alt

দিনু বিল্লাহ: জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে

তুষার গায়েন

: বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

দিনু বিল্লাহ

এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ যখন একটির ক্ষত না মুছতে না মুছতেই, নতুন নতুন নৃশংসতার অবতারণায় ভারাক্রান্ত মন- তখন নিঃশব্দে বিদায় নিলেন মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় সহযোগী, সঙ্গীতশিল্পী, লেখক দিনু বিল্লাহ, আমাদের আপনজন প্রিয় দিনু ভাই। তাঁর চিরপ্রস্থানের সংবাদ পেয়ে বিমূঢ় আমি যে কিছু লিখব, দেশজুড়ে ঘাতকদের তাণ্ডবে বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে, কলমস্থির করে বসতেও পারছিলাম না। কিন্তু টরোন্টোতে অভিবাসী হয়ে আসার পর যে কয়েকজন মানুষের সান্নিধ্য মূল্যবান স্মৃতি হিসেবে মনে গেঁথে আছে, দৈর্ঘ্য তার যাই হোক না কেন, দিনু ভাই তাঁদের মধ্যে অন্যতম এবং তাঁকে নিয়ে কিছু লেখা আমার অন্তর্তাগিদ।

টরন্টোতে ২০০৫ সালে আসার পর এখানকার বাঙালি সমাজে আমার ওঠাবসা, বিশেষত শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার সাথে জড়িত সমমনাদের সাথে। সেই সূত্রে, দিনু ভাইয়ের সাথে শুরুর দিকটায় দেখা ও আড্ডা হতো (২০০৬-২০০৭), যখন তিনি মাঝে মাঝে টরন্টো আসতেন, যাত্রাপথে দু’ঘণ্টা দূরবর্তী নায়াগ্রা জলপ্রপাতের উপকণ্ঠের শহর থরোল্ড (Thorold) থেকে। ২০০৭ সালে আমেরিকার নিউইয়র্ক সিটি ইউনিভার্সিটিতে আরবান ডিজাইন নিয়ে মাস্টার্স পড়তে যাবার প্রাক্কালে, আমি ভাবলাম একবার নায়াগ্রা জলপ্রপাত ও আশেপাশের এলাকা ঘুরে দেখি আসি। দিনু ভাই আমার পরিকল্পনার কথা শুনে তাঁর বাড়িতে যাবার আমন্ত্রণ জানালেন এবং সেই মতো আমি একদিন গ্রীষ্মের রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে বাসে চেপে বসলাম। বাসস্ট্যান্ডে নেমে দেখি দিনু ভাই তাঁর গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছেন, গ্রীষ্মের উত্তাপ থেকে রক্ষা পাবার জন্য মাথায় বড় হ্যাট। বাসায় গিয়ে দেখা হলো দিনু বিল্লাহর সহধর্মিনী মাহবুবা খানম, কুঞ্জ আপার সাথে- টেবিলে প্রস্তুত গ্রীষ্মের ফলমূল এবং রান্না করা উপাদেয় বিভিন্ন ব্যঞ্জন। আমরা খেতে খেতে অনেক আড্ডা দিলাম যার অধিকাংশ ঘিরে থাকল আজন্মলালিত মাতৃভূমি, তার সন্তাপ ও সঙ্কট নিয়ে। তিনি বললেন ষাটের দশক থেকে বেড়ে ওঠা তাঁর জীবনকাহিনী, যে সময়টাতে বাঙালি তার স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রামে পাকিস্তানি উপনিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করছে- রাজনৈতিক লড়াইয়ের পাশাপাশি গুরুত্ববাহী সাংস্কৃতিক লড়াই। সেই আড্ডায় তিনি বলেছিলেন তাঁর প্রিয় কাকাবাবু অজিত গুহর কথা যার ‘টয় হাউজ’ নামক গৃহে তিনি পিতৃস্নেহে কৈশোর-যৌবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। অজিত গুহ ছিলেন খ্যাতিমান অধ্যাপক, ভাষা সৈনিক ও রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ, বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। পারিবারিক ঘনিষ্ঠতার সূত্রে, দিনু ভাইয়ের মা আমেনা বিল্লাহ ভ্রাতৃজ্ঞানে, অকৃতদার ও অসুস্থ অজিত গুহকে সেবা করার জন্য তাঁর প্রিয় সন্তান দিনু বিল্লাহকে সঁপে দিয়েছিলেন। দিনু ভাই মা-র কথা মনে রেখে, কাকাবাবু অজিত গুহকে তাঁর শেষ দিন পর্যন্ত সেবা করেছেন। এটা হয়ত আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রূপকথার মতো শোনাবে। অজিত গুহর