আবদুল মান্নান সৈয়দ
নুরউল করিম খসরু
[আবদুল মান্নান সৈয়দ / জন্ম : ৩ আগস্ট ১৯৪৩ মৃত্য : ৫ সেপ্টেম্বর ২০১০]
“কবিতা লেখার জন্যে নিজের গভীর বিবরে ঢুকে যাওয়া চাই, সেখানে সমাজ নেই, ধর্ম নেই, রাষ্ট্র নেই, সেখানে আছে এক অপার অনন্ত আমি। সেখানকার সমুদ্রের নাম আমি, আর যে একখানি দ্বীপ আছে, তার নামও আমি, আর সেই দ্বীপে যে একখানি কাগজের নৌকো বাঁধা আছে- তার নামও আমি।” [করতলে মহাদেশ/ আবদুল মান্নান সৈয়দ]
অথবা:
“নীরবতা ছাড়া নির্জনতা ছাড়া নিঃসঙ্গতা ছাড়া জীবনের, পৃথিবীর, মানুষের গভীরতম ভিতরে প্রবেশ করা যাবে না। জীবনে এসে আমি নিঃসঙ্গতাকেই একমাত্র সঙ্গী বলে জেনেছি, কোলাহলময় পৃথিবীতে এসে আমি নীরবতাকে ভালোবাসতে শিখেছি।” [আমার বিশ^াস/আবদুল মান্নান সৈয়দ]
এই হচ্ছে আবদুল মান্নান সৈয়দ। এই সব আত্ম-উচ্চারণ আবদুল মান্নান সৈয়দকে আমাদের সাহিত্য ভূম-লে দিয়েছে পৃথক সিংহাসন। আমাদের হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যে এক অনন্যসাধারণ প্রতিভার নাম আবদুল মান্নান সৈয়দ। তিনি সমৃদ্ধ করেছেন আমাদের সাহিত্যের চিরকালীনতাকে। তিনি এক ¯্রােতস্বিনী নদীর মতো, তাঁর লেখক-সত্তা দুকূল ছাপিয়ে গেছে অনবরত ঢেউয়ে-ঢেউয়ে। তিনি আমাদের সব্যসাচী লেখক। তিনি লেখক হিশেবে নিবিষ্ট এবং অবিরাম। তাছাড়া, সাহিত্যের সৃষ্টিশীলতার সকল ক্ষেত্রে তিনি সমভাবে উৎসারিত, তাড়িত। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-গবেষণা, সমালোচনা, কাব্যনাট্য, অনুবাদ, সমালোচনা- সর্বত্র তাঁর সমান বিহার, সমান আগ্রহ, সমান উপস্থিতি। তাঁর আত্মপরিচয়¯িœগ্ধ একটি কবিতায় তিনি নিজেকে উন্মোচন করেছেন এভাবে:
“‘শিল্প! শিল্প!’ করতে করতে জীবন করেছি আমি পার।
আজ দেখি: অতলান্ত জীবনের সিংহ-আঁকা দ্বার
ছুঁতে না-ছুঁতেই কবে খ’শে গেছে বছর পঞ্চাশ।-
হে স¤্রাট! কতো লক্ষ তারকায় তোমার প্রকাশ,
অংশের যোগফল থেকে সমগ্র সে আরো বড়ো কতো,
-বুঝে আজ- আমার সমস্ত দর্প ক্রন্দনে বিনত।”
[‘পঞ্চাশ বছরে’]
“ক্রন্দনে বিনত”? না এটি আবদুল মান্নান সৈয়দের বিনয়, ¯্রষ্টার কাছে বিনয়। মূলত বীরদর্পে তিনি আমৃত্যু সাহিত্যকে আলিঙ্গন করেছেন, সাহিত্যের অলিতে-গলিতে হেঁটেছেন শিরদাঁড়া খাড়া করে। তিনি হচ্ছেন আমাদের সাহিত্যে একজন অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ লেখক।
তাঁর দ্বিতীয় প্রকৃতি, দ্বিতীয় জীবন
আগেই বলেছি, তিনি মূলত কবি; আর কবি বলেই তিনি সাহিত্যের নানা রকম উদযাপনে সমানভাবে তাড়িত, প্রবল সৃজনশীল ও মননশীল। তার সৃষ্টির কারুময় পালতোলা ডিঙি নোঙর ফেলেছে সাহিত্যের নানা বন্দরে নানা ঘাটে। সৃজনশীলতা আর মননশীলতা তার সাহিত্যসত্তার দুই বাহু যেন। তার মধ্যে রয়েছে আবার স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার দুই ডানা। তিনি অবলীলায় নিজেকে উন্মোচিত করেছেন এভাবে:
“আমি প্রকৃতি বা জীবনের অনুসরণ করি না। আমার সৃষ্টি দ্বিতীয় প্রকৃতি, দ্বিতীয় জীবন। আমি যাকে অনুসরন করি সে আমি, আমার চেতনা বা অস্তিত্ব। আমি যাকে প্রতিরূপ দিই সে আমি। আমি ক্রমাগত নিজেকে রূপ দিয়ে চলেছি।... এভাবেই আমি সৃষ্টি করি নতুন এক পৃথিবী। নিজস্ব এক পৃথিবী।” [আমার বিশ^াস]
