alt

literature » samoeky

হৃদয়রেখা

ফারহানা সিনথিয়া

: বৃহস্পতিবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বাবা পরাজিত ভঙ্গিতে মাথা নুইয়ে এসে দরজার সামনে দাঁড়ালেন। জেট ল্যাগজনিত ক্লান্তিতে আমারদুই চোখ যেন আঠা দিয়ে কেউ জোড়া দিয়েছে। সদ্য ঘুম ভাঙা চোখে অবাক হয়ে দেখছি। তখনও ঘুমের ঘোর কাটেনি।

আমি চৌকাঠের এপারে। বাবা অন্যপাশে। সাদা চুলে, ন্যুজ ভঙ্গিতে দাঁড়ানোর কারণেই হয়তো বাবাকে বৃদ্ধ দেখায়। আমার দিকে তাকিয়ে দুইপাশে মাথা নেড়ে বললেন, ‘তোমার মা আর নেই।’

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কখন?’

‘গতকাল রাতে তোমার মেজো মামী তাকে অল্প খাবার পাঠিয়েছিলেন। পেঁপে দিয়ে মুরগির মাংস। তোমার মায়ের প্রিয় খাবার। ভোর রাতের দিকে অল্প খেতে পেরেছিল। তারপরে ঘুমিয়ে যায়।ঘুমের মাঝেই... বলে বাকি বাক্য শেষ করতে পারলেন না। আমার চোখের সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।

সদ্য মা হারা আমি সমস্ত শক্তি দিয়ে বাবাকে ধরলাম। কিছুতেই মাটিতে পড়তে দেয়া যাবে না। দরজার চৌকাঠে লেগে মাথা ফেটে যেতে পারে।

দুঃসংবাদ দিতেও বাবা প্রচুর মনোবেদনায় ভুগলেন।নয়তো পেঁপের ঝোল মায়ের প্রিয় খাবার এই কথা বলে সময় নষ্ট করতেন না।অথবা মা যে নেই এই ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে তারও কষ্ট হচ্ছে।ঠিক সেই কারণেই হয়তো অতীতেনয়, বরং বর্তমানেই বর্ণনাদিলেন।

আমার বোকাসোকা মায়ের এমন প্রস্থানই যেন লেখা ছিল। আমি স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। নিস্তরঙ্গজীবনে তার প্রস্থানই যেন উল্লেখযোগ্যঘটনা। তবে আমার মনে হলো তিনি এভাবেই যেতে চেয়েছিলেন। বিনা আড়ম্বরে।

তার জীবন ঘটনাবিহীন ছিল।নিরুত্তাপ ম্যাড়মেড়ে জীবন কাটিয়েছেন। আমার মা হাউজওয়াইফ ছিলেন। রান্না-বান্না বাদে তাকে কোনো কাজ মন দিয়ে করতে দেখিনি। আমার পড়াশোনার ব্যাপারেও খুব মাথা ঘামাতেন না। সংসারে থেকেও উদাসী জীবন কাটিয়েছেন। কখনো সখনো মনে হতো এটা যে তার নিজের সংসার মা ভুলেই যেতেন।

বিকেলবেলায়ভাতঘুম দিতেন। কচিৎ-কদাচিৎ ছাদে উঠে হাঁটতে যেতেন। এমন না আশেপাশের কারো সাথে কূটকচালি করতেন। আসল কথা হচ্ছে কূটনামি করতেও বেশ খানিকটা শক্তি ক্ষয় করতে হয়। তিনি সেই চেষ্টাও করতেন না।

মা দুই দিন আগে তীব্র বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। অসুস্থতার খবর পেয়ে আমি দ্রুত টিকেট কেটে দেশে চলে এলাম। ডাক্তার গ্যাসের ওষুধপত্র দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।রাতটা ভালো ছিলেন, ভোরবেলায় আবার ব্যথা ফেরত এলো। ব্যথায় নীল হয়ে এবার যখন হাসপাতালে গেলেন পুরোনো পারিবারিক ডাক্তার দেখে-শুনে তখুনি হাসপাতালে ভর্তিকরাবার কথা বললেন।সঙ্গে এও বললেন হয়তো একটা অ্যাটাক আগেই হয়ে গেছে।

কিছুক্ষণ বাদেই মেজো চাচা এসে বললেন, “অয়ন এসো। তোমাকে হাসপাতালের ফর্মালিটিজ পূরণ করতে হবে। ভাইজানকেও ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। তুমি দ্রুত রেডি হও।”

শোক সামলানোর সুযোগ তো দূরের কথা; আমার জেটল্যাগও ভালোভাবে কাটেনি। এর মাঝে আমি বুঝলাম ডেথ সার্টিফিকেট ইত্যাদি ফর্মালিটিজ সব আমারই করতে হবে। আমার নামের অর্থ পর্বত। পর্বত সমান দায়িত্ব দিয়ে মা যে আমাকে একা করে চলে গেলেন।