টয় হাউজকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল প্রগতিশীল বাঙালি শিল্পী-সাহিত্যিকদের মিলনমেলা- যাদের সান্নিধ্যে গড়ে ওঠে দিনু ভাইয়ের মনন ও চিন্তা-দর্শন। ছাত্রজীবনে তিনি সম্পৃক্ত হন বাম রাজনীতি এবং পাশাপাশি রবীন্দ্রসঙ্গীত ও গণসঙ্গীত চর্চার সাথে। এসব স্মৃতি নিয়ে দিনু ভাই লিখেছেন অসামান্য গ্রন্থ, ‘টয় হাউস থেকে ১৯৭১ মৃত্যু ছায়াসঙ্গী’ যা প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে। দিনু ভাই তাঁর বাড়ির বেসমেন্টে গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব পড়াশোনা ও সঙ্গীত চর্চার নিভৃত স্থান। সেখানে আড্ডা দিতে দিতে, হারমোনিয়াম বাজিয়ে বেশ কয়েকটি গান গেয়ে শোনালেন। তখন গণসঙ্গীত নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শহীদ আলতাফ মাহমুদের প্রসঙ্গ উঠল যার সুরারোপে একুশের শহিদদের নিয়ে লেখা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গান কালোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। আলতাফ মাহমুদ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সংঘটিত সব আন্দোলন সংগ্রামে একজন বিপ্লবী সাংস্কৃতিক যোদ্ধা, গণসঙ্গীত শিল্পী ও সংগঠক হিসাবে প্রথম সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। এই বরেণ্য মানুষটি ছিলেন তাঁর ভগ্নিপতি, মাতৃসমা বড় বোন সারা আর মাহমুদের জীবনসঙ্গী। দিনু ভাই খুব কাছ থেকে আলতাফ মাহমুদের বৈপ্লবিক শিল্প-সাংস্কৃতিক চেতনাকে প্রত্যক্ষ করেছেন ও সমৃদ্ধ হয়েছেন। ‘ক্র্যাক প্লাটুন’-এর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ সহযোগী হিসেবে, বিশেষত তাদের অস্ত্রের মজুত রক্ষা করা ও সরবরাহ করার কথা জেনে যাবার পর, পাকহানাদার বাহিনী আলতাফ মাহমুদ ও চার ভাইসহ দিনু ভাইকে ধরে নিয়ে যায় এবং নির্মমভাবে নির্যাতন করে- আলতাফ মাহমুদ মারা যান এবং দিনু ভাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই নির্যাতনের কষ্ট বহন করেছেন। আলতাফ মাহমুদের বিপ্লবী জীবন ও তাঁর সময়ের ইতিহাসকে নিয়ে দিনু ভাই লিখেছেন ‘সুরের বরপুত্র আলতাফ মাহমুদ’ নামের বই (২০১৫) যেখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত রচিত ও গীত প্রায় সমস্ত গণসঙ্গীত যা বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য দলিল। সে দিনের আড্ডায় এসেছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি প্রসঙ্গ : বাংলাদেশে সুন্দরবন এলাকায় যেসব মানুষ জীবন-জীবিকার জন্য এই বনের ওপর নির্ভরশীল- জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বনের ভিতর মধু আহরণ, জ্বালানি সংগ্রহ অথবা বনের ভিতর প্রবহমান নদী-খালে মাছ শিকার করতে বাঘের আক্রমণে অঙ্গহানি ঘটেছে, পঙ্গু হয়ে বেঁচে আছে এবং মৃতদের অবলম্বনহীন বিধবা স্ত্রী- তাদের সহযোগিতার জন্য কুঞ্জ আপা-দিনুভাই দম্পতি গড়ে তুলেছেন সাহায্য তহবিল। কানাডায় তাঁদের পরিচিত সহমর্মী মানুষদের দান থেকে তাঁরা ঐ অঞ্চলের আক্রান্ত মানুষদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করেন। কুঞ্জ আপা আমাকে একটা ফটো এলবাম দেখিয়েছিলেন, সেখানে বাঘের আক্রমণে বেঁচে যাওয়া অনেকের বীভৎস মুখ ও অবয়ব দেখে শিউরে উঠেছিলাম। দিনু ভাই ও কুঞ্জ আপা আমাকে পরের দিন সকালে, গাড়িতে নিয়ে ঘুরে দেখালেন থরোল্ড শহর, নায়াগ্রা জলপ্রপাত ও তার আশেপাশের এলাকা। শুধু নায়াগ্রা জলপ্রপাতের অবিস্মরণীয় সৌন্দর্যই নয়, ঐ সমস্ত অঞ্চল নিয়ে আমার একটা ভালো ধারণা হয়ে গেল।

