চারাগাছ করতেন।নামমাত্র হাদিয়া রাখতেন। উপহারওদিতেন।এই উপার্জন শুধু রক্তচাপের ওষুধ কেনার জন্যে। এক অভিশপ্তবিকেলে দেখেছি ফুলে ফুলে সয়লাব বেলির ঝাড় গর্জন করতে করতে টেনেহিঁচড়ে তুলে ফেললেনহিটলার বাবা। মা কুয়াতলায় ডেকচি মাজার অছিলায় গুমরে গুমরে কেঁদেছিলেন।
‘বেলি ফুলের মালা জড়ায়া কোন নাগরের মন ভুলাবার নিয়ত,হ্যাঁ গো পিয়ারি বিবি।’বাপধনের করকরে সংলাপ।
বলছিলাম দোল পূর্ণিমার রাতের কথা। হঠাৎবাবার চঞ্চল চটির দুদ্দাড় আওয়াজ। চিলেকোঠার দিকে ধেয়ে আসছে।
‘তোমরা গুলতানি মারতাছ?তোমার মা শিঙি মাছের মতোন মোচড় দিতাছে।’
আমরা বেহুঁশের মতো ছুটে যাইমোতালেব চাচা এমবিবিএস-এর বাড়ি।প্রায় পাঁজাকোলা করে হাজির করি তাঁকে। টেথিস্কোপ বুকে ধরে বেদিশা তিনি। ‘নাইরে নাই। আল্লাহ পাক তুলে নিছেন!’ আমরা তিন অভাগা কু-ুলি পাকিয়ে জড়াজড়ি করেথ মেরে থাকি।বিলাপ করে কান্নার যে শক্তি তা যেন কোনো দানব কেড়ে নিয়েছে। ডাক্তারচাচা ভুল বকতেছেন! আমি চিক্কুর দিয়ে উঠি। মানিক মরা মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে,কচি হাত দুটো সাঁড়াশি শক্ত।
সংসারে আটা,চাল, নুন তেলের নতুন হিসাবের খাতা খোলা হলো।জমা খরচের হিসেব মেলাতেন সুরমা বুজি। হিটলার বাবাকিনা অভিভাবক?বিনা ওজরে বা অতি তুচ্ছ কারণে বেল্ট দিয়েসপাংসপাং বারি মারতেন পিঠে।বিড়বিড় করেবলতেন, ‘মরলে বাঁচি!’
আমি কাজল, এসএসসি দেবো। সুরমা বুজি সবে ইন্টার পাস করেছেন। আষাঢ় মাস,কালো মেঘ থমথম করছে আকাশে। হন্তদন্তবাবা ঘরে ঢুকলেন,সাথে ট্যারা ঘটক। চা মিষ্টি খেয়েমহল্লার সহজলভ্য ঘটক প্রায় নাচতে নাচতে বিদায় হলো।
দুই দিন বাদে সোলাইমান পাটোয়ারীরসাথে আমার পরম সহোদরার তিন কবুল সমাপ্ত হলো। হুজুর দুলাভাই জোব্বা পাগড়িতে নওশা সেজে এসেছেন। এক সপ্তাহ জান্নাত ভিলায় অবস্থান করলেন। বুজি আমি পাকঘর সামলাই। দুলামিয়া শ্যালিকার সাথেমশকরা করার মওকা খোঁজে।সুরমা বুনির্জন দুপুরে আমাকে জড়িয়ে কী কান্নাটাই না করলেন। ছোট্ট মানিকের চোখ দিয়ে টপটপ করে আষাঢ়ের ধারা।বুজি কেন ওই জোব্বাওলালোকটার বৌ হবে।
এ্যাডলফ হিটলারসকালেগর্জন করে বলে গেলেন, ‘যাও যার যার রাস্তা দেখ। বোঝা কমাও।ঘাড় সোজা করি। আর শোন তোমরা কেউ বাপেরবাড়ি বাপেরবাড়ি করবা না। মনে করবা বাপেরবাড়ি যমুনা খায়া ফেলাইছে। সুরমা মন দিয়া সংসার সামাল দিবা। আয় উন্নতির দিক খেয়ালখবর রাখবা। স্বামী ধন বড় ধন মেয়ালোকের জীবনে।মন জোগায়া চলবা।উনিশ বিশ যেননা শুনি। বাপের বাড়ি একপ্রকার হারাম জানবা।’
