শরৎ
ফারুক মাহমুদ
(উৎস: কালিদাস)
শরৎ-সুন্দরী আজ পরে আছে গাঢ় সাদা শাড়ি
কাশের আঁচল ওড়ে, হাসি যেন শিউলি-সকাল
নতুন জলের মতো চঞ্চলতা কটি মেঘলায়
নির্জন মেঘের আলো ঝলোমলো ছায়া ধরে আছে
আকাশের গোমরা মুখ ঢেকে যায় নীল চাঁদোয়ায়
যথেষ্ট রঙিন রাত্রি। চাঁদ যেন স্তনের উচ্ছ্বাস
মোমের মুখের মতো গলে পড়ে জ্যোৎস্নার ফোঁটা
তারাঠোঁটে চাপাহাসি। রমণীরা আরো রমণীয়
আনন্দ শ্রেষ্ঠত্ব চায়। নির্বাসন রতিপ্রসমনে
ভাসুক হৃদয়তরী প্রেমময় আলিঙ্গন¯্রােতে
শরৎ মানেই আজ সুদূর শৈশব
নাসির আহমেদ
নগরীর পথে পথে শরৎ সন্ধান করি-
কোথায় শরৎ!
শরতের কাশফুল আর শিল্পকর্মতুল্য
শুভ্র মেঘমালা
স্মৃতির বিষয় দূর শৈশব-কৈশোর!
কোথাও দেখি না সেই দিগন্ত বিস্তৃত কাশবন
সবুজে শাদায় মিশে আশ্চর্য সুন্দর
যেন এক ল্যান্ডস্কেপ!
এই জটিল নগরে যার কোনো চিহ্ন নেই।
শরৎ-গোধূলি আর ভোরের কুয়াশা
হরিৎ ঘাসের বুকে এঁকেছিল যত চিত্রকলা
এখানে কোথাও নেই তার চিহ্নকণা
শারদীয় দুর্গোৎসব ঢাকের শব্দও
চাপা পড়ে গেছে যন্ত্রসভ্যতার নিচে।
ট্রাফিক জ্যামের তীব্র শব্দদূষণের কাছে
জিম্মি হয়ে গেছে সেই শরৎ-সৌন্দর্য!
কোথায় শরৎ পাবো এই ইটকাঠের জঙ্গলে?
শরৎ মানেই আজ সুদূর শৈশব আর সবুজ স্বদেশ।
নদনদী ভাইবোন : ৯
জাহিদ হায়দার
অদূরে শ্মশান জ¦লছে
পুড়ছে না মৃত্যু
শবযাত্রীদের মুখশ্রী আলোকিত
বিসর্জিত নাভি ভেসে গেছে
কোনো এক মাছ জন্মচিহ্নে পেয়েছিল স্বাদ
পূজার ফুল ভাসায় তরুণী
অদূরে
অজু করে নিবিড় ধার্মিক
গির্জার কার্নিশে পারাবত
প্যাগোডায় নির্বাণ খুঁজছে ক’জন
দুধকুমার প্রফুল্ল চরণে হাঁটে
এসো বিসর্জন
বলো প্রার্থনা
বলো অর্জন
নদী-ধর্ম নিরপেক্ষ ধাবান
শরৎকালের এক সন্ধ্যায় জাহানারা গার্ডেনে
আবদুর রাজ্জাক
না না আমার অসীম সুখেও তোমার চোখে জল আসে দেখি:
এসময় আমার ভেতরে তোমার নামে গেয়ে ওঠে কেউ,
অল্প অল্প করে কেউ যেন ভেসে যায়, কেউ যেন ভাসিয়ে নেয়...
আমাদের ভেতরের একটি গোপন নদী, আর তোমার ভেতরের
একটি চমৎকার গল্প যা তুমি কখনই বলো নি।
আমাদের উঠোনে একটি চাঁদ, শারদীয় চাঁদ নির্ঝর, সেই চাঁদের-
অন্ধকারে একদিনও ফেরা হয়ে ওঠে না,
তোমার নিজের কাছেও তুমি- ফিরে যেতে পারো না।
তুমি একটি অপূর্ব জুনি, আমার হাতের ভিতরে ছড়িয়ে যাচ্ছো এক
অসম্ভব আলোময় জল। আমি কৃতজ্ঞ, দারুণ।
হিসাব মেলানোর আগেই তোমার আঙিনা থেকে আমাকে
আগুনের ভেলায় ভাসিয়ে দিয়ে তোমার অগ্নিযাত্রা সফল করেছো।
এরচে’ কী আর ভালো হতে পারতো! সে শুধু তুমিই জানো আর-
আমিই জানি।
স্বপ্নঘোর
মঈনউদ্দিন মুনশী
বিকেলের স্বপ্নময় নীরবতায়
এক সোনালি কাঁথা মেলে আছে মেঘে ও সমুদ্রে।
স্বর্গ থেকে নেমে আসা কাকলিরত পাখি
ছড়িয়ে দেয় মৌলিক শুভেচ্ছা।
বাতাসে ভরে আছে উজ্জ্বল সবুজ পাতা। যেগুলো নিচে পড়েছে,
সেগুলো উঠে দাঁড়াবে আবার আবশ্যক স্থিরতার শ্বাস নিয়ে।
প্রতিটি ব্যাকুল পাতা কম্পমান বৃক্ষ থেকে দেখায় স্বর্গসুখ,
বলে, এখন ফুল ফোটার সময়।
রাতের বিবর্ণ আঁধার অভ্যর্থনা করে
নিয়ে আসে আনন্দময় দিন।
প্রফুল্ল পাখির ঝাঁক আলোকিত হয়ে ওঠে-
ফুলের স্ফীত হলুদ রেণু ভেসে যায় দূরে।
শহরতের একগুচ্ছ আনন্দ বেদনা
হাসান কল্লোল
আহত পরাজয়ে ঝুলছে মেঘের ধূসর জামা
আরে বৈষ্ণব তোর কথার আশ্বাসসমূহ থামা!
