‘আন্তর্জাতিক বুকার ২০২৫’ বিজয়ী বানু মুশতাক-এর গল্প
অনুবাদ: ফজল হাসান
শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন
গ্রীষ্মকালীন ছুটি এলেই মায়েদের দুঃখ-দুর্দশার সীমা থাকে না। তখন সব বাচ্চারা বাড়িতে থাকে। যখন ওরা টিভির সামনে থাকে না, তখন হয় বাড়ির সামনের উঠানের পেয়ারা গাছে চড়বে, নতুবা বাড়ির সীমানার দেওয়ালের ওপর বসে থাকবে। যদি একজন দেওয়াল থেকে পড়ে গিয়ে হাত কিংবা পা ভাঙে, তখন কী অবস্থা হবে? তারপর কান্নাকাটি এবং হাসাহাসি চলবে, এমনকী তারা রহস্যময় বিচার ব্যবস্থার ভিত্তিতে একজন অন্যজনের ওপর শাস্তি আরোপ করবে... আর এ কারণেই গ্রীষ্মকালীন ছুটি শুরু হলে রাজিয়ার মাথাব্যথা আরও বেড়ে যায়। তাঁর স্নায়ুগুলো ঠা-া হয়ে যায়, মনে হয় তাঁর উত্তপ্ত মাথা ফেটে যাবে এবং যে কোনো মুহূর্তে তাঁর ঘাড়ের পেছনের শিরাগুলো ছিঁড়ে যাবে। একেকজন শিশু তাদের অভিযোগ নিয়ে তাড়াহুড়া করে আসে, কাঁদতে থাকে এবং চিৎকার-চেঁচামেচি করে... এবং তারপরই পুনরায় তাদের খেলা শুরু হয়... আবাবা১... তলোয়ার এবং স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ, বোমা হামলা...!
অনেক হয়েছে, রাজিয়া ভাবলেন। আর তারপরই তিনি একটা লম্বা কাপড় মাথার চারপাশে শক্তভাবে বেঁধে হলঘরের সোফায় সটান শুয়ে পড়েন। তিনি হৈচৈ সহ্য করতে পারছিলেন না। টিভি চালু ছিল, তবে আওয়াজ কম ছিল। তিনি শিশুদের কঠিন গলায় সতর্ক করেছেন এবং আশা করতে শুরু করেন যে, অবশেষে পা ওপরে তুলে নির্ভার হয়ে বিশ্রাম করতে পারবেন। আর ঠিক তখনই বাচ্চাদের মধ্যে একজন কান্না শুরু করে, ‘দোডাম্মা২... দোডাম্মা, ও আমাকে চিমটি দিয়েছে!’ প্রচ- রাগে রাজিয়া এক ঝটকায় সোফা থকে নেমে দাঁড়ান, কিন্তু এক মুহূর্তে রাগ চেপে তিনি নিঃশব্দে বাচ্চাদের গালিগালাজ করেন।
রাজিয়া ভাবছিলেন যে, ইতোমধ্যে বাড়িতে ছয়টা দস্যি আছে। প্রত্যেক দেবরের ছেলেমেয়ের সংখ্যা দুই-দুই... তিন-তিন... এবং সবাই ছুটির সময় এসে হাজির হয়েছে। আর আমার ছোটো বোনের দু’সন্তানও এখানে এসেছে- হে আল্লাহ, আমি কী করতে পারি! এমন সময় তাঁর স্বামী, লতিফ আহমদ, ঘরে প্রবেশ করেন। তিনি স্ত্রীর নাজেহাল অবস্থা দেখে সতর্ক হয়ে যান। রাজিয়া সবসময় বাচ্চাদের প্রতি স্পর্শকাতর। শুরুতেই তাঁর প্রচ- মাথাব্যথা ছিল এবং ছেলেমেয়েদের চিৎকার-চেঁচামেচি সেই মাথা ব্যথার মধ্যে যেন আরেকটু মসলা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়েছে... চোখের মণি তেরছা করে তিনি অসহায় দৃষ্টি মেলে তাকালেন এবং আপন মনে গুনলেন... এক, দুই, তিন, চার... মোট আঠারো জন এবং সবারই বয়স তিন থেকে বারো বছরের মধ্যে।
রাজিয়া একটি শব্দ উচ্চারণ করার আগেই লতিফ আহমদ বাচ্চাদের ধমক দেন। (‘এই, সবাই শান্ত হয়ে বসো- যে শব্দ করবে, তাকে কিছুই দেব না।’) তাঁর পেছনে পেছনে হুসেইন বাগান থেকে এক ঝুড়ি পাকা আম নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। বাচ্চারা যেই হৈচৈ করে ঝুড়ির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন লতিফ আহমদ খানিকটা ভড়কে যান। তিনি স্ত্রীর দিকে বিষণœ দৃষ্টিতে এক পলক তাকিয়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়ান। রাজিয়া মাথা ব্যথা সহ্য করতে না পেরে হাতের নাগালের মধ্যে থাকা এক বা দু’টি বাচ্চাকে ধরে মারতে শুরু করেন। পুরো গ্রীষ্মের সময় ক্রমাগত নির্যাতনের সম্ভাবনা এবং এর থেকে নিস্কৃতি নেই ভেবে শেষ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন যে, বাচ্চাদের মধ্যে কমপক্ষে কয়েকজনের জন্য আলাদা বিছানার ব্যবস্থা করতে হবে। অবশেষে তিনি উপসংহারে পৌঁছুলেন যে, কয়েকটি ছেলেকে সুন্নাতে খাতনা করিয়ে দিতে হবে।
রাজিয়ার হিসাব অনুযায়ী বাড়ির আঠারোটি বাচ্চার মধ্যে আটটি মেয়ে। তাই সুন্নাতে খাতনার জন্য ওরা গনার বাইরে। বাকি দশ ছেলের মধ্যে চারজনের বয়স জোড় সংখ্যার—চার, ছয়, আট- সুতরাং ওরাও রেহাই পাবে। স্ত্রী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করার মতো একটি শব্দও উচ্চারণ না করে লতিফ আহমদ বাকি ছয় ছেলের সুন্নাতে খাতনা করানোর জন্য রাজি হয়ে যান।
লতিফ আহমদ এবং রাজিয়ার পরিবার ছিল শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত সম্ভ্রান্ত এবং বিত্তশালী পরিবারগুলোর মধ্যে অন্যতম। যদিও লতিফ আহমদের ছোটো ছয় ভাই সরকারি চাকরিজীবী, কিন্তু তারা অন্য জায়গায় বসবাস করেন। তবে পরিবারের সব অনুষ্ঠান বড় ভাই লতিফ আহমদের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়। রাজিয়া খরচপাতির ব্যাপারে কখনই কার্পণ্য করেন না। তিনি মনে করেন যে, স্বামীর ছোটো ভাইদের এবং তাদের পরিবারের লোকজনদের ভালোভাবে আদর-আপ্যায়ন করা তাঁর কর্তব্য। এছাড়া তিনি আনন্দিত যে, ছয় জনের মধ্যে সুন্নাতে খাতনা করার উপযোগী দুইজন তাঁর ছোটো বোনের ছেলে।
