alt

স্বোপার্জিত

সবিতা শর্মা

: বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫

শিল্পী : হাশেম খান

আপন ঠিকানায় ফেরার একটা উদগ্র আকাক্সক্ষা থাকে মানুষের। স্বামী বিনায়ককে দেখে কান্তা তা বুঝতে পেরেছে। কান্তার কথা ভিন্ন। মেয়েদের তো ঠিকানা হয় না! জীবন কাটিয়ে দেয় তারা প্রযতেœ। কান্তাও ঠিকানাবিহীন। তবে স্বভাবজাতভাবে কান্তা ভাদ্র মাসের বাস্তু ব্যাঙের মতো। এক বাস্তুর কোনায় মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। হোক তা ভাড়াটে বাস্তু। বিনায়- চাকরিসূত্রে কান্তাকে জীবনের অনেকটা সময় ভাড়া বাড়িতে কাটাতে হয়েছে। ঘন ঘন বাসা বদল তার চূড়ান্ত অপছন্দ।

বিনায়ক অবসরের দ্বারপ্রান্তে। নানা পরিকল্পনা চলে স্বামী-স্ত্রীতে। এরপর কোথায়?

বিনায়কদের অনেক জমিজমা। খালি ভিটেও আছে দু’তিনটে।

চারিদিকে মহীরুহতুল্য রেইনট্রি, মেহগনিবেষ্টিত একটা ভিটে বড় মেয়েকে দেখিয়ে বলেছিল, ‘দেখিস, অবসরের টাকায় এখানে আমাদের বসত গড়ে তুলবো।’

আনন্দিত তিমু একটু অবাক হয়ে বলল, ‘বর্ষায় তো চারপাশ তলিয়ে যাবে। বাড়ি থেকে বের হবে কী করে?’

বিনায়করা নিম্নাঞ্চলের লোক। বর্ষায় থৈ থৈ কাকচক্ষু জল। সে জলে কত যে মাছেরা জলকেলিতে মেতে থাকে! আছে হরেক রকম বাহারি নামের জাল। সেসব জাল নিয়ে ছেলে-যুবা-বুডো ধরতে গেলে জলেই দিন কাটায়।

ফসলি জমিও টইটুম্বুর। কিছু ক্ষেতের ধান গাছেরা বাড়ন্ত জলের সাথে দিব্যি প্রতিযোগিতায় নামে। নাক উঁচিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে প্রাণান্ত হয়। উৎসব লাগে শাপলা বনে। মাঠকে মাঠ পেলব জোছনায় রাতভর খলবল হাসিতে বাতাসের গায়ে ঢলে পড়ে শাপলারা।

এত যে জল বর্ষায়, বাড়ি উঠান চৌকাঠ ছুঁয়ে বেড়ায়, শুকনো মরশুমে সে জল টুকরো-টাকরা খানাখন্দ পুকুর কিংবা খালের তলায় মুখ লুকায়। নানা ঋতুতে জলের ভাগাভাগি হলেও গাঁয়ে কিন্তু রোদ-ছায়ার কোনো ভাগাভাগি নেই। অঢেল, অফুরন্ত। কত যে বৃক্ষ, তার মিষ্টি ছায়া। গাছের ডালে পাখি অফুরান। ভিন্ন নাম ভিন্ন তাদের বুলি। ভিন্ন রং ভিন্ন তাদের চেহারা। গ্রামময় নেচে বেড়ায় মনখুশিতে।

মহা উর্বর মাটি। মানুষগুলো জড়িয়ে থাকে জল আর মাটির সাথে। মাটির বু- ভাষা তারা পড়ে নেয় অনায়াসে। মাটিও তাই যুগ যুগ ধরে ফসলের ভারে আনত রয়।

বড় গ্রাম। ঘর-ভদ্রাসনের ফাঁকে গজানো নানাবিধ ফসলের গন্ধ, বাতাসের উঠতি পড়তি ঢেউ, রুপালি জলের বাহার গ্রামখানিকে সৌন্দর্যের চাদরে মুড়ে দিয়েছে।