অনেক ধৈর্যে অপেক্ষার তাপ রেখেছিলাম এই হাতে
তুমি চলে গেলে ফেলে কিছু মায়া বিশাল স্বর্ণ রথে!
আমাদের চরে ধীরে ধীরে মরে শরতের কাশগুলো;
এই হেমন্তে শিশিরের সাথে তবু হাঁটার চিন্তা হলো
হলেই তো হবে না আমার উঠোনে এখনো প্লাবন জল
দূরে থাকা ঐ মেঘরাজদের সাথে
আগে কিছু কথা বল!
বলো হে শান্তি এবার শরতে পরবে কাশের শাড়ি?
বেদনা-সমূহ আলোময় হাতে যাবে কি চাঁদের বাড়ি!
নীল কুয়াশায় এ হৃদয় সেতারে বাজছে দীর্ঘশ্বাস
বাইরে অজ¯্র বৃষ্টি-বালিকারা
বিলাচ্ছে আশ্বাস!
চলো তো আমার শারদীয়া নদী
হেঁটে আসি পথ কিছু-
জীবনটা আসলে জীবনের সমান,
নয় বেশি উঁচু-নিচু!
উঠে মগডালে ভাবছি আমরা
নিজেকেই বড়সড়
ক্ষমা করো শরৎহীন অপরাধগুলো
আমাকেও ক্ষমা করো!!
শরতের উপলব্ধি
হাইকেল হাশমী
শরতের বাতাসের গতি ক্রমাগত দুর্বল হয়ে আসছে
যেন কোনো পুরাতন বইয়ের পৃষ্ঠা,
বারংবার উল্টানোর কারণে
তার প্রান্তগুলো স্মৃতির ভারে হয়ে গেছে ভঙ্গুর।
গাছের পাতাগুলো
তাদের শাখা-প্রশাখার মায়া ছিন্ন করে
বেদনায় নয়-
বরং এক নিঃশব্দ উচ্ছ্বাসে,
বিদায়ের আগে করছে শেষ নৃত্য।
শরতের আকাশ,
পুড়ে না সে গ্রীষ্মের অগ্নিশিখার তাপে,
এখন সে বিশ্রাম নিচ্ছে
সোনালি আভার মেঘমালার চাদর গায়ে দিয়ে,
সে একটি প্রাচীন কোমল প্রার্থনায় মগ্ন।
আর কোথাও এই নিস্তব্ধতার মাঝে
একটি বৃক্ষ শিখে নিয়েছে,
সম্পর্ক ছিন্ন করাও
নতুন করে প্রস্ফুটিত হওয়ার মন্ত্র।
এমন ছিল না শরৎ
চয়ন শায়েরী
গল্পের ভেতরে গল্প
কীভাবে বলতে হয়- হাত নিশপিশ করে,
গল্পের কৌশল শেখবার জন্য;
প্রমাণিত নয়- কীভাবে এতটা দূরে চলে এল বর্ষা- ঘোর লেগে থাকে- দূরযায়ী মেঘের উড়াল দেখে কালিদাসও বিরহের ব্র্যান্ড-অ্যাম্বাস্যাডর বানাতে চেয়েছে মেঘকে- মেঘদূত দূতালি করেছে- কূটসব চাল চেলে ভ-ুল করেছে- দূত ভালো না- নিজের গর্জন নিজে দেয় মানুষেরা- গল্পের অমনিবাস বিক্রি হয়- মিছা কথা কেনে মানুষেরা- খুঁজে ফেরে মানুষীর গল্প- অথচ শরৎ নাকানিচোবানি খায় জল-ঝড়ে- কত কথা মনে পড়ে- প্রলম্বিত বর্ষা তখনও আসে নাই- ছিল আশেপাশে কাশে নদীতীর ভরপুর- এমন ছিল না বর্ষা- এমন ছিল না শরৎ- বর্ষার ছোঁয়ায় ভিজে ওঠে শরতের হৃদয়- যেন শরৎসমগ্র পাঠের সময়, এখন বর্ষামঙ্গল পাঠ করছি বলে ভুল হয়- শরৎ নয় সে, ওকে বর্ষা বলে মনে হয়।
শরতের ছেলেরা মেয়েরা
মোহাম্মদ হোসাইন
তোমরা যখন হাত গুটিয়ে নেবে
আমরা তখন আমাদের সাঁড়াশি হাত বের করে আনব
বুঝে গেছি তোমার তোমাদের ফেরেব্বাজি
মানবতার ভ-ামি ছাড়ো হে সুশীল!
ফিলিস্তিন গাজা খেতে খেতে সারা পৃথিবী খেয়ে নেবে
আর তোমরা ফেরি করে বেড়াবে পৃথিবীময় নেংটো আধুলি-
সে আমরা ধরে ফেলেছি!
কবিতা শানান দিয়ে রেখেছি
যত রক্ত ঝরাবে কবিতা তত নিকটবর্তী তত সন্নিষ্ট নিশানা।
একদিন তোমাদের বারুদ শেষ হয়ে গেলে
আবার পুষ্পিত হবে কবিতা ও কারুকাজ পৃথিবীময়...
কার্তুজ ভরতি ফুল আর শব্দের তারানা নিয়ে
প্রস্তুত হচ্ছি- কোথায় পালাবে!
শরতের মেঘ আর কাশফুলের ছেলেরা মেয়েরা ওই আসছে...
শরৎবেদনা
মুজিব ইরম
এ কোন বেঘোরে তুমি মজে আছো...
কেনো তুমি ডাকছো না
কেনো তুমি বলছো না
ওঠো হে ইরম
উঠেছে ঢোলের ধ্বনি শরৎ বেলায়...
তুমিও ঘুমিয়েছো
অকালের ঘুম...
আমিও তো হারিয়েছি দেশখেশ
কাশফুল
সুগন্ধি বকুল...
ভাঙ্গিলে অবেলা ঘুম ধুনুচি নাচিও
খাসিয়া পানের খিলি আমারে যাচিও...
