alt

কোনো এক শরৎসন্ধ্যা : কোথায় পাব তারে

কামরুল ইসলাম

: বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫

রবীন্দ্রনাথের ঋতুভিত্তিক গানের ক্ষেত্রে দেখা যায় ঋতুগুলোর নানামাত্রিক বৈশিষ্ট্য আনুযায়ী তিনি গানগুলো লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ এক ঋতুর গান অন্য ঋতুতে গাওয়া পছন্দ করতেন না। বর্ষা ও বসন্ত নিয়ে সবচেয়ে বেশি গান লিখলেও অন্য ঋতুগুলোকেও অবহেলা করেননি। তার প্রকৃতি পর্যায়ের গানগুলোয় প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যের যে চিত্র এঁকেছেন কবি, তা এক অনন্য কাব্যিক সৌন্দর্যও বটে। প্রত্যেক কবি শিল্পীর কাছেই কোনো না কোনো ঋতু প্রিয়। রবীন্দ্রনাথে আমরা প্রথমত বর্ষা এবং পরে বসন্তের সগৌরব উপস্থিতি লক্ষ্য করি। জীবনানন্দের প্রিয় ঋতু হেমন্ত। রবীন্দ্রনাথ বর্ষার রূপ-সৌন্দর্যকে মহিমান্বিত করেছেন তাঁর কবিতায়, গানে নানা ভাবে ও ভঙ্গিতে। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় সেই বর্ষা ঋতুর বিপরীত প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। তাঁর ‘এইসব দিনরাত্রি’ কবিতায় আমরা ‘শ্রাবণের নির্গলিত ক্লেদরক্ত বৃষ্টির ভিতর’ দেখতে পাই ‘এ-পৃথিবী ঘুম স্বপ্ন রুদ্ধশ্বাস শঠতা রিরংসা মৃত্যু নিয়ে কেমন প্রমত্ত কালো গণিকার উত্তাল সংগীতে... নরক শ্মশান হলো সব।’ আবার অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের বসন্ত যেমন কানায় কানায় পূর্ণ; কত ফুল ফুটে, কত পাখি গায়, কিন্তু জীবনানন্দের ‘বসন্তের কোনো সাড়া নেই’ (উত্তর প্রবেশ, সাতটি তারার তিমির)। জীবনানন্দ দাশের ঋতুপ্রত্যয় রবীন্দ্রনাথের বিপরীত; এই বৈপরীত্য তাঁর কবি স্বভাবেরই বৈপরীত্য, রোমান্টিকতার বিরুদ্ধে আধুনিকতার বিদ্রোহ। রবীন্দ্রনাথের ‘আকাশভরা সূর্য তারা, বিশ্বভরা প্রাণ’-এর বিপরীতে জীবনানন্দে পাওয়া যায় ‘আমি সেই পুরোহিত- সেই পুরোহিত!-/ যে নক্ষত্র মরে যায়, তাহার বুকের শীত / লাগিতেছে আমার শরীরে-’...।

হেমন্ত নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মাত্র ৫টি গান রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ কেন হেমন্ত নিয়ে খুব বেশি গান লিখেননি, এখানে আমরা তা নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। শরৎ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ৩০টি গান রয়েছে। শরৎ নিয়ে কবির উচ্ছ্বাসের শেষ ছিল না। ছিন্নপত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-

“অনেক দিন পরে কাল মেঘবৃষ্টি কেটে শরতের সোনার রোদ্দুর উঠেছিল। পৃথিবীতে যে রোদ্দুর আছে সে কথা যেন একেবারে ভুলে গিয়েছিলুম; হঠাৎ যখন কাল দশটা এগারোটার পর রোদ্দুর ভেঙ্গে পড়লো তখন যেন একটা নতুন জিনিস দেখে মনে অপূর্ব বিস্ময়ের উদয় হলো। দিনটি বড় চমৎকার হয়েছিল। আমি দুপুর বেলায় ¯œানাহারের পর বারান্দার সামনে একটি আরাম-কেদারার উপরে পা ছড়িয়ে দিয়ে অর্ধশয়ান অবস্থায় জাগ্রত-স্বপ্নে নিযুক্ত ছিলাম। আমার চোখের সামনে আমাদের বাড়ির কম্পাউন্ডে কতকগুলো নারকেল গাছ- তার উল্টোদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় কেবলই শস্যক্ষেত্র, শস্যক্ষেত্রের একেবারে প্রান্তভাগে গাছপালার একটুখানি ঝাপসা নীল আভাস মাত্র। ঘুঘু ডাকছে এবং মাঝে মাঝ গোরুর গলার নূপুর শোনা যাচ্ছে। কাঠবিড়ালি একবার ল্যাজের ওপর ভর দিয়ে বসে মাথা তুলে চকিতের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। খুব একটা নিঝুম নিস্তব্ধ নিরালা ভাব। বাতাস অবাধে হু হু করে বয়ে আসছে, নারকেল গাছের পাতা ঝর্ঝর শব্দ করে কাঁপছে। দু-চার জনা চাষা মাঠের এক জায়গায় জটলা করে ধানের ছোট ছোট চারা উপড়ে নিয়ে আঁটি করে বাঁধছে। কাজকর্মের মধ্যে এইটুকু কেবল দেখা যাচ্ছে।” (ছিন্নপত্র : ৩৪, তিরন, ৯ সেপ্টেম্বর ১৮৯১)।

প্রকৃতির সৌন্দর্যের অপরূপ বর্ণনা রয়েছে এই চিঠিতে। মেঘ কেটে গেলে এক স্বপ্নের মতো দুপুরের উপস্থিতি আমাদের মনকে উদ্বেলিত করে। নারকেল পাতা ও ঝিরিঝিরি হাওয়ার খেলা, অবারিত শস্যক্ষেত, ঘুঘুর ডাক, শরতের মেঘমুক্ত আকাশ, রোদের পরশ কবিকে মুগ্ধ করেছে সবসময়। আমরাও মুগ্ধ হই শরতের এই বিচিত্র সম্ভারে। ‘বাতাস অবাধে হু হু করে বয়ে আসছে’- এই হু হু-র মধ্যে মন-উদাসীন করা এক বারতা রয়েছে, রয়েছে এক স্মৃতিবিধুতার শান্ত সমাহিত প্রতিবেশ।