দীর্ঘ দুপুরে রৌদ্র-ছায়ার বিছানা পেতে বাড়িগুলো নিঝুম ঘুমিয়ে পড়ে। শান্ত নিরুদ্বেগ অপরূপ গাঁ।

হাসতে হাসতে বাবা মেয়েকে বলে, ‘ওখানেই তো মজা।’ ভরা বর্ষায় সাঁকো গমনাগমনের আরেক নাম। দোল খেতে খেতে ভবসিন্ধু পাড়ি দেয়। অনভ্যস্তদের কাছে মরণ ফাঁদ।

‘ঐ দেখ কত্তগুলো তাল গাছ!’ অনতি দূরের তালগাছ ও জমি বিনায়কদের পৈতৃক। পির পির তাল রং ধরলে ধুপধাপ ঝরে। এদের তাল খাবার পদ্ধতিটি বেশ অভিনব। ত্রিকোণ বাঁশের কাঠিতে ঘষে আঁশসমেত রস জ্বাল দেয়। ঘন হলে পাতে দেয়। না গুড় না চিনি। খানিক দুধ ঢেলে দেয় পাতে। এবার খাও তাল!

এ অঞ্চলের মানুষের মুখে বেশ মিষ্টতা। মিষ্টতা কেবল খাবার বেলা। সে জন্যে পিঠা পায়েশ চাটনি এরা খুব সামান্য মিষ্টিতে খায়। ‘মথুরা, মথুরা’ -বলে ওঠে কান্তা।

মেয়ে হোঁচট খায়। ‘মথুরা মথুরা কী মা’?

‘সে ভিন্ন কাহিনী’।

‘বলো না!’

‘অন্যদিন শুনবি। আজ থাক।’

এই যে সতেজ লকলকে কলাই শাক ফলে আছে, এটাও আমাদের জমি। ‘ডাগর চোখ আরো বড় করে তিমু বলল, ‘তোমাদের এত জমি?’

‘এত কোথায় দেখলি? জানিস, আমাদের ঠাকুরদার ঠাকুরদা মাঝারি জমিদার ছিলেন। পুরুষানুক্রমে ভাগ হয়ে কত কমে গেছে।’

‘তুমি এটাকে কম বলছো?’ আনন্দোচ্ছল তিমু ঝলমলিয়ে উঠলো।

‘পা চালিয়ে চল। রোদ চড়ে যাচ্ছে। সব জমি দেখবি তো।’ দৌড়ে বাবার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘বাবা, আমাদের সব জমিতে আমি কিন্তু পা রাখবো। দূর থেকে দেখালে চলবে না।’

চাকরি সূত্রে বিনায়- ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়ি থাকা হয় না। ওদের জন্ম, বেড়ে-উঠা, পড়াশোনা অন্যত্র চলছে। এই নিয়ে বিনায়- মনে সূক্ষ্ম অথচ তীব্র অনুশোচনা মিশ্রিত বেদনা আছে।

এখন মেয়ের কথায় সে বিহ্বল হয়ে পড়ে। বিনায়ক ভেবেছিল, ওরা বাড়ি এলে হয়তো নিজেদের অতিথি মনে করে। তাহলে শিকড়বিহীন নয় এরা! নিজেদের উন্মূলিত ভাবে না! প্রশান্তিতে ছেঁয়ে যায় মন। বুক থেকে নামে পাষাণ ভার। এর চে’ সুখের বিষয় আর কী আছে জীবনে। মনুষ্যত্বের পূর্ণতা ও প্রতিষ্ঠার চাবিকাঠি পারিবারিক বন্ধন নামক শমীবৃক্ষের শিকড় হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত ।

সুখের পায়রা বাকুম বাকুম কলকণ্ঠে বলে, ‘তাই হবে। চল।’

নানান জায়গায় ছড়ানো সকল জমির অবস্থান বিনায়কও ভালো জানে না। এত বড় আহ্লাদের কথা তিমু বলেছে। সব জমিতে পা রাখবে। নিজের অজ্ঞতা কিছুতেই প্রকাশ করবে না। বরং বাড়ি পৌঁছে দাগ নম্বর নিয়ে বসে জেনে নেবে।