শরত শোভা
প্রণব মজুমদার
নীল আকাশের গায় সাদা মেঘ ভাসে
শরতে আনন্দ মন, কাশবন হাসে!
দেখ দূর নীলিমায় পাখি উড়ে যায়;
হিম হিম সমীরণ, মন দোলা খায়।
বিকেলের হলুদে রোদ, হাসছে আলো
নদী পাড়ে বসে সময়, কাটছে ভালো!
নববধূ যায় পাল তোলা নৌকায়
তারও মন উচ্ছল, মিটমিটে চায়!
শান্ত বিকেল, তুমি ছাড়া বিরান একা!
এ শরতেও তোমার পাবো না দেখা?
তবু আনন্দ মনে, ঢাকের শব্দ বাজে!
শরৎসুন্দর শোভা, মন বসে না কাজে।
প্রতি বছর এমন রূপ থাকতো যদি;
হতাম নদী, চলে যেতাম নিরবধি।
শরতের আকাশ
হাদিউল ইসলাম
শরতের আঙুল নেই, ছেনি ও হাতুড়ি নেই
চোখ নেই, মুখ নেই, ইচ্ছে আছে কি?
তার আছে লীলাময়ী বাতাস, বর্ণালী মেঘ
একটা ধারণা ছাড়া শরৎ বলতে কিচ্ছু নেই
তবু মেঘের পাড়া ও পাহাড়ে
আকাশে অনেক রবীন্দ্রনাথ, রদ্যাঁর ‘ভাবুক’
অথবা ‘মৈথুন’ গড়ে চলে নীরবে নিভৃতে
গাভী ও বাছুর, অথবা রানার,
অথবা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত টুকরো টাকরা খাজুরাহো
এরকম বিবিধ মুদ্রার কতো যে ভাস্কর্য খুঁজে পাই
শরৎ আকাশে
শরতের আকাশ মানে অনুসন্ধিৎসু চোখ
আর আবিষ্কারের বিস্ময়
শরতের আকাশে দুঃখ নয়, পুলক ছড়িয়ে থাকে
শরতের প্রকৃত ঠিকানা
ওবায়েদ আকাশ
একখ- শারদীয় মেঘ বেদনার আকাশে-
অসবর্ণ প্রার্থনার মেয়ে- কাল্পনিক সূত্রগুলো
অনন্ত পাঠশালায় তুলে দেবে বলে একান্ত গোপনে পোষে
মেঘের বিশ^স্ত মুখ জলে ধুয়ে কুড়িয়েছে অহিংস আকাশ
যা কিছু বর্ণান্ধ- তাতে অব্যাখ্যাত রঙ, অক্টোপাস-
পৃথিবীর দুরন্ত অশে^রা অবিশ^াস্য ছুটে যাচ্ছে ঝুমকালো মেঘে
আবার নির্ভার ঘিলু সাদা মেঘ নামিয়েছে সশ্রদ্ধ বিশ^াসে
পৃথিবীর সমারোহে আজো দিঘল আলোহাওয়া
যতবার যুদ্ধ হয়, রাত্রি নামে মানুষের মায়াবী বিশ^াসে
কবিতারা জেগে থাকে আলোকিত ঘুম, বিলঝিলে শে^তপদ্মরাগে
বিষাদ-জাতক জানে- কত রক্ত লেপেপুছে
সঘন অম্বরে হাসে সাদা মেঘ, কাশফুলের প্রসিদ্ধ হাসি
বোঝে বেদনার্ত চিল- মেঘে ঢাকা তারকারা কতটুকু বিষাদবিলাসী
প্রতœরঙ দুঃখগুলো জেনেবুঝে ঝরেছিল বর্ষণের ¯্রােতে
সুপ্রাচীন পৃথিবী কি জানে- কতটা উজানে ছিল বর্ণহারা বিদ্বানের দেখা!
গাঢ় রক্ত ঝরে যায়- ভরে যায় সুগভীর নবীন পরিখা!
সমাপিকা চাঁদ ওঠে, ঘাটে ঘাটে প্রতিবিম্ব কোজাগরী ঢেউয়ে-
ঋদ্ধতার প্রকৃত মানস- শরতের খোলা চাঁদে চিরদিন বিশ^স্ত আছে
চিরকাল শরৎ
যাকিয়া সুমি সেতু
আহা! কতোদিন হয়ে গেছে দেখিনি তোমায় আমি প্রিয়তমা
দেখিনি তোমার ঠোঁটে শরতের উঠোন ভেজা নরম শিউলি
আকাশনীল শাড়িতে ঝরে পড়া একরাশ বরফ সাদা তারা
দেখিনি তোমার হিমচোখে, মেঘ ডেকে আনা কাশফুল অরণ্য
হিমঝুরি, গগনশিরীষ, ছাতিম, পাখিফুল, পান্থপাদপ,
কিম্বা আমলকী, জলপাই, চালতা করমচায়
তোমার গন্ধ
আমি জানি, তুমি রুপালি জলধারায় রঙধনু রঙ আবির
তোমার জলসিঁড়ি বাড়ি জুড়ে পেঁজা তুলোর বর্ণিল পাহাড়
দোলনচাঁপা চুলে নরম হাওয়ায় উড়ে আসে প্রণয়নীল চিঠি
শরীরে সঞ্চারিত হয় পলল মাটি আর আমন ধানের শিশির
ঋতুর অমোঘ ভৌগোলিক মানচিত্রে তুমি আমার শরৎ
পূজার ঢাক, উলুধ্বনি, ধূপগন্ধী চেতনায় স্নাত অনন্যা তুমি
তোমার অন্তর লোককথা, বিশ্বাস আর পুরাণে স্বপ্নের ঝিলিক
আমি ডুবে যেতে চাই তোমার আমন ধানের ক্ষেত, আঙিনায়
ডুবে যেতে চাই নরম রোদের পত্রঝরা বৃক্ষের নীলাভ পাতায়
যেখানে আশ্বিন-কার্তিকের নদী হয়ে ঘুমায় চিরকাল শরৎ...