মায়েরে যেদিন আজিমপুরে গোর দিয়ে আসছি সেদিন থেকে বাপের বাড়ির মায়া বাদাবনের বাঘের গ্রাস।সুরমা বুজি মাসুমপুরে হুজুর পতিধনের সংসারে মন্দ নেই।রাতারাতি বুজি বদলে গেছে। দিন রাত সংসারের কেচ্ছা। ছেলেমেয়েরসুকীর্তি শুরু করলে মোটে শেষ হয় না। কন্ট্রাক্টরপাটোয়ারীর প্রথম বিবি প্রয়াত, সেটা কোনো বিষয় নয়। সুরমা বুও মৌমাছি। না রাণী,না মজুর।এক অনিবার্য মোমবাতি।
ইফতেখারের সাথে বিয়েটা চটজলদি সারতে হলো।বাপেরবড়ি হাবিয়া দোজখ। তবু মনে পড়ে নিসবেতগঞ্জের সাতরঙা শতরঞ্জি, জোছনা ধোয়া লুডুর গুটি। আর যত খুনসুটি। মৃতকাচপোকার টিপের যাদু। ফাল্গুনে, বৈশাখে শাড়ি। মালা, বেলফুলের।
খিড়কি দুয়ার দিয়ে চলে যেতাম নন্দিতাদের বাড়ি। পাশেই চন্দনদাদের গেট ভরতি চন্দ্রপ্রভার বন্যা। দেবদূতেরমতোচন্দন দা বেরিয়ে আসতেন। মাসিমা আমাদের কখনও কাসুন্দি মাখা আম,নাড়ু খাওয়াতেন। চন্দন দা সতীনাথ ভাদুড়ির ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ ওজনদার উপন্যাসটি সুরমা বুজির হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘পড়া শেষ করে সময় করে আসবে আলোচনা হবে। কাজলও এসো।’ আমাকেও নিরাশ করতেন না। হাসান আজিজুল হকের ‘আগুন পাখি’ পড়তে দিয়েছিলেন।
‘তোমরা পালা পার্বণউদযাপন করো,বড়ো সুন্দর। আমার এখন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সহোদরা কবিতা কথা হঠাৎ মনে এলো। ‘না, সে নয়।অন্য কেউ এসেছিল।ঘুমো তুই ঘুমো।/এখনো রয়েছে রাত্রি, রোদ্দুরেচুমো/লাগেনি শিশিরে।’
গলার কাছে কষ্ট দলা পাকায়। কিসে কষ্ট বুঝি না।
সুরমাবু কেন যে ডালিমের লালিমায় রাঙা হয়ে উঠতেন!... বুঝি আবার বুঝিও না।
বুজি আমার এখন অন্য নারী। জীবনে পতিব্রতা নারী দেখেছি মৌমাছি মাকে। এখন দেখি সহোদরাকে। মাঝেমধ্যে নিশি পাওয়া মানুষের মতো বুবুকে দেখতে যাই। বুজি কই! হিজাব ঢাকা পরহেজগার অন্য কেউ।দুই হাতে ময়দা ময়ান করছেনবা গরুর গোশতের কষানো নিয়ে ব্যতিব্যস্ত! তিন চারজন গৃহকর্মী। সরগরম ঘরগেরস্তি। বুবুর কি খানিক বিবিয়ানা চলন? বুঝতে চাই না। আতর লোবানের মৃদু গন্ধ বাতাসে উড়ে বেড়ায়।
‘বুজি আসো দুইটা কথা কই। মনডাএত্তো খারাপ লাগতাছে।’ বুজি আনমনা। বুজি গোশত কষায় বেহেশতি মসল্লা দিয়ে। বুজি ঘোমটা দিঘল করে। নতুন নমুনা। বুজি বদলে গেছে।
‘বুঝিস না কাজলা তিনি আমার হাতের রান্না ছাড়া মুখে তুলতে পারেননা।জলসায় যাবেন দুই দিনেরজন্যে।নরসিংদি।হাজারেহাজার ভক্ত আশেকান মুমিনদের মজলিস। ওয়াজ মাহফিলে আরও বিখ্যাতআলেম মাওলানারা জমায়েত হবেন।ওনারওয়াজ শুনতে আসবেন বহু আশেকান দিওয়ানা।’
আমি উঠে দাঁড়াই। আমার পরীক্ষার খাতা জমেছে। সালেহা ইসহাক গার্লস স্কুলে আমি দশম শ্রেণির বাংলা পড়াই। মেয়ে ঢাকা ভার্সিটিতে ফিজিক্সে। ছেলে চারুকলায়। ঘরে ইফতেখার হয়তো শুনছে‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই চিরদিন কেন পাই না।’ ওর ফেভারিট। রুটিন মাফিক আজ নিশি ভিডিও কল করবে।