নানার পুরোনো চিকিৎসক বাড়িতে বাবাকে দেখতে এলেন। ভদ্রলোক এসেছেন সাদা পোশাকে। চোখে মোটা ফ্রেমের কালো চশমা। এর আগে যতবার মঞ্জুর মামার সাথে দেখা হয়েছে ততবার পকেট থেকে চকোলেট বের করে দিয়েছেন।নানার পুরোনো চিকিৎসক হবার সুবাদেই মামা সম্বোধন আর আমাদের বাড়িতে অবাধ যাতায়াত ছিল। লোকমুখে শুনেছিলাম তিনি নাকি আমার মাকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন।অহংকারী নানা সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিলেন। অন্য কারো বাড়িতে জায়গীর থেকে যে মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাস করেছে তার সাথে অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ের কিছুতেই বিয়ে সম্ভব নয়। আমার ধারণা মঞ্জুর মামার অনুরাগ একপাক্ষিক ছিল না। আমার ধারণা মা এককালে তাকে পছন্দ করতেন।হয়তো ভালোও বাসতেন।

মঞ্জুর মামা অল্প বয়সে দেখতে সুন্দর ছিলেন। নানাজানের তা নিয়েও আপত্তি ছিল। আমার মা আমার চোখে সুন্দর হলেও পৃথিবীর চোখে সম্ভবত সাদামাটা ছিলেন।অতএব সাধারণ দর্শন একজন পুরুষের সাথে বিয়ে দেয়া হয় পরিবারের ইচ্ছেতে।

মঞ্জুর মামা বাবাকে পরীক্ষা করে বললেন, “বিপি বেড়ে গেছিল। আপনি প্লিজ বিশ্রাম নিন।”

বাবা কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে মায়ের স্মৃতিচারণ করছেন।“কোনোদিন আমার সাথে তার মনোমালিন্য হয়নি। তোমার মা কখনো আমার কথার অবাধ্য হয়নি।আমি খুব সুখী সংসার জীবন পালন করেছি। তোমার মা আমাকে সুখে রেখেছিলেন।” “বাবা তুমি রেস্ট করো। আমি হাসপাতালের ফর্মালিটিগুলো শেষ করে মাকে নিয়ে আসছি। শেষবারের মতো মায়ের প্রিয় শিউলিতলায় তাকে রাখা হবে। বাদ আছর দাফন।”

বাবার সাথে আমি যথেষ্ট রূঢ় ভঙ্গিতে কথা বলেছি। তিনি নানাবাড়ির সম্পত্তির ভাগ নেবার সময়ে মাকে বিভিন্ন সময়ে চাপ দিয়েছেন। এই নিয়ে মামাদের সাথে মায়ের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। একটা কুৎসিত রটনা শুনেছিলামবাবা নাকি কায়দা করে সাদা কাগজে মামা বাড়ির অনেকের স্বাক্ষর নিয়েছিলেন। আমার মামাতো ভাইয়ের ভাষ্য অনুযায়ী মা পুরো কথা জানার পরে সেই কাগজ মামাদের ফেরত দিয়েছিলেন। আমি আন্দাজ করতে পারি আত্মসম্মানজ্ঞানসম্পন্ন মায়ের মনের অবস্থা কেমন হয়েছিল। বাবার কথায় সত্যের সাথে মিথ্যে মেশানো আছে। সত্য হচ্ছে মা তার কথার অবাধ্য হয়েছিলেন। সেই একবার।

বাবাকে দেখে মঞ্জুর মামা আমার সাথে হাসপাতালের পথে রওনা হলেন। নিয়তির রসবোধ অসাধারণ।জীবিত অবস্থায় যে কন্যার পাণিগ্রহণ করতে পারেননি; আজ শেষ যাত্রায় সেই কন্যার সঙ্গী হতে যাচ্ছেন ভদ্রলোক। আমার পাশে বসেছে আমার মামাতো বোন হেলেন।

গাড়ি চালাচ্ছেন মেজো মামা। মায়ের ভাইদের মাঝে মেজো মামার সাথে তার চেহারায় সবচেয়ে বেশি মিল পাওয়া যায়। তবে স্বভাবে বিপরীত। মেজো মামা চতুর স্বভাবের মানুষ।হিসাব করে কথা বলেন। আমার চোখ শুষ্ক মরুভূমির মতো খটখটে।

মেজো মামা কথা শুরু করলেন, “তোমার মা বোন হিসাবে বড় ভালো ছিলেন।”

আমি চুপ করে রইলাম। ভালোই ছিলেন। কারো সাতেপাঁচে থাকতেন না। মাছের বড় টুকরো খাবার আবদার বাদে তেমন কোনো কিছুই চাননি।অথচ এই সব ছোট ছোট আবদার ঘিরেই লোকজন তিতিবিরক্ত হতো।

“তবে আপা বড় বোকা ছিলেন। ওই এক দোষ।”

আমি ভাবলাম একবার প্রশ্ন করি বুদ্ধিমতী হতে হলে আসলে ঠিক কতটা বিদ্যেধারী হতে হয়? তবে মৃত মানুষের দোষ নিয়ে যে কথা বলতে হয় না তা আমার বুদ্ধিমান মেজো মামা ভুলে গেছেন।

মঞ্জুর মামা বললেন, “সেতারা পড়ালেখায় খুব ভালো ছিল।অংকে ওর মাথা খুব ভালো ছিল। তুমি জানো কিনা জানি না বাবা- তোমার মা টানা কয়েক বছর ক্লাসে প্রথম হতেন। মেট্রিকেও স্টার পেয়েছিল।তখনকার দিনে তো এমন এ প্লাসের ছড়াছড়ি ছিল না।অল্প বয়সে বিয়ে না হলে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতো। তা না হলেও বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরি করার মতো মাথা সেতারার ছিল।”