কোজাগরী পূর্ণিমা
সঞ্জয় দেওয়ান
রৌদ্রস্নানে পুড়ে পাকুড় মন
গেরুয়া বাতাসে রাধা- কৃষ্ণের লীলা
মিথুনের অপেক্ষায় বিরহী রাত।
মৃন্ময়ীর পায়ে শুভ্র শিউলির ছোঁয়া
বোধনের অপেক্ষায় রাইকিশোরী
সিঁদুরে লাল ষষ্ঠী
দেহলতায় ওড়ে রঙিন প্রজাপতি।
সাদা মেঘ ছড়ায়-কাশফুলের সংবেদ,
ফুলেশ্বরীর আর্তি, শালিধানের হাসি।
শিশিরভেজা ধানখেতে রাঙা পায়ের আলপনা
পথ হারায় আশ্বিনের অন্ধকারে
বাতাসের কানে বৈষ্ণব পদাবলী
অনুক্ষণ খোঁজে কোজাগরী পূর্ণিমা।
বিরহে শিউলির উঠোন
আদ্যনাথ ঘোষ
শরৎও বিরহের গান লিখে যায়!
ভস্মের কাছে বসে থাকে দুঃখিত মাঠ!
বিরহের সুর যদি ভেসে ওঠে,
জীবনের বেহিসেবি পথের বাঁকে;
কী করে যে বলি! শ্রীমতি শরৎ-
শিউলির উঠোন কি মরে যাবে আগুন শিখায়!
শামুকের শুশ্রƒষায় যত
মঈনুল হাসান
কাঁচা তুলসিমালা ধান নুয়ে পড়ে মাটির আজন্ম আশ্লেষে
শাওনের মেঘ সুতীব্র চিৎকার শেষে ভেঙে দেয় আদর,
সোনালি শামুক গোছার নিচে দাঁত কাটে নিরুপায় বিদ্বেষে
বুকে হেঁটে এসে জলজ রোদ পোহায়, কখন নামবে ভাদর।
মুহূর্তে সেদিন ছলছল বেজে ওঠে, জমে থাকা বৃষ্টিজল
পোড়া মাটির শরীরের যাবতীয় ব্যথা, সবটুকু যায় খসে;
এ ভরা শাওনের মাঠে খেলে যায় ঘোলাটে প্রবাহ তরল
যুগল শামুকের পিঠ শ্লথমুখে স্নান সারে স্খির কামনার রসে।
শাওন শেষে নিদ্রাভঙ্গের পর যাবতীয় কামনা খসে যাবে
কুঁচো শামুকেরা সাঁতার কেটে তুমুল নিশ্বাসে ছড়াবে যে বিষ;
ভাদর শেষে কোনো এক অঘ্রান মাসে এই ধান পোয়াতি হবে
শরীর ও মাঠের জরা ভেঙে হেসে ওঠে রূপসী ধানের শিষ।
এ শামুকে বিষ নয়, কথা ফিসফিস, রাখে প্রেমের স্বাক্ষর;
শুশ্রƒষাশেষে যত সোনালি মহিমা, লিখে যায় মাঠের অক্ষর।
শূন্যতার স্নিগ্ধতা
কুসুম তাহেরা
নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা
ভেসে ভেসে দূরে কোথায় যায়!
আমি প্রশ্নহীন কোনো চিন্তার এক পাশে মৌনতার সিঁড়িতে ভাবছি...
সবকিছু ফেলেই ভেসে যেতে হয়
শূন্যতায়...!
শরতের বাতাস হুহু করে বয়
কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে...
অস্তিত্ব নয়... রূপান্তরই আসল সত্য হয় রয়।
শিউলি ঝরা নীরব সকালে
মন কেমনের দায়
মৃত্যুর মাঝে জীবনের গান
তাল-সূর-লয়।
শরত বলে... ছাড়ো
জীবন যাপনের গান
মিথ্যে মোহ মায়া
প্রকৃতি বদলায়... শুধু পড়ে থাকে
নিজের অলীক ছায়া!
ভূমিহীন
আতিক আজিজ
স্মৃতিকথা থেকে নামতে নামতে এটুকু এলাম
উদাসের ডালপালা বলে না কিছুই
নিরুচ্চার অন্ধকার
তলে মাটি নেই আর।
ঝুলে ঝুলে যাবো কত কাল!
নিজের কাঁধেই রেখেছি নিজের পা
চোখে ঘরদোর
নীরবতার সাথেই করি সহবাস
তোমার নখে মাটি, দাঁতে মাটি
পেট ভরা মাটির পাহাড়
ঢাল বেয়ে নামতে নামতে দেখি
তলে শুধুই আকাশ।
যুক্তিতক্কোগপ্পো শেষে বুঝি-
আমার মাটি খেয়ে হয়েছো আমারই ভূমি-
তিনভাগ জল শূন্যে থেমে আছে।
শরৎঘটিত
আশরাফুল কবীর
নদীর ওপারে এক গ্রাম আর হুহু করা এক বন। দীঘল রাতের অনুবাদে সেখানে পৌঁছাও তুমি- সাথে নিয়ে ভাদুরে উত্তাপ আর আশি^নের উদ্দীপন। সেখানে আছে এক উজ্জ্বল নদী আর গভীর পর্যবেক্ষণ। তোমার ঘন নিঃশ্বাসের ছোঁয়ায়, চেয়ে থাকে কালপুরুষ পলকবিহীন। যদিও সে বনে শরৎবাবু আসেননি কখনো তবে শরৎ এসেছে কমনীয়ভাবে কাশফুলের জোয়ার নিয়ে। শরতের পাঁয়তারায় : এসেছে আরো গহিন কিছু- ইনিয়েবিনিয়ে যা আমি বহুবার বলার চেষ্টা করেছি তোমায়।
বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫
শরৎ
ফারুক মাহমুদ
(উৎস: কালিদাস)
শরৎ-সুন্দরী আজ পরে আছে গাঢ় সাদা শাড়ি
কাশের আঁচল ওড়ে, হাসি যেন শিউলি-সকাল
নতুন জলের মতো চঞ্চলতা কটি মেঘলায়
নির্জন মেঘের আলো ঝলোমলো ছায়া ধরে আছে
আকাশের গোমরা মুখ ঢেকে যায় নীল চাঁদোয়ায়
যথেষ্ট রঙিন রাত্রি। চাঁদ যেন স্তনের উচ্ছ্বাস
মোমের মুখের মতো গলে পড়ে জ্যোৎস্নার ফোঁটা
তারাঠোঁটে চাপাহাসি। রমণীরা আরো রমণীয়
আনন্দ শ্রেষ্ঠত্ব চায়। নির্বাসন রতিপ্রসমনে
ভাসুক হৃদয়তরী প্রেমময় আলিঙ্গন¯্রােতে
শরৎ মানেই আজ সুদূর শৈশব
নাসির আহমেদ
নগরীর পথে পথে শরৎ সন্ধান করি-
কোথায় শরৎ!