এরপর আমি নিউইয়র্কে চলে গেলাম পড়াশোনা করতে এবং মাস্টার্স শেষ করে টরন্টো ফিরে এসে নিজের কাজ, জীবন ও লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম (২০০৮)। সে সময়ে দিনু ভাই টরন্টো এলে হঠাৎ কখনো দেখা হতো কোনো বন্ধুর বাসার আড্ডায়, তবে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু আমাদের দু’জনের কমন বন্ধু ইকবাল করিম হাসনু ভাইয়ের সাথে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও প্রায় নিয়মিত ফোনালাপের সুবাদে দিনু ভাইয়ের প্রসঙ্গে মাঝে মাঝে আলাপ হতো। ইকবাল ভাই টরন্টো থেকে ‘বাংলা জার্নাল’ নামে একটি উচ্চ মানের দ্বিভাষিক পত্রিকা ২১ বছর ধরে নিয়মিত সম্পাদনা করে আসছেন। সেই পত্রিকায় আমি মাঝে মাঝে কবিতা ও প্রবন্ধ লিখি। সর্বশেষ যে সংখ্যা প্রকাশিত হলো (ডিসেম্বর ২০২৪) সেখানে আমার একটি কবিতা ছিল। পত্রিকার কপি নেয়ার জন্য এ বছরের মার্চের দিকে (যতটা মনে পড়ে) ইকবাল ভাই আমাকে ডাকলেন ড্যানফোর্থের বাঙালি পাড়ার এক রেস্টুরেন্টে। সেখানে অনেক বছর পর দেখা হলো দিনু ভাই, কুঞ্জ আপা এবং শহরের আরো কয়েকজন শিল্প-সাহিত্য ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিবর্গের সাথে। দিনু ভাই সেই আদি-অকৃত্রিম আন্তরিকতার সাথে কথা বললেন, নতুন করে সংযোগ স্থাপিত হলো। এরপর ফেসবুকের মাধ্যমে আমাদের যোগাযোগ শুরু হলো, মেসেজ আদানপ্রদান ও ফোনে কথাবার্তা হতো। বেশিরভাগ আলাপ হতো দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলি ও দুরবস্থা নিয়ে। একটি উদার, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে যিনি মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়েছেন ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামে আজীবন ব্যাপৃত থেকেছেন, তাঁর পক্ষে দেশের অস্তিত্ব বিনাশী শক্তির উত্থান দেখে অবিচলিত থাকা সম্ভব নয়। আলাপ থেকে আলাপান্তরে ফিরে এলো তাঁর কাকাবাবু, টয় হাউস, আলতাফ মাহমুদ এবং নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর কথা যিনি ‘ক্র্যাক প্লাটুন’-এর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ নাট্য নির্দেশক ও চলচ্চিত্রকার হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটে দীর্ঘকাল ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিখ্যাত মঞ্চশিল্পী ও নাট্যজন শিমুল ইউসুফ, দীনু ভাইয়ের সহোদরা ও নাসির উদ্দিন ইউসুফের সহধর্মিনী- তাঁর প্রসঙ্গও উঠে আসত আলাপে। এমন একটি আলোকিত পরিবারের মানুষ তিনি, সারাজীবন মানুষের মুক্তির কথা ভেবে দেশে ও প্রবাসে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে গেছেন। দিনু ভাই একদিন বললেন যে তাঁর তিনটি বই আমাকে পাঠাবেন যার মধ্যে দুটি বইয়ের নাম আমি আগেই উল্লেখ করেছি। তাঁর তৃতীয় বই ‘মিলিত প্রাণের কলরব’-এ (মার্চ ২০২০) বাংলা গণসঙ্গীতের উৎপত্তি, কার্যকারণ ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত নিয়ে আলোচনা করেছেন যেখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, বাঙালির ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসনবিরোধী গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ভিতর দিয়ে বিকশিত বাঙালির সাংস্কৃতিক অভিযাত্রা। প্রতিটি বইয়ের ভিতর আমাকে প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়ে নিজের স্বাক্ষরসহ তাঁর ৩টি বই একদিন রেখে গেলেন টরন্টোবাসি প্রিয় বন্ধু কনক-টোরি দম্পতির বাসায়। বইগুলো হাতে পেয়ে আমি দিনু ভাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম যে সময় নিয়ে পড়ে আলোচনা করব তাঁর সাথে। দিনু ভাই খুশি হলেন এবং তাঁর বাসায় যাবার আমন্ত্রণ জানিয়ে বললেন যে আমি গেলে তিনি নায়াগ্রাসহ আশেপাশের আরো কিছু এলাকা আমাকে ঘুরে দেখাবেন এবং আড্ডা হবে বিভিন্ন বিষয়ে।