বুধবার। বুজিটুলটুলির মায়ের মারফত খবর পাঠিয়েছেন। ছুটে গেলাম। বুজি তো ঘোড়ায়জিন পরিয়েখাড়া থাকেন। টের পাই বুজির পতিধন বাপের মতো খরখরে মেজাজি না হলেও সামন্ত প্রভুর আলামত।
যদিও বুরঘোর গেরস্ত জীবন বিষয়েসার্বক্ষণিকগবেষণার মতলবনেই। তবু বুজির তরেমনকেন যে কান্দে ছাই।ভেবেছিলাম মাতৃস্নেহের বিকল্প হবে বুজি। সে গুড়ে বালি। পতিব্রতা নিছক গৃহিণী, সহোদরা।
বুজি মোড়া পেতে বসে গরুর দুধ জ্বাল দিচ্ছে। ভেজা চুল দিয়ে পানি ঝরছে।চার কেজি দুধ, বলকায় বু হু হু করে ওঠে। বু চুলার আঁচ নিভু নিভু করে। আয়েশ করে বসে।
‘আয় কাজলা।কয়ডা জরুরি কথা কই। তোর মেয়া তো আমারও মেয়া। শুনলাম ওড়না পরে না।মিছিলে যায় বেডা মানুষের সাথে। ছেলেমেয়ে ঢাকা শহরে পাঠায়ানিশ্চিন্ত থাকা যায়। কড়া নজর রাখা লাগবে। মান ইজ্জতের সওয়াল।’
কে তোমারে এসব কয় বুজি।
‘আমার ওমর ব্যাটা।’
ওমর ব্যাটা ফেরেববাজ আমি জানি। সে নিশির জন্যে সত্য মিথ্যা বলতে পারে। ভাব খাতির জমাতে শোচনীয় দশা হয়েছিল।নিশিরব্যক্তিত্ব আমি জানি।তবু মন দমে যায়। বুজি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ আরও।
‘বিপুল বুয়েটে চান্স পেয়ে পড়তে গেল চারুকলায়ঘোড়ারডিম পড়তে। হে কি জয়নুল আবেদিন হইতে পারব? সুলতান,র’নবী? ওই সব ছিচকা জুলফিওয়ালা আর্টিস্ট না পাইবেনামযশ, না টাকাকড়ি। মাস্টারি, বেহুদা সমাজসেবা নিয়া থাকিস দিওয়ানা। হুঁশ কর কাজলা।’
আমার জবানে কে সিলগালা মেরে দিল!
‘এইগুলা যদি তোর দুলামিয়ার কানে যায় নাউজুবিল্লাহ পড়তে পড়তে আমারেইনিন্দামন্দ করবেনে।বুনরে মেয়াটাকে শরিয়ত মাফিক চলার তামিল দে। দেখ আমার মরিয়ম বেটি তিনডাফুলের মত বাচ্চা,নামাজী স্বামী নিয়া নিরিবিলি সংসার করতাছে।’
সোমবার ইফতেখারেরজন্মদিন। কিছু স্পেশাল রান্না হয়েছিল। কাচ্চি বিরিয়ানি। ছেলেমেয়েরা বাবাকে সারপ্রাইজ দিতে হাজির।বুজি দুলাভাইকে বাড়ি বয়ে দাওয়াত দিয়ে এসেছিলাম।
বুজি এলেন হন্তদন্ত বিষণœ প্রায়, পর্দানশিন এক মহিলা।ইফতেখার জানতে চাইল দুলাভাই যে এলেন না?
বুজিরঘরোয়া ঘোড়ায় জিন লাগান। সামান্য ইতস্তত করে বললেন, ‘বেদাত কাজ। বে শরিয়তি এইজন্মদিন টিনের ঘটা করে আয়োজন। ওনার ওজর আছে।’ বুবু একটুখানি পায়েস মুখে দিয়ে পাঞ্জাবির প্যাকেট টেবিলের কোণে রেখে বিদায় নিলেন।
আমারঅত্যাশ্চর্যসহোদরা। একই হাঁড়ির ভাত খেয়েছি। বৈশাখে শাড়ি কাচপোকার টিপ। চাঁদের অমাবস্যা?...
ওহো সুরমা বু আপনের কলবের কয়লা সাফা করে দিসে দুলামিয়া। সাবাস। হাজার সাবাস।জিগার আঠার মহব্বতে আপনি মশগুল। এমন লাইলী মজনু!