তাঁর গানের মধ্যেও আমরা দেখি শরতের বিভাময় সগৌরব উপস্থিতি, নবজাগরণের আলেখ্য। ‘শরতে আজ কোন অতিথি এল প্রাণের দ্বারে’। ‘শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি / ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অক্সগুলি ॥’ ‘আমরা বেধেঁছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালি মালা-/ নবীন ধানের মঞ্জরি দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা ॥’ ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া-/ দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া ॥ ’ রবীন্দ্রনাথের এইসব শরতের গানে এক অনাবিল মুগ্ধতার অভিজ্ঞান রয়েছে। আমাদের চৈতন্যের এপার-ওপার যেন ছবির মধ্য দিয়ে যেতে যেতে কোথাও গিয়ে আবার শূন্য হয়ে যায়। প্রকৃতিতে শরতের আগমন ঘটলে মন কেমন উতলা হয়ে ওঠে। আকাশে শাদা মেঘের লুকোচুরি খেলা আর কখনো কখনো একটু-আধটু বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর প্রকৃতিতে নেমে আসা এক প্রশান্তির মধ্যে মনও ভিজে ওঠে। তবে কৈশোরের সেই শরৎ আর আজকের শরতের মধ্যে কোথাও যেন ফারাক দেখতে পাই। আমার কৈশোরের শরতের যে আনন্দের ঢেউ আজো আছড়ে পড়ে হৃদয়ে-মনে, তাকেই আমি উদযাপন করি নিবেদিত প্রাণে। কালের ধুলোয় মিশে যাওয়া প্রকৃতির অন্তরাত্মায় যে বিষের তা-ব নিরন্তর ক্রিয়াশীল, তা প্রকৃতির বিশুদ্ধ প্রাণের আলো কেড়ে নিয়েছে অনেকটা; তবু এই প্রকৃতিসত্তার রহস্যময়তায়ই আমরা খুঁজতে থাকি পরিত্রাণের উপায়। শরতের আগমনে কী এক অজানা রহস্যে মানব-মনের ধূসর আাঙিনায় ভেসে ওঠে এক অন্য রকম ভালোলাগার অনুভব যা খুবই ক্ষণিকের। ‘শরৎ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-

“এই ধান, এই ইক্ষু, এরা যে ছোটো, এরা যে অল্পকালের জন্য আসে, ইহাদের যত শোভা যত আনন্দ সেই দুদিনের মধ্যে ঘনাইয়া তুলিতে হয়। সূর্যের আলো ইহাদের জন্য যেন পথের ধারের পানসত্রের মতো- ইহারা তাড়াতাড়ি গ-ূষ ভরিয়া সূর্যকিরণ পান করিয়া লইয়াই চলিয়া যায়- বনস্পতি মতো জল বাতাস মাটিতে ইহাদের অন্ন পানের বাঁধা বরাদ্দ নাই; ইহারা পৃথিবীতে কেবল আতিথ্যই পাইল, আবাস পাইল না। শরৎ পৃথিবীর এই সব ছোটোদের এই সব ক্ষণজীবীদের ক্ষণিক উৎসবের ঋতু। ইহারা যখন আসে তখন কোল ভরিয়া আসে, যখন চলিয়া যায় তখন শূন্য প্রান্তরটা শূন্য আকাশের নিচে হা হা করিতে থাকে। ইহারা পৃথিবীর সবুজ মেঘ, হঠাৎ দেখিতে দেখিতে ঘনাইয়া ওঠে, তার পরে প্রচুর ধারায় আপন বর্ষণ সারিয়া দিয়া চলিয়া যায়, কোথাও নিজের কোনো দাবি-দাওয়ার দলিল রাখে না। আমরা তাই বলিতে পারি, হে শরৎ, তুমি শিশিরাশ্রু ফেলিতে ফেলিতে গত এবং আগতের ক্ষণিক মিলনশয্যা পাতিয়াছ। যে বর্তমানটুকুর জন্য অতীতের চতুর্দোলা দ্বারের কাছে অপেক্ষা করিয়া আছে, তুমি তারই মুখচুম্বন করিতেছ, তোমার হাসিতে চোখের জল গড়াইয়া পড়িতেছে। (বিচিত্র প্রবন্ধ, প্রথম খ-, পৃ. ১৩৪)

শরতের এই ‘ক্ষণিক মিলনশয্যা’, এই সরল উদ্ভাস আমাদের চিত্ত বিমোচনের এক অনির্বচনীয় দাওয়াই।

২.

শরতে প্রকৃতির এই লীলা-বৈচিত্র্যের ভেতর আমি দেখতে পাই সেই কিশোরী মেয়েটিকে- সেই নদীর পাড়- কাশবনের পথের সন্ধ্যা- মনে পড়ে সান্ধ্য বাতাসের শিহরন- শুনি গগন হরকরার সেই গান- ‘কোথায় পাব তারে / আমার মনের মানুষ যে রে / হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে/ দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে...।’ শরতের নিজস্ব গায়কীর টানে মানুষ কখন যে বাউল হয়ে ওঠে, সে নিজেও জানে না। শরতের ¯িœগ্ধ ভোরকে তাই আমার বাউলের একতারা বলেই মনে হয়। মনে আছে শরতেরই এক সন্ধ্যায় যেদিন রুনু নামের সেই মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায়, আউশের ধানকাটা মাঠের কিনার ঘেঁষে মাটির রাস্তা- সেই রাস্তা দিয়ে গরুর গাড়িতে চড়ে মেয়েটি শ্বশুর বাড়ি চলে যায় আর আমার জগৎ থেকে সরে যায় তুলো ওড়া বিষণœ দুপুর, নিরস্ত্র হৃদয়ের ডালে ডালে বেজে ওঠে- কেন পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি...। কেন জানি না গ্রামের সুন্দরী মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে একঝাঁক বেদনার পাখি উড়ে যেত হৃদয়ের পাশ দিয়ে। এরকম কত যে বেদনা-বিভোর দিন কেটেছে আমাদের তার ইয়ত্তা নেই। মনে হতো এইসব সোনার মেয়েরা গ্রামের অলংকার। এরা যখন হাঁটে, বেজে ওঠে গ্রামে। এদের আলোয় উদ্ভাসিত হয় গ্রামের ধুলোপথ, ¯œানঘাট হয়ে ওঠে লাস্যময়ী ফুলপরীদের উৎসব। বিয়ের পর যখন একে একে ওরা ছেড়ে যায় গ্রাম, শূন্য হয়ে যায় আমাদের চারপাশ। একটি বিশেষ বয়স পর্যন্ত এরকমই ভেবেছি আমরা। আমরা, বন্ধুরা জীবন-জীবিকার তাগিদে একদিন গ্রাম ছেড়ে চলে আসি। আমাদের কৈশোরের সেইসব শরৎ, গ্রামের ধুলোর রাস্তাঘাট, বিশাল চর, নদী সবকিছু আজো ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বল করছে আমাদের স্মৃতির আকাশে। আমাদের সহসাই আর গ্রামে ফেরা হয় না। আহা, কতদিন দেখা হয় না সেই বন্ধুদের সাথে!