‘একদিনে সব জমি দেখে শেষ করা যাবে না।’ বিভিন্ন মাঠে জমি তাদের। সাব্যস্ত হলো, ‘যে ক’দিন আমরা আছি সকালে জলমুড়ি খেয়ে বের হবো। তাতে একেক দিন একেক মাঠের জমি তোর পায়ের স্পর্শ পাবে। হবে?’ জানতে চায় বিনায়ক।

‘খুব হবে। সব জমি দেখা না হলে ফিরছি না বলে দিলাম।’ সরু আলপথে সামনে পিছনে পিতা-পুত্রী পা চালিয়ে যাচ্ছে। আগে চলে দ-পতি পিছে চলে ছা।

সূর্য মধ্য আকাশ পানে ধাবমান। রোদের ঝাঁজ কুটকুট গায়ে বিঁধছে।

মাথার উপর দিয়ে সাঁই সাঁই উড়ে চলা এক ঝাঁক পাখির দিকে চোখ যায় তিমুর। তাদের চলন্ত ডানায় সোনালি রোদের ঝিলিক। মুগ্ধ তিমু।

পাখিরা ভারি সুখি আর স্বাধীন। যথা ইচ্ছা তথা যা। কিচির মিচির তান শুনে তিমুর মনে হলো যেন ওরা গলা সাধতে লেগেছে। নয়তো, কতটা আকাশ পথ পাড়ি দিল, সারাদিনে আর কতটা দেবে, তারই পরিমাপে ব্যস্ত।

প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকুরে তিমু স্বোপার্জিত টাকায় কেনা এক টুকরো ভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে। আজই রেজিস্ট্রি হলো। বিশাল পৃথিবীর একান্ত নিজস্ব এক ফোঁটা ভূমিতে পা রাখতে পেরে আনন্দে উদ্বেলিত হবার কথা। উল্টো দু’চোখ ভেসে যাচ্ছে তিমুর। বু- তলায় দলা দলা নীলাভ কষ্ট দুমড়েমুচড়ে ভেঙে পড়ছে দীর্ঘশ্বাস হয়ে। বেশি করে বাজছে অপূর্ণতার কষ্ট। নিজের ইচ্ছার অপূর্ণতা। বাবাকে তৃপ্তির পূর্ণতা দিতে না পারার কষ্ট।

রঙ-বেরঙের সুতায় জড়ানো মানুষের জীবন। কোনোটা ছেড়ে কোনোটা গুটিয়ে নিয়ে চলে জীবন। তবে জীবনের সব সুতার লাগাম মানুষের হাতে থাকে না। এলোমেলো বাতাসে ছিন্ন ঘুড়ি দিগভ্রান্ত বাতাসে অসীম আকাশে কোথায় হারিয়ে যায়! সুতাবিহীন নাটাই কেবল পড়ে রয় হাতের মুঠোয়। তিমু নিঃশেষে নাটাইয়ের সুতা ছেড়ে গেছে। হাত ঘুরিয়ে সে সুতায় নাটাই পূর্ণ করার সুযোগ হারিয়ে ফেলেছে চিরকালের মতো।

সেবারে পৈতৃক সব জমি পায়ে মাড়াতে পারেনি তিমু। সাধ অপূর্ণ রেখেই ফিরতে হয়েছে বাবার কর্মস্থলে। সময়ের বৈরিতা সে সুযোগ আর তাকে দেয়নি। তিমুর হাতে থাকা সবটুকু সুতা নিয়ে, শূন্য নাটাই হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাবা তার দূর আকাশে মিশে গেলেন।

তিমুর চাকরির যোগদান তথ্যে পৈতৃক জমির কলামও ছিল। পরিবার বললে, ‘লিখে দে ৫/৬ বিঘা।’ অথচ এরা প্রত্যেকে শিক্ষিত। অশিক্ষিত নন কেউ। হয় পাঁচ নয় ছয় লিখতে হবে, এটা জানে না ভাবার কারণ নেই। তবু বলা হলো, ‘লিখে দে ৫/৬ বিঘা।’ বটবৃক্ষ যৌক্তিক কারণেই মান্যতা পায়।