সেই দিন আর এলো না। ২৩ আগস্ট ইকবাল ভাইয়ের কাছ থেকে হোয়াটস্যাপে একটি মেসেজ পেলাম যে দিনু ভাই স্ট্রোক করে কানাডার গ্রেটার নায়াগ্রা জেনারেল হাসপাতালে সংকটাপন্ন অবস্থায় আছেন। কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলাম ও ভাবলাম স্ট্রোকের ধকল কাটিয়ে নিশ্চয়ই তিনি ফিরে আসবেন। কিন্তু সবাইকে আর কোনো সুযোগ না দিয়ে তিনি চিরপ্রস্থান করলেন আগস্ট ২৬, ২০২৫, যখন তাঁর দেহ থেকে ডাক্তাররা কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের নলগুলো খুলে ফেললেন। কিন্তু তিনি কি সত্যিই প্রস্থান করলেন? নাহ, তিনি প্রস্থান করেননি, মৃত্যুর আগেই তিনি মরণোত্তর সর্বাঙ্গ দান করে গিয়েছেন। হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাঁর মৃত্যু ঘোষণা করার আগে, যখন কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে তাঁর হৃৎপিণ্ড সচল ছিল, তখন থেকেই বিভিন্ন হাসপাতালে নির্বাচিত হয় তাঁর চার প্রধান অঙ্গ- ফুসফুস (lunge) যকৃৎ (liver) এবং দুটি বৃক্কের (kidneys) গ্রহীতারা। এক অথবা একাধিক অন্ধ ব্যক্তি পাবেন তাঁর চোখ, অধিকন্তু অন্টারিও প্রদেশের ৭৯ জন রোগী তাঁর দেহের বিভিন্ন অংশ থেকে আহৃত টিস্যু থেকে উপকৃত হবেন বিভিন্নভাবে। মরে গিয়েও বেঁচে থাকার এই প্রেরণা তিনি ছড়িয়ে দিয়ে গেলেন অনন্তলোকে। নির্লোভ এই মানুষটি কোনো সম্পদ জমা করেননি নিজের জন্য, পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরাধিকার হিসেবে জমির যে-অংশ পেয়েছিলেন সেটাও দান করে গেছেন বড় বোন সারা আরা মাহমুদ, ঝিনু আপাকে। ইকবাল ভাই বলেছেন, দিনু ভাইয়ের প্রিয় পোষা কুকুর আইসিউতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর পাশেই ছিল। এটি ছিল ছিল অভিনব ব্যতিক্রম- হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনো প্রাণিকে রোগীর কক্ষে রাখার অনুমোদন সহজে দেয় না।

ব্যক্তিগতভাবে আমার শোক একটু ভারি- তাঁর যতটা সান্নিধ্য আমার পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, অন্ততপক্ষে শেষপর্বে যখন নতুন করে সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল, সেটা আর হলো না। আমি ততটা বুঝতে পারিনি যতটা তিনি আমাকে পছন্দ করতেন এবং সেটা যখন বোঝার অবকাশ হলো, তার আগেই তিনি কোনো সুযোগ না দিয়ে চলে গেলেন। তাঁর সাথে কত বিষয় নিয়ে কথা বলার ছিল, প্রশ্ন করে জানার কথা ছিল বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বহু সন্ধিক্ষণের যার অনেক কিছু হয়ত তাঁর বইগুলোতে আছে; কিন্তু একান্ত আলাপচারিতার জীবন্ত মুহূর্তগুলোকে তো আর পাওয়া যাবে না কখনো।

দিনু ভাই, তাঁর মৃত্যুশয্যায় রবীন্দ্রনাথের যে-গান নিশ্চেতনায় শুনে বিদায় নিয়েছেন বলে শুনেছি, মনে মনে গাইছি সেই গান, ‘জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে/ বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে...’

জেলার সিরিজ কবিতা

ছবি

লাল লুঙ্গি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

নির্মলেন্দু গুণের রাজনৈতিক বলয় অতিক্রমের ক্ষমতা

ছবি

কেরাসিন বাত্তি ও লালচুলা মেয়েটি

ছবি

তাঁর সমকালীনদের চোখে

ছবি

নিজের মতো করেই সঠিক পথটি বেছে নিতে হবে

ছবি

সুকান্ত ভট্টাচার্য: বহুচর্চিত, বহুপঠিত এক অনন্য কবি

ছবি

চিত্রাঙ্গদা: দ্বৈত সত্তার শিল্পস্মারক

ছবি

খালেদ হামিদীর দৌত্যে ওরহান পামুক

সাময়িকী কবিতা

ছবি

মেঘলা আকাশ বৃষ্টি

ছবি

স্মৃতি ভদ্র

ছবি

হৃদয়রেখা

ছবি

সুরমা বুজি অথবা কাচপোকা

ছবি

শ্রাবণের জোছনায় হেসেছিল নার্গিস

ছবি

যোগাযোগ

ছবি

বাংলাদেশের স্বাপ্নিক কবি নজরুল

ছবি

ইলিয়াসের আশ্চর্য নিরীক্ষা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

মাটি ও মানুষের কথক

ছবি

অনাবিল প্রাচুর্যে ঋদ্ধ নজরুল প্রতিভা

ছবি

নজরুল: চির-বিস্ময়

ছবি

জীবনের সাথে সংযোগ ঘটল কই

পোয়েমস দ্যাট কেম টু মি

ছবি

লালন ও রবীন্দ্রনাথ অন্তর্জগতের আলাপন

ছবি

বংশধারা

ছবি

অনন্ত নক্ষত্র বিথিতে এক নির্বাসিত কবির যাত্রা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