পুজোর সময়ে সারা হিন্দু পাড়ায়ই বয়ে যেত শরতের নির্মল আনন্দের ঢেউ। আমরা বালকেরা একবার ম-পে গিয়ে প্রতিমা দেখে রমেশদের বাড়ির গেটের সামনে ঝাঁকড়া হয়ে বেড়ে ওঠা করমচা গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়াতাম। যখন মালতী সেজেগুঁজে দু-একজন বান্ধবীর সাথে ম-পের দিকে এগোতো তখন করমচা গাছের শাখায় পাতায় এক পলক দমকা বাতাস এসে দোলা দিয়ে যেত। আমরা মালতীর দিকে এগিয়ে যেতাম। মেয়েটি আমাদের দিকে তাকিয়ে এক ঝলক হাসি দিয়ে নিজের মতো ঘুরে বেড়াতো। তখন বাতাসে বেজে উঠতো মহাকালের মন্দিরা; আহা, সেই মালতীই ছিল আমাদের কাছে চিরকালের মনকাড়া প্রতিমা, আমাদের প্রাণের ভেতরে ডেকে ওঠা বিহঙ্গ! শরতেরই কোনো এক রাতে মালতী এক মুসলমান ছেলের সাথে পালিয়ে গেলে হিন্দুপাড়ায় নেমে আসে নিস্তব্ধতা। মালতী কি আর ফিরেছিল পাড়ায়? সেকথা আজ আর মনে নেই, কারণ, পরের বছরেই নদীর ভাঙনে আমাদের পুরো গ্রামটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে ভিটে-ভাঙা মানুষেরা কে কোথায় চলে যায়, সে-খবর কেউ রাখেনি। মনে আছে মালতীকে দেখার জন্য সেই বালকবেলায়ই ওদের বাড়ির আশপাশ দিয়ে সকাল-বিকেল আমরা বন্ধুরা ঘোরাঘুরি করেছি। যে-রাতে মালতী পালিয়ে যায় সে-রাতের ঝকঝকে আকাশ বেয়ে ভেসে গেছে অনেক অতিথি মেঘ। আমরা, বন্ধুরা, মন খারাপ করে নদীর চরে নেমে কতদিন কাশফুলের অন্তরঙ্গ বেদনার সাথে সখ্য গড়েছি। অতঃপর মেঘে মেঘে বেলা চলে গেছে দূর পারে, কোনো এক অন্ধকার গাঁয়ের ধুলোপথ ধরে অজানায়...।

শরতের নারকেল গাছ ও পাতারা আমার মরমি চেতনার অন্তঃপুরে এসে ঘর বাঁধে। নারকেল পাতার শিশিরে জোছনার আলো পড়লে আমার আজও রুনুর কথা মনে হয়। মনে পড়ে, এমনি এক সন্ধ্যায় রুনু একগুচ্ছ কাশফুল বুকের কাছে চেপে ধরে যখন গোধূলির বাড়িতে মেঘমুলুকের ছবি দেখছিল, তখন গোলাবাড়ি গ্রামের শিমুলতলায় রামু গায়েনের কণ্ঠ থেকে ভেসে এলো- ‘দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা / তারে ধরি ধরি মনে করি/ ধরতে গেলে আর পেলুম না...।’ রুনু কি আজো শরৎসন্ধ্যায় কাশফুল বুকে চেপে ধরে গোধূলির মেঘে মেঘে ভেসে যায়, আজো কি তার মনে আছে সন্ধ্যার হালকা আঁধার-মেশা চুম্বনের পবিত্র শিহরন? মনে মনে ভাবি- ‘তোমায় কেন দিইনি আমার সকল শূন্য করে’। আমাদের শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের সেই দুরন্ত দিনগুলো যে মাটি গাছপালা ও ঘাসের স্পর্শে ধন্য হয়েছিল, সেসব আজ কেবলই স্মৃতি। স্মৃতির পসরা সাজানো বারান্দার আলো-অন্ধকারে আমি রামু গায়েনকে দেখি। শুনতে পাই- সমস্ত আদিমতার মধ্যেও তুমি দেখতে পাবে স্পন্দিত শস্যের গান আর তোমরা শরৎসন্ধ্যায় শরীরে কম্পন নিয়ে যে পোস্টারগুলো লিখে যাচ্ছো সেগুলো লোরকার ছিন্নভিন্ন দেহের মতো পবিত্র- এই বিশ্বাস নিয়ে নেমে যাও বৃষ্টি ও বাতাসের বিবিধ চেতনায়। স্পন্দিত শস্যের গান শোনার অপেক্ষায় কত দিন কত রাত আমি আকাশ-ভূমির নিকটাত্মীয় হয়ে, বনভূমির অনন্ত সবুজ কিংবা ধূসরতা বুকে মেখে হেঁটেছি কত পথ, কিন্তু কেন যেন আমি শুধু পিছনে পিছনে মরা নদীর কতরানো শুনি, শুনি কত বেড়ালের কান্নার ধ্বনি; অতঃপর আমার মনোজগতের নোনাজল ধরে একটি জাহাজের কম্পন আমাকে আবার ফিরে নিয়ে যায় জনারণ্যের সেই শুরুতে। আমাদের শুরু আর শেষের গল্পে যে বিষাদ জমে আছে, শত শত বছর, তার হিশেব নেবার জন্যে আমাদের কেউ আর ডেকে বলে না, এসো হে, এই ডিঙি নৌকোর গলুইয়ে বসে একটু জেনে নিই বটতলার পুরনো গল্পগুলো। কেউ আর বলে না! শুধু উদাস দুপুরের বিন¤্র কবিতার উপমায় ভর করে যখন কাশবন পেরুতে থাকি, কী এক বেদনার বন্দিশে হারাতে থাকি নিজেকে- তখন- সমুখের নদী আর জল নিয়ে খেলে না, তবু আমি জলেই নামি; তবু আমি হারানো তরঙ্গের চোরাপথে নির্মাণ করি মরজগতের মায়াবী সাঁকো। আর দুগ্ধফেননিভ শুভ্র আঁধারে খুঁজে নিই রূপশালী নদীতীর, বানপোকার অমীয় ঘূর্ণি।

রুনুই আমার কৈশোরের প্রথম প্রেম। আজও এতদিন পরেও রুনুর কথা আমি ভুলতে পারি না। আমার কবিতা, গল্পে, গানে রুনু আজও শরতের মেঘের মতোই ভেসে বেড়ায়। আমার মনে হতে থাকে- যে প্রেম মরে গেছে প্রত্যুষে তার কোনো বিকল্প হয় না। শরৎ এলে আমার বুক খালি হয়ে যায়, জীবনের কোথাও কোনো অন্ধ কোঠরে এক অচিন পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুনি আর চেয়ে চেয়ে দেখি- নৈঃশব্দ্যের জলে কে যেন রুপোর ডিঙি বেয়ে, কুয়াশা চিরে, ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে দিগন্তের মোহনায়। আমি দুপুর ডিঙিয়ে যে পাকুড়তলা দিয়ে হেঁটে হেঁটে শেষে এক দিঘির পাড়ে এসে পড়ি, সেখানের বাতাসে বেজে ওঠে গাছ ও পাখির যৌথ সংগীত- ঘর নাইরে বাড়ি নাই রে, নাইরে মনে সুখ / দেহে আমার বাউলামির অসুখ...

