হাবিবা রোজী
বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজটা কমে ক্রমশ বাতাসের সাথে মিশে ঝিরঝিরে মিষ্টি একটানাতালে বেজে চলেছে।অফিস থেকে নেমে আরিফ আধ-খাওয়া সিগারেটটা বিনে গুঁজে ড্রাইভওয়ে থেকে গাড়িটা নিয়ে লেকভিউর রাস্তা ধরে চলতে লাগলো। অ্যারাবিকার গুলশানের আউটলেটে গাড়ি পার্ক করলো। অ্যারাবিকায়চিকেন ক্রোসেন্ট আর ব্ল্যাক কফির টেস্টটা ইদানীংআরিফ খুব উপভোগকরে।মন খারাপ হলেই চলে আসে এখানে, কফির উত্তাপে পুড়িয়ে দিতে চায় বিরহের দহন।অ্যারাবিকায় পিক আওয়ারে লোকজন গিজগিজ করে আজ বৃষ্টি বলেই হয়তোবা লোক কিছুটা কম।অর্ডার করে জানালার গ্লাসে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিটা দেখবে বলেযুৎসই একটা জায়গায়বসে পড়ে আরিফ।
কফিতে চুমুক দিয়ে তাকাতেই চোখে পড়লো সামনের টেবিলেবসা রিয়ানাকে, রিয়ানা, হ্যাঁ রিয়ানাই তো! হোক ১২ বছর! রিয়ানাকে চিনবে না আরিফ! হ্যাঁসময়ের ইরেজার কত কিছুইমুছে দিয়েছেকিন্তু এ মুখটা কিছুতেই মুছে দিতেপারেনি,অবুঝ মনের সবুজ উপত্যকায়আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে মুখটা! সহজাত স্বাভাবিক বাধা কাটিয়ে উঠেকখনোইআরিফ কিছুবলতে পারে না,আজ১২ বছরের অব্যক্ত কথাগুলো যেনো অভিমান ঠেলে বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে। উ™£ান্তের মতো দ্রুত পায়ে আরিফরিয়ানার পাশেগিয়ে আবেগে ছুঁয়ে ফেলতে চায় রিয়ানার হাতটা। চট করে আরিফ নিজেকে সামলে নেয়। নির্বাক চাহনিতে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় রিয়ানাকে- এত দিন কেন নিজেকে আড়াল করে রেখেছো? রিয়ানা কোনো ভূমিকা ছাড়াইবলতেশুরু করেনিজের জীবনের ঘটে যাওয়া সিনেমাটিক গল্পটা। বলতেগিয়ে গলাটা ধরে আসে কখনো কখনো। বললো, ব্রেনের জটিল রোগে আক্রান্ত বাবাকে চিকিৎসা করাতে আমেরিকায় চলে গিয়েছিল। বাবামারা যাবার আগে উনারপ্রিয়ছাত্র শাহেদের সাথেরিয়ানার বিয়ে দিয়ে দেন। রিয়ানা এটা কিছুতেই চায়নি। বাবারডাক্তার বন্ধু রিয়াজুদ্দিন আঙ্কেলবুঝিয়েছিলেন অমত করলে রিয়ানার বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন। ব্রেনে প্রেসার পড়বে। ঐ অবস্থায়বাবাকে বাঁচানোই রিয়ানার প্রথম ও প্রধান কাজ বলে মনে হয়েছিল। বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায়হার্ট অ্যাটাক করে শাহেদ মারা যায়।পাঁচ বছর হলো রিয়ানা দেশেফিরেছে।আরিফের সাথে দেখা করবার জন্যেই ফিরেছে। আসবার পর থেকে প্রতিটি দিন প্রতীক্ষা করেছে আরিফের সাথে দেখা হোক কিন্তু নিজে দোটানার দ্বন্দ্বে ভুগছে। দেখাকরেনি। কেমন করে আরিফের সামনে দাঁড়াবে? কী বলবে বিশ্ববিদ্যালয়েরসহপাঠী বন্ধু, প্রিয় মানুষটিকে! যাকে জীবনসঙ্গী করার কথা দিয়েছিল! যে আরিফকে দুদ- না দেখলে অস্থির হয়ে যেতো, আজ এতগুলো বছর কেমন করে পারলোরিয়ানা আরিফকে না দেখে থাকতে।অঝোর ধারা অশ্রু ঝরছে রিয়ানার কপোল বেয়ে। আরিফ কী করবে? কী বলবে,কিছুবুঝতে পারলো না। কিছুটা সময় পাশাপাশি বসে রইলো। একসময় হাতঘড়ির দিকে তাকিয়েরিয়ানা বললো: আমার একটা মিটিং আছে। এখনই উঠতে হবে। আরিফ অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো- চলো উঠি। দুজনেই ধীর পায়ে গাড়ির দিকে এগুতে লাগলো।
স্যার বাসায় যাবেন না। সবাই তো চলে গিয়েছে। অফিস সহায়করতনের ডাকে আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠেআরিফ। লাঞ্চব্রেকে লাউঞ্জে সোফায় গা এলিয়ে দিতেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল টের পায়নি আরিফ।এতক্ষণ তাহলে স্বপ্ন দেখছিল আরিফ!
কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আরিফ পা চালায় গাড়ির দিকে,সিট বেল্টটা বাঁধতেই সেল ফোনের রিংটোনে সংবিত ফিরে এলো আরিফের। অপরপ্রান্ত থেকে নীলার অনুযোগ আজ বৃষ্টির দিনেও তোমার এত দেরি! তোমার জন্যে খিচুড়ি,মুচমুচে ইলিশ ভাজা,সরষে মরিচের ভর্তা, গোরু আলুর ঝোল রান্না করেছি। তাড়াতাড়ি চলে এসো।নীলা অসাধারণ একটা স্ত্রী। আরিফও স্ত্রীকে ভালোবাসে। প্রাণের চেয়েও ভালোবাসে মেয়ে আরিয়ানাকে। সুখী সুন্দর সংসার তাদের।
তবু হুটহাট রিয়ানার মুখটা মনে পড়ে। নির্জন দুপুর। একাকী বিকেলে। মেঘলা আকাশ বৃষ্টিদিনে। উইকেন্ডের একচিলতে অবসরে। কখনো সখনো কান্নায় ভিজে যায় পাশ বালিশটা। একটা অস্ফুট, অব্যক্তব্যথা আজীবন জীবনসঙ্গী হয়ে থেকে যাবে। তবুও মনে মনে আরিফ ¯্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানায়- রিয়ানা দেশে ফিরে এসেছে বলে। মাসে একবার হলেও রিয়ানার মুখটা দেখেজুড়িয়েনিতে পারছে তার তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো। এটাও পরম পাওয়া আরিফের জন্য।
মাঝে মাঝে দেখা হয় রিয়ানার সাথে। বন্ধুদের আড্ডায় কফিহাউজে। কথা হয় হিসেব কষে। আরিফ জানে নিজের সীমাবদ্ধতা। তার এই ঔচিত্যবোধের কারণে রিয়ানা তাকে শ্রদ্ধা করে। সমীহ করে। ভালোবাসে।
মন তো বন্ধনহীন একটা ঘুড়ি। বেঁধে রাখা যায় না সব সময়। কদম ফোটানো বৃষ্টির দিনে শীতের পাখির মতো স্মৃতিগুলো ডানা ঝাপটাতে থাকে। একটা বিরহ বিষাদআরিফের মনটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়।
গাড়িতে প্লেয়ারের নবটা ঘুরিয়ে ভলিউমটা একটু বাড়িয়ে দেয় আরিফনিঃসঙ্গতা গুচিয়ে দিতে। প্লেয়ারে বেজে চলেছে ‘শ্রাবণও ঘনায় দু’নয়নে...।’
আরিফ ভাবছে আকাশও কি আজ বিরহী! এমন মন খারাপ করে আছে সকাল থেকে! ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ছাঁট হুইপার দিয়ে মুছে নিচ্ছে আরিফ একটু পরপর। দু-হাত স্টিয়ারিঙে রাখা বলে মুছে ফেলতে পারছে না নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়া বেহিসেবি অশ্রুবিন্দু।
হাবিবা রোজী
বৃহস্পতিবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজটা কমে ক্রমশ বাতাসের সাথে মিশে ঝিরঝিরে মিষ্টি একটানাতালে বেজে চলেছে।অফিস থেকে নেমে আরিফ আধ-খাওয়া সিগারেটটা বিনে গুঁজে ড্রাইভওয়ে থেকে গাড়িটা নিয়ে লেকভিউর রাস্তা ধরে চলতে লাগলো। অ্যারাবিকার গুলশানের আউটলেটে গাড়ি পার্ক করলো। অ্যারাবিকায়চিকেন ক্রোসেন্ট আর ব্ল্যাক কফির টেস্টটা ইদানীংআরিফ খুব উপভোগকরে।মন খারাপ হলেই চলে আসে এখানে, কফির উত্তাপে পুড়িয়ে দিতে চায় বিরহের দহন।অ্যারাবিকায় পিক আওয়ারে লোকজন গিজগিজ করে আজ বৃষ্টি বলেই হয়তোবা লোক কিছুটা কম।অর্ডার করে জানালার গ্লাসে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিটা দেখবে বলেযুৎসই একটা জায়গায়বসে পড়ে আরিফ।