“জি মামা।আমি মায়ের কাছে সেই গল্প অনেকবার শুনেছি।অল্পবয়সে বিয়ে না দিলে পড়াশোনা করতেন। একথা প্রায়ই বলেন মা।”

আমার কাছে এসব গল্প কেমন অর্থহীন মনে হচ্ছে। আমার মা নেই- এই কথাটাই অমোঘ সত্য। মা বুদ্ধিমান ছিলেন না বোকা ছিলেন সেই প্রশ্ন অবান্তর।নেই- এই কথার চেয়ে বড় সত্য আর কিছুই নেই।

আমি চোখ বন্ধ করলাম।অহেতুক বকবকানি শুনতে বিরক্ত লাগছে। বাড়ি থেকে বের হবার আগেই স্বল্প সময়ে আমি বহু লোকের ফোন ধরেছি। সেই একঘেয়ে কথা। সব শেষে এককথা তোমাকে শক্ত থাকতে হবে।

হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে আমার হাঁটু ভেঙে এলো। ফিনাইলের সাথে যেন মৃত্যুর গন্ধ মিশে আছে। আমি জানালা দিয়ে বাইরে দেখছি। আমার মামাতো বোন হেলেন আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। ও কাঁদছে। হেলেনের পরনে পাট ভাঙা শাড়ি। সফেদ শাড়িতে ওকে বিষণœ দেখাচ্ছে।

ওর কান্না দেখে এক নার্স ছুটে এলেন।

ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “আহারে মা কাঁদে না। তোমার মা তেমন কষ্ট পাননি।”

হেলেন বোধ হয় তার ভুল শোধরাতে বলতে যাচ্ছিল আমি মায়ের ছেলে; আমি ওকে চোখের ইশারায় নিষেধ করলাম।থাক না। এই সময়ে কার দুঃখ গভীরআর কার কষ্ট বেশি সেই প্রতিযোগিতায় যেতে ইচ্ছে করছিল না। মায়ের ভাতিজি যেমন কষ্ট পাচ্ছে; তেমনি তার সন্তান গভীর দুঃখে ভারাক্রান্ত।

“দাদাভাই, ফুপু মোটেও বোকা ছিলেন না।”

“আমি জানি।”

“তুমি জানো শফিক ভাইয়ের বিয়েতে কী হয়েছিল?”

“মনে আছে। মা কাকে যেন বেফাঁস কথা বলেছিলেন।”, এই কথা বলে আমি হাসলাম। আমার মায়ের মুখে আসলে কোনো ফিল্টার ছিল না। যা মনে আসতো বলে ফেলতেন। বিয়েবাড়িতে মেয়েরা এক ঘরে বসে গল্প করছিলেন। আমার মামাতো ভাই রনি ঘুরেঘুরে আসছিল। মা একগাল হেসে তাকে প্রশ্ন করেছিলেন তুই কি আন্ডার ওয়ার খুজঁছিস? ঘরভর্তি মেয়েরা হাসিতে ভেঙে পড়েছিল।

“হ্যাঁ মনে আছে। মা হাসতে হাসতে একটা কথা বলে রনি ভাইকে অপ্রস্তুত করে দিয়েছিলেন। কিছু মনে রেখো না। সেসব পুরোনো কথা। মা তেমন ভেবে কিছুই বলেননি।”

“তুমি কিছুই জানো না। রনি ভাই এর চারিত্রিক দোষ ছিল। তার হাত থেকে পরিবারের মেয়েরাও রেহাই পেতো না। পুরো বিয়েবাড়িতে আমি ভয়ে ভয়ে ছিলাম। ফুপু কী করে যেন টের পেয়েছিলেন। ওই বেফাঁস কথা বলে ফেলার পরে আর মেয়েদের আড্ডায় রনি ভাই আসেননি। আর কেউ না বুঝলেও ফুপি বুঝেছিলেন। আমি তো মাকেও এসব কথা বলতে পারিনি। বাবাকে বলে দিলে সে ঠিক রনি ভাইকে মেরে ফেলত।ফুপি কী করে বুঝেছিলেন আমি জানি না; অথচ তোমরা সারাজীবন ফুপিকে বোকাসোকা বলে চালিয়ে দিলে।”

আমি অবাক চোখে হেলেনের দিকে তাকালাম। সেই ছোট্ট হেলেন কত বড় হয়ে গেছে। আমাকে গুছিয়ে সান্ত¡না দিচ্ছে।

হেলেন কাঁদছে। চোখ মুছে বলল, “দাদাভাই একটা কথা জানো? আমি ফুপির জীবনের সাথে আমার জীবনের অদ্ভুত মিল খুঁজে পাই। আমাদের দুজনের একটা করে সন্তান। ফুপির মতো বিনা আড়ম্বরে আমার শেষ বিদায় হবে।”

“তেমন কিছুই হবে না হেলেন। তুই অনেক বছর বাঁচবি।”

“যাই করো দাদাভাই। আমার মেয়ের সামনে আমাকে বোকা বোলো না। মৃত মানুষ তো আর নিজের সাফাই গাইতে পারে না। এই যে দেখো আমি আমার ফুপুর হয়ে সাফাই গাইছি।তুমি মুখ বুজে শুনছ। আমার বেলায় যদি সাফাই দেবার লোক না পাওয়া যায়।”

আমি হেলেনের দিকে তাকালাম। মাথায় কাপড়, ফোলা চোখে ওর চোখে মুখেও কেমন মা ভাব প্রবল। তার মনোবেদনার কারণ খুঁজতে ইচ্ছে হলো না। মেয়েটি তার নিজের জীবনের সাথে মায়ের জীবনের সমান্তরাল মিল খুঁজে কষ্ট পাচ্ছে।

কিছুক্ষণ পরেই আমাকে কেবিনে নিয়ে গেলো। সেখানে সাদা কাপড়ে মোড়ানো মা শুয়ে আছে। গতরাতে যখন মাকে দেখতে এসেছিলাম ঠিক এভাবেই শুয়ে ছিলেন। আমাকে দেখে চোখ মেলে তাকিয়ে বলেছিলেন, “তুই এসেছিস বাবু?”