বারবার জলভারে আনত চোখ দু’খানির সামনে এসে দাঁড়াচ্ছেন, সব জমি দেখতে চাওয়ায় আনন্দিত, তৃপ্তিময় উজ্জ্বল মুখখানি নিয়ে বাবা। বেদনাভারে নুইয়ে যেতে যেতে আকাশ পানে তাকিয়ে বিড়বিড় করে যাচ্ছে তিমু- ‘দেখ বাবা, আমার কেনা জমিতে পা রেখে দাঁড়িয়ে আছি। একদিন আমার সন্তান এখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। আমি পূর্ণ বাবা। তোমাকেও পূর্ণতা দিলাম। বাবা আমি হারিনি। তোমাকে, আমার সন্তানকেও হারতে দেব না। চোখ খোল বাবা, দেখ, দেখ আমার স্বোপার্জিত ঠিকানা।

ছবি

ধ্রুপদী বোধ ও ব্যাধির কবিতা

ছবি

সুকান্তর কবিতায় বিপ্লবী চেতনা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

মগ্নচৈতন্যে সৌন্দর্যধ্যান

ছবি

অধুনাবাদী নিরীক্ষার অগ্রসাধক

ছবি

‘বায়ান্নর আধুনিকতা ও প্রগতিশীল ধারাকে বহন করতে চেয়েছি’

ছবি

জাতীয় চেতনার অমলিন ধারক

ছবি

নক্ষত্রের অনন্ত যাত্রা

ছবি

আহমদ রফিক ও ভাষামুক্তি সাধনা

ছবি

কবি আসাদ চৌধুরী : ঘরে ফেরা হলো না তাঁর

ছবি

জীবনবোধের অনবদ্য চিত্ররূপ ‘স্বপ্নছোঁয়ার পদযাত্রা’

ছবি

অনালোকিত ইতিহাসের সন্ধানে

ছবি

কবিরের দোঁহা

ছবি

আকবর হোসেন ও ‘যৌবনটাই জীবন নয়’

ছবি

সংগ্রামের অগ্নিশিখা থেকে হেলাল হাফিজ

ছবি

কোনো এক শরৎসন্ধ্যা : কোথায় পাব তারে

শারদ পদাবলি

ছবি

লক্ষীপুর-হ

ছবি

যে জীবন ফড়িংয়ের

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বিশাল ডানাওলা এক থুত্থুরে বুড়ো মানুষ

ছবি

খুদে গল্পের যাদুকর ওসামা অ্যালোমার

ছবি

নিমগ্ন লালন সাধক ফরিদা পারভীন

ছবি

কেন তিনি লালনকন্যা

ছবি

টি এস এলিয়টের সংস্কৃতি চিন্তার অভিমুখ

ছবি

আধুনিক বাংলা কবিতার একশ’ বছর

ছবি

বিশ্বসাহিত্যে এর প্রতিফলন

ছবি

মোজগান ফারামানেশ-এর কবিতা

ছবি

চোখ

ছবি

যোগফল শূন্য

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লাল লুঙ্গি

ছবি

শ্বেতা শতাব্দী এষের কবিতা

ছবি

বিপন্ন মানুষের মনোবাস্তবতার স্বরূপ

ছবি

দিনু বিল্লাহ: জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে

জেলার সিরিজ কবিতা

tab

স্বোপার্জিত

সবিতা শর্মা

শিল্পী : হাশেম খান

বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫

আপন ঠিকানায় ফেরার একটা উদগ্র আকাক্সক্ষা থাকে মানুষের। স্বামী বিনায়ককে দেখে কান্তা তা বুঝতে পেরেছে। কান্তার কথা ভিন্ন। মেয়েদের তো ঠিকানা হয় না! জীবন কাটিয়ে দেয় তারা প্রযতেœ। কান্তাও ঠিকানাবিহীন। তবে স্বভাবজাতভাবে কান্তা ভাদ্র মাসের বাস্তু ব্যাঙের মতো। এক বাস্তুর কোনায় মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। হোক তা ভাড়াটে বাস্তু। বিনায়- চাকরিসূত্রে কান্তাকে জীবনের অনেকটা সময় ভাড়া বাড়িতে কাটাতে হয়েছে। ঘন ঘন বাসা বদল তার চূড়ান্ত অপছন্দ।

বিনায়ক অবসরের দ্বারপ্রান্তে। নানা পরিকল্পনা চলে স্বামী-স্ত্রীতে। এরপর কোথায়?