রাজিয়ার তত্ত্বাবধানে সুন্নাতে খাতনার প্রস্তুতি শুরু হয়। তিনি বেশ কয়েক মিটার লাল থান কাপড় কেনার ব্যবস্থা করেন। বাচ্চারা ওদের দোডাম্মার সঙ্গে আয়োজন করার কাজে যোগ দেয়। রাজিয়া লুঙ্গি বানানোর জন্য কাপড় কাটেন। মেয়েদেরও অনেক কাজ করার আছে, যেমন লুঙ্গিতে নকশা আঁকা, পাথর বসানো এবং জরির কাজ করা। ছয় ছেলের জন্য লুঙ্গি তৈরি করার পর বেশ খানিকটা কাপড় বেঁচে যায়। অবশিষ্ট কাপড় দিয়ে কী করা যায়, এই চিন্তা রাজিয়ার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খেতে থাকে। বিদ্যুৎ ঝলকের মতো তাঁর মাথায় একটা পরিকল্পনা ভেসে ওঠে। ‘আরে, আমাদের রাঁধুনী আমিনার ছেলে আরিফ আছে না? আর আমাদের ক্ষেতমজুরের ছেলে ফরিদও তো আছে... সত্যি বলতে কী, একই সঙ্গে দুঃস্থ পরিবারের কয়েকটি ছেলেকেও সুন্নাতে খাতনা করানো যায়। আর চটজলদি তিনি কাজে নেমে পড়েন।
জামে মসজিদ এবং মসজিদ-এ-নূরসহ শহরের মধ্যে পাঁচটি মসজিদ রয়েছে। শুক্রবারের জুম্মার নামাজের পর সব মসজিদের সেক্রেটারি ঘোষণা করেন: ‘আল্লাহপাকের খেদমতের জন্য লতিফ আহমদ সাহেব আগামী শুক্রবার বাদ আসর সম্মিলিতভাবে সুন্নাতে ইব্রাহিমের ব্যবস্থা করেছেন। যারা নিজেদের ছেলেদের সুন্নাতে খাতনা করাতে চান, দয়া করে তারা তালিকায় অগ্রিম নাম লেখাবেন।’
তাঁরা সবাই আঞ্চলিক ভাষায় খাতনা শব্দটি ব্যবহার করতে পারতেন, কিন্তু করেননি। কেননা মঞ্চে মাইক্রোফোন হাতে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে কোনো ঘোষণা করতে হলে তা আনুষ্ঠানিকভাবেই করতে হয়। আসলে বিষয়টি ছিল নবী ইবরাহিম (আঃ)-এর অনুষ্ঠান উদযাপনের মতো। তবে ঘটনা ছিল একই ধরনের: ছেলেরা সম্মিলিত উৎসবমুখর অনুষ্ঠানের জন্য অপেক্ষা করত এবং খাতনার সময় চিৎকার-চেঁচামেচি করে কান্নাকাটি করত।
সবকিছুই রাজিয়ার পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছিল। অনেক দুঃস্থ লোকজন তাদের ছেলেদের নাম নিবন্ধন করিয়েছে। রাজিয়া একটার পর একটা লুঙ্গি তৈরি করেছেন। তাঁর পরিবারের ছেলেরা পেয়েছে নকশা আঁকা, পাথর বসানো ও জরির কাজ করা লুঙ্গি। অন্যদিকে অন্য ছেলেরা পেয়েছে সাদামাটা লুঙ্গি। তাঁর ছেলে সামাদের লুঙ্গিতে এত বেশি নকশা আঁকা হয়েছে এবং পাথর বসানো ও জরির কাজ করা হয়েছে যে, লুঙ্গির কাপড়ের আসল রঙ বলা মুশকিল হয়ে পড়েছে। বস্তা ভর্তি গম এবং শুকনো নারিকেল সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়া কাজু বাদাম, কিসমিস, খেজুর ও গরুর দুধ থেকে তৈরি ঘি কেনা হয়েছে। শিশু-কিশোররা প্রচন্ডভাবে অস্থির এবং উত্তেজিত ছিল, কেননা সেখানে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছিল এবং অন্য সবাই খুশি ছিল। কারোর বুঝে ওঠার আগেই শুক্রবার এসে হাজির হয়। জুম্মার নামাজ শেষ হওয়ার পরপরই লতিফ আহমদ দ্রুত দুপুরের খাবার খেয়ে বাড়ির পাশের মসজিদে যান। সেখানে অনেক লোকজন জড়ো হয়েছে; শিশুদের সুন্নাতে খাতনা করা হবে এবং তাদের বাবা-মায়েরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। সেখানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে একদল যুবক উপস্থিত রয়েছে। তাদের সবার পরনে সাদা সালোয়ার ও জুব্বা এবং তারা মাথায় সাদা টুপি বা সাদা কাপড় বেঁধেছে। তারা জুম্মার নামাজের আগে গোসল করেছে, তাই তাদের সতেজ এবং পরিচ্ছন্ন দেখাচ্ছিল। কিছু লোক তাদের চোখে সুরমা লাগিয়েছে এবং গায়ে সুগন্ধি মেখেছে। বাতাসে মিষ্টি গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল।
ছেলেদের মুসলমানী করা হবে কাছাকাছি মাদ্রাসার ভেতরে। ইব্রাহিম, যার শরীর কুস্তিগীরের মতো, ছিলেন সেই দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তার সাদা জুব্বার নিচে বিশাল আকৃতির মাংসপেশী ফুটে উঠেছিল। মুসলমানী করার কাজ তার পারিবারিক পেশা। তবে অন্য সময়ে সে একজন নাপিত। সে মাদ্রাসার বিশাল হলঘরের এক কোণে প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত রয়েছে। সে অনুষ্ঠানের জন্য ধার করা কলসীর মতো পিতলের পাত্র উপুড় করে রেখে তার কাজ শুরু করে। আমিনাকে তেঁতুলের রস দিয়ে পাত্রটি দু’বার ঘষে পরিষ্কার করতে বলেছিলেন রাজিয়া, যেন পাত্রটি ঝকঝকে দেখায়। তারপর সে উল্টো করে রাখা পাত্রের সামনে মিহি করা ছাইয়ের বাটি রাখে।
পুরোপুরি সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত ইব্রাহিম সমস্ত ব্যবস্থা পুনরায় দেখে নেয়। এ বিষয়ে সে অত্যন্ত অভিজ্ঞ মানুষ। বলা হয় যে, যখন সে ছুরির কাজ শেষ করে, তখন খাতনা শেষ হয়ে যায় এবং কোনো ধরনের সংক্রমণ ছাড়াই ক্ষত সেরে ওঠে। আর এটাই ছিল তার খ্যাতি। হলঘরের আরেক কোণে কয়েকজন তরুণ একটি বড় শতরঞ্জি এমনভাবে বিছিয়ে দেয়, যেন শতরঞ্জির ভাঁজগুলো মসৃণ থাকে। ইব্রাহিম শেষবারের মতো সবকিছু ভালো করে পরীক্ষা করে এবং তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। সে তার পকেট থেকে একটি শেভিং রেজার বের করে বাম হাতের ওপর ঘষতে ঘষতে বলল, ‘একজন একজন করে ছেলেদের নিয়ে আসুন।’