আমাদের পাড়ার সেই বয়স্ক কড়ইতলে আমরা কড়ইগাছের নিজস্ব গান শুনতে শুনতে খুঁজতে থাকতাম হারানো দিনগুলি। সুতোকাটা ঘুড়িটি যেমন আর ফেরেনি। ফেরেনি কান্নার অদূরে আল ধরে হেঁটে যাওয়া চুপচাপ ছায়াগুলো। ভেতরে ভেতরে আজো শরতের ¯িœগ্ধ ভোর যেন সেই নন্দনবাড়ি, যার নিচে ক্ষীণকায়া নদী, চর, কাশবন আর কোনো জেলে-কন্যার চোখের মতো দুপুর- এ অনন্তের খেলায় শুভ্র মেঘের সাথে ভেসে যায় মনও দূরের কোনো জঙ্গলের দিকে। ভোর মানে প্রান্তিক আড়ালের ডাক, আমি সেই ডাকের অপেক্ষায় আজো দেখো এই সন্ধ্যার কাছে, এই টুংটাং শব্দের কিনারে একটু একটু করে যার দিকে সরে যাই কিংবা যার শরীরে-শিকড়ে আড়ি পেতে বাঁচতে চেয়ে নিজেকে তুলে ধরি গাছ-গাছালির পোশাকে, সেখানের নির্জন সীমান্তে কবি ছাড়া আর কারো অধিকার নেই প্রবেশের।

‘শরত-আলোর কমলবনে’ আমাদের জীবন উৎসবিত হয়। আমরা প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে বলি ‘এবার অবগুণ্ঠন খোলো’। ‘ আকাশ হতে খসলো তারা’ গানটি সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠে যখন শুনি, নিভৃতে কোথাও বেদনা ও আনন্দের বাঁশি বাজে যুগপৎ। ভালোবেসে দুঃখকে পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে জীবনের এক বিস্তৃত পথের সন্ধান মেলে। সেই তারাকে খুঁজে পাওয়া যায় প্রভাতের শিশির ধারার মধ্যে। শুনতে পাই পথের ধারের পাঠশালায় ছেলেরা সমস্বরে গাইছে- ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে / বাদল গেছে টুটি’...। সেই পথের ধারের পাঠশালার ছাত্র হতে ইচ্ছে জাগে আবার- ‘অমল ধবল পালে মন্দ মধুর হাওয়া’ লেগে কবে কবেই যে সেই নির্জন কুয়াশা-ঢাকা ঘাটের কাছাকাছি এসে গেছি আমরা, টেরও পাইনি; শরতের আনন্দ-বেদনার ছন্দে ছন্দে এক বিষাদময় হাওয়া এসে পাল্টে দেয় প্রকৃতির পাঠ, আসে হেমন্ত- মানবজীবনেও নেমে আসে গোধূলির হিমেল হাওয়া। মন্থর হয় জীবনের গতি, ধূসরতার মধ্যে সন্ধ্যা নামে, প্রকৃতির পাঠশালায় তখন আরেক পাঠ, আরেক ছন্দের ঢেউয়ের ভেতরে নেমে আসে অন্ধকার। হৃদয়পুরের মাঠে মাঠে আজো কারো ডাক শুনি- সে ডাক তছনছ করে মনবাড়ির জানালা-কপাট। সে কি রুনু নাকি মালতী- কার ডাক এসে ভরে তুলে শরতের ডাকবাক্স বিকেলের নরম আলোয় ...। তোমরা ‘হৃদয়ে ছিলে জেগে’ বিষণœ প্রহরের স্মৃতি হয়ে, আছো আজো শরতের বিপুল বাতাসে, শুভ্র মেঘে মেঘে, কাশের গুচ্ছে। কোনো এক শরৎসন্ধ্যায় যে বাউলের গান শুনে বুকের ভেতরে অনুভব করেছিলাম শেফালি ফোটার আনন্দ, তার সাথে আর দেখা হয়নি কখনো। সময় গড়িয়ে গড়িয়ে অতীতের বিশাল গহ্বরে ঢুকে পড়ে, জীবনের সুখ-দুঃখের মাঝখানে এসে দাঁড়ায় বিষাদ ও নৈঃশব্দ্যে আঁকা এক অচেনা নগরের মানচিত্র। সেই মানচিত্রের মধ্যে আমি কেবল আমাকে দেখতে পাই নুয়ে পড়া আধমরা গাছের মতো। চারপাশে আর কেউ নেই। আমার কান্নার অদূরে একতারা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন গগন হরকরা। আমি শুনতে পাই জগৎ-কাঁপানো সেই বাণী- কোথায় পাবো তারে!

ছবি

ধ্রুপদী বোধ ও ব্যাধির কবিতা

ছবি

সুকান্তর কবিতায় বিপ্লবী চেতনা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

মগ্নচৈতন্যে সৌন্দর্যধ্যান

ছবি

অধুনাবাদী নিরীক্ষার অগ্রসাধক

ছবি

‘বায়ান্নর আধুনিকতা ও প্রগতিশীল ধারাকে বহন করতে চেয়েছি’

ছবি

জাতীয় চেতনার অমলিন ধারক

ছবি

নক্ষত্রের অনন্ত যাত্রা

ছবি

আহমদ রফিক ও ভাষামুক্তি সাধনা

ছবি

কবি আসাদ চৌধুরী : ঘরে ফেরা হলো না তাঁর

ছবি

জীবনবোধের অনবদ্য চিত্ররূপ ‘স্বপ্নছোঁয়ার পদযাত্রা’

ছবি

অনালোকিত ইতিহাসের সন্ধানে

ছবি

কবিরের দোঁহা

ছবি

আকবর হোসেন ও ‘যৌবনটাই জীবন নয়’