শরতের কাশফুল আর শিল্পকর্মতুল্য
শুভ্র মেঘমালা
স্মৃতির বিষয় দূর শৈশব-কৈশোর!
কোথাও দেখি না সেই দিগন্ত বিস্তৃত কাশবন
সবুজে শাদায় মিশে আশ্চর্য সুন্দর
যেন এক ল্যান্ডস্কেপ!
এই জটিল নগরে যার কোনো চিহ্ন নেই।
শরৎ-গোধূলি আর ভোরের কুয়াশা
হরিৎ ঘাসের বুকে এঁকেছিল যত চিত্রকলা
এখানে কোথাও নেই তার চিহ্নকণা
শারদীয় দুর্গোৎসব ঢাকের শব্দও
চাপা পড়ে গেছে যন্ত্রসভ্যতার নিচে।
ট্রাফিক জ্যামের তীব্র শব্দদূষণের কাছে
জিম্মি হয়ে গেছে সেই শরৎ-সৌন্দর্য!
কোথায় শরৎ পাবো এই ইটকাঠের জঙ্গলে?
শরৎ মানেই আজ সুদূর শৈশব আর সবুজ স্বদেশ।
নদনদী ভাইবোন : ৯
জাহিদ হায়দার
অদূরে শ্মশান জ¦লছে
পুড়ছে না মৃত্যু
শবযাত্রীদের মুখশ্রী আলোকিত
বিসর্জিত নাভি ভেসে গেছে
কোনো এক মাছ জন্মচিহ্নে পেয়েছিল স্বাদ
পূজার ফুল ভাসায় তরুণী
অদূরে
অজু করে নিবিড় ধার্মিক
গির্জার কার্নিশে পারাবত
প্যাগোডায় নির্বাণ খুঁজছে ক’জন
দুধকুমার প্রফুল্ল চরণে হাঁটে
এসো বিসর্জন
বলো প্রার্থনা
বলো অর্জন
নদী-ধর্ম নিরপেক্ষ ধাবান
শরৎকালের এক সন্ধ্যায় জাহানারা গার্ডেনে
আবদুর রাজ্জাক
না না আমার অসীম সুখেও তোমার চোখে জল আসে দেখি:
এসময় আমার ভেতরে তোমার নামে গেয়ে ওঠে কেউ,
অল্প অল্প করে কেউ যেন ভেসে যায়, কেউ যেন ভাসিয়ে নেয়...
আমাদের ভেতরের একটি গোপন নদী, আর তোমার ভেতরের
একটি চমৎকার গল্প যা তুমি কখনই বলো নি।
আমাদের উঠোনে একটি চাঁদ, শারদীয় চাঁদ নির্ঝর, সেই চাঁদের-
অন্ধকারে একদিনও ফেরা হয়ে ওঠে না,
তোমার নিজের কাছেও তুমি- ফিরে যেতে পারো না।
তুমি একটি অপূর্ব জুনি, আমার হাতের ভিতরে ছড়িয়ে যাচ্ছো এক
অসম্ভব আলোময় জল। আমি কৃতজ্ঞ, দারুণ।
হিসাব মেলানোর আগেই তোমার আঙিনা থেকে আমাকে
আগুনের ভেলায় ভাসিয়ে দিয়ে তোমার অগ্নিযাত্রা সফল করেছো।
এরচে’ কী আর ভালো হতে পারতো! সে শুধু তুমিই জানো আর-
আমিই জানি।
স্বপ্নঘোর
মঈনউদ্দিন মুনশী
বিকেলের স্বপ্নময় নীরবতায়
এক সোনালি কাঁথা মেলে আছে মেঘে ও সমুদ্রে।
স্বর্গ থেকে নেমে আসা কাকলিরত পাখি
ছড়িয়ে দেয় মৌলিক শুভেচ্ছা।
বাতাসে ভরে আছে উজ্জ্বল সবুজ পাতা। যেগুলো নিচে পড়েছে,
সেগুলো উঠে দাঁড়াবে আবার আবশ্যক স্থিরতার শ্বাস নিয়ে।
প্রতিটি ব্যাকুল পাতা কম্পমান বৃক্ষ থেকে দেখায় স্বর্গসুখ,
বলে, এখন ফুল ফোটার সময়।
রাতের বিবর্ণ আঁধার অভ্যর্থনা করে
নিয়ে আসে আনন্দময় দিন।
প্রফুল্ল পাখির ঝাঁক আলোকিত হয়ে ওঠে-
ফুলের স্ফীত হলুদ রেণু ভেসে যায় দূরে।
শহরতের একগুচ্ছ আনন্দ বেদনা
হাসান কল্লোল
আহত পরাজয়ে ঝুলছে মেঘের ধূসর জামা
আরে বৈষ্ণব তোর কথার আশ্বাসসমূহ থামা!