আমি কাছে গিয়ে হাত ধরে দাঁড়িয়েছিলাম।শীর্ণ হাতের নীল শিরা উপশিরা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।

আমি সারা জীবন বাড়ি থেকে দূরেই থেকেছি।প্রথমে ক্যাডেট কলেজ। তারপরে সিঙ্গাপুর-এ ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গেলাম। এই দোষটাও সবাই মাকেই দিতো। একমাত্র সন্তানকে কেন দূরে দূরে রাখছেন? আমার ফাঁকিবাজ, অলস, বোকাসোকা মা। আমি কোনোকালেই গৃহী মানুষ ছিলাম না। যাযাবর জীবনে আমার ঘরের সাথে একমাত্র সংযোগ ছিল মা।

মায়ের সামনে দাঁড়িয়েই ঠিক সেই মুহূর্তে তার অনুপস্থিতি আমি অনুভব করলাম। বুঝলাম তার নশ্বর শরীরটা আছে; মা আর নেই। আমার কাঁধে হাতের স্পর্শ পেলাম। দেখি মেজো মামা আর মঞ্জুর মামা দাঁড়িয়ে আছেন।

মেজো মামা বেরিয়ে গেলেন।হয়তো আমাকে একান্তে মায়ের সাথে শেষবারের মতো সময় কাটাতে দিলেন।মঞ্জুর মামা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার দৃষ্টি জানালার বাইরে। যেন দূরে দেখছেন।

মেজো মামার কথা ভেসে এলো, “আপার জন্য শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন ডাক্তাররা। ওই যে দেখো না সিনেমাতে যেমন হয়। একটা স্ক্রিনে দেখা যায় উঁচু নিচু লাইন কেমন সোজা হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে।আপার সৌভাগ্য চিন্তা করো শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করেছেন চিকিৎসকরা।”

অদ্ভুত এক বিষাদে আচ্ছন্ন হলাম। আমার মায়ের হৃদয়রেখা আঁকাবাঁকা থেকে স্থির হয়ে গেছে এর চেয়ে বেদনার কিছুই নেই।অথচ মেজো মামার কথা বলার ভঙ্গিতে আমি অসুস্থ কৌতূহল শুনতে পাচ্ছি।মায়ের হৃদয়রেখা নিয়ে তার মন্তব্য শুনে বিরক্ত হচ্ছিলাম। কাঁটার মতো বিঁধেছিল কথাগুলো কানে।

সেই কথা বুঝেই কিনা মঞ্জুর মামা বলে উঠলেন, “শোনো আমি শেষ পর্যন্ত তোমার মায়ের পাশে ছিলাম। যেমন শুনছো তেমন কিছুই হয়নি। তিনি কষ্ট পাননি।যমে-মানুষে টানাটানি হয়নি।নীরবে চলে গেছেন। তার হৃদয়রেখা একসময় স্থিরবিন্দুতে পৌঁছে গেছে।”

একথা বলে তিনি চুপ করে গেলেন। আবার সেই জানালার দিকে দৃষ্টি। আমি খেয়াল করে দেখলাম তিনি কাঁদছেন। আমার মনে হলো আমার মায়ের হৃদয়রেখা শূন্যে মিলিয়ে যায়নি; মিশে গিয়েছে তার এক পুরোনো অনুরাগীর হৃদয়ে। আমার বাবা যেই হৃদয়ের সন্ধান পাননি। বা পেয়েছিলেন বলে ভুল ধারণা পোষণ করতেন। সমাজ সম্পর্কের সংজ্ঞা দিতে পারে। তবে হৃদয়রেখা সেই ভেদাভেদ ছিন্ন করে মিশে যায় আত্মার বন্ধনে।

ছবি

সুকান্ত ভট্টাচার্য: বহুচর্চিত, বহুপঠিত এক অনন্য কবি

ছবি

চিত্রাঙ্গদা: দ্বৈত সত্তার শিল্পস্মারক

ছবি

খালেদ হামিদীর দৌত্যে ওরহান পামুক

সাময়িকী কবিতা

ছবি

মেঘলা আকাশ বৃষ্টি

ছবি

স্মৃতি ভদ্র

ছবি

সুরমা বুজি অথবা কাচপোকা

ছবি

শ্রাবণের জোছনায় হেসেছিল নার্গিস

ছবি

যোগাযোগ

ছবি

বাংলাদেশের স্বাপ্নিক কবি নজরুল

ছবি

ইলিয়াসের আশ্চর্য নিরীক্ষা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

মাটি ও মানুষের কথক

ছবি

অনাবিল প্রাচুর্যে ঋদ্ধ নজরুল প্রতিভা

ছবি

নজরুল: চির-বিস্ময়

ছবি

জীবনের সাথে সংযোগ ঘটল কই

পোয়েমস দ্যাট কেম টু মি

ছবি

লালন ও রবীন্দ্রনাথ অন্তর্জগতের আলাপন

ছবি

বংশধারা

ছবি

অনন্ত নক্ষত্র বিথিতে এক নির্বাসিত কবির যাত্রা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