বিনায়কদের অনেক জমিজমা। খালি ভিটেও আছে দু’তিনটে।

চারিদিকে মহীরুহতুল্য রেইনট্রি, মেহগনিবেষ্টিত একটা ভিটে বড় মেয়েকে দেখিয়ে বলেছিল, ‘দেখিস, অবসরের টাকায় এখানে আমাদের বসত গড়ে তুলবো।’

আনন্দিত তিমু একটু অবাক হয়ে বলল, ‘বর্ষায় তো চারপাশ তলিয়ে যাবে। বাড়ি থেকে বের হবে কী করে?’

বিনায়করা নিম্নাঞ্চলের লোক। বর্ষায় থৈ থৈ কাকচক্ষু জল। সে জলে কত যে মাছেরা জলকেলিতে মেতে থাকে! আছে হরেক রকম বাহারি নামের জাল। সেসব জাল নিয়ে ছেলে-যুবা-বুডো ধরতে গেলে জলেই দিন কাটায়।

ফসলি জমিও টইটুম্বুর। কিছু ক্ষেতের ধান গাছেরা বাড়ন্ত জলের সাথে দিব্যি প্রতিযোগিতায় নামে। নাক উঁচিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে প্রাণান্ত হয়। উৎসব লাগে শাপলা বনে। মাঠকে মাঠ পেলব জোছনায় রাতভর খলবল হাসিতে বাতাসের গায়ে ঢলে পড়ে শাপলারা।

এত যে জল বর্ষায়, বাড়ি উঠান চৌকাঠ ছুঁয়ে বেড়ায়, শুকনো মরশুমে সে জল টুকরো-টাকরা খানাখন্দ পুকুর কিংবা খালের তলায় মুখ লুকায়। নানা ঋতুতে জলের ভাগাভাগি হলেও গাঁয়ে কিন্তু রোদ-ছায়ার কোনো ভাগাভাগি নেই। অঢেল, অফুরন্ত। কত যে বৃক্ষ, তার মিষ্টি ছায়া। গাছের ডালে পাখি অফুরান। ভিন্ন নাম ভিন্ন তাদের বুলি। ভিন্ন রং ভিন্ন তাদের চেহারা। গ্রামময় নেচে বেড়ায় মনখুশিতে।

মহা উর্বর মাটি। মানুষগুলো জড়িয়ে থাকে জল আর মাটির সাথে। মাটির বু- ভাষা তারা পড়ে নেয় অনায়াসে। মাটিও তাই যুগ যুগ ধরে ফসলের ভারে আনত রয়।

বড় গ্রাম। ঘর-ভদ্রাসনের ফাঁকে গজানো নানাবিধ ফসলের গন্ধ, বাতাসের উঠতি পড়তি ঢেউ, রুপালি জলের বাহার গ্রামখানিকে সৌন্দর্যের চাদরে মুড়ে দিয়েছে।

দীর্ঘ দুপুরে রৌদ্র-ছায়ার বিছানা পেতে বাড়িগুলো নিঝুম ঘুমিয়ে পড়ে। শান্ত নিরুদ্বেগ অপরূপ গাঁ।

হাসতে হাসতে বাবা মেয়েকে বলে, ‘ওখানেই তো মজা।’ ভরা বর্ষায় সাঁকো গমনাগমনের আরেক নাম। দোল খেতে খেতে ভবসিন্ধু পাড়ি দেয়। অনভ্যস্তদের কাছে মরণ ফাঁদ।

‘ঐ দেখ কত্তগুলো তাল গাছ!’ অনতি দূরের তালগাছ ও জমি বিনায়কদের পৈতৃক। পির পির তাল রং ধরলে ধুপধাপ ঝরে। এদের তাল খাবার পদ্ধতিটি বেশ অভিনব। ত্রিকোণ বাঁশের কাঠিতে ঘষে আঁশসমেত রস জ্বাল দেয়। ঘন হলে পাতে দেয়। না গুড় না চিনি। খানিক দুধ ঢেলে দেয় পাতে। এবার খাও তাল!