তাঁর সমকালীনদের চোখে:
বস্তুত আবদুল মান্নান সৈয়দকে নিয়ে তর্ক-বিতর্কের অবশেষ নেই। তার সাহিত্যকৃতি, তার জীবনযাপন, তার বিশ^াস, জীবনবোধ, তার আধুনিকতা এবং আধ্যাত্মিকতা -কোথায় বিতর্ক নেই? তিনি হচ্ছেন আমাদের কাব্যবস্তুতে পরাবাস্তব চেতনার পুরোহিত, পুরোধা পুরুষ।
“যেহেতু তিনি বহন করেন এক অনিঃশেষ বৈশি^ক শিল্প উত্তরাধিকার এবং জীবন ও বস্তুবিশ^ যাকে দিয়েছে অপরিমেয় শিল্প চৈতন্যের ধ্রুপদ অনুসন্ধিৎসা, ফলত তার কবিতা যেন আধুনিক আত্মার নির্যাস, শতাব্দীবাহী জরাজীর্ণ সভ্যতার মাটিতে যেন মরমী অথচ ক্লেদার্ত ফুল-ফসল। ব্যক্তি সত্তা তার কাছে সর্ব-বিশারদ; অবিনাশী সেই ব্যক্তিক নির্মিতির প্রেরণায় কবিতাকে তিনি করে তুলেছেন ঋদ্ধ, জটিল-স্বভাবী আর পরাবাস্তব-মনস্ক।” [আবদুল মান্নান সৈয়দ, সাম্প্রতিক কাব্যকৃতি, ‘‘দশ জন কবি”/নুরউল করিম খসরু]
এবার দেখা যাক, তার সমকালীনদের চোখে সেই উৎসারণ কীভাবে উদ্বোধিত হলো:
কবি শামসুর রাহমান [১৯২৯-২০০৬] আমাদের আধুনিক কবিতার তিনি আরেক দিকপাল। আবদুল মান্নান সৈয়দের আত্মপ্রকাশকালীন সময়কে এভাবে সবিশেষ তাৎপর্যম-িত করেছেন তিনি। তাঁর ভাষায়: “ষাটের দশকের গোড়ার দিকে এক গ্রীষ্ম-দুপুরে প্রশান্ত ঘোষাল আমাকে একটি লিটল ম্যাগাজিন উপহার দেন। ছোট পত্রিকাটির নাম ‘স্বাক্ষর’... দেখতে তেমন সুমুদ্রিত, আকর্ষণীয় ছিল না, কিন্তু মুদ্রিত কিছু কবিতা ছিল চিত্তাকর্ষক। বিশেষ করে তিনজনের লেখা পড়ে মনে হলো আমাদের কাব্যে নতুন ঋতু প্রায় সমাগত। এঁরা হলেন সিকদার আমিনুল হক, রফিক আজাদ এবং অশোক সৈয়দ। (*অশোক সৈয়দ- আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রথমদিকে এ নামে লিখতেন- প্রবন্ধকার)। অশোক সৈয়দ-এর টানা গদ্যে লেখা কবিতায় ছিল টাটকা স্বাদ।... তার সাড়া-জাগানো প্রথম কাব্যগ্রন্থ “জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ”। এই নতুন কবিকে তরুণ লেখকগণ তো বটেই, কাব্যরসিক প্রবীণ কথাশিল্পী শওকত ওসমানও সমকাল-এর মতো উন্নতমানের সাহিত্যপত্রে দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখে বরণ করলেন।
আবদুল মান্নান সৈয়দ, যিনি পূর্ব বাংলায় সচেতন এবং ব্যাপকভাবে পরাবাস্তব কবিতা লেখেন,...। তিনি তার সৃজনশীল ক্ষমতা কবিতাতেই অর্পণ করেননি, তার লেখনি থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছে ছোটগল্প, উপন্যাস, অজ¯্র প্রবন্ধ।.... আমি এখনো আবদুল মান্নান সৈয়দ-এর লেখার নিরলস অনুরক্ত পাঠক।... তিনি আমাদের সাহিত্যক্ষেত্রে যে অবদান রেখেছেন সে জন্য আমি তাকে র্কতজ্ঞতা জানাই।’’