আব্বাস, সেচ্ছাসেবকদের একজন, যে ইব্রাহিমের পাশে অস্বস্তিকর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল, কথাটা না বলে থাকতে পারল না। সে বলল, ‘যদি আপনি আমাকে রেজারটা দিতেন, তাহলে আমি গরম পানিতে ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করতাম। আমি মনে করি, জীবাণুমুক্ত করার জন্য আমরা ডেটলও ব্যবহার করতে পারি।’ ইক্রাহিম আব্বাসের দিকে তাকায়- এখন সে বুঝতে পারল যে, তার পাশে দাঁড়ানো যুবকটি কলেজের সিঁড়ি পেরিয়ে এসেছে। ইব্রাহিম আব্বাসের দিকে তির্যক দৃষ্টি নিয়ে তাকাল, যেমন ভাবে ক্ষতিকারক কোনো জীবজন্তুর দিকে তাকানো হয়, এবং অপমানিত বোধ করে কারণ জানতে চাইল। ‘যেন কোনো ধরনের সংক্রমণের সুযোগ না থাকে...’ বিচলিত হয়ে আব্বাস কথাটি অসম্পূর্ণ রেখে থেমে যায়। কিন্তু ইব্রাহিমও কম যায় না। সে অবজ্ঞা করে জিজ্ঞেস করে যে, আব্বাসের এমন সংক্রমণ হয়েছিল কি না। ইব্রাহিমের রসিকতা আব্বাসের বন্ধুদেরকে হাসতে বাধ্য করে, কি কি কি... আব্বাস তাদের ওপর প্রচ- বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তোমরা সবাই এত অশালীন, অভদ্র’, এবং বলেই সে চলে যায়। ইব্রাহিমের চোখেমুখে বিজয়ের হাসি ফুটে ওঠে। সে পুনরায় ছেলেদের ডাকে, ‘একজন একজন করে আসো।’
বাইরে কর্তব্যরত সেচ্ছাসেবকরা ছেলেদের প্যান্ট খুলতে বলল। লাইনের সামনে ছিল আরিফ, যার বয়স তেরো বছর এবং সে অনেকটা বড় হয়ে গেছে। যদিও সাধারণত ছেলেদের নয় বছর পূর্ণ হওয়ার আগে সুন্নাতে খাতনা করানো হয়, কিন্তু তার মা আমিনার কোনো টাকাপয়সা ছিল না। তাই সময় মতো ছেলেকে খাতনা করাতে পারেনি। যাহোক, উপস্থিত সবাই মৃদু হাসছিল, যখন আরিফ পরনের পায়জামা খোলার পর শার্ট খুলছিল। এক যুবক, যে হাসি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না, আরিফের পিঠে হালকাভাবে ধাক্কা দিয়ে সামনের দিকে ঠেলে দেয়।
পাঁচ-ছয়জন স্বেচ্ছাসেবক জোর করে আরিফকে উল্টো করে রাখা পিতলের পাত্রের ওপর বসায়। সে পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে এবং কী ঘটতে যাচ্ছে, তা বলার আগেই একজোড়া শক্ত হাত এসে তার বগলের নিচে পৌঁছে। হাত দু’টি আরিফের উরু চেপে ধরে এবং পা জোড়া ফাঁক করে। সে আতঙ্কে চিৎকার করে এবং তখন আরও দু’জন পিঠ চেপে ধরে। আরিফের হৃৎপি- ধড়ফড় করতে থাকে এবং সে পালাতে চাচ্ছিল। কিন্তু যারা তাকে চেপে ধরেছিল, তারা ছিল আরও চটপটে এবং শক্তিশালী। এমনকী তারা তাকে একবিন্দুও এদিক-ওদিক নড়াচড়া করার সুযোগ দেয়নি। আরিফ সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে এবং চিৎকার করে, ‘ছেড়ে দাও, আমাকে যেতে দাও, আইয়্যু৩... আম্মা... হে আল্লাহ!’ এমন পরিস্থিতি হতে পারে, সেই আশঙ্কায় তিন কিংবা চারজন স্বেচ্ছাসেবক ক্ষেপে যায়, বলল, ‘এই, এভাবে চিৎকার-চেঁচামেচি করিস না, বরং ‘দ্বীন, দ্বীন’ বলতে থাক।’ আরিফ হাঁপাতে হাঁপাতে বারবার বলতে থাকে, ‘দ্বীন... দ্বীন ... আল্লাহ ... আল্লাহ... আম্মা... আইয়্যু...’
এই ঘটনা চলার সময় ইব্রাহিম শান্তভাবে কাগজের মতো পাতলা বাঁশের কঞ্চি আরিফের লিঙ্গে এমন জায়গায় ধরে, যেখানে খাতনা করার পর শুধু সামনের চামড়াটি ঝুলে থাকে। একজন আরিফের মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে তাকিয়ে বলল, ‘বলো, বলো খোকা, বলো ‘দ্বীন’, দ্রুত বলো, তাড়াতাড়ি বলো।’ দ্বীন শব্দের অর্থ ‘বিশ্বাস’ থেকে ‘ধর্ম’ পর্যন্ত যে কোনোটি হতে পারে, কিন্তু দ্বীন শব্দের অর্থ না জেনেই আরিফ শরীরের মস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে ওঠে, ‘দ্বীন! দ্বীন!’ তার জিহ্বা শুকিয়ে আমসি হয়ে যায়, পিঠ বেয়ে ঘাম গড়াতে থাকে, সারা শরীরে উত্তাপের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে, এমনকী ভয়ে তার হাত-পা ঠা-া হয়ে যায়। শেষবারের মতো সে নিজেকে আলগা করার বৃথা চেষ্টা করে।
‘কেন যেতে চাও, খোকা?’ একজন স্বেচ্ছাসেবক আরিফের পা দু’টি চেপে ধরে জিজ্ঞেস করে। ‘আমাকে যেতে দাও, আমি পেচ্ছাব করব,’ সে অনুনয়-বিনয় করে বলল, শুধু ‘এক মিনিটের জন্য’। তারা তাকে আরও শক্ত করে চেপে ধরে। ইব্রাহিম তার পিঠের পেছনে লুকিয়ে রাখা ক্ষুর বের করে এক ঝটকায় আরিফের লিঙ্গের ডগা বরাবর ঢুকিয়ে দেয়। লিঙ্গের সামনের চামড়া সঙ্গে সঙ্গে বাটিতে পড়ে। ক্ষত থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। ইব্রাহিম আলতো করে কাটা লিঙ্গের ওপর কিছু ছাই ছিটিয়ে দেয়, যা রক্তের প্রবাহকে বন্ধ করে। আরিফের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায় এবং তার সারা শরীর ঘামে ভিজে যায়। তার কান্না চলতে থাকে। দু’জন যুবক তাকে অবলীলায় তুলে নিয়ে হল ঘরের এক কোণে মেঝেতে শুইয়ে দেয়। শীতল প্লাস্টার কিছুটা স্বস্তি দেয়, তবুও জ্বালাপোড়া কমেনি...
কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক অন্য একটি ছেলেকে ধরে টেনেহিঁচড়ে ইব্রাহিমের কাছে নিয়ে আসে। আব্বাস আরিফকে একটু পানি দেয় এবং বাতাস করে। কেউ একজন কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘দ্বীন... দ্বীন...’ পাশে মাদুরের ওপর আরেক ছেলেকে শুইয়ে দেয়। আরিফ পেট চেপে যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে।
‘দ্বীন... দ্বীন...’ বিভিন্ন গলায় প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। চারিদিকে সুন্নাতে খাতনা করা ছেলেরা যন্ত্রণায় ছটফট করে। অসহ্য যন্ত্রণা সত্ত্বেও আরিফের চোখ বুজে আসে। তন্দ্রা তাকে কাবু করে ফেলে এবং তারপর হঠাৎ করে সে আবার জেগে ওঠে। কয়েকবার ঘুম আর জাগরণের পর অবশেষে সে গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে যাচ্ছিল। সেই সময় কেউ তাকে মৃদু ঝাঁকুনি দেয়। তখনো তার ব্যথা ছিল। সে চোখ খুলে দেখে আব্বাস সহানুভূতির দৃষ্টি মেলে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ‘আরিফ, তুই কী হাঁটতে পারবি?’ আব্বাস জিজ্ঞেস করে। ‘দেখ, তোর মা এসেছেন।’
আরিফের মা পুরনো বোরখা পরে নিজেকে ঢেকে রেখেছেন। তিনি পুরুষদের সামনে আসতে পারতেন না কিংবা এই অবস্থায় ছেলেকে একা রেখে যেতে পারতেন না। তিনি দরজার অপর দিক থেকে তাকিয়ে দেখলেন। মায়ের রঙ-চটা বোরখা দেখে আরিফের শক্তি বেড়ে যায়। আব্বাসের সাহায্য নিয়ে সে পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়ায় এবং এক পা দুই পা ফেলে মায়ের দিকে হাঁটতে শুরু করে।
লতিফ আহমদ দরজার পাশে চেয়ারে বসেছিলেন। তিনি আরিফের হাতে একটি ব্যাগ তুলে দেন। আরিফ দেখে যে, ব্যাগের মধ্যে গম, দু’টি অর্ধেক নারিকেল, এক প্যাকেট চিনি, প্লাস্টিকে মোড়ানো সামান্য মাখন... এসব দেখে তার মুখে লালা জমা হয়।
একটি ছেলে ঘরে ঢোকার মুহূর্তে থেমে যায়। ছেলেটি কাঁদতে শুরু করে। ছেলেটিকে দেখে আরিফের মনে হলো সে একজন সুপারহিরো এবং তাকে ডাকল, ‘এই... সুবহান, ভয় পাস নে... ‘দ্বীন’- শুধু ‘দ্বীন’ বলবি... তোর কিছুই হবে না।’ আরিফ নিজেকে একজন অভিজ্ঞ ছেলে মনে করে।
আরিফ খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাইরে আসে। তার হাত থেকে ব্যাগটি নিয়ে আমিনা তাকে বারান্দায় বসতে বললেন। সে সাবধানে লুঙ্গি নামিয়ে পা ছড়িয়ে বসে, যেন ঘষা না লাগে। লাইনে দাঁড়িয়ে এক ছেলে জোরে জিজ্ঞেস করল, ‘এই আরিফ... ব্যথা লাগে?’ আরিফ চোখেমুখে ব্যথার কোনো চিহ্ন না ফুটিয়ে বলল, ‘না, মোটেও না। কোনো ব্যথা নেই। একদমই ব্যথা করছে না।’
একজন দাড়িওয়ালা মধ্যবয়সী ভদ্রলোক আরিফের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি আরিফের কথা শুনে বললেন, ‘শাবাশ, বেটা। ধরো, এটা রাখো, আর নিজের খেয়াল করো,’ বলেই তিনি পঞ্চাশ রুপির একটা নোট আরিফকে দিলেন। সেখানে অপেক্ষায় থাকা ছেলেরা হিংসায় আরিফের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘরের ভেতর থেকে চিৎকারের আওয়াজ ভেসে আসে। ‘দ্বীন... দ্বীন... আইয়্যু...আল্লাহ...’ আরেকটি ছেলেকে ঠেলে ভেতরে পাঠানো হয়।
ছেলেরা একজন একজন করে ভেতরে ঢোকে এবং কিছুক্ষণ পরে প্রত্যেকেই লাল লুঙ্গি পরে বেরিয়ে আসে। এই পরিবেশের মাঝে একজন মহিলা এসে উপস্থিত হন। রোগা-পাতলা, চোখ কোটরে ঢুকে গেছে, বলতে গেলে তার শরীরের সঙ্গে কোমর নেই এবং তারপরও তিনি একটি শিশু কোলে নিয়ে এসেছেন। তাঁর রঙচটা ছেঁড়া শাড়ির আড়ালে লুকিয়ে আছে সেলাই করা ব্লাউজ। মহিলা ছয় বা সাত বছরের একটা ছেলেকে হাত ধরে টেনেহিঁচড়ে এনেছেন। ছেলেটি ছুটে পালাতে চাইছিল, কিন্তু তিনি ছেলেটিকে শক্ত করে ধরে রেখেছেন। ছেলেটির চিৎকার হৃদয়বিদারক। মহিলা ছেঁড়া শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথা ঢাকার চেষ্টা করেন, কিন্তু আঁচল আরও খুলে যায়। তিনি খুব ধীরে অস্ফুট গলায় বললেন, ‘ভাইয়া...’ তখন লতিফ আহমদ অন্যদের সঙ্গে কথায় বিভোর ছিলেন এবং একটু পরে মহিলার দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করেন, ‘কিছু বলবেন, মা?’