সময় অসময়ে মায়ের জন্যে বুকের মধ্যে তুফান ওঠে।
পিয়ারি মা আমার চলে গেলেন হাওয়ার মতো। মৌমাছির গুঞ্জন ছড়িয়ে। কাঁকর বাছতে বাছতে-
হঠাৎ শুক্রবার সকালে মোহসীন মামা এলেন আষাঢ় মাসের ঝড় মাথায় করে।মামা মায়ের দুই বছরের বড়ো।কত দিন পর মামা এলেন। দুপুরে বোয়ালমাছের ঘন ঝোল তৃপ্তি করে খেলেন।সারাবিকেল সন্ধ্যা বাদলা মেঘের ডাকাডাকি।মায়ের হাজার কথা, স্মৃতির হাট।মামা অতিপুরানো ইতিহাসের পাতা খুলে ধরেন। আমরা এক শ্যামলা ষোড়শীর নিয়তির খেলারখোয়াব দেখি !...
‘পিয়ারির বিয়ের পাকা কথা হয়ে গেছে। হবু বর কলেজ শিক্ষক। রবিবার মুলাডুলির বাড়িতে আত্মীয় কুটুমেরমেলা।রঙিন গেট। ফরাস বিছানো বৈঠকঘর। জামাইয়ের জন্যে ‘সাগোরানা’ সাজানো। শ্যালিকার দল বরণডালা হাতে খাড়া।বিয়ের গীত হচ্ছে ছাতিম তলায়। তরফদার বাড়িতে ঝিলমিলি জোনাক জ্বলে।
আচমকা হঠাৎ এক বিষমাখা তির ছুটে এলো।হাটিকুমরুলের কাছে সড়ক দুর্ঘটনায় কলেজ শিক্ষক মোজাম্মেল,হবু বরপ্রাণ হারিয়েছেন।স্পট ডেট।
পিয়ারি বু কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে হয়ে গেলেন অপয়া। পাত্রপক্ষেরখা-ারণী কিছু মহিলা ষোলবছরের বোনটার জীবন কষ্টিকালা করে তুলল।অপয়া,অলক্ষী,ভাতারখাকি যত গালমন্দ করা যায়। বুবু ঘরের ভিতর বন্দী দশায় কাটান।পাড়া পড়শি সুযোগপেলেই টিপ্পনী কাটে। অপয়া- অপয়া।জন্মদাগী।অসতী অলক্ষী।কপাল পোড়া। তারপর দুম করে বাসেত মৃধার সাথে কবুল হয়ে যায়। হায় আমার শান্ত গুণবতী বোনটি লক্ষ্মী হতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। পয়মন্ত পিয়ারি হতে দিন-রাত হাপরের দিকদারি।’
মহসিনমামা এক প্রতœ সিন্দুকের ডালা খুলে দিলেন। আমি এক অবোধ শিশু যেন!হঠাৎ বলে উঠলাম ‘মৌমাছি মৌমাছি কোথা যাওনাচি নাচি/...দাঁড়াবার সময় তো নাই।’...
পড়ন্তফাল্গুনের দিন। ডালে ডালেসোনালু, কৃষ্ণচূড়ার বৈভব।নিঝুম মহল্লা। সরাইল সারমেয় কয়েকটিআর কাক ডাকছে। মামা চলে গেলেনমুলাডুলি।
সন্ধ্যা আসন্ন। আদা চা নিয়ে বসেছি। বিবিয়ানা সুরমা বুজি কপাটের ওপাশে চিত্রবৎ খাড়া। চোখ জোড়া আমার বেকুব। হাতে সেই কিশোরকালের বাদামি রঙের লেদার ব্যাগ। আমি রবোটের মতো পাতিলেবুর ফালি কাটি। দ্রুততম সময়ে শরবত বানিয়ে ফেলি। বুজি কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘কাজলা পানি দে।’
তখন বুজি দমকে দমকে ক্রন্দন গিলে ফেলেন। বাপের বাড়িতে যেমন শাক ভাতের সাথে মথে নানাজাতের ক্রন্দন গিলে ফেলতাম আমরা। সেও এক অধীত বিদ্যা। শিল্পকলা!বুজি বেহুশ, চোখ দুইটা লিচু ফলের মতো ঘোলা।
‘কাজলারে সেই দরবেশ, সেই ফেরেশতারে আমি এতকালেওচিনি নাই। সেই লোকটা সুফিবাক্য কয়। ওয়াজে নসিহত করে। মধ্যে মধ্যে খানকা শরীফের রাস্তা ভুলভুলাইয়ারদিক নিয়া যায়! লোকটা যায় ছিনাল ঝিলিকের ঘরে।আরও যায় কুলটা ঝিনুকমালার দাওয়ায়।তিনি নাকি তাগরে ইসলামের দাওয়াত দিতেস্বয়ং হাজির হন।’
বুজির উন্মাদ দশা। হিজাব খসে গেছে। দিঘল চুল সাপের ফুা। কেউটেসাপের ফু। বুজি ফেটে পড়ে, যেন এক সুপ্ত আগ্নেয়গিরি, ‘ইসলামের খিদমতগার! থুঃ।’
প্রাণপণে ভুলতে চাওয়া একটা কালো দাগ ক্রমশ গাঢ়বর্ণ হয়ে উঠল। বুবু জান্নাত ভিলা থেকে বিদায় নেবার ঠিক আগের দিন দাঁড়িতে আঙুল দিয়ে চিরুনি করতে করতেজড়িয়ে ধরেছিল লোকটা,আমাকে। সাক্ষাৎপাইথন বুনো ভল্লুক!