আবার কবি শামসুর রাহমান তার ঐ সবিশেষ আলোকসঞ্চারি অভিমতে আরো দুজন তরুণ তুর্কির নাম উচ্চারণ করে বলেছেন, তাদের মধ্যেও তিনি ‘আমাদের কাব্যে নতুন ঋতু’-র নবনতুন উদ্ভব দেখেছেন, তারা হলেন: সিকদার আমিনুল হক ও রফিক আজাদ। সেই কবি সিকদার আমিনুল হক তার সমকালীন সতীর্থ-কবি-বন্ধু আবদুল মান্নান সৈয়দকে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে : “কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ আমার বন্ধু। আবদুল মান্নান সৈয়দ ষাট দশকের অন্যতম নক্ষত্র- তাতে তর্কের কোনো অবকাশ নেই।... তিনি কোনো একটি অন্তর্গত বিশ^াসের দাসত্ব করেননি। মিলিয়েছেন দিন আর রাত্রিকে, গ্রীষ্ম আর শীতকে, পূর্ব আর পশ্চিমকে। জীবনানন্দ, নজরুল, মাইকেল, ফররুখ, পরাবাস্তব, হিস্পানী কবিতা, ওয়ালীউল্লাহ- এরকম বিরোধী দীপ্তিকে নীলিমায়; আপাত অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছেন। কাল এর অনেকটাই আত্মসাৎ করবে; কিন্তু তার প্রাথমিক ও প্রবল সত্তাকে কখনোই ম্লান করবার সম্ভাবনা আপাতত দেখি না- সেই সত্তা কবির সত্তা। আমার কাছে এখনও পর্যন্ত মান্নানের প্রধান পরিচয় তিনি একজন প্রকৃত ও শুদ্ধ কবি।”
কবি রফিক আজাদ, তার কবিতার দ্যুতিময় পংক্তি উচ্চারণে পাঠক মাত্রই বিলোড়িত হন, তার কবিতা ঝংকার তোলে আমাদের চৈতন্যে। যেমন :
“সময়ের জলে কি ধুয়েছো মুখ, জ¦ালাময় চোখ?
তবে কি সে চিহ্ন তোমার সর্বাঙ্গে ফোটে-
বিরাগ না ভালোবাসা?
কিছু কি ধরেছো তুমি চেতনা-দর্পণে-স্বপ্ন, কিম্বা স্মৃতিরাশি?”
[সমুদ্রায়ন/অস¤ভবের পায়ে]
কবিতায় তিনি যেমন দেদীপ্যমান, আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পর্কেও তার মূল্যায়ন সবিশেষ আলোকময় ও প্রদীপ্যমান। তার ভাষায়:
“আবদুল মান্নান সৈয়দ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও আমার জন্ম ১৩৫০ বঙ্গাব্দে। ইলিয়াস প্রধানত কথাশিল্পী, যদিও ওঁর আশ্চার্য সুন্দর কিছু কবিতা রয়েছে। মান্নান প্রধানত কবি। কিন্তু সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ। তাঁর “শুদ্ধতম কবি” বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যের একটি মাইলফলক। অসাধারণ কিছু গল্প রয়েছে তার। কাব্যনাট্য আছে। তাঁর অনূদিত বিদেশি কবিতা চমৎকার। নন্দিত গবেষক হিশেবেও তাঁর নামডাক আছে। বাগ্মিতায়ও পারঙ্গম। এতো গুণের সমাহার একজন মানুষের মধ্যে প্রায়ই দেখা যায় না। কিন্তু বহুগুণী মান্নানের কবিতাই আমার পছন্দ। হীরকদ্যুতিময় ওঁর কবিতার আমি ভক্ত পাঠক। অবিশ্যি মান্নানের গদ্যশৈলীও উচ্চ প্রশংসিত।”
আমাদের কবিতায় আরেক অনন্য-বিশিষ্টতায় উজ্জ্বল, পঞ্চাশের অন্যতম প্রধাণ কবি আল মাহমুদ। বস্তুত পঞ্চাশের কবিদের হাত ধরেই আমাদের কবিতা বাঙ্গালীয়ানা পেলো স্বভাবে এবং স্বধর্মে। কবি আল মাহমুদ তাদেরই অন্যতম। স্বদেশচেতনা ও স্বকাল নিঃসরিত হৃদয় অনুভবকে আলিঙ্গন করে আল মাহমুদের কাব্য যাত্রা শুরু। আবদুল মান্নান সৈয়দকে কবি আল মাহমুদ- “আমাদের কালের সবচেয়ে অগ্রসর-সাহিত্য-চিন্তার মানুষ” বলে অভিহিত করে বলেছেন:
‘‘একাধারে কবি, কথাশিল্পী এবং ক্রিটিক। সাহিত্যের উপর তাঁর সমকালীন বক্তৃতার বিদ্যুৎ স্পর্শ করেনি এমন রসজ্ঞ ব্যক্তি বিরল।... জীবনানন্দ দাশের উপর রচিত তার “শুদ্ধতম কবি”র মতো বই বাংলা ভাষায় খুব কমই লেখা হয়েছে। আমি নিজে তার কবিতার মুগ্ধ পাঠক। বিশেষ করে চিত্রকল্প নির্মাণে তার অসাধারণ অন্তরদৃষ্টি আমাকেও মোহগ্রস্ত করে রেখেছে। তার গল্প ও ছোট উপন্যাসগুলোতে পরিবেশ বর্ণনার সাথে চরিত্রের সংক্ষিপ্ত রেখাচিত্র নির্মাণের কৌশল দেখে আমার ধারণা হয়েছে এ ধরনের মৌলিক গদ্যশিল্পীর আবির্ভাবে আমাদের কথাশিল্প সহসা এগিয়ে গেলো।” [সংগ্রাম সাহিত্য, দৈনিক সংগ্রাম। ২৭ নভেম্বর, ১৯৯২]
এ পর্যায়ে তাঁর সমকালীন কয়েকজন অনুজ কবির অভিমত এখানে বিবৃত হলো:
ক] “বাংলাদেশের সাহিত্যের অন্যতম প্রধান স্থপতি তিনি, প্রসারিত করেছেন নিজেকে, এবং আমাদেরকেও। বাংলা সাহিত্যের চিরায়ত ঐতিহ্যের নির্মাতা ও পুননির্মাতা।” [মুহম্মদ নূরুল হুদা, কবি]
খ] “শাগালের আঁকা ছবির মতো বহুবর্ণিল তাঁর কবিতা, চোখের সামনে পরাবাস্তব অনুভূতির বিশাল দরোজা হাট করে খুলে দেয় তার কবিতা, কাব্যভাষা তার চীৎকৃত স্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল; তাঁর কবিতা পড়ে পাঠক/পাঠিকা স্বপ্নাবিষ্টের মতো পথ চলে; অন্য সবার থেকে আলাদা, একাকী, অনন্য এই পথিকের নাম আবদুল মান্নান সৈয়দ।” [দিলারা হাফিজ, কবি]
গ] “আপন সত্তাকে বিরতিহীন উৎসবে, মৌতাতে আপ্লুত রেখে পাঠকের সামনে নিজেকে চিরসতেজ রাখা- ধ্রুপদ শিল্পের এই ধারাকে লালন করার জন্যই বুঝি আবদুল মান্নান সৈয়দ। সম্পূর্ণ ভিন্ন মেজাজ ও ভঙ্গিতে তিনি নিজেকে সমর্পিত রেখেছেন শিল্পে, যে-শিল্প একাধারে নির্জন আনন্দের ও তীব্র উপলব্ধির।... আর অন্তর্গতভাবে কবি বলেই তাঁর গদ্য এমন স্বাদু ও মূর্ছনাময়। ছোটগল্প ও উপন্যাসে মগ্নচৈতন্যের নানাস্তরে আলো ফেলার কুশলতা থেকে পাওয়া যায় আরেক মান্নান সৈয়দকে।” [শিহাব সরকার, কবি ]
ঘ] “সমকালীন বাংলা কবিতায় কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ-ই হচ্ছেন আমার প্রধান মুগ্ধতা, তিনিই আমার অশেষ আকর্ষণ।” [আবিদ আজাদ, কবি]
পরিশেষ:
‘নদী তুমি
নদীর ভিতরে চলা মাছ তুমি
মাছের হৃদয়ে জ¦লা মুক্তা তুমি।’
বস্তুত তিনি, আবদুল মান্নান সৈয়দ আমাদের সাহিত্যের একজন নদী-মাছ-মুক্তাপ্রতিম অনন্য পুরুষ। তিনি আমৃত্যু যে সৌধ গড়েছেন, তার নাম সাহিত্য, এক অমল ধবল সাহিত্যসৌধ। অতএব একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে তাঁর মেধা ও মননের দীপশিখায় নিঃসন্দেহে উজ্জ্বল ও আলোকময় হয়েছে বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের আধুনিক আবহমান বাংলা সাহিত্য; বাংলা সাহিত্যের বাঁক-কোণ-মোড় অধিকতর বীর্যবান হয়েছে। শেষ কথা হচ্ছে, তিনি ছিলেন তারুণ্যের অভিবাবক: তিনি তার অতুলনীয় মনন-সাহিত্য, সাহিত্যমত্ততা ও ব্যক্তিগত বন্ধুতার ¯েœহাস্পর্শে আমাকে, আমার সাহিত্য-অনুসন্ধিৎসাকে ক্রমাগত আলোক-সঞ্চারি কবেছেন।
তথ্যসূত্র : আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পর্কে সমকালীনদের যে সব অভিমত এই প্রবন্ধে উদ্ধৃত হয়েছে সেগুলি ‘‘আবদুল মান্নান সৈয়দের ৫০ বর্ষপূর্তি উৎসব সংবর্ধনা-গ্রন্থ” থেকে নেয়া হয়েছে।
আবদুল মান্নান সৈয়দ