ছবি

স্বোপার্জিত

ছবি

সংগ্রামের অগ্নিশিখা থেকে হেলাল হাফিজ

শারদ পদাবলি

ছবি

লক্ষীপুর-হ

ছবি

যে জীবন ফড়িংয়ের

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বিশাল ডানাওলা এক থুত্থুরে বুড়ো মানুষ

ছবি

খুদে গল্পের যাদুকর ওসামা অ্যালোমার

ছবি

নিমগ্ন লালন সাধক ফরিদা পারভীন

ছবি

কেন তিনি লালনকন্যা

ছবি

টি এস এলিয়টের সংস্কৃতি চিন্তার অভিমুখ

ছবি

আধুনিক বাংলা কবিতার একশ’ বছর

ছবি

বিশ্বসাহিত্যে এর প্রতিফলন

ছবি

মোজগান ফারামানেশ-এর কবিতা

ছবি

চোখ

ছবি

যোগফল শূন্য

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লাল লুঙ্গি

ছবি

শ্বেতা শতাব্দী এষের কবিতা

ছবি

বিপন্ন মানুষের মনোবাস্তবতার স্বরূপ

ছবি

দিনু বিল্লাহ: জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে

জেলার সিরিজ কবিতা

tab

কোনো এক শরৎসন্ধ্যা : কোথায় পাব তারে

কামরুল ইসলাম

বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫

রবীন্দ্রনাথের ঋতুভিত্তিক গানের ক্ষেত্রে দেখা যায় ঋতুগুলোর নানামাত্রিক বৈশিষ্ট্য আনুযায়ী তিনি গানগুলো লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ এক ঋতুর গান অন্য ঋতুতে গাওয়া পছন্দ করতেন না। বর্ষা ও বসন্ত নিয়ে সবচেয়ে বেশি গান লিখলেও অন্য ঋতুগুলোকেও অবহেলা করেননি। তার প্রকৃতি পর্যায়ের গানগুলোয় প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যের যে চিত্র এঁকেছেন কবি, তা এক অনন্য কাব্যিক সৌন্দর্যও বটে। প্রত্যেক কবি শিল্পীর কাছেই কোনো না কোনো ঋতু প্রিয়। রবীন্দ্রনাথে আমরা প্রথমত বর্ষা এবং পরে বসন্তের সগৌরব উপস্থিতি লক্ষ্য করি। জীবনানন্দের প্রিয় ঋতু হেমন্ত। রবীন্দ্রনাথ বর্ষার রূপ-সৌন্দর্যকে মহিমান্বিত করেছেন তাঁর কবিতায়, গানে নানা ভাবে ও ভঙ্গিতে। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় সেই বর্ষা ঋতুর বিপরীত প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। তাঁর ‘এইসব দিনরাত্রি’ কবিতায় আমরা ‘শ্রাবণের নির্গলিত ক্লেদরক্ত বৃষ্টির ভিতর’ দেখতে পাই ‘এ-পৃথিবী ঘুম স্বপ্ন রুদ্ধশ্বাস শঠতা রিরংসা মৃত্যু নিয়ে কেমন প্রমত্ত কালো গণিকার উত্তাল সংগীতে... নরক শ্মশান হলো সব।’ আবার অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের বসন্ত যেমন কানায় কানায় পূর্ণ; কত ফুল ফুটে, কত পাখি গায়, কিন্তু জীবনানন্দের ‘বসন্তের কোনো সাড়া নেই’ (উত্তর প্রবেশ, সাতটি তারার তিমির)। জীবনানন্দ দাশের ঋতুপ্রত্যয় রবীন্দ্রনাথের বিপরীত; এই বৈপরীত্য তাঁর কবি স্বভাবেরই বৈপরীত্য, রোমান্টিকতার বিরুদ্ধে আধুনিকতার বিদ্রোহ। রবীন্দ্রনাথের ‘আকাশভরা সূর্য তারা, বিশ্বভরা প্রাণ’-এর বিপরীতে জীবনানন্দে পাওয়া যায় ‘আমি সেই পুরোহিত- সেই পুরোহিত!-/ যে নক্ষত্র মরে যায়, তাহার বুকের শীত / লাগিতেছে আমার শরীরে-’...।

হেমন্ত নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মাত্র ৫টি গান রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ কেন হেমন্ত নিয়ে খুব বেশি গান লিখেননি, এখানে আমরা তা নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। শরৎ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ৩০টি গান রয়েছে। শরৎ নিয়ে কবির উচ্ছ্বাসের শেষ ছিল না। ছিন্নপত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-

“অনেক দিন পরে কাল মেঘবৃষ্টি কেটে শরতের সোনার রোদ্দুর উঠেছিল। পৃথিবীতে যে রোদ্দুর আছে সে কথা যেন একেবারে ভুলে গিয়েছিলুম; হঠাৎ যখন কাল দশটা এগারোটার পর রোদ্দুর ভেঙ্গে পড়লো তখন যেন একটা নতুন জিনিস দেখে মনে অপূর্ব বিস্ময়ের উদয় হলো। দিনটি বড় চমৎকার হয়েছিল। আমি দুপুর বেলায় ¯œানাহারের পর বারান্দার সামনে একটি আরাম-কেদারার উপরে পা ছড়িয়ে দিয়ে অর্ধশয়ান অবস্থায় জাগ্রত-স্বপ্নে নিযুক্ত ছিলাম। আমার চোখের সামনে আমাদের বাড়ির কম্পাউন্ডে কতকগুলো নারকেল গাছ- তার উল্টোদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় কেবলই শস্যক্ষেত্র, শস্যক্ষেত্রের একেবারে প্রান্তভাগে গাছপালার একটুখানি ঝাপসা নীল আভাস মাত্র। ঘুঘু ডাকছে এবং মাঝে মাঝ গোরুর গলার নূপুর শোনা যাচ্ছে। কাঠবিড়ালি একবার ল্যাজের ওপর ভর দিয়ে বসে মাথা তুলে চকিতের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। খুব একটা নিঝুম নিস্তব্ধ নিরালা ভাব। বাতাস অবাধে হু হু করে বয়ে আসছে, নারকেল গাছের পাতা ঝর্ঝর শব্দ করে কাঁপছে। দু-চার জনা চাষা মাঠের এক জায়গায় জটলা করে ধানের ছোট ছোট চারা উপড়ে নিয়ে আঁটি করে বাঁধছে। কাজকর্মের মধ্যে এইটুকু কেবল দেখা যাচ্ছে।” (ছিন্নপত্র : ৩৪, তিরন, ৯ সেপ্টেম্বর ১৮৯১)।