অনেক ধৈর্যে অপেক্ষার তাপ রেখেছিলাম এই হাতে
তুমি চলে গেলে ফেলে কিছু মায়া বিশাল স্বর্ণ রথে!
আমাদের চরে ধীরে ধীরে মরে শরতের কাশগুলো;
এই হেমন্তে শিশিরের সাথে তবু হাঁটার চিন্তা হলো
হলেই তো হবে না আমার উঠোনে এখনো প্লাবন জল
দূরে থাকা ঐ মেঘরাজদের সাথে
আগে কিছু কথা বল!
বলো হে শান্তি এবার শরতে পরবে কাশের শাড়ি?
বেদনা-সমূহ আলোময় হাতে যাবে কি চাঁদের বাড়ি!
নীল কুয়াশায় এ হৃদয় সেতারে বাজছে দীর্ঘশ্বাস
বাইরে অজ¯্র বৃষ্টি-বালিকারা
বিলাচ্ছে আশ্বাস!
চলো তো আমার শারদীয়া নদী
হেঁটে আসি পথ কিছু-
জীবনটা আসলে জীবনের সমান,
নয় বেশি উঁচু-নিচু!
উঠে মগডালে ভাবছি আমরা
নিজেকেই বড়সড়
ক্ষমা করো শরৎহীন অপরাধগুলো
আমাকেও ক্ষমা করো!!
শরতের উপলব্ধি
হাইকেল হাশমী
শরতের বাতাসের গতি ক্রমাগত দুর্বল হয়ে আসছে
যেন কোনো পুরাতন বইয়ের পৃষ্ঠা,
বারংবার উল্টানোর কারণে
তার প্রান্তগুলো স্মৃতির ভারে হয়ে গেছে ভঙ্গুর।
গাছের পাতাগুলো
তাদের শাখা-প্রশাখার মায়া ছিন্ন করে
বেদনায় নয়-
বরং এক নিঃশব্দ উচ্ছ্বাসে,
বিদায়ের আগে করছে শেষ নৃত্য।
শরতের আকাশ,
পুড়ে না সে গ্রীষ্মের অগ্নিশিখার তাপে,
এখন সে বিশ্রাম নিচ্ছে
সোনালি আভার মেঘমালার চাদর গায়ে দিয়ে,
সে একটি প্রাচীন কোমল প্রার্থনায় মগ্ন।
আর কোথাও এই নিস্তব্ধতার মাঝে
একটি বৃক্ষ শিখে নিয়েছে,
সম্পর্ক ছিন্ন করাও
নতুন করে প্রস্ফুটিত হওয়ার মন্ত্র।
এমন ছিল না শরৎ
চয়ন শায়েরী
গল্পের ভেতরে গল্প
কীভাবে বলতে হয়- হাত নিশপিশ করে,
গল্পের কৌশল শেখবার জন্য;
প্রমাণিত নয়- কীভাবে এতটা দূরে চলে এল বর্ষা- ঘোর লেগে থাকে- দূরযায়ী মেঘের উড়াল দেখে কালিদাসও বিরহের ব্র্যান্ড-অ্যাম্বাস্যাডর বানাতে চেয়েছে মেঘকে- মেঘদূত দূতালি করেছে- কূটসব চাল চেলে ভ-ুল করেছে- দূত ভালো না- নিজের গর্জন নিজে দেয় মানুষেরা- গল্পের অমনিবাস বিক্রি হয়- মিছা কথা কেনে মানুষেরা- খুঁজে ফেরে মানুষীর গল্প- অথচ শরৎ নাকানিচোবানি খায় জল-ঝড়ে- কত কথা মনে পড়ে- প্রলম্বিত বর্ষা তখনও আসে নাই- ছিল আশেপাশে কাশে নদীতীর ভরপুর- এমন ছিল না বর্ষা- এমন ছিল না শরৎ- বর্ষার ছোঁয়ায় ভিজে ওঠে শরতের হৃদয়- যেন শরৎসমগ্র পাঠের সময়, এখন বর্ষামঙ্গল পাঠ করছি বলে ভুল হয়- শরৎ নয় সে, ওকে বর্ষা বলে মনে হয়।
শরতের ছেলেরা মেয়েরা
মোহাম্মদ হোসাইন
তোমরা যখন হাত গুটিয়ে নেবে
আমরা তখন আমাদের সাঁড়াশি হাত বের করে আনব
বুঝে গেছি তোমার তোমাদের ফেরেব্বাজি
মানবতার ভ-ামি ছাড়ো হে সুশীল!
ফিলিস্তিন গাজা খেতে খেতে সারা পৃথিবী খেয়ে নেবে
আর তোমরা ফেরি করে বেড়াবে পৃথিবীময় নেংটো আধুলি-
সে আমরা ধরে ফেলেছি!
কবিতা শানান দিয়ে রেখেছি
যত রক্ত ঝরাবে কবিতা তত নিকটবর্তী তত সন্নিষ্ট নিশানা।
একদিন তোমাদের বারুদ শেষ হয়ে গেলে
আবার পুষ্পিত হবে কবিতা ও কারুকাজ পৃথিবীময়...
কার্তুজ ভরতি ফুল আর শব্দের তারানা নিয়ে
প্রস্তুত হচ্ছি- কোথায় পালাবে!
শরতের মেঘ আর কাশফুলের ছেলেরা মেয়েরা ওই আসছে...
শরৎবেদনা
মুজিব ইরম
এ কোন বেঘোরে তুমি মজে আছো...
কেনো তুমি ডাকছো না
কেনো তুমি বলছো না
ওঠো হে ইরম
উঠেছে ঢোলের ধ্বনি শরৎ বেলায়...
তুমিও ঘুমিয়েছো
অকালের ঘুম...
আমিও তো হারিয়েছি দেশখেশ
কাশফুল
সুগন্ধি বকুল...