এ অঞ্চলের মানুষের মুখে বেশ মিষ্টতা। মিষ্টতা কেবল খাবার বেলা। সে জন্যে পিঠা পায়েশ চাটনি এরা খুব সামান্য মিষ্টিতে খায়। ‘মথুরা, মথুরা’ -বলে ওঠে কান্তা।

মেয়ে হোঁচট খায়। ‘মথুরা মথুরা কী মা’?

‘সে ভিন্ন কাহিনী’।

‘বলো না!’

‘অন্যদিন শুনবি। আজ থাক।’

এই যে সতেজ লকলকে কলাই শাক ফলে আছে, এটাও আমাদের জমি। ‘ডাগর চোখ আরো বড় করে তিমু বলল, ‘তোমাদের এত জমি?’

‘এত কোথায় দেখলি? জানিস, আমাদের ঠাকুরদার ঠাকুরদা মাঝারি জমিদার ছিলেন। পুরুষানুক্রমে ভাগ হয়ে কত কমে গেছে।’

‘তুমি এটাকে কম বলছো?’ আনন্দোচ্ছল তিমু ঝলমলিয়ে উঠলো।

‘পা চালিয়ে চল। রোদ চড়ে যাচ্ছে। সব জমি দেখবি তো।’ দৌড়ে বাবার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘বাবা, আমাদের সব জমিতে আমি কিন্তু পা রাখবো। দূর থেকে দেখালে চলবে না।’

চাকরি সূত্রে বিনায়- ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়ি থাকা হয় না। ওদের জন্ম, বেড়ে-উঠা, পড়াশোনা অন্যত্র চলছে। এই নিয়ে বিনায়- মনে সূক্ষ্ম অথচ তীব্র অনুশোচনা মিশ্রিত বেদনা আছে।

এখন মেয়ের কথায় সে বিহ্বল হয়ে পড়ে। বিনায়ক ভেবেছিল, ওরা বাড়ি এলে হয়তো নিজেদের অতিথি মনে করে। তাহলে শিকড়বিহীন নয় এরা! নিজেদের উন্মূলিত ভাবে না! প্রশান্তিতে ছেঁয়ে যায় মন। বুক থেকে নামে পাষাণ ভার। এর চে’ সুখের বিষয় আর কী আছে জীবনে। মনুষ্যত্বের পূর্ণতা ও প্রতিষ্ঠার চাবিকাঠি পারিবারিক বন্ধন নামক শমীবৃক্ষের শিকড় হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত ।

সুখের পায়রা বাকুম বাকুম কলকণ্ঠে বলে, ‘তাই হবে। চল।’

নানান জায়গায় ছড়ানো সকল জমির অবস্থান বিনায়কও ভালো জানে না। এত বড় আহ্লাদের কথা তিমু বলেছে। সব জমিতে পা রাখবে। নিজের অজ্ঞতা কিছুতেই প্রকাশ করবে না। বরং বাড়ি পৌঁছে দাগ নম্বর নিয়ে বসে জেনে নেবে।

‘একদিনে সব জমি দেখে শেষ করা যাবে না।’ বিভিন্ন মাঠে জমি তাদের। সাব্যস্ত হলো, ‘যে ক’দিন আমরা আছি সকালে জলমুড়ি খেয়ে বের হবো। তাতে একেক দিন একেক মাঠের জমি তোর পায়ের স্পর্শ পাবে। হবে?’ জানতে চায় বিনায়ক।

‘খুব হবে। সব জমি দেখা না হলে ফিরছি না বলে দিলাম।’ সরু আলপথে সামনে পিছনে পিতা-পুত্রী পা চালিয়ে যাচ্ছে। আগে চলে দ-পতি পিছে চলে ছা।