প্রকৃতির সৌন্দর্যের অপরূপ বর্ণনা রয়েছে এই চিঠিতে। মেঘ কেটে গেলে এক স্বপ্নের মতো দুপুরের উপস্থিতি আমাদের মনকে উদ্বেলিত করে। নারকেল পাতা ও ঝিরিঝিরি হাওয়ার খেলা, অবারিত শস্যক্ষেত, ঘুঘুর ডাক, শরতের মেঘমুক্ত আকাশ, রোদের পরশ কবিকে মুগ্ধ করেছে সবসময়। আমরাও মুগ্ধ হই শরতের এই বিচিত্র সম্ভারে। ‘বাতাস অবাধে হু হু করে বয়ে আসছে’- এই হু হু-র মধ্যে মন-উদাসীন করা এক বারতা রয়েছে, রয়েছে এক স্মৃতিবিধুতার শান্ত সমাহিত প্রতিবেশ।

তাঁর গানের মধ্যেও আমরা দেখি শরতের বিভাময় সগৌরব উপস্থিতি, নবজাগরণের আলেখ্য। ‘শরতে আজ কোন অতিথি এল প্রাণের দ্বারে’। ‘শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি / ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অক্সগুলি ॥’ ‘আমরা বেধেঁছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালি মালা-/ নবীন ধানের মঞ্জরি দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা ॥’ ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া-/ দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া ॥ ’ রবীন্দ্রনাথের এইসব শরতের গানে এক অনাবিল মুগ্ধতার অভিজ্ঞান রয়েছে। আমাদের চৈতন্যের এপার-ওপার যেন ছবির মধ্য দিয়ে যেতে যেতে কোথাও গিয়ে আবার শূন্য হয়ে যায়। প্রকৃতিতে শরতের আগমন ঘটলে মন কেমন উতলা হয়ে ওঠে। আকাশে শাদা মেঘের লুকোচুরি খেলা আর কখনো কখনো একটু-আধটু বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর প্রকৃতিতে নেমে আসা এক প্রশান্তির মধ্যে মনও ভিজে ওঠে। তবে কৈশোরের সেই শরৎ আর আজকের শরতের মধ্যে কোথাও যেন ফারাক দেখতে পাই। আমার কৈশোরের শরতের যে আনন্দের ঢেউ আজো আছড়ে পড়ে হৃদয়ে-মনে, তাকেই আমি উদযাপন করি নিবেদিত প্রাণে। কালের ধুলোয় মিশে যাওয়া প্রকৃতির অন্তরাত্মায় যে বিষের তা-ব নিরন্তর ক্রিয়াশীল, তা প্রকৃতির বিশুদ্ধ প্রাণের আলো কেড়ে নিয়েছে অনেকটা; তবু এই প্রকৃতিসত্তার রহস্যময়তায়ই আমরা খুঁজতে থাকি পরিত্রাণের উপায়। শরতের আগমনে কী এক অজানা রহস্যে মানব-মনের ধূসর আাঙিনায় ভেসে ওঠে এক অন্য রকম ভালোলাগার অনুভব যা খুবই ক্ষণিকের। ‘শরৎ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-

“এই ধান, এই ইক্ষু, এরা যে ছোটো, এরা যে অল্পকালের জন্য আসে, ইহাদের যত শোভা যত আনন্দ সেই দুদিনের মধ্যে ঘনাইয়া তুলিতে হয়। সূর্যের আলো ইহাদের জন্য যেন পথের ধারের পানসত্রের মতো- ইহারা তাড়াতাড়ি গ-ূষ ভরিয়া সূর্যকিরণ পান করিয়া লইয়াই চলিয়া যায়- বনস্পতি মতো জল বাতাস মাটিতে ইহাদের অন্ন পানের বাঁধা বরাদ্দ নাই; ইহারা পৃথিবীতে কেবল আতিথ্যই পাইল, আবাস পাইল না। শরৎ পৃথিবীর এই সব ছোটোদের এই সব ক্ষণজীবীদের ক্ষণিক উৎসবের ঋতু। ইহারা যখন আসে তখন কোল ভরিয়া আসে, যখন চলিয়া যায় তখন শূন্য প্রান্তরটা শূন্য আকাশের নিচে হা হা করিতে থাকে। ইহারা পৃথিবীর সবুজ মেঘ, হঠাৎ দেখিতে দেখিতে ঘনাইয়া ওঠে, তার পরে প্রচুর ধারায় আপন বর্ষণ সারিয়া দিয়া চলিয়া যায়, কোথাও নিজের কোনো দাবি-দাওয়ার দলিল রাখে না। আমরা তাই বলিতে পারি, হে শরৎ, তুমি শিশিরাশ্রু ফেলিতে ফেলিতে গত এবং আগতের ক্ষণিক মিলনশয্যা পাতিয়াছ। যে বর্তমানটুকুর জন্য অতীতের চতুর্দোলা দ্বারের কাছে অপেক্ষা করিয়া আছে, তুমি তারই মুখচুম্বন করিতেছ, তোমার হাসিতে চোখের জল গড়াইয়া পড়িতেছে। (বিচিত্র প্রবন্ধ, প্রথম খ-, পৃ. ১৩৪)

শরতের এই ‘ক্ষণিক মিলনশয্যা’, এই সরল উদ্ভাস আমাদের চিত্ত বিমোচনের এক অনির্বচনীয় দাওয়াই।

২.

শরতে প্রকৃতির এই লীলা-বৈচিত্র্যের ভেতর আমি দেখতে পাই সেই কিশোরী মেয়েটিকে- সেই নদীর পাড়- কাশবনের পথের সন্ধ্যা- মনে পড়ে সান্ধ্য বাতাসের শিহরন- শুনি গগন হরকরার সেই গান- ‘কোথায় পাব তারে / আমার মনের মানুষ যে রে / হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে/ দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে...।’ শরতের নিজস্ব গায়কীর টানে মানুষ কখন যে বাউল হয়ে ওঠে, সে নিজেও জানে না। শরতের ¯িœগ্ধ ভোরকে তাই আমার বাউলের একতারা বলেই মনে হয়। মনে আছে শরতেরই এক সন্ধ্যায় যেদিন রুনু নামের সেই মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায়, আউশের ধানকাটা মাঠের কিনার ঘেঁষে মাটির রাস্তা- সেই রাস্তা দিয়ে গরুর গাড়িতে চড়ে মেয়েটি শ্বশুর বাড়ি চলে যায় আর আমার জগৎ থেকে সরে যায় তুলো ওড়া বিষণœ দুপুর, নিরস্ত্র হৃদয়ের ডালে ডালে বেজে ওঠে- কেন পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি...। কেন জানি না গ্রামের সুন্দরী মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে একঝাঁক বেদনার পাখি উড়ে যেত হৃদয়ের পাশ দিয়ে। এরকম কত যে বেদনা-বিভোর দিন কেটেছে আমাদের তার ইয়ত্তা নেই। মনে হতো এইসব সোনার মেয়েরা গ্রামের অলংকার। এরা যখন হাঁটে, বেজে ওঠে গ্রামে। এদের আলোয় উদ্ভাসিত হয় গ্রামের ধুলোপথ, ¯œানঘাট হয়ে ওঠে লাস্যময়ী ফুলপরীদের উৎসব। বিয়ের পর যখন একে একে ওরা ছেড়ে যায় গ্রাম, শূন্য হয়ে যায় আমাদের চারপাশ। একটি বিশেষ বয়স পর্যন্ত এরকমই ভেবেছি আমরা। আমরা, বন্ধুরা জীবন-জীবিকার তাগিদে একদিন গ্রাম ছেড়ে চলে আসি। আমাদের কৈশোরের সেইসব শরৎ, গ্রামের ধুলোর রাস্তাঘাট, বিশাল চর, নদী সবকিছু আজো ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বল করছে আমাদের স্মৃতির আকাশে। আমাদের সহসাই আর গ্রামে ফেরা হয় না। আহা, কতদিন দেখা হয় না সেই বন্ধুদের সাথে!