তিন প্রহরের শকুন

ছবি

ইলিয়াসের আশ্চর্য নিরীক্ষা

ছবি

যতীন সরকার : সাম্যবাদের চেতনায় একজীবন

ছবি

‘প্রান্তিক মানুষের হারানোর কিছু নেই’

ছবি

ভাঙা ছাদ

ছবি

চন্দ্রাবতী : মধ্যযুগের প্রথম মহিলা কবি

ছবি

আধুনিক-উত্তর সময়ের নির্মিতি

tab

literature » samoeky

দিনু বিল্লাহ: জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে

তুষার গায়েন

দিনু বিল্লাহ

বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ যখন একটির ক্ষত না মুছতে না মুছতেই, নতুন নতুন নৃশংসতার অবতারণায় ভারাক্রান্ত মন- তখন নিঃশব্দে বিদায় নিলেন মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় সহযোগী, সঙ্গীতশিল্পী, লেখক দিনু বিল্লাহ, আমাদের আপনজন প্রিয় দিনু ভাই। তাঁর চিরপ্রস্থানের সংবাদ পেয়ে বিমূঢ় আমি যে কিছু লিখব, দেশজুড়ে ঘাতকদের তাণ্ডবে বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে, কলমস্থির করে বসতেও পারছিলাম না। কিন্তু টরোন্টোতে অভিবাসী হয়ে আসার পর যে কয়েকজন মানুষের সান্নিধ্য মূল্যবান স্মৃতি হিসেবে মনে গেঁথে আছে, দৈর্ঘ্য তার যাই হোক না কেন, দিনু ভাই তাঁদের মধ্যে অন্যতম এবং তাঁকে নিয়ে কিছু লেখা আমার অন্তর্তাগিদ।