তিন প্রহরের শকুন

ছবি

ইলিয়াসের আশ্চর্য নিরীক্ষা

ছবি

যতীন সরকার : সাম্যবাদের চেতনায় একজীবন

ছবি

‘প্রান্তিক মানুষের হারানোর কিছু নেই’

ছবি

ভাঙা ছাদ

ছবি

চন্দ্রাবতী : মধ্যযুগের প্রথম মহিলা কবি

ছবি

আধুনিক-উত্তর সময়ের নির্মিতি

ছবি

বংশধারা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

আবুবকর সিদ্দিকের ছোট গল্পে রাজনীতি

ছবি

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসের তুলনামূলক বিচার

ছবি

সমকালীন কাব্যভাষায় কবি শহীদ কাদরী

ছবি

চরফুলের কন্যা

ছবি

নজরুলের গল্প ও উপন্যাস

সাময়িকী কবিতা

tab

literature » samoeky

হৃদয়রেখা

ফারহানা সিনথিয়া

বৃহস্পতিবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বাবা পরাজিত ভঙ্গিতে মাথা নুইয়ে এসে দরজার সামনে দাঁড়ালেন। জেট ল্যাগজনিত ক্লান্তিতে আমারদুই চোখ যেন আঠা দিয়ে কেউ জোড়া দিয়েছে। সদ্য ঘুম ভাঙা চোখে অবাক হয়ে দেখছি। তখনও ঘুমের ঘোর কাটেনি।

আমি চৌকাঠের এপারে। বাবা অন্যপাশে। সাদা চুলে, ন্যুজ ভঙ্গিতে দাঁড়ানোর কারণেই হয়তো বাবাকে বৃদ্ধ দেখায়। আমার দিকে তাকিয়ে দুইপাশে মাথা নেড়ে বললেন, ‘তোমার মা আর নেই।’

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কখন?’

‘গতকাল রাতে তোমার মেজো মামী তাকে অল্প খাবার পাঠিয়েছিলেন। পেঁপে দিয়ে মুরগির মাংস। তোমার মায়ের প্রিয় খাবার। ভোর রাতের দিকে অল্প খেতে পেরেছিল। তারপরে ঘুমিয়ে যায়।ঘুমের মাঝেই... বলে বাকি বাক্য শেষ করতে পারলেন না। আমার চোখের সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।

সদ্য মা হারা আমি সমস্ত শক্তি দিয়ে বাবাকে ধরলাম। কিছুতেই মাটিতে পড়তে দেয়া যাবে না। দরজার চৌকাঠে লেগে মাথা ফেটে যেতে পারে।

দুঃসংবাদ দিতেও বাবা প্রচুর মনোবেদনায় ভুগলেন।নয়তো পেঁপের ঝোল মায়ের প্রিয় খাবার এই কথা বলে সময় নষ্ট করতেন না।অথবা মা যে নেই এই ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে তারও কষ্ট হচ্ছে।ঠিক সেই কারণেই হয়তো অতীতেনয়, বরং বর্তমানেই বর্ণনাদিলেন।

আমার বোকাসোকা মায়ের এমন প্রস্থানই যেন লেখা ছিল। আমি স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। নিস্তরঙ্গজীবনে তার প্রস্থানই যেন উল্লেখযোগ্যঘটনা। তবে আমার মনে হলো তিনি এভাবেই যেতে চেয়েছিলেন। বিনা আড়ম্বরে।

তার জীবন ঘটনাবিহীন ছিল।নিরুত্তাপ ম্যাড়মেড়ে জীবন কাটিয়েছেন। আমার মা হাউজওয়াইফ ছিলেন। রান্না-বান্না বাদে তাকে কোনো কাজ মন দিয়ে করতে দেখিনি। আমার পড়াশোনার ব্যাপারেও খুব মাথা ঘামাতেন না। সংসারে থেকেও উদাসী জীবন কাটিয়েছেন। কখনো সখনো মনে হতো এটা যে তার নিজের সংসার মা ভুলেই যেতেন।

বিকেলবেলায়ভাতঘুম দিতেন। কচিৎ-কদাচিৎ ছাদে উঠে হাঁটতে যেতেন। এমন না আশেপাশের কারো সাথে কূটকচালি করতেন। আসল কথা হচ্ছে কূটনামি করতেও বেশ খানিকটা শক্তি ক্ষয় করতে হয়। তিনি সেই চেষ্টাও করতেন না।

মা দুই দিন আগে তীব্র বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। অসুস্থতার খবর পেয়ে আমি দ্রুত টিকেট কেটে দেশে চলে এলাম। ডাক্তার গ্যাসের ওষুধপত্র দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।রাতটা ভালো ছিলেন, ভোরবেলায় আবার ব্যথা ফেরত এলো। ব্যথায় নীল হয়ে এবার যখন হাসপাতালে গেলেন পুরোনো পারিবারিক ডাক্তার দেখে-শুনে তখুনি হাসপাতালে ভর্তিকরাবার কথা বললেন।সঙ্গে এও বললেন হয়তো একটা অ্যাটাক আগেই হয়ে গেছে।