পুজোর সময়ে সারা হিন্দু পাড়ায়ই বয়ে যেত শরতের নির্মল আনন্দের ঢেউ। আমরা বালকেরা একবার ম-পে গিয়ে প্রতিমা দেখে রমেশদের বাড়ির গেটের সামনে ঝাঁকড়া হয়ে বেড়ে ওঠা করমচা গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়াতাম। যখন মালতী সেজেগুঁজে দু-একজন বান্ধবীর সাথে ম-পের দিকে এগোতো তখন করমচা গাছের শাখায় পাতায় এক পলক দমকা বাতাস এসে দোলা দিয়ে যেত। আমরা মালতীর দিকে এগিয়ে যেতাম। মেয়েটি আমাদের দিকে তাকিয়ে এক ঝলক হাসি দিয়ে নিজের মতো ঘুরে বেড়াতো। তখন বাতাসে বেজে উঠতো মহাকালের মন্দিরা; আহা, সেই মালতীই ছিল আমাদের কাছে চিরকালের মনকাড়া প্রতিমা, আমাদের প্রাণের ভেতরে ডেকে ওঠা বিহঙ্গ! শরতেরই কোনো এক রাতে মালতী এক মুসলমান ছেলের সাথে পালিয়ে গেলে হিন্দুপাড়ায় নেমে আসে নিস্তব্ধতা। মালতী কি আর ফিরেছিল পাড়ায়? সেকথা আজ আর মনে নেই, কারণ, পরের বছরেই নদীর ভাঙনে আমাদের পুরো গ্রামটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে ভিটে-ভাঙা মানুষেরা কে কোথায় চলে যায়, সে-খবর কেউ রাখেনি। মনে আছে মালতীকে দেখার জন্য সেই বালকবেলায়ই ওদের বাড়ির আশপাশ দিয়ে সকাল-বিকেল আমরা বন্ধুরা ঘোরাঘুরি করেছি। যে-রাতে মালতী পালিয়ে যায় সে-রাতের ঝকঝকে আকাশ বেয়ে ভেসে গেছে অনেক অতিথি মেঘ। আমরা, বন্ধুরা, মন খারাপ করে নদীর চরে নেমে কতদিন কাশফুলের অন্তরঙ্গ বেদনার সাথে সখ্য গড়েছি। অতঃপর মেঘে মেঘে বেলা চলে গেছে দূর পারে, কোনো এক অন্ধকার গাঁয়ের ধুলোপথ ধরে অজানায়...।

শরতের নারকেল গাছ ও পাতারা আমার মরমি চেতনার অন্তঃপুরে এসে ঘর বাঁধে। নারকেল পাতার শিশিরে জোছনার আলো পড়লে আমার আজও রুনুর কথা মনে হয়। মনে পড়ে, এমনি এক সন্ধ্যায় রুনু একগুচ্ছ কাশফুল বুকের কাছে চেপে ধরে যখন গোধূলির বাড়িতে মেঘমুলুকের ছবি দেখছিল, তখন গোলাবাড়ি গ্রামের শিমুলতলায় রামু গায়েনের কণ্ঠ থেকে ভেসে এলো- ‘দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা / তারে ধরি ধরি মনে করি/ ধরতে গেলে আর পেলুম না...।’ রুনু কি আজো শরৎসন্ধ্যায় কাশফুল বুকে চেপে ধরে গোধূলির মেঘে মেঘে ভেসে যায়, আজো কি তার মনে আছে সন্ধ্যার হালকা আঁধার-মেশা চুম্বনের পবিত্র শিহরন? মনে মনে ভাবি- ‘তোমায় কেন দিইনি আমার সকল শূন্য করে’। আমাদের শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের সেই দুরন্ত দিনগুলো যে মাটি গাছপালা ও ঘাসের স্পর্শে ধন্য হয়েছিল, সেসব আজ কেবলই স্মৃতি। স্মৃতির পসরা সাজানো বারান্দার আলো-অন্ধকারে আমি রামু গায়েনকে দেখি। শুনতে পাই- সমস্ত আদিমতার মধ্যেও তুমি দেখতে পাবে স্পন্দিত শস্যের গান আর তোমরা শরৎসন্ধ্যায় শরীরে কম্পন নিয়ে যে পোস্টারগুলো লিখে যাচ্ছো সেগুলো লোরকার ছিন্নভিন্ন দেহের মতো পবিত্র- এই বিশ্বাস নিয়ে নেমে যাও বৃষ্টি ও বাতাসের বিবিধ চেতনায়। স্পন্দিত শস্যের গান শোনার অপেক্ষায় কত দিন কত রাত আমি আকাশ-ভূমির নিকটাত্মীয় হয়ে, বনভূমির অনন্ত সবুজ কিংবা ধূসরতা বুকে মেখে হেঁটেছি কত পথ, কিন্তু কেন যেন আমি শুধু পিছনে পিছনে মরা নদীর কতরানো শুনি, শুনি কত বেড়ালের কান্নার ধ্বনি; অতঃপর আমার মনোজগতের নোনাজল ধরে একটি জাহাজের কম্পন আমাকে আবার ফিরে নিয়ে যায় জনারণ্যের সেই শুরুতে। আমাদের শুরু আর শেষের গল্পে যে বিষাদ জমে আছে, শত শত বছর, তার হিশেব নেবার জন্যে আমাদের কেউ আর ডেকে বলে না, এসো হে, এই ডিঙি নৌকোর গলুইয়ে বসে একটু জেনে নিই বটতলার পুরনো গল্পগুলো। কেউ আর বলে না! শুধু উদাস দুপুরের বিন¤্র কবিতার উপমায় ভর করে যখন কাশবন পেরুতে থাকি, কী এক বেদনার বন্দিশে হারাতে থাকি নিজেকে- তখন- সমুখের নদী আর জল নিয়ে খেলে না, তবু আমি জলেই নামি; তবু আমি হারানো তরঙ্গের চোরাপথে নির্মাণ করি মরজগতের মায়াবী সাঁকো। আর দুগ্ধফেননিভ শুভ্র আঁধারে খুঁজে নিই রূপশালী নদীতীর, বানপোকার অমীয় ঘূর্ণি।