সূর্য মধ্য আকাশ পানে ধাবমান। রোদের ঝাঁজ কুটকুট গায়ে বিঁধছে।

মাথার উপর দিয়ে সাঁই সাঁই উড়ে চলা এক ঝাঁক পাখির দিকে চোখ যায় তিমুর। তাদের চলন্ত ডানায় সোনালি রোদের ঝিলিক। মুগ্ধ তিমু।

পাখিরা ভারি সুখি আর স্বাধীন। যথা ইচ্ছা তথা যা। কিচির মিচির তান শুনে তিমুর মনে হলো যেন ওরা গলা সাধতে লেগেছে। নয়তো, কতটা আকাশ পথ পাড়ি দিল, সারাদিনে আর কতটা দেবে, তারই পরিমাপে ব্যস্ত।

প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকুরে তিমু স্বোপার্জিত টাকায় কেনা এক টুকরো ভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে। আজই রেজিস্ট্রি হলো। বিশাল পৃথিবীর একান্ত নিজস্ব এক ফোঁটা ভূমিতে পা রাখতে পেরে আনন্দে উদ্বেলিত হবার কথা। উল্টো দু’চোখ ভেসে যাচ্ছে তিমুর। বু- তলায় দলা দলা নীলাভ কষ্ট দুমড়েমুচড়ে ভেঙে পড়ছে দীর্ঘশ্বাস হয়ে। বেশি করে বাজছে অপূর্ণতার কষ্ট। নিজের ইচ্ছার অপূর্ণতা। বাবাকে তৃপ্তির পূর্ণতা দিতে না পারার কষ্ট।

রঙ-বেরঙের সুতায় জড়ানো মানুষের জীবন। কোনোটা ছেড়ে কোনোটা গুটিয়ে নিয়ে চলে জীবন। তবে জীবনের সব সুতার লাগাম মানুষের হাতে থাকে না। এলোমেলো বাতাসে ছিন্ন ঘুড়ি দিগভ্রান্ত বাতাসে অসীম আকাশে কোথায় হারিয়ে যায়! সুতাবিহীন নাটাই কেবল পড়ে রয় হাতের মুঠোয়। তিমু নিঃশেষে নাটাইয়ের সুতা ছেড়ে গেছে। হাত ঘুরিয়ে সে সুতায় নাটাই পূর্ণ করার সুযোগ হারিয়ে ফেলেছে চিরকালের মতো।

সেবারে পৈতৃক সব জমি পায়ে মাড়াতে পারেনি তিমু। সাধ অপূর্ণ রেখেই ফিরতে হয়েছে বাবার কর্মস্থলে। সময়ের বৈরিতা সে সুযোগ আর তাকে দেয়নি। তিমুর হাতে থাকা সবটুকু সুতা নিয়ে, শূন্য নাটাই হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাবা তার দূর আকাশে মিশে গেলেন।

তিমুর চাকরির যোগদান তথ্যে পৈতৃক জমির কলামও ছিল। পরিবার বললে, ‘লিখে দে ৫/৬ বিঘা।’ অথচ এরা প্রত্যেকে শিক্ষিত। অশিক্ষিত নন কেউ। হয় পাঁচ নয় ছয় লিখতে হবে, এটা জানে না ভাবার কারণ নেই। তবু বলা হলো, ‘লিখে দে ৫/৬ বিঘা।’ বটবৃক্ষ যৌক্তিক কারণেই মান্যতা পায়।

বারবার জলভারে আনত চোখ দু’খানির সামনে এসে দাঁড়াচ্ছেন, সব জমি দেখতে চাওয়ায় আনন্দিত, তৃপ্তিময় উজ্জ্বল মুখখানি নিয়ে বাবা। বেদনাভারে নুইয়ে যেতে যেতে আকাশ পানে তাকিয়ে বিড়বিড় করে যাচ্ছে তিমু- ‘দেখ বাবা, আমার কেনা জমিতে পা রেখে দাঁড়িয়ে আছি। একদিন আমার সন্তান এখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। আমি পূর্ণ বাবা। তোমাকেও পূর্ণতা দিলাম। বাবা আমি হারিনি। তোমাকে, আমার সন্তানকেও হারতে দেব না। চোখ খোল বাবা, দেখ, দেখ আমার স্বোপার্জিত ঠিকানা।

back to top