কিছুক্ষণ বাদেই মেজো চাচা এসে বললেন, “অয়ন এসো। তোমাকে হাসপাতালের ফর্মালিটিজ পূরণ করতে হবে। ভাইজানকেও ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। তুমি দ্রুত রেডি হও।”

শোক সামলানোর সুযোগ তো দূরের কথা; আমার জেটল্যাগও ভালোভাবে কাটেনি। এর মাঝে আমি বুঝলাম ডেথ সার্টিফিকেট ইত্যাদি ফর্মালিটিজ সব আমারই করতে হবে। আমার নামের অর্থ পর্বত। পর্বত সমান দায়িত্ব দিয়ে মা যে আমাকে একা করে চলে গেলেন।

নানার পুরোনো চিকিৎসক বাড়িতে বাবাকে দেখতে এলেন। ভদ্রলোক এসেছেন সাদা পোশাকে। চোখে মোটা ফ্রেমের কালো চশমা। এর আগে যতবার মঞ্জুর মামার সাথে দেখা হয়েছে ততবার পকেট থেকে চকোলেট বের করে দিয়েছেন।নানার পুরোনো চিকিৎসক হবার সুবাদেই মামা সম্বোধন আর আমাদের বাড়িতে অবাধ যাতায়াত ছিল। লোকমুখে শুনেছিলাম তিনি নাকি আমার মাকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন।অহংকারী নানা সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিলেন। অন্য কারো বাড়িতে জায়গীর থেকে যে মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাস করেছে তার সাথে অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ের কিছুতেই বিয়ে সম্ভব নয়। আমার ধারণা মঞ্জুর মামার অনুরাগ একপাক্ষিক ছিল না। আমার ধারণা মা এককালে তাকে পছন্দ করতেন।হয়তো ভালোও বাসতেন।

মঞ্জুর মামা অল্প বয়সে দেখতে সুন্দর ছিলেন। নানাজানের তা নিয়েও আপত্তি ছিল। আমার মা আমার চোখে সুন্দর হলেও পৃথিবীর চোখে সম্ভবত সাদামাটা ছিলেন।অতএব সাধারণ দর্শন একজন পুরুষের সাথে বিয়ে দেয়া হয় পরিবারের ইচ্ছেতে।

মঞ্জুর মামা বাবাকে পরীক্ষা করে বললেন, “বিপি বেড়ে গেছিল। আপনি প্লিজ বিশ্রাম নিন।”

বাবা কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে মায়ের স্মৃতিচারণ করছেন।“কোনোদিন আমার সাথে তার মনোমালিন্য হয়নি। তোমার মা কখনো আমার কথার অবাধ্য হয়নি।আমি খুব সুখী সংসার জীবন পালন করেছি। তোমার মা আমাকে সুখে রেখেছিলেন।” “বাবা তুমি রেস্ট করো। আমি হাসপাতালের ফর্মালিটিগুলো শেষ করে মাকে নিয়ে আসছি। শেষবারের মতো মায়ের প্রিয় শিউলিতলায় তাকে রাখা হবে। বাদ আছর দাফন।”

বাবার সাথে আমি যথেষ্ট রূঢ় ভঙ্গিতে কথা বলেছি। তিনি নানাবাড়ির সম্পত্তির ভাগ নেবার সময়ে মাকে বিভিন্ন সময়ে চাপ দিয়েছেন। এই নিয়ে মামাদের সাথে মায়ের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। একটা কুৎসিত রটনা শুনেছিলামবাবা নাকি কায়দা করে সাদা কাগজে মামা বাড়ির অনেকের স্বাক্ষর নিয়েছিলেন। আমার মামাতো ভাইয়ের ভাষ্য অনুযায়ী মা পুরো কথা জানার পরে সেই কাগজ মামাদের ফেরত দিয়েছিলেন। আমি আন্দাজ করতে পারি আত্মসম্মানজ্ঞানসম্পন্ন মায়ের মনের অবস্থা কেমন হয়েছিল। বাবার কথায় সত্যের সাথে মিথ্যে মেশানো আছে। সত্য হচ্ছে মা তার কথার অবাধ্য হয়েছিলেন। সেই একবার।

বাবাকে দেখে মঞ্জুর মামা আমার সাথে হাসপাতালের পথে রওনা হলেন। নিয়তির রসবোধ অসাধারণ।জীবিত অবস্থায় যে কন্যার পাণিগ্রহণ করতে পারেননি; আজ শেষ যাত্রায় সেই কন্যার সঙ্গী হতে যাচ্ছেন ভদ্রলোক। আমার পাশে বসেছে আমার মামাতো বোন হেলেন।

গাড়ি চালাচ্ছেন মেজো মামা। মায়ের ভাইদের মাঝে মেজো মামার সাথে তার চেহারায় সবচেয়ে বেশি মিল পাওয়া যায়। তবে স্বভাবে বিপরীত। মেজো মামা চতুর স্বভাবের মানুষ।হিসাব করে কথা বলেন। আমার চোখ শুষ্ক মরুভূমির মতো খটখটে।

মেজো মামা কথা শুরু করলেন, “তোমার মা বোন হিসাবে বড় ভালো ছিলেন।”

আমি চুপ করে রইলাম। ভালোই ছিলেন। কারো সাতেপাঁচে থাকতেন না। মাছের বড় টুকরো খাবার আবদার বাদে তেমন কোনো কিছুই চাননি।অথচ এই সব ছোট ছোট আবদার ঘিরেই লোকজন তিতিবিরক্ত হতো।