নুরউল করিম খসরু
[আবদুল মান্নান সৈয়দ / জন্ম : ৩ আগস্ট ১৯৪৩ মৃত্য : ৫ সেপ্টেম্বর ২০১০]
বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
“কবিতা লেখার জন্যে নিজের গভীর বিবরে ঢুকে যাওয়া চাই, সেখানে সমাজ নেই, ধর্ম নেই, রাষ্ট্র নেই, সেখানে আছে এক অপার অনন্ত আমি। সেখানকার সমুদ্রের নাম আমি, আর যে একখানি দ্বীপ আছে, তার নামও আমি, আর সেই দ্বীপে যে একখানি কাগজের নৌকো বাঁধা আছে- তার নামও আমি।” [করতলে মহাদেশ/ আবদুল মান্নান সৈয়দ]
অথবা:
“নীরবতা ছাড়া নির্জনতা ছাড়া নিঃসঙ্গতা ছাড়া জীবনের, পৃথিবীর, মানুষের গভীরতম ভিতরে প্রবেশ করা যাবে না। জীবনে এসে আমি নিঃসঙ্গতাকেই একমাত্র সঙ্গী বলে জেনেছি, কোলাহলময় পৃথিবীতে এসে আমি নীরবতাকে ভালোবাসতে শিখেছি।” [আমার বিশ^াস/আবদুল মান্নান সৈয়দ]
এই হচ্ছে আবদুল মান্নান সৈয়দ। এই সব আত্ম-উচ্চারণ আবদুল মান্নান সৈয়দকে আমাদের সাহিত্য ভূম-লে দিয়েছে পৃথক সিংহাসন। আমাদের হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যে এক অনন্যসাধারণ প্রতিভার নাম আবদুল মান্নান সৈয়দ। তিনি সমৃদ্ধ করেছেন আমাদের সাহিত্যের চিরকালীনতাকে। তিনি এক ¯্রােতস্বিনী নদীর মতো, তাঁর লেখক-সত্তা দুকূল ছাপিয়ে গেছে অনবরত ঢেউয়ে-ঢেউয়ে। তিনি আমাদের সব্যসাচী লেখক। তিনি লেখক হিশেবে নিবিষ্ট এবং অবিরাম। তাছাড়া, সাহিত্যের সৃষ্টিশীলতার সকল ক্ষেত্রে তিনি সমভাবে উৎসারিত, তাড়িত। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-গবেষণা, সমালোচনা, কাব্যনাট্য, অনুবাদ, সমালোচনা- সর্বত্র তাঁর সমান বিহার, সমান আগ্রহ, সমান উপস্থিতি। তাঁর আত্মপরিচয়¯িœগ্ধ একটি কবিতায় তিনি নিজেকে উন্মোচন করেছেন এভাবে:
“‘শিল্প! শিল্প!’ করতে করতে জীবন করেছি আমি পার।
আজ দেখি: অতলান্ত জীবনের সিংহ-আঁকা দ্বার
ছুঁতে না-ছুঁতেই কবে খ’শে গেছে বছর পঞ্চাশ।-
হে স¤্রাট! কতো লক্ষ তারকায় তোমার প্রকাশ,
অংশের যোগফল থেকে সমগ্র সে আরো বড়ো কতো,
-বুঝে আজ- আমার সমস্ত দর্প ক্রন্দনে বিনত।”
[‘পঞ্চাশ বছরে’]
“ক্রন্দনে বিনত”? না এটি আবদুল মান্নান সৈয়দের বিনয়, ¯্রষ্টার কাছে বিনয়। মূলত বীরদর্পে তিনি আমৃত্যু সাহিত্যকে আলিঙ্গন করেছেন, সাহিত্যের অলিতে-গলিতে হেঁটেছেন শিরদাঁড়া খাড়া করে। তিনি হচ্ছেন আমাদের সাহিত্যে একজন অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ লেখক।
তাঁর দ্বিতীয় প্রকৃতি, দ্বিতীয় জীবন
আগেই বলেছি, তিনি মূলত কবি; আর কবি বলেই তিনি সাহিত্যের নানা রকম উদযাপনে সমানভাবে তাড়িত, প্রবল সৃজনশীল ও মননশীল। তার সৃষ্টির কারুময় পালতোলা ডিঙি নোঙর ফেলেছে সাহিত্যের নানা বন্দরে নানা ঘাটে। সৃজনশীলতা আর মননশীলতা তার সাহিত্যসত্তার দুই বাহু যেন। তার মধ্যে রয়েছে আবার স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার দুই ডানা। তিনি অবলীলায় নিজেকে উন্মোচিত করেছেন এভাবে:
“আমি প্রকৃতি বা জীবনের অনুসরণ করি না। আমার সৃষ্টি দ্বিতীয় প্রকৃতি, দ্বিতীয় জীবন। আমি যাকে অনুসরন করি সে আমি, আমার চেতনা বা অস্তিত্ব। আমি যাকে প্রতিরূপ দিই সে আমি। আমি ক্রমাগত নিজেকে রূপ দিয়ে চলেছি।... এভাবেই আমি সৃষ্টি করি নতুন এক পৃথিবী। নিজস্ব এক পৃথিবী।” [আমার বিশ^াস]
তাঁর সমকালীনদের চোখে:
বস্তুত আবদুল মান্নান সৈয়দকে নিয়ে তর্ক-বিতর্কের অবশেষ নেই। তার সাহিত্যকৃতি, তার জীবনযাপন, তার বিশ^াস, জীবনবোধ, তার আধুনিকতা এবং আধ্যাত্মিকতা -কোথায় বিতর্ক নেই? তিনি হচ্ছেন আমাদের কাব্যবস্তুতে পরাবাস্তব চেতনার পুরোহিত, পুরোধা পুরুষ।
“যেহেতু তিনি বহন করেন এক অনিঃশেষ বৈশি^ক শিল্প উত্তরাধিকার এবং জীবন ও বস্তুবিশ^ যাকে দিয়েছে অপরিমেয় শিল্প চৈতন্যের ধ্রুপদ অনুসন্ধিৎসা, ফলত তার কবিতা যেন আধুনিক আত্মার নির্যাস, শতাব্দীবাহী জরাজীর্ণ সভ্যতার মাটিতে যেন মরমী অথচ ক্লেদার্ত ফুল-ফসল। ব্যক্তি সত্তা তার কাছে সর্ব-বিশারদ; অবিনাশী সেই ব্যক্তিক নির্মিতির প্রেরণায় কবিতাকে তিনি করে তুলেছেন ঋদ্ধ, জটিল-স্বভাবী আর পরাবাস্তব-মনস্ক।” [আবদুল মান্নান সৈয়দ, সাম্প্রতিক কাব্যকৃতি, ‘‘দশ জন কবি”/নুরউল করিম খসরু]
এবার দেখা যাক, তার সমকালীনদের চোখে সেই উৎসারণ কীভাবে উদ্বোধিত হলো:
কবি শামসুর রাহমান [১৯২৯-২০০৬] আমাদের আধুনিক কবিতার তিনি আরেক দিকপাল। আবদুল মান্নান সৈয়দের আত্মপ্রকাশকালীন সময়কে এভাবে সবিশেষ তাৎপর্যম-িত করেছেন তিনি। তাঁর ভাষায়: “ষাটের দশকের গোড়ার দিকে এক গ্রীষ্ম-দুপুরে প্রশান্ত ঘোষাল আমাকে একটি লিটল ম্যাগাজিন উপহার দেন। ছোট পত্রিকাটির নাম ‘স্বাক্ষর’... দেখতে তেমন সুমুদ্রিত, আকর্ষণীয় ছিল না, কিন্তু মুদ্রিত কিছু কবিতা ছিল চিত্তাকর্ষক। বিশেষ করে তিনজনের লেখা পড়ে মনে হলো আমাদের কাব্যে নতুন ঋতু প্রায় সমাগত। এঁরা হলেন সিকদার আমিনুল হক, রফিক আজাদ এবং অশোক সৈয়দ। (*অশোক সৈয়দ- আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রথমদিকে এ নামে লিখতেন- প্রবন্ধকার)। অশোক সৈয়দ-এর টানা গদ্যে লেখা কবিতায় ছিল টাটকা স্বাদ।... তার সাড়া-জাগানো প্রথম কাব্যগ্রন্থ “জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ”। এই নতুন কবিকে তরুণ লেখকগণ তো বটেই, কাব্যরসিক প্রবীণ কথাশিল্পী শওকত ওসমানও সমকাল-এর মতো উন্নতমানের সাহিত্যপত্রে দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখে বরণ করলেন।
আবদুল মান্নান সৈয়দ, যিনি পূর্ব বাংলায় সচেতন এবং ব্যাপকভাবে পরাবাস্তব কবিতা লেখেন,...। তিনি তার সৃজনশীল ক্ষমতা কবিতাতেই অর্পণ করেননি, তার লেখনি থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছে ছোটগল্প, উপন্যাস, অজ¯্র প্রবন্ধ।.... আমি এখনো আবদুল মান্নান সৈয়দ-এর লেখার নিরলস অনুরক্ত পাঠক।... তিনি আমাদের সাহিত্যক্ষেত্রে যে অবদান রেখেছেন সে জন্য আমি তাকে র্কতজ্ঞতা জানাই।’’