ভাঙ্গিলে অবেলা ঘুম ধুনুচি নাচিও
খাসিয়া পানের খিলি আমারে যাচিও...
শরত শোভা
প্রণব মজুমদার
নীল আকাশের গায় সাদা মেঘ ভাসে
শরতে আনন্দ মন, কাশবন হাসে!
দেখ দূর নীলিমায় পাখি উড়ে যায়;
হিম হিম সমীরণ, মন দোলা খায়।
বিকেলের হলুদে রোদ, হাসছে আলো
নদী পাড়ে বসে সময়, কাটছে ভালো!
নববধূ যায় পাল তোলা নৌকায়
তারও মন উচ্ছল, মিটমিটে চায়!
শান্ত বিকেল, তুমি ছাড়া বিরান একা!
এ শরতেও তোমার পাবো না দেখা?
তবু আনন্দ মনে, ঢাকের শব্দ বাজে!
শরৎসুন্দর শোভা, মন বসে না কাজে।
প্রতি বছর এমন রূপ থাকতো যদি;
হতাম নদী, চলে যেতাম নিরবধি।
শরতের আকাশ
হাদিউল ইসলাম
শরতের আঙুল নেই, ছেনি ও হাতুড়ি নেই
চোখ নেই, মুখ নেই, ইচ্ছে আছে কি?
তার আছে লীলাময়ী বাতাস, বর্ণালী মেঘ
একটা ধারণা ছাড়া শরৎ বলতে কিচ্ছু নেই
তবু মেঘের পাড়া ও পাহাড়ে
আকাশে অনেক রবীন্দ্রনাথ, রদ্যাঁর ‘ভাবুক’
অথবা ‘মৈথুন’ গড়ে চলে নীরবে নিভৃতে
গাভী ও বাছুর, অথবা রানার,
অথবা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত টুকরো টাকরা খাজুরাহো
এরকম বিবিধ মুদ্রার কতো যে ভাস্কর্য খুঁজে পাই
শরৎ আকাশে
শরতের আকাশ মানে অনুসন্ধিৎসু চোখ
আর আবিষ্কারের বিস্ময়
শরতের আকাশে দুঃখ নয়, পুলক ছড়িয়ে থাকে
শরতের প্রকৃত ঠিকানা
ওবায়েদ আকাশ
একখ- শারদীয় মেঘ বেদনার আকাশে-
অসবর্ণ প্রার্থনার মেয়ে- কাল্পনিক সূত্রগুলো
অনন্ত পাঠশালায় তুলে দেবে বলে একান্ত গোপনে পোষে
মেঘের বিশ^স্ত মুখ জলে ধুয়ে কুড়িয়েছে অহিংস আকাশ
যা কিছু বর্ণান্ধ- তাতে অব্যাখ্যাত রঙ, অক্টোপাস-
পৃথিবীর দুরন্ত অশে^রা অবিশ^াস্য ছুটে যাচ্ছে ঝুমকালো মেঘে
আবার নির্ভার ঘিলু সাদা মেঘ নামিয়েছে সশ্রদ্ধ বিশ^াসে
পৃথিবীর সমারোহে আজো দিঘল আলোহাওয়া
যতবার যুদ্ধ হয়, রাত্রি নামে মানুষের মায়াবী বিশ^াসে
কবিতারা জেগে থাকে আলোকিত ঘুম, বিলঝিলে শে^তপদ্মরাগে
বিষাদ-জাতক জানে- কত রক্ত লেপেপুছে
সঘন অম্বরে হাসে সাদা মেঘ, কাশফুলের প্রসিদ্ধ হাসি
বোঝে বেদনার্ত চিল- মেঘে ঢাকা তারকারা কতটুকু বিষাদবিলাসী
প্রতœরঙ দুঃখগুলো জেনেবুঝে ঝরেছিল বর্ষণের ¯্রােতে
সুপ্রাচীন পৃথিবী কি জানে- কতটা উজানে ছিল বর্ণহারা বিদ্বানের দেখা!
গাঢ় রক্ত ঝরে যায়- ভরে যায় সুগভীর নবীন পরিখা!
সমাপিকা চাঁদ ওঠে, ঘাটে ঘাটে প্রতিবিম্ব কোজাগরী ঢেউয়ে-
ঋদ্ধতার প্রকৃত মানস- শরতের খোলা চাঁদে চিরদিন বিশ^স্ত আছে
চিরকাল শরৎ
যাকিয়া সুমি সেতু
আহা! কতোদিন হয়ে গেছে দেখিনি তোমায় আমি প্রিয়তমা
দেখিনি তোমার ঠোঁটে শরতের উঠোন ভেজা নরম শিউলি
আকাশনীল শাড়িতে ঝরে পড়া একরাশ বরফ সাদা তারা
দেখিনি তোমার হিমচোখে, মেঘ ডেকে আনা কাশফুল অরণ্য
হিমঝুরি, গগনশিরীষ, ছাতিম, পাখিফুল, পান্থপাদপ,
কিম্বা আমলকী, জলপাই, চালতা করমচায়
তোমার গন্ধ
আমি জানি, তুমি রুপালি জলধারায় রঙধনু রঙ আবির
তোমার জলসিঁড়ি বাড়ি জুড়ে পেঁজা তুলোর বর্ণিল পাহাড়
দোলনচাঁপা চুলে নরম হাওয়ায় উড়ে আসে প্রণয়নীল চিঠি
শরীরে সঞ্চারিত হয় পলল মাটি আর আমন ধানের শিশির
ঋতুর অমোঘ ভৌগোলিক মানচিত্রে তুমি আমার শরৎ
পূজার ঢাক, উলুধ্বনি, ধূপগন্ধী চেতনায় স্নাত অনন্যা তুমি
তোমার অন্তর লোককথা, বিশ্বাস আর পুরাণে স্বপ্নের ঝিলিক
আমি ডুবে যেতে চাই তোমার আমন ধানের ক্ষেত, আঙিনায়
ডুবে যেতে চাই নরম রোদের পত্রঝরা বৃক্ষের নীলাভ পাতায়
যেখানে আশ্বিন-কার্তিকের নদী হয়ে ঘুমায় চিরকাল শরৎ...