“তবে আপা বড় বোকা ছিলেন। ওই এক দোষ।”

আমি ভাবলাম একবার প্রশ্ন করি বুদ্ধিমতী হতে হলে আসলে ঠিক কতটা বিদ্যেধারী হতে হয়? তবে মৃত মানুষের দোষ নিয়ে যে কথা বলতে হয় না তা আমার বুদ্ধিমান মেজো মামা ভুলে গেছেন।

মঞ্জুর মামা বললেন, “সেতারা পড়ালেখায় খুব ভালো ছিল।অংকে ওর মাথা খুব ভালো ছিল। তুমি জানো কিনা জানি না বাবা- তোমার মা টানা কয়েক বছর ক্লাসে প্রথম হতেন। মেট্রিকেও স্টার পেয়েছিল।তখনকার দিনে তো এমন এ প্লাসের ছড়াছড়ি ছিল না।অল্প বয়সে বিয়ে না হলে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতো। তা না হলেও বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরি করার মতো মাথা সেতারার ছিল।”

“জি মামা।আমি মায়ের কাছে সেই গল্প অনেকবার শুনেছি।অল্পবয়সে বিয়ে না দিলে পড়াশোনা করতেন। একথা প্রায়ই বলেন মা।”

আমার কাছে এসব গল্প কেমন অর্থহীন মনে হচ্ছে। আমার মা নেই- এই কথাটাই অমোঘ সত্য। মা বুদ্ধিমান ছিলেন না বোকা ছিলেন সেই প্রশ্ন অবান্তর।নেই- এই কথার চেয়ে বড় সত্য আর কিছুই নেই।

আমি চোখ বন্ধ করলাম।অহেতুক বকবকানি শুনতে বিরক্ত লাগছে। বাড়ি থেকে বের হবার আগেই স্বল্প সময়ে আমি বহু লোকের ফোন ধরেছি। সেই একঘেয়ে কথা। সব শেষে এককথা তোমাকে শক্ত থাকতে হবে।

হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে আমার হাঁটু ভেঙে এলো। ফিনাইলের সাথে যেন মৃত্যুর গন্ধ মিশে আছে। আমি জানালা দিয়ে বাইরে দেখছি। আমার মামাতো বোন হেলেন আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। ও কাঁদছে। হেলেনের পরনে পাট ভাঙা শাড়ি। সফেদ শাড়িতে ওকে বিষণœ দেখাচ্ছে।

ওর কান্না দেখে এক নার্স ছুটে এলেন।

ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “আহারে মা কাঁদে না। তোমার মা তেমন কষ্ট পাননি।”

হেলেন বোধ হয় তার ভুল শোধরাতে বলতে যাচ্ছিল আমি মায়ের ছেলে; আমি ওকে চোখের ইশারায় নিষেধ করলাম।থাক না। এই সময়ে কার দুঃখ গভীরআর কার কষ্ট বেশি সেই প্রতিযোগিতায় যেতে ইচ্ছে করছিল না। মায়ের ভাতিজি যেমন কষ্ট পাচ্ছে; তেমনি তার সন্তান গভীর দুঃখে ভারাক্রান্ত।

“দাদাভাই, ফুপু মোটেও বোকা ছিলেন না।”

“আমি জানি।”

“তুমি জানো শফিক ভাইয়ের বিয়েতে কী হয়েছিল?”

“মনে আছে। মা কাকে যেন বেফাঁস কথা বলেছিলেন।”, এই কথা বলে আমি হাসলাম। আমার মায়ের মুখে আসলে কোনো ফিল্টার ছিল না। যা মনে আসতো বলে ফেলতেন। বিয়েবাড়িতে মেয়েরা এক ঘরে বসে গল্প করছিলেন। আমার মামাতো ভাই রনি ঘুরেঘুরে আসছিল। মা একগাল হেসে তাকে প্রশ্ন করেছিলেন তুই কি আন্ডার ওয়ার খুজঁছিস? ঘরভর্তি মেয়েরা হাসিতে ভেঙে পড়েছিল।

“হ্যাঁ মনে আছে। মা হাসতে হাসতে একটা কথা বলে রনি ভাইকে অপ্রস্তুত করে দিয়েছিলেন। কিছু মনে রেখো না। সেসব পুরোনো কথা। মা তেমন ভেবে কিছুই বলেননি।”

“তুমি কিছুই জানো না। রনি ভাই এর চারিত্রিক দোষ ছিল। তার হাত থেকে পরিবারের মেয়েরাও রেহাই পেতো না। পুরো বিয়েবাড়িতে আমি ভয়ে ভয়ে ছিলাম। ফুপু কী করে যেন টের পেয়েছিলেন। ওই বেফাঁস কথা বলে ফেলার পরে আর মেয়েদের আড্ডায় রনি ভাই আসেননি। আর কেউ না বুঝলেও ফুপি বুঝেছিলেন। আমি তো মাকেও এসব কথা বলতে পারিনি। বাবাকে বলে দিলে সে ঠিক রনি ভাইকে মেরে ফেলত।ফুপি কী করে বুঝেছিলেন আমি জানি না; অথচ তোমরা সারাজীবন ফুপিকে বোকাসোকা বলে চালিয়ে দিলে।”

আমি অবাক চোখে হেলেনের দিকে তাকালাম। সেই ছোট্ট হেলেন কত বড় হয়ে গেছে। আমাকে গুছিয়ে সান্ত¡না দিচ্ছে।