মহিলার সঙ্গের ছেলেটি ভীষণ জোরে কান্না শুরু করে। ‘আমি ওরও সুন্নাতে খাতনা করাতে চাই, ভাইয়া,’ মহিলা অনুনয়-বিনয়ের সুরে বললেন। ‘না, না, আমি চাই না,’ ছেলেটি চিৎকার করে পালাতে চেষ্টা করে। মহিলা শক্ত করে ছেলের হাত ধরে রাখেন। এই টানাটানির সময় মহিলার মাথা থেকে শাড়ির আঁচল খসে পড়ে। তাঁর কুঁচকে যাওয়া পেট, ঘাড়ের উঁচু হাড়, কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখ এবং সেলাই করা ব্লাউজে লতিফ আহমদের চোখে ধরা পড়ে মর্মান্তিক এক দৃশ্য।
লতিফ আহমদ মাটির দিকে তাকিয়ে ছেলেটিকে ধমকের সুরে বললেন, ‘এই ছেলে, চুপ করে দাঁড়াও। তুমি কী দ্বীনের অংশ হতে চাও না? তুমি সুন্নাতে খাতনা ছাড়া ইসলাম ধর্মে থাকতে পারবে না। তুমি কী তাই চাও?’ কান্নার মধ্যে ছেলেটি সত্য কথাটি বলল, ‘আমার খাতনা করা হয়েছে।’
সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটির মা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন, ‘কিন্তু ওর খাতনা ঠিক মতো করা হয়নি, ভাইয়া... এখন সঠিক ভাবে করা যাবে।’ লতিফ আহমদের মনে সন্দেহ দানা বাঁধে, কিন্তু তিনি নিশ্চিত হতে পারলেন না। কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে ডেকে বললেন, ‘এই, সামি, এ ছেলেকে ধরে পরীক্ষা করো।’ সেখানে চিত্তবিনোদনের আশায় দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি দুষ্ট ছেলে শিশুটিকে চ্যাংদোলা করে ওপরে তোলে এবং তাদের মধ্যে একজন তার হাফ প্যান্ট খুলে ফেলে। ঢিলেঢালা প্যান্টটি খুলতে অসুবিধা হয়নি। দৃশ্যটি দেখার সময় দর্শকরা সবাই হাসিতে ফেটে পড়ে। ‘খাতনা সঠিকভাবে করা হয়েছে।’ ছেলেরা শিশুটিকে ছেড়ে দেয়। এক লোক নির্দয়ভাবে বলল, ‘তোমার স্বামীকেও এনে দাও। চলো, তারও সুন্নাতে খাতনা করা হোক, যাতে তুমি গম এবং নারিকেল পাও।’ আবারও হাসির রোল ওঠে।
যেই শিশুটিকে ছেড়ে দেওয়া হয়, সে দ্রুত তার হাফ প্যান্ট পরে দৌড়ে পালিয়ে যায়। তার মা আবারও শাড়ির ছেঁড়া আঁচল দিয়ে মাথা ঢেকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বের হয়ে যান।
‘থু! এই পৃথিবীতে এত নীচু মনের মানুষ আছে... তারা যে কোন স্তরে নামতে পারে,’ এক লোক ঘৃণায় থুথু ছিটিয়ে বলল। (বাকি অংশ আগামী সংখ্যায়)
টীকা: (ইংরেজি অনুবাদে নেই, তবে বাংলাদেশী পাঠকের সুবিধার্থে দেওয়া হলো)
১ আবাবা: কন্নড় ভাষায় আশ্চর্য কিংবা প্রশংসা সূচক অভিব্যক্তি (যেমন ইংরেজিতে ‘ওয়াও’)।
২ দোডাম্মা: কন্নড় ভাষায় বড় খালা বা বড় চাচী।
৩ আইয়্যু: সম্বোধনটি বিশেষভাবে দক্ষিণ ভারতে বিভিন্ন আবেগ প্রকাশ করতে ব্যবহৃত হয়, যেমন দুঃখ, অবাক হওয়া, ভয় বা আনন্দ।
গল্পসূত্র: ‘লাল লুঙ্গি’ গল্পটি ইংরেজিতে ‘রেড লুঙ্গি’ গল্পের অনুবাদ। ইংরেজিতে গল্পটি বানু মুশতাকের ২০২৫ সালে আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার প্রাপ্ত ছোটগল্প গ্রন্থ ‘হার্ট ল্যাম্প’-এ অন্তর্ভুক্ত। গ্রন্থটি কন্নড় ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন দীপা ভাসতি।
‘আন্তর্জাতিক বুকার ২০২৫’ বিজয়ী বানু মুশতাক-এর গল্প
অনুবাদ: ফজল হাসান
শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন
বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
গ্রীষ্মকালীন ছুটি এলেই মায়েদের দুঃখ-দুর্দশার সীমা থাকে না। তখন সব বাচ্চারা বাড়িতে থাকে। যখন ওরা টিভির সামনে থাকে না, তখন হয় বাড়ির সামনের উঠানের পেয়ারা গাছে চড়বে, নতুবা বাড়ির সীমানার দেওয়ালের ওপর বসে থাকবে। যদি একজন দেওয়াল থেকে পড়ে গিয়ে হাত কিংবা পা ভাঙে, তখন কী অবস্থা হবে? তারপর কান্নাকাটি এবং হাসাহাসি চলবে, এমনকী তারা রহস্যময় বিচার ব্যবস্থার ভিত্তিতে একজন অন্যজনের ওপর শাস্তি আরোপ করবে... আর এ কারণেই গ্রীষ্মকালীন ছুটি শুরু হলে রাজিয়ার মাথাব্যথা আরও বেড়ে যায়। তাঁর স্নায়ুগুলো ঠা-া হয়ে যায়, মনে হয় তাঁর উত্তপ্ত মাথা ফেটে যাবে এবং যে কোনো মুহূর্তে তাঁর ঘাড়ের পেছনের শিরাগুলো ছিঁড়ে যাবে। একেকজন শিশু তাদের অভিযোগ নিয়ে তাড়াহুড়া করে আসে, কাঁদতে থাকে এবং চিৎকার-চেঁচামেচি করে... এবং তারপরই পুনরায় তাদের খেলা শুরু হয়... আবাবা১... তলোয়ার এবং স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ, বোমা হামলা...!