কফিতে চুমুক দিয়ে তাকাতেই চোখে পড়লো সামনের টেবিলেবসা রিয়ানাকে, রিয়ানা, হ্যাঁ রিয়ানাই তো! হোক ১২ বছর! রিয়ানাকে চিনবে না আরিফ! হ্যাঁসময়ের ইরেজার কত কিছুইমুছে দিয়েছেকিন্তু এ মুখটা কিছুতেই মুছে দিতেপারেনি,অবুঝ মনের সবুজ উপত্যকায়আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে মুখটা! সহজাত স্বাভাবিক বাধা কাটিয়ে উঠেকখনোইআরিফ কিছুবলতে পারে না,আজ১২ বছরের অব্যক্ত কথাগুলো যেনো অভিমান ঠেলে বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে। উ™£ান্তের মতো দ্রুত পায়ে আরিফরিয়ানার পাশেগিয়ে আবেগে ছুঁয়ে ফেলতে চায় রিয়ানার হাতটা। চট করে আরিফ নিজেকে সামলে নেয়। নির্বাক চাহনিতে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় রিয়ানাকে- এত দিন কেন নিজেকে আড়াল করে রেখেছো? রিয়ানা কোনো ভূমিকা ছাড়াইবলতেশুরু করেনিজের জীবনের ঘটে যাওয়া সিনেমাটিক গল্পটা। বলতেগিয়ে গলাটা ধরে আসে কখনো কখনো। বললো, ব্রেনের জটিল রোগে আক্রান্ত বাবাকে চিকিৎসা করাতে আমেরিকায় চলে গিয়েছিল। বাবামারা যাবার আগে উনারপ্রিয়ছাত্র শাহেদের সাথেরিয়ানার বিয়ে দিয়ে দেন। রিয়ানা এটা কিছুতেই চায়নি। বাবারডাক্তার বন্ধু রিয়াজুদ্দিন আঙ্কেলবুঝিয়েছিলেন অমত করলে রিয়ানার বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন। ব্রেনে প্রেসার পড়বে। ঐ অবস্থায়বাবাকে বাঁচানোই রিয়ানার প্রথম ও প্রধান কাজ বলে মনে হয়েছিল। বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায়হার্ট অ্যাটাক করে শাহেদ মারা যায়।পাঁচ বছর হলো রিয়ানা দেশেফিরেছে।আরিফের সাথে দেখা করবার জন্যেই ফিরেছে। আসবার পর থেকে প্রতিটি দিন প্রতীক্ষা করেছে আরিফের সাথে দেখা হোক কিন্তু নিজে দোটানার দ্বন্দ্বে ভুগছে। দেখাকরেনি। কেমন করে আরিফের সামনে দাঁড়াবে? কী বলবে বিশ্ববিদ্যালয়েরসহপাঠী বন্ধু, প্রিয় মানুষটিকে! যাকে জীবনসঙ্গী করার কথা দিয়েছিল! যে আরিফকে দুদ- না দেখলে অস্থির হয়ে যেতো, আজ এতগুলো বছর কেমন করে পারলোরিয়ানা আরিফকে না দেখে থাকতে।অঝোর ধারা অশ্রু ঝরছে রিয়ানার কপোল বেয়ে। আরিফ কী করবে? কী বলবে,কিছুবুঝতে পারলো না। কিছুটা সময় পাশাপাশি বসে রইলো। একসময় হাতঘড়ির দিকে তাকিয়েরিয়ানা বললো: আমার একটা মিটিং আছে। এখনই উঠতে হবে। আরিফ অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো- চলো উঠি। দুজনেই ধীর পায়ে গাড়ির দিকে এগুতে লাগলো।
স্যার বাসায় যাবেন না। সবাই তো চলে গিয়েছে। অফিস সহায়করতনের ডাকে আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠেআরিফ। লাঞ্চব্রেকে লাউঞ্জে সোফায় গা এলিয়ে দিতেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল টের পায়নি আরিফ।এতক্ষণ তাহলে স্বপ্ন দেখছিল আরিফ!
কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আরিফ পা চালায় গাড়ির দিকে,সিট বেল্টটা বাঁধতেই সেল ফোনের রিংটোনে সংবিত ফিরে এলো আরিফের। অপরপ্রান্ত থেকে নীলার অনুযোগ আজ বৃষ্টির দিনেও তোমার এত দেরি! তোমার জন্যে খিচুড়ি,মুচমুচে ইলিশ ভাজা,সরষে মরিচের ভর্তা, গোরু আলুর ঝোল রান্না করেছি। তাড়াতাড়ি চলে এসো।নীলা অসাধারণ একটা স্ত্রী। আরিফও স্ত্রীকে ভালোবাসে। প্রাণের চেয়েও ভালোবাসে মেয়ে আরিয়ানাকে। সুখী সুন্দর সংসার তাদের।
তবু হুটহাট রিয়ানার মুখটা মনে পড়ে। নির্জন দুপুর। একাকী বিকেলে। মেঘলা আকাশ বৃষ্টিদিনে। উইকেন্ডের একচিলতে অবসরে। কখনো সখনো কান্নায় ভিজে যায় পাশ বালিশটা। একটা অস্ফুট, অব্যক্তব্যথা আজীবন জীবনসঙ্গী হয়ে থেকে যাবে। তবুও মনে মনে আরিফ ¯্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানায়- রিয়ানা দেশে ফিরে এসেছে বলে। মাসে একবার হলেও রিয়ানার মুখটা দেখেজুড়িয়েনিতে পারছে তার তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো। এটাও পরম পাওয়া আরিফের জন্য।
মাঝে মাঝে দেখা হয় রিয়ানার সাথে। বন্ধুদের আড্ডায় কফিহাউজে। কথা হয় হিসেব কষে। আরিফ জানে নিজের সীমাবদ্ধতা। তার এই ঔচিত্যবোধের কারণে রিয়ানা তাকে শ্রদ্ধা করে। সমীহ করে। ভালোবাসে।
মন তো বন্ধনহীন একটা ঘুড়ি। বেঁধে রাখা যায় না সব সময়। কদম ফোটানো বৃষ্টির দিনে শীতের পাখির মতো স্মৃতিগুলো ডানা ঝাপটাতে থাকে। একটা বিরহ বিষাদআরিফের মনটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়।
গাড়িতে প্লেয়ারের নবটা ঘুরিয়ে ভলিউমটা একটু বাড়িয়ে দেয় আরিফনিঃসঙ্গতা গুচিয়ে দিতে। প্লেয়ারে বেজে চলেছে ‘শ্রাবণও ঘনায় দু’নয়নে...।’
আরিফ ভাবছে আকাশও কি আজ বিরহী! এমন মন খারাপ করে আছে সকাল থেকে! ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ছাঁট হুইপার দিয়ে মুছে নিচ্ছে আরিফ একটু পরপর। দু-হাত স্টিয়ারিঙে রাখা বলে মুছে ফেলতে পারছে না নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়া বেহিসেবি অশ্রুবিন্দু।