কোজাগরী পূর্ণিমা
সঞ্জয় দেওয়ান
রৌদ্রস্নানে পুড়ে পাকুড় মন
গেরুয়া বাতাসে রাধা- কৃষ্ণের লীলা
মিথুনের অপেক্ষায় বিরহী রাত।
মৃন্ময়ীর পায়ে শুভ্র শিউলির ছোঁয়া
বোধনের অপেক্ষায় রাইকিশোরী
সিঁদুরে লাল ষষ্ঠী
দেহলতায় ওড়ে রঙিন প্রজাপতি।
সাদা মেঘ ছড়ায়-কাশফুলের সংবেদ,
ফুলেশ্বরীর আর্তি, শালিধানের হাসি।
শিশিরভেজা ধানখেতে রাঙা পায়ের আলপনা
পথ হারায় আশ্বিনের অন্ধকারে
বাতাসের কানে বৈষ্ণব পদাবলী
অনুক্ষণ খোঁজে কোজাগরী পূর্ণিমা।
বিরহে শিউলির উঠোন
আদ্যনাথ ঘোষ
শরৎও বিরহের গান লিখে যায়!
ভস্মের কাছে বসে থাকে দুঃখিত মাঠ!
বিরহের সুর যদি ভেসে ওঠে,
জীবনের বেহিসেবি পথের বাঁকে;
কী করে যে বলি! শ্রীমতি শরৎ-
শিউলির উঠোন কি মরে যাবে আগুন শিখায়!
শামুকের শুশ্রƒষায় যত
মঈনুল হাসান
কাঁচা তুলসিমালা ধান নুয়ে পড়ে মাটির আজন্ম আশ্লেষে
শাওনের মেঘ সুতীব্র চিৎকার শেষে ভেঙে দেয় আদর,
সোনালি শামুক গোছার নিচে দাঁত কাটে নিরুপায় বিদ্বেষে
বুকে হেঁটে এসে জলজ রোদ পোহায়, কখন নামবে ভাদর।
মুহূর্তে সেদিন ছলছল বেজে ওঠে, জমে থাকা বৃষ্টিজল
পোড়া মাটির শরীরের যাবতীয় ব্যথা, সবটুকু যায় খসে;
এ ভরা শাওনের মাঠে খেলে যায় ঘোলাটে প্রবাহ তরল
যুগল শামুকের পিঠ শ্লথমুখে স্নান সারে স্খির কামনার রসে।
শাওন শেষে নিদ্রাভঙ্গের পর যাবতীয় কামনা খসে যাবে
কুঁচো শামুকেরা সাঁতার কেটে তুমুল নিশ্বাসে ছড়াবে যে বিষ;
ভাদর শেষে কোনো এক অঘ্রান মাসে এই ধান পোয়াতি হবে
শরীর ও মাঠের জরা ভেঙে হেসে ওঠে রূপসী ধানের শিষ।
এ শামুকে বিষ নয়, কথা ফিসফিস, রাখে প্রেমের স্বাক্ষর;
শুশ্রƒষাশেষে যত সোনালি মহিমা, লিখে যায় মাঠের অক্ষর।
শূন্যতার স্নিগ্ধতা
কুসুম তাহেরা
নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা
ভেসে ভেসে দূরে কোথায় যায়!
আমি প্রশ্নহীন কোনো চিন্তার এক পাশে মৌনতার সিঁড়িতে ভাবছি...
সবকিছু ফেলেই ভেসে যেতে হয়
শূন্যতায়...!
শরতের বাতাস হুহু করে বয়
কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে...
অস্তিত্ব নয়... রূপান্তরই আসল সত্য হয় রয়।
শিউলি ঝরা নীরব সকালে
মন কেমনের দায়
মৃত্যুর মাঝে জীবনের গান
তাল-সূর-লয়।
শরত বলে... ছাড়ো
জীবন যাপনের গান
মিথ্যে মোহ মায়া
প্রকৃতি বদলায়... শুধু পড়ে থাকে
নিজের অলীক ছায়া!
ভূমিহীন
আতিক আজিজ
স্মৃতিকথা থেকে নামতে নামতে এটুকু এলাম
উদাসের ডালপালা বলে না কিছুই
নিরুচ্চার অন্ধকার
তলে মাটি নেই আর।
ঝুলে ঝুলে যাবো কত কাল!
নিজের কাঁধেই রেখেছি নিজের পা
চোখে ঘরদোর
নীরবতার সাথেই করি সহবাস
তোমার নখে মাটি, দাঁতে মাটি
পেট ভরা মাটির পাহাড়
ঢাল বেয়ে নামতে নামতে দেখি
তলে শুধুই আকাশ।
যুক্তিতক্কোগপ্পো শেষে বুঝি-
আমার মাটি খেয়ে হয়েছো আমারই ভূমি-
তিনভাগ জল শূন্যে থেমে আছে।
শরৎঘটিত
আশরাফুল কবীর
নদীর ওপারে এক গ্রাম আর হুহু করা এক বন। দীঘল রাতের অনুবাদে সেখানে পৌঁছাও তুমি- সাথে নিয়ে ভাদুরে উত্তাপ আর আশি^নের উদ্দীপন। সেখানে আছে এক উজ্জ্বল নদী আর গভীর পর্যবেক্ষণ। তোমার ঘন নিঃশ্বাসের ছোঁয়ায়, চেয়ে থাকে কালপুরুষ পলকবিহীন। যদিও সে বনে শরৎবাবু আসেননি কখনো তবে শরৎ এসেছে কমনীয়ভাবে কাশফুলের জোয়ার নিয়ে। শরতের পাঁয়তারায় : এসেছে আরো গহিন কিছু- ইনিয়েবিনিয়ে যা আমি বহুবার বলার চেষ্টা করেছি তোমায়।