অনেক হয়েছে, রাজিয়া ভাবলেন। আর তারপরই তিনি একটা লম্বা কাপড় মাথার চারপাশে শক্তভাবে বেঁধে হলঘরের সোফায় সটান শুয়ে পড়েন। তিনি হৈচৈ সহ্য করতে পারছিলেন না। টিভি চালু ছিল, তবে আওয়াজ কম ছিল। তিনি শিশুদের কঠিন গলায় সতর্ক করেছেন এবং আশা করতে শুরু করেন যে, অবশেষে পা ওপরে তুলে নির্ভার হয়ে বিশ্রাম করতে পারবেন। আর ঠিক তখনই বাচ্চাদের মধ্যে একজন কান্না শুরু করে, ‘দোডাম্মা২... দোডাম্মা, ও আমাকে চিমটি দিয়েছে!’ প্রচ- রাগে রাজিয়া এক ঝটকায় সোফা থকে নেমে দাঁড়ান, কিন্তু এক মুহূর্তে রাগ চেপে তিনি নিঃশব্দে বাচ্চাদের গালিগালাজ করেন।
রাজিয়া ভাবছিলেন যে, ইতোমধ্যে বাড়িতে ছয়টা দস্যি আছে। প্রত্যেক দেবরের ছেলেমেয়ের সংখ্যা দুই-দুই... তিন-তিন... এবং সবাই ছুটির সময় এসে হাজির হয়েছে। আর আমার ছোটো বোনের দু’সন্তানও এখানে এসেছে- হে আল্লাহ, আমি কী করতে পারি! এমন সময় তাঁর স্বামী, লতিফ আহমদ, ঘরে প্রবেশ করেন। তিনি স্ত্রীর নাজেহাল অবস্থা দেখে সতর্ক হয়ে যান। রাজিয়া সবসময় বাচ্চাদের প্রতি স্পর্শকাতর। শুরুতেই তাঁর প্রচ- মাথাব্যথা ছিল এবং ছেলেমেয়েদের চিৎকার-চেঁচামেচি সেই মাথা ব্যথার মধ্যে যেন আরেকটু মসলা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়েছে... চোখের মণি তেরছা করে তিনি অসহায় দৃষ্টি মেলে তাকালেন এবং আপন মনে গুনলেন... এক, দুই, তিন, চার... মোট আঠারো জন এবং সবারই বয়স তিন থেকে বারো বছরের মধ্যে।
রাজিয়া একটি শব্দ উচ্চারণ করার আগেই লতিফ আহমদ বাচ্চাদের ধমক দেন। (‘এই, সবাই শান্ত হয়ে বসো- যে শব্দ করবে, তাকে কিছুই দেব না।’) তাঁর পেছনে পেছনে হুসেইন বাগান থেকে এক ঝুড়ি পাকা আম নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। বাচ্চারা যেই হৈচৈ করে ঝুড়ির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন লতিফ আহমদ খানিকটা ভড়কে যান। তিনি স্ত্রীর দিকে বিষণœ দৃষ্টিতে এক পলক তাকিয়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়ান। রাজিয়া মাথা ব্যথা সহ্য করতে না পেরে হাতের নাগালের মধ্যে থাকা এক বা দু’টি বাচ্চাকে ধরে মারতে শুরু করেন। পুরো গ্রীষ্মের সময় ক্রমাগত নির্যাতনের সম্ভাবনা এবং এর থেকে নিস্কৃতি নেই ভেবে শেষ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন যে, বাচ্চাদের মধ্যে কমপক্ষে কয়েকজনের জন্য আলাদা বিছানার ব্যবস্থা করতে হবে। অবশেষে তিনি উপসংহারে পৌঁছুলেন যে, কয়েকটি ছেলেকে সুন্নাতে খাতনা করিয়ে দিতে হবে।
রাজিয়ার হিসাব অনুযায়ী বাড়ির আঠারোটি বাচ্চার মধ্যে আটটি মেয়ে। তাই সুন্নাতে খাতনার জন্য ওরা গনার বাইরে। বাকি দশ ছেলের মধ্যে চারজনের বয়স জোড় সংখ্যার—চার, ছয়, আট- সুতরাং ওরাও রেহাই পাবে। স্ত্রী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করার মতো একটি শব্দও উচ্চারণ না করে লতিফ আহমদ বাকি ছয় ছেলের সুন্নাতে খাতনা করানোর জন্য রাজি হয়ে যান।
লতিফ আহমদ এবং রাজিয়ার পরিবার ছিল শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত সম্ভ্রান্ত এবং বিত্তশালী পরিবারগুলোর মধ্যে অন্যতম। যদিও লতিফ আহমদের ছোটো ছয় ভাই সরকারি চাকরিজীবী, কিন্তু তারা অন্য জায়গায় বসবাস করেন। তবে পরিবারের সব অনুষ্ঠান বড় ভাই লতিফ আহমদের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়। রাজিয়া খরচপাতির ব্যাপারে কখনই কার্পণ্য করেন না। তিনি মনে করেন যে, স্বামীর ছোটো ভাইদের এবং তাদের পরিবারের লোকজনদের ভালোভাবে আদর-আপ্যায়ন করা তাঁর কর্তব্য। এছাড়া তিনি আনন্দিত যে, ছয় জনের মধ্যে সুন্নাতে খাতনা করার উপযোগী দুইজন তাঁর ছোটো বোনের ছেলে।
রাজিয়ার তত্ত্বাবধানে সুন্নাতে খাতনার প্রস্তুতি শুরু হয়। তিনি বেশ কয়েক মিটার লাল থান কাপড় কেনার ব্যবস্থা করেন। বাচ্চারা ওদের দোডাম্মার সঙ্গে আয়োজন করার কাজে যোগ দেয়। রাজিয়া লুঙ্গি বানানোর জন্য কাপড় কাটেন। মেয়েদেরও অনেক কাজ করার আছে, যেমন লুঙ্গিতে নকশা আঁকা, পাথর বসানো এবং জরির কাজ করা। ছয় ছেলের জন্য লুঙ্গি তৈরি করার পর বেশ খানিকটা কাপড় বেঁচে যায়। অবশিষ্ট কাপড় দিয়ে কী করা যায়, এই চিন্তা রাজিয়ার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খেতে থাকে। বিদ্যুৎ ঝলকের মতো তাঁর মাথায় একটা পরিকল্পনা ভেসে ওঠে। ‘আরে, আমাদের রাঁধুনী আমিনার ছেলে আরিফ আছে না? আর আমাদের ক্ষেতমজুরের ছেলে ফরিদও তো আছে... সত্যি বলতে কী, একই সঙ্গে দুঃস্থ পরিবারের কয়েকটি ছেলেকেও সুন্নাতে খাতনা করানো যায়। আর চটজলদি তিনি কাজে নেমে পড়েন।
জামে মসজিদ এবং মসজিদ-এ-নূরসহ শহরের মধ্যে পাঁচটি মসজিদ রয়েছে। শুক্রবারের জুম্মার নামাজের পর সব মসজিদের সেক্রেটারি ঘোষণা করেন: ‘আল্লাহপাকের খেদমতের জন্য লতিফ আহমদ সাহেব আগামী শুক্রবার বাদ আসর সম্মিলিতভাবে সুন্নাতে ইব্রাহিমের ব্যবস্থা করেছেন। যারা নিজেদের ছেলেদের সুন্নাতে খাতনা করাতে চান, দয়া করে তারা তালিকায় অগ্রিম নাম লেখাবেন।’
তাঁরা সবাই আঞ্চলিক ভাষায় খাতনা শব্দটি ব্যবহার করতে পারতেন, কিন্তু করেননি। কেননা মঞ্চে মাইক্রোফোন হাতে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে কোনো ঘোষণা করতে হলে তা আনুষ্ঠানিকভাবেই করতে হয়। আসলে বিষয়টি ছিল নবী ইবরাহিম (আঃ)-এর অনুষ্ঠান উদযাপনের মতো। তবে ঘটনা ছিল একই ধরনের: ছেলেরা সম্মিলিত উৎসবমুখর অনুষ্ঠানের জন্য অপেক্ষা করত এবং খাতনার সময় চিৎকার-চেঁচামেচি করে কান্নাকাটি করত।
সবকিছুই রাজিয়ার পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছিল। অনেক দুঃস্থ লোকজন তাদের ছেলেদের নাম নিবন্ধন করিয়েছে। রাজিয়া একটার পর একটা লুঙ্গি তৈরি করেছেন। তাঁর পরিবারের ছেলেরা পেয়েছে নকশা আঁকা, পাথর বসানো ও জরির কাজ করা লুঙ্গি। অন্যদিকে অন্য ছেলেরা পেয়েছে সাদামাটা লুঙ্গি। তাঁর ছেলে সামাদের লুঙ্গিতে এত বেশি নকশা আঁকা হয়েছে এবং পাথর বসানো ও জরির কাজ করা হয়েছে যে, লুঙ্গির কাপড়ের আসল রঙ বলা মুশকিল হয়ে পড়েছে। বস্তা ভর্তি গম এবং শুকনো নারিকেল সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়া কাজু বাদাম, কিসমিস, খেজুর ও গরুর দুধ থেকে তৈরি ঘি কেনা হয়েছে। শিশু-কিশোররা প্রচন্ডভাবে অস্থির এবং উত্তেজিত ছিল, কেননা সেখানে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছিল এবং অন্য সবাই খুশি ছিল। কারোর বুঝে ওঠার আগেই শুক্রবার এসে হাজির হয়। জুম্মার নামাজ শেষ হওয়ার পরপরই লতিফ আহমদ দ্রুত দুপুরের খাবার খেয়ে বাড়ির পাশের মসজিদে যান। সেখানে অনেক লোকজন জড়ো হয়েছে; শিশুদের সুন্নাতে খাতনা করা হবে এবং তাদের বাবা-মায়েরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। সেখানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে একদল যুবক উপস্থিত রয়েছে। তাদের সবার পরনে সাদা সালোয়ার ও জুব্বা এবং তারা মাথায় সাদা টুপি বা সাদা কাপড় বেঁধেছে। তারা জুম্মার নামাজের আগে গোসল করেছে, তাই তাদের সতেজ এবং পরিচ্ছন্ন দেখাচ্ছিল। কিছু লোক তাদের চোখে সুরমা লাগিয়েছে এবং গায়ে সুগন্ধি মেখেছে। বাতাসে মিষ্টি গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল।