টরন্টোতে ২০০৫ সালে আসার পর এখানকার বাঙালি সমাজে আমার ওঠাবসা, বিশেষত শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার সাথে জড়িত সমমনাদের সাথে। সেই সূত্রে, দিনু ভাইয়ের সাথে শুরুর দিকটায় দেখা ও আড্ডা হতো (২০০৬-২০০৭), যখন তিনি মাঝে মাঝে টরন্টো আসতেন, যাত্রাপথে দু’ঘণ্টা দূরবর্তী নায়াগ্রা জলপ্রপাতের উপকণ্ঠের শহর থরোল্ড (Thorold) থেকে। ২০০৭ সালে আমেরিকার নিউইয়র্ক সিটি ইউনিভার্সিটিতে আরবান ডিজাইন নিয়ে মাস্টার্স পড়তে যাবার প্রাক্কালে, আমি ভাবলাম একবার নায়াগ্রা জলপ্রপাত ও আশেপাশের এলাকা ঘুরে দেখি আসি। দিনু ভাই আমার পরিকল্পনার কথা শুনে তাঁর বাড়িতে যাবার আমন্ত্রণ জানালেন এবং সেই মতো আমি একদিন গ্রীষ্মের রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে বাসে চেপে বসলাম। বাসস্ট্যান্ডে নেমে দেখি দিনু ভাই তাঁর গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছেন, গ্রীষ্মের উত্তাপ থেকে রক্ষা পাবার জন্য মাথায় বড় হ্যাট। বাসায় গিয়ে দেখা হলো দিনু বিল্লাহর সহধর্মিনী মাহবুবা খানম, কুঞ্জ আপার সাথে- টেবিলে প্রস্তুত গ্রীষ্মের ফলমূল এবং রান্না করা উপাদেয় বিভিন্ন ব্যঞ্জন। আমরা খেতে খেতে অনেক আড্ডা দিলাম যার অধিকাংশ ঘিরে থাকল আজন্মলালিত মাতৃভূমি, তার সন্তাপ ও সঙ্কট নিয়ে। তিনি বললেন ষাটের দশক থেকে বেড়ে ওঠা তাঁর জীবনকাহিনী, যে সময়টাতে বাঙালি তার স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রামে পাকিস্তানি উপনিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করছে- রাজনৈতিক লড়াইয়ের পাশাপাশি গুরুত্ববাহী সাংস্কৃতিক লড়াই। সেই আড্ডায় তিনি বলেছিলেন তাঁর প্রিয় কাকাবাবু অজিত গুহর কথা যার ‘টয় হাউজ’ নামক গৃহে তিনি পিতৃস্নেহে কৈশোর-যৌবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। অজিত গুহ ছিলেন খ্যাতিমান অধ্যাপক, ভাষা সৈনিক ও রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ, বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। পারিবারিক ঘনিষ্ঠতার সূত্রে, দিনু ভাইয়ের মা আমেনা বিল্লাহ ভ্রাতৃজ্ঞানে, অকৃতদার ও অসুস্থ অজিত গুহকে সেবা করার জন্য তাঁর প্রিয় সন্তান দিনু বিল্লাহকে সঁপে দিয়েছিলেন। দিনু ভাই মা-র কথা মনে রেখে, কাকাবাবু অজিত গুহকে তাঁর শেষ দিন পর্যন্ত সেবা করেছেন। এটা হয়ত আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রূপকথার মতো শোনাবে। অজিত গুহর টয় হাউজকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল প্রগতিশীল বাঙালি শিল্পী-সাহিত্যিকদের মিলনমেলা- যাদের সান্নিধ্যে গড়ে ওঠে দিনু ভাইয়ের মনন ও চিন্তা-দর্শন। ছাত্রজীবনে তিনি সম্পৃক্ত হন বাম রাজনীতি এবং পাশাপাশি রবীন্দ্রসঙ্গীত ও গণসঙ্গীত চর্চার সাথে। এসব স্মৃতি নিয়ে দিনু ভাই লিখেছেন অসামান্য গ্রন্থ, ‘টয় হাউস থেকে ১৯৭১ মৃত্যু ছায়াসঙ্গী’ যা প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে। দিনু ভাই তাঁর বাড়ির বেসমেন্টে গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব পড়াশোনা ও সঙ্গীত চর্চার নিভৃত স্থান। সেখানে আড্ডা দিতে দিতে, হারমোনিয়াম বাজিয়ে বেশ কয়েকটি গান গেয়ে শোনালেন। তখন গণসঙ্গীত নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শহীদ আলতাফ মাহমুদের প্রসঙ্গ উঠল যার সুরারোপে একুশের শহিদদের নিয়ে লেখা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গান কালোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। আলতাফ মাহমুদ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সংঘটিত সব আন্দোলন সংগ্রামে একজন বিপ্লবী সাংস্কৃতিক যোদ্ধা, গণসঙ্গীত শিল্পী ও সংগঠক হিসাবে প্রথম সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। এই বরেণ্য মানুষটি ছিলেন তাঁর ভগ্নিপতি, মাতৃসমা বড় বোন সারা আর মাহমুদের জীবনসঙ্গী। দিনু ভাই খুব কাছ থেকে আলতাফ মাহমুদের বৈপ্লবিক শিল্প-সাংস্কৃতিক চেতনাকে প্রত্যক্ষ করেছেন ও সমৃদ্ধ হয়েছেন। ‘ক্র্যাক প্লাটুন’-এর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ সহযোগী হিসেবে, বিশেষত তাদের অস্ত্রের মজুত রক্ষা করা ও সরবরাহ করার কথা জেনে যাবার পর, পাকহানাদার বাহিনী আলতাফ মাহমুদ ও চার ভাইসহ দিনু ভাইকে ধরে নিয়ে যায় এবং নির্মমভাবে নির্যাতন করে- আলতাফ মাহমুদ মারা যান এবং দিনু ভাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই নির্যাতনের কষ্ট বহন করেছেন। আলতাফ মাহমুদের বিপ্লবী জীবন ও তাঁর সময়ের ইতিহাসকে নিয়ে দিনু ভাই লিখেছেন ‘সুরের বরপুত্র আলতাফ মাহমুদ’ নামের বই (২০১৫) যেখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত রচিত ও গীত প্রায় সমস্ত গণসঙ্গীত যা বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য দলিল। সে দিনের আড্ডায় এসেছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি প্রসঙ্গ : বাংলাদেশে সুন্দরবন এলাকায় যেসব মানুষ জীবন-জীবিকার জন্য এই বনের ওপর নির্ভরশীল- জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বনের ভিতর মধু আহরণ, জ্বালানি সংগ্রহ অথবা বনের ভিতর প্রবহমান নদী-খালে মাছ শিকার করতে বাঘের আক্রমণে অঙ্গহানি ঘটেছে, পঙ্গু হয়ে বেঁচে আছে এবং মৃতদের অবলম্বনহীন বিধবা স্ত্রী- তাদের সহযোগিতার জন্য কুঞ্জ আপা-দিনুভাই দম্পতি গড়ে তুলেছেন সাহায্য তহবিল। কানাডায় তাঁদের পরিচিত সহমর্মী মানুষদের দান থেকে তাঁরা ঐ অঞ্চলের আক্রান্ত মানুষদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করেন। কুঞ্জ আপা আমাকে একটা ফটো এলবাম দেখিয়েছিলেন, সেখানে বাঘের আক্রমণে বেঁচে যাওয়া অনেকের বীভৎস মুখ ও অবয়ব দেখে শিউরে উঠেছিলাম। দিনু ভাই ও কুঞ্জ আপা আমাকে পরের দিন সকালে, গাড়িতে নিয়ে ঘুরে দেখালেন থরোল্ড শহর, নায়াগ্রা জলপ্রপাত ও তার আশেপাশের এলাকা। শুধু নায়াগ্রা জলপ্রপাতের অবিস্মরণীয় সৌন্দর্যই নয়, ঐ সমস্ত অঞ্চল নিয়ে আমার একটা ভালো ধারণা হয়ে গেল।