আবার কবি শামসুর রাহমান তার ঐ সবিশেষ আলোকসঞ্চারি অভিমতে আরো দুজন তরুণ তুর্কির নাম উচ্চারণ করে বলেছেন, তাদের মধ্যেও তিনি ‘আমাদের কাব্যে নতুন ঋতু’-র নবনতুন উদ্ভব দেখেছেন, তারা হলেন: সিকদার আমিনুল হক ও রফিক আজাদ। সেই কবি সিকদার আমিনুল হক তার সমকালীন সতীর্থ-কবি-বন্ধু আবদুল মান্নান সৈয়দকে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে : “কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ আমার বন্ধু। আবদুল মান্নান সৈয়দ ষাট দশকের অন্যতম নক্ষত্র- তাতে তর্কের কোনো অবকাশ নেই।... তিনি কোনো একটি অন্তর্গত বিশ^াসের দাসত্ব করেননি। মিলিয়েছেন দিন আর রাত্রিকে, গ্রীষ্ম আর শীতকে, পূর্ব আর পশ্চিমকে। জীবনানন্দ, নজরুল, মাইকেল, ফররুখ, পরাবাস্তব, হিস্পানী কবিতা, ওয়ালীউল্লাহ- এরকম বিরোধী দীপ্তিকে নীলিমায়; আপাত অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছেন। কাল এর অনেকটাই আত্মসাৎ করবে; কিন্তু তার প্রাথমিক ও প্রবল সত্তাকে কখনোই ম্লান করবার সম্ভাবনা আপাতত দেখি না- সেই সত্তা কবির সত্তা। আমার কাছে এখনও পর্যন্ত মান্নানের প্রধান পরিচয় তিনি একজন প্রকৃত ও শুদ্ধ কবি।”
কবি রফিক আজাদ, তার কবিতার দ্যুতিময় পংক্তি উচ্চারণে পাঠক মাত্রই বিলোড়িত হন, তার কবিতা ঝংকার তোলে আমাদের চৈতন্যে। যেমন :
“সময়ের জলে কি ধুয়েছো মুখ, জ¦ালাময় চোখ?
তবে কি সে চিহ্ন তোমার সর্বাঙ্গে ফোটে-
বিরাগ না ভালোবাসা?
কিছু কি ধরেছো তুমি চেতনা-দর্পণে-স্বপ্ন, কিম্বা স্মৃতিরাশি?”
[সমুদ্রায়ন/অস¤ভবের পায়ে]
কবিতায় তিনি যেমন দেদীপ্যমান, আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পর্কেও তার মূল্যায়ন সবিশেষ আলোকময় ও প্রদীপ্যমান। তার ভাষায়:
“আবদুল মান্নান সৈয়দ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও আমার জন্ম ১৩৫০ বঙ্গাব্দে। ইলিয়াস প্রধানত কথাশিল্পী, যদিও ওঁর আশ্চার্য সুন্দর কিছু কবিতা রয়েছে। মান্নান প্রধানত কবি। কিন্তু সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ। তাঁর “শুদ্ধতম কবি” বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যের একটি মাইলফলক। অসাধারণ কিছু গল্প রয়েছে তার। কাব্যনাট্য আছে। তাঁর অনূদিত বিদেশি কবিতা চমৎকার। নন্দিত গবেষক হিশেবেও তাঁর নামডাক আছে। বাগ্মিতায়ও পারঙ্গম। এতো গুণের সমাহার একজন মানুষের মধ্যে প্রায়ই দেখা যায় না। কিন্তু বহুগুণী মান্নানের কবিতাই আমার পছন্দ। হীরকদ্যুতিময় ওঁর কবিতার আমি ভক্ত পাঠক। অবিশ্যি মান্নানের গদ্যশৈলীও উচ্চ প্রশংসিত।”
আমাদের কবিতায় আরেক অনন্য-বিশিষ্টতায় উজ্জ্বল, পঞ্চাশের অন্যতম প্রধাণ কবি আল মাহমুদ। বস্তুত পঞ্চাশের কবিদের হাত ধরেই আমাদের কবিতা বাঙ্গালীয়ানা পেলো স্বভাবে এবং স্বধর্মে। কবি আল মাহমুদ তাদেরই অন্যতম। স্বদেশচেতনা ও স্বকাল নিঃসরিত হৃদয় অনুভবকে আলিঙ্গন করে আল মাহমুদের কাব্য যাত্রা শুরু। আবদুল মান্নান সৈয়দকে কবি আল মাহমুদ- “আমাদের কালের সবচেয়ে অগ্রসর-সাহিত্য-চিন্তার মানুষ” বলে অভিহিত করে বলেছেন:
‘‘একাধারে কবি, কথাশিল্পী এবং ক্রিটিক। সাহিত্যের উপর তাঁর সমকালীন বক্তৃতার বিদ্যুৎ স্পর্শ করেনি এমন রসজ্ঞ ব্যক্তি বিরল।... জীবনানন্দ দাশের উপর রচিত তার “শুদ্ধতম কবি”র মতো বই বাংলা ভাষায় খুব কমই লেখা হয়েছে। আমি নিজে তার কবিতার মুগ্ধ পাঠক। বিশেষ করে চিত্রকল্প নির্মাণে তার অসাধারণ অন্তরদৃষ্টি আমাকেও মোহগ্রস্ত করে রেখেছে। তার গল্প ও ছোট উপন্যাসগুলোতে পরিবেশ বর্ণনার সাথে চরিত্রের সংক্ষিপ্ত রেখাচিত্র নির্মাণের কৌশল দেখে আমার ধারণা হয়েছে এ ধরনের মৌলিক গদ্যশিল্পীর আবির্ভাবে আমাদের কথাশিল্প সহসা এগিয়ে গেলো।” [সংগ্রাম সাহিত্য, দৈনিক সংগ্রাম। ২৭ নভেম্বর, ১৯৯২]
এ পর্যায়ে তাঁর সমকালীন কয়েকজন অনুজ কবির অভিমত এখানে বিবৃত হলো:
ক] “বাংলাদেশের সাহিত্যের অন্যতম প্রধান স্থপতি তিনি, প্রসারিত করেছেন নিজেকে, এবং আমাদেরকেও। বাংলা সাহিত্যের চিরায়ত ঐতিহ্যের নির্মাতা ও পুননির্মাতা।” [মুহম্মদ নূরুল হুদা, কবি]
খ] “শাগালের আঁকা ছবির মতো বহুবর্ণিল তাঁর কবিতা, চোখের সামনে পরাবাস্তব অনুভূতির বিশাল দরোজা হাট করে খুলে দেয় তার কবিতা, কাব্যভাষা তার চীৎকৃত স্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল; তাঁর কবিতা পড়ে পাঠক/পাঠিকা স্বপ্নাবিষ্টের মতো পথ চলে; অন্য সবার থেকে আলাদা, একাকী, অনন্য এই পথিকের নাম আবদুল মান্নান সৈয়দ।” [দিলারা হাফিজ, কবি]
গ] “আপন সত্তাকে বিরতিহীন উৎসবে, মৌতাতে আপ্লুত রেখে পাঠকের সামনে নিজেকে চিরসতেজ রাখা- ধ্রুপদ শিল্পের এই ধারাকে লালন করার জন্যই বুঝি আবদুল মান্নান সৈয়দ। সম্পূর্ণ ভিন্ন মেজাজ ও ভঙ্গিতে তিনি নিজেকে সমর্পিত রেখেছেন শিল্পে, যে-শিল্প একাধারে নির্জন আনন্দের ও তীব্র উপলব্ধির।... আর অন্তর্গতভাবে কবি বলেই তাঁর গদ্য এমন স্বাদু ও মূর্ছনাময়। ছোটগল্প ও উপন্যাসে মগ্নচৈতন্যের নানাস্তরে আলো ফেলার কুশলতা থেকে পাওয়া যায় আরেক মান্নান সৈয়দকে।” [শিহাব সরকার, কবি ]
ঘ] “সমকালীন বাংলা কবিতায় কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ-ই হচ্ছেন আমার প্রধান মুগ্ধতা, তিনিই আমার অশেষ আকর্ষণ।” [আবিদ আজাদ, কবি]
পরিশেষ:
‘নদী তুমি
নদীর ভিতরে চলা মাছ তুমি
মাছের হৃদয়ে জ¦লা মুক্তা তুমি।’
বস্তুত তিনি, আবদুল মান্নান সৈয়দ আমাদের সাহিত্যের একজন নদী-মাছ-মুক্তাপ্রতিম অনন্য পুরুষ। তিনি আমৃত্যু যে সৌধ গড়েছেন, তার নাম সাহিত্য, এক অমল ধবল সাহিত্যসৌধ। অতএব একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে তাঁর মেধা ও মননের দীপশিখায় নিঃসন্দেহে উজ্জ্বল ও আলোকময় হয়েছে বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের আধুনিক আবহমান বাংলা সাহিত্য; বাংলা সাহিত্যের বাঁক-কোণ-মোড় অধিকতর বীর্যবান হয়েছে। শেষ কথা হচ্ছে, তিনি ছিলেন তারুণ্যের অভিবাবক: তিনি তার অতুলনীয় মনন-সাহিত্য, সাহিত্যমত্ততা ও ব্যক্তিগত বন্ধুতার ¯েœহাস্পর্শে আমাকে, আমার সাহিত্য-অনুসন্ধিৎসাকে ক্রমাগত আলোক-সঞ্চারি কবেছেন।
তথ্যসূত্র : আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পর্কে সমকালীনদের যে সব অভিমত এই প্রবন্ধে উদ্ধৃত হয়েছে সেগুলি ‘‘আবদুল মান্নান সৈয়দের ৫০ বর্ষপূর্তি উৎসব সংবর্ধনা-গ্রন্থ” থেকে নেয়া হয়েছে।