ছেলেদের মুসলমানী করা হবে কাছাকাছি মাদ্রাসার ভেতরে। ইব্রাহিম, যার শরীর কুস্তিগীরের মতো, ছিলেন সেই দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তার সাদা জুব্বার নিচে বিশাল আকৃতির মাংসপেশী ফুটে উঠেছিল। মুসলমানী করার কাজ তার পারিবারিক পেশা। তবে অন্য সময়ে সে একজন নাপিত। সে মাদ্রাসার বিশাল হলঘরের এক কোণে প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত রয়েছে। সে অনুষ্ঠানের জন্য ধার করা কলসীর মতো পিতলের পাত্র উপুড় করে রেখে তার কাজ শুরু করে। আমিনাকে তেঁতুলের রস দিয়ে পাত্রটি দু’বার ঘষে পরিষ্কার করতে বলেছিলেন রাজিয়া, যেন পাত্রটি ঝকঝকে দেখায়। তারপর সে উল্টো করে রাখা পাত্রের সামনে মিহি করা ছাইয়ের বাটি রাখে।
পুরোপুরি সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত ইব্রাহিম সমস্ত ব্যবস্থা পুনরায় দেখে নেয়। এ বিষয়ে সে অত্যন্ত অভিজ্ঞ মানুষ। বলা হয় যে, যখন সে ছুরির কাজ শেষ করে, তখন খাতনা শেষ হয়ে যায় এবং কোনো ধরনের সংক্রমণ ছাড়াই ক্ষত সেরে ওঠে। আর এটাই ছিল তার খ্যাতি। হলঘরের আরেক কোণে কয়েকজন তরুণ একটি বড় শতরঞ্জি এমনভাবে বিছিয়ে দেয়, যেন শতরঞ্জির ভাঁজগুলো মসৃণ থাকে। ইব্রাহিম শেষবারের মতো সবকিছু ভালো করে পরীক্ষা করে এবং তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। সে তার পকেট থেকে একটি শেভিং রেজার বের করে বাম হাতের ওপর ঘষতে ঘষতে বলল, ‘একজন একজন করে ছেলেদের নিয়ে আসুন।’
আব্বাস, সেচ্ছাসেবকদের একজন, যে ইব্রাহিমের পাশে অস্বস্তিকর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল, কথাটা না বলে থাকতে পারল না। সে বলল, ‘যদি আপনি আমাকে রেজারটা দিতেন, তাহলে আমি গরম পানিতে ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করতাম। আমি মনে করি, জীবাণুমুক্ত করার জন্য আমরা ডেটলও ব্যবহার করতে পারি।’ ইক্রাহিম আব্বাসের দিকে তাকায়- এখন সে বুঝতে পারল যে, তার পাশে দাঁড়ানো যুবকটি কলেজের সিঁড়ি পেরিয়ে এসেছে। ইব্রাহিম আব্বাসের দিকে তির্যক দৃষ্টি নিয়ে তাকাল, যেমন ভাবে ক্ষতিকারক কোনো জীবজন্তুর দিকে তাকানো হয়, এবং অপমানিত বোধ করে কারণ জানতে চাইল। ‘যেন কোনো ধরনের সংক্রমণের সুযোগ না থাকে...’ বিচলিত হয়ে আব্বাস কথাটি অসম্পূর্ণ রেখে থেমে যায়। কিন্তু ইব্রাহিমও কম যায় না। সে অবজ্ঞা করে জিজ্ঞেস করে যে, আব্বাসের এমন সংক্রমণ হয়েছিল কি না। ইব্রাহিমের রসিকতা আব্বাসের বন্ধুদেরকে হাসতে বাধ্য করে, কি কি কি... আব্বাস তাদের ওপর প্রচ- বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তোমরা সবাই এত অশালীন, অভদ্র’, এবং বলেই সে চলে যায়। ইব্রাহিমের চোখেমুখে বিজয়ের হাসি ফুটে ওঠে। সে পুনরায় ছেলেদের ডাকে, ‘একজন একজন করে আসো।’
বাইরে কর্তব্যরত সেচ্ছাসেবকরা ছেলেদের প্যান্ট খুলতে বলল। লাইনের সামনে ছিল আরিফ, যার বয়স তেরো বছর এবং সে অনেকটা বড় হয়ে গেছে। যদিও সাধারণত ছেলেদের নয় বছর পূর্ণ হওয়ার আগে সুন্নাতে খাতনা করানো হয়, কিন্তু তার মা আমিনার কোনো টাকাপয়সা ছিল না। তাই সময় মতো ছেলেকে খাতনা করাতে পারেনি। যাহোক, উপস্থিত সবাই মৃদু হাসছিল, যখন আরিফ পরনের পায়জামা খোলার পর শার্ট খুলছিল। এক যুবক, যে হাসি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না, আরিফের পিঠে হালকাভাবে ধাক্কা দিয়ে সামনের দিকে ঠেলে দেয়।
পাঁচ-ছয়জন স্বেচ্ছাসেবক জোর করে আরিফকে উল্টো করে রাখা পিতলের পাত্রের ওপর বসায়। সে পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে এবং কী ঘটতে যাচ্ছে, তা বলার আগেই একজোড়া শক্ত হাত এসে তার বগলের নিচে পৌঁছে। হাত দু’টি আরিফের উরু চেপে ধরে এবং পা জোড়া ফাঁক করে। সে আতঙ্কে চিৎকার করে এবং তখন আরও দু’জন পিঠ চেপে ধরে। আরিফের হৃৎপি- ধড়ফড় করতে থাকে এবং সে পালাতে চাচ্ছিল। কিন্তু যারা তাকে চেপে ধরেছিল, তারা ছিল আরও চটপটে এবং শক্তিশালী। এমনকী তারা তাকে একবিন্দুও এদিক-ওদিক নড়াচড়া করার সুযোগ দেয়নি। আরিফ সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে এবং চিৎকার করে, ‘ছেড়ে দাও, আমাকে যেতে দাও, আইয়্যু৩... আম্মা... হে আল্লাহ!’ এমন পরিস্থিতি হতে পারে, সেই আশঙ্কায় তিন কিংবা চারজন স্বেচ্ছাসেবক ক্ষেপে যায়, বলল, ‘এই, এভাবে চিৎকার-চেঁচামেচি করিস না, বরং ‘দ্বীন, দ্বীন’ বলতে থাক।’ আরিফ হাঁপাতে হাঁপাতে বারবার বলতে থাকে, ‘দ্বীন... দ্বীন ... আল্লাহ ... আল্লাহ... আম্মা... আইয়্যু...’
এই ঘটনা চলার সময় ইব্রাহিম শান্তভাবে কাগজের মতো পাতলা বাঁশের কঞ্চি আরিফের লিঙ্গে এমন জায়গায় ধরে, যেখানে খাতনা করার পর শুধু সামনের চামড়াটি ঝুলে থাকে। একজন আরিফের মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে তাকিয়ে বলল, ‘বলো, বলো খোকা, বলো ‘দ্বীন’, দ্রুত বলো, তাড়াতাড়ি বলো।’ দ্বীন শব্দের অর্থ ‘বিশ্বাস’ থেকে ‘ধর্ম’ পর্যন্ত যে কোনোটি হতে পারে, কিন্তু দ্বীন শব্দের অর্থ না জেনেই আরিফ শরীরের মস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে ওঠে, ‘দ্বীন! দ্বীন!’ তার জিহ্বা শুকিয়ে আমসি হয়ে যায়, পিঠ বেয়ে ঘাম গড়াতে থাকে, সারা শরীরে উত্তাপের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে, এমনকী ভয়ে তার হাত-পা ঠা-া হয়ে যায়। শেষবারের মতো সে নিজেকে আলগা করার বৃথা চেষ্টা করে।
‘কেন যেতে চাও, খোকা?’ একজন স্বেচ্ছাসেবক আরিফের পা দু’টি চেপে ধরে জিজ্ঞেস করে। ‘আমাকে যেতে দাও, আমি পেচ্ছাব করব,’ সে অনুনয়-বিনয় করে বলল, শুধু ‘এক মিনিটের জন্য’। তারা তাকে আরও শক্ত করে চেপে ধরে। ইব্রাহিম তার পিঠের পেছনে লুকিয়ে রাখা ক্ষুর বের করে এক ঝটকায় আরিফের লিঙ্গের ডগা বরাবর ঢুকিয়ে দেয়। লিঙ্গের সামনের চামড়া সঙ্গে সঙ্গে বাটিতে পড়ে। ক্ষত থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। ইব্রাহিম আলতো করে কাটা লিঙ্গের ওপর কিছু ছাই ছিটিয়ে দেয়, যা রক্তের প্রবাহকে বন্ধ করে। আরিফের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায় এবং তার সারা শরীর ঘামে ভিজে যায়। তার কান্না চলতে থাকে। দু’জন যুবক তাকে অবলীলায় তুলে নিয়ে হল ঘরের এক কোণে মেঝেতে শুইয়ে দেয়। শীতল প্লাস্টার কিছুটা স্বস্তি দেয়, তবুও জ্বালাপোড়া কমেনি...
কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক অন্য একটি ছেলেকে ধরে টেনেহিঁচড়ে ইব্রাহিমের কাছে নিয়ে আসে। আব্বাস আরিফকে একটু পানি দেয় এবং বাতাস করে। কেউ একজন কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘দ্বীন... দ্বীন...’ পাশে মাদুরের ওপর আরেক ছেলেকে শুইয়ে দেয়। আরিফ পেট চেপে যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে।
‘দ্বীন... দ্বীন...’ বিভিন্ন গলায় প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। চারিদিকে সুন্নাতে খাতনা করা ছেলেরা যন্ত্রণায় ছটফট করে। অসহ্য যন্ত্রণা সত্ত্বেও আরিফের চোখ বুজে আসে। তন্দ্রা তাকে কাবু করে ফেলে এবং তারপর হঠাৎ করে সে আবার জেগে ওঠে। কয়েকবার ঘুম আর জাগরণের পর অবশেষে সে গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে যাচ্ছিল। সেই সময় কেউ তাকে মৃদু ঝাঁকুনি দেয়। তখনো তার ব্যথা ছিল। সে চোখ খুলে দেখে আব্বাস সহানুভূতির দৃষ্টি মেলে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ‘আরিফ, তুই কী হাঁটতে পারবি?’ আব্বাস জিজ্ঞেস করে। ‘দেখ, তোর মা এসেছেন।’
আরিফের মা পুরনো বোরখা পরে নিজেকে ঢেকে রেখেছেন। তিনি পুরুষদের সামনে আসতে পারতেন না কিংবা এই অবস্থায় ছেলেকে একা রেখে যেতে পারতেন না। তিনি দরজার অপর দিক থেকে তাকিয়ে দেখলেন। মায়ের রঙ-চটা বোরখা দেখে আরিফের শক্তি বেড়ে যায়। আব্বাসের সাহায্য নিয়ে সে পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়ায় এবং এক পা দুই পা ফেলে মায়ের দিকে হাঁটতে শুরু করে।
লতিফ আহমদ দরজার পাশে চেয়ারে বসেছিলেন। তিনি আরিফের হাতে একটি ব্যাগ তুলে দেন। আরিফ দেখে যে, ব্যাগের মধ্যে গম, দু’টি অর্ধেক নারিকেল, এক প্যাকেট চিনি, প্লাস্টিকে মোড়ানো সামান্য মাখন... এসব দেখে তার মুখে লালা জমা হয়।
একটি ছেলে ঘরে ঢোকার মুহূর্তে থেমে যায়। ছেলেটি কাঁদতে শুরু করে। ছেলেটিকে দেখে আরিফের মনে হলো সে একজন সুপারহিরো এবং তাকে ডাকল, ‘এই... সুবহান, ভয় পাস নে... ‘দ্বীন’- শুধু ‘দ্বীন’ বলবি... তোর কিছুই হবে না।’ আরিফ নিজেকে একজন অভিজ্ঞ ছেলে মনে করে।
আরিফ খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাইরে আসে। তার হাত থেকে ব্যাগটি নিয়ে আমিনা তাকে বারান্দায় বসতে বললেন। সে সাবধানে লুঙ্গি নামিয়ে পা ছড়িয়ে বসে, যেন ঘষা না লাগে। লাইনে দাঁড়িয়ে এক ছেলে জোরে জিজ্ঞেস করল, ‘এই আরিফ... ব্যথা লাগে?’ আরিফ চোখেমুখে ব্যথার কোনো চিহ্ন না ফুটিয়ে বলল, ‘না, মোটেও না। কোনো ব্যথা নেই। একদমই ব্যথা করছে না।’
একজন দাড়িওয়ালা মধ্যবয়সী ভদ্রলোক আরিফের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি আরিফের কথা শুনে বললেন, ‘শাবাশ, বেটা। ধরো, এটা রাখো, আর নিজের খেয়াল করো,’ বলেই তিনি পঞ্চাশ রুপির একটা নোট আরিফকে দিলেন। সেখানে অপেক্ষায় থাকা ছেলেরা হিংসায় আরিফের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘরের ভেতর থেকে চিৎকারের আওয়াজ ভেসে আসে। ‘দ্বীন... দ্বীন... আইয়্যু...আল্লাহ...’ আরেকটি ছেলেকে ঠেলে ভেতরে পাঠানো হয়।
ছেলেরা একজন একজন করে ভেতরে ঢোকে এবং কিছুক্ষণ পরে প্রত্যেকেই লাল লুঙ্গি পরে বেরিয়ে আসে। এই পরিবেশের মাঝে একজন মহিলা এসে উপস্থিত হন। রোগা-পাতলা, চোখ কোটরে ঢুকে গেছে, বলতে গেলে তার শরীরের সঙ্গে কোমর নেই এবং তারপরও তিনি একটি শিশু কোলে নিয়ে এসেছেন। তাঁর রঙচটা ছেঁড়া শাড়ির আড়ালে লুকিয়ে আছে সেলাই করা ব্লাউজ। মহিলা ছয় বা সাত বছরের একটা ছেলেকে হাত ধরে টেনেহিঁচড়ে এনেছেন। ছেলেটি ছুটে পালাতে চাইছিল, কিন্তু তিনি ছেলেটিকে শক্ত করে ধরে রেখেছেন। ছেলেটির চিৎকার হৃদয়বিদারক। মহিলা ছেঁড়া শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথা ঢাকার চেষ্টা করেন, কিন্তু আঁচল আরও খুলে যায়। তিনি খুব ধীরে অস্ফুট গলায় বললেন, ‘ভাইয়া...’ তখন লতিফ আহমদ অন্যদের সঙ্গে কথায় বিভোর ছিলেন এবং একটু পরে মহিলার দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করেন, ‘কিছু বলবেন, মা?’
মহিলার সঙ্গের ছেলেটি ভীষণ জোরে কান্না শুরু করে। ‘আমি ওরও সুন্নাতে খাতনা করাতে চাই, ভাইয়া,’ মহিলা অনুনয়-বিনয়ের সুরে বললেন। ‘না, না, আমি চাই না,’ ছেলেটি চিৎকার করে পালাতে চেষ্টা করে। মহিলা শক্ত করে ছেলের হাত ধরে রাখেন। এই টানাটানির সময় মহিলার মাথা থেকে শাড়ির আঁচল খসে পড়ে। তাঁর কুঁচকে যাওয়া পেট, ঘাড়ের উঁচু হাড়, কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখ এবং সেলাই করা ব্লাউজে লতিফ আহমদের চোখে ধরা পড়ে মর্মান্তিক এক দৃশ্য।
লতিফ আহমদ মাটির দিকে তাকিয়ে ছেলেটিকে ধমকের সুরে বললেন, ‘এই ছেলে, চুপ করে দাঁড়াও। তুমি কী দ্বীনের অংশ হতে চাও না? তুমি সুন্নাতে খাতনা ছাড়া ইসলাম ধর্মে থাকতে পারবে না। তুমি কী তাই চাও?’ কান্নার মধ্যে ছেলেটি সত্য কথাটি বলল, ‘আমার খাতনা করা হয়েছে।’
সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটির মা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন, ‘কিন্তু ওর খাতনা ঠিক মতো করা হয়নি, ভাইয়া... এখন সঠিক ভাবে করা যাবে।’ লতিফ আহমদের মনে সন্দেহ দানা বাঁধে, কিন্তু তিনি নিশ্চিত হতে পারলেন না। কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে ডেকে বললেন, ‘এই, সামি, এ ছেলেকে ধরে পরীক্ষা করো।’ সেখানে চিত্তবিনোদনের আশায় দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি দুষ্ট ছেলে শিশুটিকে চ্যাংদোলা করে ওপরে তোলে এবং তাদের মধ্যে একজন তার হাফ প্যান্ট খুলে ফেলে। ঢিলেঢালা প্যান্টটি খুলতে অসুবিধা হয়নি। দৃশ্যটি দেখার সময় দর্শকরা সবাই হাসিতে ফেটে পড়ে। ‘খাতনা সঠিকভাবে করা হয়েছে।’ ছেলেরা শিশুটিকে ছেড়ে দেয়। এক লোক নির্দয়ভাবে বলল, ‘তোমার স্বামীকেও এনে দাও। চলো, তারও সুন্নাতে খাতনা করা হোক, যাতে তুমি গম এবং নারিকেল পাও।’ আবারও হাসির রোল ওঠে।
যেই শিশুটিকে ছেড়ে দেওয়া হয়, সে দ্রুত তার হাফ প্যান্ট পরে দৌড়ে পালিয়ে যায়। তার মা আবারও শাড়ির ছেঁড়া আঁচল দিয়ে মাথা ঢেকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বের হয়ে যান।
‘থু! এই পৃথিবীতে এত নীচু মনের মানুষ আছে... তারা যে কোন স্তরে নামতে পারে,’ এক লোক ঘৃণায় থুথু ছিটিয়ে বলল। (বাকি অংশ আগামী সংখ্যায়)
টীকা: (ইংরেজি অনুবাদে নেই, তবে বাংলাদেশী পাঠকের সুবিধার্থে দেওয়া হলো)
১ আবাবা: কন্নড় ভাষায় আশ্চর্য কিংবা প্রশংসা সূচক অভিব্যক্তি (যেমন ইংরেজিতে ‘ওয়াও’)।
২ দোডাম্মা: কন্নড় ভাষায় বড় খালা বা বড় চাচী।
৩ আইয়্যু: সম্বোধনটি বিশেষভাবে দক্ষিণ ভারতে বিভিন্ন আবেগ প্রকাশ করতে ব্যবহৃত হয়, যেমন দুঃখ, অবাক হওয়া, ভয় বা আনন্দ।
গল্পসূত্র: ‘লাল লুঙ্গি’ গল্পটি ইংরেজিতে ‘রেড লুঙ্গি’ গল্পের অনুবাদ। ইংরেজিতে গল্পটি বানু মুশতাকের ২০২৫ সালে আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার প্রাপ্ত ছোটগল্প গ্রন্থ ‘হার্ট ল্যাম্প’-এ অন্তর্ভুক্ত। গ্রন্থটি কন্নড় ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন দীপা ভাসতি।