এরপর আমি নিউইয়র্কে চলে গেলাম পড়াশোনা করতে এবং মাস্টার্স শেষ করে টরন্টো ফিরে এসে নিজের কাজ, জীবন ও লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম (২০০৮)। সে সময়ে দিনু ভাই টরন্টো এলে হঠাৎ কখনো দেখা হতো কোনো বন্ধুর বাসার আড্ডায়, তবে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু আমাদের দু’জনের কমন বন্ধু ইকবাল করিম হাসনু ভাইয়ের সাথে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও প্রায় নিয়মিত ফোনালাপের সুবাদে দিনু ভাইয়ের প্রসঙ্গে মাঝে মাঝে আলাপ হতো। ইকবাল ভাই টরন্টো থেকে ‘বাংলা জার্নাল’ নামে একটি উচ্চ মানের দ্বিভাষিক পত্রিকা ২১ বছর ধরে নিয়মিত সম্পাদনা করে আসছেন। সেই পত্রিকায় আমি মাঝে মাঝে কবিতা ও প্রবন্ধ লিখি। সর্বশেষ যে সংখ্যা প্রকাশিত হলো (ডিসেম্বর ২০২৪) সেখানে আমার একটি কবিতা ছিল। পত্রিকার কপি নেয়ার জন্য এ বছরের মার্চের দিকে (যতটা মনে পড়ে) ইকবাল ভাই আমাকে ডাকলেন ড্যানফোর্থের বাঙালি পাড়ার এক রেস্টুরেন্টে। সেখানে অনেক বছর পর দেখা হলো দিনু ভাই, কুঞ্জ আপা এবং শহরের আরো কয়েকজন শিল্প-সাহিত্য ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিবর্গের সাথে। দিনু ভাই সেই আদি-অকৃত্রিম আন্তরিকতার সাথে কথা বললেন, নতুন করে সংযোগ স্থাপিত হলো। এরপর ফেসবুকের মাধ্যমে আমাদের যোগাযোগ শুরু হলো, মেসেজ আদানপ্রদান ও ফোনে কথাবার্তা হতো। বেশিরভাগ আলাপ হতো দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলি ও দুরবস্থা নিয়ে। একটি উদার, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে যিনি মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়েছেন ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামে আজীবন ব্যাপৃত থেকেছেন, তাঁর পক্ষে দেশের অস্তিত্ব বিনাশী শক্তির উত্থান দেখে অবিচলিত থাকা সম্ভব নয়। আলাপ থেকে আলাপান্তরে ফিরে এলো তাঁর কাকাবাবু, টয় হাউস, আলতাফ মাহমুদ এবং নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর কথা যিনি ‘ক্র্যাক প্লাটুন’-এর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ নাট্য নির্দেশক ও চলচ্চিত্রকার হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটে দীর্ঘকাল ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিখ্যাত মঞ্চশিল্পী ও নাট্যজন শিমুল ইউসুফ, দীনু ভাইয়ের সহোদরা ও নাসির উদ্দিন ইউসুফের সহধর্মিনী- তাঁর প্রসঙ্গও উঠে আসত আলাপে। এমন একটি আলোকিত পরিবারের মানুষ তিনি, সারাজীবন মানুষের মুক্তির কথা ভেবে দেশে ও প্রবাসে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে গেছেন। দিনু ভাই একদিন বললেন যে তাঁর তিনটি বই আমাকে পাঠাবেন যার মধ্যে দুটি বইয়ের নাম আমি আগেই উল্লেখ করেছি। তাঁর তৃতীয় বই ‘মিলিত প্রাণের কলরব’-এ (মার্চ ২০২০) বাংলা গণসঙ্গীতের উৎপত্তি, কার্যকারণ ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত নিয়ে আলোচনা করেছেন যেখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, বাঙালির ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসনবিরোধী গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ভিতর দিয়ে বিকশিত বাঙালির সাংস্কৃতিক অভিযাত্রা। প্রতিটি বইয়ের ভিতর আমাকে প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়ে নিজের স্বাক্ষরসহ তাঁর ৩টি বই একদিন রেখে গেলেন টরন্টোবাসি প্রিয় বন্ধু কনক-টোরি দম্পতির বাসায়। বইগুলো হাতে পেয়ে আমি দিনু ভাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম যে সময় নিয়ে পড়ে আলোচনা করব তাঁর সাথে। দিনু ভাই খুশি হলেন এবং তাঁর বাসায় যাবার আমন্ত্রণ জানিয়ে বললেন যে আমি গেলে তিনি নায়াগ্রাসহ আশেপাশের আরো কিছু এলাকা আমাকে ঘুরে দেখাবেন এবং আড্ডা হবে বিভিন্ন বিষয়ে।