রুনুই আমার কৈশোরের প্রথম প্রেম। আজও এতদিন পরেও রুনুর কথা আমি ভুলতে পারি না। আমার কবিতা, গল্পে, গানে রুনু আজও শরতের মেঘের মতোই ভেসে বেড়ায়। আমার মনে হতে থাকে- যে প্রেম মরে গেছে প্রত্যুষে তার কোনো বিকল্প হয় না। শরৎ এলে আমার বুক খালি হয়ে যায়, জীবনের কোথাও কোনো অন্ধ কোঠরে এক অচিন পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুনি আর চেয়ে চেয়ে দেখি- নৈঃশব্দ্যের জলে কে যেন রুপোর ডিঙি বেয়ে, কুয়াশা চিরে, ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে দিগন্তের মোহনায়। আমি দুপুর ডিঙিয়ে যে পাকুড়তলা দিয়ে হেঁটে হেঁটে শেষে এক দিঘির পাড়ে এসে পড়ি, সেখানের বাতাসে বেজে ওঠে গাছ ও পাখির যৌথ সংগীত- ঘর নাইরে বাড়ি নাই রে, নাইরে মনে সুখ / দেহে আমার বাউলামির অসুখ...

আমাদের পাড়ার সেই বয়স্ক কড়ইতলে আমরা কড়ইগাছের নিজস্ব গান শুনতে শুনতে খুঁজতে থাকতাম হারানো দিনগুলি। সুতোকাটা ঘুড়িটি যেমন আর ফেরেনি। ফেরেনি কান্নার অদূরে আল ধরে হেঁটে যাওয়া চুপচাপ ছায়াগুলো। ভেতরে ভেতরে আজো শরতের ¯িœগ্ধ ভোর যেন সেই নন্দনবাড়ি, যার নিচে ক্ষীণকায়া নদী, চর, কাশবন আর কোনো জেলে-কন্যার চোখের মতো দুপুর- এ অনন্তের খেলায় শুভ্র মেঘের সাথে ভেসে যায় মনও দূরের কোনো জঙ্গলের দিকে। ভোর মানে প্রান্তিক আড়ালের ডাক, আমি সেই ডাকের অপেক্ষায় আজো দেখো এই সন্ধ্যার কাছে, এই টুংটাং শব্দের কিনারে একটু একটু করে যার দিকে সরে যাই কিংবা যার শরীরে-শিকড়ে আড়ি পেতে বাঁচতে চেয়ে নিজেকে তুলে ধরি গাছ-গাছালির পোশাকে, সেখানের নির্জন সীমান্তে কবি ছাড়া আর কারো অধিকার নেই প্রবেশের।

‘শরত-আলোর কমলবনে’ আমাদের জীবন উৎসবিত হয়। আমরা প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে বলি ‘এবার অবগুণ্ঠন খোলো’। ‘ আকাশ হতে খসলো তারা’ গানটি সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠে যখন শুনি, নিভৃতে কোথাও বেদনা ও আনন্দের বাঁশি বাজে যুগপৎ। ভালোবেসে দুঃখকে পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে জীবনের এক বিস্তৃত পথের সন্ধান মেলে। সেই তারাকে খুঁজে পাওয়া যায় প্রভাতের শিশির ধারার মধ্যে। শুনতে পাই পথের ধারের পাঠশালায় ছেলেরা সমস্বরে গাইছে- ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে / বাদল গেছে টুটি’...। সেই পথের ধারের পাঠশালার ছাত্র হতে ইচ্ছে জাগে আবার- ‘অমল ধবল পালে মন্দ মধুর হাওয়া’ লেগে কবে কবেই যে সেই নির্জন কুয়াশা-ঢাকা ঘাটের কাছাকাছি এসে গেছি আমরা, টেরও পাইনি; শরতের আনন্দ-বেদনার ছন্দে ছন্দে এক বিষাদময় হাওয়া এসে পাল্টে দেয় প্রকৃতির পাঠ, আসে হেমন্ত- মানবজীবনেও নেমে আসে গোধূলির হিমেল হাওয়া। মন্থর হয় জীবনের গতি, ধূসরতার মধ্যে সন্ধ্যা নামে, প্রকৃতির পাঠশালায় তখন আরেক পাঠ, আরেক ছন্দের ঢেউয়ের ভেতরে নেমে আসে অন্ধকার। হৃদয়পুরের মাঠে মাঠে আজো কারো ডাক শুনি- সে ডাক তছনছ করে মনবাড়ির জানালা-কপাট। সে কি রুনু নাকি মালতী- কার ডাক এসে ভরে তুলে শরতের ডাকবাক্স বিকেলের নরম আলোয় ...। তোমরা ‘হৃদয়ে ছিলে জেগে’ বিষণœ প্রহরের স্মৃতি হয়ে, আছো আজো শরতের বিপুল বাতাসে, শুভ্র মেঘে মেঘে, কাশের গুচ্ছে। কোনো এক শরৎসন্ধ্যায় যে বাউলের গান শুনে বুকের ভেতরে অনুভব করেছিলাম শেফালি ফোটার আনন্দ, তার সাথে আর দেখা হয়নি কখনো। সময় গড়িয়ে গড়িয়ে অতীতের বিশাল গহ্বরে ঢুকে পড়ে, জীবনের সুখ-দুঃখের মাঝখানে এসে দাঁড়ায় বিষাদ ও নৈঃশব্দ্যে আঁকা এক অচেনা নগরের মানচিত্র। সেই মানচিত্রের মধ্যে আমি কেবল আমাকে দেখতে পাই নুয়ে পড়া আধমরা গাছের মতো। চারপাশে আর কেউ নেই। আমার কান্নার অদূরে একতারা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন গগন হরকরা। আমি শুনতে পাই জগৎ-কাঁপানো সেই বাণী- কোথায় পাবো তারে!

back to top