হেলেন কাঁদছে। চোখ মুছে বলল, “দাদাভাই একটা কথা জানো? আমি ফুপির জীবনের সাথে আমার জীবনের অদ্ভুত মিল খুঁজে পাই। আমাদের দুজনের একটা করে সন্তান। ফুপির মতো বিনা আড়ম্বরে আমার শেষ বিদায় হবে।”

“তেমন কিছুই হবে না হেলেন। তুই অনেক বছর বাঁচবি।”

“যাই করো দাদাভাই। আমার মেয়ের সামনে আমাকে বোকা বোলো না। মৃত মানুষ তো আর নিজের সাফাই গাইতে পারে না। এই যে দেখো আমি আমার ফুপুর হয়ে সাফাই গাইছি।তুমি মুখ বুজে শুনছ। আমার বেলায় যদি সাফাই দেবার লোক না পাওয়া যায়।”

আমি হেলেনের দিকে তাকালাম। মাথায় কাপড়, ফোলা চোখে ওর চোখে মুখেও কেমন মা ভাব প্রবল। তার মনোবেদনার কারণ খুঁজতে ইচ্ছে হলো না। মেয়েটি তার নিজের জীবনের সাথে মায়ের জীবনের সমান্তরাল মিল খুঁজে কষ্ট পাচ্ছে।

কিছুক্ষণ পরেই আমাকে কেবিনে নিয়ে গেলো। সেখানে সাদা কাপড়ে মোড়ানো মা শুয়ে আছে। গতরাতে যখন মাকে দেখতে এসেছিলাম ঠিক এভাবেই শুয়ে ছিলেন। আমাকে দেখে চোখ মেলে তাকিয়ে বলেছিলেন, “তুই এসেছিস বাবু?”

আমি কাছে গিয়ে হাত ধরে দাঁড়িয়েছিলাম।শীর্ণ হাতের নীল শিরা উপশিরা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।

আমি সারা জীবন বাড়ি থেকে দূরেই থেকেছি।প্রথমে ক্যাডেট কলেজ। তারপরে সিঙ্গাপুর-এ ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গেলাম। এই দোষটাও সবাই মাকেই দিতো। একমাত্র সন্তানকে কেন দূরে দূরে রাখছেন? আমার ফাঁকিবাজ, অলস, বোকাসোকা মা। আমি কোনোকালেই গৃহী মানুষ ছিলাম না। যাযাবর জীবনে আমার ঘরের সাথে একমাত্র সংযোগ ছিল মা।

মায়ের সামনে দাঁড়িয়েই ঠিক সেই মুহূর্তে তার অনুপস্থিতি আমি অনুভব করলাম। বুঝলাম তার নশ্বর শরীরটা আছে; মা আর নেই। আমার কাঁধে হাতের স্পর্শ পেলাম। দেখি মেজো মামা আর মঞ্জুর মামা দাঁড়িয়ে আছেন।

মেজো মামা বেরিয়ে গেলেন।হয়তো আমাকে একান্তে মায়ের সাথে শেষবারের মতো সময় কাটাতে দিলেন।মঞ্জুর মামা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার দৃষ্টি জানালার বাইরে। যেন দূরে দেখছেন।

মেজো মামার কথা ভেসে এলো, “আপার জন্য শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন ডাক্তাররা। ওই যে দেখো না সিনেমাতে যেমন হয়। একটা স্ক্রিনে দেখা যায় উঁচু নিচু লাইন কেমন সোজা হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে।আপার সৌভাগ্য চিন্তা করো শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করেছেন চিকিৎসকরা।”

অদ্ভুত এক বিষাদে আচ্ছন্ন হলাম। আমার মায়ের হৃদয়রেখা আঁকাবাঁকা থেকে স্থির হয়ে গেছে এর চেয়ে বেদনার কিছুই নেই।অথচ মেজো মামার কথা বলার ভঙ্গিতে আমি অসুস্থ কৌতূহল শুনতে পাচ্ছি।মায়ের হৃদয়রেখা নিয়ে তার মন্তব্য শুনে বিরক্ত হচ্ছিলাম। কাঁটার মতো বিঁধেছিল কথাগুলো কানে।

সেই কথা বুঝেই কিনা মঞ্জুর মামা বলে উঠলেন, “শোনো আমি শেষ পর্যন্ত তোমার মায়ের পাশে ছিলাম। যেমন শুনছো তেমন কিছুই হয়নি। তিনি কষ্ট পাননি।যমে-মানুষে টানাটানি হয়নি।নীরবে চলে গেছেন। তার হৃদয়রেখা একসময় স্থিরবিন্দুতে পৌঁছে গেছে।”

একথা বলে তিনি চুপ করে গেলেন। আবার সেই জানালার দিকে দৃষ্টি। আমি খেয়াল করে দেখলাম তিনি কাঁদছেন। আমার মনে হলো আমার মায়ের হৃদয়রেখা শূন্যে মিলিয়ে যায়নি; মিশে গিয়েছে তার এক পুরোনো অনুরাগীর হৃদয়ে। আমার বাবা যেই হৃদয়ের সন্ধান পাননি। বা পেয়েছিলেন বলে ভুল ধারণা পোষণ করতেন। সমাজ সম্পর্কের সংজ্ঞা দিতে পারে। তবে হৃদয়রেখা সেই ভেদাভেদ ছিন্ন করে মিশে যায় আত্মার বন্ধনে।

back to top