সেই দিন আর এলো না। ২৩ আগস্ট ইকবাল ভাইয়ের কাছ থেকে হোয়াটস্যাপে একটি মেসেজ পেলাম যে দিনু ভাই স্ট্রোক করে কানাডার গ্রেটার নায়াগ্রা জেনারেল হাসপাতালে সংকটাপন্ন অবস্থায় আছেন। কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলাম ও ভাবলাম স্ট্রোকের ধকল কাটিয়ে নিশ্চয়ই তিনি ফিরে আসবেন। কিন্তু সবাইকে আর কোনো সুযোগ না দিয়ে তিনি চিরপ্রস্থান করলেন আগস্ট ২৬, ২০২৫, যখন তাঁর দেহ থেকে ডাক্তাররা কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের নলগুলো খুলে ফেললেন। কিন্তু তিনি কি সত্যিই প্রস্থান করলেন? নাহ, তিনি প্রস্থান করেননি, মৃত্যুর আগেই তিনি মরণোত্তর সর্বাঙ্গ দান করে গিয়েছেন। হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাঁর মৃত্যু ঘোষণা করার আগে, যখন কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে তাঁর হৃৎপিণ্ড সচল ছিল, তখন থেকেই বিভিন্ন হাসপাতালে নির্বাচিত হয় তাঁর চার প্রধান অঙ্গ- ফুসফুস (lunge) যকৃৎ (liver) এবং দুটি বৃক্কের (kidneys) গ্রহীতারা। এক অথবা একাধিক অন্ধ ব্যক্তি পাবেন তাঁর চোখ, অধিকন্তু অন্টারিও প্রদেশের ৭৯ জন রোগী তাঁর দেহের বিভিন্ন অংশ থেকে আহৃত টিস্যু থেকে উপকৃত হবেন বিভিন্নভাবে। মরে গিয়েও বেঁচে থাকার এই প্রেরণা তিনি ছড়িয়ে দিয়ে গেলেন অনন্তলোকে। নির্লোভ এই মানুষটি কোনো সম্পদ জমা করেননি নিজের জন্য, পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরাধিকার হিসেবে জমির যে-অংশ পেয়েছিলেন সেটাও দান করে গেছেন বড় বোন সারা আরা মাহমুদ, ঝিনু আপাকে। ইকবাল ভাই বলেছেন, দিনু ভাইয়ের প্রিয় পোষা কুকুর আইসিউতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর পাশেই ছিল। এটি ছিল ছিল অভিনব ব্যতিক্রম- হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনো প্রাণিকে রোগীর কক্ষে রাখার অনুমোদন সহজে দেয় না।

ব্যক্তিগতভাবে আমার শোক একটু ভারি- তাঁর যতটা সান্নিধ্য আমার পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, অন্ততপক্ষে শেষপর্বে যখন নতুন করে সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল, সেটা আর হলো না। আমি ততটা বুঝতে পারিনি যতটা তিনি আমাকে পছন্দ করতেন এবং সেটা যখন বোঝার অবকাশ হলো, তার আগেই তিনি কোনো সুযোগ না দিয়ে চলে গেলেন। তাঁর সাথে কত বিষয় নিয়ে কথা বলার ছিল, প্রশ্ন করে জানার কথা ছিল বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বহু সন্ধিক্ষণের যার অনেক কিছু হয়ত তাঁর বইগুলোতে আছে; কিন্তু একান্ত আলাপচারিতার জীবন্ত মুহূর্তগুলোকে তো আর পাওয়া যাবে না কখনো।

দিনু ভাই, তাঁর মৃত্যুশয্যায় রবীন্দ্রনাথের যে-গান নিশ্চেতনায় শুনে বিদায় নিয়েছেন বলে শুনেছি, মনে মনে গাইছি সেই গান, ‘জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে/ বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে...’

back to top