‘শালিকা এমনভরা যুবতী। আমার পাওনা। বোনাস না নিয়া বিদায় হওয়া জায়েজ না।’
পুরোপুরি ঘোরগ্রস্ত বোধ শূন্য আমি।পাতালের কোনঅন্ধকারেতলিয়ে গেছি। কেমন করে যেন গোসলখানায় ঢুকে বালতি বালতি পানি ঢেলেছি। সিন্দুকেরগহীনে লুকিয়ে ফেলেছি আমার বিপর্যয়ের বিষণœতম অধ্যায়।কাকপক্ষীও জানে না।প্রাণপণে গগনবিদারী চিক্কুর গিলে খেতে হয়েছিল।...
বুজিপাথর প্রতিমারমতো শান্ত এখন। লেদারের ব্যাগ খুলে নক্সা করা সেইছোট্টকাঠেরবাক্সটা আলগোছে বের করলেন।উপরের ডালায় চন্দন সুবাস। চন্দনদা এক ফাল্গুনে উপহার দিয়েছিলেন। ডালার ভেতরে নীল ভেলভেটের আস্তর। তার উপরে কয়েকটি মৃত কাচপোকার ডানা। কিছুটা উজ্জ্বল রঙের আভাস। সহসাচোখ ভিজে ওঠে।
নকশিবাক্সের মালিকানা নিয়ে আমাদের খুনসুটি হতো। মান অভিমান কখনও খুচরো ঝগড়া!...
বুজি ভেজা গলায় বলেন, ‘কাজলা হাত পাত। এটা তোর।’ এইমাহেন্দ্রক্ষণে মানিকের জন্যে হুহু করে ওঠে মন।সুদূর মরুর দেশে ভাইটি আমার। তোরজোড় করে হিটলার বাবাই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
আমি সুরমা বুজিকে জাঁপটে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠি। বুজি প্রলাপবকছেন, ‘মা মা গো। কত দূরে তুমি।
মা রে আয়। আমি তোমার ওষুধ বাক্স ভরে কিনে দেব’ মা- সারা ঘরে মায়ের গায়েরগন্ধ। হায় ‘অপয়া’ নাম ঘোচাতে মা আমার মধ্যরাত অবধি দৌড়ের উপরে থাকতেন।
সহোদরাদের ক্রন্দন ছাতিম পাতায় লেপ্টে থাকে।জানালা বরাবর সপ্তপর্ণ। ফুল ফুটেছে অজ¯্র। মাতালকরা সুগন্ধ।
কোনো একদিন ছাতিম পাতার কাহিনি আর যত সুখদুঃখের ইতিকথা জোড়া দিয়ে আমি রাষ্ট্র করে দেবো,সহোদরার অমিত সাহসের পাঁয়তারা। দয়ালু আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় বলব, আমার মায়ের খুনি দিব্যি আছে, নতুন বৌ নিয়ে। জান্নাত ভিলা নিজের নামে লিখে নিয়েছে ডগমগে নবাগতা।
অনেক দিন আগেই ‘বাপের বাড়ি’ শব্দ দুটায় মরচে পড়ে গেছে। আমরা এক নয়া কিতাব পাঠ করব। যে কিতাবটির রচয়িতা সহোদরা ভগিনী, আমরা দুইজন।